চিহ্ন – শ্রীধর সেনাপতি
খুন করা হয়েছে নির্মলা সরকারকে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, খুনী কে?
এক্ষেত্রে গুপ্তঘাতকের পরিচয়ের মধ্যে একটু রহস্য ছিল। তার কাজের দ্বারা বস্তুত এটা স্বীকৃত····ঘটনার পর লুকিয়ে পালিয়ে যাওয়া একটা কন্ফেসান।
ট্রাজেডির রাত্রি থেকে নির্মলা সরকারের ভাইপো কুমুদরঞ্জন আত্মগোপন করেছে।
জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে অমন একটা অপঘাত-মৃত্যু বরণ করতে হল নির্মলা সরকারকে। জেলা-শহরে এই সরকার-পরিবার সম্ভ্রান্ত ধনীরূপে চিহ্নিত বহুদিন থেকে। বছর কয়েক আগে মারা গেছেন গৃহকর্তা। গৃহর্এীও এখন চলে গেলেন। নিঃসন্তান ছিলেন তাঁরা। শিশুবয়সে মা-বাপ-হারা ভাইপো কুমুদরঞ্জন আর ভাইঝি টুনিকে প্রায় বছর ষোল-সতের আগে নির্মলা সরকার সেই যে নিজের কাছে এনে রেখেছিলেন, সে বোঝা তাঁকে আর নামাতে হয়নি ঘাড় থেকে। অবশ্য এ ব্যাপারে গৃহকর্তারও প্রশ্রয় ছিল যথেষ্ট। নিজেদের অভাবটা ওই কুমুদ আর টুনিকে কাছে পেয়ে ভুলে থাকতে চেয়েছেন।
কুমুদরঞ্জন আর তার বোন টুনিকে তাদের সব কিছুর উত্তরাধিকারী করে রেখেছিলেন নির্মলা সরকার। সেসব আইনের কাজ করে রেখেছেন নির্মলা সরকারের নিযুক্ত করা উকিলবাবু। কাগজপত্র তাঁর হাতে রয়েছে। কাজটা অনেকদিন আগে থেকেই সেরে রাখা হয়েছিল।
নির্মলা সরকারের মৃত্যুর পরই অনেকের সামনে পড়া হল সেই উইলখানা। বিশেষ করে ভাইপো কুমুদের প্রতি পিসির স্নেহ-মমতা, ভালবাসা, বিশ্বাস যে কত গভীর ছিল, তা প্রকাশ পেয়েছে উইলের ভাষার প্রতিটি ছত্রে।
সেই কুমুদরঞ্জন এখন পলাতক।
তুলনায় ভাইঝি টুনি সম্পর্কে উইলে যেসব কথা বলা হয়েছে, খুবই মামুলি। নেহাৎ সাধারণভাবে এবং ভাষায় টুনিকে সম্পত্তির অর্ধেক দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। দায় সারার মত।
শেষদিকে নির্মলা সরকার নাকি একটু খিটখিটে মেজাজের হয়ে পড়েছিলেন। কারণে অকারণে ভাইপো ভাইঝির প্রতি হয়তো রূঢ় ব্যবহার করেছেন, কখনো কখনো হয়তো বা মাত্রা ছাড়িয়েও গিয়েছেন, সে সবই টুনি সহ্য করেছে, সামলে নিয়েছে। কিন্তু কুমুদরঞ্জন সে চরিত্রের ছেলেই নয়। পিসির ধমক-টমক প্রথম প্রথম চুপচাপ মেনে নিলেও পরে আর সে মুখ বুজে থাকেনি।
নির্মলার সমান প্রতিপক্ষ তখন কুমুদরঞ্জন।
টুনি দাদাকে বোঝাতে গিয়ে হার মেনেছে।
ইদানীং কুমুদরঞ্জনের সঙ্গে নির্মলার সম্পর্কটা এমনই খারাপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, টুনি সব সময়ে ভাবত, পিসির বাড়ি থেকে দাদার সঙ্গে তারও বিতাড়িত হবার দিন বুঝি দ্রুততালে এগিয়ে আসছে।
সম্পর্ক এমন চরম তিক্ত হয়ে ওঠার পরও, দেখা যাচ্ছে, নির্মলা সরকার তাঁর উইলের বয়ান পাল্টায়নি।
(অতঃপর পুলিশের কাছে টুনি আরো যা বলেছে 🙂
বাড়িটা দেখছেন আপনারা ইংরিজি ‘এল্’ অক্ষরের মত। দুটো উইং একটা রাইট অ্যাঙ্গল-এ এসে মিশেছে। পুরনো আমলের বাড়ি।
একটা উইং-এ থাকত আমাদের পিসিমা। সম্পূর্ণ একটা আলাদা বাড়িতে থাকার মত। অন্য অংশে ছিলাম আমরা, আমি দোতালায়, দাদা নিচে।
আমি হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছি। পাঁচ বছর আগে দাদা কলেজে ভর্তি হয়েছিল। তার পড়াশোনা কোনদিনই হয়নি। পরীক্ষার সময় এলে নানা অজুহাতে সে পরীক্ষা দিতে বসত না। অসুখ-টসুখের কথা শুনলে পিসিমা খুব ভয় পেত বরাবর। তার সেই দুর্বলতাকে নিজের উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ কাজে লাগাত আমার দাদা।
পরীক্ষার দিন থেকে, কোন কোন সময়ে.দু’একদিন আগে-পিছনেও হত, দাদা আর তার ঘর থেকে বেরিয়ে কোথাও যেত না। বিছানাতেই শুধু ওঠা-বসা। দু’পা হাঁটলেই তার মাথা ঘোরে, গা-বমি ভাব, চোখের সামনে তারাবাজি দেখে, রোগের এইরকম বিশেষ লক্ষণগুলোই শুধু প্রকাশ পায়। ভয়-ভাবনায় পিসিমা তখন অস্থির। ধমক দেয় দাদাকে, সারা বছরটা পড়াশোনায় ফাঁকি দিয়ে পরীক্ষার সময়ে দিনরাত ধরে এত পড়লে চিন্তা করলে এমনটা হবে না?
