1 of 2

চিরকুমারী – সন্তোষকুমার ঘোষ

চিরকুমারী – সন্তোষকুমার ঘোষ

এক

উইন্ডস্ক্রিন বেয়ে দরদর ধারায় জল ঝরছিল। কিছু দেখা যায় না। ওয়াইপারটাকে সবেগে চালিয়ে দিল পূর্ণেন্দু, তাতে নিয়মিত গতিতে যান্ত্রিক গোঙানির মতো একটা অস্পষ্ট আওয়াজই সৃষ্টি হল শুধু, অস্পষ্টতা বাড়ল বই কমল না।

পকেট থেকে রুমাল বের করল পূর্ণেন্দু, কাচ ভিতর থেকে ঘষল। একবার ভাবল গাড়িটা দাঁড় করাই, বৃষ্টির কতদূর দৌড়, খানিক দেখি। কিন্তু মন সায় দিল না, অতএব ইঞ্জিনটাকে সচল রাখতেই হল। বৃষ্টি পড়ছে, ফিনকি দিয়ে জল ছিটকে পড়ছে দু-পাশে—পূর্ণেন্দু বুঝতে পারছিল। রাস্তার দু’-পাশের নালায় যেন ঢল নেমেছে। যে-গাছগুলো ভুতুড়ে প্রহরীর মতো, তারা দু-ধার থেকে ঝুঁকে পড়ে নিজেরাই চুলোচুলি করে মরছে।

এই দুর্যোগ যে নামবে, বেরোবার একটু আগেও যদি তার আভাস পাওয়া যেত! তখন আকাশ ছিল খটখটে—হঠাৎ ঝড়-জল পিছে-পিছে ধাওয়া করে এসে যেন তাকে ধরে নিল।

এখন অন্ধকার, অপরিচিত গন্তব্য, গাড়িতে সে একা। পূর্ণেন্দু একবার শিউরে উঠল। শোঁ-শোঁ হাওয়া বইছে। সেই শীতে, না ভয়ে? পূর্ণেন্দু নিজেকে তিরস্কার করল। পুলিশ অফিসার—হলেই বা জুনিয়র—এই অহেতুক ভয় তাকে মানায় না। আর, সে না এক ভয়ার্ত মহিলাকে অভয় দিতে চলেছে? নিজেই যে ভয়ে জড়োসড়ো, সে অভয় দেবে কাকে? কী করে?

বস্তুত আজকের এই দায়িত্ব পূর্ণেন্দুর মোটে মনঃপুত ছিল না। এই ঠান্ডায় খিচুড়ি জমত বেশ। অবশেষে গভীর ঘুম। কিন্তু পুলিশের কাজে সে-সুখ কপালে নেই।

পাশের জানালা দিয়েও জল পড়ছিল চুঁইয়ে-চুঁইয়ে। পূর্ণেন্দু থেকে-থেকে কেঁপে উঠছিল। মানে হয় না, একটি টেলিফোনে উড়ো খবর পেয়ে তাকে ঝড়-জলের এই সন্ধ্যার পথে ঠেলে দেওয়ার কোনও মানে হয় না। ‘হে ভবেশ, হে শঙ্কর, সবারে দিয়েছ ঘর, আমারে দিয়েছ শুধু পথ’—পূর্ণেন্দু একবার স্কুলে-পড়া কবিতাটার অংশ মনে-মনে আবৃত্তি করল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

কে এই কমলা দেবী—যিনি বড়সাহেবকে আজ ফোন করেছিলেন?—’আমার বিপদ আসন্ন, একটা অঘটন কিছু ঘটবে আমার মন বলছে, কাউকে পাঠান।’

সে যেন আসবে, আমার মন বলেছে! প্রিয় গানের কলিটি মনে পড়ে গেলে পূর্ণেন্দু হেসে ফেলল। মুখ ভেঙচে উচ্চারণ করল কথা কয়টি। কে জানে, ন্যাকা কোন স্ত্রী-লেখকের এই কারসাজি। হয়তো গিয়ে দেখা যাবে, কিছুই নয়, কমলা দেবী আসলে মৃগী রোগী, হিস্টিরিয়াগ্রস্ত, অথবা নার্ভাস, কিংবা পাগল। ভয়ের কোনও কারণই নেই।

যদি থাকেও, তাহলে? পূর্ণেন্দু—একা পূর্ণেন্দু কী করবে, করতে পারে! অন্যের প্রাণ বাঁচাবে সে, কিন্তু তার নিজের প্রাণ বাঁচায় কে। কোমরের কাছে রিভলভারটা একবার টিপে দেখল পূর্ণেন্দু, ঠিকই আছে। একটু যেন ভরসা পেল। না, অন্তত একজন সঙ্গী আছে।

কমলা, বিমলা, রমলা। আর—আর কে? সুব্রত। পূর্ণেন্দু মনে-মনে সাহেবের মুখে শোনা নামগুলো ঝালিয়ে নিচ্ছিল। ‘অনন্ত আলয়’—বাড়িটার নাম। তিন মহলা, প্রাচীন বাড়ি—অনন্ত রায়ের পৈতৃক ভদ্রাসন। এই পরিবারটি সাহেবের চেনা, অনন্ত রায় তাঁর বন্ধুস্থানীয় ছিলেন। তিনটি মেয়েকেই চেনেন তিনি। হয়তো তাই এই টান। টেলিফোন পেয়েই বিচলিত হয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন পূর্ণেন্দুকে।

বিমলা কিন্তু অনন্ত রায়ের মেয়ে নন—বিধবা বোন। তাঁর বয়সও অন্তত সত্তর-বাহাত্তর। চোখে কম দেখেন। কানে আদৌ শোনেন না। সাহেব পাখি-পড়ানোর মতো করে পূর্ণেন্দুকে মুখস্থ করিয়ে দিয়েছেন। বিমলা রায় বালবিধবা। কবে বিবাহ হয়েছিল আজ কারও তা মনেও নেই, সম্ভবত বিমলার নিজেরও না। বড়-বড় থাম, ফাঁকে-ফাঁকে পায়রার বাসার মতো বিমলাকেও সকলে ওই বিরাট নোনা-ধরা বাড়িটারই অংশ বলে ধরে নিয়েছে। সুব্রত সম্পর্কে বিমলার ভাশুরপো, আজ কয়েকবছর ধরে কাকিমার আশ্রয়েই আছে। কলেজের ছাত্র, স্পোর্টসে দক্ষ, আইন কলেজের খাতাতেও নাম আছে।

কমলা আর রমলা। কমলাই অনন্ত রায়ের মেয়ে—একমাত্র সন্তান। রমলা ভ্রাতুষ্পুত্রী। আশ্চর্য, দু-জনই অবিবাহিত। বিয়ে হয়নি কেন? এ-রহস্য সাহেব নিজেও ভালো জানেন না। দুজনকেই অনন্ত রায় লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন—বোধহয় কতকটা জেদ করে। বিয়ে যে দেননি, তা-ও বোধহয় জেদ। অনন্ত রায় অত্যন্ত একরোখা মানুষ ছিলেন। বড়লোকের মেয়ে—আজ দুজনেরই বয়স পঞ্চাশ পার হয়ে গেছে, তাদের ভাগ্য নিয়ে অনন্ত রায় নিষ্ঠুর খেয়ালের বশে এমন কাণ্ড করলেন কেন? বোন বিধবা হয়ে ফিরে এসেছিল, তার সেই চেহারা অনন্ত রায় সহ্য করতে পারতেন না—সেই ক্ষোভ কি গোটা বিবাহ-প্রথার ওপর দিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন?

