চিরঞ্জীব

চিরঞ্জীব

লোকটিকে দেখিয়া আড়াই শত বৎসর বয়স বলিয়া মনে হয় না। মনে হয়, বড় জোর যাট-বাষট্টি। লম্বা-চওড়া গড়ন, পাকা কাশীর পেয়ারার মতো গায়ের রঙ, গোঁফ ও গালপাট্টা বেশীর ভাগ পাকিয়া গিয়াছে। পৌরাণিক নাটকে পিতামহ ভীষ্মের ভূমিকায় লোকটিকে বেশ মানাইত। বৃদ্ধ বটে, কিন্তু কোথাও স্থবিরতার চিহ্ন নাই। প্রথম তাহাকে দেখিবার দুইটি কথা আমার মনে আসিয়াছিল: এক, লোকটি অনেক দূর হইতে আসিতেছে: দুই, লোকটির দেহ অত্যন্ত কঠিন স্থায়ী ধাতুতে নির্মিত। একবার দেখিয়া কেন এমন ধারণা হইয়াছিল জানি না—

কিন্তু গোড়া হইতে এই বিচিত্র মানুষটির কথা বলি।

পুণায় সিদ্ধিবিনায়ক গণপতির একটি প্রাচীন মন্দির আছে। পূর্বকালে মন্দিরের চারিপাশে প্রকাণ্ড দিঘি ছিল, পেশোয়ারা নৌকায় চড়িয়া দেব-দর্শনে আসিতেন। এখন দিঘি শুকাইয়া গিয়াছে, শুষ্ক খাদ পার হইয়া মন্দিরে যাইতে হয়। আমি পুণায় আসিয়া ডেরাডাণ্ডা ফেলিবার পর হইতে প্রতি চতুর্থী তিথিতে নিয়মিত গিয়া গণপতিকে প্রণাম করিয়া আসি।

বড় জাগ্রত দেবতা।

এবার আষাঢ় মাসের কৃষ্ণা চতুর্থী তিথিতে অপরাহ্নকালে মন্দিরে প্রণাম করিতে গিয়াছি, হঠাৎ সবেগে বৃষ্টি নামিল। ছাতা আনি নাই, পুণায় বর্ষাকালে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়, ছাতার দরকার হয় না। কিন্তু আজ অপ্রত্যাশিত ভাবে বজ্র বিদ্যুৎ ও বর্ষণের সমারোহ লাগিয়া গেল।

মন্দিরে আট্‌কা পড়িলাম। মন্দির-সংলগ্ন টিনের চালার নীচে বেঞ্চিতে বসিয়া বৃষ্টি ধরণের অপেক্ষা করিতে লাগিলাম।

চালার নীচে আরও কয়েকজন লোক আছে। অধিকাংশ স্ত্রীলোক; বেঞ্চির উপর পা তুলিয়া বসিয়া নিশ্চিন্ত মনে গল্পগুজব করিতেছে।

একটি পুরুষ চালার এক কোণে বসিয়া ছিল, এতক্ষণ তাহাকে ভাল করিয়া লক্ষ্য করি নাই। বৃষ্টির ছাট গায়ে লাগিতেছিল বলিয়াই সে উঠিয়া আমার পাশে বেঞ্চিতে বসিল। তাহার চেহারার বর্ণনা আগেই করিয়াছি; হাতে মোটা একটা লাঠি, পরিধানে খাটো ধুতি ও পুরা আস্তিনের মেরজাই, কাঁধে একটা মোটা কালো কম্বল; মস্তক নিরাবরণ। লোকটির কাপড়-চোপড় যদি গৈরিক রঙের হইত তাহা হইলে পরিব্রাজক সন্ন্যাসী মনে করিতাম।

টিনের চালার উপর বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ সমানে চলিয়াছে, ভিতরে অপরিচ্ছন্ন ময়লা আলো।

লোকটি কয়েকবার আমার দিকে কটাক্ষপাত করিয়া হঠাৎ মোটা গলায় প্রশ্ন করিল, ‘আপুনি কি বাঙালি বটে?’

আমার পাঞ্জাবি ও ধুতির কোঁচা দেখিয়া বুঝিয়াছে। বলিলাম, ‘হ্যাঁ। আপনি?’

সে বলিল, হ্যাঁ, আমিও বাঙালি। আপুনি কি পুণার বাসিন্দা বটে?’

বলিলাম, ‘হ্যাঁ। আপনি?’