গোড়ায় গোড়ায় ডাক্তারকে খবর দিত।
ওষুধপত্র দাদা খেত না। আসলে ডাক্তারের বোঝবার মত অসুখই তার নয়।
দু-একটি বন্ধুও ছিল, যারা দাদাকে ওই অবস্থায় দেখতে এসে কাপের পর কাপ চা আর ডজন ডজন সিগারেট না উড়িয়ে আমার অসুস্থ দাদার ঘর থেকে সাধারণত বেরোত না।
আমি সবই বুঝতে পারতাম। কিন্তু সত্যি কথাটা পিসিমাকে বলিনি কোনদিন।
কিন্তু দাদাকে আমি আড়ালে অনেকবার বোঝাবার চেষ্টা করেছি। সফল হইনি। বরং সময়ে সময়ে উল্টো ফল হয়েছে।
যেমন, দাদার কোন অপকীর্তি হয়তো পিসিমার হিতাকাঙক্ষী কেউ পিসিমাকে জানিয়ে গেল, দাদার কাছ থেকে ধাক্কাটা এল আমার দিকে। তার মনে সন্দেহ, আমি ছাড়া পিসিমার তেমন হিতাকাঙক্ষী নাকি আর কেউ নেই। বাইরে কোথাও কোন গর্হিত কাজ করে বসার সম্ভাবনা থাকলে দাদা সেকথা নিজেই আমাকে শুনিয়ে বলে যেত, পিসিমার কানে গিয়ে কথাটা পৌঁছলে আমি বুঝব কিন্তু মেসেঞ্জার টুনুরানী স্বয়ং।
তা এসব সত্ত্বেও পিসিমাকে দাদার প্রতি তেমন বিরূপ হতে আমি দেখিনি। টাকাকড়ি যখন যেমন চেয়েছে, পিসিমা প্রায় মুখ বুজে তুলে দিয়েছে তার হাতে।
মাঝে মাঝে অবশ্য বলত, এখন আর তুমি ছেলেমানুষটি নও। বুঝতে শিখছ। বেহিসেবীর মত আর খরচ কোরো না।
দাদা বলত, ওসব কথা ভেবে তুমি মাথা-খারাপ কোরো না, পিসিমা।
পিসিমা বলত, উড়িয়ে-পুড়িয়ে না দিলে শেষ পর্যন্ত তো সব কিছু তোদেরই থাকবে।
কিন্তু ক্রমশ দাদার হালচাল দেখেশুনে আমারই মনে ভয় জাগত, পিসিমা বরাবরের জন্যে দু’চোখ বোজবার আগেই হয়তো বুঝে যাবে, তার আশ্রিত বাউণ্ডুলে ভাইপোর হাতে বিষয়সম্পত্তি বেশিদিন টিকবে না।
পিসিমা একদিন তাকে বলল, তোর দ্বারা আর লেখাপড়া হবে না, বুঝতে পারছি। চাকরি-বাকরির সন্ধান কর।
সন্ধান কর বললেই তো আর সঙ্গে সঙ্গে চাকরির সন্ধান মিলছে না।
দাদা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে চুটিয়ে আড্ডা মারে। পিসিমাকে নানারকম কথা বুঝিয়ে আগের মতই টাকা-পয়সা আদায় করতে থাকে।
টাকা দিতে আপত্তি করলে দাদা বলে, তোমার কাছ থেকে আমি এ টাকা এখন ধার নিচ্ছি, পিসি। তুমি তো জানো, ভবিষ্যতে এসব আমারই হবে। তখন অভাব হবে না, শোধ করে দেব।
এইভাবে চলতে চলতে একদিন—
টুনির মুখখানা হঠাৎ লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছিল এসময়ে। নতমুখ করে চোখের দৃষ্টি পায়ের দিকে নামিয়ে নিয়েছিল। শাড়ির আঁচল বার কয়েক জড়িয়ে ছিল হাতের আঙুলে ;
একদিন পাড়ার একটি মেয়েকে দেখলাম পিসিমার ঘর থেকে বেরোতে। তার সঙ্গে অল্পস্বল্প পরিচয় আমাদের ছিল। পোস্টঅফিসের কাছে থাকে।
মেয়েটি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে আমাকে কানে কানে বলে গেল—
(এ সময়ে টুনিকে আবার হাতের আঙুলে শাড়ির আঁচল জড়াতে জড়াতে ঘরের মেঝের ওপরে পা ঘষতে দেখা গিয়েছিল। লজ্জানরম মুখে শিশিরবিন্দুর মত ঘামের চিহ্ন। আস্তে গলা ঝেড়ে নিয়েছিল।)
পোস্টমাস্টারের মেয়ে সুমনার সঙ্গে দাদার আলাপের কথা আমরা জানতাম। তাদের দুজনের মেলামেশা নিয়ে একসময়ে পাড়ায় কিছুটা হৈ-চৈ হয়েছিল। ওই পর্যন্তই! এতদিন আর কোনরকম গোলমালের কথা শোনা যায়নি।
তারপর আমাদের বাড়িতে মেয়েটির এই হঠাৎ আগমন, আর একটা সাঙ্ঘাতিক নোংরা খবর সরবরাহ করে যাওয়া!
সুমনাকে নিয়ে দাদা নাকি কলকাতা গিয়েছিল। কোন একটা নার্সিংহোমে সুমনাকে দেখিয়ে এনেছে। কলকাতা থেকে সারাপথ সুমনার মুখে যেন কালি মাখানো ছিল। মাঝে মাঝে রুমাল দিয়ে নাকি চোখও মুছেছে। পোস্টমাস্টারের একভাই সাক্ষী, মিথ্যে বলে উড়িয়ে দেওয়া কি এত সহজ?
মেয়েটি এক চোখ মট্কে আমাকে শুধোল, কিছু বুঝতে পারলে?
সেদিনই পিসিমার সঙ্গে প্রবল বাক্বিতণ্ডা হতে দেখলাম দাদার। আমি এখন অস্বীকার করছি না, সেদিন দাদাকে গোপনে অনুসরণ করে আমি পিসিমার ঘর পর্যন্ত গিয়েছিলাম।
পিসিমার ঘরের বাইরে বারান্দায় আমি জানলার পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সেদিনকার বাকযুদ্ধ দেখেছি।
দাদার সবরকম অত্যাচার পিসিমা মেনে নিত। কখনও হাসিমুখে, কখনো বা রাগ দেখিয়ে।
এদিনে কিন্তু দেখলাম পিসিমার আর এক মূর্তি। মাঝে মাঝে দাদাকে ধমকাচ্ছে। আবার আঁচল দিয়ে নিজের চোখ মুছছে ঘনঘন। ঘরময় ছুটে বেড়াচ্ছে পিসিমা আর তার পেছনে পেছনে আমার দাদা।
শেষে একসময়ে পিসিমা টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। একটা সাদা কাগজ টেনে নিল। টেবিলের ড্রয়ার খুলে যে জিনিসটা তারপর বের করল, আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলেও সেটাকে জিভে ঠেকিয়ে সাদা কাগজখানার ওপরে সেঁটে দিতে বুঝলাম, একটা রেভিনিউ স্ট্যাম্প।
কাগজখানা দাদার সামনে এগিয়ে দিয়ে পিসিমা বলল, আমি যা যা বলছি, নিজ-হাতে এই কাগজে লেখ। শেষে স্ট্যাম্পের ওপরে নিজের নাম সই করবি।
পিসিমা বলে চলল, আমার দাদা তা লিখে গেল সেই কাগজের ওপরে।
সেসব কথা ঠিক পর পর লাইন ধরে বলতে পারব না, কারণ সব কথা স্পষ্টভাবে আমার কানে আসেনি, আর তেমন একটা উত্তেজনার মুহূর্তে সব কথা মনে গেঁথে রাখতেও পারিনি আমি। তবে ব্যাপারটা যা ঘটল, মোটামুটি বলছি।
ওই রকম একটা কাগজকে পিসিমা হ্যান্ডনোট বলল।
সব কিছু লেখা হয়ে যাওয়ার পর পিসিমা দাদাকে বলল, এখন থেকে যত টাকা তুই আমার কাছ থেকে নিবি, সব এই হ্যান্ডনোটে লেখা থাকবে। সেসব টাকা পাওনা হবে টুনির। অবশ্য যদি আমাকে সময়ে সব টাকা ফেরৎ দিতে পারিস, তাহলে সে টাকার ভাগ তুইও পাবি। বড় হয়েছিস, চাকরি-বাকরি জোগাড় করে নে চেষ্টা-চরিত্র করে। এভাবে চিরকাল কারো চলে না।
প্রয়োজনমত টাকা দাদা অবশ্যই পেয়েছিল বলে আমার ধারণা।
পিসিমা এ সম্পর্কে নিজে থেকে যেমন আমাকে কোন কথা বলেনি কোনদিন, তেমনি দাদাও মুখে কুলুপ এঁটে থেকেছে আমার কাছে। আমি আড়ি পেতে তাদের কথা মাঝে মাঝে শুনতাম। এতে যদি কোন অপরাধ হয়ে থাকে, আমি তা স্বীকার করছি। আমার কৌতূহল আমাকে এই গর্হিত কাজে টেনে নামিয়েছিল।
তারপর একদিন, সন্ধ্যার পরের ঘটনা।
পিসিমার সঙ্গে দাদার সেদিন তুমুল ঝগড়া। পিসিমা যা-তা কথা বলতে লাগল দাদাকে। মাঝে মাঝে এমন সব খারাপ গালাগাল পর্যন্ত দিল যে, আমি বারান্দায় আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও, লজ্জায় কান-মুখআমার গরম হয়ে উঠছিল।
ঝগড়ার আসল কথাটা আমার শোনা হয়নি। তাই কী নিয়ে সূত্রপাত হয়েছিল, আমার জানা নেই। পিসিমার ঘরের দিকে হৈ-হল্লা শুনে আমি দৌড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তখন আসল কথা থেকে তারা দুজনেই সরে দাঁড়িয়েছে।
পিসিমার মুখ থেকে তখন দুঃখ হতাশা ক্রোধের বাক্য অনর্গল বেরোচ্ছে স্রোতের মত। ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের মাথার চুল মুঠো করে ধরে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চায় যেন সে।
পিসিমা দাদাকে বলল, ‘তুই জন্তুরও অধম। তোর ও মুখ আমি আর দেখতে চাই না। এই ক’দিন ধরে যত টাকা-পয়সা আমার কাছ থেকে নিয়েছিস, আজ-কালের মধ্যে শোধ করে দিতে না পারলে আমি তোকে জেল খাটাব।’
ভয়ে আমি পালিয়ে এলাম সেখান থেকে। আমার মাথা ঘুরছিল। মনে হচ্ছিল, সিঁড়ির ওপরেই হয়তো অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব।
দাদার ওপরে আমারও ভীষণ রাগ হয়েছিল প্রথমে। এত গালাগালি এত অপমান সহ্য করেও সে এখনও পিসিমার আশ্রয়কে আঁকড়ে পড়ে থাকছে কেন? লজ্জা ঘৃণা কি তার নেই?