এমনও হতে পারে, বড় ঘরের মেয়ে, মনোমতো পাত্র বাছাই করতে-করতেই কবে বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে।

কিন্তু ক্ষতি তো বিবাহ-প্রথার হল না, সমাজব্যবস্থারও না, তাঁর মেয়ে দুটিই চিরকুমারী হয়ে রইল। তীব্র একটা দীর্ঘনিশ্বাস বুকে চেপেই অনন্ত রায় মারা গিয়েছিলেন।

অবশ্য উইলে তিনি ভুল করেননি। বিধবা বোন আর কুমারী কন্যা দুটিকে সমান তিন ভাগে সম্পত্তি ভাগ করে দিয়েছিলেন। তিন মহল বিরাট প্রাসাদটিতেও তিনজনেরই সমান অধিকার।

বড়সাহেব পরিবারের ইতিহাসটা সবিস্তারেই বলে দিয়েছেন পূর্ণেন্দুকে। পূর্ণেন্দু মনে-মনে তাই ঝালিয়ে নিচ্ছিল, যাতে ওখানে পৌঁছে পরিস্থিতিটা বুঝে নিতে কোনও অসুবিধা না ঘটে।

অনন্ত রায়ের মৃত্যুর পরও তো প্রায় বিশ বছর কেটে গেছে। হঠাৎ এমন কী ঘটল, যাতে কমলা ব্যাকুল হয়ে টেলিফোন করলেন পুলিশের বড়সাহেবকে?

দুই

ঘসঘস শব্দ করে দেউড়ি পেরিয়ে পূর্ণেন্দুর গাড়ি দাঁড়াল। সাহেব পথের নিশানা ভালো করে বুঝিয়েই দিয়েছিলেন। প্রাসাদের বর্ণনাও। নারিকেল-সুপারি গাছের পাতার আড়ালে প্রায় ঢাকা-পড়া বাড়িটাকে দূর থেকে চিনতেও অতএব পূর্ণেন্দুর কোনও অসুবিধে হয়নি।

কিন্তু আলো নেই কেন?

পরপর কয়েকটা অন্ধকার খুপরি—এককালে হয়তো অতিথি-মহল ছিল। কিংবা মালি-ঠাকুর-চাকরদের আস্তানা। এখন তাদের চিহ্নমাত্র নেই। হয়তো অবস্থাতেও কুলোয় না।

সদর আর অন্দরমহলের মধ্যে প্রশস্ত অঙ্গন পড়ে আছে। কোনওকালে হয়তো বাগান ছিল। একটি ফোয়ারার চিহ্নাবশেষ এখনও দেখা যায়। কুন্দশুভ্র কোনও নগ্নিকা ঈষৎ নুয়ে পড়ে ঝারি থেকে জল ঢালছিল। এখন জল নেই, জল ঢালার ভঙ্গিটা শুধু আছে।

বৃষ্টি থেমে একটু মেঘ-ভাঙা জ্যোৎস্না ফুটেছিল, পূর্ণেন্দু তাই সবই অস্পষ্ট আবছায়াভাবে দেখতে পেল। শত অনাদরেও গোটা কয়েক পাম আর ঝাউ আজও মরেনি। তখনও থেকে-থেকে কনকনে ভিজে হাওয়া বইছিল।

একটা কুকুর হঠাৎ ডেকে উঠল, পূর্ণেন্দু চমকে উঠল, আর-একটু হলেই ফাটল ধরা সিঁড়িটার ফাঁকে-ফাঁকে অশ্বত্থের শিকড়ের জালে পা জড়িয়ে হোঁচট খেত।

ওই সিঁড়ির পরে ভারী কালো রঙের কাঠের কপাট। পা টিপে-টিপে উঠে পূর্ণেন্দু কপাট ঠেলল।

ভিতর থেকে বন্ধ।

ঘাড় উঁচু করে দেখল পূর্ণেন্দু, ওপরের কোনও বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়ে আলোর ক্ষীণ আভাসও যদি আসে।

আলো ছিল না। কাঠের জানালা নয়, খড়খড়িও নেই—কাচের শার্সি। বাইরের মরা-মরা জ্যোৎস্নায় ঝিকমিক করে উঠছিল। কিন্তু ভিতরের দিকে আলোর রশ্মিটুকুও ছিল না।

টর্চ জ্বালিয়ে দেখল পূর্ণেন্দু, যদি কপাটের গায়ে কড়া দেখতে পায়।

কড়াও ছিল না।

পূর্ণেন্দু তখন ভাবল, চেঁচিয়ে কাউকে ডাকবে কি না। পরক্ষণেই টের পেল, সে-চেষ্টাও নিষ্ফল হবে। এই ছমছমে আধো-অন্ধকার যে পাথরের মতো ভারী হয়ে সাহসকে নিঃশেষে পিষে মারে। কণ্টকিত শরীর শুধু অস্বস্তির পুঁটলি হয়ে ওঠে। এই অস্পষ্ট আলোকে বিশ্বাস নেই। এর যে-কোনও বিন্দু সহসা বিস্ফারিত হয়ে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে বিদীর্ণ হবে—পূর্ণেন্দু যেন তারই অপেক্ষা করছিল।

এই রহস্যপুরীর অধিবাসিনী কমলা রায় বৃথা ভয় পায়নি।

পূর্ণেন্দুর তখনই শিকলটা চোখে পড়ল। ভারী কপাটের কবজার ফাঁকে এই শিকলটা কেন, অথবা কোথায় গিয়েছে, এসব প্রশ্ন বিন্দুমাত্র বিচার না করেই পূর্ণেন্দু শিকল ধরে টানল।

আর সঙ্গে-সঙ্গে নিথর নিস্তরঙ্গ পরিবেশটা যেন সহসা আর্তনাদ করে উঠল। একটি গম্ভীর ঘণ্টাধ্বনি চমকিত করল প্রাসাদপুরীর অন্তঃপুর। দেয়ালে-দেয়ালে সেই ধ্বনি প্রতিহত হয়ে অসংখ্য প্রতিধ্বনির বুদ্বুদ সৃষ্টি করে ধীরে-ধীরে মিলিয়ে গেল।

কপাটজোড়া অল্প ফাঁক হল। অনেক দূর থেকে কে যেন প্রশ্ন করল, ‘কে?’

