চিন্ময়ের চাকরি

চিন্ময়ের চাকরি

চিন্ময়ের মুখে মামার ভাত তিক্ত হইয়া গিয়াছিল। মামী মানুষটি ভাল তাই রক্ষা, নহিলে এতদিন সে মামার বাড়িতে টিকিতে পারিত না।

আজ আট মাস হইল সে চাকরির খোঁজে কলিকাতায় আসিয়াছে এবং মামার স্কন্ধে আরোহণ করিয়াছে। সে পিতৃহীন; তাহার মা উত্তরবঙ্গে কোনও শহরের একটি হাসপাতালে নার্সের কাজ করেন। তিনি চিন্ময়কে আই. এ. পর্যন্ত পড়াইয়াছেন, কিন্তু আর অধিক পড়াইবার সামর্থ্য তাঁহার নাই; চিন্ময়ও আর পড়িতে চায় না। কোনও রকমে একটি চাকরি জুটাইয়া সে স্বাধীন হইতে চায়, মায়ের দুঃখ দূর করিতে চায়। তাহার বয়স কুড়ি বছর।

কলিকাতায় আসিয়া এই আট মাস সে চাকরির খোঁজে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, অসংখ্য দরখাস্ত করিয়াছে, সরকারী এমপ্লয়মেন্ট ব্যুরোতে ধর্না দিয়াছে, কিন্তু চাকরি পায় নাই। কেহ তাহার দরখাস্তের জবাব পর্যন্ত দেয় নাই। মামা মধ্যবিত্ত গৃহস্থ, ছেলেপিলে আছে; মুখে কিছু না বলিলেও মনে মনে অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছেন তাহা বেশ বোঝা যায়। সঙ্গতি যেখানে অল্প, সেখানে দয়া দাক্ষিণ্য স্নেহ প্রীতির স্থান কোথায়?

তবু চিন্ময় দাঁতে দাঁত চাপিয়া পড়িয়াছিল। যেমন করিয়া থোক একটা চাকরি তাহার চাই; বেশী নয়, পঞ্চাশ-ষাট টাকার চাকরি হইলেও চলিবে। কোনও রকমে নিজের অন্ন-সংস্থান করিতে পারিলে সে ধন্য হইবে। পরের অন্ন আর তাহার গলা দিয়া নামিতেছে না।

অবশেষে তাহার নাছোড়বান্দা অধ্যবসায়ের ফলেই বোধ হয় হঠাৎ একদিন একটু আশার আলো দেখা দিয়াছিল। কয়েক মাস পূর্বে সে এক বিলাতি সওদাগরী অফিসে দরখাস্ত করিয়াছিল, আজ তাহার উত্তর আসিয়াছে; কর্মকতা আগামী কল্য তাহাকে দর্শন দিবেন, সে যেন বেলা দশটার সময় অফিসে গিয়া তাঁহার সহিত দেখা করে।

চিঠি পাওয়া অবধি চিন্ময়ের মন আনন্দে নৃত্য করিতেছে। সারা দিন সে বিহ্বলভাবে ছটফট করিয়া বেড়াইয়াছে, চিঠিখানি বারবার খুলিয়া পড়িয়াছে এবং মনে মনে ভাবিয়াছে—চাকরি পাইলে সে দিবা-রাত্র কাজ করিবে, দরকার হইলে প্রভুর পদসেবা পর্যন্ত করিবে, কোনও কাজেই পশ্চাৎপদ হইবে না। ভগবান, চাকরিটা যেন হয়।

রাত্রে আহারের পর চিন্ময় চুপি চুপি মামীকে বলিয়াছিল, ‘মামীমা, এখন শুলে ঘুম হবে না, আমি একটু পার্কে বেড়াতে যাচ্ছি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফিরে আসব।’

মামী তাহার মনের অবস্থা বুঝিয়াছিলেন, ‘আচ্ছা। সদর-দরজা খোলা থাকবে।’

চিন্ময়ের মামা যে পাড়ায় থাকেন, তাহা খুব উচ্চ শ্রেণীর পাড়া নয়; কিন্তু এখান হইতে আধ মাইল রকম দূরে একটা নূতন পার্ক তৈরি হইতেছে। কলিকাতা শহর এই দিকে বাহু বিস্তার করিয়া নূতন জমি গ্রাস করিতেছে। চিন্ময় পার্কের দিকে চলিল।

স্থানটি রাত্রিকালে বেশ নির্জন। পার্কের চারিধারে রেলিং বসানো এখনো সম্পূর্ণ হয় নাই; ভিতরে অনেকগুলি বড় বড় গাছ আছে; গাছের নিচে সিমেন্টের বেঞ্চি। কিন্তু আলোর ব্যবস্থা নাই।

