চিলেকোঠার সেপাই – ৩৬
আজ তাড়াতাড়ি আসবেন। দুপুরে আপা পড়তে আসবে। দরজায় তালা লাগাচ্ছিল ওসমান, সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে রঞ্জু বলে, তাড়াতাড়ি আসবেন।
রঞ্জ ফিকফিক করে হাসলে ওসমানের মাথার ভেতর রক্ত ছলকে ওঠে, অফিস ছুটি না হলে আসবো কি করে?
‘রবিবারে অফিস?
আজ সোমবার। অফিস করে খেয়েদেয়ে ফিরবো। দেরি হবে।
সার্জেন্ট জহুরের রক্ত-বৃথা যেতে দেবো না; গোলটেবিল না রাজপথ-রাজপথ রাজপথ’, ‘জেলের তালা ভাঙবো –‘শেখ মুজিবকে আনবো’ –ইত্তেফাঁকের সামনে ওসমানকে রিকশা ছেড়ে দিতে হলো। এখন প্রবলেম হলো,-মিছিল সম্পূর্ণ চলে যাওয়া পর্যন্ত ওসমান কি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে? নাকি মিছিলের ভেতর দিয়ে রাস্তা ক্রস করে অফিসে চলে যাবে? মিছিলে কামালকে দেখে ওসমান এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয়,
এই কামাল, অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছেন? অফিসে কি স্ট্রাইক নাকি?
‘আজ রোববার না? আজ সোমবার। ওসমান জোর দিয়ে বলে, মতিঝিলের সব অফিস থেকে সবাই বেরিয়ে এসেছে।’
আপনি কি পাগল হলেন নাকি? আজ রোববার। কামাল এগিয়ে যায়। ওসমান বিরক্ত হয়ে মিছিলের এক পাশে দাঁড়ায়, সোমবারকে বলার মধ্যে পাগলামির কি হলো ?
‘আরে ওসমান ভাই? আসেন, আসেন। শাহাদতের আহ্বানে ওসমান ওর পাশে চলতে শুরু করে। সোমবারের ব্যাপারটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে উদগ্রীব, ‘আজ তো সোমবার, না? অফিসে বোধহয় স্ট্রাইক। কিন্তু রিকশা তো চলছে।
এই ব্যাপারে শাহাদতের কোনো মতামত আছে বলে মনে হয় না, আপনার কথা একটু আগেই জিগ্যেস করছিলাম। ঐ যে আপনাদের পাড়ায় ঐ রিকশাওয়ালা—কি নাম যেন?— ওকে জিগ্যেস করলাম।
খিজির? খিজির এসেছে নাকি? মিছিলে আছে? ‘হ্যাঁ সামনের দিকে। শাহাদতও জোর পা ফেলে সামনে চলে যায়, পেছনে চলে যায়, পেছনে কোনো কর্মীকে সে উপদেশ দেয়, প্রসেশনে ডেড-বডি আছে। পাবলিক যেন ওয়াইল্ড না হয়ে যায়! ওসমান তখন পাশের লোককে জিগ্যেস করে, কার ডেড-বডি ভাই ?
লোকটি জবাব না দিলে পেছন থেকে কে যেন বলে, আপনি বোধ হয় পাকিস্তানের ইনফর্মেশন মিনিস্টার। আগরতলা মামলার আসামীকে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর গুলি করে মারে, আপনি খবর রাখেন না?
এইবার হঠাৎ করে মনে পড়ে, এই হত্যার খবর ওসমান পেয়েছে কাল বিকালে, রেক্সে বসে চা খেতে খেতে। সেই বন্দি কি বুলেটে নিহত ? ক্যান্টনমেন্টে আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়া আর কি ব্যবহার করবে? মিছিল চলছে, মিছিলের সঙ্গে হাটতে হাটতে ওপরদিকে তাকালে চোখে পড়ে উড়ন্ত ইলেকট্রিক তার থেকে ঝোলে বুকে-বুলেট-বেধা লাশ। দেখতে দেখতে মৃতদেহের ২ হাত থেকে ঝোলে আরো ২টো বুলেট-বিদ্ধ লাশ। ২ জনের ৪ হাত থেকে আরো ৪ জনের লাশ। মিছিলের ভেতর দিয়ে সেই লাশের উল্লম্ব সারি চলে, মানুষের সঙ্গে যে কোনো মুহুর্তে তাদের ঠোকাঠুকি লাগতে পারে। সবাইকে সাবধান করা দরকার। কিন্তু কামাল কোথায়? শাহাদত কোথায়? খিজির কোথায়? ওদিকে বায়তুল মোকাররমের সামনে থেকে মাইকে দুর্বোধ্য ধ্বনি বেজে ওঠে, ওসমানের মাথা ঘুরে ওঠে বো করে, দেখতে দেখতে মৃতদেহের সারির সঙ্গে সমস্ত মিছিল অদৃশ্য হয়ে যায়। টলোমলো পায়ে ওসমান ফিরে যায় নবাবপুরে, মোহাম্মদিয়া রেস্টুরেন্টে একটু বসে চা খায়। মনে হয় ওদিকে বোধ হয় সব শেষ হয়ে গেলো। কি শেষ হলো সে সম্বন্ধে স্পষ্ট কোনো ধারণা করতে না পেরে বাইরে এসে হাঁটতে থাকে নবাবপুর রোড ধরে। নবাবপুরে অজস্র মানুষ, প্রায় সবাই যাচ্ছে বায়তুল মোকাররমের দিকে। দক্ষিণে যাচ্ছে সে একা। দোকানপাট বেশির ভাগই বন্ধ, যানবাহন খুব কম। ওসমানের হাটতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আজ বোধহয় গোটা ঢাকা শহর জুড়ে নবাবপুর প্রসারিত, এই রাস্তা আর শেষ হয় না।
ঘরে ঢুকে গ্লাস দুয়েক পানি খেলে গলার খটখটে ভাবটা কমে, কিন্তু পেটের ওপর দিকটা চিনচিন করে ওঠে। ভুল হয়ে গেলো, কোথাও খেয়ে নিলো ভালো হতো। রানু যদি অঙ্ক করতে আসে তো এই দারুণ খিদে নিয়ে অঙ্কের ভুলগুলো সনাক্ত করা কঠিন হবে। খিজির এলে ভালো হতো। খিজির ঘরে থাকলে রানুর অঙ্কে ভুল ধরার দায়িত্ব থেকে ওসমান অব্যাহতি পায়। আবার খিজিরের কাচ থেকে জেনে নেওয়া যেতো যে ঐ বন্দির ঠিক কোন জায়গাটায় বুলেট বিদ্ধ হয়েছিলো। দরজা বন্ধ করে শুতে শুতে খিজিরের ওপর ওসমানের রাগ হয়: মিছিলের সামনে থেকে সে দিব্যি চলে গেলো, একবার খোজও করলো না, ওসমান মিছিল থেকে একরকম বহিষ্কৃত হয়ে একা একা এই দীর্ঘ পথ হেঁটে কি রকম ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আর রাস্তাও বটে একখানা। আজ কি নবাবপুরের ভীমরতি ধরেছিলো যে গোটা ঢাকা মহর জুড়ে শালা শুয়েছিলো গতর ছড়িয়ে? আর্মানিটোলা, পটুয়াটুলি, ইসলামপুর, তাঁতীবাজার সব কি সে দখল করে বসেছিলো আজ? নবাবপুর ধরে হাটতে হাটতে গরমে হাসফাস করে, এই হাঁটার মনে হয় আর কোনো শেষ নাই। এদিকে খিদেও পেয়েছে খুব। দূরসম্পর্কের চাচার বাড়ি থেকে পাওয়া যায় মোট ২ আনা পয়সা, তা দিয়ে বাসে করে ঘরে ফিরবে, না টিফিন পিরিওডে কিছু খাবে? কতোকাল আগেকার সেই ক্ষুধা মেশে আজকের খিদের সঙ্গে। মাথার ভেতর ভোতা ঠেকে, ভোতা মাথায় কি বর্তমান কি অতীত কাউকেই ভালো করে ধরা যায় না। মাথার ভেতরটা বড়ডো দোলে, শুধু দোলে। এই দুলুনিতে ঘোড়ার গাড়ির গড়িয়ে চলাটা বেশ বোঝা যায়। সবেধন নীলমণি ২ আনা দিয়ে স্কুলের গেট থেকে আমড়া কি চালতার আচার খেয়ে ফেলেছে, এখন বাড়ি পর্যন্ত পাড়ি দিতে হবে হেঁটে। এতোটা পথ হাটা কি সোজা কথা? ওসমান তাই উঠে বসেছে একটা ঘোড়ার গাড়ির পেছনের পাদানিতে। কোচোয়ান টের না পাওয়া পর্যন্ত যতোদূর যাওয়া যায়। ঘোড়ার গাড়ি চলেছে, ঘোড়াজোড়া ছুটছে, গাড়ি গড়িয়ে যাচ্ছে, পেছনের পাদানিতে বসে দুলছে ওসমান। ভোতা ক্লান্তি ও একঘেয়ে দুলুনিতে তার ঘুম পায়। কোনো এক পিচ্চি কেটলিতে চা নিয়ে রাস্তা ক্রস করতে করতে চ্যাচায়, গাড়িকা পিছে মানু’। গোড়ার গাড়ির ছাদ থেকে কোচোয়ানের চাবুক এসে পড়ে তার মাথায় ও বুকে। গাড়ির পাদানি থেকে লাফিয়ে নামতে নামতে চাবুক উড়ে যায় সামনের দিকে। ঘোড়ার গতি বাড়ে। কোচোয়ান পলকের জন্য মুখ ফিরিয়েছিলো। আরে এ তো খিজির! খিজির তাকে চিনতে পারলে কি তার গাড়ি থেকে এভাবে নামিয়ে দেয়? খিজির! খিজির আরে আমি। দাঁড়াও। আরে এই খিজির—।
কিন্তু খিজির আলি ফিরেও তাকায় না। ঘোড়ার গাড়ি দেখতে দেখতে চলে যায় অনেক দূরে। ওসমান রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই দেখছে, এমন সময় প্যাক প্যাক করে রবারের হর্ন বাজায় মুড়ির টিন মার্ক ঝরঝরে বাস। চমকে উঠে সরে দাঁড়ালে বাসের গায়ে কণ্ডাক্টর দমাদম বাড়ি মারে। বাসের প্যাক প্যাক আওয়াজে অথবা বাসের গায়ে কণ্ডাক্টর দমাদম বাড়ি মারার ফলে ওসমান বিছানায় উঠে বসে। কিছুক্ষণ পর বোঝা যায় দরজায় কে যেন আস্তে আস্তে টোকা দিয়ে চলেছে।
আপনের শরীর খারাপ? রানু একবার আসছিলো, রঞ্জু আসলো কয়েকবার। সারাদিন দরজা বন্ধ। কি হইছে? মকবুল হোসেনের উদ্বেগ দেখে ওসমান হাসে, না এমনি।’
অসময়ে ঘুমান? ভাত খাইছেন? ওসমান ঘড়ি দ্যাখে। একটু পর নিচে যাবো।’ কারফ্যুর ভিতর কৈ যাইবেন? কারফ্যু? . বিছানায় বেশ জুত করে বসে মকবুল হোসেন, বসতে বসতে ওসমানকে ভালো করে দ্যাখে। আজ খুব গোলমাল হইছে, জানেন না?
‘হ্যাঁ ফেরার সময় রথখোলার মোড়ে লাল রায়ট কারটা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। টিয়ার গ্যাস ছুড়লো। আনোয়ার আর আমি একসঙ্গে ফিরছিলাম।
বলতে বলতে ওসমানের ভুল ভাঙে, রথখোলার মোড়ে রায়ট কার দ্যাখার ঘটনাটি বেশ কয়েকদিন আগেকার। ওটা কি রথখোলার মোড়ে দেখলো? নাকি জিপিওর সামনে? নাকি আর্মানিটোলা স্কুলের মাঠে? তবে আজ সে কি দেখলো? ঘোড়ার গাড়ির পেছনের পাদানি থেকে খিজির তাকে নামিয়ে দিলো কবে?—মাথার ভেতর একটার পর একটা মরা গেরো পড়ছে, সেগুলো খোলা কি সোজা?
মকবুল হোসেন বলে, কোন মিনিস্টারের বাড়ি নাকি আগুন লাগাইয়া দিছে। দ্যাখেন তো এরকম করলে দেশে ল এ্যাঁণ্ড অর্ডার থাকে?
কখন? কোন মিনিস্টারের বাড়ি? মন্ত্রীর বাড়ির আগুনের শিখায় ওসমানের মাথার জট পুড়ে যায়, সবগুলো গেরো খুলে গেলে চেয়ারে বসে সে সিগ্রেট ধরায়।
‘দ্যাখেন তো মিনিস্টারের বাড়ি পোড়াইলে লোকসান কার? এই ঘটনায় মকবুল হোসেন বেশ অসন্তুষ্ট, গভর্মেন্ট প্রপার্টি মানে পাবলিক প্রপার্টি, তাই না?
হোস্টাইল আর এনিমি গভর্মেন্টের প্রপার্টিতে মানুষের রাইট কতোটা? এসব থাকলে মানুষের লাভ কি? নষ্ট হলেই বা কি?
কিন্তু বাড়াবাড়িটা কি ভালো? এই যে জ্বালানো পোড়ানো শুরু হইছে—। ‘গভমেন্ট এতোদিন ধরে, এতোকাল ধরে যে অত্যাচার চালাচ্ছে, তার তুলনায় এটা কি? মানুষ যদি এটুকু না করে তো নেতাদের আপোষ করার স্কোপ থাকে, বুঝলেন? তার কথা মকবুল হোসেন বুঝলো কি-না পরোয়া না করে ওসমান বলে, ‘জ্বালানো পোড়ানো এমন অবস্থায় এসেছে যে বড়ো বড়ো নেতারা ইচ্ছা করলেও আর পিছিয়ে যেতে পারবে না। ধরেন, ইচ্ছা থাকলেও শেখ সায়েব কি এখন প্যারোলে বেরিয়ে এসে রাউন্ড টেবলে যেতে পারবে?
‘না, এখন আর প্যারোলে আসে ক্যামনে? আর দ্যাখেন, গভমেন্ট নিজেই আইন মানে না। কথায় কথায় গুলি করে, নিরীহ মানুষকে খুন করে তো পাবলিক সে তুলনায় কি করেছে, বলেন?
কি করছে? প্রশ্নবোধক বাক্যটি দিয়ে মকবুল হোসেন ওসমানের ওপর আস্থা জানায়। তার নিজের বা পারিবারিক বা বড়োজোর পেশাগত ব্যাপারের বাইরে কোনো বিষয়ে মতামত পোষণ করার সুযোগ তার কোনোদিন হয়নি। ওসমানের মতামত সমর্থন জানাবার জন্য তাই সে ছটফট করে। আমার তালেবটারে দ্যাখেন না, কথা নাই বার্তা নাই-। আবার আরু তালেব এবার গোটা ঘর জুড়ে ঝুলে থাকার আয়োজন করছে? ওসমান উঠে দাঁড়ায়, ছাদে যেতে যেতে আড়চোখে ঘরের ভেতরটা তদন্ত করে। না, ঘরের শূন্যতা একেবারে নিরাভরণ।
ছাদে পেচ্ছাব করে ঘরে ফিরতে ফিরতে সিঁড়ির কোনো ধাপ থেকে শোনা যায় রানুর গলা, আচ্ছা। মকবুল হোসেন বলে, ভাত উপরে পাঠাইয়া দিস।
সিঁড়ির দিকের দরজা দিয়ে ওসমান দ্যাখে রানু আস্তে আস্তে নেমে যাচ্ছে। এই ঘরের আলো একটু ময়লা হয়ে পড়েছে সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ পর্যন্ত। রানুর পিঠ জুড়ে ছড়ানো চুল। চুলের ওপর পড়ে আলো একটু সাফসুতরো হয়েছে, চুলের রাশি তাই চিকচিক করে। ওসমান ওর চুল দেখতে দেখতে মেয়েটা সিঁড়ির বাক ঘুরলো। সেখানে অন্ধকার। রানুর ঠিক পেছনের ধাপে আরু তালেবের বুলেট-বিদ্ধ শরীর। ওসমান ঐ দরজার কাছে গেলে রানুকে সতর্ক করার জন্য ছোট্রো করে কাশলে রানু পেছনে তাকায়। তালেবের শরীর তখন সলিড আকার ধারণ করেছে। তাই দেখেও রানুর চেহারা অপরিবর্তিত রয়ে যায়। রানুর পেছনে তালেবও অন্ধকারে নিচে নেমে গেলে ওসমান দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে, নাঃ মরে যাওয়ার পরও তালেব রানুর আস্থা এতটুকু হারায়নি।
চেয়ারে বসে ওসমান ভদ্রতা করে, আবার ওকে খাবার আনতে বললেন কেন? ঘরে পাউরুটি ছিলো।
ঘরে যা আছে তাই খাইবেন। ইলিশ মাছ খান তো? তালেবের মায় সর্ষা বাটা দিয়া ইলিশ মাছ রানছে।
‘খাই। ইলিশ আমার ভালো লাগে। ছোটবেলায় ঢাকায় এলে আব্বা রোজ ইলিশ মাছ আনতেন। গ্রামে থাকতেও পদ্মার ইলিশের নাম শুনতাম খুব।
‘ধলেশ্বরীর ইলিশ যদি খাইতেন তো বুঝতেন। ধলেশ্বরীর—। মকবুল হোসেন হঠাৎ খেয়াল করে যে চোখজোড়া যতোটা পারে খুলে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে রয়েছে ওসমান। তার ঠোঁট আবার সেই পরিমাণ চাপা। মনে হয় ভয়ে কিংবা বিস্ময়ে তার জ্বজোড়া কাঁপছে। মকবুল হোসেনও ভয় পায়, কি হইলো? কি?
ওসমানের মনোযোগে এদিকে ফেরাতে না পেরে মকবুল হোসেন বিছানা থেকে নেমে সিঁড়ির দরজার দিকে যায়। সিঁড়ির প্রথম কয়েকটি ধাপে ঘরের আলোর ময়লা আঁচল লোটানো। ধাপে ধাপে আলো আরো ময়লা হয়। অন্ধকার গাঢ় হতে হতে নিচের ধাপগুলোকে নিজের খাপের ভেতর গায়েব করে ফেলে। ভয় পাইছেন? মকবুল হোসেন স্নেহতেলতেলে আওয়াজে তার ভয় তাড়াবার চেষ্টা করে, ভয়ের কি আছে? ঐ্যা? আমি আছি না?
ভয় পাবো কেন? ওসমান চটচটে আদর প্রত্যাখ্যান করে, আরে ভাই ভয় পাওয়ার কি হলো? এতো সহজে ঘাবড়াই না আমি, বুঝলেন? কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো। এর ক্ষতিপূরণ হিসাবে মকবুল হোসেনকে ধলেশ্বরী ও ইলিশের প্রসঙ্গ ফিরিয়ে দিতে চায়, ইলিশ তো জানি পদ্মারই ভালো।
একটু আগে প্রকাশিত ওসমানের বিরক্তি মকবুল হোসেন গায়ে মাখে না। কেউ রাগ করলে বা বিরক্ত হলে তার প্রতিক্রিয়া দ্যাখানো মানে নতুন ঝামেলা তৈরি। এছাড়া ধলেশ্বরী তার বড়ো প্রিয় বিষয়। এ থেকে চট করে সরে আসা তার পক্ষে কষ্টকর। মকবুল হোসেন তাই ওসমান গনির শেষ বাক্যে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দেয়, সেই কথা আমি কইলে আপনে মানবেন কেন? একবার চলেন। আমাগো বাড়ি ধলেশ্বরীর উপরেই। আমাগো এলাকায় যে হাঁটে যান ধলেশ্বরীর ইলিশ উঠছে তো পদ্মার ইলিশ থাইকা দাম এটু বেশি থাকবেই।’
‘সত্যি? মাথা থেকে অবাঞ্ছিত সব ছবি মুছে ফেলার জন্য ওসমান তৎপর, কিরকম বেশি?
তার ঠিক আছে? আমাগো ছোটোবেলায় এক আনা ছয় পয়সা বেশি হইলেই অনেক বেশি।
বলেন কি?’ তয়? ওসমানের বানানো-বিস্ময়ে মকবুর হোসেন অভিভূত হয়, ‘পদ্মার ইলিশ তিন আনা জোড়া তো ধলেশ্বরীরটা চাইর আনা, আঠারো পয়সা। আর মাছ পাওয়াও যাইতো! আমাগো হাঁটে বর্ষাকালে ইলিশের আমদানী হইছে এমন, কি কমু?-হাঁটের মধ্যে কুলায় নাই, জাইলারা হাই ইশকুলের ফিল্ডে বসছে চুপড়ি লইয়া – হঠাৎ বেশি কথা বলার লজ্জা বা ক্লাস্তিতে মকবুল হোসেন একটু হাসে। এরপর লজ্জা কাটাবার জন্য সে চলে আসে বর্তমানের সমস্যায়, তাইতো চিন্তা করি, বাপদাদায় কি খাইছে, আর আমরা কি খাই। সংসার চালাইতে পারি না। ছেলেমেয়ে ল্যাখাপড়ার খরচ কেমন বাড়ছে, দ্যাখেন না? এক মাইয়ারে তো আল্লা আল্লা কইরা পার করছি, আরেক মাইয়ার বিয়া দিতে হইবো। বিয়াশাদীর খরচ– ‘ –
মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছেন না? ওসমান বেশ সিরিয়াস। কোনোদিন কারো বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া দূরের কথা, কোনো বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজনের সঙ্গে সে জীবনে কখনো জড়িত ছিলো না। এই প্রথম একটা সুযোগ পেয়েছে, এটা সে হারাতে চায় না, রানুর বিয়ের ব্যাপারে একটা কথা ছিলো।’
রানুর বিয়ের ব্যাপারে ওসমানের উৎসাহকে বেহায়াপনা ভেবে মকবুল হোসেন বিরক্ত হওয়ার বদলে বরং লজ্জা পায় এবং ছেলেটার বেহায়াপনা আড়াল করার উদ্যোগ নেয় সে নিজেই, রানুর মায়ে আমারে কয়দিন বলছে। আপনার ফাদার তো ইন্ডিয়ায় থাকে, না? বাবাজীগো বাড়ি ওয়েস্ট বেঙ্গলের কোন জেলায়? পার্টিশনের আগে কইলকাতা গেছি কতোবার তার হিসাব নাই। গোয়ালদের জাহাজে উঠছি, সেই সময় ঐ জাহাজ–। তার ভ্রমণ কাহিনী বর্ণনা বন্ধ করে দেয় ওসমান, বাড়িওয়ালা আপনাকে কিছু বলেনি?
জী? আমাগো বাড়িওয়ালা? মকবুল হোসেন হঠাৎ ভয় পায়। ‘জী। রহমতউল্লা সায়েব রানুর জন্য একটা প্রস্তাব নিয়ে আসেনি? অপরাধবোধ নুয়ে-পড়া গরিবের মতো চোখমুখমাথা নিচের দিকে নুইয়ে মকবুল হোসেন কৈফিয়ৎ দেয়, মাইয়া যখন আছে তখন কতো প্রস্তাব আসবো। বাড়িঅলাও একটা লইয়া আসছে। কথা বলতে বলতে সে সাহস সঞ্চয় করে, আমার মাইয়ারে আমি কৈ বিয়া দেই না দেই, সেইটা দেখুম আমি। বাড়িআলারে পরোয়া করি? আরে কতো বাড়িআলা দেখলাম। আমারে চাপ দেওয়াইয়া কাম করাইতে পারে এমন মানুষ—।
তার সিংহপুরুষসুলভ সাহসের প্রতি ওসমান একেবারে উদাসীন, কেন? বাড়িওয়ালার প্রস্তাব খারাপ কি? ছেলেটার বাপ তো বেশ ভালো ব্যবসা করে, ছেলের নামে নবাবপুরে হার্ডওয়্যারের দোকান থাকা কি কম কথা? ঢাকায় পৈতৃক বাড়ি, আবার মার্কেট তৈরি করছে। আর কি চান?
ভয়-পাওয়া ও সুবোধ ছাত্রের মতো মকবুল মিনমিন করে, না, আমরা মানে একটু ল্যাখাপড়ার কথা ভাবছিলাম। ছেলের যদি ল্যাখাপড়া তেমন না থাকে তো—।’
রাখেন লেখাপড়া টাকাপয়সা রোজগারের জন্যেই তো লোকে লেখাপড়ার করে। একটু প্র্যাকটিক্যাল হতে চেষ্টা করেন।’
‘না, ধরেন, মেয়েটা আমার আবার একটু লাখাপড়ার ভক্ত। তারও একটা মতামত-। আপনাকে বলি, মাইল্ড করবেন না, রানু লেখাপড়ায় ভালো করতে পারবে না। অঙ্কের মাথা একেবারে ভাল। প্রোপোজালটা রিফিউজ করবেন না।
এই সময়ে ট্রেতে করে খাবার নিয়ে আসে রানু। গামলা ভর্তি ধোঁয়া-ওঠা ভাত, ইলিশ মাছের সৰ্যে-বাটা পাতুড়ি, আলু ভর্তা এবং কুচি কুচি করে কাটা ঢেঁড়সের চচ্চড়ি। আপাতত এর কোনোটিতেই ওসমানের রুচি নাই। রানুর কপালে লাল টিপ। তার চুল এখন দুটো বেশী হয়ে সামনে এসে ঢেউ তুলে নেমে গেছে কোমরের দিকে। তার নাকে ঘামের বিন্দু নাই, সেখানে পাউডারের আভাস। ওসমান স্বচ্ছন্দে কয়েকবার তাকে দ্যাখে। কারফ্যুর ভেতর ওর এই সাজগোজ দেখতে আসবে কে? টেবিলের ওপর ট্রে ঠিক করে রাখতে রাখতে ওসমান বলে, তুমি যাও। আমার খেতে এখনো অনেক দেরি। সকালবেলা প্লেট বাটি সব পাঠিয়ে দেবো।’
বাপের সঙ্গে রানু নিচে চলে গেলে হঠাৎ-শ্রমের ক্লান্তিতে ওসমান বড়ো বড়ো নিশ্বাস ফেলে। এইভাবে ৯/১০টা নিশ্বাস ফেললে বেশ সহজ বোধ করে। তার সমস্ত শরীরের ভার যেন পাম্প করে বার করে দেওয়া হলো। হয়তো এই কারণে তার বড়ডো খিদে পায়। হাতটাতে না ধুয়েই গপগপ করে খেতে শুরু করলো। ভাতের গামলায় আলু ভর্তা, ঢেঁড়সের চচ্চড়ি, ডাল এক সঙ্গে মেখে যতোই খায় মনে হয় পেটের সবটা বোধহয় খালিই পড়ে রয়েছে। এতো যে খাচ্ছে, শরীরের অজস্র ফাক ফোকর তবু একটুও ভরে না। ইলিশ মাছের কাটাগুলো পর্যন্ত চিবিয়ে চিবিয়ে ছিবড়ে করে ফেললো। ওসমানের