চিরকালের গল্প
একতলার ঘরের মেঝেতে শুয়ে কিছু আজগুবি ভাবনা মাথায় আসছিল তন্ময়ের৷ সকাল থেকে এদিকটায় কারেন্ট নেই, মানে লোডশেডিং আর কী৷
ঘণ্টা খানেক আগে মোবাইলটা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে, এক্ষুনি ল্যাপটপটাও৷ ফলে আর করার মতো কিছু নেই, কারেন্ট না আসা অবধি স্রেফ চুপচাপ শুয়ে থাকা, গরমে ঘুমও আসবে না৷ গোটা পৃথিবীটা ল্যাপটপের স্ক্রিনের মতোই অন্ধকার হয়ে যাবে-ফাঁকা৷ একসময় যা খুশি ফুটিয়ে তোলা যেত সেখানে৷ এখন হালকা চাঁদের আলোয় শুধু তার নিজের মুখের আউটলাইনটাই দেখা যাচ্ছে সেখানে৷ একটু আগেই দিপ্তির সঙ্গে কথা হচ্ছিল ফেসবুকে৷ এখন সেটাও মিলিয়ে গেছে৷ সেদিকে তাকিয়ে দু-দিন আগের একটা ব্যাপার মনে পড়ল তন্ময়ের৷ নেট সার্চ করতে গিয়ে আচমকা একটা সাইট খুলে গেছিল, এমনিতে আজকাল অনেক ওয়েব সাইট এরকম নিজে থেকেই খুলে যায়৷ সেরকমই একটা সাইট ভেবে বন্ধ করে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু ক্রসের কাছে পৌঁছেও হাত আটকে গেল৷ স্ক্রিনের উপর ধীরে ধীরে যে লেখাটা ফুটে উঠছে তার বাংলা মানে করলে দাঁড়ায়, ‘আপনি কি জানেন পৃথিবীর প্রতিটা মানুষের জন্য একজন মাত্র পারফেক্ট মানুষ আছে?’
প্রশ্নটা পড়ে একটু হেসেছিল তন্ময়, খানিকটা কৌতূহলও জেগেছিল সেইসঙ্গে৷ নব্বইয়ের দশকে হিন্দি সিনেমায় এইরকম কথা বেশ শোনা যেত৷ এখন পৃথিবী এগিয়ে গেছে, পারফেক্ট কারওর খোঁজ আর কেউ করে না৷ তালেগোলে যা হয়ে যায় সেই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে৷ কয়েক সেকেন্ড পরেই লেখাটা মুছে গিয়ে আবার নতুন লেখা ফুটে উঠল সেখানে, ‘আপনি কি আপনার জন্য পারফেক্ট মানুষটিকে খুঁজে পেতে চান?’ নীচের দিকের কোণে ইয়েস আর নো লেখা দুটো বাটনও ফুটে উঠল সেই সঙ্গে৷ সাতপাঁচ না ভেবে ইয়েসে ক্লিক করে দিল তন্ময়৷ ভেবেছিল এরপরই কোনও বিজ্ঞাপনের ছবি আসবে অথবা কিছু ডাউনলোড হতে চাইবে; কিন্তু সেসব কিছুই হল না৷ উলটে একটা নতুন পাতা খুলে গেল৷ হাজাররকম প্রশ্ন লেখা আছে সেখানে৷ ‘এটা কি ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট নাকি?’ মনে মনে ভাবল তন্ময়৷ অথচ এ সাইটের নামটা তো আগে শোনেনি সে৷ যাই হোক ভেবেচিন্তে সব ক-টা প্রশ্নেরই উত্তর দিল একে একে, মেয়েটার নাক কেমন হবে, চোখের গড়ন কেমন, গায়ের রং ইত্যাদি ইত্যাদি৷ সঙ্গে নিজের ঠিকানাটাও দিয়ে দিল৷ সাবমিটে ক্লিক করতেই বন্ধ হয়ে গেল সাইটটা৷ যেন শুধু এইসব জানার জন্যই অপেক্ষা করছিল এতক্ষণ৷ জানা হয়ে যেতে আর একমুহূর্ত দাঁড়াল না৷ কেমন যেন খটকা লেগেছিল তার৷ এইধরনের সাইট খুঁজে দেবার বদলে সাধারণত টাকাপয়সা চায়, অথবা অ্যাকাউন্ট খুলতে বলে৷ এ সাইটটা কিন্তু তার ধারই ধারল না৷ একটু থতমত খেয়ে আবার সাইটের অ্যাড্রেসটা টাইপ করল সে—PERFECTION.COM এন্টারে চাপ দিতেই কিন্তু অবাক হয়ে গেল৷ পেজ নট ফাউন্ড৷ কী আশ্চর্য৷ এইমাত্র তো খোলা ছিল ওয়েবসাইটটা৷ আর এখন বলছে কিনা ওরকম কিছুর অস্তিত্বই নেই, ভারী তাজ্জব ব্যাপার তো৷ সঙ্গে সঙ্গে ল্যাপটপের পাশে পড়ে থাকা মোবাইলটা তুলে কয়েকজনকে ফোন করেছিল৷ কিছু গন্ডগোল হবে না তো? তারা আশ্বাস দিয়ে বলেছিল টাকাপয়সা যখন কিছু চায়নি তখন খারাপ কিছু হবে না৷ এই ক-দিনে বেশ কয়েকবার সাইটটা খোলা চেষ্টা করেছে তন্ময়; কিন্তু বৃথা চেষ্টা৷ সেটাকে আর একবারও দেখতে পায়নি সে৷
আজ এই অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে সেটার কথাই ভাবছিল; দীপ্তিকে বলা হয়নি কথাটা৷ বলাটা বোকামো হবে৷ এই মুহূর্তে জানলার বাইরে থেকে নানারকম আওয়াজ ভেসে আসছে—যেমন ব্যাটারিচালিত রেডিও থেকে গান, ঝিঁঝির ডাক, পাড়ার লোকের মৃদু হইচই, গুঞ্জন, হালকা হাওয়াও দিচ্ছে বুঝি, কাচের জানলার বাইরে নিভন্ত ফসফরাসের আলোর মতো আকাশের অবয়বটা বোঝা যাচ্ছে৷ আচমকা এইসময় একটা কাণ্ড ঘটে গেল৷ রাতের নীরবতা খানখান করে ঘরের একটা কাচ ভাঙার আওয়াজ হল৷ ভয় পেয়ে ধড়ফড় করে উঠে বসল তন্ময়৷ এঘরের কোনও একটা জানলা ভেঙে ঘরের ভিতর এসে পড়েছে কিছু৷ অন্ধকারে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না জিনিসটা৷ বাইরে থেকে কেউ কি ছুড়ে ফেলেছে? জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল সে৷ নাঃ! কাউকে দেখা যাচ্ছে না৷ রাস্তাটা শুনশান, ফাঁকা, ব্যাপার কী? এত রাতে এ পাড়ায় অন্যের বাড়িতে ঢিল ছুড়ে কাচ ভাঙবে কে? তার সঙ্গে তো কারও শত্রুতা নেই৷ বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল তন্ময়৷ জানলা ভেঙে যে জিনিষটা ভিতরে এসে পড়েছে সেটা সম্ভবত ইঞ্চিখানেকের বেশি লম্বা নয়, তার বেশি হলে জানলার পুরো কাচটাই ভেঙে পড়ত৷ সে সাবধানে জানলার দিকে এগিয়ে গেল৷ চারিদিকে ভাঙা কাচ পড়ে রয়ছে৷ এখানে হাঁটাচলা করাটা মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়৷ এখন না সরিয়ে কাল সকালের আলোতেই কিছু একটা ব্যবস্থা করা যাবে, সে ধীরে ধীরে ফিরে আসতে যাচ্ছিল, এমন সময়ে একটা হালকা আলো চোখে পড়তেই থেমে গেল৷ বিছানার তলা থেকেই আসছে আলোটা৷ যেন গোটা চারেক জোনাকি একসঙ্গে জ্বলছে সেখানে, ব্যাপার কী? জোনাকিরা তো জানলা ভেঙে ঢুকতে পারে না৷ কৌতূহলে বুক ঢিপ ঢিপ করছিল তন্ময়ের বিছানার তলায় ঝুঁকে পড়ল সে৷ হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল সেই দিকে, হ্যাঁ জোনাকিই বটে, একটা লাল কাপড়ে কিছু একটা বাঁধা আছে৷ কাপড়ের ভিতর থেকেই আসছে জোনাকির আলো৷ ভারী অদ্ভুত ব্যাপার তো? এরকম কাপড়ের ভিতর জোনাকি আটকে রেখে জানলা দিয়ে ছুড়ে পাঠাবে কে? জিনিসটা হাতে নিতেই কিন্তু খানিকটা পরিষ্কার হল ব্যাপারটা৷ কাপড়ের ভিতর শক্ত কিছু একটা জড়ানো আছে৷
সেটা যাতে চোখে পড়ে সেইজন্যই ভিতরে বন্দি করে রাখা হয়েছে জোনাকিগুলোকে৷ জিনিসটা হাতে নিয়ে বিছানার উপরে উঠে এল তন্ময়৷ কৌতূহলটা এখন আগের থেকে বেড়ে উঠেছে৷ একপাশ থেকে একটু টান দিতেই খুলে গেল কাপড়টা৷ সঙ্গে সঙ্গে জোনাকিগুলোও বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়ল ঘরের ভিতর! মাত্র চারটে জোনাকিও অন্ধকার ঘর আলোয় ভরিয়ে দিতে পারে এটা এতদিন জানা ছিল না তন্ময়ের৷ সেই আলোতেই দেখতে পেল হাতে ধরে থাকা জিনিসটা একটা কালো রঙের যন্ত্র৷ বাজার মোবাইল ফোনে ছেয়ে যাওয়ার আগে পেজার নামে একধরনের যন্ত্র পাওয়া যেত৷ অনেকটা সেইরকম৷ আন্দাজ আড়াই ইঞ্চি লম্বা৷ তার বেশিরভাগটা জুড়েই একটা আয়তাকার স্ক্রিন৷ অনেকটা ক্যালকুলেটরের স্ক্রিনের মতো৷ তার ঠিক নীচেই একটা মাত্র বোতাম৷ সেটা টিপলেই সম্ভবত চালু হয় যন্ত্রটা৷ পিছনদিকটাতেও কিছু নেই৷ নিরেট, ফাঁকা৷ ঠান্ডা৷ তবে কি কেউ মশকরা করছে তার সঙ্গে? চারদিকে একবার ভালো করে তাকিয়ে নিয়ে বোতামটা টিপে দিল তন্ময়—আর সঙ্গে সঙ্গে আয়তাকার স্ক্রিনের উপর লেখা ফুটে উঠল৷ কয়েকটা সংখ্যা৷ যেন এই মাত্র ক্যালকুলেটরে একটা বড়োসড়ো যোগের অঙ্ক করেছে কেউ৷ ৩৬৪৯ সংখ্যাগুলো সবুজ, স্থির হয়ে জ্বলছে৷ আরও কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকার পরেও কোনও অদলবদল হল না তাতে৷ সংখ্যাগুলো আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে৷ খারাপ হয়ে গেছে নাকি? তাই কেউ ছুঁড়ে ফেলেছে জানলা দিয়ে? কিন্তু সেই বা কী করত এটা দিয়ে? ব্যাপারটা নিয়ে আর কিছু ভাবতে ইচ্ছা করল না, সেটাকে বালিশের পাশে রেখে শুতে গেল সে, আর সঙ্গে সঙ্গে হাতের ধাক্কায় সেটা ছিটকে গিয়ে পড়ল বিছানা থেকে একটু দূরে, মুখ দিয়ে একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করে বিছানা থেকে নেমে সেটাকে আবার হাতে তুলে নিল তন্ময়৷ আর ঠিক তখনই একটা ব্যাপার চোখে পড়তে সে থমকে গেল৷ এতক্ষণ যে সংখ্যাগুলো যন্ত্রটা দেখাচ্ছিল তার প্রথম তিনটে একই আছে—শুধু বদলে গেছে শেষেরটা৷ নয়ের বদলে সেখানে এখন আট৷ তাহলে কি জিনিসটাকে একটু দূরে সরালে নম্বরগুলো পালটে যায়? অবাক চোখে সে যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে থাকল৷ হঠাৎ কী মাথায় আসতে বিছানা থেকে আর একটু দূরে সরে এল৷ সঙ্গে সঙ্গে আবার পালটে গেল নম্বরটা৷ এবার আটের বদলে সাত৷ যন্ত্রটা নিয়ে নড়াচড়া করলেই শেষের নম্বরটা পালটে যাচ্ছে৷ মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে লাগল তন্ময়৷ তবে কি কোনও কিছুর দূরত্ব বোঝাচ্ছে সেটা? কীসের? জানলার বাইরে আর একবার চোখ গেল তন্ময়ের৷ মনে হল কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়৷ লোকটা একভাবে তাকিয়ে আছে তার জানলার দিকে৷ যেন নজর রাখছে৷ তন্ময় জানলার দিকে আরও খানিকটা এগিয়ে গেল৷ সেটা দেখেও কিন্তু সরে গেল না লোকটা৷ যেন নিজেকে দেখাতেই চাইছে সে৷ যন্ত্রটা যে সেই ছুড়েছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই৷ কিন্তু উদ্দেশ্যটা কী? কেমন যেন ভয় লাগল তন্ময়ের৷ বহু চেষ্টা করেও দু’চোখের পাতা এক করতে পারল না৷
শহরের লম্বা লম্বা বাড়িগুলোর কোল ঘেঁষে একটু একটু করে সন্ধ্যা নামছে৷ বাড়ির নীচে পায়ে চলা রাস্তাগুলো খালি পড়ে আছে৷ একটু আগেই স্কুলযাত্রী কিছু ছেলেমেয়ের দল রাস্তার উপর দিয়ে হেঁটে গেছে৷ সন্ধেবেলা এদিকটা ফাঁকা হয়ে যায়৷ তখন কদাচিৎ দু-একটা গাড়ির দেখা মেলে৷ এখন অবশ্য তিনজন মানুষকে হাঁটতে দেখা যাচ্ছে৷ দু-জন সামনে, আর একজন একটু পিছনে, সন্তর্পণে৷ সামনের দু-জন যাতে তার উপস্থিতি বুঝতে না পারে সেই ভেবে পা টিপে টিপে হাঁটছে৷ সেভাবেই পা চালিয়ে আরও কিছুটা এগিয়ে এলেন ডাক্তার সান্যাল৷ ছেলেমেয়েদুটোর কথাবার্তা এখন আবছা শোনা যাচ্ছে৷ অন্ধকারে শরীর ঢেকে কান খাড়া করে শুনতে লাগলেন তিনি৷
‘ছিঃ ছিঃ ছিঃ ছিঃ… অঙ্কে ছাব্বিশ! ভূগোলে আঠেরো! আর… আর জীবন বিজ্ঞানে তো কামাল করে দিয়েছিস! যোলো!’
‘তো আমি কী করব? অত বিজ্ঞানসম্মত নাম মনে রাখতে গিয়ে আমি বাপের নাম ভুলে যাই শালা৷’
‘তাবলে একশোতে ষোলো! গোটা খাতা তো লাল কালিতে রক্তাক্ত হয়ে গেছে৷’
‘ওই হরিচরণটা একটা ঢ্যামনা৷ যা লিখি তাই কেটে দেয়৷ আবার খাতার নীচে লিখে দিয়েছে আপনার ছেলের এ জীবনে জীবন বিজ্ঞানে পাশ করা হবে না৷’
‘কেস খেয়েছে৷ সেসব যদি বাড়ির লোকের হাতে পড়ে?’
‘পড়তেই হবে৷ মন্তব্যের নীচে গার্জেনের সই করে নিয়ে যেতে বলেছে পরের দিন৷’
‘তুই গেলি৷ জীবন বিজ্ঞানই তোর মরণের কারণ হয়ে দাঁড়াবে এবার৷’
‘হুম… মাথায় একটা আইডিয়া আছে৷’
‘কী?’
‘তুই আমার বাবার সইটা করে দে৷’
‘আমি! মেয়েদের হাতের লেখা দেখলেই বুঝে যাবে৷ নিজে করে নে৷’
‘আমার হাতের লেখাও দেখলে বুঝে যাবে৷’
‘আরে কায়দা করে লেখ না৷ হ্যান্ডরাইটিং এক্সপার্ট আনবে নাকি?’
‘তাই করতে হবে আর কী… তবে সেটা বাড়িতে করতে গেলে কেস খাব৷’
ডাক্তার সান্যাল আর একটু পিছিয়ে এসে হাসলেন৷ এতক্ষণে সন্ধের অন্ধকারটা আর একটু গাঢ় হয়ছে৷ গা ঢাকা না দিলেও চলে৷
‘মন দিয়ে একটু পড়াশোনা কর বাবা! এরকম বাবার সই নকল করে কতদিন চালাবি?’
‘উফ! তুইও শুরু করলি?’
‘(হাসি) আচ্ছা ছাড়৷ সিগারেট দে দেখি৷ দুটো টান মেরে ছেড়ে দেব৷ আর এটা রাখ৷’
ছেলেটার হাতে একটা কাগজের টুকরো গুঁজে দিল মেয়েটা৷
‘যদি কাল দেখা না হয়?’
‘কী আর… আমার একটা সিগারেট বেঁচে যাবে৷’
‘ও…রে হারামি এই করে পয়সা বাঁচাচ্ছ? প্যাক্টিকাল খাতায় কে ছবি এঁকে দেয় আমিও দেখে নেব৷’
‘ওসব ছবি আমিও আঁকতে পারি৷’
‘হেঃ কী যে আঁকিস আমার জানা আছে৷ হৃৎপিণ্ড দেখে মনে হয় ফোলানো বেলুন৷’
‘মনে প্রেম থাকলে হৃৎপিণ্ড অমন ফুলে যায়৷’
‘বাবা! এত ফোলা প্রেম কার জন্য?’
‘মধুছন্দাদি৷’
‘কে দি?’
‘আরে মধুছন্দাদি৷ শুনিসনি? মধুছন্দাদি কেন আসছ না/চাঁদে রোদ্দুরে ভালোবাসছ না৷’
‘তোর দিদিবাজি বন্ধ করছি আমি৷ ফোট ফোট শালা এখান থেকে৷’
একটু পরে দু-জনের কেউই আর সেখানে দাঁড়াল না৷ পাশেই একটা বড়োসড়ো ফুটবল মাঠ৷ অল্প আলোতেও কয়েকটা কমবয়সি ছেলে খেলাধুলা করছে সেখানে৷ সেদিকেই এগিয়ে গেল ছেলেটা৷ মেয়েটা গলিপথে বাড়ির রাস্তা ধরল৷ ডাক্তার সান্যালও ছেলেটার পিছন পিছন মাঠের ভিতর ঢুকে এলেন৷ এই মাঠটা তার চেনা৷ অবশ্য বহুদিন পরে আবার এই অবস্থায় দেখছেন৷ একটা বেঞ্চে গিয়ে বসে ব্যাগ থেকে পরীক্ষার খাতাগুলো বের করল তন্ময়৷ রাফ খাতায় কয়েকবার বাবার সইটা প্যাকটিস করে নিল৷ নাঃ তাও হচ্ছে না৷ হাতের লেখাটার মধ্যে কেমন যেন কাঁচা ভাব থেকে যাচ্ছে৷ অথচ সইটা না করে বাড়ি গেলে কপালে সর্বনাশ লেখা আছে৷ বসে বসে কপাল ঘামতে লাগল তার৷ সঙ্গে মাথাটাও গরম হতে লাগল৷ ঠিক এই সময় পাশ থেকে নিজের নামটা শুনে ফিরে তাকাল সে৷ পাশেই এসে বসেছে একটা বছর পঁয়ত্রিশের লোক৷ তার মাথাভরা টাক৷ চোখে কালো ফ্রেমের চশমা৷ মুখে অল্প দাড়ি৷ চেহারার মধ্যে বেশ একটা ভব্যিযুক্তি ভাব আছে৷ তন্ময় তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁ বলুন?’
‘তোমার নাম তন্ময় তো?’
‘এক্ষুনি তো ওই নামেই ডাকলেন…’
‘আসলে এভাবে কোনওদিন দেখিনি তো৷’
লোকটার কথাবার্তা কেমন যেন৷ সে মুখ ফিরিয়ে নিল৷ এমনিতেই হাতের লেখা মেলাতে না পেরে চাপ খাচ্ছে তার উপর লোকটা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে৷ এইসব আপদ কি এখনই এসে উপস্থিত হয়?
‘তোমার সইটা কিন্তু আমি করে দিতে পারি৷’
সেরেছে৷ লোকটা কি জানে সে সই নকল করতে বসেছে এখানে? তন্ময় ভাবল এত তাড়াতাড়ি স্যারেন্ডার করলে চলবে না৷ গলায় ঝাঁজ এনে বলল, ‘আপনাকে কে বলল আমার সই দরকার?’ ডাক্তার সান্যালের মুখে এবার একটা হালকা হাসি ফুটে উঠল, ‘তোমার সম্পর্কে সব কিছুই জানি আমি৷’
বাবা কি তবে টিকটিকি লাগিয়েছে তার পিছনে? তন্ময় ভাবল লোকটাকে আর পাত্তা দিলে চলবে না৷ মুখ নামিয়ে খাতায় আঁক কাটতে লাগল সে৷ লোকটা কিন্তু চুপ করে থাকল না৷ তার দিকে বেশ খানিকটা সরে এসে বলল, ‘মনে পড়ে… সেই যে যেবার পুরী গিয়ে হোটেলের জানলা দিয়ে লোকের মাথায় হিসি করে দিয়েছিলে…’
তন্ময়ের বুকের ভিতর এবার উত্তেজনার স্রোত খেলে গেল৷ এ ঘটনাটার কথা সে নিজে ছাড়া আর কেউ জানে না৷ মুখ তুলে লোকটার দিকে একবার তাকাল তন্ময়৷ তারপর আবার মাথা নামিয়ে নিল৷ সঙ্গে সঙ্গে একটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়ল৷ লোকটার বাঁ হাতের কড়ে আঙুলের নীচে ছোটো তিল৷ ঠিক ওইরকম একটা তিল তার নিজের হাতেও আছে৷ ‘আপনার দাবিটা কী বলুন তো?’ ঝাঁঝিয়ে ওঠে তন্ময়, ‘দেখছেন ইতিহাস ছাড়া সব কিছুতে গাড্ডা খেয়ে বসে আছি তার উপর আপনি এই ভর সন্ধেবেলা ভদ্রলোকের ছেলের মাথা চাটছেন৷’
শান্ত গলায় সান্যাল বললেন, ‘বললাম যে তোমার সব সমস্যার সমাধান আমি করে দেব৷ শুধু আমার একটা কথা শুনতে হবে৷’
এতক্ষণে কেমন যেন কৌতূহল হল তন্ময়ের৷ লোকটার তার মানে কিছু উদ্দেশ্য আছে৷ কিন্তু সব সমস্যার সমাধান করে দেব কথাটা কেমন যেন ভগবান সুলভ৷ সে জিজ্ঞেস করল, ‘এত উঁচু উঁচু কথা বলছেন, কে বলুন তো আপনি?’
‘আমার নাম ডাক্তার তন্ময় সান্যাল৷’
‘সে তো আমারও নাম… তবে ওই ডাক্তারটা নেই৷’
‘ওটা হয়ে যাবে৷ কয়েকটা বছর পরেই হয়ে যাবে৷’
‘আমি ডাক্তার হয়ে যাব? বয়স তো কম নয়৷ ফাজলামো মারছেন কেন?’
‘আমার সঙ্গে তোমার তো ওই একটাই পার্থক্য—বয়সের৷’
তন্ময় মনে মনে কী যেন ভাবল, কৌতূহলের চোটে গলার ঝাঁজটাই কমে এসেছে৷ সে মিনমিন কড়ে বলল, ‘মানে আপনি বলছেন আপনি আর আমি একই মানুষ৷’
‘শুধু কুড়ি বছরের এদিক-ওদিক৷’
হাসতে গিয়েও তন্ময় হাসতে পারল না৷ বিদেশি সায়েন্স ফিকশনে এরকম হয় বটে কিন্তু সেসবই তো গল্প৷ বাস্তবে দাঁড়িয়ে এরকম কথা অন্য কেউ বললে সে বিশ্বাস করত না৷ কিন্তু এ লোকটা তার সম্পর্কে এমন কিছু জানে যেটা অন্য কেউ জানে না৷ সেটাই বা কী করে হয়৷ অবশ্য লোকটা বলছে জীবন বিজ্ঞানে ষোলো পাওয়া ছেলে একদিন ডাক্তার হবে৷ ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে খারাপ লাগে না৷
‘খাতাটা দাও৷ সই করে দিই৷’
চুপচাপ খাতাটা এগিয়ে দিল সে৷ ডাক্তার সান্যাল পকেট থেকে পেন বের করে খাতার উপরেই আঁক কাটলেন৷ তন্ময় হাঁ হাঁ করে উঠল, ‘আরে পেনে কালি পড়ে কি না সেটা তো অন্য কোথাও ঘষে দেখতে পারতেন৷’
‘অ্যাঁ! না, না৷ ওটাই আমার সই৷’
ওটা সই! তন্ময়ের মনে হল খাতার উপর কেউ থেঁতলে যাওয়া কেঁচো বা প্রতিবন্ধী অ্যামিবা আঁকার চেষ্টা করছে৷ ‘আসলে হাতের লেখাটা…’
লোকটার কথাবার্তা এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না৷ হঠাৎ মনে পড়ল পকেটে কাল রাতের সেই যন্ত্রটা এখনও সজাগ আছে৷ রাতে কি জানলা থেকে তবে এই লোকটাকেই দেখেছিল?
‘আপনি কী চাইছেন বলুন তো?’ তন্ময়ের মনে কেমন যেন সন্দেহ জাগে৷
‘আপনি নয়৷ আমরা৷ তুমি আর আমি দু-জনেই চাইছি৷’
‘সে যাই হোক… আমরাই বা কী চাইছি?’
লোকটা মাথা নামিয়ে কী যেন ভাবতে লাগল৷ যে কথাটা বলতে চলেছে সেটাই কীভাবে বলবে ভেবে নিচ্ছে৷ তন্ময় একবার চারপাশে তাকাল৷ একটু আগে যে ছেলেগুলো খেলছিল তারা এতক্ষণে বাড়ি চলে গেছে৷ শুনশান মাঠটা অন্ধকারে ডুবে আছে৷ থেকে থেকে দু-এক জায়গায় ভেপারের আলো জ্বলছে৷
সেখানাই এসে পড়েছে লোকটার চকচকে টাকে৷
তন্ময়ের মনটা খারাপ হয়ে গেল৷ এখন তার মাথা ভর্তি কালো চুল৷ একসময় কি… ‘দীপ্তির সঙ্গে আর মেলামেশা কোর না তুমি৷’
আচমকা চেনা নামটা কানে আসতে চমকে উঠল সে৷ বাদবাকি কথাটা ভালো করে কানে যায়নি৷ জিজ্ঞেস করল, ‘অ্যাঁ? কী বললেন?’
‘দীপ্তির সঙ্গে আর তেমন মেলামেশা কোর না৷ একেবারে না করলে আরও ভালো৷’
‘আমি চললাম, সইয়ের জন্য ধন্যবাদ৷’
তন্ময় উঠে পড়ল৷ ব্যাগটা পিঠে নিতে নিতে বলল, ‘কোনও ভালো রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে গিয়ে কোকেনের নেশাটা ছাড়িয়ে আসুন৷ ওসব মারাদোনা ফারাদোনাকেই মানায়৷ আপনার মতো বেচুরামরা নিলে এইসব ভাট বকে৷’
‘কাল রাতের যন্ত্রটার কথা… ওয়েবসাইটের কথা… বলেছ দীপ্তিকে?’
তন্ময় পা বাড়াতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল৷ কথাগুলো সত্যি বলা হয়নি৷ কেন যে বলতে পারেনি তা সে নিজেও জানে না৷
‘আপনিই কাল রাতে জানলা দিয়ে ছুড়েছিলেন ওটা?’
মাথা নাড়লেন ডাক্তার সান্যাল৷ বেঞ্চে তার পাশের জায়গাটা দেখিয়ে বললেন, ‘রাগ কোর না৷ এখানে বস৷ এরকম সুযোগ সবাই পায় না৷’
‘কীসের সুযোগ?’ সে বসে পরে বলল৷
‘নিজের জীবনটা পালটানোর৷ নিজের ভুলগুলো শোধরানোর৷’
বেশ কিছুক্ষণ মুখ গোঁজ করে বসে রইল তন্ময়৷ খুব দ্রুত তার মাথায় কিছু ভাবনা খেলে যাচ্ছে৷ ধরে নেওয়া যাক লোকটা যা বলছে সেটা সত্যি৷
তাহলে তার জীবনে যা যা ঘটবে সেটা লোকটা জানে৷ তাই যদি হয় তাহলে এরকম সুযোগ সত্যি কেউ পায় না৷
‘কিন্তু আপনি ভবিষ্যৎ থেকে এসেছেন মানে তো ঘটনাগুলো এর মধ্যে ঘটে গেছে৷’
‘ঘটেছে৷ আমার জন্য, তোমার জন্য নয়৷’
‘কিন্তু আপনি যে বললেন আমরা একই মানুষ৷’
সান্যাল হাসলেন৷ ছেলেটার পিঠে একটা হাত রেখে বললেন, ‘কী করে তোমায় বোঝাই বল তো? দেখ, সৃষ্টির শুরু থেকে আমাদের হাতে দুটো জিনিস ছিল৷ এক, এই মহাবিশ্ব, আর দুই সময়৷ তোমরা যে থ্রি-ডি সিনেমা দেখ, মহাবিশ্ব হল ওইরকম ৩ডি৷ তাকে ধরাছোঁয়া যায়৷ অনুভব করা যায়৷ আবার সময় হল ১ডি৷ তাকে ধরাছোঁয়া তো দূরের কথা, অস্তিত্ব প্রমাণই করা যায় না৷ শুধু সে আছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়৷ তোমার মাথার চুল আর আমার টাক দেখে৷ তো এই দুটো মিলেমিশে আছে আমাদের চারপাশে৷ দুই মিলে হল মোট ৪ডি৷ তো এই স্পেস আর টাইমের মাঝে আবার কিছু সাঁকো আছে৷’
‘মানে ব্রিজ? যা দিয়ে মানুষ পার হয়?’
‘একদম৷ একে বলে আইনস্টাইন-রোজেনবারগ ব্রিজ৷ কিন্তু এই ব্রিজ দিয়ে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নয়৷ এক সময় থেকে আর এক সময়ে যাওয়া যায়৷’
‘সেখান থেকেই এসেছেন আপনি?’
‘হ্যাঁ৷’
‘আমি যেতে পারব না সেখানে?’
ডাক্তার সান্যাল এবার বেঞ্চ ছেড়ে উঠে পড়লেন৷ মাঠের চারপাশে তাকিয়ে বললেন, ‘একদিন নিশ্চয়ই যাবে৷ কিন্তু আমি যে কথাটা বললাম সেটা মনে রেখো৷ ওর সঙ্গে আর মিশো না৷’
‘কেন? কী হবে তাতে?’ তন্ময়ের গলায় এখন আর শ্লেষ মেশানো নেই৷
‘ভালো কিছু হবে না৷ আমি তোমার খারাপ চাই না৷ নিজের খারাপ পাগলেও চায় না৷’
দু’মিনিট কিছু একটা ভেবে নিল তন্ময়৷ তারপর পকেট থেকে বের করে আনল কাল রাতের সেই যন্ত্রটা৷ সেটার দিকে তাকিয়ে টাকমাথা ডাক্তার স্মিত হাসলেন, ‘ওটায় যে সংখ্যাটা দেখতে পাচ্ছ সেটা একজনের থেকে তুমি কতটা দূরে আছ তা দেখাচ্ছে৷’
‘কার থেকে?’
ডাক্তার মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে একটা হাত রাখলেন তার কাঁধে, ‘শোন তন্ময়৷ কী করলে তোমার ভালো হবে তা আমি জানি না৷ তবে কী করলে খারাপ হবে সেটা জানি৷ কাল আবার এসো মাঠের এইখানে৷ আমিও চলে আসব৷’
‘কারণটা কিন্তু বললেন না আপনি৷’
‘যদি একান্তই না মানতে চাও তাহলে বলব কারণটা৷ তবে সেটা না হলেই ভালো৷ চলি আজ৷’
খানিকটা হেঁটে অন্ধকারের মধ্যে ডুবে গেল লোকটা৷ ক্লান্ত পায়ে উঠে দাঁড়াল তন্ময়৷ মাথাটা ভোঁ-ভোঁ করছে৷ একটু আগে দীপ্তির দেওয়া কাগজের টুকরোটা ব্যাগের সামনের চেনে রাখা আছে৷ সেটা বের করে চোখের সামনে ধরল সে৷ মার্কারি ভেপারের জীর্ণ আলোতেও চিনে নিতে পারল কয়েকটা অক্ষর—এ পি বাই টয়েন্টিটু৷
লাইব্রেরি থেকে বই হাতে বেরিয়ে থমকে দাঁড়াল তন্ময়৷ বইয়ের ভাঁজ খুলে কিছু যেন দেখল৷ মনে মনে হাসল তারপর সেই ভাঁজের ভিতর থেকে একটা ছোটো কাগজ বের করে পকেটে চালান করে দিল৷ একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে দীপ্তি৷ সেও বই নিতে এসেছে৷ এই মুহূর্তে তাকে চিনতেই পারছে না৷ চারপাশটা মোটামুটি ফাঁকা৷ তন্ময় সেদিকে এগিয়ে এল৷ হাতের বইটা তুলে ধরে বলল, ‘এত বই থাকতে ট্রেজার আইল্যান্ড! অন্য কারওর হাতে পড়লে?’ বলল, ‘এত বই
‘ধুর, এসব বই আর কেউ পড়ে না৷’
বইথেকে বের করা কাগজটা হাতে নিয়ে আর একবার দেখল তন্ময়, বলল, ‘তিন জায়গায় বানান ভুল আছে৷ কোনদিনও; শেষে ওকার নয়, ও হবে৷ আর ভালোবাসা তালব্য স নয়৷ দন্ত-স৷ এই বাসা মানে হল বাড়ি৷ প্রেমপত্রটাও মানুষের মতো লিখতে শিখলি না৷’
‘তোর পকেটে ওটা কী রে?’
এতক্ষণ তন্ময় খেয়াল করেনি যন্ত্রটা থাকার জন্য পকেটটা ফুলে আছে৷ বাইরে থেকে একনজরে দেখলে সিগারেটের প্যাকেট বলে মনে হয়৷ মুহূর্তে সে ভেবে নিল কতটা বলা যাবে আর কতটা যাবে না৷ ধীরে সুস্থে সেটা পকেট থেকে বের করে বলল, ‘এই দেখ৷’
যন্ত্রটা এখন চালানো নেই৷ ফলে স্ক্রিনের উপর কোনও সংখ্যা দেখা যাচ্ছে না৷ সেটাকে ভালো করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে দীপ্তি বলল, ‘কী হয় এটা দিয়ে?’
‘আমিও ঠিক জানি না৷’ তন্ময় আমতা আমতা করল৷
‘সেকি! তাহলে নিয়ে কী করছিস?’ দীপ্তি অবাক হয়ে গেল৷
‘কিছুই না৷ কুড়িয়ে পেয়েছিলাম৷’
স্ক্রিনের ঠিক নীচেই বড়ো বোতামটা চোখে পড়তে সেটা টিপে দিল দীপ্তি৷ সঙ্গে সঙ্গে জ্বলজ্বলে সংখ্যা ফুটে উঠল স্ক্রিনের উপর৷ অবাক চোখে সেদিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘এই নাম্বারগুলো কী রে?’
তন্ময় লক্ষ্য করল নম্বরগুলো এখন আগের থেকে অনেক কমে এসেছে৷ এক হাজারের কাছে ঘোরাফেরা করছে৷ অর্থাৎ এক কিলোমিটারের মধ্যেই আছে সে৷ মুখে কিছু বলল না সে৷ কীরকম যেন অস্বস্তি শুরু হয়ছে৷
‘এটাকে নাড়ালে নম্বরগুলো বদলাচ্ছে৷’ নীচু স্বরে কথাটা বিড়বিড় করতেই হঠাৎ দীপ্তির চোখ মুখ জ্বলে উঠল, ‘মনে হচ্ছে যন্ত্রটা যার তার থেকেই আমাদের দূরত্ব বোঝাচ্ছে৷ ভারী মজার জিনিস তো…’
তন্ময়ের মুখে কিন্তু হাসি শুকিয়ে গেছে৷ সে এখন কোনওরকমে বাড়ি যেতে পারলে বাঁচে৷ জিনিসটা আগে ফেলে দিলেই ভালো হত৷
‘চল খুঁজে দেখি৷ বেশিদূর তো নয়৷ ফেরত দিয়ে আসব৷’
তন্ময় বাধা দিয়ে উঠল, ‘না না, তুই কেন যাবি? আমি নিজেই কখনও গিয়ে ফেরত দিয়ে আসব৷’
‘কেন আমি গেলে কী হয়েছে তোর? সম্মান যাবে?’
আর বাধা দিল না তন্ময়৷ বুঝল এর বেশি যুক্তি দেখাতে গেলে দীপ্তির জেদ ক্রমশ বাড়তেই থাকবে৷ সেটা হলে ব্যাপারটা আরও খারাপের দিকে গড়াবে৷ খানিক ভেবেচিন্তে রাজি হল সে৷ যে মেয়েটার কাছে যন্ত্রটা নিয়ে যাবে সে তো নিতে চাইবে না৷ তখন দীপ্তি ব্যাপারটাকে কীভাবে নেবে সেটাই বড়ো কথা৷ খোলা রোদে দুপুরের রাস্তায় হাঁটতে লাগল দু-জনে৷ তাড়াতাড়ি হবে এবং লোকজন দেখার সম্ভবনা কম বলে মেন রাস্তায় ওঠেনি ওরা৷ এই রাস্তাটা খানিকটা নির্জন৷ একপাশে সারবাঁধা একতলা বাড়ি৷ সেই বাড়ির বাইরে কঞ্চি দিয়ে বেড়া দেওয়া আছে৷ কতগুলো মেনি বিড়াল জবুথুবু হয়ে বসে গেরস্থের দরজার দিকে ঠায় তাকিয়ে আছে৷ হাঁটতে হাঁটতে তন্ময়ের মনে পড়ল কালকের লোকটার কথা৷ সেই যত নষ্টের গোঁড়া৷ কোথাকার কে হনু৷ এসে ঠিক করে দেবে সে কার সঙ্গে মিশবে না৷ অবশ্য লোকটাকে হাতে রাখলে মন্দ হয় না৷ কিসে খারাপ হবে সেটা যদি আগে থেকে জেনে যাওয়া যায় তবে সাফল্য ঠেকায় কে৷
‘তোর ব্যাপার কী বলত? কী ভাবছিস এত?’
এইসব ভাবতে ভাবতে খানিকটা পিছিয়ে পড়েছিল তন্ময়৷ একটু থতমত খেয়ে বলল, ‘না, ভাবছিলাম বড়ো হয়ে কী হতে চাই৷’
‘বাবা!’ দীপ্তির গলায় অবিশ্বাস স্পষ্ট, ‘আজকাল এসব ভেবে সময় নষ্ট করছিস যে৷ তা কী ভাবলি?’
‘যদি ডাক্তার হই?’
জোরে জোরে হেসে উঠল দীপ্তি, ‘তুই ডাক্তার!’
‘চেষ্টা করলে না হওয়ার কী আছে?’
‘ধুর৷ ডাক্তার আমার ভালো লাগে না৷ ছেলেবেলায় তেড়ে ইঞ্জেকশন দিত৷’ কী যেন ভেবে একটু উদাস হল তন্ময়৷ কিছুক্ষণ চুপচাপ৷ শুধু হাঁটার শব্দ৷ দীপ্তির হাতে ধরা যন্ত্রটায় সংখ্যা নিম্নগামী৷ অর্থাৎ সে কোথাও বসে, দাঁড়িয়ে বা শুয়ে আছে৷ আচমকা একটা প্রশ্ন করে বসল তন্ময়, ‘আচ্ছা আমার মাথায় যদি টাক পড়ে যায়?’
‘ভালোই তো, দাদুর মাথায় টাক ছিল সেই টাকে তেল মাখছিল… তারপরে কী যেন৷’
‘ধুর শালা, ইয়ার্কি করছি আমি?’
‘ও করছিস না? সত্যি জানতে চাস তোর টাক পড়লে আমি কী করব৷’
তন্ময় মাথা নাড়াল৷ চুপ করে কী যেন ভাবতে লাগল দীপ্তি৷ খানিক দূর এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘আচ্ছা আগে আমাকে একটা কথা বল?’
‘কী কথা?’
‘ধর তুই কাগজে আমার জন্য পাত্র-চাই এর বিজ্ঞাপন দিচ্ছিস, তাহলে কী লিখবি?’
‘হুম… পঃ বঃ মাহিষ্য, গৌরবর্ণ, স্লিম, পিতা বেসঃ চাকুরে৷ কলিতে নিজস্ব বাড়ি আর…’
‘ব্যস ব্যস! আর বলতে হবে না, এবার বল কারও মুখে আমার নাম শুনলে এই পঃ বঃ কলিতে বাড়ি, স্লিম এইসব মনে পড়ে তোর?’
‘হেঁ হেঁ, ধুর৷ না৷’
‘তালে?’
‘পরপর ক-দিন স্কুলে এলে রোদে তোর গৌরবর্ণ দফারফা হয়ে যায়৷ নীচের পাটির দাঁতগুলো এবড়ো খেবড়ো, যেগুলো ঢেকে রাখার জন্য এইটুকুর বেশি হাসিস না, আর…’
‘বলে ফেল, আর লজ্জা করে কী হবে?’
‘তোদের পাড়ার কেষ্টদার গালে টোল পড়ত বলে ক-দিন নাচিয়ে ছিলি, তারপর কেষ্ট চৌমাথার মোড়ে চানাচুরের দোকান করতে চক্ষুলজ্জার ভয়ে ওকে লেঙ্গি দিলি৷’
‘এইটা তুই জানলি কী করে?’
‘কেষ্টই বলছিল, এও বলেছে এখন তুই ওর ভাইটার জন্য ফাঁদ পেতেছিস৷’
‘এই এই … এইটা বাজে কথা কিন্তু৷ আমার নামে রটাচ্ছে ছোটোলোকটা৷’
‘সে যাই হোক, আমার টাকের ব্যাপারটা…’
‘ও হ্যাঁ, তোর টাক না? দেখ একটা মানুষ মানে কতগুলো অনুস্বার নয়৷ আজ হোক বা পরে… তোর কথা ভাবলে আমার, খুলিতে সুবিন্যস্ত কেশঃ মনে পড়বে না৷’
‘হুম… ঠিকই বলেছিস তবে ওটা অনুস্বর না৷ বিসর্গ!’
‘ওই একই হল৷ চল তাড়াতাড়ি৷ অবজেক্ট আর স্থির নিই৷’
যন্ত্রের সংখ্যাটা পঞ্চাশে পৌঁছাতেই একটা বড়োসড়ো পুকুরের সামনে এসে পড়ল ওরা দু-জনে৷ পুকুরের ধার জুড়ে লম্বা পার্ক করা আছে৷ সেখানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে লোকজন৷ অল্প, মাঝারি এবং প্রাপ্ত, তিন বয়সের মানুষই চোখে পড়ছে৷ যন্ত্রটা দীপ্তির হাতে৷ এক পা এক পা করে দিক ঠিক করে এগিয়ে যাচ্ছে সে৷ তন্ময় চারপাশে তাকাল৷ অল্প বয়সি কয়েকটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে৷ কেউ বসে আবার কেউ হেঁটে চলে সরে যাচ্ছে৷ আর পনেরো মিটার৷ তন্ময়ের বুকের ভিতর একটু আগের অস্বস্তিটা আবার বেড়ে উঠল৷
‘ওই মেয়েটা মনে হচ্ছে৷ দেখ৷ বসে আছে৷’
খানিকটা দূরেই ঘাসের উপর ওদের দিকে পিঠ করে বসে আছে একটা মেয়ে৷ পিছন থেকে সোজা খয়েরি রঙের চুল চোখে পড়ছে৷ এরকম চুলের কথাই তো লিখেছিল সাইটটায়৷ সেটা তার মানে মিথ্যে ছিল না৷
‘আয় দেখি আমার সঙ্গে, জিজ্ঞেস করি এটা ওরই কি না৷’
তন্ময় এগোল না৷ জিনিসটা যে মেয়েটার নয় সেটা তার থেকে ভালো আর কে জানে৷ অর্থাৎ সে নিতে চাইবে না৷ তারপর কী হবে?
‘আরে এটা তো আমার, তুমি পেলে কী করে?’
একটা চেনা গলা শুনে চোখ তুলে তাকাল তন্ময়৷ গলাটা তার নিজের৷ শুধু একটু বয়সের ছাপ৷ কালকের লোকটা এসে দাঁড়িয়েছে দীপ্তির সামনে৷ সে বলল, ‘পড়ে গেছিল, ওই যে ও আমার বন্ধু খুঁজে পেয়েছে৷ দারুণ জিনিস কিন্তু…’
লোকটা হাসল, ‘তাই? কী হয় জানো এটা দিয়ে?’
‘সেটাই বুঝতে পারিনি৷’
ডাক্তার সান্যাল চোখ তুলে তাকালেন তন্ময়ের দিকে৷ তার সেই অর্থপূর্ণ চোখ দুটোতে কিছুর একটা ইঙ্গিত খেলে গেল৷ তন্ময় মাথা নামিয়ে নিল৷ সান্যাল দীপ্তির মাথায় একটা হাত রাখলেন৷ একটা অবর্ণনীয় হাসি খেলা করছে তার মুখে৷ তার মাঝেই চোখের কোল গড়িয়ে একফোঁটা জল নামল৷ দীপ্তি অবাক হয়ে গেল, ‘একী! কাঁদছেন কেন?’
‘অনেকদিন দেখিনি তোমাকে৷’ অজান্তে সান্যালের মুখ থেকে বেরিয়ে গেল কথাটা৷
‘আপনি আমাকে আগে দেখেছেন?’
‘হ্যাঁ, অনেকবার৷’
দীপ্তি অবাক চোখে একবার সান্যালের দিকে আর একবার তন্ময়ের দিকে তাকাল৷ তারপর বেশ কিছুটা পিছিয়ে এল সে৷ বিকেলের নরম আলোয় তার মুখটা মায়াবী দেখাচ্ছিল৷ এতদূর হেঁটে আসার জন্য ক্লান্তির ছাপ পড়েছে শরীরে৷
‘চল বাড়ি যাই৷ সন্ধে নামবে৷’ তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলল দীপ্তি৷
‘একটু পরে যেও৷’ সান্যাল বললেন, ‘আমার কিছু কথা আছে৷’
‘কী কথা, বলুন৷’
‘তোমার সঙ্গে নয়৷ ওর সঙ্গে৷’
এবার যেন একটু ঘাবড়ে গেল দীপ্তি৷ তন্ময় এতক্ষণ কোনও কথা বলেনি৷ তার সঙ্গে যে লোকটার কী দরকার সেটাই সে বুঝতে পারছে না৷ দীপ্তি ফিসফিস করে বলল, ‘মালটার মুখ দেখেই মনে হচ্ছে গে৷ পার্কে তোকে একা পেয়ে বলাৎকার না করে দেয়৷’ বলে খিকখিক করে চাপা হাসল৷
‘মুখ দেখে আর কী মনে হচ্ছে?’ নীচু স্বরে জিজ্ঞেস করল তন্ময়৷
‘কন্সটিপেসনে নিয়মিত ভোগে৷’
‘হুম… আর?’
‘একটু আলুর দোষ আছে৷’
কটমট করে তার দিকে একবার তাকাল তন্ময়৷ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ সান্যাল তার কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, ‘ও এখানে থাকুক, আমরা চল ওই বেঞ্চটায় গিয়ে বসি৷’
দীপ্তি অবাক চোখে তাকিয়েছিল৷ কিন্তু আর বাধা দিল না সে৷ সান্যাল আর তন্ময় কয়েক পা হেঁটে একটু দূরে এসে একটা বেঞ্চে বসে পড়ল৷ এতক্ষণে গলায় জোর এল তন্ময়ের৷ বলল, ‘যা বলার জলদি বলুন৷ বাড়ি ফিরতে হবে আমাদের৷ আর আপনার পারফেকশন আপনার কাছেই রাখুন; আমার দরকার নেই৷’
‘ও জিনিসটা কিছুদিন হল আবিষ্কার হয়েছে জানো? এতে কী হয় বুঝতেই তো পেরেছ৷’
‘খানিকটা৷’
‘পুরোটাই পারবে৷ আমাদের সময়ে দেশের প্রত্যেকটা মানুষের যাবতীয় তথ্য প্রশাসনের কাছে থাকে৷ মানে ধর তোমার চা খেতে ভালো লাগে না কফি, ক্রিকেট খেলতে ভালো লাগে না ফুটবল, এইরকম সব কিছু৷ সবার ভালো লাগা একরকম হয় না৷ দুটো মানুষের মানসিকতা যত বেশি কাছাকাছি হয় তত আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালো হয় তাদের…’
‘মানে বলছেন এইসব তথ্য নিয়ে দেশই বিয়ের ঘটকালি করে? তাতে লাভ কী?’ অবাক হয় যায় তন্ময়৷
‘লাভ অনেক কিছু৷ ভবিষ্যতে কোন মানুষটার সঙ্গে তুমি সব থেকে ভালো থাকবে সেটা আগে থেকে বুঝে নেওয়া যায়৷’
‘বুঝেছি৷ কিন্তু আমি ভালো আছি দিব্যি৷ আপনি আসতে পারেন৷’
দূরে তাকিয়ে তন্ময় দেখতে পেল দীপ্তি হাওয়াই মিঠাই কিনছে৷ সান্যাল এবার সেদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দেখে নাও হে ছোকরা৷ সারাজীবন এরকমটি থাকবে না৷’
এই প্রথম তন্ময়ের মনে হল লোকটা তার ভবিষ্যৎ হলেও হতে পারে৷ কিন্তু সে যাই হোক এই মুহূর্তে তার আর ভবিষ্যৎ জানতে ইচ্ছা করছে না৷ উত্তর দিয়েই দিয়েছে, বেঞ্চ ছেড়ে উঠে পড়তে যাচ্ছিল সান্যাল হাত ধরে থামিয়ে দিলেন৷ ‘দাঁড়াও৷ তোমাকে কথাটা কেন বলেছিলাম জেনে যাও৷’
জামার পকেটের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে একটা ছবি বের করে আনলেন সান্যাল৷ সেটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি কিন্তু আগে তোমাকে বলতে চাইনি৷ যাই হোক—দেখ এটা৷’
হাতে নিয়ে তন্ময় দেখল ছবিটা কোনও মানুষের৷
বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে বোঝা যায়, মহিলা৷ কোনও মারণ রোগের আক্রমণে মুখটা রক্তশূন্য৷ সেখানে মাঝে মাঝে চামড়া ফাটা দাগ৷ চোখের উপর থেকে ভুরুর রেখা উধাও৷
‘কে ইনি?’ প্রশ্নটা অজান্তেই তন্ময়ের মুখ থেকে বেরিয়ে এল৷ সান্যাল উত্তর দিলেন না৷ তার চোখ দুটো এখনও তাকিয়ে আছে দীপ্তির দিকে৷ বিস্ময়, যন্ত্রণা আর শূন্যতা খেলা করে যাচ্ছে সেখানে৷
‘চার বছর হল ওর ক্যানসার ধরা পড়েছে৷’
কাঁপা কাঁপা হাতে ছবিটা কয়েকবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল তন্ময়৷ না কোনও মিল নেই মুখের৷ এতটুকু মিল নেই৷ হতেই পারে না৷ মিথ্যে কথা বলছে লোকটা৷
‘যে যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে আমি গেছি আমি চাই না সেটা তুমি আবার ভোগ কর৷’
তন্ময় কোনও উত্তর দিল না৷ তার কানটা ধীরে ধীরে লাল হয়ে উঠছে৷ সান্যাল বলে চললেন, ‘তুমি আজ যা ভাব পনেরো বছর আগে আমি ঠিক তাই ভাবতাম৷
কিন্তু বিশ্বাস কর, যেদিন আমার জুতোয় পা গলাবে সেদিন বুঝবে এ যন্ত্রণাটা ঠিক কী… প্রতিদিন রাতে… এখনও ও বন্ধু হয় তোমার৷ এখন কষ্টটা অনেক কম হবে৷ পনেরো বছর একসঙ্গে কাটানোর পর…’
‘এ ঘটনাটা যে ঘটবেই জানলেন কেমন করে? সিগারেট যদি কম খায়…’
‘এ রোগটা কেন হয় কেউ জানে না৷ এমন লোকেরও হয়েছে যারা সারাজীবনে সিগারেটের ধারে কাছেও যায়নি৷’
দু-হাতে মুখ ঢেকে নিল তন্ময়৷ তার বন্ধ হয়ে আসা গলার ভিতর থেকে কয়েকটা শব্দ বেরিয়ে এল, ‘আমি ওকে ছেড়ে যাব না৷ আপনি চলে যান এখান থেকে৷’
স্মিত হাসিটা আবার ফিরে এল সান্যালের মুখে, ছবিটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বললেন, ‘জানতাম সব জানার পরও তুমি এটাই বলবে৷ আচ্ছা এক কাজ কর৷ তুমি বরং উত্তরটা ওকেই জিজ্ঞেস কর৷’
‘ওকে বলব এইসব৷ আপনি পাগল!’
‘আমি যা বলেছি সেটা বলতে হবে না৷ শুধু জিজ্ঞেস কর ওর মতামতটা কী৷ তারপর ভেবে দেখ৷ কাল ওই মাঠেই দেখা হবে আবার৷ হয়তো শেষবার৷ চলি এখন৷’
ডাক্তার সান্যাল চলে যেতে ধীরে ধীরে উঠে পড়ল তন্ময়৷ এখনও হাজার লোকের মেলা মাঠজুড়ে৷ অথচ দীপ্তি ছাড়া যেন কাউকেই চোখে পড়ছে না তার৷ সে হাওয়াই মিঠাই হাতে ধরে আগ্রহী চোখে তাকিয়ে আছে তন্ময়ের হেঁটে আসা শরীরটার দিকে৷ কাছে আসতেই জিজ্ঞেস করল, ‘ছবি দেখাচ্ছিল রে? মেয়ের বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজছিল?’
তন্ময় বসে পড়ল৷ কিছুক্ষণ একটানা দূরের দিকে তাকিয়ে থেকে অবশিষ্ট হাওয়াই মিঠাইটা নিয়ে নিল তার হাত থেকে৷ সেটায় কামড় দিতে দিতে বলল, ‘লোকটার জন্য খারাপ লাগছে৷’
‘কেন?’
‘ওর স্ত্রীর ক্যানসার ধরা পড়েছে৷’
‘এ বাবা!’ এই প্রথম দীপ্তির মুখে সন্ধের ছায়া নামল৷
‘আমি ভাবছি লোকটা যদি আগে থেকে জেনে যেত যে এরকম কিছু একটা হবে তাহলে?’
‘মানে?’
‘মানে দেখ, যার শারীরিক যন্ত্রণা পাবার সে তো পাবেই৷ তাকে যারা ভালোবাসে তাদের যন্ত্রণা আবার অন্য জায়গায়৷ দুটো মানুষের সাফার করার থেকে একজনের সাফার করা ভালো না?’
‘হু… আমারও তাই মনে হয়৷’
‘তুই থাকলে কী করতিস?’ প্রশ্নটা করতে বিন্দুমাত্র সময় নিল না তন্ময়৷
‘জিন্দেগী কা সাফার/হ্যায় ইয়ে ক্যায়সা সাফার…’ (সুর করে)
‘আরে ধুর৷ ইয়ার্কি মারছি না৷’
‘ও মারছিস না? তাহলে ভাবতে দে৷’
তন্ময়ের মনে হল দীপ্তি সত্যি কিছু ভাবছে৷ হাতের কাঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে৷ কিছুক্ষণ উদাস মুখে চুপ করে থেকে হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার চোখ দুটো, ‘মনে পড়েছে৷ র্যাক নম্বর বি-পি বাই সেভেন্টিন৷ বাহাত্তর পাতা৷’
‘সে কী! আমি তো এইমাত্র প্রশ্নটা করলাম তোকে৷’
‘তাতে কী? আমি আগে থেকেই রেখে দিয়েছি৷’
‘কী করে?’
‘জানিস না? ভবিষ্যৎ দেখতে পাই আমি৷ এই যেমন দেখতে পাচ্ছি তিন মিনিটের মধ্যে একটা সিগারেট দিবি তুই আমাকে৷’
‘নেই আমার কাছে৷ কিন্তু লাইব্রেরি তো বন্ধ হয়ে গেছে৷’
‘তাতে কী? কাল খুলবে৷ TOMORROWS SUN WILL BE RISE’.
তন্ময় উঠে পড়ল৷ এবার ঘন সন্ধ্যা নামছে চারিদিকে৷ বাড়ি ফিরতে আর দেরি হলে মুশকিল আছে৷ ‘চল, এবার আর হেঁটে ফিরব না৷’ দীপ্তিও উঠে পড়ল বেঞ্চ ছেড়ে৷ খানিকটা এগিয়ে এসে নীচু স্বরে বলল, ‘এবার আর আমার ভুলটা ধরলি না যে…’
‘কোন ভুল?’
আর কোনও উত্তর শোনা গেল না৷ শহরের বাড়িগুলোর খাঁজে খাঁজে কুয়াশা নামছে৷ খানিক দূরের মানুষকেই দেখতে পাওয়া যায় না৷ শব্দ শুনে চিনে নিতে হয় কোনটা বাইক কোনটা সাইকেল কোনটা রিক্সা৷ ‘সরে আয় এদিকে৷’ দীপ্তির হাত ধরে তাকে মেন রোড থেকে ফুটপাথে টেনে আনল তন্ময়৷ তারপর আর ছাড়ল না হাতটা৷
আজকের বিকেলটা একটু অন্যরকম৷ সূর্যটা ডুবে যাওয়ার কোন তাড়া দেখাচ্ছে না৷ একটা রাতপাখি বাঁশবনের ভিতর থেকে ক্রমাগত হুমকি দিয়ে চলেছে তাকে৷ মাঠ থেকে ভাসানো চিৎকার শোনা গেল, ‘এই আলো কমে এসেছে রে, আর জোরে বল করিস না৷’
তাদের থেকে অনেকটা দূরে৷ খানিকটা নির্জনে বসে আছে দুটো ছায়ামূর্তি৷ তাদের দু-জনেরই চোখ মাটির দিকে৷
‘তোমার এই সিদ্ধান্তের কারণ?’ ডাক্তার সান্যাল জিজ্ঞেস করলেন৷
‘সিদ্ধান্ত তো আমার নয়৷ আপনি তো ওর মতামত নিতে বলছিলেন৷’ তন্ময় বলল৷
‘হ্যাঁ৷ কী বলেছিল ও?’
‘বলেছিল বি পি বাই সেভেন্টিন৷ বাহাত্তর পাতা৷’
‘তার মানে?’ অবাক গলায় প্রশ্ন করলেন ডাক্তার সান্যাল৷
‘ভুলে গেছেন দেখছি৷ পাড়ার লাইব্রেরির বইয়ের দুটো পাতার মাঝখানের একটা জায়গা ওটা৷ ওর গোপন কিছু বলার থাকলে সেটা কাগজে লিখে বইয়ের ভিতর রেখে আসে৷ আমাকে খালি নম্বরটা বলে৷’
‘হুম… তারপর… কাগজটায় কী লেখা ছিল৷’
‘কোনও কাগজ ছিল না ওখানে৷ ফাঁকা৷’
ডাক্তার সান্যালের ঠোঁটের কোনায় একটা করুণ হাসি খেলে গেল৷ তন্ময়ের পিঠে একটা হাত রেখে বললেন, ‘কিছু জিনিসকে আগে থেকে জানলেও পালটানো যায় না৷ শুধু তার ইমপ্যাক্টটা কমানো যায়৷ আজ অল্প কষ্টের সঙ্গে মানিয়ে নিলে পরে আর ভয়ানক যন্ত্রণা পেতে হবে না৷’
‘হুম… ঠিকই বলেছেন আপনি৷’
‘তোমার আর যা যা জানার দরকার হবে বোলো৷ আমি সাহায্য করলে খারাপ কিছু হবে না তোমার জীবনে৷’
‘সত্যি বলছেন?’
‘আচ্ছা বল আর কী জানতে চাও৷’
‘আপনি বিদায় হচ্ছেন কখন? পার্মানেন্টলি? দীপ্তির সঙ্গে দেখা করার কথা আছে আধ ঘণ্টা পরে৷’
‘মানে? ও তো উত্তর দিয়ে দিয়েছে৷ কাগজ না থাকার অর্থ বোঝো না?’ এই প্রথম সান্যালের গলায় রাগ ফুটে উঠছে৷
‘প্রথমে বুঝেছিলাম৷ তার পরে দেখলাম বইয়ের ওই পাতায় একটা কবিতা ছাপা আছে৷ শঙ্খ ঘোষের কবিতা৷ সেটা পড়ে বুঝলাম আমাকে হাতে লেখা কাগজ নয়, ওই পাতাটাই দেখাতে চেয়েছিল ও৷ এই দেখুন, ছিঁড়ে এনেছি৷’
‘কবিতা! যাই হোক, পড়ে শোনাও চশমা নেই আমার কাছে৷’ ছোটো কাগজটা খুলে ধরে পড়তে থাকে তন্ময়, এতে লেখা আছে—
‘হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয়
সারাজীবন বইতে পারা সহজ নয়
এ কথাটা খুব সহজ কিন্তু কে না জানে
সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়৷
পায়ের ভিতর মাতাল আমার পায়ের নীচে
মাতাল৷ এই মদের কাছে সবাই ঋণী-
ঝলমলে ঘোর দুপুরবেলাও সঙ্গে থাকে
হাঁ করা ওই গঙ্গাতীরের চণ্ডালিনী৷
সেই সনাতন ভরসাহীনা অশ্রুহীনা
তুমিই আমার সব সময়ের সঙ্গিনী না?
তুমি আমায় সুখ দেবে তা সহজ নয়
তুমি আমায় দুঃখ দেবে, সহজ নয়৷’
‘এই কবিতা পরেই মাথা ঘুরে গেল তোমার৷’
সান্যাল গর্জে উঠলেন, ‘ক্যানসার কাকে বলে বোঝোনি এখনও, বোঝার বয়স হয়নি তোমার৷’
‘না, বুঝি না৷ আমি জীবন বিজ্ঞানে তো বরাবরই কাঁচা৷ আমি ইতিহাসে বেশি নম্বর পাই৷ আর ইতিহাস মানে ছোটো ছোটো মানুষের হার না মানার গল্প, লড়াইয়ের গল্প৷ ইতিহাস মানে প্রবল দাঙ্গার সময় যে মুসলমান লোকটা কোনও হিন্দু মেয়েকে জীবন দিয়ে বাঁচিয়েছিল৷ বা উলটোটা৷ আপনি কবে ভুলে গেলেন তন্ময়বাবু যে জীবন মানে শুধু সুখ আর নিরাপত্তার খোঁজ করা নয়৷ শুধু ভালো থাকার জন্য বেঁচে থাকা যায় না৷ ভালোবাসা কিন্তু দন্তে স না৷ তালব্যশ৷ ভুল—কিন্তু ভুলটাই ঠিক৷ আমি জানি আজ আমি ভুল করছি৷
আমি জানি দীপ্তি সারাজীবন আমার কাছে থাকবে না, যুদ্ধের শেষে একদিন আমি ঠিক হেরে যাব৷ কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাব না আমি৷ আপনিও পালাবেন না৷ ফিরে যান৷’
‘ভুল করলে তুমি৷ একটা বয়সে গিয়ে পস্তাবে৷’
সান্যাল উঠে পড়লেন৷ অন্ধকারেও তার চোখদুটো রাগে জ্বলছে৷ সেটা তন্ময়ের ভবিষ্যৎ যন্ত্রণার কথা ভেবে না এইটুকু ছেলের স্পর্ধায় তা বোঝা যায় না৷ লোহার বেঞ্চের উপর ঘুসি মারলেন একটা৷ আর সেখানে দাঁড়ালেন না তিনি৷ মেঠো রাস্তার ধার দিয়ে হাঁটতে লাগলেন পা চালিয়ে৷ তন্ময় মাঠ থেকে বেরিয়ে এল৷ কাগজটা এখনও হাতে ধরা আছে তার৷
ল্যাম্পপোস্টটা খারাপ হয়ছে৷ জ্বলছে না সেটা৷ রাস্তাটা অন্ধকার৷ একটু দূরে একটানা শাঁখ বাজার আওয়াজ আসছে৷ শরীরের গভীরে ঢুকে পড়ছে ঘন জমাট অন্ধকার৷ একটু পরে দীপ্তি এসে দাঁড়াবে এখানে৷ একটু দূরেই মাটির উপর তার পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে৷ চোখের পাতা ফেলার শব্দ৷ হাওয়ায় মৃদু কম্পন৷ আজ সন্ধেয় তন্ময়ের সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলো বেশি সজাগ হয়ে উঠেছে৷ ‘কিহে নটবর, আজ আগে এসে দাঁড়িয়ে?’ সামনে থেকে ভেসে এল কৌতুকটা৷
কৌতুককারিণীকে দেখা গেল না৷
‘আমি সময়েই এসেছি, তুই দেরি করেছিস৷’
‘আর জায়গা পেলি না? উফ কী অন্ধকার এখানটা৷’
‘মুন্ডুটা উপরে তোল, চাঁদ উঠেছে আজ৷ আমি তো বেশ দেখতে পাচ্ছি তোকে৷’
‘এখন পাচ্ছিস৷ রাতের দিকে এতটা রাস্তা দিয়ে হেঁটে ফিরতে হবে৷’
‘তো? ভয় করবে তোর?’
‘না, এভাবে ভয় লাগে না আমার৷’
‘আমারও৷’
ফিকে অন্ধকারে দুটো মানুষ আরও কাছে সরে এল৷ সামনে অনেকটা রাস্তা খালি পড়ে আছে৷ লোক নেই, জন নেই, গাড়ি ঘোড়া কিচ্ছু নেই৷ শুধু সোজা রাস্তা চাঁদের আলো মেখে শুয়ে আছে৷ তার উপর দিয়ে নিঃশব্দে হাঁটতে লাগল দু-জনে৷