অন্ধকারে চিন্ময় একটি গাছের তলায় বেঞ্চিতে বসিল। চৈত্রের শেষে দিনগুলি ক্রমশ উষ্ণ হইয়া উঠিতেছে বটে, কিন্তু রাত্রির মাধুর্য একেবারে শুকাইয়া যায় নাই। দক্ষিণা বাতাস অভিসারিকার মতো সন্তর্পণে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, যেন সঙ্কেত-স্থানে প্রিয়তমকে খুঁজিতেছে।

কিন্তু চিন্ময়ের প্রাণে কবিত্ব নাই, সে একাগ্র চিত্তে নিজের কথাই ভাবিতেছে। তাহার মন স্বভাবতই আগ্রহশীল ও একনিষ্ঠ, তাই একটা কথা একবার ভাবিতে আরম্ভ করিলে সহজে তাহা ছাড়িতে পারে না। রাস্তা দিয়া কদাচিৎ দুই-একটা মোটর গাড়ি আলোকচ্ছটা বিকীর্ণ করিয়া চলিয়া যাইতেছে; মাথার উপর গাছের নিবিড় শাখা-প্রশাখার মধ্যে নিদ্রালু পাখির কিচিমিচি থাকিয়া থাকিয়া শুনা যাইতেছে; কিন্তু চিন্ময়ের চক্ষু-কর্ণ সম্পূর্ণরূপে অন্তঃপ্রবিষ্ট, সে অন্ধকারে বসিয়া কেবল একটি কথাই ভাবিতেছে : কাল সকালে সে ইন্টারভিউ দিতে যাইবে…যাঁহার কাছে ইন্টারভিউ দিতে যাইবে, তিনি কেমন লোক? তাহাকে পছন্দ করিবেন তো! আই. এ. পাসের প্রশংসাপত্রটা লইয়া যাইতে হইবে, ভুল না হয়—

মন যখন আশা-আকাঙ্ক্ষার চিত্রাঙ্কনে মগ্ন থাকে, তখন সময় কোন দিক দিয়া যায় জানিতে পারা যায় না; দু ঘণ্টা কিভাবে কাটিয়া গিয়াছে চিন্ময় অনুভব করে নাই। তাহার মন একই কথা চিন্তা করিতে করিতে একটু স্তিমিত হইয়া পড়িয়াছিল, হঠাৎ চমক ভাঙিয়া সে সজাগ হইয়া উঠিল।

অতি নিকটে ঠুং করিয়া একটি শব্দ। রিক্সাতে যেমন ঘন্টি বাজে সেই রকম। কিন্তু ঘণ্টি একবার বাজিয়াই থামিয়া গেল, আর বাজিল না। চিন্ময়ের চক্ষু অন্ধকারে খানিকটা অভ্যস্ত হইয়াছিল, সে চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া যেদিক হইতে শব্দ আসিতেছে সেই দিকে চাহিয়া রহিল।

পাঁচ-ছয় গজ দূরে যেন কি-একটা আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। রিক্সা বলিয়াই মনে হয়। সেটা নড়িতেছে। আর একবার ঠুং করিয়া শব্দ হইল, আবার সঙ্গে সঙ্গে নীরব হইল। চিন্ময় ভাবিল, বোধ হয় কোনও রিক্সাওয়ালা এখানে ঘাসের উপর শুইয়া ঘুমাইবার উপক্রম করিতেছে।

তারপর তাহার ভুল ভাঙিয়া গেল। একটা মোটর গাড়ি রাস্তা দিয়া আসিতেছিল, তাহার হেড লাইটের তির্যক ছটায় সমস্ত দৃশ্যটা উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। —

রিক্সাই বটে। রিক্সার মধ্যে একটা স্ত্রীলোকের দেহ আড় হইয়া পড়িয়া আছে; একটা পুরুষ রিক্সার পাশে দাঁড়াইয়া স্ত্রীলোকের দেহটাকে টানিয়া বাহির করিবার চেষ্টা করিতেছে। আলোর ছটা গায়ে পড়িতেই লোকটা ঘাড় ফিরাইয়া সেই দিকে চাহিল; বাঘের মতো ভারি হাম্‌দো একটা মুখ, কিন্তু মুখে ভয় মাখানো। কপালের বাঁ-পাশে ভুরুর উপর লম্বা একটা কালো দাগ।

মোটর চলিয়া গেল। আবার অন্ধকার। চিন্ময়ের বুক ধড়াস ধড়াস করিতে লাগিল, সে মাত্র ছয়-সাত হাত দূরে বসিয়া আছে; কিন্তু লোকটা তাহাকে দেখিতে পায় নাই। লোকটা যে স্ত্রীলোকটিকে খুন করিয়া রিক্সাতে তুলিয়া পার্কে ফেলিয়া দিতে আসিয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই। সে চিন্ময়কে দেখিতে পায় নাই এই ভাগ্য, দেখিতে পাইলে নিশ্চয় তাহাকেও খুন করিত। একবার তাহার মুখ দেখিয়াই চিন্ময় বুঝিয়াছে, হিংস্র ভয়ঙ্কর প্রকৃতির লোক।

ধপ করিয়া শব্দ হইল। চোখে কিছু দেখা গেল না, কিন্তু চিন্ময় কর্ণেন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করিল, লোকটা মৃতদেহ টানিয়া রিক্সা হইতে মাটিতে ফেলিল। তারপর কিছুক্ষণ সাড়া-শব্দ নাই। চিন্ময় নিশ্বাস বন্ধ করিয়া রহিল; কিছুক্ষণ পরে অপেক্ষাকৃত দূরে ঠুং করিয়া শব্দ হইল। লোকটা রিক্সা লইয়া চলিয়া যাইতেছে।

চিন্ময় আর বসিয়া থাকিতে পারিল না, তাহার সমস্ত অন্তরাত্মা অসহ্য পলায়নস্পৃহায় ছটফট করিয়া উঠিল। মৃতদেহটা অদূরে এক চাপ গভীরতর অন্ধকারের মতো পড়িয়া আছে; চিন্ময় গাছতলা হইতে উঠিয়া নিঃশব্দে বিপরীত দিকে পা বাড়াইল। পুলিসে খবর দিবার কথা তাহার মনে আসিল না; কোনও ক্রমে এখান হইতে পলায়ন করিতে পারিলেই সে বাঁচে।

গৃহে ফিরিয়া চিন্ময় দেখিল দরজা ভেজানো রহিয়াছে। সামনের ঘরে তক্তপোশের উপর তাহার শয়নের ব্যবস্থা। সে নিঃশব্দে গিয়া শয়ন করিল। তাহার মাথা গরম হইয়া উঠিয়াছিল, তবু সে চোখ বুজিয়া ঘুমাইবার চেষ্টা করিল। কিন্তু ঘুম সহজে আসিল না; তাহার নিজের চাকরির চিন্তা ছাপাইয়া ওই ভয়ঙ্কর হাম্‌দো মুখখানা বারবার তাহার চোখের সামনে ফুটিয়া উঠিতে লাগিল।

সকালবেলা ঘুম ভাঙিবার পর কিন্তু গত রাত্রির ঘটনা দুঃস্বপ্নের মতো তাহার মনের পশ্চাৎপটে সরিয়া গেল, ইন্টারভিউ দিবার তাড়া অন্য সব চিন্তাকে আড়াল করিয়া দিল। কাল রাত্রে সে যাহা দেখিয়াছিল তাহার জীবনে নিতান্তই তাহা আকস্মিক ঘটনা, সে দর্শক মাত্র, এই ঘটনার সহিত তাহার নাড়ীর যোগ নাই। যে লোকটার মুখ এখনো তাহার অন্তরপটে আঁকা রহিয়াছে, এ জীবনে হয়তো আর তাহার সহিত দেখা হইবে না।

ধোপদস্ত জামা কাপড় পরিয়া মামা-মামীকে প্রণাম করিয়া চিন্ময় বাহির হইল।

সওদাগরী অফিসের প্রকাণ্ড প্রাসাদে খোঁজ-খবর লইয়া সে একটি কক্ষে উপনীত হইল। সেখানে আরও কয়েকটি উমেদার উপস্থিত আছে। যে অফিসারের সঙ্গে ইন্টারভিউ তিনি পাশের ঘরে আছেন, একে একে প্রার্থীদের ডাক পড়িতেছে।

সকলের শেষে চিন্ময়ের ডাক পড়িল। সে দুরু দুরু বক্ষে পাশের ঘরে প্রবেশ করিল, সেখানে টেবিলের সামনে যিনি বসিয়া আছেন, তাঁহার মুখ দেখিয়া সে একেবারে কাঠ হইয়া গেল।