‘আমি পরিব্রাজক ইতি-উতি ঘুরে বেড়াই।’ সে আমার দিকে ঝুঁকিয়া হঠাৎ প্রশ্ন করিল, ‘এখানে বিরিঞ্চি বর্মা নামে কাউকে আপুনি চিনেন নাকি?’

‘বিরিঞ্চি বর্মা! না, কখনো নাম শুনিনি। কে তিনি?’

‘দেখেন নাই? যখের মতো কালো লম্বা চেহারা, ড্যাবডেবে চোখ, একটা কান বড়, অন্য কানটা ছোট, বাঁ গালে কাটা ঘায়ের মতো লালচে একটা জড়ুল! দেখেন নাই তাকে?’

লোকটির কথা বলিবার ভঙ্গি একটু সেকেলে ধরনের, মনে হয় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষা শুনিতেছি! বলিলাম, ‘না, বিরিঞ্চি বাবা—থুড়ি—বিরিঞ্চি বর্মাকে আমি দেখিনি। আপনার আত্মীয়?’

লোকটার চক্ষু উত্তপ্ত হইয়া উঠিল—‘আত্মীয়! সে আমার ঘোর শত্রু, সর্বদা আমার সর্বনাশ করবার চেষ্টা করছে’—তারপর সুর বদলাইয়া বলিল, ‘এটা ১৮৭৯ শকাব্দ বটে?’

সম্প্রতি শকাব্দ লইয়া জ্যোতির্বিদ মহলে বিস্তর আলোচনা হইয়া গিয়াছে। বলিলাম, ‘হ্যাঁ, ১৮৭৯ শকাব্দ বটে। কেন বলুন দেখি?’

সে বলিল, ‘তাহলে নিশ্চয় তার দেখা যাব। এই বছরে সে আসে। কোথাও না কোথাও আছে, এবার দেখা হলে আর ছাড়ছি না।’

কেমন ধোঁকা লাগিল। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘শেষবার কত দিন আগে তাকে দেখেছেন?’

লোকটি বলিল, ‘১৭৭৯ শকাব্দে। সিপাহী যুদ্ধের সময়।’

কিছুক্ষণের জন্য গুম হইয়া গেলাম। মনের মধ্যে একটি আশঙ্কা অঙ্কুরিত হইয়া উঠিল—পাগল নয় তো? আড়চোখে তাহাকে নিরীক্ষণ করিলাম। বেশভূষা একটু অসাধারণ বটে, কিন্তু চোখের দৃষ্টি অত্যন্ত সহজ ও স্বাভাবিক। শুনিলাম সে কতকটা আপন মনেই বলিয়া চলিল—‘তখন আমি কাশীতে। একজন সিদ্ধপুরুষকে খুঁজতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ চতুর্দিকে আগুন জ্বলে উঠল। দাবানলের মতো।—আপুনি দাবানল দেখেছেন?’

‘না।’

‘বনে আগুন লাগে। গ্রীষ্মকালে শুকনো গাছের ডালে ডালে ঘষা লেগে দপ্ করে আগুন জ্বলে ওঠে, তারপর আগুন এক গাছ থেকে লাফিয়ে অন্য গাছে যায়; সারা বন জ্বলে ওঠে। কাঁচা গাছও পুড়ে ছাই হয়ে যায়—’

‘মাফ করবেন, আপনার নামটি কি?’

‘নাম? চিরঞ্জীব সিংহ।’

‘নিবাস?’

‘আদি নিবাস রাঢ় দেশ।’

‘বয়স কত?’

চিরঞ্জীব সিংহ এদিক ওদিক দৃষ্টি ফিরাইয়া অন্যমনস্কভাবে বলিল, ‘বয়স? কে জানে…অক্ষয় তৃতীয়ার দিন জন্ম…আমার জন্মদিনে একটা বট গাছ পোঁতা হয়েছিল, সেটা এখন দু’বিঘে জমির ওপর ছড়িয়ে গেছে—’

‘আপনার আত্মীয়স্বজন?’

‘কেউ নেই, সব মরে গেছে।’

‘যাক। তা কাশীর কথা কি বলছিলেন?’

‘হ্যাঁ—কাশীর কথা।’—

চিরঞ্জীব ক্ষণেক চিন্তা করিল—‘কাশীতে অনেক বনেদী বেশ্যা আছে।’

লোকটির কথা বলিবার বিচিত্র ভঙ্গি, এক কথা বলিতে বলিতে হঠাৎ অন্য কথা বলিতে আরম্ভ করে।

বলিলাম, ‘কাশীতে বনেদী বেশ্যা থাকতে পারে, আমি জানি। কিন্তু আপনি বলছিলেন, সিদ্ধপুরুষের খোঁজে কাশী গিয়েছিলেন, হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠল।’

‘হ্যাঁ—আগুন জ্বলে উঠল, লড়াইয়ের আগুন। মারামারি কাটাকাটি। কোম্পানীর লোক সিপাহীদের মারে, সিপাহীরা কোম্পানীর লোকদের মারে। দিল্লী আগ্রা কাশী গয়া মৃজাপুর, সব শহরেই রক্তারক্তি কাণ্ড। তখন জানতাম না যে বিরিঞ্চি এর মধ্যে আছে। জানলে কি আর হাতিয়ার না নিয়ে রাস্তায় বেরুতাম!’

‘বিরিঞ্চি লোকটা কে?’

‘লোকটা শয়তান, সাক্ষাৎ পাপের অবতার। যেখানে ঝগড়া বিবাদ, যেখানে বেইমানি বিশ্বাসঘাতকতা, সেখানে সে আছে। মানুষের দুঃখ নিয়ে তার কারবার, মানুষের দুর্গতি নিয়ে তার ব্যবসা। মূর্তিমান শনি, মূর্তিমান রাহু।’

চিরঞ্জীব উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে দেখিলাম, ‘তারপর কাশীতে কি হল?’

সে কিছুক্ষণ চোখ বুজিয়া রহিল, তারপর বলিল, ‘বিকালবেলা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি সামনে একদল কোম্পানীর পল্টন আসছে। সঙ্গে দুটো লালমুখো গোরা—আর বিরিঞ্চি। বিরিঞ্চির পরনে ফৌজী পোষাক।

‘আমাকে দেখে বিরিঞ্চি চিৎকার করে উঠল, গোরা দুটোকে খাটো গলায় কি বলল, তারপর তলোয়ার উঁচিয়ে আমার দিকে তেড়ে এল।

‘গোটা চার-পাঁচ সিপাহীও তার সঙ্গে হা-রে-রে-রে করে তেড়ে এল। আমার হাতে হাতিয়ার নেই, কি করি? পাশে একটা সরু গলি ছিল, ঢুকে পড়লাম।

‘জানতাম না যে গলিটা কানা গলি; দু’পাশে বেশ্যাদের বাড়ি। বিরিঞ্চি আর সিপাহীরা পিছনে হৈ হৈ শব্দে ছুটে আসছে। বাড়িগুলোর দরজা জানলা পটাপট্‌ বন্ধ হয়ে গেল।

‘সবশেষে যে বাড়িটা গলির মুখ বন্ধ করে রেখেছে, তার সদর দরজার মাথার ওপর বারান্দা বেরিয়ে আছে, বাঈজী সেখানে বসে বেসাতি করে। আমার আর পালাবার রাস্তা নেই, আমি বন্ধ দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়ালাম।

‘গলি এত সরু যে দু’জন লোকের বেশী পাশাপাশি আসতে পারে না। দেখলাম আগে আগে বিরিঞ্চি আর একজন সিপাহী ছুটে আসছে, তাদের পিছনে আরও তিন-চার জন।

‘একটা সুবিধা, ওরা আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে মারতে পারবে না। কিন্তু ওদের হাতে তলোয়ার, আমার হাত খালি। খালি হাতে তলোয়ারের সঙ্গে কে লড়তে পারে?

‘ওরা যখন প্রায় আমার নাগালের মধ্যে এসে পড়েছে, তখন ওপরের বারান্দা থেকে একটা মেয়ে সামনে ঝুঁকে চিৎকার করে বলল, “এই নাও তলোয়ার, বিদেশী কুত্তাগুলোকে মেরে তাড়িয়ে দাও।”

‘তলোয়ার লুফে নিলাম। তখন আর আমাকে মারে কে?’

‘বিরিঞ্চি আর সিপাহীরা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, তারপর সাবধানে এগিয়ে আসতে লাগল। বিরিঞ্চি হিংস্র জন্তুর মতো দাঁত বার করে রইল।

‘লড়লাম ওদের সঙ্গে। কিন্তু আমি একা। ওরা সামনের দু’জন পিছু হটে তো আর দু’জন এগিয়ে আসে। ক্রমে আমার হাতের তলোয়ার বোঝার মতো ভারী হয়ে উঠল।

‘এই সময় হঠাৎ পিছনের দরজা খুলে গেল। আমি দরজায় পিঠ দিয়ে হাঁপাচ্ছিলাম, ভিতরে পড়ে গেলাম। অমনি দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল।

‘বেশ্যা মেয়েটা আমার প্রাণ বাঁচিয়ে দিল।

‘বিরিঞ্চি আর সিপাহীরা দরজা ভাঙবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি। শেষ পর্যন্ত গালাগাল দিতে দিতে চলে গেল।’

এই পর্যন্ত বলিয়া চিরঞ্জীব চুপ করিল।

বৃষ্টির বেগ যেন একটু কমিয়াছে, কিন্তু অন্ধকার কমে নাই; মেঘের অন্তর পথে সূর্যাস্ত হইয়াছে।

আমি বলিলাম, ‘তারপর?’

চিরঞ্জীব বলিল, ‘তারপর বিরিঞ্চির আর দেখা পাইনি।’

প্রশ্ন করিলাম, ‘আপনাকে যে তলোয়ার দিয়েছিল সে কে?’

‘সে ও বাড়ির বেশ্যা…তার নাম ছিল শিউ মোহিনী…চার বছর তার সঙ্গে ছিলাম। সে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছিল।’

‘তারপর?’

‘তারপর সে মরে গেল। আমিও আবার বেরিয়ে পড়লাম।’

কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলাম, ‘কিছু মনে করবেন না। আপনি যা বললেন তা থেকে মনে হয়, একশো বছর আগে, সিপাহী যুদ্ধের সময় আপনি বেঁচে ছিলেন; এখনো দিব্যি বেঁচে আছেন। মাঝের এই একশো বছর আপনি কোথায় ছিলেন, কি করছিলেন?’

আমার প্রশ্নের মধ্যে যে স্পষ্ট শ্লেষ ছিল তাহা সে ধরিতেই পারিল না, সহজভাবে বলিল, ‘নেপালে গুরুর আশ্রমে থাকতাম আর ইতি-উতি ঘুরে বেড়াতাম। কত রদ-বদল দেখলাম। মোগল গেল, লালমুখো ফিরিঙ্গি এল; এখন আবার ফিরিঙ্গি গিয়ে কালো চামড়া এসেছে। কিন্তু বিরিঞ্চিকে খুঁজে পাচ্ছি না।’

‘বিরিঞ্চি হয়তো মরে গেছে।’

চিরঞ্জীব মাথা নাড়িল, ‘না, সে আছে। সে না থাকলে মন্বন্তর আসবে কোথা থেকে? বুঝতে পারছেন না, সে শয়তান। একশো বছর অন্তর ভারতে মহাদুর্যোগ আসে, তখন সে মাথা তোলে। এই ভারতেই কোথাও সে পাপের বিষ ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এবার আমি তৈরি আছি, এবার তাকে ছাড়ছি না।’ বলিয়া কালো মোটা লাঠিটা তুলিয়া ধরিল।

‘লাঠি দিয়ে বিরিঞ্চিকে ঠেঙিয়ে মারবেন?’

‘কেবল লাঠি নয়। এই দেখুন—’ চিভঞ্জীব লাঠির মুঠ ধরিয়া ঘুরাইল। ভিতরে লিকলিকে লম্বা তলোয়ার রহিয়াছে। গুপ্তি লাঠি।

লোকটা সদ্য মানুষ কিংবা পাগল কিংবা গঞ্জিকা-বীর ঠিক ধরিতে পারিতেছি না। যদি গঞ্জিকা-বীর হয়, আমাকে বোকা বানাইয়া দিয়া চলিয়া যাইবে! দেখি, জেরা করিয়া যদি ফাঁদে ফেলিতে পারি।

বলিলাম, ‘সিপাহী যুদ্ধের সময় যখন বিরিঞ্চির সঙ্গে দেখা হয়েছিল তখন তাকে দেখেই চিনেছিলেন! তার মানে, আগে থাকতেই তাকে চিনতেন!’

সে বলিল, ‘চিনতাম বৈকি। বিরিঞ্চিকে কি আজ থেকে চিনি!’

‘তার আগে কবে তাকে দেখেছিলেন?’

‘কেন, ১৬৭৯ শকাব্দে, পলাশীর যুদ্ধের সময়। বিরিঞ্চি ছিল ক্লাইভের তেলেঙ্গি সিপাহীদের দলে। আর আমি—’

উঠিয়া পড়িলাম।

চিরঞ্জীবকে ফাঁদে ফেলা আমার কর্ম নয়, এইভাবে পিছাইয়া পিছাইয়া হয়তো কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে গিয়া ঠেকিবে।

এদিকে বৃষ্টিও থামিয়া আসিয়াছে। চলিয়া আসিবার সময় একটি শ্লেষ-বাণ নিক্ষেপ করিবার লোভ সংবরণ করিতে পারিলাম না—‘আচ্ছা, আজ আসি। আবার ১৯৭৯ শকে দেখা হবে।’

চিরঞ্জীবকে গঞ্জিকা-বীর বলিয়া মন হইতে সরাইয়া দিয়াছিলাম। কিন্তু সম্প্রতি একটু গণ্ডগোল বাঁধিয়াছে। কিছু বুঝিতে পারিতেছি না। সত্যই কি—?

পুণা ভারতের একটি সামরিক কেন্দ্র। এখানে যেসব রথী মহারথী আছেন, তন্মধ্যে বাঙালির সংখ্যা খুব অল্প নয়। আমি পুণায় আসার পর তাঁহাদের কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় হইয়াছে।

চিরঞ্জীবের সহিত দেখা হইবার মাসখানেক পরে মেজর গাঙ্গুলীর বাড়িতে চায়ের জলসা ছিল। বিকালবেলা গিয়াছি। দেখিলাম ত্রিশ-চল্লিশ জন সপত্নীক অফিসার সমবেত হইয়াছেন। কয়েকজন অবাঙালীও আছেন।

একটি লোককে দেখিয়া স্তম্ভিতবৎ দাঁড়াইয়া পড়িলাম। গৃহস্বামীনী শীলা দেবী পরিচয় করাইয়া দিলেন—‘ইনি কর্নেল ভার্মা, কয়েকদিনের জন্যে কাশ্মীর থেকে এসেছেন।’

যখের মতো কালো লম্বা চেহারা, ড্যাবড়েবে চোখ, একটা কান ছোট একটা কান বড়, বাঁ গালে কাটা ঘায়ের মতো রক্তাভ জড়ুল। পরিধানে ফৌজী পোষাক নয়, সাধারণ বিলাতি পোষাক। বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ।

আমার মুখ দিয়া বাহির হইয়া গেল, ‘আপনার নাম কি বিরিঞ্চি বর্মা?’

কর্নেল ভর্মা ঈষৎ ভ্রূ তুলিলেন, ‘হ্যাঁ। আপনি জানলে কি করে?’

বলিলাম, ‘চিরঞ্জীব সিংহর মুখে আপনার নাম শুনেছি।’

কর্নেল ভর্মার মুখে দ্রুত একটা পরিবর্তন হইল; ভদ্রতার মুখাশ ছাড়িয়া দাঁতগুলা হিংস্রভাবে বাহির হইয়া আসিল, চোখ দু’টাতে গরিলার মতো নিষ্ঠুর কুটিলতা ফুটিয়া উঠিল। তিনি একবার চারিদিকে ক্ষিপ্র দৃষ্টি ফিরাইয়া চাপা কর্কশ স্বরে বলিলেন, ‘চিরঞ্জীব! কোথায় সে?’

বলিলাম, ‘এখানে নেই, মাসখানেক আগে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সে আপনাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছিল।’

কর্নেল ভর্মা ক্রূর মর্মভেদী দৃষ্টিতে আমার পানে চাহিয়া রহিলেন, তারপর হঠাৎ পিছু ফিরিয়া অন্যত্র প্রস্থান করিলেন।

আমি মোহাচ্ছন্নের মতো দাঁড়াইয়া রহিলাম।

চমক ভাঙিলে মনে হইল কর্নেল ভর্মাকে আরও দু’ একটা প্রশ্ন করিলে ভাল হইত। অতিথিদের মধ্যে তাঁহাকে খুঁজিলাম, কিন্তু দেখিতে পাইলাম না।

মেজর গাঙ্গুলী বলিলেন, ‘কর্নেল ভর্মা এইমাত্র চলে গেলেন। তাঁকে আজ রাত্রেই কাশ্মীর ফিরে যেতে হবে।’

১৯ বৈশাখ ১৩৬৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *