চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উদ্দেশ্য
১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে কর্নওয়ালিশ যখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন তখন তিনি ধসে-পড়া প্রাচীন জমিদারদের তাঁর পন্থা অনুকরণে নির্ভরশীল সঙ্গী করতে ভরসা পাননি। সুতরাং, তিনি এমন এক নতুন জমিদার শ্রেণি তৈরি করেন যাঁরা জাতীয় ঐতিহ্য ও বিবেকের দ্বারা পরিচালিত নন। যাঁদের নিয়ে তিনি চিরকালের জন্য ব্রিটিশ শাসনের প্রয়োজনে কৃষির উন্নতির সম্ভাবনা অকেজো করে রাখতে পারবেন এবং যাঁরা সহজেই নিজেদের ব্রিটিশ শাসনের রক্ষাকারী একটি ভূম্যধিকারী শ্রেণিতে পরিণত করবেন। আর যাঁদের ওপর তিনি এই বিশ্বাস স্থাপন করতে পারবেন যে, তাঁরা দেশকে কৃষিমূলক স্তরে আবদ্ধ রাখবেন এবং স্বদেশি ব্যাবসা, বাণিজ্য ও শিল্প থেকে অধিকসংখ্যক মানুষকে সরিয়ে নিয়ে এসে সেই শূন্যস্থান ইংল্যাণ্ড ও বিদেশ থেকে আমদানি করা শিল্পজাত দ্রব্যে ভরে দেবেন।১ এই উদ্দেশ্য সামনে রেখেই কর্নওয়ালিশ ভূমির ওপর জমিদারদের সম্পত্তিগত অধিকার দান করেন। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণেই কর্নওয়ালিশ এই পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হন। খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উদ্দেশ্য ছিল : (১) সরকারি রাজস্বের নিরাপত্তা বিধান করা। (২) যাঁদের হাতে প্রচুর টাকা আসে, শহরের সেই নতুন গজিয়ে ওঠা ধনিক শ্রেণিকে জমিদারি ও অন্যান্য মধ্যস্বত্বের অধিকার ক্রয় করতে এই অর্থ নিয়োগে উৎসাহিত করা। ব্রিটিশ শাসক শ্রেণি, এই আশা পোষণ করেন যে, এইভাবে যদি কৃষির ক্ষেত্রে এই পুঁজি চালনা করা যায় তা হলে দুটো উদ্দেশ্য সাধন করা সম্ভব : (ক) ভারতবর্ষ একটি কৃষিমূলক দেশ হিসেবে ইংল্যাণ্ডের শিল্পের প্রয়োজনে কাঁচামাল সরবরাহ করবে এবং এই দেশ ইংল্যাণ্ডের শিল্পজাত দ্রব্যের বাজারে পরিণত হবে। (খ) এই ব্যবস্থা জমিদারদের তাঁদের জমিদারির উন্নতিসাধনে অনুপ্রাণিত করবে এবং তার ফলে কৃষির সংকটের সমাধান হবে।২ (৩) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে এমন এক জমির মালিক সৃষ্টি করা যাঁরা নিজেদের স্বার্থেই ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন এবং যাঁরা কখনোই ইংরেজ শাসনের পরিবর্তন কামনা করবেন না।৩
ইংরেজ শাসকেরা একথা বিশেষভাবে উপলব্ধি করেন যে, তাঁদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য এই ধরনের নতুন শ্রেণি তৈরি করার মাধ্যমে একটি নতুন সামাজিক ভিত্তি স্থাপন করা একান্ত প্রয়োজন। এই শ্রেণি যদি লুন্ঠনের একটি অংশ পায় (প্রথমে তাঁদের এগারো ভাগের এক ভাগ দেওয়ার কথা বলা হয়), তাহলে তাঁরা ব্রিটিশ শাসন সংরক্ষণের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন।৪ নি:সন্দেহে বলা চলে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উদ্দেশ্য ছিল বিপ্লবের প্রতিরোধ করা। এই কথা তো ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক নিজেই ব্যাখ্যা করে বলেন, যদি কখনো বিপ্লবের উত্তাল তরঙ্গে ইংরেজ শাসন টলমল করে ওঠে তখন এই জমিদার শ্রেণিই নিজেদের স্বার্থে এই শাসনকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসবেন। বেন্টিঙ্কের নিজের কথাই এখানে উদ্ধৃত করছি :
If security was wanting against extensive popular tumult or revolution, I should say that the Permanent Settlement, though a failure in many other respects and in most important essentials, has this great advantage at least, of having created a vast body of rich landed proprietors deeply interested in the continuance of the British Dominion and having complete command over the mass of the people.৫
পরবর্তীকালের ঘটনা থেকে আমরা বলতে পারি, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবক্তারা সঠিকভাবেই ঘটনার বিশ্লেষণ করতে পেরেছিলেন।
.
১. Census of India, 1951, vol. IV, pt. 1-a, p. 439
২. Minute of Lord Cornwallis, 3rd February, 1790, in The Fifth Report, vol. I, Madras, 1883, pp. 609-626; The Zamindary Settlement of Bengal. 2 vols. Calcutta, 1879; CD Field, Landholding and the Relation of Landlord and Tenant, Calcutta, 1883, chapter xxi; N K Sinha, Economic History of Bengal, vol. II. Calcutta. 1962, chapter VII; Bhowani Sen, Evolution of Agrarian Relations in India, New Delhi, 1962, p. 63
৩. Minute of Lord Cornwallis, 3 Feb. 1790, op cit. pp. 624-25
৪. Ibid ; R P Dutt, India To-Day, Bombay, 1947, p. 192