সেই হাম্‌দো মুখ, সেই বাম ভুরুর উপর আর একটা ভুরুর মতো লম্বা কাটা দাগ। উপরন্তু নিকট হইতে মুখের আরও কয়েকটা বৈশিষ্ট্য প্রকট হইল; নাকটা স্থূল এবং মাংসল, চোখ দু’টাতে বিষাক্ত নৃশংসতা, নাকের নিচে চৌকশ ছাঁটা গোঁফ, দুই কানের নিচে চোয়ালের হাড় উঁচু হইয়া আছে। বলিষ্ঠ পেশীবদ্ধ শরীর। বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ।

ইনিই গত রাত্রির রিক্সাওয়ালা এবং এই অফিসের দোর্দণ্ডপ্রতাপ বড়বাবু লালগোপাল মল্লিক। চিন্ময় টেবিলের পাশে দাঁড়াইয়া বিহুলচক্ষে চাহিয়া রহিল।

লালগোপালবাবুর কেবল চক্ষে বিষ আছে এমন নয়, জিহ্বাও বিষ মাখানো, তিনি চিন্ময়কে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন, ‘লবাবজাদা নাকি! নমস্কার করতেও জান না?’

চিন্ময় চমকিয়া হাত তুলিয়া নমস্কার করিল, অধর লেহন করিয়া বলিল, ‘আজ্ঞে—’

লালগোপালবাবু ভেংচি কাটিলেন, ‘আজ্ঞে! খুব শৌখীন জামা-কাপড় চড়িয়েছ দেখছি। তোমার চাকরিতে কী দরকার? বৈঠকখানায় তাকিয়া হেলান দিয়ে বসে গড়গড়া টানলেই পারো।’

‘আজ্ঞে—’ বলিয়া এবারও চিন্ময় থামিয়া গেল।

টেবিলের উপর লালগোপালবাবুর সামনে চিন্ময়ের দরখাস্তটা রাখা ছিল, তিনি তাহার উপর একবার চোখ বুলাইয়া বলিলেন, ‘এ দরখাস্ত তোমার নিজের হাতে লেখা?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘খাসা হাতের লেখা! একেবারে মুক্তো ছড়িয়ে দিয়েছ!’ লালগোপালবাবু হঠাৎ ফাটিয়া পড়িলেন, ‘এই হাতের লেখা নিয়ে তুমি চাকরি করতে এসেছ! যাও যাও—এ অফিসে ঝাড়ুদারের চাকরিও তুমি পাবে না।’ বলিয়া দরখাস্তটা মুঠি পাকাইয়া তিনি রদ্দি কাগজের চ্যাঙারিতে ফেলিয়া দিলেন। চিন্ময়ের প্রতি তাঁহার রূঢ়তার কোনও কারণ ছিল না; কিন্তু এক জাতীয় লোক আছে যাহারা অসহায় ব্যক্তির প্রতি কটু বাক্য প্রয়োগ করিয়া তৃপ্তি পায়, ইহাই তাহাদের মানস বিলাস।

চিন্ময়ের মনটা এতক্ষণ মোহাচ্ছন্ন হইয়া ছিল, এখন যেন চাবুকের ঘা খাইয়া সচেতন হইয়া উঠিল। সঙ্গে সঙ্গে তাহার মাথা গরম হইয়া গেল। কী! এই খুনী লোকটা তাহাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করিবে? অপমান করিবে? চিন্ময় যখন কথা কহিল তখন তাহার মুখের ভাব বদলাইয়া গিয়াছে, ক্রোধের বশে বোধ করি চরিত্রও বদলাইয়া গিয়াছে। সে লালগোপালবাবুর চোখে চোখ রাখিয়া বলিল, ‘চাকরি তাহলে দেবেন না?’

লালগোপালবাবু গর্জন করিয়া বলিলেন, ‘না, দেব না। তোমার মতো অপদার্থ লোক আমার চাই না। যাও।’

চিন্ময়ের মুখে একটা শুষ্ক বিকৃত হাসি দেখা দিল। সে বলিল, ‘যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি জানেন? পুলিসে খবর দিতে যাচ্ছি।’ বলিয়া সে দ্বারের দিকে চলিল।

সে দ্বার পর্যন্ত গিয়াছে, পিছন হইতে ডাক আসিল, ‘ওহে, শুনে যাও।’

চিন্ময় ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল, লালগোপালবাবুর বিষাক্ত চোখে শঙ্কার ছায়া পড়িয়াছে; সে ফিরিয়া গিয়া টেবিলের পাশে দাঁড়াইল। লালগোপালবাবু সতর্ক স্বরে বলিলেন, পুলিসের কথা কী বলছিলে?’

চিন্ময় বলিল, ‘কাল রাত্রে পার্কে যা দেখেছি, তাই পুলিসকে বলতে যাচ্ছি।’

লালগোপালবাবু নিশ্চল চক্ষে চিন্ময়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন, তাহার কপালের দুই পাশে দুইটা শিরা স্ফীত হইয়া উঠিল। চিন্ময়ের আশঙ্কা হইল তিনি এখনি তাহার ঘাড়ে লাফাইয়া পড়িয়া তাহার টুঁটি টিপিয়া ধরিবেন।

সে পিছু হটিতে হটিতে দূরে সরিয়া যাইতে লাগিল। লালগোপালবাবু রুমাল বাহির করিয়া মুখ এবং ঘাড় মুছিলেন।

‘শোনো—শোনো।’

চিন্ময় থামিল।

লালগোপালবাবু রদ্দির চ্যাঙারি হইতে চিন্ময়ের দরখাস্ত তুলিয়া লইয়া টেবিলের উপর ইস্তিরি করিতে করিতে বলিলেন, ‘কি নাম তোমার—চিন্ময় ঘোষাল? আই. এ. পাস করেছ দেখছি। তা বেশ, তোমাকে চাকরি দেব। কাল থেকে কাজে আসবে।’

চিন্ময় নির্বাক দাঁড়াইয়া রহিল। তখন লালগোপালবাবু বলিলেন, ‘যে কাজের জন্যে অ্যাপ্লাই করেছ তার মাইনে পঁচাত্তর টাকা, তা তোমাকে পুরোপুরি একশ’ টাকাই করে দিলাম। কাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাবে। আর দেখো, তুমি ছেলেমানুষ তাই বলছি, পুলিসের হাঙ্গামায় যেও না, নিজেই জড়িয়ে পড়বে। আচ্ছা, আজ তুমি যেতে পার।’

চিন্ময় তবু দাঁড়াইয়া রহিল। সে লক্ষ্য করিল না যে লালগোপালবাবুর মুখের কথার সহিত চোখের দৃষ্টির সঙ্গতি নাই, চোখ দু’টা আগের মতোই বিষ বিকীর্ণ করিতেছে। চিন্ময়ের মনের মধ্যে প্রচণ্ড দড়ি টানাটানি আরম্ভ হইয়াছে। একদিকে লোভ—আশাতীত মাহিনার চাকরি; অন্যদিকে—অশেষ হয়রানি, পুলিসের টানাটানি। সে গরিবের ছেলে, দু’পয়সা উপার্জন করিয়া কোনও ক্রমে বাঁচিয়া থাকিতে চায়—

চিন্ময় মনস্থির করিবার পূর্বেই বাধা পড়িল। বাহিরে মশমশ জুতার শব্দ; তারপর পুলিস অফিসারের ইউনিফর্ম পরা তিন ব্যক্তি ঘরে প্রবেশ করিলেন।

যিনি সর্বাগ্রে আসিলেন তিনি বয়স্থ ব্যক্তি, বড় দারোগা; তাঁহার পিছনে দুইজন সাব-ইন্সপেক্টর। তাঁহাদের আসিতে দেখিয়া লালগোপালবাবুর মুখখানা কেমন একরকম হইয়া গেল, তিনি চেয়ার হইতে অর্ধোত্থিত হইয়া শীর্ণস্বরে বলিলেন, ‘কি—কি চাই?’

দারোগাবাবু বলিলেন, ‘আমরা থানা থেকে আসছি। আপনার নাম লালগোপাল মল্লিক?’

লালগোপালবাবুর মুখ দিয়া সহসা কথা বাহির হইল না, তিনি কেবল ঘাড় নাড়িলেন।

দারোগাবাবু অনাহূত একটি চেয়ারে বসিলেন। তাঁহার দেহ এবং মুখের গঠনে এমন একটি কঠোর দৃঢ়তা আছে, যাহা এক পক্ষে আশ্বাসজনক এবং অন্য পক্ষে বিশেষ ভয়প্রদ। তিনি স্থির দৃষ্টিতে লালগোপালবাবুর দিকে চাহিয়া থাকিয়া প্রশ্ন করিলেন, ‘আপনার স্ত্রী কোথায় লালগোপালবাবু?’

লালগোপালবাবুর কাছে পুলিসের আগমন অবশ্য অপ্রত্যাশিত নয়, তবু পুলিস দর্শনে তিনি প্রবল ধাক্কা খাইয়াছিলেন। এখন নিজেকে সামলাইয়া লইয়া বিস্ময়ের ভান করিয়া বলিলেন, ‘আমার স্ত্রী—চঞ্চলা?’

দারোগাবাবু বলিলেন, ‘আপনার স্ত্রীর নাম চঞ্চলা? তিনি কোথায়?’

‘সে—সে কাল সন্ধ্যেবেলা বাপের বাড়ি গিয়েছে। কেন বলুন দেখি?’

‘তাঁর বাপের বাড়ি কোথায়?’

‘কলকাতাতেই। বাগবাজারে। কিন্তু আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’

দারোগাবাবু আরও কিছুক্ষণ নিবিষ্ট চক্ষে লালগোপালবাবুকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন, ‘আপনার স্ত্রী মারা গেছেন। আজ সকালে একটা পার্কে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া গেছে।’

লালগোপালবাবু লাফাইয়া উঠিয়া থিয়েটারি ভঙ্গিতে চিৎকার করিয়া উঠিলেন, ‘কী—কী বললেন! চঞ্চলা মারা গেছে! পার্কে তার লাশ পাওয়া গেছে?’

দারোগা অবিচলিত স্বরে বলিলেন, ‘হ্যাঁ। দু’জন লোক লাশ সনাক্ত করেছেন। আপনার বাসা পার্ক থেকে বেশী দূর নয়।’

লালগোপালবাবু দু’হাতে মুখ ঢাকিয়া আবার বসিয়া পড়িলেন, দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া হৃদয়বিদারক স্বরে বলিলেন, ‘উঃ! এ যে আমার কল্পনার অতীত।’

দারোগা বলিলেন, ‘আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।’

লালগোপালবাবু মুখ তুলিলেন, ‘প্রশ্ন? তা করুন, কি প্রশ্ন করবেন করুন।’

দারোগা প্রশ্ন আরম্ভ করিলেন। উত্তরে লালগোপালবাবু বলিলেন, চঞ্চলা তাঁহার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী, বয়স আটাশ বছর, সন্তানাদি নাই। তাহার বাপের বাড়ি কলিকাতাতেই, তাই ইচ্ছা হইলেই সে বাপের বাড়ি গিয়া দু’ একদিন কাটাইয়া আসিত। গতকল্য লালগোপালবাবু অফিস হইতে ফিরিলে চঞ্চলা বাপের বাড়ি যাইবার ইচ্ছা প্রকাশ করে, তিনি অনুমতি দান করেন। চঞ্চলা ট্যাক্সি চড়িয়া চলিয়া যায়; তাহার গায়ে সাধারণ আটপৌরে গহনা ছিল, চুড়ি, বালা, হার ইত্যাদি। পরিধানে সবুজ রঙের শাড়ি ছিল।

দারোগাবাবু বলিলেন, ‘গয়না গায়ে পাওয়া যায়নি। হত্যাকারী হাতের চুড়ি টেনে-হিঁচড়ে খুলে নিয়েছে, হাতের চামড়া ছিঁড়ে গেছে। যা হোক—’

আবার প্রশ্নোত্তর আরম্ভ হইল। লালগোপালবাবুর বাড়িটি পৈতৃক। ছোট বাড়ি তাই ভাড়াটে রাখেন নাই, নিজেরাই থাকেন। কেবল বাড়ির উঠানটি কয়েকজন রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া দিয়াছেন, তাহারা রাত্রিকালে তাহাদের রিক্সাগুলি এখানে রাখিয়া যায়।

গত রাত্রে চঞ্চলা বাপের বাড়ি চলিয়া যাইবার পর লালগোপালবাবু সারাক্ষণ বাড়িতেই ছিলেন, তারপর আজ সকালে অফিসে আসিয়াছেন। স্ত্রীর সম্বন্ধে তিনি আর কিছু জানেন না। স্ত্রীর মৃত্যু তাঁহার কাছে শক্তিশেল তুল্য আঘাত।

জেরা শেষ করিয়া দারোগা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, তারপর বলিলেন, আপনি আমার সঙ্গে চলুন। লাশ অবশ্য অন্য লোক সনাক্ত করেছে; কিন্তু আপনি নিকটতম আত্মীয়, আপনাকেও সনাক্ত করতে হবে।’

লালগোপালবাবু ভীতভাবে মাথা নাড়িয়া বলিলেন, ‘না না, দারোগাবাবু, তার মরা মুখ আমাকে দেখতে বলবেন না।’

দারোগা বলিলেন, ‘মৃতদেহ আপনার স্ত্রীর কি না সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হতে চান না?’

লালগোপালবাবু থতমত হইয়া বলিলেন, ‘অ্যাঁ—তা আপনারা যখন বলছেন আমার স্ত্রীর মৃতদেহ—কিন্তু—আচ্ছা চলুন।’

লালগোপালবাবু অনিচ্ছাভরে চেয়ার ছাড়িয়া উঠিলেন, দারোগাও উঠিলেন। তাঁহারা দ্বারের দিকে পা বাড়াইয়াছেন, এমন সময়—

‘দারোগাবাবু!’

চিন্ময় এতক্ষণ ঘরের এক কোণে নিশ্চল দাঁড়াইয়া সমস্ত শুনিতেছিল। লালগোপালবাবু যখন স্ত্রীর মৃত্যুতে শোক ও বিস্ময় প্রকাশ করিতেছিলেন তখন শুনিতে শুনিতে তাহার সর্বাঙ্গ জ্বালা করিতেছিল, কিন্তু সে বাঙ্‌নিষ্পত্তি করে নাই। তাহার মনে চাকরির আশাটা একেবারে নির্মূল হইয়া যায় নাই। কিন্তু দারোগাবাবু যখন লালগোপালবাবুকে স্ত্রী হত্যার অপরাধে অভিযুক্ত না করিয়া তাঁহাকে লাশ দেখাইবার জন্য গমনোন্মুখ হইলেন, তখন চিন্ময়ের অন্তর হইতে একটা দ্বিধাহীন বিদ্রোহ বাহির হইয়া আসিল। —চুলোয় যাক চাকরি। এই নৃশংস নারীহন্তাকে সে ছাড়িয়া দিবে না, সে দারোগাবাবুকে সত্য কথা বলিবে।

‘দারোগাবাবু!’

দারোগা ফিরিলেন। লালগোপালবাবু চিন্ময়কে একেবারেই ভুলিয়া গিয়াছিলেন, তাহার কণ্ঠস্বর শুনিয়া সমস্ত কথা তাঁহার মনে পড়িয়া গেল। তিনি ঝাঁপাইয়া গিয়া তাহার সম্মুখে দাঁড়াইলেন, উগ্র স্বরে বলিলেন, ‘তুমি এখানে কি করছ! যাও যাও, বাইরে যাও—’

দারোগা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কে ও?’

লালগোপালবাবু বলিলেন, ‘কেউ না, কেউ না, একটা চ্যাংড়া ছোঁড়া। চাকরির জন্যে এসেছিল—’

চিন্ময় বলিল, ‘চাকরি চাই না। দারোগাবাবু, ইনিই নিজের স্ত্রীকে খুন করেছেন—’

লালগোপালবাবু দু’ হাতে চিন্ময়ের গলা টিপিয়া ধরিয়া চিৎকার করিয়া উঠিলেন, ‘মিথ্যে কথা। মিথ্যে কথা। আমি কিছু জানি না—’

সাব-ইন্সপেক্টর দুইজন আসিয়া জোর করিয়া চিন্ময়কে ছাড়াইয়া লইল।

লালগোপালবাবু হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিলেন, ‘মিথ্যেবাদী রাস্কেল। আমার নামে মিথ্যে বদনাম দিচ্ছে। দারোগাবাবু, আমি আমার স্ত্রীকে মারিনি, মেরেছে তার—তার ভাবের লোক, শ্যামল ঘোষ। ওই পার্কে ওরা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করত—’

দারোগা ইশারা করিলেন, দুইজন সাব-ইন্সপেক্টর লালগোপালবাবুর দুই পাশে গিয়া দাঁড়াইলেন, যাহাতে তিনি যথেচ্ছা নড়িতে চড়িতে না পারেন। দারোগা চিন্ময়ের হাত ধরিয়া চেয়ারে লইয়া গিয়া বসাইলেন, শান্ত স্বরে বলিলেন, ‘এবার কি বলবে বল।’

গলা টিপুনি খাইয়া চিন্ময়ের সর্বাঙ্গ কাঁপিতেছিল, সে কোনোমতে আত্মসংবরণ করিয়া গত রাত্রির ঘটনা বিবৃত করিল। লালগোপালবাবু মাঝে মাঝে উন্মত্তের ন্যায় বাধা দিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু তাঁহার আবোলতাবোল প্রলাপে কেহ কর্ণপাত করিল না।

চিন্ময়ের বয়ান শেষ হইলে দারোগা ক্ষণেক চিন্তা করিলেন, শেষে একজন সাব-ইন্সপেক্টরকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, ‘নরেশ, তুমি অফিসে যাও, একটা সার্চ-ওয়ারেন্ট লিখিয়ে নিয়ে এস। লালগোপাল মল্লিকের বাড়ি খানাতল্লাশ করতে হবে। উনি যদি অপরাধী হন, মৃতের গয়নাগুলো হয়তো বাড়িতেই আছে। চুড়ি খোলবার সময় হাতের চামড়া ছড়ে গিয়েছিল, সম্ভবত চুড়িতে চামড়া এখনো লেগে আছে। তুমি চটপট ব্যবস্থা কর।’ দারোগা উঠিলেন, ‘লালগোপালবাবু, আপনাকে থানায় যেতে হবে। চিন্ময়, তুমিও চল। তোমার জবানবন্দি লিখে নিতে হবে।’

সারাদিন চিন্ময়ের থানায় কাটিল। বড় ছোট মাঝারি নানা শ্রেণীর পুলিস অফিসার আসিয়া তাহাকে সওয়াল-জবাব করিলেন, সে সত্য কথা বলিতেছে কিনা যাচাই করিলেন। তাহার এজাহার লওয়া হইল। চিন্ময় কয়েক পেয়ালা চা পান করিয়া দিন কাটাইয়া দিল।

ওদিকে লালগোপালবাবুর গৃহ খানাতল্লাশ করিয়া গহনা পাওয়া গিয়াছে, চুড়িতে সংলগ্ন চামড়া হইতে নিঃসংশয়ে প্রমাণ হইয়াছে যে, মৃত্যুকালে লালগোপালবাবুর স্ত্রীর গায়ে ওই সব গহনা ছিল। একটা রিক্সাতে অল্প রক্তের দাগও পাওয়া গিয়াছে। লালগোপালবাবু কিন্তু হাজতে বসিয়া ক্রমাগত অপরাধ অস্বীকার করিয়া চলিয়াছেন; তিনি পাগলের মতো বলিয়া চলিয়াছেন যে, শ্যামল ঘোষ চঞ্চলাকে খুন করিয়াছে। তাহাতে উল্টো ফল হইতেছে, স্ত্রীকে খুন করার যে বলবান মোটিভ ছিল তাহা প্রমাণ হইতেছে। কিন্তু তাহা বুঝিবার মতো মনের অবস্থা তাঁহার নাই।

সন্ধ্যার সময় চিন্ময়ের দেহ-মন অবসাদে ও ক্লান্তিতে ভাঙিয়া পড়িবার উপক্রম করিল। সে কাতর স্বরে দারোগাকে বলিল, ‘দারোগাবাবু, এবার আমাকে ছেড়ে দিন। বাড়িতে মামা-মামীমা হয়তো ভাবছেন আমি গাড়ি চাপা পড়েছি—’

দারোগা বলিলেন, ‘আচ্ছা, আজ তুমি যাও। কাল সকালে আবার আসবে।’

চিন্ময় হতাশ চক্ষে চাহিয়া বলিল, ‘আবার কাল!’

দারোগা কহিলেন, ‘হ্যাঁ। তুমি এ মামলার প্রধান সাক্ষী, তোমাকে এখন রোজ আসতে হবে। ট্রায়েলের সময় আসামীর উকিলের জেরায় তুমি ভেঙে না পড়ো সেজন্যে তোমাকে আমরা রোজ জেরা করব, তোমার স্মৃতিশক্তিকে ঘষে মেজে ঝকঝকে করে রাখব।’

চিন্ময় ক্ষীণ স্বরে বলিল, ‘কিন্তু—’

‘কিন্তু কী?’

‘আমাকে যে আবার চাকরির খোঁজে বেরুতে হবে দারোগাবাবু।’

দারোগাবাবুর মুখ অপ্রসন্ন হইল, তিনি বলিলেন, ‘ওসব পরের কথা। খুনের মামলা আগে। আজ বাড়ি যাও। কাল সকালে ন’টার মধ্যে এস।’

তারপর তিন মাস কাটিয়া গিয়াছে। এই তিনটি মাস চিন্ময়ের জীবনে একটা অবিস্মরণীয় বিভীষিকা। তাহাকে প্রথমে কমিটিং কোর্টে এবং পরে বড় আদালতে দাঁড়াইয়া দিনের পর দিন সাক্ষ্য দিতে হইয়াছে, আসামীর উকিলের কুটিল জেরার ফাঁদ বাঁচাইয়া চলিতে হইয়াছে। শেষ পর্যন্ত লালগোপালবাবু চরম দণ্ড পাইয়াছেন। কিন্তু চিন্ময়ের শরীর মন একেবারে ভাঙিয়া পড়িয়াছে।

মোকদ্দমা শেষ হইবার পর সে আবার চাকরির সন্ধানে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। কিন্তু এখনও চাকরি পায় নাই।

১১ এপ্রিল ১৯৬২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *