চিরকালের জুটি উত্তম-সুচিত্রা
ধরুন, ধর্মতলার মোড়ে দাঁড়িয়ে অফিস টাইমে আমি চিৎকার করে বলতে শুরু করলাম, এই যে মশাইরা শুনছেন, আজকের তাজা খবর— পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। লোকে হাসবে তো? কিন্তু যদি উলটোটা বলি, চারপাশে লোক জড়ো হয়ে যাবে। ঠিক সেইরকম কিছু সুচিত্রা-উত্তম জুটির ব্যাপারটা। আজকের দিনে কতটা জানি না, ছয়ের দশকে কিন্তু বাঙালি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত সুচিত্রা সেন আর উত্তমকুমার সত্যিই প্রেমিক-প্রেমিকা। এর উলটোটা বলতে গেলে ওই সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে গোছের শোনাত সে সময়। বাঙালি দর্শকের এই ধারণাটাকে পুরোপুরি ক্যাশ করেছিলেন পরিচালক, প্রযোজকেরা। রকের ছেলেরা সে সময় বলত, এক ব্র্যাকেটে সুচিত্রা-উত্তম। কথাটা মিথ্যে নয়। পরে উত্তমদা এই ব্র্যাকেটের বাইরে বেরোতে পারলেও, রমাদি (সুচিত্রা সেনের ডাকনাম) কিন্তু পারেননি। মানে সুচিত্রাকে ছাড়াও নায়ক উত্তম সুপারহিট, সেটা বেশ কিছু ছবিতে প্রমাণিত হলেও অন্য নায়কের সঙ্গে সুচিত্রাকে তেমন ভাবে নেয়নি দর্শক। দু-একটা ব্যতিক্রম অবশ্য আছে।
ওঁদের দু’জনের সঙ্গে বহু ছবিতে অভিনয় করেছি আমি। সেটে বসে একটা কথা বারবার মনে হত, কোন কথায় উত্তমদার কেমন প্রতিক্রিয়া হবে, সেটা যেন রমাদির নখদর্পণে। আবার উত্তমদাও খুব ভালো বুঝতেন রমাদির মুড। এই সমঝোতা না থাকলে অত ভালো অভিনয় করা মুশকিল। মধ্যবিত্ত দর্শকের আর দোষ কী। এত স্বতঃস্ফূর্ত, এত জীবন্ত প্রেমের অভিনয় এর আগে আর কোনও নায়ক-নায়িকা তো দেখাতে পারেনি। সবই যেন ছিল ‘লার্জার দ্যান লাইফ’, মানে শো ভেঙে গেলে স্বপ্নও ভেঙে গেল। সুচিত্রা-উত্তমই প্রথম দেখালেন সিনেমাকেও টেনে আনা যায় উঠোনে। পাশের বাড়ির ছাদে কাপড় শুকোতে দিতে আসা মেয়েটিকে দেখে একটি ছেলে ঠিক উত্তম স্টাইলেই গান গেয়ে উঠত সে সময়। প্রায়শই তাদের মধ্যে প্রেমও হয়ে যেত। এই যে দর্শকের সঙ্গে আইডেন্টি তৈরি করতে পারা, এটা খুব, খুব কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজটা যে-কোনও ভাবেই হোক-না-কেন, করে ফেলেছিলেন রমাদি আর উত্তমদা। আর কয়েকটা কঠিন কাজও অবশ্য ওঁরা করেছিলেন, নিজেদের জন্য। সামনাসামনি ওঁদের কখনও রূঢ় ব্যবহার করতে দেখিনি পরস্পরের সঙ্গে। ওঁরাও যখন মানুষ, তখন নিশ্চয়ই কোনও-না-কোনও সময় কোনও-না-কোনও ইস্যূতে ক্ষোভ, অভিমান, রাগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু ওঁদের সঙ্গে দীর্ঘ শুটিং জীবনের অভিজ্ঞতা হাতড়েও এমন একটা মুহূর্ত খুঁজে পাই না, যখন উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হচ্ছে প্রকাশ্যে দু’জনের মধ্যে। তা বলে কি এ কথা ভেবে নেওয়া ঠিক যে আড়ালে এরকম কিছু হত? তাও বোধহয় নয়। কারণ আড়ালে-আবডালে কখনও দু’জনকে কথাই বলতে দেখিনি আমরা। বরং স্টুডিয়োতে সবাই মিলে জোর আড্ডা হত। রমাদি, উত্তমদা, বেণু, সাবিত্রী, কমলদা, অনুভাদি সবাই যেন ছিল একটা পরিবারের মতো। শুনলে হয়তো আজ অনেকেই অবাক হয়ে যাবে, রমাদি ভীষণ আদিরসাত্মক কথা বলতেন। এমন সব রসিকতা করতেন আমাদের কান টান লাল হয়ে যেত। এমনিতেই ভীষণ লাজুক ছিলাম আমি। তার ওপর তখনকার দিনে রমাদির মতো স্মার্ট মেয়ে সত্যিই ধারেকাছে দেখার সুযোগ ছিল না। রমাদি ছিলেন সপ্রতিভ বলতে যা বোঝায় তা-ই। অকারণ লাজুক নন, আবার অসম্ভব মেয়েলি। এই যে প্রাপ্তবয়স্ক ঠাট্টাইয়ার্কি প্রায়ই করতেন রমাদি, এ জন্য কিন্তু কখনও ওঁর আভিজাত্য এতটুকু টাল খায়নি। যে-কারও মনে হতে বাধ্য এরকম আচরণই ওঁকে সবচেয়ে মানায়। আজকের কঠিন খোলসবন্দি সুচিত্রা সেনের কথা ভাবলে সত্যিই স্বপ্ন বলে মনে হয় সে দিনগুলো। রমাদি কী জোর গলায় হাঁক দিতেন, ‘এই উতু শোন না’। এই একটা অদ্ভুত স্বভাব ছিল রমাদির। কখনও ‘তুই’, কখনও ‘তুমি’— কাকে যে কী বলে ডাকতেন ভুলে যেতেন পরমুহূর্তে। উত্তমদাকেও কখনও তুই, কখনও তুমি বলতেন।
আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে বন্ধুত্ব ব্যাপারটা ঠিক কীরকম, পরিষ্কার ধারণা নেই আমার। শুনেছি ধারণাটা পাল্টে গেছে অনেক। পাঁচ বা ছয়ের দশকে কিন্তু কলকাতায় বয়স্ক দু’জন নারী-পুরুষের মধ্যে নিছক বন্ধুত্ব থাকতে পারে, এই ধারণার চলন বেশি ছিল না। একটু সাহেবি-সাহেবি মনে হত ব্যাপারটা। আমাদের সব ধারণাকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল উত্তম সুচিত্রার গভীর বন্ধুত্ব। এখন অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, বন্ধুত্ব যখন এমনই একটা জিনিস যার কোনও ধরাবাঁধা সীমারেখা টানা যায় না, তখন উত্তম-সূচিত্রার বন্ধুত্বকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা উচিত? কতটা ছিল তার গভীরতা, কতটাই বা ছিল ব্যাপ্তি? এ প্রশ্নের উত্তর আমার অনেকটাই জানা। দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা খুব কাছে থেকে দেখেছি দু’জনকে। তবু আজ যখন উত্তমদা প্রয়াত এবং রমাদি স্বেচ্ছানির্বাসিত, তখন এ-প্রসঙ্গে আলোচনা খুব একটা রুচিকর হবে না।