বুক পর্যন্ত ফাকা, —যতোই ঠাসো আর যতোই গাদো আবক্ষউদরের চাহিদা মেটে না। গ্লাস গ্লাস পানি খেয়েও শরীরের খ খ করা আর থামে না। খিদে ভোলবার আশায় ওসমান তখন ঘরের শূন্যতার দিকে দ্যাখে। কিন্তু ঘর তার পেটের মতোই শূন্য। গুলিবিদ্ধদের খাড়া কোনো সচল ও আচল মিছিল দেওয়ালের মাঝখানের শূন্যতাকে এতোটুকু গয়না পরিয়ে দেয় না। ওসমান এখন তাহলে করবেটা কি? কোনো উপায় না দেখে তোশকের নিচে অনেকদিন আগে লুকিয়ে রাখা একটা পর্নোগ্রাফির বই বার করে। যা তা মাল নয়, গুলিস্তানের সামনে থেকে ২৮ টাকায় কেনা। আর্ট পেপারের পাতায় পাতায় সায়েব-মেমসায়েবদের এ্যাঁকশনের ছবি। কিন্তু সেসব বারবার দেখেও শরীরের কোথাও কিছুমাত্র স্পন্দন বোধ করা যায় না। নানা ভঙ্গিতে সঙ্গমরত নর-নারীর দেহ কেবল বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উদ্ভট সমাবেশ ছাড়া অন্য কোনো দৃশ্য তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। তবে একটা ভালো লক্ষণ দ্যাখা যায়, তলপেটটা টনটন করতে থাকে। হবেই তো! যে পরিমাণ পানি খাওয়া হলো পেচ্ছাব না করে উপায় কি?
একটা কাজ পেয়ে খুশি হয়ে ওসমান দরজা খুলে ছাদে এলো। শীত যাই যাই করছে, ফাল্গুন মাস এসে পড়লো বলে! দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করতে করতে ওসমাননয়ন ভরে চারদিকের কুয়াশা-ঢাকা নির্জনতা দ্যাখে। পেচ্ছাব করা হয়ে গেলে রেলিঙে ঝুঁকে নিচে খোয়া-ওঠা রাস্তা দ্যাখে, কালো রাস্তার ওপর কালো রাত্রি। এই সময় কোন এক কবিতার লাইন মাথায় আস্তে আস্তে চুলকায় কারফ্যু-দাগানো পথ, রাত্রিবেলা/ছাদের ওপরে থাকি আমি একেলা।—এটা কার লেখা? কার? কোথায় পড়েছে?—মনে পড়ার আগেই শোনা যায় কোথায় যেন গুলির শব্দ হচ্ছে। কারফ্যু ভাঙার অভিযোগে মিলিটারি কোথাও গুলি করছে। তাকেও তো গুলি করতে পারে। সে তো ঘরের বাইরে, আকাশে নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। তাহলে? গুলি একবার তার বুকে লাগলে হয়, তখন এই ছাদে দাঁড়িয়ে থাকে কোন শালা? আগেই প্রাকটিস করার জন্য ওসমান লাফিয়ে এই ইঞ্চি চারেক ওপরে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যায় ধপ করে। শূন্যে থাকতে পারলে ভালো হয়। তার গুলিবিদ্ধ দেহ উড়তে উড়তে কারফ্যুচাপা শহরের বাড়িঘর, দোকানপাট, ডিআইটি, স্টেডিয়াম, কার্জন হল, গুলিস্তান, ইউনিভারসিটি, মেডিক্যাল কলেজের সামনে এলম গাছের সারি, মালিবাগের মোড়, কমলাপুর রেল স্টেশনের ফুল মার্কা ছাদ, এয়ারপোর্টের টাওয়ার, আজিমপুর গোরস্থান-এসবের ওপর দিয়ে দিব্যি উড়ে বেড়াবে। তার ওপরে কি?-ওপরে অন্যান্য গুলিবিদ্ধদের খাড়া মিছিল। এই আবু তালেব, আবু তালেবের হাতের সঙ্গে গুলি দিয়ে গাথা খিজিরের লাশ। আরে, আনোয়ার? আনোয়ারের নিচে আলতাফ, শওকত ভাই। কিন্তু ওসমানের জায়গাটা কোথায়? ঐ মিছিলে সে অনুপস্থিত কেন? মিছিলে তার এতো চেনা লোক, আকাশ জুড়ে এরা তার নিজের মুখটা সে কি-না সনাক্ত করতে পারে না। এতো মানুষের খাড়া সমাবেশে তার ঠাই হলো না। তার শূন্য ও ফাঁকা বুকে এই দুঃখ ঢুকলে একটু বল পেয়ে ওসমান নিচের দিকে দ্যাখে। পায়ের নিচে চুন সুরকি ঢাকা কালচে খয়েরি ছাদ। ফের সামনে তাকালে সব ফাকা। এই একটু-আগে-দ্যাখা জলজ্যান্ত গুলিবিদ্ধ মানুষের লম্বা ও ঋজু প্রবাহ এভাবে মুছে যাওয়াটা ভালো কথা নয়। কিন্তু তার ভয় করে না। কিংবা করলেও তা চাপা পড়ে এই হঠাৎ-হারাবার হাহাকারের নিচে। ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে ফের উঠতে হয়, শেষবারের মতো পেচ্ছাবটা সেরেই নিই। কিন্তু পেচ্ছাব বেশি হয় না, কয়েক ফোটা পড়ার পর তলপেটও খালি। অন্নজলমুক্ত, মলমূত্রমুক্ত, রক্তমাংসমুক্ত, শুক্ৰধাতুমুক্ত ওসমান এখন অনায়াসে ঝুলে পড়তে পারে বুলেট বিদ্ধদের লম্বা ঝাকে। কিন্তু এবার আকাশ একেবারে ফাকা।
ঘরে এসে শুতে না শুতেই শোনা যায় গুলিবর্ষণের শব্দ। ওসমান ফের ছাদে যায়। এবার আকাশ জুড়ে লাশের মিছিল, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন মানুষের দল। কিন্তু এই সমাবেশে তার মুখ নাই। এবার আবার একটি কবিতা মনে পড়ে, এটা কি অন্য কবিতা? না ঐটারই পরের জোড়া-লাইন? বিড়বিড় করে সে আবৃত্তি করে আকাশে কারফ্যু ভাঙে সবাই মিলে। আমার শ্ৰীমুখ কৈ এই মিছিলে?-কার লেখা? কার? কিছুঁতেই মনে করতে না পারলে রাগ করে ওসমান ফের ঘরে ঢুকে বসে থাকে। ঐ কবিতার আরো সব লাইন তার একটু একটু মনে পড়ে, কিন্তু স্পষ্ট করে বুঝতে পারে না। হয়তো স্পষ্টই মনে পড়তো, কিন্তু তার আগেই অনেক দূরে কোথায় মিলিটারির গুলিবর্ষণ শোনা যায়, সে এক লাফে এসে দাঁড়ায় ছাদে।
ওসমান এই রকম ঘর-ছাদ, ছাদ-ঘর, ঘর-ছাদ ঘর করে ওদিকে কালো ডিমের খোসা ভেঙে বেরিয়ে আসে আকাশ মহারাজ। পাতলা কুয়াশার কাফনের নিচে রাস্তার শরীরের প্রায় সবটাই একটু একটু দ্যাখা যাচ্ছে। শাহ শাহেব বাড়ির মসজিদের আজান এই রাস্তার জনশূন্য চেহারা ন্যাংটা করে ফেললে সেদিকে তাকাতে ওসমানের লজ্জা হয়। খিজির থাকলে ওসমান নির্ঘাত ওর সঙ্গে বেরিয়ে পড়তো। লম্বা লম্বা হাত পা নেড়ে খিজির অবিরাম কথা বলতে বলতে যেভাবে হাঁটে তাতে এই রাস্তার আব্রু দেওয়ার জন্য ও একাই একশো। খিজিরটা কোথায়? সারারাত ঘরে ফিরলো না কেন? তবে ওকে কোথায় যেন দেখলো? কোথায় দেখলো হাজার চিন্তা করেও ওসমান সেটা উদ্ধার করতে পারে না।