চিলেকোঠার সেপাই – ৪৩
কাঁঠালতলায় অন্ধকার। রাস্তার ওপার মরিচ ও বেগুনের ছোটোখাটো খেত পেরিয়ে জোড়পুকুরের ওপরকার পাতলা কুয়াশা ওপারের ন্যাড়া মাঠকে ঝাপশ করে তুলেছে। একটু দূরে বৈরাগীর ভিটায় হ্যাঁজাক লণ্ঠনের সাদা আলো, কিন্তু সেই আলোর একটু ছটাও এখানে আসেন। ঐ আলো এখান থেকে দ্যাখা যাচ্ছে বলে বরং এখানকার অন্ধকার আরো জমাটবাধা। একই নিয়মে বৈরাগীর ভিটার হৈচৈ এবং বক্তৃতায় এখানকার নীবরতা আরো ঘন হয়। বৈরাগীর ভিটায় মাইকে বস্তৃতা চলছে, আনোয়ার সব শুনতে পাচ্ছে, দীর্ঘ বক্তৃতা, গলাটা খুব চেনাচেনা ভাইসব, অনেক সংগ্রাম, ত্যাগ ও তিতিক্ষার ফলে আমাদের আন্দোলন আজ সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে। বাঙলার জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙলার মানুষ আজ পশ্চিমাদের কারাগার থেকে মুক্ত করে এনেছে। এই বিজয় সম্ভব হলো কেন?-এই বিজয়ের একমাত্র কারণ হলো বাঙালির জাতীয় ঐক্য। কিন্তু ভাইসব, ঐক্যের প্রয়োন কি শেষ?-না। পশ্চিম পাকিস্তানীদের ষড়যন্ত্র আজো চলছে। এই মুহুর্তে আমরা যদি নিজেদের মধ্যে হানাহানি করি, বাঙালি হয়ে বাঙালির বাড়ি জ্বালাই, এক হত্যা করে, ওর ফসল কেটে নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করি তার সুযোগ নেবে কারা? বলুন কারা? যারা বারোশো মাইল দূর থেকে আমাদের সম্পদ শোষণের কর্মে লিপ্ত, যারা আমাদের সোনার বাঙলাকে আজ শশানে পরিণত করেছে, যারা বাইশ বৎসর ধরে বাঙলাকে তাদের বাজার ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেনা- ৷ শিক্ষিত লোকের ভরাট গলা। বোধহয় ঢাকা থেকে এসেছে, জেলার কোন নেতাও হতে পারে। মনোযোগী হলে লোকটাকে বোধহয় চেনা যায়, কিন্তু আনোয়ার বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে। চোখের সামনে অন্ধকার হঠাৎ অন্ধকারতর একটি ছায়া তৈরি হলে আনোয়ার ভয়ে চিৎকার করে, কে?
ভাইজান একলা বস্যা আছেন? নবেজউদ্দিন হাঁটু ভেঙে মাটিতে বসে পড়ে।
‘নবেজউদ্দিন? কোথেকে?
বৈরাগীর ভিটাত সভা হবা নাগছে। সভাত গেছিলাম।
সভা শেষ হয়ে গেলো?
এখনি? নবেজউদ্দিন ডানদিকে মুখ ফিরিয়ে থুথু ফেলে, সভা তামান আতই ব্যান চলে! আপনের মামুর ভাষণ চলতিছে, এইতো শোনাই যায়।
আমার মামু?
‘ছ, বগুড়া টাউন থাকা আপনের মামু আসছে তো। সাক্ষাৎ হয় নাই? মেজোমামার বস্তৃতা আনোয়ার আগে কখনো শোনেনি। তবে মেজোমামার এমনিতে কথা বলে চমৎকার। তা মেজোমামা এসেছে, আনোয়ার কোন খবরই পেলো না। নবেজউদ্দিন আরো তথ্য দেয়, ‘চন্দনদহ বাজারের সভা শ্যাষ করা এটি আসছে। আপনার চাচাও তো সাথে আসছে। তারা সোগলি যায়া গাজীগোরে পোড়া ঘরগুল্যান দেখ্যা আসলো। টাউনেত থাকা, ঢাকাত থ্যাকা কতো ছাত্র আসছে। চন্দনদহের বাজারে মস্ত বড়ো সভা হলো। তা হামি কই ভাইজান, ঐ সভা হামাগোর বৈরাগীর ভিটার এই সভার লাকান জমে নাই। আত না হলে কি সভা জমে?
‘চন্দনদহের মিটিঙে আর কে কে ছিলো?
আফসার গাজী আছিলো, তাই সব বন্দোবস্ত করা দিলো!
আফসার গাজী? আনোয়ার প্রায় বিষম খায়, আফসার গাজী না পালিয়ে গেছে ও ব্যাটা এসে জুটলো কোথেকে?
আনোয়ার ১বার উঠে দাঁড়ায়, ফের বসে, বিড়বিড় করে বলে, লোকটার সাহস একটু বেড়ে গেছে না?
কি যে কন ভাইজান।’ পিছনে মানুষ থাকলে সাহস হবো না? আপনের মামু ধরেন জেলার এতোবড়ো নেতা, আফসার গাজী তার কোলে কোলে ঘোরে, তার সাথে ঢাকার ছাত্ররা আছে, বগুড়ার কলেজের ছাত্ররা আছে। ছাত্রগোরে খিলান দিলান করায় আফসার গাজী, বাজারের মধ্যে তার গুদামঘর খালি কর্যা দিছে, চাকর দিয়া পাকশাক করায়, খরচ করতিছে দুই হাতে, এখন তার গায়েত হাত তুলবো ক্যাডা?
‘আর ওর চাচা? খয়বার গাজী ?
নবেজউদ্দিন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর পাল্টা জিগ্যেস করে, কিসক? খয়বার গাজীর খবর আপনে জানেন না?
‘ঐ শালা শুওরের বাচ্চার খবর আমি জানবো কোথেকে? এ্যাঁ? এই কথাটি আনোয়ার বলে চিৎকার করে, আমি জানবো কেন? ঐ্যা’ আনোয়ারের হঠাৎ-উত্তেজনার তাপে নবেজউদ্দিন উঠে দাঁড়ায়, হাত ২টো তার স্বতঃস্ফূর্তভাবে জোড়া হয়ে যায়। নবেজ কথা বলে না। তার কালো শরীরের চাপে চারপাশের অন্ধকার একটু ফিকে হয়ে এলে নবেজের চেহারা সম্পূর্ণ আকার পায়। হঠাৎ উচ্চকণ্ঠ হয়ে পড়ায় আনোয়ারও বিব্রত হয়, তার মেজাজ এরকম হঠাৎ চড়া হলো কেন? গলা নামিয়ে এবার আনোয়ার বলে, ‘খয়বার গাজীর খবর আমি জানবো কোথেকে? ব্যাটাকে কি কম খোজা হলো? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই নবেজউদ্দিন হাত কচলায়, কোনোরকমে সে মুখ খোলে, না ভাইজান, এমনি কল্যাম। হামরা মুখ্য মানুষ, হামাগোরে কথা কি ধরা লাগে? চেংটু উদিনক্যা কলো—।’
‘চেংটুটা কোথায়? সেই যে আলিবক্সের সঙ্গে গেলো তার আর পাত্তা নেই। এরকম করলে কাজ হয়? তোমার সঙ্গে দ্যাখা হলো কোথায়?
কামেই গেছে, এক জায়গাত দ্যাখা হলো। নবেজউদ্দিন সেই জায়গার নাম গোপন রাখে। বলে, আপনার কথা চেংটু কয়, ভাইজান নরম দিলের মানুষ, সোজা মানুষ, খয়বারের শয়তানী আপনে বুঝব্যার পারেন নাই। নামাজের অছিলা করা তাই পার পায়া গেলো। না হলে ঐ শালা বাঁচবার পারে? না তার ভাইসতা আজ সভার মধ্যে দেওয়ানগিরি করে?
আনোয়ার জবাব দেয় না। নবেজউদ্দিন একটু পর উসখুস করে, বলে, ‘ভাইজান, ঘরেত যান। নিওড় পড়তিছে, একটা অসুখ বাধাবেন!’
শিশিরে ভিজলে আমার অসুখ হয় না।’
কি যে কন আপনেরা ঢাকার মানুষ, গায়ের শীত, নিওড় সহ্য করার পারবেন?
