চির নবীন, চির নূতন, ভাস্বর বৈশাখ
আমার যখন খুব মন খারাপ হয় আমি তখন স্বামীজীর জীবনী পড়ি। বিশেষ করে তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায়। তাঁর জীবনের শেষ কয়েকটি দিনের ইতিহাস। কারণ, আমি কাঁদতে চাই, আমি তাঁর কাছে দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা সহ্য করার শক্তি চাই। তিনি যে ক্রুশ বহন করেছিলেন, আমি সেইটিকে বহন করতে চাই। আমরা চোখ উলটে, হাত নেড়ে খুব বলি—স্ট্রাগল, ফাইট, সাফারিং। স্বামীজীর মতো ‘সাফার’ কে করেছিলেন! বাগবাজার থেকে প্রমদাবাবুকে লিখছেন : “ঈশ্বরের মঙ্গলহস্তে বিশ্বাস আমার যায় নাই এবং যাইবারও নহে—শাস্ত্রে বিশ্বাসও টলে নাই। কিন্তু ভগবানের ইচ্ছায় গত ৫।৭ বৎসর আমার জীবন ক্রমাগত নানাপ্রকার বিঘ্নবাধার সহিত সংগ্রামে পরিপূর্ণ। আমি আদর্শ শাস্ত্র পাইয়াছি, আদর্শ মনুষ্য চক্ষে দেখিয়াছি, অথচ পূর্ণভাবে নিজে কিছু করিয়া উঠিতে পারিতেছি না, ইহাই অত্যন্ত কষ্ট, বিশেষ কলিকাতার নিকটে থাকিলে হইবারও কোন উপায় দেখি না।” স্বামীজী কখন লিখছেন? শ্রীশ্রীঠাকুরের দেহাবসান হয়েছে। কাশীপুর উদ্যানবাটীর পাট উঠে গেছে। গৃহী ভক্তরা সব সরে গেছেন। বরানগরের এক প্রাচীন গৃহে ঠাকুরের অন্তরঙ্গ পার্ষদ কয়েকজন নরেন্দ্রনাথকে নেতা করে দানা বাঁধার চেষ্টা করছেন। অনেকের মধ্যেই বিষণ্ণতা, হতাশা। আর কি হবে! এবার নাহয় ফিরেই যাই পূর্বাশ্রমের পরিচিত পেটানো জীবনে! সেইসব দিনের শূন্যতার বিবরণ মাস্টারমশাই লিখে গেছেন তাঁর নিজের হৃদয়ের শূন্যতা সহায়ে—”কয়মাস হইল, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ক্তদের অকূল পাথারে ভাসাইয়া স্বধামে চলিয়া গিয়াছেন। অবিবাহিত ও বিবাহিত ভক্তেরা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সেবাকালে যে স্নেহসূত্রে বাঁধা হইয়াছেন তাহা আর ছিন্ন হইবার নহে। হঠাৎ কর্ণধারের অদর্শনে আরোহিগণ ভয় পাইয়াছেন বটে, কিন্তু সকলেই যে এক প্রাণ, পরস্পরের মুখ চাহিয়া রহিয়াছেন।”
এখন কর্ণধার হবেন নরেন্দ্রনাথ। গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ ঐ গভীর আধারে ঢেলে দিয়ে গেছেন শক্তি। ধর্মের ওপর কর্মের প্রতিষ্ঠা। এক নতুন সত্যযুগের উদ্বোধন করবেন নরেন্দ্রনাথ। সংশয়ান্বিত গুরুভ্রাতাদের বললেন : “পক্ষহীন শোনো বিহঙ্গম, এ যে নহে পথ পালাবার।” “রামকে পেলুম না বলে কি শ্যামের সঙ্গে ঘর করতে হবে; আর ছেলেপুলের বাপ হতে হবে!” একথা তিনিই বলতে পারেন, যাঁর জীবনদর্শন হলো—
“ভ্রান্ত সেই যেবা সুখ চায়, দুঃখ চায় উন্মাদ সে জন—
মৃত্যু মাঙ্গে সেও যে পাগল, অমৃতত্ব বৃথা আকিঞ্চন।
যতদূর যতদূর যাও, বুদ্ধিরথে করি আরোহণ,
এই সেই সংসার-জলধি, দুঃখ সুখ করে আবর্তন।”
মঠের ভাইদের নিজের জীবনের সাংসারিক সুখ-দুঃখের কথা বলতে চাইতেন না। কেউ কদাচিৎ প্রশ্ন করলে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলতেন : “সে- খবরে তোর কি প্রয়োজন! আমাদের কথা অন্য। সংসার আমাদের পদতলে।
“শোন বলি মরমের কথা, জেনেছি জীবনে সত্য সার-
তরঙ্গ-আকুল ভবঘোর, এক তরী করে পারাপার-
মন্ত্র-তন্ত্র, প্রাণ-নিয়মন, মতামত, দর্শন-বিজ্ঞান,
ত্যাগ-ভোগ বুদ্ধির বিভ্রম; ‘প্রেম’ ‘প্রেম’–এই মাত্র ধন।”
কোন্ জীবনে আসীন হয়ে তিনি এই কথা বলছেন, তার একটি ঝলক প্রকাশিত প্রমদাবাবুকে লেখা চিঠিটিতে—”কলিকাতার নিকটে থাকিলে হইবারও কোন উপায় নেই। আমার মাতা এবং দুইটি ভ্রাতা কলিকাতায় থাকে। আমি জ্যেষ্ঠ, মধ্যমটি এইবার ফার্স্ট আর্টস পড়িতেছে, আরেকটি ছোট। ইঁহাদের অবস্থা পূর্বে অনেক ভাল ছিল, কিন্তু আমার পিতার মৃত্যু পর্যন্ত বড়ই দুঃস্থ, এমনকি কখনো কখনো উপবাসে দিন যায়। তাহার উপর জ্ঞাতিরা দুর্বল দেখিয়া পৈতৃক বাসভূমি হইতে তাড়াইয়া দিয়াছিল; হাইকোর্টে মকদ্দমা করিয়া যদিও সেই পৈতৃক বাটীর অংশ পাইয়াছেন, কিন্তু সর্বস্বান্ত হইয়াছেন—যেপ্রকার মকদ্দমার দস্তুর।”
নরেন্দ্রনাথ দত্তের পিতা বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন ধনী অ্যাটর্নি। ইংরেজের কলকাতার এক নামী মানুষ। সঙ্গীতপ্রিয়, ভোজনবিলাসী, বন্ধুবৎসল, মজলিসী এক মানুষ। এই পরিবারের এক মানুষ সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ করেন। ভক্তিমতী নরেন্দ্রনাথের মাতা শিবের কাছে প্রার্থনা করে ‘বিলে’কে পেয়েছিলেন। কৈশোর থেকে যৌবন—মানুষ হলেন জমিদারপুত্রের ধারায়। শ্রেষ্ঠ শিক্ষা, সঙ্গীত, স্বাস্থ্যচর্চা, জিমন্যাস্টিক, দর্শনচর্চা, মিস্টিসিজমের চর্চা, ধর্মের আধুনিক জিজ্ঞাসার অনুশীলন, যুক্তি ও তর্কের মাধ্যমে ঈশ্বরের অন্বেষণ। মুক্ত চিন্তায়, উচ্চ শিক্ষায়, মানসিক স্বাধীনতায়, পরিপালনের উদারতায় নরেন্দ্রনাথ এক নব্য যুবক। তিনি সন্ন্যাসী হবেন, দক্ষিণেশ্বরের মজার ঠাকুর তাঁকে ধরবেন—এমন কোন ভবিষ্যতের জন্যে তাঁর পিতামাতা প্রস্তুত ছিলেন না। হ্যাঁ, ছেলেটি একটু ভিন্ন প্রকৃতির। অত্যন্ত রূপবান, স্বাস্থ্যবান, মেধাবী। অতিশয় বেপরোয়া, রাগী। তর্কাতীত বস্তু মানতে চায় না। ঘোরতর সংস্কারবিরোধী। যুক্তি যেখানে নেই, নরেন্দ্রনাথ সেখানে নেই। সেই অর্থে সে নাস্তিক, কিন্তু সর্বথা তার অন্বেষণের বস্তু ঈশ্বর। সে ব্রাহ্মসমাজে ছুটে যায়, কেশবের বক্তৃতা শোনে, অসাধারণ কণ্ঠে ব্রহ্মসঙ্গীত করে, তার গানে মানুষ আত্মহারা হয়। সে সরাসরি দেবেন ঠাকুরকে প্রশ্ন করে—”আপনি কি ঈশ্বরকে দেখেছেন?” সে শুধু সমাজে নয়, বড়লোকের বাগানবাড়িতেও মজলিস করে, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা মারে, রঙ্গ-রসিকতা করে, কিন্তু অসাধারণ চরিত্রবান। বদলোকের সঙ্গে মিশলে ফল হয় বিপরীতই, নরেন্দ্রনাথের অধঃপতন হয় না, বদলোকটাই ভাল হয়ে যায়। সিমুলিয়ার পরশপাথরের এমনই ভেলকি!
সংসারপথে বিশ্বনাথ দত্তের কৃতী পুত্র নরেন্দ্রনাথ অর্থে, বিত্তে, প্রাচুর্যে, ক্ষমতায় উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালী হবেন—এই ভবিষ্যদর্শনে তাঁর পিতামাতার কোন সংশয় থাকার কথা নয়। অ্যাটর্নির ছেলে অ্যাটর্নি হতে পারে, অধ্যাপনায় বিপুল খ্যাতি—সেও তো অসম্ভব নয়! বিবাহের জন্য ধনীর কন্যা অবশ্যই দুর্লভ হতো না। কিন্তু!
এই ‘কিন্তু’তেই আছে দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুরের খেলা। নরেন্দ্রনাথ কে, তাঁর পিতামাতা জানতেন না। যেমন মাতা যশোদা জানতেন কি স্বয়ং কৃষ্ণ কে? কয়েকজন ঋষি ছাড়া রামকে কে জানতেন? স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণকেই কি জানতেন তাঁর পিতামাতা, আত্মীয়, পরিজন? শ্রীরামকৃষ্ণ পৃথিবীতে প্রবেশের প্রাক্কালে গলা জড়িয়ে ধরে বলে এসেছিলেন—আমি যাচ্ছি, তুমি এস। সপ্তর্ষিমণ্ডলের সেই প্রধান ঋষি এলেন কলকাতার সিমুলিয়ায়। কামারপুকুরের গদাধর এগিয়ে এলেন রাসমণির দক্ষিণেশ্বরে। দক্ষিণেশ্বরও তো মহাকাল ও মহাকালীর এক অদৃশ্য অলৌকিক খেলা। এক ধনী মহিলা, কিন্তু তেজস্বিনী এবং অলৌকিক এক মনের অধিকারিণী রাসমণি। আক্ষরিক অর্থে বিদূষী নন অথচ দক্ষ প্রশাসক, আইন ও বাণিজ্যিক বুদ্ধিতে বাঘা ইংরেজকে ল্যাজে গোবরে করে দিতে পারেন। অত্যন্ত সাহসী, মরণকেও ভয় পান না। সময়ের ঠিক এই পাদে কেন তাঁর আবির্ভাব হলো! মহাকালের মহাসচিব এর উত্তর দিতে পারেন। পরবর্তী কালের আমরা এই যোগাযোগে অদৃশ্য শক্তির অনুমান করে নিতে পারি।
রাসমণির নৌবহর প্রস্তুত। বিশাল তীর্থযাত্রা। যাবেন তিনি কাশী। পূর্ব রাতের শেষ প্রহরে স্বপ্নাদেশ—কেন কাশী যাওয়া রে মেয়ে? আমাকে প্রতিষ্ঠা কর, আমি তোমার পূজা নেব, সেবা নেব। গঙ্গার তীরে স্থাপন কর আমার মন্দির। খুলে দাও বহর। গোশালায় ফিরিয়ে দাও গরু। বিলিয়ে দাও সব দ্রব্যাদি। ঐ অর্থে হবে দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির, তৈরি হবে অভূতপূর্ব এক জাগরণের ইতিহাস। শুধু রানী একা নন, তাঁর সঙ্গে যুক্ত হলেন সুযোগ্য জামাতা মথুরমোহন। সেখানেও আবার এক অদ্ভুত খেলা, মথুরমোহন পরপর দুটি কন্যাকেই বিবাহ করলেন। প্রথমজনের মৃত্যুর পর দ্বিতীয়টিকে, অর্থাৎ সেজ বা ছোট মেয়ে জগদম্বাকে। এই মথুর এবং জগদম্বা চোদ্দ বছর শ্রীরামকৃষ্ণের সেবা করবেন! তিনি আসছেন কামারপুকুর-লীলা সমাপ্ত করে। যে অদৃশ্য হস্ত এই ঘুঁটি সাজাচ্ছেন, সেই হাতেই হাত ধরা আছে শ্রীরামকৃষ্ণের। তিনিই দেখিয়ে দেন কে কি! নরেন্দ্রনাথ সপ্তঋষির প্রধান ঋষি। রাসমণি মা ভবতারিণীর অষ্টসখীর এক সখী, মথুরমোহন অন্যতম রসদদার, রাখাল–ব্রজের রাখাল, শ্রীম চৈতন্যপার্ষদ।
এই ছকে নরেন্দ্রনাথ। তাঁকে তো ঠাকুর কিঞ্চিৎ ঘোল খাওয়াবেনই। আধ্যাত্মিক পথ যে বড় নিষ্ঠুর পথ! মায়ের কোল থেকে ছেলে তুলে নিয়ে যায়। স্ত্রীর পাশ থেকে স্বামীকে সরিয়ে নেয়। ঘরের মঙ্গলশঙ্খ নহে তার তরে, নহে প্রেয়সীর অশ্রুচোখ। নরেন্দ্রনাথের সব হৃত হবে-রিক্ততার অলৌকিক অলঙ্কারে ভূষিত হবেন বলে! দুঃখ চেনো, তাহলেই ঈশ্বরকে চিনতে পারবে। তাঁর সপ্তসিন্ধুতে অগাধ জল, কিন্তু তিনি প্রেমিক ভক্তের দু-ফোঁটা চোখের জলের বড়ই প্রত্যাশী।
নরেন্দ্রনাথ অতঃপর লিখছেন : “কখনো কখনো কলিকাতার নিকট থাকিলে তাঁহাদের (মাতা এবং ভ্রাতা) দুরবস্থা দেখিয়া রজোগুণের প্রাবল্যে অহঙ্কারের বিকার-স্বরূপ কার্যকরী বাসনার উদয় হয়, সেইসময়ে মনের মধ্যে ঘোর যুদ্ধ বাধে, তাহাতেই লিখিয়াছিলাম (প্রমদাবাবুকে), মনের অবস্থা বড়ই ভয়ঙ্কর। এবার তাঁহাদের মকদ্দমা শেষ হইয়াছে। কিছুদিন কলিকাতায় থাকিয়া, তাঁহাদের সমস্ত মিটাইয়া এদেশ হইতে চিরদিনের মতো বিদায় হইতে পারি, আপনি আশীর্বাদ করুন।”
“আপূর্যমাণমচলপ্রতিষ্ঠং সমুদ্রমাপঃ প্রবিশন্তি যদ্বৎ।
তদ্বৎ কামা যং প্রবিশন্তি সর্বে স শান্তিমাপ্নোতি ন কামকামী।।” (গীতা, ২।৭০)
—বিবিধ নদনদীর জলে পরিপূর্ণ সমুদ্রে যেমন অপর জলরাশি প্রবেশ করে তাতে বিলীন হয়ে যায়, কিন্তু সাগরের প্রশান্তি তাতে বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয় না, তেমনি আত্মজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত যে যোগীর অন্তরে বিষয়চিন্তাসকল প্রবেশ করেও কোনপ্রকার চিত্ত-বিক্ষোভ সৃষ্টি করে না, তিনিই আত্যন্তিক শান্তিলাভ করেন।
‘চিরদিনের মতো বিদায়’ নয় নরেন্দ্রনাথ, চির উদয়! ঐ যে দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর গামছা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন—”তুই না এলে বুকের ভেতর গামছা নিংড়োয়।” তখন এই অদৃশ্য গামছা যায় নরেন্দ্রনাথের গলায়, পালাবে কোথায় প্ৰভু!
