চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও বিংশ শতাব্দীর বুদ্ধিজীবী
বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায় রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সাহসের সঙ্গে অগ্রসর হলেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রতি তাঁদের মনোভাব অনেকটা যেন ঊনবিংশ শতাব্দীর বুদ্ধিজীবীদের মতোই থেকে যায়। যেহেতু স্বদেশি আন্দোলনের (১৯০৫-১৯১১ খ্রি.), অসহযোগ আন্দোলনের (১৯১৯-১৯২২ খ্রি.) এবং স্বরাজ্য পার্টির (১৯২৩-১৯২৫ খ্রি) প্রভাব বিস্তারের সময়ে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্য নেতৃবৃন্দের আন্তরিক প্রয়াস লক্ষ করা যায়, সেজন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রতি বুদ্ধিজীবীদের মনোভাবের প্রশ্নটি এইসব ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে এখানে আলোচনা করা হল :
(ক) স্বদেশি আন্দোলনে কৃষি পরিকল্পনার অভাব :
স্বদেশি ও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী অংশ ছিলেন হিন্দু জমিদারেরা। তাঁদের আশঙ্কা ছিল, বাংলা ভাগের পরে মুসলিম-প্রজা অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গে তাঁদের জমিদারির অবসান ঘটবে। যেহেতু তাঁরা ভূমি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের বিরোধী ছিলেন, সেজন্য যখন বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব ঘোষণা করা হয় তখন তাঁরা অত্যন্ত শঙ্কিত হন। সুতরাং, সরকারি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বঙ্গভঙ্গ রহিত করবার উদ্দেশ্যে তাঁরা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জানুয়ারি বঙ্গীয় ল্যাণ্ড হোল্ডারস’ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরে লর্ড মিন্টোকে সাদরে গ্রহণ করে যে সম্ভাষণপত্র দেওয়া হয় তাতেই এই আন্দোলনের নেতাদের মনোভাব সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইংরেজ সিংহাসনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে এবং ইংরেজ শাসনের ন্যায়পরায়ণতার ওপর আস্থা স্থাপন করে আবেদনকারীরা বঙ্গভঙ্গের পরে যে অস্থিরতা সমগ্র প্রদেশে দেখা দিয়েছে তার প্রতি ভাইসরয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁরা এই আশা পোষণ করেন, ভারতীয় শিল্প (industry) শাসন কতৃপক্ষের নিকট থেকে সহায়তা পাবে এবং সরকার কারিগরিবিদ্যা-সহ সামগ্রিকভাবে শিক্ষার উন্নতির জন্য অনেক সাহায্য দেবেন। তাঁরা একথাও উল্লেখ করেন: ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলা এক সমৃদ্ধিশালী প্রদেশে পরিণত হয়েছে।’৬১ স্বদেশি ও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, নেতৃবৃন্দ জমিদারিপ্রথা অক্ষুণ্ণ রেখে জাতীয় শিক্ষা ও শিল্প গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট হন। তাঁরা এই কথা কখনো উপলব্ধি করেননি, প্রচলিত ভূমি ব্যবস্থা ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার পূর্ণ বিকাশের পথে অনেক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।৬২
(খ) ভূমিসমস্যা বাংলার রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা :
(১) স্বরাজ্য পার্টি ও কংগ্রেসের ভূমিকা: খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে (১৯১৯-১৯২২ খ্রি.) হিন্দু-মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের এক নতুন মনোভাব গড়ে উঠলেও, ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘গণ-সত্যাগ্রহ’ বর্জন করার ফলে আকস্মিক-ভাবে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে চিত্তরঞ্জন দাস ও মতিলাল নেহরু ভারতের রাজনীতিতে অবতীর্ণ হন। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ‘স্বরাজ্য পার্টি’-র পরিকল্পনা ঘোষিত হয়। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে হিন্দু-মুসলিম সমস্যা সমাধানের জন্য স্বরাজ্য দলের নেতৃবৃন্দ এক দুঃসাহসিক পন্থা অনুসরণ করেন। তাঁদের এই বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘হিন্দু-মুসলিম প্যাক্ট’ নামে খ্যাত। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে গৃহীত স্বরাজ্য পার্টির পরিকল্পনা চারটি ভাগে বিভক্ত ছিল : ধ্বংসাত্মক দিক, গঠনমূলক দিক, জাতীয় জাগরণের দিক এবং শেষ আঘাত হানার দিক। এই পরিকল্পনায় জনসাধারণকে আইন-আদালত এবং সরকার পরিচালিত স্কুল-কলেজ বয়কট, সরকারি চাকরিতে পদত্যাগ, বিদেশি বস্ত্র বর্জন, জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, খদ্দর প্রস্তুত, কুটিরশিল্পের পুনরুজ্জীবন, কৃষক ও শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন, কংগ্রেস কমিটি স্থাপন করতে বলা হয় এবং সমগ্র দেশে দীর্ঘস্থায়ী হরতালের মাধ্যমে সরকারকে শেষ আঘাত হানতে আহ্বান জানানো হয়। এই পরিকল্পনার কোথাও জমিদারি ব্যবস্থা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়নি। এমনকী ‘হিন্দু-মুসলিম চুক্তি’ নামক বিখ্যাত দলিলেও এই বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই। আইনসভায় ও শাসনযন্ত্রে সংখ্যাগুরু জনসমষ্টির প্রভাব বৃদ্ধি করে স্বরাজ্য পার্টির নেতৃবৃন্দ সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান করতে চান।৬৩ অবশ্য স্বরাজ্য পার্টি এই সমস্যার প্রতি পুরোপুরি অবহেলা দেখায়নি। যখন স্বরাজ্য পার্টি কাউন্সিলের মধ্যে চিত্তরঞ্জন দাসের নেতৃত্বে কার্যসূচি রচনা করে, তখন এই পার্টি সিদ্ধান্ত করে যে প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তারা সরকারি উদ্যোগের জন্য অপেক্ষা করবে না, কিন্তু এই পার্টি অন্য দলের সঙ্গে আলোচনা করে এই বিষয়ে এমন কিছু সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করবে যার ফলে জমিদার ও কৃষক উভয়ের নিকট গ্রহণযোগ্য একটি বিল কাউন্সিলের অনুমোদনের জন্য পেশ করা যায়। স্বরাজ্য দলের নেতৃবৃন্দ জমিদারিপ্রথার কাঠামোর মধ্যে জমিদার ও কৃষক উভয়কেই সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুন চিত্তরঞ্জন দাসের আকস্মিক মৃত্যুতে তাঁর পক্ষে আর এই পরিকল্পনা কার্যকরী করা সম্ভব হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পরে স্বরাজ্য দলের নেতৃবৃন্দ ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কে পার্টির পরিকল্পনা কার্যকরী করবার উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠন করেন। ঠিক হয় এই কমিটি ভূমিসমস্যা পর্যালোচনা করে এমন এক সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করবে যা জমিদার ও কৃষক উভয়ের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে। এই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বরাজ্য দল কাউন্সিলের পরবর্তী অধিবেশনে একটি বিল পেশ করার প্রস্তাব ঘোষণা করে। স্বভাবতই কমিটিকে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসের মধ্যে রিপোর্ট দাখিল করতে বলা হয়।৬৪ কিন্তু স্বরাজ্য পার্টি ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয় এবং এমনকি কোনো রিপোর্টও প্রস্তুত করতে পারেনি। যখন ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে ক্যালকাটা গেজেট-এ ঘোষণা করা হয় যে, কাউন্সিলে একটি ‘টেনান্সি বিল’ পেশ করা হবে, তখন স্বরাজ্য পার্টির ইংরেজি মুখপত্র ফরওয়ার্ড কাগজ ‘টেনান্সি বিল’ এই শিরোনামায় একটি সম্পাদকীয় প্রবন্ধ প্রকাশ করে। এই প্রবন্ধে লেখা হয়, টেনান্সি অ্যাক্টের সংশোধনের প্রস্তাবের অন্যতম উদ্দেশ্য হল মামলামোকদ্দমার পরিমাণ হ্রাস করা। এই প্রবন্ধে এও লেখা হয়, বিনা অসুবিধায় অতিসহজেই জমিদারদের খাজনা আদায়ের অধিকার মেনে নিয়ে যদি জমিতে রায়তের স্বত্ব স্বীকার করা হয়, তাহলে কারও আপত্তির কারণ থাকবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই বিলে এমন কিছু নেই যার ফলে খাজনা আদায়ের জন্য মামলার পথে যেতে লোকেরা উৎসাহিত হবে না অথবা মামলামোকদ্দমার আওতার বাইরেই রায়তের অধিকার স্বীকৃতি পাবে। ফরওয়ার্ড এই কথাও উল্লেখ করে, ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের কমিটি স্বীকার করেছিল বর্তমানে কৃষির ক্ষেত্রে কোনো বিশৃঙ্খলা নেই অথবা জমিদার-কৃষক সম্পর্কও খারাপ নয়। কিন্তু এই টেনান্সি বিলটি যদি আইনে পরিণত হয় তাহলে তাদের মধ্যে তিক্ততা বৃদ্ধি পাবে। তাই ফরওয়ার্ড দেশের ভূমি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেনি। এই কথাও এই কাগজ বুঝতে পারেনি যে, প্রচলিত ভূমি ব্যবস্থা গ্রামবাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে সাম্প্রদায়িকতা ও জাতিবিদ্বেষের উর্বর ভূমিতে পরিণত করেছে।৬৫
স্বরাজ্যপন্থীরা কেবলমাত্র জমিদারদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন না, এমনকী তাঁরা জাতীয় সংগ্রামে জমিদারদের ‘প্রগতিশীল ভূমিকার’ও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। জমিদারদের প্রতি তাঁদের এই মনোভাব চিত্তরঞ্জন দাস জীবিত থাকাকালীন লক্ষ করা যায়। বস্তুত, বাংলার জমিদারদের একটি ভালো অংশই স্বরাজ্য পার্টির সমর্থনে বঙ্গীয় কাউন্সিলে সদস্যও হন। বঙ্গীয় কাউন্সিলে জমিদার সদস্যদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৩ এপ্রিল ফরওয়ার্ড কাগজে প্রকাশিত ‘Bengal Council : Its Work’ নামক প্রবন্ধে একজন লেখক মন্তব্য করেন :
It cannot, however, be over looked that much of the strength of the opposition was due to the attitude of the Zamindars. Their independence and courage have been phenomenal, and the country owes them a deep debt of gratitude that they have made such a bold stand in spite of the known difficulty and delicacy of their position. Their sympathy for the poor of the province, their efforts to ameliorate the hopeless condition of the masses augurs well for the improvement of the village, and directly contradict the mischievous lie that the nationalist movement is a middle class movement for the purpose of safeguarding middle class rights. The speeches of Kumar Shiv Sekhareshwar Roy have still the vigour of old times; while the argument of Rai Harendranath Chaudhuri are as full of information and vitality as ever. Babu Sailajanath Roy Choudhuri, Kumar Arun Chandra Singha, Babu Prasanna Deb Raikut, Babu Taraknath Mukherji, Babu Satya Kishore Banerji, Rai Satyendra Nath Roy Chaudhuri Bahadur, Babu Abinash Chandra Roy, among others were always to be fround championing the people’s cause, and their sympathy and their co-operation has been of such vital value to the Nationalist movement that it cannot be overestimated. By associating themselves with the progressive movement they have proved themselves natural leaders of the people and have shown conclusively that the Zamindars are determind to occupy their proper place in the province. All honour and glory to them.৬৬
এই প্রবন্ধ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, স্বরাজ্য পার্টি জমিদারদের প্রগতিশীল ভূমিকার প্রতি অপরিসীম গুরুত্ব আরোপ করে এবং জাতীয় সংগ্রামে এইসব জমিদারদের সহায়তা লাভের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। স্বরাজ্য পার্টির মতে, জাতীয় মুক্তি অর্জনের সমস্যাটিই হল আজ দেশের সামনে প্রধান কাজ।৬৭ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পুরোপুরি বজায় রেখে স্বরাজপন্থীরা কিছু আইনগত ব্যবস্থার মাধ্যমে জমিদারদের সঙ্গে কৃষকদের বিরোধ মীমাংসা করার কথা চিন্তা করেন, এবং এইভাবে তাদের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করেন। যে কৃষির প্রশ্নের সঙ্গে বেশিরভাগ বাঙালি জনসাধারণের স্বার্থ যুক্ত ছিল, সাফল্যের সঙ্গে তার মীমাংসা করতে ব্যর্থ হলে তার পরিণতি যে কী জটিল হতে পারে, সে-বিষয়ে স্বরাজপন্থীরা সচেতন ছিলেন না। এই বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট চিন্তার ছাপ তাঁদের কার্যসূচিতে, বক্তৃতায় ও রচনায় পাওয়া যায় না। সম্ভবত এই প্রশ্নটি তাঁরা স্বাধীনতা-পরবর্তী কালের জন্য রেখে দেন। স্বভাবতই হিন্দু-মুসলিম সখ্যতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁদের সদিচ্ছা থাকলেও স্বরাজপন্থীরা বাংলার রাজনীতিকে সাম্প্রদায়িক প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে জনসাধারণকে কোনো নতুন পথ দেখাতে সক্ষম হননি।৬৮
তা ছাড়া কংগ্রেসও জমিদারিপ্রথার অবসান ঘটিয়ে ভূমি ব্যবস্থার কোনো আমূল পরিবর্তনের পক্ষপাতী ছিল না। এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলিতে (১৯১৯-১৯২২ খ্রি.) কংগ্রেসের ডাকে বাংলার কৃষকেরা অনেক উৎসাহের সঙ্গে সাড়া দেয়। গ্রামের মানুষের মধ্যে এতটা উৎসাহ ও উদ্দীপনা আর কখনো দেখা যায়নি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত শ্রেণিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বাংলার কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ কৃষকের নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হন। ফলে, কৃষকেরা হতাশাগ্রস্ত হয়। পরবর্তীকালের ঘটনা থেকে কংগ্রেস কোনোই শিক্ষা নেয়নি এবং তার নীতিরও কোনো সংশোধন করেনি। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি Deshbandhu Village Reorganisation Fund Committee গঠন করে গ্রামের উন্নতির উদ্দেশ্যে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কিন্তু তাতে ভূমিসমস্যার সমাধানের মাধ্যমে গ্রাম উন্নয়নের কোনো ব্যবস্থা ছিল না।৬৯ ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে গৌহাটিতে (গুয়াহাটি) ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে কমিউনিস্টদের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব পেশ করা হয়। তাতে ভারতের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করার সঙ্গে জমিদারিপ্রথা উচ্ছেদের শর্ত যুক্ত করা হয়। কংগ্রেস মহলে কমিউনিস্টদের এই প্রস্তাব যথেষ্ট চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। গভীর বিস্ময় প্রকাশ করে প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত বলেন, ‘জমিদারেরা কংগ্রেসকে অর্থ সাহায্য করেন, আর উচ্ছেদ হবে তাঁদেরই।’ বলা বাহুল্য, প্রচুর সংখ্যক ভোটের ব্যবধানে এই প্রস্তাব পরাজিত হয়।৭০ এই গৌহাটি (গুয়াহাটি) অধিবেশনে যে-প্রস্তাব গৃহীত হয় তাতে বলা হয় : (ক) যাতে জমিতে কৃষকদের স্বত্ব স্থায়ী হয় এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধা পায় তার জন্য কংগ্রেস চেষ্টা করবে।
(খ) তা ছাড়া কংগ্রেস কৃষির ও শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমজীবী মানুষের অধিকার সংরক্ষণের এবং সমতার ভিত্তিতে জমিদার-কৃষক, পুঁজিপতি-শ্রমিক ইত্যাদির সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়াসী থাকবে।৭১
কিন্তু ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে যখন প্রজাস্বত্ব আইন (১৮৮৫ খ্রি.) সংশোধন করা হয় তখন দেখা যায়, বঙ্গীয় আইনসভায় কংগ্রেস সদস্যদের নিকটে কৃষকদের পরিবর্তে জমিদারদের স্বার্থই ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ।৭২ এই আইনের শর্তসমূহে কংগ্রেস সদস্যরা এতটা খুশি হন যে স্বরাজ্য পার্টির এক বিখ্যাত নেতা তো বলেই ফেলেন, এই আইনে গাছ কেটে নেওয়ার যে টানা স্বত্ব কৃষককে দেওয়া হল তাতেই বাংলার কৃষকেরা ‘কংগ্রেসের চাষি-হিতৈষণায় মুগ্ধ থাকবে।’ কিন্তু বাংলার চাষি ‘চাষা’ হলেও অতটা যে ‘বোকা’ নয় তা পরবর্তী ঘটনাতেই বোঝা যায়। জমিদারদের প্রতি কংগ্রেসের এই সহানুভূতিশীল মনোভাব বাংলার কৃষককে এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে শুধু সন্দিগ্ধ করেই তোলেনি, তাদের কংগ্রেস থেকে অনেক দূরেও সরিয়ে নিয়ে যায়।৭৩
(২) ফজলুল হক পরিচালিত কৃষক-প্রজা আন্দোলন: কংগ্রেস কতৃক জমিদারের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব অবলম্বন করার ফলে গ্রামবাংলায় জমিদার-কৃষক সম্পর্কে যে ব্যবধান সৃষ্টি হয় সেখানে ধীরে ধীরে একদল শিক্ষিত মুসলিম রাজনীতিবিদের অনুপ্রবেশ ঘটে। তাঁদের মুখপাত্র ছিলেন এ কে ফজলুল হক। তিনি ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে সক্রিয়ভাবে বাংলার রাজনীতিতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রামবাংলার জনসাধারণের মধ্যে, বিশেষ করে মুসলিম কৃষকদের মধ্যে নিজের প্রভাব বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ভূমিসমস্যাকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে তুলে ধরেন।৭৪ ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকেই ফজলুল হক জমিদারি-মহাজনিপ্রথার বিরুদ্ধে কৃষক প্রজাদের সংঘবদ্ধ করতে শুরু করেন। তখন থেকেই কয়েকটি জেলায় প্রজা আন্দোলনের উন্মেষ ঘটে। তাঁরই প্রত্যক্ষ পরিচালনায় ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বরিশালের একটি গ্রামে এবং ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার একটি গ্রামে দু-টি বড়ো প্রজা-সমাবেশ হয়।৭৫ প্রজা আন্দোলনকে একটি সুস্পষ্ট রূপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ‘নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতি’ গঠন করেন। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করে তিনি দু-টি শব্দ ‘কৃষক’ এবং ‘প্রজা’ চয়ন করেন। এই সমিতির নেতৃত্ব ছিল প্রধানত শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতে। সমস্ত রকমের জনসাধারণের ক্ষেত্রেই ‘প্রজা’ শব্দটি প্রয়োগ করা যায়। সেই অর্থে শিক্ষিত লোকেরাও ‘প্রজা’। অন্যদিকে ‘কৃষক’ শব্দটি একটি সুনির্দিষ্ট শ্রেণির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এইভাবে প্রজাদের ও কৃষকদের স্বার্থ সংযুক্ত করে ফজলুল হক বাংলার রাজনীতিতে এক নতুন রঙের সংযোজন করেন।৭৬
১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত সরকারের আইন অনুযায়ী ছয় আনা খাজনা প্রদানকারী কৃষকদের ক্ষেত্রেও ভোটের অধিকার সম্প্রসারিত হওয়ায় কৃষক-প্রজাসমিতির খুবই সুবিধা হয়। এই কৃষকদের সমিতির মধ্যে সংঘটিত করে ফজলুল হক জমিদারিপ্রথা অবসানের দাবি করেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত কৃষক-প্রজা সমিতির নির্বাচনি ইস্তাহারে পরিষ্কার করে বলা হয় :
‘কৃষিজীবী মানুষের স্বার্থে এবং জমিতে কৃষকের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য ‘‘বেঙ্গল টেনান্সি অ্যাক্ট’’ সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন করতে হবে এবং নিম্নোক্ত বিষয়গুলি একটি নতুন আইনে যুক্ত করতে হবে : (ক) নজর ও সেলামি আদায়ের যে অধিকার জমিদারেরা ভোগ করেন তা রহিত করতে হবে। (খ) অতিরিক্ত খরচ না করেও কৃষকদের নাম পরিবর্তনের অধিকার মেনে নিতে হবে। (গ) খাজনার পরিমাণ কমাতে হবে। জমিদার, মহাজন ও তাদের প্রতিনিধি কতৃক বেআইনি আদায়ের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ও কার্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে।’৭৭
এই পরিকল্পনা নিয়ে ফজলুল হক গ্রামবাংলার বিভিন্ন প্রান্তর ঘুরে-বেড়ান এবং জমিদারি-মহাজনি প্রথার বিরুদ্ধে সেখানকার জনসাধারণকে নতুন চেতনায় উদবুদ্ধ করেন। কৃষক-প্রজারা তাঁর আহ্বানে সাড়া দেন এবং ফজলুল হক ও তাঁর সমর্থকদের আইনসভায় নির্বাচিত করে পাঠান। কিন্তু ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে ফজলুল হক এই পরিকল্পনা নিয়ে আর বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেননি। যদিও ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের সংশোধনের ফলে কৃষকেরা কিছু সুযোগসুবিধা পান, তা হলেও তাঁদের আর্থিক দুর্গতির কোনো লাঘব হয়নি। তাতে রাইয়তদের অনেকটা সুবিধা হলেও খেতমজুর, ভাগচাষি ও উঠবন্দি প্রজাদের কোনো সুবিধা হয়নি। যেহেতু কৃষক-প্রজা সমিতিতে জোতদার ও ধনী কৃষক শ্রেণির প্রাধান্য ছিল সেজন্য তারা সমিতির পরিকল্পনা কার্যকরী হতে দেয়নি। বাংলার মন্ত্রীসভার আর একটি প্রভাবশালী অংশ ছিল মুসলিম লিগ। এই মুসলিম লিগের নেতৃত্ব পরিচালনা করতেন জমিদার, জোতদার ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, আর তাঁদের স্বার্থ যুক্ত ছিল প্রচলিত ভূমি ব্যবস্থার সঙ্গে। তাঁরাও ফজলুল হককে বেশি দূর এগোতে দেননি। অবশ্য মুসলিম জনসাধারণের সমর্থন পাওয়ার উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝে মুসলিম লিগ নেতৃবৃন্দ জমিদারিপ্রথার অবসানের কথাও বলতেন। কিন্তু কার্যত ভূমি সংস্কারের জন্য কোনো গঠনমূলক উদ্যোগই তাঁরা গ্রহণ করেননি। তাঁদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের জন্য তাঁরা কেবলমাত্র ভূমিসমস্যাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। অন্যদিকে আইনসভার কংগ্রেস সদস্যরা এই প্রশ্ন সম্পর্কে নিস্পৃহ ছিলেন। এই অবস্থায় প্রচলিত ভূমি ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য কোনোই কার্যকরী পন্থা অবলম্বন করা হয়নি। তার ফলে গ্রামবাংলায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়।৭৮
(৩) কৃষক সভার ভূমিকা : বাংলায় কৃষক বিদ্রোহের এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে। সমগ্র অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে কৃষকেরা ও উপজাতীয় অধিবাসীরা অসংখ্য প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে। তা সত্ত্বেও কৃষকদের একটি পৃথক সংগঠনে সংঘবদ্ধ করার প্রচেষ্টা দীর্ঘকাল হয়নি। অবশ্য ১৯২০-১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলার কয়েকটি অঞ্চলে পৃথকভাবে কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট কর্মীরা কৃষকদের সংগঠিত করতে চেষ্টা করেন। খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব কৃষকদের ওপর পড়ায় কংগ্রেস কর্মীদের একটি অংশ তাদের সংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ও পরে (চম্পারণ সত্যাগ্রহ, ১৯১৭-১৯১৮ খ্রি. কয়রা আন্দোলন, ১৯১৮ খ্রি.) এবং অসহযোগ আন্দোলনের সময় (১৯২০-১৯২২ খ্রি.) কৃষকেরা জেগে ওঠে ও কংগ্রেসের ডাকে সাড়া দেয়। এমনকি ১৯৩০-১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দেও কংগ্রেসের আইন অমান্য আন্দোলনে কোনো কোনো স্থানে কৃষকেরা সাড়া দেয় এবং সক্রিয়ভাবে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে প্রাণ পর্যন্ত দান করে। প্রসঙ্গত হাসনাবাদ অঞ্চলে কৃষকদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করা যায়। কিন্তু কৃষকের শ্রেণিস্বার্থ উপেক্ষা করায় কংগ্রেস নেতারা আর বেশিদূর এগোতে পারলেন না। বস্তুত, কংগ্রেস নেতারা কৃষকদের জন্য পৃথক একটি শ্রেণিসংগঠন গড়ারও কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। ফলে, কৃষকেরা নিরাশ হয়, জাতীয় আন্দোলনের নেতাদের ওপর আস্থা হারায়। বাংলার কংগ্রেসে জমিদার শ্রেণির বিশেষ প্রভাব ছিল। তাই দুই-একটি জেলা ছাড়া কৃষকদের মধ্যে কংগ্রেসের প্রত্যক্ষ প্রভাব কোথাও ছিল না। এই কারণে কংগ্রেস বাংলার কৃষকদের মধ্যে চেতনা জাগাতে পারেনি।৭৯
শ্রেণিস্বার্থ সম্বন্ধে চেতনা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষকদের মধ্যে সংঘবদ্ধ হওয়ার আগ্রহ দেখা যায়। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের পরই নদিয়া, ত্রিপুরা, নোয়াখালি ইত্যাদি জেলায় বিক্ষিপ্তভাবে কৃষক আন্দোলনের উৎপত্তি হয় এবং স্থানীয়ভাবে কৃষক সমিতি গঠিত হয়। পরবর্তীকালে আর্থিক সংকট ও কৃষি সংকট বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধনের ফলে বাংলায় কৃষকদের অসন্তোষ ও প্রতিরোধ বৃদ্ধি পায়। অন্ধ্রদেশে রাইয়ত সভা (১৯২৮ খ্রি.), বিহারে স্বামী সহজানন্দের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন (১৯৩৪-১৯৩৫ খ্রি.), যুক্তপ্রদেশে কৃষক সংঘ (১৯৩৫ খ্রি.), পাঞ্জাবে কৃষক সংগঠনের তৎপরতা এবং বাংলার বাইরেও কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা পরিষদের কয়েক জন মেম্বারকে নিয়ে কৃষক দল (১৯৩৫-১৯৩৬ খ্রি.) ইত্যাদি প্রচেষ্টাকে কৃষকদের সংগঠিত করার সুনির্দিষ্ট প্রয়াস বলে উল্লেখ করা যায়।৮০
এইসব বিক্ষিপ্ত ও খন্ড খন্ড আন্দোলনকে একটি বিরাট দেশব্যাপী আন্দোলনে পরিণত করার জন্য প্রথম চেষ্টা হয় মিরাটে (জানুয়ারি, ১৯৩৬ খ্রি.)। সেই চেষ্টার প্রত্যক্ষ ফল হল ‘নিখিল ভারত কৃষকসভা’। এই সভার জন্মের পরই বাংলার জন্য একটি কৃষক সংগঠন সমিতি করে দেওয়া হয়। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে কলকাতায় সংগঠন সমিতির অধিবেশন বসে এবং বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। এই সভাতেই বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার জন্ম হয়। বলা বাহুল্য, বাংলার কমিউনিস্টদের উদ্যোগেই এই কৃষকসভার প্রতিষ্ঠা হয়। এই সভার উদ্দেশ্য ও স্লোগান ছিল নিখিল ভারত কৃষকসভার মতোই। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে বাঁকুড়া জেলার পাত্রসায়র গ্রামে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভার প্রথম সম্মেলন হয়।৮১ তখন থেকেই কমিউনিস্টরা বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারিপ্রথা উচ্ছেদের দাবিতে জোরালো আন্দোলন শুরু করেন। প্রকৃতপক্ষে বাংলার কমিউনিস্টরাই এই বিষয়ে সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও কার্যসূচি গ্রহণ করে প্রচারের ও পুস্তিকার মাধ্যমে জনমত গঠনে সচেষ্ট হন। যদিও তাঁরা বাংলার বিভিন্ন জেলায় কৃষকের চেতনার মান উন্নত করতে সক্ষম হন, তবুও ব্যাপক জনসাধারণের ওপর কংগ্রেসের ও মুসলিম লিগের প্রভাব হ্রাস করে তাঁরা বাংলার রাজনীতিকে এক নতুন পথে চালিত করতে পারেননি।৮২
(গ) বাংলার জমিদার ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মনোভাব (১৯৩৮-১৯৪০ খ্রি.) :
প্রজা-লিগ মন্ত্রীসভা জমিদারিপ্রথা উচ্ছেদের প্রশ্নটি সম্পর্কে নীরবতা অবলম্বন করলেও বাংলার কৃষকেরা এই দাবিতে জোরালো আন্দোলন শুরু করে। তার ফলে বাংলার মন্ত্রীসভাকে নীতি পরিবর্তন করতে হয়। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ৫ নভেম্বর বাংলা সরকার স্যার ফ্রান্সিস ফ্লাউডকে চেয়ারম্যান করে ভূমি রাজস্ব কমিশন নিয়োগ করে। বাংলার ভূমি ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক, বিশেষ করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিশ্লেষণ করে অভিমত প্রকাশ করতে এই কমিশনকে বাংলা সরকার নির্দেশ দেয়। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২১ মার্চ কমিশন তার রিপোর্ট সরকারের নিকট দাখিল করে। কমিশনের বেশিরভাগ সদস্য এই সিদ্ধান্তে আসেন, ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের যদি প্রয়োজনীয়তা থাকেও, এই ব্যবস্থা আর বর্তমান অবস্থার সঙ্গে খাপ খায় না। তাঁরা বলেন, জমিদারিপ্রথার এত ত্রুটি দেখা দিয়েছে যে, এই প্রথা আর কোনো জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে সক্ষম নয়। সুতরাং, কমিশন ক্ষতিপূরণ সহ জমিদারিপ্রথার উচ্ছেদ এবং ভাগচাষি বা আধিয়ারদের জন্য ফসলের তিন ভাগের দু-ভাগ দেওয়ার সুপারিশ করে। এই বিষয়ে কমিশনের মন্তব্য থেকে কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হল :
No half measures will satisfactorily remedy its defects. Provided that a practicable scheme can be devised to acquire the interests of all classes of rent-receivers on reasonable terms, the policy should be to aim at bringing the actual cultivators into the position of tenants holding directly under Government. We recognise that this proposal involves a fundamental change in the rural economy of Bengal, affecting vitally the whole social and economic structure of the province, that it can only be carried out gradually over a term of years, and that it would be a most formidable administrative undertaking, which will tax to the full all the resources of Government.৮৩
এখন প্রশ্ন হল এই রিপোর্ট সম্পর্কে বাংলার ভূস্বামী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি কী মনোভাব ব্যক্ত করেন? তাঁরা কি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উচ্ছেদের দাবি সমর্থন করেন? ভূমি রাজস্ব কমিশন জমিদারদের ও কৃষকদের সংগঠনের, বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিদের এবং কয়েক জন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণ করে। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সরকার ছ-খন্ডে কমিশনের যে-রিপোর্ট প্রকাশ করে, তাতে যে প্রচুর তথ্য প্রকাশিত হয় তা থেকে জানা যায় জমিদারদের প্রতিষ্ঠানসমূহ—বঙ্গীয় প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভা, বঙ্গীয় ব্রাহ্মণসভা, ময়মনসিংহের মিডল ক্লাস পিপলস অ্যাসোসিয়েশন, ঢাকার পিপলস অ্যাসোসিয়েশন, খুলনার পিপলস অ্যাসোশিয়েশন এবং কলকাতা হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি স্যার নলিনীরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, রায়বাহাদুর জে এন গুপ্ত, রায়বাহাদুর কে পি মৈত্র ও রায়বাহাদুর জে এন সরকার প্রভৃতি ভূমি রাজস্ব বিশেষজ্ঞরা সবাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উচ্ছেদের বিরোধী ছিলেন। তাঁরা এই আশঙ্কা করেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উচ্ছেদ হলে আধুনিক বাংলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়বে। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের সেন্সাসের কথা উল্লেখ করে তাঁরা একথাও বলেন, জমিদারিপ্রথার অবসান হলে ছোটো-বড়ো এক কোটি পঞ্চাশ লক্ষ জমির মালিক (সমগ্র জনসংখ্যা ছিল পাঁচ কোটি) ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। এই ব্যবস্থা বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বুনিয়াদকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করবে। সুতরাং, সমগ্র প্রদেশের পক্ষেই এই ব্যবস্থা ভীষণ ক্ষতিকারক হবে।৮৪
অন্যদিকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভা, ঢাকা ডিস্ট্রিক্ট মুসলিম ফেডারেশন, রাজসাহি মহমেডান অ্যাসোসিয়েশন, ময়মনসিংহের আঞ্জুমান-ই-ইসলামিয়া, নদিয়ার আঞ্জুমান ইত্তেফাক-ই-ইসলাম, বাখরগঞ্জ ডিস্ট্রিক্ট প্রজা পার্টি ও নিখিল বঙ্গ কৃষক-প্রজা সমিতির সম্পাদক এবং কলকাতা হাই কোর্টের অ্যাডভোকেট ড. নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত ও হাই কোর্টের সিনিয়র সরকারি উকিল ড. শরৎচন্দ্র বসাক জমিদারিপ্রথা অবসানের দাবি করেন।৮৫ কিন্তু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সমগ্র জনসংখ্যার মধ্যে কতজন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষে ও বিপক্ষে ছিলেন তা যদি বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষের পাল্লাই ছিল ভারী। প্রকৃতপক্ষে কলকাতার ও মফসসলের বার অ্যাসোসিয়েশন এবং বিভিন্ন জেলার জমিদারদের সংগঠন ছিল বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের প্রভাবশালী অংশ।৮৬
.
৬১. The Bengalee, 17 January, 1906, p. 3
৬২. J C Jack, Survey and Settlements Operations in the Binkerganj District, 1900-1908, Calcutta, 1915; মুজফফর আহমদ, সমকালের কথা, কলিকাতা, ১৯৬৩; আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, কলিকাতা, ১৯৭০; Sumit Sarkar, The Swadeshi Movement In Bengal (1903-1908), New Delhi, 1973; বাঙালি বুদ্ধিজীবী, তৃতীয় অধ্যায়; সিরাজুল ইসলাম, ‘পত্তনিপ্রথা ও মধ্যস্বত্ব সমস্যা’, প্রবন্ধ, ইতিহাস সমিতি পত্রিকা, ঢাকা, তৃতীয় ও চতুর্থ সংখ্যা, ১৩৮১-৮২ বাংলা সন। J C Jack-এর জরিপ (১৯০০-১৯০৮) থেকে বাখরখঞ্জের মধ্যস্বত্ব সমস্যার একটি তথ্যবহুল চিত্র পাওয়া যায়। মধ্যস্বত্বপ্রথা সামন্ততান্ত্রিক উপকরণসমূহ টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে কতটা সহায়ক ছিল তা এই জরিপ থেকে পাওয়া যায়। (দ্র J C Jack. op. cit.)
৬৩. RAB 1922-23, Calcutta, 1924, pp. XV, xxiv; The Calcutta Municipal Gazette, June, 1925; RAB, 1923-24, Calcutta 1925, Part I, pp. i-iii; Maulana Abul Kalam Azad, ‘A study of Deshbandhu Das’, an article in Forward, Saturday, 18 July 1925, p. 10; Maulavi Abdul Karim, Letters On Hindu-Muslim Pact, Calcutta, 1924; R C Majumdar, History of Freedom Movement in India, vol. III, Calcutta 1963, pp. 220, 281-281; মুজফফর আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা, ১৯৬৫, পৃষ্ঠা : ৩৬৩-৩৬৪; আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর।
মৌলানা আজাদ তাঁর প্রবন্ধে বিস্তারিতভাবে হিন্দু-মুসলিম প্যাক্টের পটভূমিকা আলোচনা করেন এবং তখন চিত্তরঞ্জন কী ধরনের চিন্তা করেন সে-বিষয়েও নতুন আলোকপাত করেন। আজাদ লেখেন, ‘এই প্যাক্টের শর্তাবলি রচনার সময়ে চিত্তরঞ্জনের মনে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না।’ মুজফফর আহমদ লেখেন, ‘কংগ্রেস কর্মীসহ বেশির ভাগ হিন্দুরা এই প্যাক্টের বিরোধী ছিলেন।’ ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণনগরে প্রাদেশিক সম্মেলনের সময়ে তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই প্যাক্টের প্রতি মুসলমানদের মনোভাব কীরকম ছিল, সে-বিষয়ে আলোচনা করেন মৌলবি আবদুল করিম।
৬৪. Forward, Wednesday, 26 August, 1925, p. 3; Forward, Sunday, 27 March, 1927, p. 17; Rajen Sen (compiled). Deshabandhu Chittaranjan Das, A Collection of Deshbandhu’s Speeches, vol. 1 Calcutta, 1927.
The members of the committee set up by the Swaraj Party for its tenancy programme were; (1) Rai Harendranath Choudhury (24 Parganas, Hindu Rural), (2) Rai Satyendranath Choudhury Bahadur (Barisal, Hindu Rural), (3) D N Roy, Bar-at-Law (Jessore, Hindu Rural), (4) N C Chunder, Attorney-at-Law (Calcutta, Hindu Urban), (5) Jogendra Chandra Chakraborty (Dinajpur, Hindu), (6) Rajibuddin Tarafdar (Bogra, Mahomedan), (7) Kader Bux. (Dinajpur, Mahomedan), (8) Hemanta Kumar Sarkar (Nadia, Hindu)
৬৫. ‘Tenancy Bill’, editorial article in Forward, Tuesday, 24 November, 1925, p. 4; ‘The situation in East Bengal’, an article in Forward, Saturday, 23 April, 1927 p. 4; see also Files of Forward (1924-1927); Files of Atmashakti (1926-27); আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, পৃষ্ঠা ৪৫-৫৫; মুজফফর আহমদ, প্রবন্ধ সংকলন, কলিকাতা, ১৯৭০।
স্বরাজ্য পার্টি পরিচালিত দুটি কাগজ ছিল—ইংরেজি দৈনিক ফরওয়ার্ড ও বাংলা সাপ্তাহিক আত্মশক্তি। অনেক বিষয়েই এই দু-টি কাগজের সঙ্গে মুজফফর আহমদ সম্পাদিত গণবাণী নামক বাংলা সাপ্তাহিক কাগজের তীব্র মতবিরোধ ছিল। সাম্প্রদায়িক বিরোধের মূলে যে অর্থনৈতিক কারণসমূহ ছিল তা মুজফফর আহমদ বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন। প্রধানত অর্থনৈতিক কারণেই সাম্প্রদায়িক বিরোধ দেখা দেয়, গণবাণী এই মন্তব্য করায় ‘The Situation in East Bengal’ নামক প্রবন্ধে ফরওয়ার্ড তার সমালোচনা করে। ভূমি ও সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন সম্পর্কে মুজফফর আহমদ যেসব মতামত ব্যক্ত করেন তার সমালোচনা ফরওয়ার্ড ও আত্মশক্তি উভয় কাগজই করে। এই বিতর্কে কবি নজরুল ইসলাম মুজফফর আহমদ-এর পক্ষ অবলম্বন করেন এবং আত্মশক্তি-র সম্পাদকের নিকটে এক দীর্ঘ পত্র পাঠিয়ে ফরওয়ার্ড ও আত্মশক্তি কাগজের ভূমিকার সমালোচনা করেন। ভূমিসমস্যার ও সাম্প্রদায়িক প্রশ্নের প্রতি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মনোভাব কী ছিল সে-বিষয়ে এই বিতর্ক নতুন আলোকপাত করে। এই সময়ে মুজফফর আহমদ বাঙালি জীবনের ওপর ভূমিসমস্যার প্রভাব আলোচনা করেন এবং জমিদারিপ্রথার অবসান দাবি করেন। (দ্র মুজফফর আহমদ, প্রবন্ধ সংকলন ; আত্মশক্তি সম্পাদকের নিকটে লিখিত নজরুলের পত্র ৮ ভাদ্র, ১৩৩৩ বাংলা সন)।
৬৬. Bengal Council; Its Work by Whip, an article in Forward, Sunday, 13 April, 1924, p 11
৬৭. ‘Middle-class Unemployed’, an article in Forward, 12 April, 1924, p. 4
৬৮. Files of Forward (1924-1925)
৬৯. Forward, Sunday, 22 November, 1925, p. 3; অতুলচন্দ্র গুপ্ত, জমির মালিক, কলিকাতা, ১৩৫১, পৃষ্ঠা ১১-১২
The programme adopted by the Deshabandhu Village Reorganisation Fund Committee, started by the Bengal Provincial Congress Committee from September 1925, was: to open day and night schools, medical relief centres, Charkha spinning centres, arbitration board for settlement cases, agricultural co-operative and credit societies, and co-operative purchase and sale societies. (vide Forward, 22 November, 1925).
৭০. মুজফফর আহমদ, সমকালের কথা, পৃষ্ঠা ১১৯; মুজফফর আহমদ, প্রবন্ধ সংকলন, পৃষ্ঠা ৭৪-৭৫, ২০৬
৭১. Pattabhi Sitaramayya, The History of the Indian National Congress (1885-1935), vol. I, Allahabad, 1935, p. 517. মূল প্রস্তাবটি এখানে উল্লেখ করা হল।
At the Gauhati Session it was laid down that the Congress shall:
‘take steps to improve the condition of agricultural tenants by introducing and supporting measures to secure fixity of tenure and other advantages with a view to ensure a speedy amelioration of the condition of the tenants; and generally, protect the rights of Labour, agricultural and industrial, and adjust on an equitable basis the relations between landlords and tenants, capitalists and workmen.’ (Ibid)
৭২. অতুলচন্দ্র গুপ্ত, জমির মালিক, পৃষ্ঠা ১১-১২ Report, vol. I, pp. 28-29 ; PBLC 1925-1928, ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে হাই কোর্ট ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের প্রজাস্বত্ব আইনের সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে। তার ফলে স্যার জন কের-এর সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি একটি বিল রচনা করে এবং ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে পেশ করে। সেখান থেকে বিলটি সিলেক্ট কমিটিতে প্রেরণ করা হয়। তারপরে একটি ছোটো কমিটিতে তা যায় এবং সেই কমিটি ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে রিপোর্ট পেশ করে। অবশেষে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে সংশোধনী আইনটি পাস হয় (দ্র. Report I; PBLC)
৭৩. অতুলচন্দ্র গুপ্ত, জমির মালিক, পৃষ্ঠা ১১-১২; বাঙালি বুদ্ধিজীবী, পৃষ্ঠা ৩২৬
৭৪. অমলেন্দু দে, পাকিস্তান প্রস্তাব ও ফজলুল হক, কলিকাতা, ১৯৭২, প্রথম অধ্যায় (এরপরে পাকিস্তান প্রস্তাব নামে উল্লেখ করা হবে)।
৭৫. ওই
৭৬. ওই
৭৭. ওই, পরিশিষ্ট ‘ক’ (পৃষ্ঠা ২৪৪-২৪৬), প্রথম অধ্যায়; আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর; Humaira Momen, Muslim Politics in Bengal A study of Krishak Praja Party and the Elections of 1937, Dacca, 1972
৭৮. PBLA (1937-1947); PBLC (1937-1947); S C Mukherjee, The Law Relating to Usury and Interest in Bengal, Calcutta 1941; মুজফফর আহমদ, নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা ; আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর ; মুজফফর আহমদ, প্রবন্ধ সংকলন ; পাকিস্তান প্রস্তাব ; বাঙালি বুদ্ধিজীবী, ৩, ৬। ৩২৭ ; বদরুদ্দীন উমর, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলাদেশের কৃষক, ঢাকা, ১৩৭৯, পৃষ্ঠা ৩৭-৪১, ৪৪
৭৯. কৃষক কর্মীদের শিক্ষা-কোর্স, কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস, রাজনীতি, সংগঠন, কলিকাতা, ১৯৪৩ (বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভা কতৃক প্রকাশিত), পৃষ্ঠা ৮, ১১ (এরপরে শিক্ষা-কোর্স এই নামে উল্লেখ করা হবে)
৮০. ওই পৃষ্ঠা ৯
৮১. মুজফফর আহমদ, কৃষক সমস্যা, কলিকাতা, ১৯৩৭; শিক্ষা-কোর্স, পৃষ্ঠা ৯; মুহম্মদ আবদুল্লাহ রসুল, কৃষকসভার ইতিহাস, কলিকাতা, ১৩৭৬ বাংলা সন।
৮২. মুজফফর আহমদ, কৃষক সমস্যা, Memorandum Submitted to Floud Commission by the Bengal Provincial Kisan Sabha, in Report, vol. VI, Alipore, 1941, pp. 3-72 ; শিক্ষা-কোর্স ; মুহম্মদ আবদুল্লাহ রসুল, কৃষক সভার ইতিহাস, কলিকাতা, ১৩৭৬ বাংলা সন ; মুজফফর আহমদ, নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা, পৃষ্ঠা ৩৪৪-৪৫ ; ৩৫১-৩৬১, ৩৯৫-৪০০ ; Sunil Kumar Sen, Agrarian Struggle in Bengal, 1946-47, New Delhi, 1972 ; বদরুদ্দীন উমর, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলাদেশের কৃষক। ১৯২০-১৯২১ খ্রিস্টাব্দে মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতচর্চার সূত্রপাত। তখন থেকেই কৃষক সমস্যার প্রতি মার্কসবাদীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় এবং তাঁরা এই সমস্যার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। একথা অনেকেই জানেন যে, কৃষকদের শ্রেণিভিত্তিক সংগঠিত করার ব্যাপারে মুজফফর আহমদ এক বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। নন কো-অপারেশন আন্দোলনের পরে কংগ্রেস কর্মীদের একটি অংশ কৃষক ও প্রজা আন্দোলনের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করেন। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত লেবার স্বরাজ পার্টি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই পার্টির মুখপত্র ছিল বাংলা সাপ্তাহিক লাঙল এবং কবি নজরুল ইসলাম ছিলেন এর প্রধান পরিচালক। নজরুলের বন্ধু মণিভূষণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন এর সম্পাদক। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর লাঙল-এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। কৃষকের ও শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষা করাই ছিল এই পত্রিকার মুখ্য উদ্দেশ্য। নজরুলের বিখ্যাত কবিতা ‘সাম্যবাদী’ ও ‘কৃষকের গান’ এই কাগজেই প্রকাশিত হয়। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বঙ্গীয় কৃষক-শ্রমিক দল স্থাপনের চেষ্টা হয়। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে নিখিল বঙ্গীয় প্রজা সম্মিলনের দ্বিতীয় অধিবেশন নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর শহরে অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে ‘বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দল’ (The Bengal Peasants’ and Workers’ Party) গঠিত হয়। এই দল কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। লেবার স্বরাজ পার্টি এই দলের সঙ্গে মিশে যায়। বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দল প্রতিষ্ঠায় যাঁরা অগ্রণী ছিলেন : মুজফফর আহমদ, আবদুল হালিম, কুতবুদ্দীন আহমদ, শামসুদ্দীন হুসয়ন, শামসুদ্দীন আহমদ, সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমন্তকুমার সরকার, ড. নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, অতুলচন্দ্র গুপ্ত এবং কবি নজরুল ইসলাম। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে সারা ভারত মজুর ও কৃষক দল গঠিত হয় The All-India Workers’ and Peasants’ Party। এই সময়ে কৃষক ও শ্রমিক ফ্রন্টে কর্মরত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত। এই সময়ে ভূস্বামীরা কোনো কাগজের নাম লাঙল হোক তা পছন্দ করেননি। এমনকী তাঁরা কৃষক ও শ্রমিক দলের আবির্ভাবকেও স্বাগত জানাননি। তৎকালীন বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানসিক গড়নের একটি সুস্পষ্ট ছবি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পথের দাবী উপন্যাসের সব্যসাচী ও কবি শশী এই দুই চরিত্রের কথোপকথনের মধ্যে পাওয়া যায়। প্রধান চরিত্র সব্যসাচী শশীকে কৃষক ও শ্রমিকের জন্য গান রচনা না করে ‘শিক্ষিত ভদ্র জাতের’ জন্য গান রচনা করতে উপদেশ দেন (দ্রঃ পথের দাবী, অষ্টম সংস্করণ, পৃ: ৩৫৭)। এইভাবে শরৎচন্দ্র সব্যসাচী চরিত্রের মাধ্যমে নজরুলের ‘লাঙলের গান’-এর প্রতি কটাক্ষপাত করেন (কৃষকদের প্রতি বাঙালি ভদ্রলোকদের মনোভাবের বিস্তৃত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য মুজফফর আহমদ, কাজি নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা, পৃষ্ঠা ৩৯৬-৪০০)। সম্ভবত পরবর্তীকালে শরৎচন্দ্র তাঁর মনোভাব পরিবর্তন করেন। শরৎচন্দ্রের মৃত্যুর পরে তাঁর অপ্রকাশিত রচনা থেকে জানা যায়, তিনি মনে করেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তপ্রসূত জমিদারি, তালুকদারি ও অসংখ্য মধ্যস্বত্বভোগীদের কাজকর্মের ফলে সমগ্র বাংলার অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত হয়েছে (দ্র. সরোজ মুখার্জি, ‘শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’, প্রবন্ধ, গণশক্তি, সান্ধ্য দৈনিক, কলিকাতা, ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৫, পৃ: ২)।
দীর্ঘ ষোলো বছর বিদেশে কাটিয়ে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে ফিরে এসে ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত মার্কসবাদ প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা নেন। ভূমিসমস্যা, সমাজ ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে ভূপেন্দ্রনাথের চিন্তা তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত করে। তাঁর প্রভাবে অনেকেই কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯২৭-১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে প্রখ্যাত মার্কসবাদী লেখক রেবতী বর্মন তাঁর কাছ থেকে প্রথম মার্কসবাদের পাঠ নেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভের পর বঙ্কিম মুখার্জি কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করতে উদ্যোগী হন।
এই প্রবন্ধে পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় কৃষক আন্দোলন সুস্পষ্ট রূপ ধারণ করে। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ২৮ মার্চ পাত্রসায়রে কৃষকসভা সম্মেলনে ‘কৃষক সমস্যা’ নামক যে-ডকুমেন্ট সভাপতি মন্ডলীর পক্ষ থেকে মুজফফর আহমদ পেশ করেন তা উপস্থিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গৃহীত হয়। সভাপতি মন্ডলীর সদস্য ছিলেন : (১) বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়, (২) ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, (৩) সৈয়দ আহমদ খান (নোয়াখালি), (৪) নীহারেন্দু দত্ত মজুমদার এবং (৫) মুজফফর আহমদ (দ্র কৃষক সমস্যা)। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলন থেকে বঙ্কিম মুখার্জিকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২২ মার্চ কৃষকসভার পক্ষ থেকে ফ্লাউড কমিশনের নিকটে সাক্ষ্য দিতে যাঁরা যান : (১) বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়, (২) রেবতী বর্মন, (৩) মুহম্মদ আবদুল্লাহ রসুল এবং (৪) ভবানী সেন (দ্র. Report, vol. VI, op. cit., p-62)। ফ্লাউড কমিশনের নিকটে কৃষকসভার পক্ষ থেকে যে মেমোরেণ্ডাম পেশ করা হয় তার রচনায় রেবতী বর্মনের বিরাট ভূমিকা ছিল। কৃষক সমস্যা সম্বন্ধে রেবতী বর্মনের দুখানি গ্রন্থের কথা এখানে উল্লেখ করা হল : কৃষক ও জমিদার (১৯৩৮) এবং ভারতে কৃষকের সংগ্রাম ও আন্দোলন (১৯৩৮)।
১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে হুগলি জেলার বড়াগ্রামে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভার যে দ্বিতীয় সম্মেলন হয় সে-সম্মেলনের সভাপতি পরিষদের পক্ষ থেকে যে-প্রবন্ধ পাঠ করা হয় তার রচয়িতা ছিলেন রেবতী বর্মন। তাঁর এই প্রবন্ধটি ‘ভারতে কৃষকদের সংগ্রাম ও আন্দোলন’ নাম দিয়ে গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হয়। ভূমিসমস্যা নিয়ে গবেষণায় রত ব্যক্তিরা রেবতী বর্মনের গ্রন্থাবলি থেকে অনেক তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা পনেরো। (দ্র. রেবতী বর্মন লিখিত সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ গ্রন্থে মুজফফর আহমদ লিখিত ভূমিকা)।
বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ দৃঢ়তার সঙ্গে কৃষির আমূল পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে কৃষকের পাশে এসে দাঁড়ান। কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসচর্চা (historiography) আলোচনায় রত অনেক গবেষকদের রচনাতেই এঁদের উল্লেখ পাওয়া যায় না। আবার তাঁদের মধ্যে দু-এক জনের মন্তব্য থেকে এমন ধারণাও হবে যে, কৃষকসভা পরিচালিত আন্দোলনে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির কর্মীদেরই প্রাধান্য ছিল, প্রকৃত কৃষকের ভূমিকা ছিল অনেকটা গৌণ। কৃষকসভার তথ্যের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত তাঁদের পক্ষে এইসব মন্তব্য গ্রহণ করা কষ্টকর হবে। এইসব গবেষকেরা দুটো পয়েন্টের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে ভুলে যান, যথা— প্রথমত, কৃষক ফ্রন্টে নিযুক্ত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আগত নেতা ও কর্মী সারাক্ষণের শ্রেণিচ্যুত (de-classed) নেতা বা কর্মী ছিলেন। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক শ্রেণি থেকে অসংখ্য কৃষক নেতার ও কর্মীর আবির্ভাব ঘটে এবং প্রকৃতপক্ষে তাঁরাই ছিলেন কৃষকসভার প্রধান পরিচালিকা শক্তি। জনযুদ্ধ (সাপ্তাহিক) ও স্বাধীনতা (দৈনিক), এই দুটো কাগজের প্রতি সংখ্যায় এঁদের পরিচয় মিলবে (দ্র. জনযুদ্ধ, বাংলা সাপ্তাহিক, কলিকাতা, ১৬, ১৯৪২-১৯ এপ্রিল, ১৯৪৫ ; স্বাধীনতা, দৈনিক, কলিকাতা, ১৯৪৫-১৯৪৭ ; বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভা কর্তৃক প্রকাশিতপুস্তিকা)।
বাংলায় কৃষি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের দাবিতে কৃষকসভা যে-আন্দোলন শুরু করে তার প্রভাব কতটা বাংলার কৃষকের ওপর পড়ে তার কিছুটা পরিচয় কৃষকসভার সদস্যসংখ্যা থেকে পাওয়া যায় : ১৯৩৭-১০, ০৮০ সভ্য ; ১৯৩৮-৩৫, ৫০০ সভ্য ; ১৯৪৩-১, ২৪, ৮৭২ সভ্য (দ্র. শিক্ষা-কোর্স, পৃষ্ঠা ৫-১৬)।
৮৩. Report. vol. I, pp. 1, 3, 41-42
৮৪. Ibid, pp. 227, 231, 319, 337-341
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের সেন্সাসের কথা উল্লেখ করে রাধাকুমুদ মুখার্জি ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর নোটে লেখেন : ‘According to the Census Report, non-cultivating proprietors of land who receive rent in cash or kind number 7 lakhs 83 thousand. Each of these has to support a large number of working and non-working dependants, ranging from five to fifty in accordance with the size of his income. Considering that there are more than 1 lakh revenue-paying estates and 27 lakhs of tenures, the number of rent-receivers, the Zamindars, tenure-holders, and the rent-receiving raiyats, together with their dependants may be estimated at more than 1 crore 50 lakhs of people, or a third of Bengal’s total population’ (vide Report, vol. I pp 337-338)। এই তথ্য থেকে বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির আকৃতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা করা যায়।
৮৫. Report, vol. III-VI ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কে ড. নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের মতামতের জন্য নিম্নে উল্লেখিত তাঁর রচনাবলি দ্রষ্টব্য :
(১) Naresh Chandra Sen Gupta, ‘Land System of Bengal’, Calcutta, 1936 (Lecture delivered at the Indian Institue of Economics); (২) নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, ‘কর্নওয়ালিসি বেদ’, প্রবন্ধ, ভারতবর্ষ, ১৩৩০, ১১শ বর্ষ ১ম খন্ড, ১ম সংখ্যা ; (৩) নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, ‘জমিদারী বন্দোবস্ত’, প্রবন্ধ, ভারতবর্ষ, ১৩৩১, ১২শ বর্ষ, ১ম সংখ্যা ; (৪) নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, যুগ পরিক্রমা, ২য় খন্ড, কলিকাতা, ১৯৬১, পৃ: ২২০-২৩৪। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত রাজগী উপন্যাসে জমিদারিপ্রথার বিরুদ্ধে মনোভাব ব্যক্ত করেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত Land System of Bengal নামে যে-পুস্তিকা প্রকাশ করেন তাতে তিনি ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমিদারিপ্রথা অবসানের কথা বলেন (দ্র Land System of Bengal, p. 18)।
৮৬. Report, vol I, p. 233
বাঙালি বিজ্ঞানীদের মধ্যে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় একমাত্র ব্যক্তি যিনি জমিদারিপ্রথা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন এবং এই বিষয়ে নিজের মতামত ব্যক্ত করেন। তাঁর কয়েকটি রচনা এখানে উল্লেখ করা হল : (১) প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ‘প্রবাসী জমিদার ও দুরবস্থ পল্লী’, প্রবন্ধ, ভারতবর্ষ, ভাদ্র ১৩৪০, ১ম খন্ড, ৩য় সংখ্যা ; (২) প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ‘বাংলার জমিদার বর্গ’, প্রবন্ধ, ভারতবর্ষ, কার্তিক ১৩৪০ ; (৩) প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ‘বাংলার জমিদার বর্গ’, প্রবন্ধ, ভারতবর্ষ, পৌষ, ফাল্গুন, ১৩৪০, জ্যৈষ্ঠ ১৩৪১