চিরব্যতিক্রমী
সিনেমায় অভিনয় শুরু করার আগে আমাদের সেই তরুণ বয়সে যখন হিন্দি সিনেমা দেখতাম, তখন নায়ক দিলীপকুমারকে বলা হত ‘ট্র্যাজেডি কিং’। বয়সে খানিকটা বড় স্বনিযুক্ত বিশেষজ্ঞরা এই বিশেষ উপাধির যে সব ব্যাখ্যা শোনাতেন, তা আমরা মেনে নিতাম। কারণ, সেই সময়ের হিন্দি সিনেমার প্রচুর ভাগ্য বিড়ম্বনা ও অপরিমেয় দুঃখসম্পৃক্ত চরিত্রগুলো দিলীপকুমার যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে তুলে ধরতে পারতেন। ওঁর অভিনয় করা ছবিগুলোর মধ্যে কোনটা প্রথম দেখেছিলাম তা আজ ঠিক মনে নেই, মনে হয় সেটা ছিল ‘দিদার’। ভারতীয় চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে যাঁদের পছন্দ করা হয় তাঁদের চেহারায় যে রমণীয় রূপ থাকে, দিলীপকুমারের চেহারা কখনও তেমন ছিল না। কিন্তু একই সঙ্গে এ কথা বলতে হবে, বাইরের লোক দেখানো রূপ অভিনেতা দিলীপকুমারের কাছে কখনও সমস্যা হয়নি। আমার ও আমাদের বন্ধুদের কাছে এই রূপময় প্রশ্ন কখনও বড় হয়ে ওঠেনি, সেই সময়ের মুসাফির দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। অকারণ আস্ফালন, প্রবল উচ্চকিত স্বরে সংলাপ বলার যে প্রবণতা হিন্দি সিনেমায় ছিল, সেখানে দিলীপকুমার মাত্র কয়েকজন ব্যতিক্রমীদের একজন। অন্যদের তুলনায় ঠান্ডা, চুপচাপ, কিন্তু কখনও দর্শকরা কেউই সেই চরিত্র থেকে চোখ সরাতে পারতেন না।
কিছুকাল পরে দেখেছি ‘দেবদাস’ এবং এখনও ভুলিনি। সেই সময়ে দিলীপকুমারের দেবদাস কিছুসংখ্যক বাঙালি দর্শকের পছন্দ হয়নি বলে শুনেছিলাম, তবে আমার ভালই লেগেছিল। স্বাভাবিকভাবেই প্রমথেশ বড়ুয়ার দেবদাস সামনে এসে হাজির হয়। আমার চোখে সেটা অন্যরকম ভাল। বড়ুয়া সাহেবের দেবদাস-এর প্রতি ইঞ্চি দুঃখী মানুষ, যেন সারাক্ষণই চরিত্রটি কষ্ট পাচ্ছে। তুলনায় দিলীপকুমারের দেবদাস সচেতন চরিত্র-চিত্রণ। সেই দেবদাস শান্ত, ধীরস্থির, গভীর দুঃখ এসে মানুষটির মধ্যে বাসা বেঁধেছে ঠিকই, কিন্তু তার কোনও অস্বাভাবিক অভিব্যক্তি নেই।
নিজে সিনেমায় অভিনয় শুরু করার পর দিলীপকুমারের ছবি তেমন নিয়মিত দেখা হয়নি। তবে ‘গঙ্গা-যমুনা’ ছবিতে দিলীপকুমারের অভিনয় দেখে চমৎকৃত হয়েছিলাম। জনপ্রিয় হিন্দি ছবি যেমন হয় ‘গঙ্গা-যমুনা’ তার ব্যতিক্রম কিছু নয়। সেখানে কাব্যময় দৃশ্যের পাশাপাশি মারদাঙ্গা-অত্যাচারও ছিল। দুটো দৃশ্য এখনও আলাদাভাবে মনে আছে। ভিলেন যখন নায়িকা বৈজয়ন্তীমালাকে ধর্ষণে উদ্যত, সেই সময়ে পরিত্রাতা হিসেবে হাজির দিলীপকুমার, তাঁকে যথারীতি হিন্দি ছবির একান্ত নিজস্ব স্টাইল অনুযায়ী পাহাড়ের ওপর থেকে গড়িয়ে এসে ভিলেনমশাইয়ের সঙ্গে লড়াই করে কাবু করে ফেলতে হল, প্রায় অনিবার্য বিপদ থেকে বাঁচানোর পর আশ্চর্য সুন্দর সংলাপ, তা মুগ্ধ করেছিল। একই ছবিতে গ্রামের জনপ্রিয় খেলা হিসেবে হাডুডু-তে অংশগ্রহণকারী দিলীপকুমারের খেলায় যে দৃপ্তভঙ্গি ছিল, তাতে দুর্লভ প্রাণশক্তির পরিচয় ছিল। অনেক পরে, নায়ক চরিত্র ছেড়ে বর্ষীয়ান চরিত্রাভিনেতা হিসেবে দিলীপকুমার একাধিক ভাল অভিনয়ের উদাহরণ পেশ করেছেন। সংযমী অভিনেতা হিসেবে তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা সেখানে লক্ষ্য করা গেছে। সেই ছবিগুলোর অধিকাংশই খুবই খারাপ ছবি, সিরিয়াস দর্শকরা এ ধরনের ছবির স্মৃতি মনে রাখতে চান না, কিন্তু দিলীপকুমার নিজের কাজে যে উঁচুমানের দক্ষতা দেখিয়েছেন তা যে কোনও অভিনয় শিক্ষার্থীর কাছে দুর্লভ অভিজ্ঞতা।