“কথা বলতে ডরাই, না বললেও ডরাই,
মনে সন্দ হয়, পাছে তোমাধনে হারাই, হা-রাই!
আমরা জানি যে মন-তোর, দিলাম তোরে সেই মন্তর,
(এখন মন তোর)
(আমরা) যে-মন্ত্রে বিপদেতে তরী তরাই।।”
এই চিঠি নরেন্দ্রনাথ সমাপ্ত করেছেন ‘Imitation of Christ’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে—”আশীর্বাদ করুন যেন আমার হৃদয় মহা ঐশবলে বলীয়ান হয় এবং সকলপ্রকার মায়া আমা হইতে দূরপরাহত হইয়া যায়—”
“For We have taken up the Cross, Thou hast laid it upon us, and grant us strength that we bear it unto death. Amen.”
‘ক্ৰশ’! স্বামীজী সেটি দিয়ে গেছেন জাতিকে, সেই রিক্ত সম্রাট। তাঁর দুটি চিত্র-ধর্মমহাসভায় বুকে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন গৈরিক মহারাজ। মানুষের আবেগ উচ্ছ্বাসের তরঙ্গশীর্ষে। তিন মিনিটে তিনি বিশ্বমানব, লোকহৃদয়ের অধীশ্বর—স্বোয়ামী ভিভেকানন্দ। ‘ইন্ডিয়ান সোয়ান’ পরমহংস শ্রীরামকৃষ্ণ দুয়ার ভেঙে উড়ে গেলেন ‘স্পিরিট ইটার্নাল’ স্বামী বিবেকানন্দের ডানায় ভর করে। (দ্রঃ রোমাঁ রোলাঁ)
দ্বিতীয় চিত্র—কৌপীনধারী স্বামীজী লাঠিতে দেহভার রেখে ভবভোলা সন্ন্যাসীর মতো দাঁড়িয়ে আছেন সাঁওতাল কর্মীদের মধ্যে, পার্শ্বে প্রবাহিত গঙ্গা, নির্মীয়মাণ স্বপ্নের বেলুড় মঠ-মন্দিরের প্রলম্বিত ছায়ায়। দিন শেষ হয়ে আসছে। কণ্ঠে তাঁর সেই অমোঘ আদেশ—
“আমার ভিতরে যে-আগুন জ্বলছে, তা জ্বলে উঠুক তোমাদের মধ্যে— তোমরা যেন জগতের যুদ্ধক্ষেত্রে মরতে পার বীরের মতো। ভাঙনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়–তাকে ভরাট কর নিজের জীবন দিয়ে। তুচ্ছ জীবন, তুচ্ছ মরণ, তুচ্ছ ক্ষুধা, তুচ্ছ শীত। এগিয়ে যাও, প্রভু আমাদের নেতা।”
আমি স্বামীজীর কাছে ঐ ক্রশটি চাই। ওটি মা কালী। ঠাকুর দিয়েছিলেন স্বামীজীকে। আমি চাইছি তাঁর কাছ থেকে। নরেন্দ্রনাথের কালী—”আমি ভয়ঙ্করকে ভয়ঙ্কর বলে ভালবাসি। নৈরাশ্যকে নৈরাশ্য বলে ভালবাসি, দুঃখকে দুঃখ বলে ভালবাসি। সংগ্রাম কর, অবিরাম সংগ্রাম কর। প্রতি পদে পরাজয়, তবু সংগ্রাম কর। উপাসনা কর মৃত্যুর। শক্তিমানের মৃত্যু আবাহন।”
স্বামীজীকে আমি দুঃখে, হতাশায়, নৈরাশ্যে, নৈরাজ্যে খুঁজব। সেই আমাদের জীবন।
“সত্য তুমি মৃত্যুরূপা কালী,
সুখবনমালী তোমার মায়ার ছায়া।।”
সেই কারণে শতবর্ষ বয়সী ‘উদ্বোধন’-এ আমি স্বামীজীর প্রাণস্পন্দন শুনতে পাই। চির নবীন, চির নূতন, ভাস্বর বৈশাখ।