কিন্তু দাদা যখন ছুটে এসে আমার কাছে দাঁড়াল, তার মুখ দেখে মায়া হল আমার।
ভাঙা ভাঙা গলায় সে আমার হাতদুটো ধরে বলল, টুনি, তুই বিশ্বাস কর, দোষ যা করার আমি করে ফেলেছি। এখন আমি নিরুপায়। সুমনার কাছে আমি আর তাহলে মুখ দেখাতে পারব না। তুই আমাকে কিছু টাকা দে। আমি পিসিমার ঋণটা শোধ করে দিই। তারপর তার সঙ্গে আমার বরাবরের জন্যে একটা বোঝাপড়া হয়ে যাবে।
আমার হাতে কিছু টাকা জমেছিল। আমি দাদাকে টাকা দিলাম।
দাদা টাকা নিয়ে পিসিমার সঙ্গে দেখা করতে গেল। এবার আর আমি তার পিছু নিলাম না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজের সাইকেলটা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল আমার দাদা।
অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেও দাদা বাড়ি ফিরে এল না দেখে ভয়ে ভাবনায় বিছানায় শুয়ে-বসে সময় কাটাতে লাগলাম।
এইভাবে রাত শেষ। খুব সকালে উঠে আমি পিসিমাকে দেখতে গেলাম। দাদা যে রাত্রে বাড়ি ফিরে আসেনি, এ খবরটা কে জানানোর জন্যেও মনে মনে ছটফট করছিলাম আমি।
পিসিমার শোবার ঘরের দরজা খোলা দেখে একটু অবাক হলাম। আজ কি তাহলে পিসিমাও ঘুম থেকে সকাল সকাল উঠেছে? আমার মত রাতভোর হয়তো দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি!
একটু ভয়ও পেলাম মনে মনে। আমার ওপরেও কি পিসিমা রাগ করে থাকতে পারে?
ভয়ে ভয়েই ডাকলাম, ‘পিসিমা!’
কোন সাড়া নেই। ফের চেঁচিয়ে ডাকলাম।
সাড়া না পেয়ে পা পা করে ঢুকে পড়লাম ঘরের ভেতরে। জানলাগুলো বন্ধ থাকার জন্যে ঘরের ভেতরে আলো কম।
একটা জানলা আমি খুলে দিলাম। আর তারপরই ঘরের দৃশ্য দেখে সভয়ে আঁৎকে উঠলাম আমি।
(টুনির মুখ থেকে সব রক্ত যেন মুহূর্তের জন্যে সরে গিয়েছিল। বুকের ওপরে হাত রেখে বিস্ফারিত চোখে চুপ করে তাকিয়ে ছিল কয়েক লহমা।)
দেখলাম, সামনের টেবিলের ওপরে মাথা রেখে শুয়ে রয়েছে পিসিমা। বুকের আঁচল পায়ের কাছে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছে। আর পিঠের বাঁ দিকে জামাটা তার রক্তে ভেজা। টেবিলের ওপরে যে শুধু একটা রক্তমাখা ছুরি পড়ে রয়েছে, তা নয়, অনেক কাগজপত্রেরও ছড়াছড়ি। কেউ একজন সেসব ঘাঁটাঘাঁটি করলে যেমন দেখতে হয়।
ঘরের ওই জানলাটিকে খুলে দেওয়া ছাড়া, আমি ওখানকার আর কিছুতে হাত দিইনি। পুলিশ আসার আগে যে কোন জিনিস নাড়াচাড়া করতে নেই, জানতাম।
আমার পিসিমা যে আর বেঁচে নেই, সেই মর্মান্তিক দৃশ্যটা আমাকে যেন তখনই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল।
ওই রকম একটা ভয়ঙ্কর উপায়েই তাহলে শেষ পর্যন্ত কুমুদরঞ্জন তার পিসিমা নির্মলা সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া করে গা-ঢাকা দিল? কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেছিল সে তার হ্যান্ডনোটটিকে হস্তগত করার জন্যে। আপাতদৃষ্টিতে অন্তত তাই মনে হয়। নির্মলা সরকারের ঘর অনুসন্ধান করে যখন সেই হ্যান্ডনোটটি পুলিশ উদ্ধার করতে পারেনি, তখন এমনও অনুমান করে নিতে অসুবিধা হয় না যে, সেটি কুমুদরঞ্জন নিয়ে পালিয়েছে।
টুনির বিবৃতির মধ্যে কোনরকম অসঙ্গতি তদন্তকারী পুলিশ অফিসার খুঁজে পান না।
তাঁর এখন মাথা-ব্যথার প্রধান কারণ কুমুদরঞ্জন। পলাতক সন্দেহভাজন ব্যক্তিটিকে অবিলম্বে খুঁজে বের করতে হবে।
পরামর্শ করার জন্যে অফিসার ব্যক্তিগতভাবে শঙ্কর চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে থানায় ডেকে এনেছেন।
সলাপরামর্শ চলছিল, এমন সময়ে থানায় এসে হাজির হল এক তরুণী। কুড়ি-একুশ বছর বয়স হবে। ফর্সা রোগা চেহারা। কোঁকড়ানো রুক্ষ চুল মাথায়। লম্বাটে মুখের গড়ন, তাই বেশ একটা যেন বাড়তি সৌন্দর্য পেয়েছে।
কী ব্যাপার?
প্রবেশপথে এসে দাঁড়িয়েছে সে। সেখান থেকে অফিসারদের মুখের দিকে ভয় পাওয়া চোখে তাকিয়ে রয়েছে।
মেয়েটিকে ঘরের ভেতরে আসতে বলা হল।
জড়িত পায়ে এসে দাঁড়াল সে শঙ্কর চৌধুরীর সামনে।
পুলিশ অফিসার একটা খালি চেয়ার দেখিয়ে বললেন, ‘বসুন।’
এবার কথা বলল তরুণী, গলার স্বরে কিছুটা আবেগ মেশানো, আপনাদের কাছে আমার কিছু বলার আছে।’
অফিসার বললেন, ‘বেশ তো, বলুন।’
পুলিশ অফিসার এবং শঙ্কর চৌধুরীর মুখের ওপর দিয়ে তরুণীর চঞ্চল দৃষ্টি একবার ঘুরে এল। বলল, ‘এ কাজ আমি করেছি।’
তিনটে সাধারণ কথা নয়, যেন কান্নার শব্দ বেরিয়ে এল তার থরথর করে কেঁপে ওঠা পাতলা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে। অথচ একটা নির্লিপ্ততা মুখোসের মত মুখে এঁটে রাখার চেষ্টা রয়েছে তার।
স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ সবাই তরুণীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর শঙ্কর চৌধুরী উঠে দাঁড়ায়।
তরুণীর কাছে গিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে সহানুভূতি জড়ানো স্বরে বলে,’এমন একটা সাঙ্ঘাতিক অপরাধ করতে হয়েছে আপনাকে, তার বিশেষ একটা কারণ নিশ্চয়ই আছে? এবং সেটা বলবার জন্যেই তো আপনি এখানে এসেছেন?’
এমন সময়ে জনৈক পুলিশ কর্মচারী সে-ঘরে একটা ফাইল দিতে এসে তরুণীকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। একজন সহকর্মীকে অনুচ্চ গলায় বললেন, ‘মেয়েটিকে আমি চিনি। এখানকার পোস্টমাস্টারের মেয়ে। নাম সুমনা।’
কথাটা সুমনার কানেও বুঝি গেল। সঙ্গে সঙ্গে দু’হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে উঠল সে।
আবার সকলে কিছুক্ষণ চুপচাপ। একটা চাপা কান্নার শব্দ ঘরের মধ্যে মাঝে মাঝে ইথারে ঢেউ তুলতে লাগল।
বিকেলের রোদ জানলা গলে ঘরের মেঝেয় এসে পড়েছে। বাতাসে ভেসে আসছে শহরের মিশ্রিত কোলাহল।
আবেগ একটু কমতে মুখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিল সুমনা। ভিজে চোখ দুটো মুছে নিল আঁচল দিয়ে। পরবর্তী অবস্থার মুখোমুখি হওয়ার জন্যে এখন যেন সে তৈরি। চোখে-মুখে তেমনি একটা ভাব জেগে উঠল।
গলা ঝেড়ে নিয়ে স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করে বলল, আমার নাম সুমনা চক্রবর্তী। আমার বাবা এখানকার পোস্টমাস্টার।’
শঙ্কর চৌধুরী বলল, নির্মলা সরকারকে আপনি খুন করেছেন ছুরি মেরে?’
সুমনার মধ্যে একটা ইতস্তত ভাব লক্ষ্য করা যায়।
স্বীকৃতিসূচক ঘাড় নাড়তে নাড়তে সুমনা বলে,’ কুমুদের পিসিমার সঙ্গে আমি লুকিয়ে দেখা করতে গিয়েছিলাম। প্রথমে আমাকে তিনি আমলই দিতে চাননি। অনেক মিনতি জানানোর পর আমার কথা তিনি শুনতে রাজী হলেন। আমি তাঁকে বলেছিলাম, কুমুদের কোন অপরাধ নেই। সব কিছুর জন্যে আমি একা দায়ী। কুমুদকে দয়া করে আপনি কিছু বলবেন না—হঠাৎ বারুদের মত যেন ফেটে পড়লেন মহিলা। আমাকে অতি জঘন্য ভাষায় তিনি গালাগালি দিতে শুরু করলেন। তবু আমি কুমুদের মুখ চেয়ে নিজেকে সংযত করে রাখার চেষ্টা করেছিলাম প্রথমে, কিন্তু শেষে যখন তিনি আমাকে কুৎসিতভাবে বাজারের মেয়েদের সঙ্গে তুলনা—’
সুমনার কথাগুলো ফের কান্নায় জড়িয়ে গেল।
‘তখন পর্যন্ত কুমুদ তার কাছ থেকে যত টাকা নিয়েছিল, সেসবই নাকি আমার জন্যে সে খরচ করেছে। একটা হ্যান্ডনোট দেখিয়ে তিনি আমাকে বারবার সেই কথাই বলছিলেন।—এই নিন, সেই হ্যান্ডনোটখানা।’
বলে সুমনা তার বুকের কাছে জামার ভেতরে হাত ভরে টেনে বের করে আনল একখানা কাগজ।
শঙ্কর চৌধুরী হাত পেতে সেটা গ্রহণ করল। হ্যাঁ, কুমুদরঞ্জনের সই করা হ্যান্ডনোটই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তাতে কী হল? কুমুদরঞ্জনের প্রতি সন্দেহটা কি নিরসন হয়ে যাচ্ছে সম্পূর্ণভাবে? একটা ছুরি লুকিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে সে তার পিসিমার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। সেই ছুরি দিয়ে আচমকা পিসিমাকে সে খুন করেছে, ঘরের কাগজপত্র ওলোটপালোট করে খুঁজেছে ওই হ্যান্ডনোটটাকে, তারপর সেটাকে খুঁজে পেয়ে টুনির দেওয়া টাকাগুলো নিয়ে পালিয়ে গিয়ে কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছে কুমুদরঞ্জন। সেখান থেকেই পাঠিয়ে দিয়েছে সে এই হ্যান্ডনোটখানা তার সুইটহার্টের কাছে। কিন্তু এটা কি তার নির্দোষিতার প্রমাণ হল? বরং প্রকারান্তরে এটা তার অপরাধেরই একটা প্রমাণ।
শঙ্কর চৌধুরী বলল, ‘কুমুদরঞ্জন কোথায় রয়েছে, আপনি তাহলে জানেন?’
সুমনা জবাব দেয় না।
পুলিশ ইন্সপেক্টর বলেন, ‘উনি যা জানতে চান, সেকথার জবাব দিন।’
শঙ্কর চৌধুরী বলল, ‘না, আমার ও-কথার জবাব আমি আপনার কাছ থেকে এখন চাই না।’
সুমনা এবার বিদ্রোহিনীর মত ভঙ্গি করে বলল, ‘খুনের ব্যাপারে শুধু কুমুদের কথাই আসছে কেন? আমি অপরাধ করেছি। স্বীকার করছি তা অকপটে। আপনারা আমার বিচার করুন। আমাকে ফাঁসি দিন।’
শঙ্করের চোখে কিছুটা বিস্ময়, সন্দিগ্ধ গলার স্বর, বলল, ‘আপনি ফাঁসির আসামী নন, সুমনা দেবী।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমিই অপরাধী। এ সব কিছুর জন্যে দায়ী আমি একা। আমার কথা আপনারা বুঝতে পারছেন না, এটা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? নির্মলা সরকারকে আমিই হত্যা করেছি। কুমুদ যাতে আমাকে বিয়ে না করে তার জন্যে নির্মলা সরকারের চেষ্টার অন্ত ছিল না। কুমুদ আমাকে বারবার সে কথা বলেছে। এটা আপনারা বুঝতে পারছেন না যে নির্মলা সরকারের প্রতি আমার বিদ্বেষ থাকা স্বাভাবিক? তার ওপরে আমাকে নানা অপমানকর কুৎসিত যত কথা তিনি বলেছিলেন, আমার সহ্যের সীমা তাতে ভেঙে পড়েছিল। ভালমন্দ বিচার করার ক্ষমতা আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম সাময়িকভাবে। আমাকে আপনারা ফাঁসি দিন।’
শঙ্কর চৌধুরী ফের বলল, আপনাকে আমরা ফাঁসি দিতে পারি না।’
‘আপনারা কুমুদকেও ফাঁসি দিতে পারেন না তাহলে।’
বলে, সুমনা এবার জামার ভেতর থেকে একখানা চিঠি বের করল। চিঠির একটা কোণ ছিঁড়ে ফেলল যেন কিছুটা আনমনে। তারপর টেবিলের ওপরে হ্যান্ডনোটখানার পাশে সেটাকে সে রেখে দিল। দেখা গেল, মাত্র একটি বাক্যের চিঠি সেখানা।
উপস্থিত অফিসারদের শোনানোর জন্যে চিঠিটাকে শঙ্কর হাতে নিয়ে জোর গলায় পড়তে লাগল।
‘নির্মলা সরকারকে আমার পিসিমা বলে পরিচয় দিতে লজ্জা করে, সুমনা।’
কারো কাছ থেকে কোন মন্তব্য শোনা গেল না। অফিসাররা জিজ্ঞাসু চোখে পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন।
সুমনাকে পাশের ঘরে পাঠিয়ে দিল শঙ্কর। সেখানে কিছুক্ষণ বসে অপেক্ষা করতে বলল। তারপর টুনিকে ডেকে আনা হল অফিসারদের সামনে।
চেয়ারে বসে শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিল টুনি। মুখ তুলতেই ওর চোখের সঙ্গে শঙ্কর চৌধুরীর দু’চোখের মিলন ঘটল।
শঙ্কর শুধোল, ‘কে আসল অপরাধী আপনি জানেন?’
জবাব দেবার আগে চোখের দৃষ্টি নত হল মেঝের দিকে। কয়েক মুহূর্ত পরে টুনি বলল, ‘এ কথার জবাব আপনি আমার কাছ থেকে আশা করতে পারেন না।’
‘ঠিকই তো।’ শঙ্কর চৌধুরীও তাড়াতাড়ি নিজেকে যেন সংশোধন করে নিতে চাইল, না, না। আশা করা যায় না। আমি আমার এ প্রশ্নটা উইথড্র করছি।
অতঃপর টেবিলের ওপর থেকে সে তুলে নিল হ্যান্ডনোটখানা। এবং কুমুদরঞ্জনের লেখা এক বাক্যের সেই চিঠিখানাও উঠে এল তার হাতে।
অলস ভঙ্গিতে বলল, ‘আপনার বলা সেই ট্র্যাজিক কাহিনীর পুনরাবৃত্তি করে আপনাকে আর বিরক্ত করতে চাই না। আপনার পক্ষে ঘটনাটা তো খুব বেদনাদায়কও বটে। সেটা আমরা বুঝতে পারছি। যাক সেকথা। কিন্তু সৌভাগ্যবশত আমাদের হাতে হঠাৎ এমন এক এভিডেন্স এসে গেছে, যেটা এ ব্যাপারে আপনার দেওয়া বিবৃতির দুটো ভাইট্যাল পয়েন্টস্কে সমর্থন করে। হত্যার দিন রাত্রে কুমুদরঞ্জনকে আপনি অত্যন্ত কুপিত অবস্থায় দেখেছিলেন। এবং এখানে কুমুদরঞ্জনের লেখা অতি সংক্ষিপ্ত এক চিঠি আমাদের হাতে জমা দিয়েছে একজন। সেই চিঠি সমর্থন করে কুমুদরঞ্জনের পিসিমার প্রতি অপরিসীম বিরাগের কথাটা। এ অবস্থায় যা ঘটে গেছে, কুমুদরঞ্জনের হয়তো আপনাদের পিসিমার সঙ্গে বোঝাপড়া করে নেওয়ার শেষ পরিণতি। সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
‘এবার তৃতীয় একটা পয়েন্ট। আপনি মনে করেন, মৃতার কাছ থেকে কুমুদরঞ্জন হ্যান্ডনোটটা বার করে নিয়ে গেছে।’
টুনির সামনে ঝুঁকে পড়ে শঙ্কর চৌধুরী আরো বলল, ‘আপনি বলেছেন, কুমুদরঞ্জন বলেছিল, ঋণটা শোধ করে দিই। তারপর তার সঙ্গে আমার বরাবরের জন্যে একটা বোঝাপড়া হয়ে যাবে। এখানেই আমরা ধাঁধায় পড়ছি : পিসিমাকে যদি কুমুদরঞ্জন হত্যা করার মনস্থই করে থাকে, সে আপনার কাছ থেকে টাকা নেবে কেন পিসিমার ঋণটুকু শোধ করে দেওয়ার জন্যে? তাকে হত্যা করে হ্যান্ডনোটটাকে হস্তগত করার অর্থ কী? ঋণের টাকা শোধ করে দিয়ে সহজে সেটা ফেরৎ নিয়ে নেওয়া যেত।’
কপালে গালে জমে ওঠা ঘাম টুনি ফের শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে নিল। ঢোক গিলে দুর্বল গলায় বলল, ‘হ্যান্ডনোট ফেরৎ পাবার জন্যে দাদা আমার কাছ থেকে টাকা নেয়নি। হয়তো পিসিমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্যে টাকার দরকার হয়েছিল তার।’
‘ও, আপনি তাহলে শেষ পর্যন্ত এটাই অনুমান করে নিয়েছেন? আপনার কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিজের কাছেই রেখে দেয় সে, চলে যায় আপনার পিসিমার ঘরে। তারপর ছুরি মেরে তাকে হত্যা করে হ্যান্ডনোটটার জন্যে ঘরের কাগজপত্র হাতড়ে বেড়ায়। শেষে সেটাকে হস্তগত করে নিয়ে পালায়। এটাই তো আপনার থিওরি?’
‘না, এটাকে আমার নিজের থিওরি বলছি না। এসব কথা সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে অনুমান করে নেওয়া যায়।’
‘ইয়েস, ইয়েস’, শঙ্কর চৌধুরী বলল, ‘কোয়ায়েট রাইট। এভিডেন্সের ওপরেই আমরা নির্ভর করব। মৃতদেহ রক্তাক্ত অবস্থায় টেবিলে মাথা রেখে পড়ে রয়েছে। ঘরের জিনিসপত্র সব ওলোট-পালোট করা। হত্যাকারীই ঘাঁটাঘাঁটি করেছে ভেবে নেওয়া যায়। আঙুলের ছাপ উদ্ধার করা না গেলেও, কোন কোন জিনিসে ছিটেফোঁটা রক্তের দাগ দেখা গেছে। হ্যাঁ, টুনি দেবী, এটা আমাদের কাছে প্রায় সুনিশ্চিত যে গুপ্তঘাতক লুকিয়ে পিছন থেকে নির্মলা সরকারকে হত্যা করেছে। দুজনের মধ্যে কোন রকম উত্তপ্ত কথা কাটাকাটি হয়নি। তেমন হলে আপনি অবশ্যই শুনতে পেতেন। আপনি কিছু শোনেননি। ঝগড়ার শব্দ আপনি শুনতে পেয়েছিলেন, বলুন?’
আস্তে মাথা নেড়ে টুনি জবাব দিল, না—’
‘গুড। এখানে আপনাকে আমরা সন্দেহ করতে পারছি না। আপনার পিসিমার ঘরে অস্বাভাবিক কোন ঘটনা ঘটেছে, সেটা তো আপনি সে-রাতে জানতেই পারেননি। রাতের শেষে প্রায় ভোরের সময়ে সত্যটা আপনার কাছে প্রকাশ পেয়েছে। ঘরে তখন অন্ধকার ছিল?’
‘অন্ধকার ছিল, তবে খুব গাঢ় নয়।’ টুনি বলল, ‘ঘরের কোন জানলা খোলা ছিল না। সামান্য যেটুকু আলোর আভাস ছিল, তাতে আমি বুঝতে পারি সেখানে খারাপ কিছু একটা ঘটেছে।’
‘কিন্তু স্পষ্ট কিছু আপনি দেখতে পাননি?’
‘না। সেই জন্যে আমি একটা জানলা খুলে দিয়েছিলাম। ঠিক কী ঘটেছে বোঝবার আশায় সেই ঘরে আমি আরো একটু আলো পেতে চেয়েছিলাম।’
‘কিন্তু আপনি কিছুতে হাত দেননি।’
‘ওই একটি জানলা খুলে দিয়েছিলাম।’
‘সে-ঘরের ওই একটি মাত্র জিনিসে ছাড়া আপনি তাহলে আর কিছুতেই হাত দেননি, আমরা একথা ধরে নিতে পারি?’
‘হ্যাঁ।’ একটু অস্বস্তি ভরে টুনি শঙ্কর চৌধুরীর মুখের দিক থেকে তার দৃষ্টি সরিয়ে নিল।
শঙ্কর বলল, ‘সে-ঘরের জানলাগুলোর একটু বিশেষত্ব রয়েছে, যে কেউ সেটা লক্ষ্য করতে পারে। একটা রোলারের ওপরে স্প্রিংয়ের সঙ্গে লাগানো পাল্লা। পাল্লার এক সাইড ধরে একটু ওপর দিকে ঠেলে দিলেই সেটা রোল করে উঠে যায়, আবার বন্ধ করার দরকার হলে নিচের দিকে একটু টেনে নিলেই হল। আপনি জানলাটা খুলে দিয়েছিলেন, অথাৎ জানলার পাল্লা স্প্রিংয়ের জোরে রোল করে ওপর দিকে উঠে গিয়েছিল। তাই না?’
‘হ্যাঁ।’
‘এটা আমাদের সৌভাগ্য যে, আপনি অতি সতর্ক ছিলেন। ঘরের ওই অংশটুকু ছাড়া আপনি আর কোথাও বা কিছুতে হাত ছোঁয়াননি। সেই ঘরে মাত্র দুটি মানুষ ছিল, বুঝলেন? নির্মলা সরকার এবং আপনি নিজে। এবার যা বলার, তা হল—একজন খুন করেছে, অপরজন খুন করেনি।’
শঙ্কর চৌধুরী এবার কিছুটা ঝুঁকে পড়ল টুনির দিকে। স্বর একটু নিচু পর্দায় নামিয়ে বলে চলল, ‘খুনের মোটিভ এখানে কল্পনা করে নেওয়া যায়। নির্মলা সরকারের উইল অনুসারে আপনি এবং কুমুদরঞ্জন, অবশ্য কুমুদরঞ্জনকে তিনি শেষ পর্যন্ত সম্পত্তির ভাগীদার করে রেখেছিলেন কিনা, এখনও আমাদের কাছে সেটা অজানা, উকিলের সঙ্গে আলোচনা হয়নি—তবে আমরা ধরে নিচ্ছি, নির্মলা সরকারের সম্পত্তির অংশীদার আপনারা দুজনেই। এক্ষেত্রে একজন অংশীদার আর একজন অংশীদারকে অপরাধের মধ্যে জড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করেছে বলেই আমাদের অনুমান।’
এবার টুনি বেশ ক্ষিপ্ত স্বরে বলে উঠল, ‘সব তো অনুমানের কথাই শুনছি। আমার পিসিমাকে কে খুন করেছে?’
শঙ্কর চৌধুরী হাসি মুখে বলল, ‘আসল অপরাধী কে, আপনিই তা জানেন।’
‘না, আমি জানি না।’
শঙ্কর বলল, ‘খুনীর হাত রক্তরঞ্জিত ছিল। সে-রাতে খুনের ঘরে যার হাতে রক্ত লেগেছিল, খুনী সে-ই। আপনার হাতে রক্ত লাগেনি?’
‘না।’ প্রায় গলা চিরে চিৎকার করে টুনি বলল, ‘না, না। পরিষ্কার ছিল আমার দুটো হাতই।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, পরিষ্কার ছিল। তারপর রক্ত লেগেছে—’
আক্রমণে কোণঠাসা হয়ে যাওয়ার মত অবস্থায় পড়ে টুনি এবার অসহায় বোধ করতে লাগল। শাড়ির আঁচলটা মুঠো করে চেপে ধরে সে তুলে আনল মুখের কাছে।
কথায় না বলে, মাথা নাড়তে লাগল সে বারবার—না, না, না!
শঙ্কর চৌধুরী বলল, ‘এখানেই ব্যাপারটাকে শেষ করতে দিন। আপনিই হত্যা করেছেন আপনার পিসিমাকে। তার দেহ হাতড়েছেন, কাগজপত্র ঘেঁটেছেন টাকাকড়ি পাবার আশায়। আপনার দাদাকে আপনি যে-টাকা দিয়েছিলেন, সে-টাকা আপনার দাদা নির্মলা সরকারকে দিয়ে গিয়েছিল।’
কাগজ জড়ানো একটা চৌকো জিনিস অফিস-ঘরের কোণে রাখা হয়েছিল। সেটাকে হাতে নিয়ে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ালেন একজন পুলিশ অফিসার। জিনিসটা হালকা নয়, দেখে বোঝা যায়।
শঙ্কর চৌধুরী জিনিসটাকে টেবিলের ওপরে রেখে মোড়কটা খুলে ফেলতে বলল।
কাগজের মোড়কের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল জানলার একখানা পাল্লা। এই বিশেষ পাল্লাটি টুনি হাত দিয়ে ছুঁয়েছিল। তার রক্তমাখা আঙুলের ছাপ রয়ে গেছে এই পাল্লার গায়ে। পাল্লাটি গুটিয়ে রোল করে ওপর দিকে উঠে গিয়েছিল রক্তমাখা আঙুলের ছাপ বুকে নিয়ে। টুনির সেটা অলক্ষ্যে থেকে যায়।
হ্যান্ডনোটটিকে হাতে নিয়ে শঙ্কর চৌধুরী বলল, ‘এই কাগজটির গায়ে কোথাও কোন চিহ্ন নেই রক্তের। কুমুদরঞ্জন তার পিসিমার ঋণ শোধ করে দিয়ে এই হ্যান্ডনোটটিকে ফেরৎ নেয়। সুমনা চক্রবর্তীর কাছে এটা পাঠিয়ে দিয়েছিল সে নিজেকে ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্ত করে নেওয়ার প্রমাণস্বরূপ। কিন্তু জানলার পাল্লার গায়ে পাওয়া গেছে রক্তের দাগ। এবং আঙুলের ছাপ। রক্তটা নির্মলা সরকারের আর আঙুলের ছাপটা—এখনই প্রমাণ হয়ে যাবে, সেটা আপনার ছাড়া আর কারোর নয়।’
দু’হাতে মুখ চাপা দিয়ে টুনি সামনের দিকে ঝুঁকে বসল। কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠতে লাগল তার শরীরটা।