ঢাকাতেও শিশির, শীত, রোদ বৃষ্টি আছে নবেজ। ঢাকার হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় ফুটপাতে রাত কাটায়।
আপনারা বড়োলোক। দালানের মধ্যে থাকেন। নবেজউদ্দিন একটু সস্নেহ তাড়াও দেয়, ’ওঠেন ভাইজান, ঘরত যান।’
ঘরে শুয়ে হ্যারিকেনের আলোয় আনোয়ার ময়লা সাদা সিলিঙের কালচে সবুজ কড়িকাঠ দ্যাখে। বৈরাগীর ভিটায় মেজোমামা এখনো গলাবাজি করেই চলেছে। মেজোমামার সঙ্গে একবার দাখা হলে ভালো হয়। বৈরাগীর ভিটায় একবার গেলে হতো। কিন্তু গণ-আদালত নিয়ে ওখানে যে ধরনের কথাবার্তা চলছে তাতে যাওয়াটা ঠিক নিরাপদ নয়। মেজোমামার ওপর রাগও হয়, লোকটা কি বোকা, না সুবিধাবাদী? গতবার জাতীয় পরিষদের ইলেকশনে যারা তার সঙ্গে বিট্রে করলো, তাদেরই ১জন মৌলিক গণতন্ত্রী পদ থেকে রিজাইন করে তার মিটিঙে প্রিজাইড করে, আর মেজোমামা কি-না তাদের মতো লোকদের নিয়ে এ গ্রাম সে -গ্রাম করে বেড়াচ্ছে? মেজোমামাকে একবার এসব কথা বললে হতো। মেজোমামাই রাজনীতিতে তার প্রথম আগ্রহ তৈরি করে। ছেলেবেলায় তার কাছ থেকে কতো কতো বই পেয়েছে। রাজনীতির সোজা সোজা বইগুলো সব মেজোমামার দেওয়া। ক্লাস নাইনে উঠে উপহার পেলো, জানবার কথা’র দশ খণ্ড। কলেজে পড়ার সময়ও বইগুলো তার যা কাজে এসেছে। তারপর লোকায়ত দর্শন’, ‘মার্কসবাদের অ আ ক খ’। সব মেজোমামার দেওয়া। ইউনিভারসিটিতে পড়ার সময়েই মেজোমামা নেতাগোছের লোক। ভাষা আন্দোলনের সময় কোন হলের ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক কিংবা কি যেন ছিলো। ক্লাস-ফাইভে-পড়া আনোয়ারের কাছে মেজোমামা তখন হিরো। রাজনীতির জন্যেই সি এস এস পরীক্ষা দিলো না। পরীক্ষা দিলে এতোদিন নির্থাৎ জয়েন্ট সেক্রেটারি। আব্বা কতোবার চাপ দিয়েছে বুলু, পরীক্ষাটা দে। নতুন দেশ, চাকরিতে ঢুকলেই লিফট তা দেশোদ্ধার করবে বলে মোজোমামা চাকরির মোহ ছাড়লো, এতো সাধের ঢাকা শহর,-তাও ছাড়লো। নিজের জেলা-শহর ওকালতি করে, বিরোধীদলের রাজনীতি করে মেজোমামা অবশ্য এখন চমৎকার পজিশন করে নিয়েছে। পার্টি পাওয়ারে এলে মন্ত্রিত্ব সুনিশ্চিত। অন্তত উপমন্ত্রী তো হবেই। কিন্তু মেজোমামার মন্ত্রিত্ব বা উপমন্ত্রিত্বের সম্ভাবনায় একটু বিরক্ত হলেও তার সঙ্গে দ্যাখা কররা ইচ্ছাটা আনোয়ারের কমে না। মনে হয় মিটিং শেষ করে মেজোমামা একবার এখানে আসবেই। এতোদূর এসে বড়োবুবুর শ্বশুরবাড়িটা ঘুরে যাবে না?–তাহলে বড়ো ভালো হয়। আনোয়ারকে বৈরাগীর ভিটায় যেতে হলো না, আবার মামার সঙ্গে দ্যাখাও হয়েও গেলো! এই সম্ভাবনার কথা ভাবতে ভাবতে তার বুকের বদলে পা নাচতে শুরু করে এবং দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে।
ঘণ্টা দুয়েক পর পাশের ঘরে কথাবার্তার আওয়াজে তার ঘুম ভাঙে। প্রথমে কেবল ধ্বনি, তারপর অন্ধকার। বড়োচাচার কথা শোনা যাচ্ছে, অন্ধাকারের কারণটা বোঝা যায়, বড়োচাচা বোধহয় হ্যারিকেনটা নিয়ে গেছে।
নিশ্চিত হয়ে আনোয়ার পাশ ফিরে শোয়। হ্যারিকেন নিয়ে ঘরে ঢোকে মন্টু, ভাইজান, ঘুমাচ্ছেন?
তোমরা কখন এলে?
ঘণ্টাখানেক হবে। আব্বা আপনাকে ডাকতে নিষেধ করলো।
বড়োচাচা এসেছেন? বড়োচাচী?