পূর্ণেন্দু বলে উঠল, ‘আমি।’—যদিও কথাটার কোনও মানে হয় না।

তবু ভরসা পেয়ে কপাট এবার একটু জোর দিয়ে ঠেলল পূর্ণেন্দু। মুহূর্ত পরেই টের পেল, সে এক প্রশস্ত আঙিনায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আঙিনার যেখানে শেষ, তার পরেই অপরিসর একটি দীর্ঘ বারান্দা, যার দু-ধারে মৃদু দীপের সারি।

যা-হোক, অন্দরমহলে তবু দেখছি আলো আছে! পূর্ণেন্দু অস্ফুট স্বরে স্বগতোক্তি করল।

সরু স্বল্পালোক প্যাসেজের শেষে দীর্ঘ একটি নারীমূর্তি। শুভ্রদেহ, শুক্লবাস—হঠাৎ মনে হতে পারত যে, এটিও কোনও মর্মরমূর্তি।

কিন্তু সেই নারীদেহ ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসছিল।

একেবারে কাছাকাছি এসে সে থমকে দাঁড়াল। তার ভ্র কুঞ্চিত হল : ‘কে? কে আপনি?’ জিজ্ঞাসা করল তীক্ষ্ন স্বরে।

সেই স্বর থেকে পূর্ণেন্দু অনুমান করল, বাইরে থেকেও সে এঁরই গলা শুনেছিল।

কার্ড বের করে পূর্ণেন্দু এগিয়ে দিল। মধ্যবয়সিনী মহিলা, চুলেও দু-একটি পাক ধরেছে।

‘কমলা দেবী?’ পূর্ণেন্দু জিজ্ঞাসা করল সাহসে ভর করে, ‘আপনিই কি পুলিশে ফোন করেছিলেন?’

মাথা নীচু করে সেই শীর্ণ শুভ্র মহিলা কার্ডটা পড়ছিলেন। তাঁর মুখ থেকে রূঢ়তার রেখা ক’টি ধীরে-ধীরে অপসৃত হচ্ছিল।

‘পুলিশ? আপনি পুলিশের লোক বুঝি?’ মহিলাটি বললেন, মৃদু স্বরে, ‘আসুন।’

বারান্দা পার হয়ে বসবার ঘর। সে-ঘরে প্রখর বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছে দেখে পূর্ণেন্দু আশ্বস্ত হল। সেকেলে রীতিতে সাজানো ঘর—আসবাবও দামি কিন্তু সেকেলে। ভারী একটা চেয়ারে বসে পূর্ণেন্দু বলল, ‘আপনিই ফোন করেছিলেন?’

‘ফোন?’ মহিলাটির কণ্ঠে বিস্ময় প্রকাশ পেল। বললেন, ‘ফোন আমি তো করিনি।’

পূর্ণেন্দু বলতে গেল, ‘কিন্তু কমলা দেবী—।’

‘ভুল করছেন, আমি কমলা নই। আমি রমলা।’

পূর্ণেন্দু সঙ্গে-সঙ্গে নিজের ভুলটা টের পেল। ইনি কমলা নন, রমলা। অনন্ত রায়ের ভ্রাতুষ্পুত্রী। চিরকুমারী দুটির অন্যতমা।

রমলা দেবী বললেন, ‘বসুন। কমলাকে খবর দিই।’

আকাশের মেঘের মতোই ভয় কেটে যাচ্ছিল পূর্ণেন্দুর মন থেকে। জানালার কাছে উঠে এসে সে এতক্ষণে একটা সিগারেট ধরাতে পারল। রেনকোটটা চুঁইয়ে জল পড়ছিল তখনও। পূর্ণেন্দু সেটাকে খুলে রাখল চেয়ারের হাতলে।

রমলা দেবীর ফিরতে একটু দেরি হল। হাতে চায়ের পেয়ালা। বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না। দেরি হয়ে গেল।’

ব্যস্ত-লজ্জিত হয়ে পূর্ণেন্দু হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আপনি নিজে কষ্ট করে—।’

রমলা দেবী বললেন, ‘ঠাকুর-চাকর দুজনেরই আজ ছুটি। বিকেলবেলাই শহরে গেছে, কী একটা হিন্দি ছবি এসেছে নাকি।’

ঠান্ডায় চা ভালোই লাগছিল পূর্ণেন্দুর, গলার ধরা-ধরা ভাব কেটে যাচ্ছিল। রমলা নিজের জন্যও এক পেয়ালা চা এনেছিলেন।

চায়ে চুমুক দিতে-দিতে রমলা বললেন, ‘কমলা আপনাকে ফোন করেছিল?’

‘আমাকে ঠিক না। বড়সাহেবকে।’

‘কী বলেছিল?’

একটু ইতস্তত করল পূর্ণেন্দু। সব কি খোলাখুলি বলা ঠিক হবে? টের পেল, উৎসুক রমলা ওর দিকে চেয়ে আছেন।

অগত্যা পূর্ণেন্দুকে বলতেই হল, ‘প্রাণের ভয়ে তিনি ভীত, সবসময়েই বিপদের আশঙ্কা করছেন।’

রমলার শঙ্খ-শুভ্র মুখে বিস্ময়ের ঢেউ বয়ে গেল। তিনি অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। চেয়ারটা ওঁর কাছাকাছি এগিয়ে নিয়ে গেল পূর্ণেন্দু : ‘রমলা দেবী বলতে পারেন, কমলা দেবীর ভয়ের হেতুটা কী।’

ঈষৎ ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন রমলা : ‘ঠিক জানি না।’

‘ভয়ের কি সত্যিই কোনও কারণ আছে?’

রমলা যেন ত্রস্ত হলেন। এদিক-ওদিক চেয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘আছে।’

‘কী ভয়, কীসের ভয় রমলা দেবী?’ পূর্ণেন্দু যেন ওঁকে আশ্বাস দিতেই আরও সন্নিহিত হয়ে এল।

দু-হাতে মুখ ঢাকা দিয়ে রমলা বলে উঠলেন, ‘পারব না, আমি বলতে পারব না। আপনি, আপনি বরং কমলাকেই জিজ্ঞাসা করবেন।’

‘কমলা দেবী কোথায়?’

‘ওপরে। ওর শোওয়ার ঘরে। বিকেল থেকেই বলছিল, মাথায় খুব যন্ত্রণা। শুয়ে পড়েছে।’

‘একবার যদি ওঁকে—’

‘আসুন না আপনি ওপরে।’

রমলা উঠে দাঁড়ালেন। রমলা কৃশকায়, বয়সের পক্ষে বেশ তাড়াতাড়িই সিঁড়ি ভেঙে উঠছিলেন, উঠছিল পূর্ণেন্দুও। শ্বেত পাথরের ধাপ, ধবধবে মসৃণ। রেলিং বরাবরও কোমর অবধি পাথর বসানো। ঠান্ডা। যেন অনেককালের জমানো বরফ এরই আড়ালে কোথাও স্তূপীকৃত হয়ে আছে।

দোতলার সিঁড়ির মুখেই আবার দীর্ঘ বারান্দা। একেবারে সামনের ঘরখানিতে কালো পুরু পরদা ঝুলছিল।

‘কমলার ঘর।’ রমলা বললেন ফিসফিস করে, ‘আপনি দাঁড়ান। আমি খবর দিই।’

পরদা ঠেলে রমলা ভিতরে ঢুকেছিলেন, কিন্তু বেরিয়েও এলেন প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে। আগের মতোই মৃদু গলায় বললেন, ‘এখনও ঘুমোচ্ছে। তুলে দেব?’