একটা সময়ে দিলীপকুমারের অভিনয় সম্পর্কে এক ধরনের মৃদু অভিযোগ ছিল যে, তিনি হলিউডের অভিনেতাদের দ্বারা বড় বেশিমাত্রায় প্রভাবিত, ম্যানারিজম ছাড়তে পারেন না কিছুতেই, ক্লোজ শটেও মুখের অভিব্যক্তিতে বাড়াবাড়ি করেন এবং সংলাপের শেষ দিকের কথা এমন মৃদু ভঙ্গিতে বলেন যে বোঝা যায় না (অভিনয় জগতের ভাষায়— কথা খেয়ে ফেলেন)। আমি নিজে এই সমালোচনার সঙ্গে একমত নই, কারণ এই বিশ্লেষণেই বেশ কিছুটা বাড়াবাড়ি আছে। সিনেমার অভিনয়ে অকারণে চড়া সুরে সংলাপ বলার কী প্রয়োজন? আজ জাতীয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার পেয়েছেন বলেই এ কথা লিখছি না, দিলীপকুমারের অভিনয়ের ভাল দিকগুলো প্রকাশ পেয়েছে এমন সুসম্পাদিত ক্যাসেট অভিনয় শিক্ষার্থীদের দেখানো উচিত হবে বহুকাল আগেই মনে করেছি। ব্যক্তিগত জীবনে দিলীপকুমারের চেয়ে স্বাভাবিক সৌজন্যের মানুষ আমি কমই দেখেছি। আমার সঙ্গে তাঁর প্রথম আলাপ হয়েছিল ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ রিলিজ করার পরে। কলকাতায় এসেছিলেন একটা ব্যক্তিগত কাজে, এসেছেন জেনেই বোধহয় তপনদা ইউসুফ ভাইকে ছবি দেখতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। পাশাপাশি বসে ছবিটা দেখেছিলাম। ছবি শেষ হওয়ার পর সৌজন্যমূলক প্রশংসা করেছিলেন, কিন্তু তার বেশি কিছু বলেননি। পরে বোম্বাইতে যখন ‘অভিযান’ রিলিজ করল, তখন তাঁকে একটু অন্যরকমভাবে নিজের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে দেখেছিলাম। ছবি শেষ হওয়ার পর অনেক দূর থেকে হাত তুলে এগিয়ে এসে প্রবলভাবে হাত ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘সৌমিত্র, আই উড হ্যাভ বিন প্রাউড টু ডু এ রোল লাইক দিস।’ পরে যখন যেখানে দেখা হয়, তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সৌজন্যে মুগ্ধ হই। ‘সাগিনা মাহাতো’র শুটিং করতে কলকাতায় এসে খবর পাঠিয়ে ডেকে আমার স্ত্রী দীপার ব্যাডমিন্টন খেলার দক্ষতার প্রসঙ্গ তুলে নিজের ফিটনেসের জন্য ব্যাডমিন্টন খেলার বন্দোবস্ত করতে অনুরোধ করেছিলেন এবং শুটিংয়ের ব্যস্ততার মধ্যে খেলেও ছিলেন। তাঁর সেই নিষ্ঠায় অবাক হয়েছিলাম। হঠাৎ দেখলে বোঝা যায় না, দিলীপকুমার ভারতীয় মানে রীতিমতো দীর্ঘদেহী, ব্যাডমিন্টন-ক্রিকেটসহ একাধিক খেলাধুলোয় তাঁর ভাল মানের দক্ষতা আছে। কথাও বলেন চমৎকার, একাধিক অনুষ্ঠানে ইংরেজি ও উর্দুতে তাঁর বক্তৃতার স্টাইল শ্রোতাদের প্রশংসা অর্জন করে। যাঁরা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁরা সকলেই জানেন ইউসুফভাই সত্যিই একজন বড় হৃদয়ের মানুষ। এমন মানুষকে সম্মানিত হতে দেখলে মন নিজে থেকেই খুশি হয়, আমিও তাই খুশি।