আম্মা আরো কয়েকটা দিন দেখে আসবে। আমরাই আসতে সাহস করি না। ইয়াসিন মামা আজমিটিং করতে আসলো, আমরা তার জিপে আসলাম। গ্রামের কনডিশন তো এখন অনেক ভালো দেখতেছি। আম্মাকে পরশুদিন নিয়া আসবো।
বড়োচচা শুয়ে পড়েছে?
না, এখনো খাওয়াই হয়নি।—আপনের খুব দুর্ভোগ গেলো, না? আপনেও কাম পান নাই ঐ হুজ্জতের মধ্যে ঢুকছেন!
বড়োচাচা কি করছেন?
আব্বা গল্প করে জালাল ফুপার সঙ্গে। জালাল ফুপ চন্দনদহ বাজার থাকা ইয়াসিন মামার সঙ্গেই আছে। জালাল ফুপা আপনের কথা খুব কয় তা আপনে ওদের সঙ্গে থাইকা ভালোই করছেন। ফুপ কয়, আপনের হেলপ না পাইলে খয়বার চাচা নাকি বাঁচতোই না!
আমার হেলপ? আনোয়ার রেগে ওঠে, আমি ঐ প্রফেশনাল মার্ডারারকে হেলপ করতে যাবো কোন দুঃখে? শুওরের বাচ্চা কতো মানুষকে খুন করেছে, কতো লোকের সর্বনাশ করেছে, জানো? আমি ওকে হেলপ করবো?
কি যে কন আনোয়ার ভাই! হাজার হলেও মুরুব্বি তো!
আরে রাখো তোমার মুরুব্বি একই গ্রামে থাকো, আর জানো না? মানুষের গোরুচুরির গ্যাঙের সঙ্গে ব্যাটা জড়িত, জানো না?
আনোয়ার তুমি ঘুমাও নাই বাবা? লণ্ঠনের আলোতে জালালউদ্দিন মাস্টারের দীর্ঘ শরীর ছায়ার মতো দোলে। আনোয়ার বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়, চলেন, ঐ ঘরে চলেন। মন্টু বরং একটু ঘুমাক!
পাশের ঘরে খেয়ে উঠে ইজিচেয়ারে বসে বড়োচাচা খিলাল করছে। আনোয়ারকে দেখে বলে, কয়েকদিন তোমার খুব কষ্ট হলো, না? জমিরের মাকে ভালো করা বলা গেছিলাম। বড়োচাচার সাময়িক নীবরতার সুযোগে জালাল মাস্টার তার আগেকার প্রসঙ্গ টেনে আনে, এই চ্যাংড়াক জিজ্ঞাসা করা দ্যাখেন।
কি? আনোয়ার জানতে চাইলে জালালউদ্দিন বলে, চেংটুর উপরে আমরা যতো দোষারোপ করি, ছোড়া সেদিন বৈরাগীর ভিটা সাফ না করলে গায়ের মধ্যে এরকম বৃহৎ সভা হবার পারে?
জালালউদ্দিন বিস্তারিতভাবে জানায় যে চন্দনদহের মিটিং সেরে ইয়াসিন সায়েব চলেই যেতো, তার জিপ তো রেডিই ছিলো। বেঁকে বসলো এই জালালউদ্দিন। কেন?-না, তা হয় না। এই এলাকা, এই সমগ্র থানা নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের গ্রামের লোক। সেই গ্রামে ১টা মিটিং হতেই হবে। ইয়াসিন সায়েব হাসে, গোটিয়ায় মিটিং করার জায়গা কোথায়? আমি বৈরাগীর ভিটার কথা কই তা ইয়াসিন ভাই কয়, আরে মাস্টার সায়েব, বটগাছের ডালে ঝুলতে ঝুলতে মানুষ ভাষণ শোনে? আর আমি ভাষণ দেবো মগডালে চড়ে?—আবার আফসার গাজীও লম্ফ ঝম্প করে, আরে না ঐ গ্রামে সভা করার জায়গা নেই। তা আমি কই, একবার চলেন, গেলেই চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হয়। ছেলেপেলে বটগাছের অর্ধেক সাফ করছে না? চেংটু একলাই পরিষ্কার করছে বারো আনি ভাগ।
বড়োচাচা হাই তোলে, চেংটুর কথা বাদ দেন। শালা খুনী, মানুষ খুন করার জন্য শালা লাফ পাড়ে। প্রসঙ্গটি এখানেই শেষ করার জন্য বড়োচাচা আনোয়ারকে বলে, তোমার মামার সাথে দ্যাখা করলা না কেন? দরগাতলার সরকার বাড়িতে তার জেয়াফত, আসগর সরকার একরকম জোর করাই নিয়া গেলো, কাল কৰ্ণিবাড়ি ইস্কুলের ফিল্ডে মিটিং আসরের বাদ। যদি যাও তো দ্যাখা হবে। একটু থেমে ফের বলে, অবশ্য তুমি যদি সময় করতে পারো, তোমরা সব ব্যস্ত মানুষ!’ বড়োচাচার এই শ্লেষটি আনোয়ার হজম করে। বড়োচাচা কিন্তু থামতে পারে না, তোমরা ময়মুরুব্বি মানো না। তোমার মামা খুব আঘাত পাইছে।’
‘কেন?’
কেন তা তুমি নিজেই জানো। খয়বার গাজী নিজেই বগুড়া গিয়া তাকে সব বলছে।
‘খয়রার গাজী এখান থেকে পালিয়ে মেজোমামার সঙ্গে দ্যাখা করেছে? খয়রার গাজী আইয়ুব খানের পাড় দালাল, আর মেজোমামা জেল খেটে বের হলো সেদিন!—
তোমরা খালি পলিটিক্স দ্যাখো। আত্মীয়তা কুটুম্বিতা সব বাদ দিবা?
খয়রার গাজীর প্রাপ্য শাস্তি তাকে দেওয়া হয়েছিলো। লোকটা পালিয়ে না গেলে-
আনোয়ারের কথা শেষ না হতেই জালালউদ্দিন বলে, না ভাইজান, শোনেন, আনোয়ারের জন্যেই খয়রার গাজীর প্রাণহানি হলো না। নামাজের বুদ্ধিটা না করলে।
নামাজের বুদ্ধি আমি করিনি। খয়রার গাজী যতো ক্রাইম করেছে, যতো লোক হত্যা করেছে, যতো মানুষের গোরু চুরিতে নেতৃত্ব দিয়েছে-।
সেই হিসাব করবে গভমেন্ট। বড়োচাচা ধমক দেয়, তুমি পলিটিক্স করো আর এই সোজা কথাটা তোমার মাথায় ঢোকে না? ইলেকশনে উইন করো, গভমেন্ট ফর্ম করো, তারপর অপরাধীদের ধরে শাস্তি দাও। পশ্চিমাদের খেদাবার আগেই যদি নিজেদের আত্মীয়স্বজন জ্ঞাতিগুষ্টি ধ্বংস করা শুরু করো তো ফায়দা লুটবে কারা?—বোঝাই যায় এসব কথা মেজোমামার বক্তৃতার উদ্ধৃতি। উদ্ধৃতি প্রয়োগের পর বড়োচাচা নিজের মন্তব্য ঝাড়ে, তোমার বাপের ছেলেবেলার বন্ধু, খেলার সাথী, তার সাথে কি আচরণটা তুমি করলা, এ্যাঁ?
না না ভাইজান, ভুল বুঝবেন না। আনোয়ারকে রক্ষা করার জন্য জালালউদিনের সমস্ত প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে দেয় আনোয়ার নিজেই, আব্বার বন্ধু, কিন্তু গ্রামের লোকদের সঙ্গে তার সম্পর্কটা কিরকম?
আমরাও তো গ্রামেরই লোক।
আপনি খালি খালি লোকটাকে সাপোর্ট করছেন বড়োচাচা। আপনার কোনো উপকারে আসে খয়রার গাজী ? কয়েক বছর ধরে তো আপনার সঙ্গে গোলমাল করেই চলেছে।
লাভ লোকসান, উপকার অপকার দিয়া সব বিচার করি না বাবা! জলচৌকিতে জায়নামাজ বিছায় বড়োচাচা, আত্মীয় তো! জ্ঞাতি না হলেও কুটুম্ব। আমাদের মধ্যে বিয়াশাদি চলে আজ কয়েক পুরুষ ধর্যা। আমার দাদা ভিন্ন মজহাবে গেছেন, বাবাও কড়া আহলে হাদিস ছিলেন, সম্পর্ক তো তাও নষ্ট হয়নি। আত্মীয়তা বন্ধ হয়নি। এখন উটকা মানুষের সাথে একজোট হয় আত্মীয়স্বজনের বেইজ্জত করা-এসব কি ভালো কাজ?
জায়নামাজ দাঁড়াতে দাঁড়াতে বড়োচাচা বলে, তোমার একটা চিঠি আছে। আমার জামার পকেটে দ্যাখো।’