পূর্ণেন্দু যদিও অধীর হয়ে উঠেছিল, তবু তাকে বলতেই হল, ‘থাক না। না-হয় আর কয়েকমিনিট অপেক্ষাই করি।’

ব্যস্ত হয়ে পড়লেন রমলা : ‘দাঁড়িয়ে থাকবেন—সে কী! আসুন, আপনাকে বরং বড়পিসিমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। আমাদের পিসিমা বিমলা দেবী—এঁর কথা শোনেননি?’

পূর্ণেন্দু বলল, ‘শুনেছি।’

বারান্দার একেবারে শেষপ্রান্তে যে-ঘর, সেখানে আলো জ্বলছিল। রমলা দ্রুত পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেলেন। বললেন, ‘পিসিমার ঘর।’

হেঁট হয়ে পূর্ণেন্দু জুতো খুলছিল। কেন না সে দেখতে পেয়েছে, এ-ঘরের মেঝেও পাথরে বাঁধানো। প্রকাণ্ড ঘরখানারই একদিকে রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ, সামনে ধূপ-দীপ জ্বলছে। ধোঁয়ায় ঘরখানা মৃদু সুরভিত, ঈষৎ আচ্ছন্ন।

এ-ঘরে বিজলি আলো নেই, পূর্ণেন্দু লক্ষ করেছিল। পুরোনো আমলের বেলোয়ারি ঝাড়ে কয়েকটি মোমবাতিই জ্বলছিল। সেই আলোয় মেঝেয় আসন পেতে যিনি একটি বই পড়ছিলেন, তাঁরও গায়ের রং, পূর্ণেন্দুর মনে হল, মোমের মতো। সাদা, নিষ্প্রভ। এখান থেকে তাঁর শুভ্র কেশের কয়েকগুচ্ছই মাত্র দেখা যায়, আর দেখা যায় একটি ধারালো নাক, যার পাশের চামড়া কুঞ্চিত।

এই প্রাচীনপুরীর ইনিই বুঝি অধিষ্ঠাত্রী দেবী। এঁর বয়স কত, পূর্ণেন্দু অনুমান করতে পারল না। এই প্রায়-নিস্পন্দ সমাহিত দেহ কয়টি শরৎ আর বসন্ত দেখেছে? কতবার স্নান করেছে, বর্ষার নবধারা-জলে? সেই মুহূর্তে কেউ যদি বলত, উনি এই প্রাসাদপুরীরই সমবয়সী, পূর্ণেন্দু অবিশ্বাস করতে পারত না। একটি প্রাচীন বট, গভীর অরণ্য, অতল নদী বা অটল পাহাড় যেমন করে তার পত্র-প্রচ্ছায়ে, জলের তলায় বা নিঃসঙ্গ শিখরে কাল আর ইতিহাসকে ধরে রাখে, এঁর জ্ঞানে, স্মৃতিতে আর ব্যক্তিত্বে তেমনই যেন এই রহস্যপুরীর বহু কাহিনি সঞ্চিত আছে।

‘পিসিমা সবরকম আধুনিকতার বিরোধী’, রমলা দেবী বলছিলেন ফিসফিস করে, ‘তাই ওঁব ঘরে ইলেকট্রিক আলো পর্যন্ত লাগাতে দেননি। আজকাল আর চলাফেরা করতে পারেন না। তাই স্থাপিত বিগ্রহ শ্যামরায় আর রাধা-রানিকেও এনে বসিয়েছেন এই ঘরে। কানে ভালো শোনেন না, চোখের জ্যোতিও কম, তবু দেখছেন না—এখনও, এত রাত্রেও ভাগবত পুঁথিখানা খুলে রেখেছেন?’

দেখছিল, পূর্ণেন্দু অবশ্যই দেখছিল। এ-ঘরের পরদাটা থেকে-থেকে উড়ে ঘরখানাকে অনাবৃত করে দিচ্ছিল। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে যে-জরাজীর্ণ মহিলা বসে আছেন, তাঁর বসবার আড়ষ্ট ভঙ্গি ওর চোখ এড়ায়নি। ভালো করে এ-বয়সে উনি আর বসতেও পারেন না, সে সহজেই বুঝেছিল, নইলে আর পিঠের কাছে, ঘাড়ের কাছে বালিশগুলোই বা নেবেন কেন। ওঁর পাশেও তাকিয়া, যে-হাতে ভাগবতের পুঁথি সে-হাতটিও তাকিয়াতেই ন্যস্ত। পুঁথিটি সামনে একটি ডেস্কের ওপরে রাখা। চোখে পুরু চশমা।

যে-বিড়ালটি মাত্র বিঘতখানেক দূরে প্রসাদের থালা চাটছিল, তাকেও দেখতে পেয়েছিল পূর্ণেন্দু। সাহস তো কম নয় বিড়ালটার। ওই তো বিমলা দেবী মোটে আধহাত মাত্র দূরে—অথচ নির্ভয়ে প্রসাদে মুখ দিয়েছে?

পূর্ণেন্দু বিস্মিত হয়েছিল, কিন্তু বিস্ময়কে নিরস্ত করার যুক্তিও সে খুঁজে পেয়েছিল। নিষ্ঠা আর ভক্তি যতই থাক, আচারে যতই থাক আস্থা—নিঃসন্তান বালবিধবা আর চিরকুমারীদের একটি দুর্বলতার কথা সে জানে—জীবে মায়া। কুকুর-বিড়ালকে এঁরা ভালোবাসেন, আদর করেন। এই বিড়ালটির প্রতিও নিতান্ত মায়াবদ্ধ বলেই প্রশ্রয় না দিয়ে বিমলা দেবীর উপায় নেই। ইশারায় ওকে দাঁড়াতে বলে রমলা দেবী খালি পায়ে ঢুকলেন ঘরে। পূর্ণেন্দু দেখল চকিতে বিড়ালটা লাফ দিয়ে জানালায় গিয়ে উঠল। জোরে, প্রায় চেঁচিয়েই রমলা ডাকলেন, ‘পিসিমা!’

পূর্ণেন্দু স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল। প্রথমবার সাড়া পেলেন না রমলা, আবার ডাকলেন, ‘পিসিমা!’

এবার যেন দূর থেকে ক্ষীণ উত্তর ভেসে এল, ‘উঁ!’

‘আপনার পুজো সারা হয়েছে?’

‘একটু বাকি আছে।’

‘পিসিমা, আজ বাড়িতে একজন অতিথি এসেছেন।’

‘অতিথি? বেশ তো, আদর-যত্ন করো।’

‘পিসিমা, ইনি পুলিশের লোক।’

‘পুলিশ? পুলিশ কেন? সনাতন কি কিছু চুরি করে—।’

‘না-না। কমলা ওঁকে ডেকে এনেছে। কমলা ভয় পেয়েছে।’

‘ভয়? কমলা বড় ভিতু।’

‘কমলা এখনও কিন্তু ঘুমোচ্ছে। পিসিমা আপনি ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করবেন? ডেকে আনি?’

‘না-না। ডেকো না, পুজো এখনও সারা হয়নি। আর ওঁর জামাকাপড় কেমন কে জানে। যদি আ-ছাড়া হয়? আমি বরং—বরং পরে কথা বলব।’

‘পিসিমা আপনার বালিশগুলো সরে গেছে। ঠিক করে দিই?’

‘দাও।’

‘রাত্তিরে কী খাবেন, দুধ? এখানে পাঠিয়ে দেব?’

‘দিয়ো।’

‘সনাতন বাড়ি নেই। পরে এসে ও আলো নিবিয়ে দেবে, কেমন?’

‘বেশ।’

রমলা দেবী বেরিয়ে এলেন। পূর্ণেন্দুকে কিছু বলতে হল না। সব কথাই সে শুনেছিল। বিমলা দেবী অত্যন্ত ক্লান্ত, নির্জীব গলায় যে-কয়টি কথা বলছিলেন, তাও। কথা বলতে ওঁর অসুবিধা হয়, তা-ও বুঝেছিল পূর্ণেন্দু। ওঁর বুঝি উপরের পাটিতে দাঁত একটাও নেই। বারবার জিভ ঠেকাচ্ছিলেন তালুতে, তাতে কয়েকটি বিকৃত স্বরের সৃষ্টি হয়েছিল। ফোকলা দাঁতে বৃদ্ধ বয়সে যে-বাচনভঙ্গি হয়, হুবহু তাই।

রমলা বললেন, ‘এবার কমলার ঘরে যেতে পারেন। এতক্ষণে ও বোধহয় উঠেছে। তবে সাবধান।’

‘সাবধান কেন?’

রমলা হেসে বললেন, ‘কবিতা শুনিয়ে দিতে পারে। কমলা একজন মহিলা-কবি, জানেন না!’

পূর্ণেন্দু সসঙ্কোচে বলল, ‘কবিতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কম।’

‘থাকলেও জানতেন না। ওর কবিতা কোথাও ছাপা তো হয় না। সব ফেরত আসে। তবু লেখে। একবার ঘটা করে নিজেই খরচ করে একটা বই ছেপেছিল। কিছু বিলিয়েছে, কিছু পোকায় কেটেছে, কিছু পড়ে আছে এখনও নীচের গুদামঘরে। বিক্রি হয়নি।’

পূর্ণেন্দু বলল, ‘ও।’

‘এই অভ্যাস ও পেয়েছে জ্যাঠামশায়ের কাছ থেকে। জ্যাঠামশায়—মানে অনন্ত রায়েরও এই স্বভাব ছিল কিনা! তিনি অনেক ছড়া লিখেছিলেন, পালা বেঁধেছিলেন।’

পূর্ণেন্দু অবাক হয়ে বলল, ‘তাই নাকি! আমি তো জানি, উনি একজন শাঁসালো জমিদার—।’

‘সে তো পৈতৃক। পরে অবশ্য সম্পত্তির আয় আর পরিমাণ বাড়িয়েও নিয়েছিলেন। কিন্তু ওঁর ভিতরে একটি কবিও ছিল। প্রকৃতিতে খুব কোমল ছিলেন জ্যাঠামশাই। আমার বাবা ঠিক উলটো।’

এই পরিবারের বিচিত্র ইতিহাসের আরও কিছু জেনে নেবে বলে ঔৎসুক্য হয়েছিল পূর্ণেন্দুর, কিন্তু রমলা সে-অবসর দিলেন না : ‘আপনার নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে—যাই জলখাবার নিয়ে আসি।’ বলে তরতর করে নীচে নেমে গেলেন।

পূর্ণেন্দু আস্তে-আস্তে পরদা ঠেলল কমলার দরজার।

তিন

কমলা সত্যিই ঘুম ভেঙে উঠেছিলেন।

ছোট টেবিলটিতে বসে কী যেন লিখছিলেন, পূর্ণেন্দুকে দেখে লজ্জিত হেসে কাগজ লুকোলেন। পূর্ণেন্দু অনুমান করল, কবিতাই হবে।

কমলা ওঁকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। পূর্ণেন্দু দেখল, আকারে ইনিও রমলার মতোই দীর্ঘ হবেন, বর্ণেও গৌর, তবে রমলার মতো ফ্যাকাশে পাণ্ডুর নন। সবচেয়ে অবাক হল পূর্ণেন্দু কমলার চোখ দেখে। মণি দুটি কেমন যেন আবিল, আচ্ছন্ন। কমলা স্মিত মুখে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেই হাসির ভঙ্গি যেন কেমন অস্বাভাবিক।

রমলার গালের হাড় দুটি যেমন উঁচু কমলার তেমন নয়, কিন্তু চোখের কোলে কয়েকটি রেখা আর কালি।

কমলা বললেন, ‘আসুন আ-প-নি—।’

‘আমি পুলিশ থেকে আসছি। আপনি কি ক্যাপ্টেন চৌধুরীকে ফোন করেছিলেন?’

পলকে কমলার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল : ‘হ্যাঁ। ক্যাপ্টেন চৌধুরী আমার বাবার বন্ধু ছিলেন। বিপদে পড়ে—।’

পূর্ণেন্দু একটা কার্ড বাড়িয়ে দিল : ‘কমলা দেবী, আমি আপনার বিপদ দূর করতেই এসেছি। কী বিপদ, আমাকে একটু খুলে বলবেন?’

চোখে সেই অস্বচ্ছ বিহ্বল দৃষ্টি, কমলা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘আপনাকে কি বোঝাতে পারব আমি! এ বিপদ আছে আমার অনুভবে।’

ধোঁয়াটে কথা, পূর্ণেন্দু নিজেই বিপন্ন বোধ করল। প্রথম থেকেই তার যা মনে হয়েছিল ব্যাপারটা সত্যিই হয়তো তাই। ভদ্রমহিলা হয়তো অতিরিক্ত ভাবপ্রবণ—স্নায়বিক রোগগ্রস্ত, সহজেই ভীত, ত্রস্ত, বিহ্বল। এই জাতীয় কবিপ্রকৃতির মেয়েরা যা হয়ে থাকে। জিজ্ঞাসা করে বিশেষ ফল হবে না জেনেও সে বলল, ‘তবু যদি একটা আন্দাজ দেন!’

নেশাগ্রস্তের মতো কমলা কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইলেন। চোখ তুলে চেয়ে যখন কথা বলতে শুরু করলেন, পূর্ণেন্দুর চকিতে সন্দেহ হল, যেন কমলা নয়, যেন তার মুখ দিয়ে অন্য কেউ কথা কইছে।

ক্লান্ত, ভাঙা-ভাঙা গলায় কমলা বলছিলেন, ‘কী বিপদ, তা কি বলে আমি আপনাকে বোঝাতে পারব? আপনি কি টের পাননি? রমলা আপনাকে কিছু বলেনি? বিপদ এই বাড়ির নিশ্বাসে। এর প্রতিটি ইটের ফাটলের কনকনে বাতাসে।’

‘এ-ধারণা আপনার কেন?’

কমলা বললেন, ‘কী জানি কেন। হয়তো এই বাড়ির আয়ু পূর্ণ হয়ে গেছে। এর হয়তো এখন মৃত্যুই মঙ্গল। জানেন, নির্দিষ্ট আয়ুকে অতিক্রম করার চেষ্টাও করতে নেই। সেই চেষ্টাই বিপদ ডেকে আনে। সময় পূর্ণ হলে নীরবে চলে যাওয়াই ভালো। এই বাড়ির কাল পূর্ণ হয়ে গেছে। একে একদিন যেতেই হবে। একগুঁয়েমি করে আজও টিকে আছে। যেদিন যাবে, সেদিন এই মৃত্যু-ফাঁদে আমরা সবাই পিষে যাব, মরব।’

মন্ত্রমুগ্ধের স্বরে কমলা আবার বললেন, ‘আমরা সবাই মরব। জানেন, আমার কেবলই মনে হয় কোনও অশরীরী আত্মা ভর করেছে এ-বাড়িতে। চারদিকে খালি ফিসফিস শুনি। অলৌকিক সব কাণ্ড ঘটছে এখানে। সেদিন কী হয়েছে জানেন? বারান্দা দিয়ে সন্ধ্যার পর হাঁটছি। রমলার ঘরে স্পষ্ট শুনলুম, কারা যেন কথা কইছে। কারা? কান পাতলুম দরজায়। একটা গলা চিনতে পারলুম, পিসিমার। আর-একটা রমলার। আশ্চর্য, রমলার ঘরে পিসিমা নেই তো! ঠিক তখনই পিসিমার ঘরে সোজা গিয়ে ঢুকলুম। তিনি তো যেমন থাকেন, তেমনই পূজার আসনে বসে আছেন। জানেন, সেদিন থেকেই আমার দৃঢ়মূল বিশ্বাস হয়েছে যে, কোনও অশরীরী কাণ্ড এ-বাড়িতে ঘটছে। আরও ঘটবে। ভয় পেয়েছি কি সাধে!’

পূর্ণেন্দুর আর কিছু জিজ্ঞাসা করবার ছিল না। এই ভদ্রমহিলা অন্তত অংশত অপ্রকৃতিস্থ, এ-বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ আর ছিল না।

ঠিক তখনই নীচে কার প্রফুল্ল কণ্ঠস্বর শোনা গেল। সিঁড়ি দিয়ে শিস দিতে-দিতে কে যেন উঠছে। কমলা বললেন, ‘সুব্রত। পিসিমার ভাশুরপো। এই বুঝি ফিরল।’

সুব্রতর নাম আগেই শোনা ছিল পূর্ণেন্দুর। এবার চাক্ষুষ পরিচয় হল। কুড়ি কিংবা বাইশ বছরের যুবক। একটা নীল হাফ-শার্ট গায়ে, পরনে ট্রাউজার, কলেজের আর-দশজন ছাত্র যেমন হয়ে থাকে। একটা হকিস্টিক ছিল সুব্রতর হাতে, সেটাকে দরজার কোণে রাখতে-রাখতেই সে বলছিল, ‘ঝড়-জলে আটকা পড়ে গিয়েছিলুম।’ ঠিক তখনই তার চোখ পড়ল পূর্ণেন্দুর দিকে। সুব্রত অপরিচিত লোক দেখে থমকে দাঁড়াল।

কমলা পরিচয় করিয়ে দিলেন বটে, কিন্তু ভ্রুক্ষেপ যেন করল না সুব্রত। সে কমলার দিকেই চেয়ে-চেয়ে বলতে থাকল, ‘বড়দি, আমাকে পঞ্চাশটা টাকা দেবে?’

‘পঞ্চাশ টাকা, এত টাকা কেন?’

‘কলেজের সোশ্যাল হবে যে, ওরা সবাই ধরেছে।’

‘তোমার তো ফি-মাসেই একটা না একটা লেগে আছে। এত টাকা আসে কোথা থেকে শুনি!’

‘লেগে থাকবেই তো। আরও কত টাকার দরকার আমার জানো? নভেম্বরে সবাই মিলে এক্সকারশনে বেরুব। তখন আমার কিন্তু কমসে-কম তিনশো টাকা চাই, আগে থেকেই বলে দিচ্ছি।’ পরপর আরও কয়েকটা টাকার ফিরিস্তি দিল সুব্রত।

শেষ পর্যন্ত রাগ করে কমলা বলে উঠলেন, ‘আমাকে এসব কথা শুনিয়ে লাভ নেই, সুব্রত। তোমার আপন জ্যাঠাইমা আছেন, তাকে বোলো।’

কথা না বাড়িয়ে সুব্রত ভিতরের দরজা দিয়ে তার নিজের ঘরে ঢুকে গেল ‘যাই, চান করে আসি।’

‘চান করবি এই শীতে? তুই কি পাগল?’

‘ঘামে শরীর জবজবে হয়ে গেছে যে।’

সুব্রত চলে যেতে কমলা পূর্ণেন্দুর দিকে চেয়ে বললেন, ‘খালি টাকা আর টাকা। কোথা থেকে যে আসবে, ছেলেটা একেবারে বোঝে না। সম্বলের মধ্যে তো এই পৈতৃক বাড়ি। এটাকে বিক্রি করতে চাই—আমিও চাই, রমলাও চায়। কিন্তু পিসিমা চান না একেবারে। এই বাড়ি ছেড়ে এক পাও নড়বেন না। অথচ বাড়িটা বিক্রি করে ছোট একটা বাসায় যদি উঠে যাই—।’

একটু থেমে কমলা বললেন, ‘সুব্রতকে তাই তো বলি, তুমি বাপু তোমার নিজের জ্যাঠাইমাকে বলে-কয়ে রাজি করাও। পিসিমাই ওকে ছেলেবেলা এ-বাড়িতে এনে রেখেছেন কিনা! মানুষ করেছেন।’

রমলা দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন।

‘পূর্ণেন্দুবাবু, আপনার খাবার দেওয়া হয়েছে। একবার নীচে আসবেন?’

চার

নীচের ঘরেই পূর্ণেন্দুর বিছানা হয়েছিল। আজ রাত্রে রাস্তার যা অবস্থা, ফেরবার কথা মনে আনাও যায় না। তা ছাড়া কাল সকালে সে দিনের আলোয় বাড়িটাকে ভালো করে দেখবে, আরও খোঁজখবর নেবে বলে স্থির করে রেখেছিল।

দেওয়ালে কয়েকটা বাঘের মাথা আর হরিণের শিং সাজানো। তাদের ছায়া আরও বিস্তৃত হয়ে মেঝের কার্পেটে পড়েছিল।

ঘুম এসেছিল পূর্ণেন্দুর, কিন্তু রমলা ছোট একটি মোড়া পেতে বসেছিলেন ওর ঘরেই, মাথা নিচু করে উল বুনছিলেন। মাঝে-মাঝে কথাও বলছিলেন রমলা। এ-বাড়ির ইতিহাস। একদিন কত গৌরব, কী ঐশ্বর্য ছিল এই বাড়ির। শৌর্ষও কম ছিল না। রমলার বাবা ছিলেন মস্ত শিকারি—এই যে দেয়ালে বাঘের মাথা আর ভালুকের চামড়া—সব তারই স্মৃতি।

পূর্ণেন্দু জড়িত গলায় বলল, ‘ও।’ তার চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছিল।

আর ঠিক সেই মুহূর্তেই প্রচণ্ড একটা শব্দ হল। ঝনঝন করে ওপরের কোনও ঘরে যেন সব ক’টা শার্সি ভেঙে পড়ল।

পূর্ণেন্দু ধড়মড় করে উঠে বসেছিল। অভ্যাসবশতই সে হাত দিয়েছিল নীচের ব্রাকেটে, যেখানে রিভলভার গোঁজা আছে। উত্তেজিত স্বরে পূর্ণেন্দু বলে উঠল, ‘গুলির শব্দ।’

রমলার মুখ আতঙ্কে সাদা হয়ে গিয়েছিল। রমলা ঠকঠক করে কাঁপছিলেন। লোক-লজ্জা ভুলে পূর্ণেন্দুকে আঁকড়ে ধরতে চাইছিলেন।

পূর্ণেন্দু তাঁকে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। রিভলভারটা হাতে বাগিয়ে ধরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে। চাপা গলায় রমলাকে বলল, ‘আপনি আমার পেছনে-পেছনে আসুন।’

দোতলার বারান্দার রেলিং ধরে কাঁপছিলেন কমলাও। সুব্রত—মুখ রক্তিম, চুল বিশৃঙ্খল—বেরিয়ে এল বিমলার ঘর থেকে। তার রুদ্ধ গলা থেকে মাত্র একটি শব্দই বেরিয়ে এল, ‘জ্যাঠাইমা।’

পূর্ণেন্দুও ছুটে সেই ঘরের দিকেই এগিয়ে গেল। দেখার অবশ্য আর কিছু ছিল না। উঁকি দিতেই সব স্পষ্ট হল। যেখানে ছিলেন বিমলা দেবী, ঠিক সেখানেই আছেন। তেমনি রাধাকৃষ্ণের মূর্তির সামনে, ধ্যানাসনে, শুধু তাঁর মাথাটি বুকের ওপর ঝুঁকে পড়েছে।

পিছন দিকে তাকিয়ে পূর্ণেন্দু বিহ্বল গলায় বলে উঠল, ‘একজন ডাক্তার পাওয়া যায় না!’

তখনই কোনও ডাক্তার পাওয়া গেলেও লাভ হত না। বিমলাকে স্পর্শ করেই পূর্ণেন্দু টের পেয়েছিল বিমলার দেহে প্রাণ নেই। ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল ওরাও। কমলা, রমলা আর সুব্রত। সকলেরই মুখ আতঙ্কে পাণ্ডুর। চোখের মণি বিস্ফারিত। এ-ওর মুখের দিকে চাইছিল আর কানাকানি করছিল।

‘কে! কে!’ বলছিলেন রমলা। কমলার দৃষ্টিতেও সেই প্রশ্নই ছিল। সুব্রত এগিয়ে গেল জানালার দিকে, যেখানে শার্সিগুলো টুকরো-টুকরো হয়ে ছড়িয়ে আছে। কী একটা কুড়িয়ে এনে সে পূর্ণেন্দুর হাতে দিল।

পূর্ণেন্দু বলল, ‘গুলি? জানালার কাছেই পড়ে আছে যখন, তখন গুলিটা নিশ্চয় ভেতরের দিক থেকেই এসেছে। অর্থাৎ বারান্দায় দাঁড়িয়ে কেউ তাক করে বন্দুক ছুড়েছে।’

কিন্তু কে? একটা শিহরণ হিল্লোলিত হয়ে গেল সেই পরিবেশে। নিস্তব্ধতা দীর্ণ করে রমলা অকস্মাৎ কর্কশ গলায় বলে উঠলেন, ‘কে! কে মারল পিসিমাকে? এইরকম নিষ্ঠুরভাবে তাঁকে হত্যা করল কে?’

আস্তে-আস্তে মাথা নেড়ে কমলা বললেন, ‘জানি না।’

তীক্ষ্ন গলায় আবার বলে উঠলেন রমলা, ‘কিন্তু তোমরা দুজনই তো মাত্র ওপরে ছিলে। তুমি আর সুব্রত। তোমরা নিশ্চয় জানো।’

কমলা আবার বললেন, ‘না, আমরা ঘরে ছিলুম। সুব্রত বই পড়ছিল, আওয়াজ শুনে আমরা বেরিয়ে এসেছি।’

রমলার চোখ জ্বলছিল, সেই চোখে এবার একটি ইঙ্গিতও খেলে গেল। অতি ধীরে প্রায় চিবিয়ে-চিবিয়ে রমলা উচ্চারণ করলেন, ‘তোমরাই কেউ নও তো?’

কমলা ভয়ার্ত পাণ্ডুর, আরও কুঁকড়ে আরও পিছিয়ে গেলেন : ‘আমি? আমি এই কাজ করব?’

সুব্রত বলে উঠল, ‘আমি হত্যা করব আমার জ্যাঠাইমাকে? কেন ছোড়দি, কেন?’

অতি স্পষ্ট কণ্ঠে রমলা উচ্চারণ করলেন, ‘তোমার টাকার দরকার ছিল।’ বলতে-বলতে হঠাৎ যেন উত্তেজিত হয়ে উঠলেন রমলা, রুদ্ধস্বরে বলে গেলেন, ‘জানি, আমি জানি। তুমি কুসংসর্গে মিশছ। বাজি ধরে তাস খেল। তোমার রোজই টাকার দরকার। কমলার লেখা কেউ ছাপায় না। তাই নিজেই একটা কাগজ বার করবার ফন্দি আঁটছিল। কিন্তু টাকা ছিল না, একমাত্র উপায় এ বাড়ি বিক্রি করা। অনেক বুঝিয়েও তোমরা পিসিমাকে রাজি করাতে পারোনি। তিনিও এ-বাড়ির একজন শরিক। সেটাই ছিল তোমাদের আক্রোশ। সেই আক্রোশেই তোমরা তাঁকে পথ থেকে সরিয়ে দিয়েছ।’

এই বিচিত্র কলহে পূর্ণেন্দুর রুচি ছিল না। সে তন্নতন্ন করে পরীক্ষা করছিল ঘরটাকে। একবার দরজার স্কাইলাইটের দিকে তাকাল, চোখ নামিয়ে নিল পরক্ষণেই। গম্ভীর গলায় বলল, ‘চেঁচামেচি করবেন না। আজ রাত্রে কোনও উপায় নেই। কাল সকালে যতক্ষণ না ডাক্তার আর পুলিশ এসে পড়ছে ততক্ষণ এ-ঘর আমিই আগলাব। আপনারা তিনজনেই ও-ঘরে গিয়ে বসুন। শুধু এই অনুরোধ, আমার অনুমতি ছাড়া ঘর থেকে বেরোবেন না।’

পাঁচ

পরদিন সকালে পূর্ণেন্দু টেলিফোনে পুলিশকে খবর দিয়ে আনিয়ে নিয়েছিল। ডাক্তারও এসেছিলেন। একটা গাড়িতে ওরা তুলে দিল মৃতদেহ। ডাক্তার যাওয়ার আগে ফিসফিস করে পূর্ণেন্দুকে কী বললেন। কেউ শুনতে পেল না। পূর্ণেন্দুর মুখভঙ্গি দৃঢ়তর হল মাত্র।

ওদের রওনা করে দিয়ে ফিরে এল পূর্ণেন্দু, যে-ঘরে কমলা, রমলা, সুব্রত বসেছিল। অনিদ্রাজড়িত ক্লান্তির ছাপ সকলের মুখে, শোকেরও ছায়া, চোখের কোলে কালি। পূর্ণেন্দু প্রথমে কমলাকে ডাকল বাইরে। কঠিন গলায় কিছুক্ষণ জেরা করল। ডাকল সুব্রতকেও। সবশেষে ইশারায় ডাকল রমলাকে, অনেকটা দূরে বারান্দার এককোণে ডেকে নিয়ে এল। গম্ভীর কিন্তু শান্ত গলায় বলল, ‘আমার গাড়িটা তৈরিই আছে, রমলা দেবী, আপনিও তৈরি হয়ে নিন।’

রমলা বলে উঠলেন, ‘সে কী! কেন? আমি কোথায় যাব?’

পূর্ণেন্দু বলল, ‘কেন, থানায়। আপনার পিসিমার মৃত্যু সম্পর্কে আপনাকে কয়েকটা কথা জিগ্যেস করবার আছে রমলা দেবী।’

‘আমাকে? আমি কী জানি?’

পূর্ণেন্দু আগের মতোই নির্বিকার কিন্তু স্থির কণ্ঠে বলল, ‘আপনি সবই জানেন। এই মৃত্যুর সঙ্গে আপনি কারণ হিসাবে জড়িত এ-কথা মনে করবার সঙ্গত কারণ আছে।’

অপ্রকৃতিস্থের মতো রমলা হো-হো করে হেসে উঠলেন, ‘পূর্ণেন্দুবাবু, আপনি হয় মূর্খ নয় তো পাগল। ঘটনা যখন ঘটে তখন আমি নীচেই ছিলাম, আপনিই তার সাক্ষী।’

পূর্ণেন্দু বলল, ‘তা ঠিক। কিন্তু এই বস্তুটা কী রমলা দেবী?’ বলতে-বলতে পূর্ণেন্দু পকেট থেকে যেটা বার করল সেটা একটা অ্যালার্ম ঘড়ি। তার সঙ্গে ‘তার’ দিয়ে একটি রিভলভারের ট্রিগার জড়ানো। পূর্ণেন্দু আবার অবিচল গলায় বলল, ‘এটা কী? এটা আমি স্কাইলাইটে পেয়েছি। এতে সময় দেখানো আছে ঠিক এগারোটা।’

মুখ ঢেকে রমলা বসে পড়েছিলেন। হাত সরিয়ে হঠাৎ আবার হিংস্র গলায় বলে উঠলেন, ‘প্রমাণ কি এই একটাই? মোটিভ কোথায় পূর্ণেন্দুবাবু?’

পূর্ণেন্দু বলল, ‘তাও আছে। স্থির হয়ে বসুন, আপনাকে বলছি। গোপনে-গোপনে আপনি শেয়ার কিনে লোকসান খেয়ে যে একেবারে ফতুর হয়ে গিয়েছিলেন এ-খবর আপনাদের ঠাকুরই আমাকে বলেছে। ওই লোকটিই আপনার এজেন্ট ছিল কিনা। দুটো ধমক দিতেই ও সব কবুল করতে পথ পায়নি। এ-বাড়ি বিক্রি করাতে আপনারও স্বার্থ কারুর চেয়ে কম ছিল না। ঠাকুর আর চাকরকে বাড়ি থেকে আপনিই কাল ছুটি দিয়েছিলেন। কমলাকেও কি ড্রাগ স্টোরে পাঠিয়েছিলেন আপনিই? আর সেই অবসরেই কি কাজটা হাসিল করেছিলেন?’

বাধা দিয়ে রমলা বললেন, ‘কিন্তু তার পরেও তো পিসিমা বেঁচেছিলেন, আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন, আপনি শুনেছেন।’

পূর্ণেন্দু বলে উঠল, ‘আঃ রমলা দেবী, আপনি ভাঙবেন তবু মচকাবেন না। আমি যদি বলি, আমি আপনার পিসিমার কথা শুনিনি, যে-গলা শুনেছি সেটা আপনারই? দরজায় পরদা ছিল, আপনি আড়াল করে দাঁড়িয়ে ছিলেন, হরবোলার মতো নিজেই কথা বলেছিলেন নিজের সঙ্গে? কমলা দেবী যে ভয় পেয়েছিলেন সে-তো এই জন্যেই। এ-বাড়িতে অশরীরী অস্তিত্বের কথা তাঁর কল্পনায় এসেছিল, আপনার ঘরে আপনার পিসিমার গলা শুনে। অথচ আপনার পিসিমা সে-ঘরে ছিলেন না। রমলা দেবী, আপনি কি মহড়া দিচ্ছিলেন, ফোকলা দাঁতের ফ্যাঁসফেসে কথা কেমন শোনায়? আপনার পিসিমার কথা বলার ধরন নকল করছিলেন? এই পরিকল্পনা আপনার তো তবে অনেকদিনের। হত্যাকাণ্ডটা তাহলে সুপরিকল্পিত। ভাগ্যক্রমে আমি না এসে পড়লে এই অভিনয় আপনি হয়তো অন্য কাউকে শোনাতেন। কমলা দেবীর মুখে অশরীরী স্বরের কথা শুনেই আমার প্রথম সন্দেহ হয়, পরে ডাক্তারের কাছে আমার সন্দেহেরই সমর্থন পেলাম। তিনি বলে গেছেন, বিমলা দেবীর মৃত্যু রাত এগারোটায় ঘটেনি, তিনি মারা গেছেন অন্তত তারও চার-পাঁচ ঘণ্টা আগে। সম্ভবত বিষ প্রয়োগের ফলে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে সেটা চূড়ান্তভাবে জানা যাবে। এই গুলির ব্যাপারটা একেবারেই সাজানো। আপনার অ্যালার্ম ঘড়ির টাইমিং কিন্তু পারফেক্ট। কিন্তু কোনও কাজ হল না, রমলা দেবী। অত তাড়াতাড়ি কমলা আর সুব্রতকে জড়াতে গিয়ে আপনি নিজেকে কিন্তু বড় সহজে ধরা দিয়ে ফেললেন। ফাঁসিকাঠে ওদের তুলে দিতে আপনার আগ্রহ দেখে আমার সন্দেহ আরও দৃঢ়তর হল। …আর-একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করি। বালিশগুলো ঠিক করে দেওয়ার নাম করেই কি আপনি আপনার পিসিমার দেহ সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে দিয়ে এসেছিলেন? ওখানে তো আমি ছিলাম না। আমি দেখতে পাইনি।’

রমলার চোখ জ্বলছিল, কোনও উত্তর এল না।

পূর্ণেন্দু একটু থেমে আবার বলল, ‘তাছাড়া হত্যা তো আপনার রক্তে, রমলা দেবী। আপনার বাবা বড় শিকারি ছিলেন, দেওয়ালে বাঘের মাথা আর হরিণের শিংগুলোই তার সাক্ষী। আপনাকে গুলি ছুড়তে তিনিই হয়তো শিখিয়েছিলেন। এ-বাড়ির অন্য কারও হাতে সে-সুযোগ ছিল না।’

রমলা এবারও কোনও উত্তর দিলেন না।

পূর্ণেন্দু বলল, ‘দেরি হয়ে যাচ্ছে, একটু তাড়াতাড়ি করুন, রমলা দেবী।’

মাসিক রহস্য পত্রিকা

পুজো সংখ্যা, ১৯৫৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *