চিন্তা প্রকাশের স্বাধীনতা
প্রত্যেক মানুষেরই চলনে-বলনে-করনে নিজের মনের মতো নীতি-পদ্ধতি রয়েছে। অন্যকথায় বলা যায়, প্রত্যেকেরই জীবনে স্ব স্ব পছন্দসই মত ও পথ আছে। এর সাধারণ নাম আদর্শবাদ। Men are born-Philosophers বলে যে-কথাটি চালু আছে, তার সোজা অর্থ দাঁড়ায় প্রত্যেক মানুষই স্ব স্ব জগতে ও জীবনে দার্শনিক। এ দৃষ্টিতে দেখলে, কোনো আদর্শই মিথ্যা বা নিরর্থক বলে মনে হবে না। কাজেই প্রত্যেক আদর্শেরই ব্যক্তিক, স্থানিক ও কালিক উপযোগ থাকে। এ সূত্রেই স্বীকার করতে হয়, যে-কোনো আদর্শেরই সর্বজনীন ও শাশ্বত হবার যোগ্যতা নেই। এ কারণেই যুগে যুগে দেশে দেশে আদর্শবাদের জন্ম ও মৃত্যু হয়েছে।
আগেই বলতে চেয়েছি, আদর্শবাদ একান্তই উপযোগ-ভিত্তিক। এবং সে-উপযোগ কোনো অবস্থাতেই মানুষের বিচিত্র প্রয়োজনানুগ হতে পারে না। কেননা, এমন কোনো একক আদর্শ থাকা সম্ভব নয়, যা জীবন ও জীবিকার সর্বক্ষেত্রে ফলপ্রসূ। প্রয়োগ, প্রয়োজন এবং স্থান-কাল-ব্যক্তি ভেদে এর ফলাফলও বিভিন্ন ও বিচিত্র। কাজেই কোনো আদর্শই নিরঙ্কুশ কিংবা নির্ভেজাল ভালও নয়, মন্দও নয়। অতএব, আদর্শবাদের ক্ষেত্রে কোনো কিছু চরম কিংবা পরম বলে মনে করা কেবল অবাঞ্ছিত নয়, অকল্যাণকরও। এমনকি আল্লাহর দান–রোদ-বৃষ্টিও সব সময় সবার কাছে অভিপ্রেত নয়।
একটি দৃষ্টান্ত নিলেই আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট হবে। শারদীয় কিংবা বাসন্তী জ্যোৎস্নার সৌন্দর্য ও উপভোগ্যতা সম্বন্ধে কারুর দ্বিমত নেই। তবু যে-ছেলেকে পরীক্ষার পড়া তৈরি করতে হবে, জ্যোত্স যতই পর্যাপ্ত ও আকর্ষণীয় হোক না কেন–তাকে ঘরের কোণে দীপের আশ্রয় নিতেই হবে। বাহ্যত চাদে আর দীপে তুলনাই হয় না। তবু এ ক্ষেত্রে কেউ যদি ছেলেটিকে রুচিহীন নির্বোধ মনে করে, তা হলে নিশ্চয়ই তার প্রতি অবিচার করা হবে।
প্রতিবেশ ও প্রয়োজনমত আদর্শবাদের পরিবর্তন যে হয় বা হতে যে পারে তার আভাস একটি হাদিসেও আছে: তোমরা এখন এমন এক কালে আছ, যখন যেসব বিধি-নিষেধ তোমাদের জন্য নির্দেশিত হয়েছে, তার দশভাগের একভাগ অমান্য করলেও তোমরা ধ্বংস হবে, কিন্তু এমন যুগও আসবে, যখন এসব আদেশ-নির্দেশের দশভাগের নয়ভাগ অবহেলা করলেও তোমরা মুক্তি পাবে।
মূলত একটি অপরটির পরিপূরক হলেও আগেকার দিনে ধর্মাদর্শ, সমাজাদর্শ নৈতিকজীবনাদর্শ ও শাসনাদর্শের মধ্যে বাহ্যত সমন্বয়-সামঞ্জস্যের রূপ প্রায়শই প্রকট হয়ে উঠত না। তার কারণ, হয়তো তখনো বিজ্ঞতর মানুষেরও জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্বন্ধে পূর্ণদৃষ্টি ও সামগ্রিক ধারণার অভাব ছিল।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সমাজান্দোলন ও রাষ্ট্র বিপ্লবের ফলে, মানুষের মধ্যে ক্রমে জীবনযাত্রার নানাক্ষেত্রের বৈচিত্র্যের মধ্যেও এক অখণ্ড জীবনচর্যার বোধ জন্মেছে। ফলে সামগ্রিক জীবনবোধ যেমন জেগেছে, তেমনি আবিষ্কৃত হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রের জীবন জিজ্ঞাসা ও জীবন প্রচেষ্টার ঐক্যসূত্র।
আগেকার অবস্থায় তাই গড়ে উঠেছিল ধর্মের ক্ষেত্রে পুরোহিততন্ত্র, এবং সমাজের সঙ্গে মাতব্বরতন্ত্র; আর দেশ হয়েছিল রাজার রাজ্য। তাই এগুলো মূলত মানুষের জীবন-নিয়ন্ত্রী সংস্থা ও শক্তি হলেও ঐক্য ও সহযোগিতার অভাবে কোনো কোন ক্ষেত্রে প্রায়ই দ্বান্দ্বিকশক্তিরূপে দেখা দিয়েছে।
তাই রুশোর সামাজিক চুক্তি–যতই অপ্রাকৃত বোধ হোক, মানুষের জীবন-জিজ্ঞাসার পথে যুগান্তকর উপলব্ধি। এতে মানুষের বোধের ক্ষেত্র হয়েছে প্রসারিত, জীবনের পরিপূর্ণ রূপ জানবার ও বুঝবার উদ্যম হয়ে উঠেছে দুর্নিবার।
এ বোধের সুসন্তান গণতন্ত্র। ব্যষ্টি দিয়ে সমষ্টি এবং ব্যষ্টির প্রয়োজনে সমাজ, ব্যষ্টির প্রয়োজনেই ধর্ম আর ব্যষ্টিস্বার্থে শাসন-সংস্থার প্রয়োজন–এ বোধ মানুষের অগ্রগতির মূল ভিত্তি। তা হলে ব্যষ্টির তথা ব্যক্তিক স্বার্থ সংরক্ষণই অর্থাৎ ব্যক্তিজীবনের নির্ঘ ও নির্বিঘ্ন বিকাশের সুযোগদানের মৌল স্বীকৃতিই গণতন্ত্রের বুনিয়াদ।
অতএব কথা দাঁড়ায় : ব্যক্তিক জীবনে নিরাপত্তা ও সুযোগ লাভের জন্যেই মানুষ সমাজ গড়ে তুলেছে এবং ব্যক্তিক জীবন সুশৃঙ্খল ও সুনিয়ন্ত্রণের জন্যেই ধর্ম-বিধির গরজ বোধ করেছে। আর ব্যক্তিক জীবন উপভোগের ও বিকাশের সহায়রূপে গঠন করেছে শাসনসংস্থা তথা রাষ্ট্র। এ যদি সত্য হয়, তা হলে এসব প্রচেষ্টার মূল লক্ষ্য ব্যষ্টির জীবন-যাপনে সুযোগ ও সহযোগিতা প্রাপ্তি। অতএব স্বীকার করতে হয়, সমাজ-সংস্থা, ধর্ম-বিধান কিংবা রাষ্ট্র-ব্যবস্থা হচ্ছে মূলত ও লক্ষ্যত সমবায় সমিতি। ব্যক্তিক সুযোগ লাভ ও পারস্পরিক সহযোগিতা দানই এর আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।
এ দৃষ্টিতে দেখলে পারস্পরিকতাই (Reciprocity) সব কিছুর ভিত্তি বলে সহজেই উপলব্ধ হবে। এই পারস্পরিক হবে ব্যক্তিক সুযোগ লাভের বিনিময়ে সামষ্টিক সহযোগিতা দান। অতএব, প্রতিজ্ঞাগুলো এরূপ দাঁড়ায় : ব্যষ্টির জন্যে সমাজ এবং সমাজের জন্যে ব্যষ্টি, ব্যষ্টির স্বার্থে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের জন্যেই ব্যষ্টি (People for the state and state for the people)। অন্যকথায়, ব্যষ্টির সমষ্টিতে সমাজ এবং সমাজের একতম সদস্য ব্যষ্টি। জনস্বার্থেই জনগণের জন্যে জনগণের সমবায়েই গড়ে উঠেছে রাষ্ট্র।
অতএব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রতত্ত্বে শাসক-শাসিত বলে কোনো শ্রেণী নেই। জনগণের হাতেই রয়েছে সার্বভৌম ক্ষমতা। এ অর্থেই রাষ্ট্র হচ্ছে সমবায় প্রতিষ্ঠান আর রাষ্ট্র-সংস্থা তথা সরকার হচ্ছে জনচর্যার প্রতিরূপ। অন্যকথায়, জনমানস লালন ও নিয়ন্ত্রণ এবং জন-আচরণ নিয়ন্ত্রণ আর জনস্বার্থের রক্ষণ ও পোষণই এর দায়িত্ব। তা হলে রাষ্ট্রই জনগণের জীবন ও জীবিকার প্রতীক। জীবন বলতে ব্যষ্টির ধর্মীয়, নৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সত্তা বুঝায়, যা বিকাশোনুখ এবং স্বচ্ছন্দ বিহার প্রয়াসী। কাজেই যা ব্যক্তিজীবনের বিকাশে, প্রসারে ও স্বাচ্ছন্দ্য বিধানে প্রয়াসী, তা-ই গণ-সরকার। বেঁচে থাক এবং বাঁচতে দাও, আর ভাল হও এবং ভাল চাও– এই হচ্ছে এর মৌল নীতি। এ ভাবে এ উদ্দেশ্যে আর এই নীতিতে গণ-জীবন নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনই গণ-সরকারের ব্রত। যেহেতু গণ-গরজে, গণ-স্বার্থে ও গণ-নির্দেশেই সরকার পরিচালিত হয়, সেজন্যে জনগণের সাধারণ (Common) ধর্মীয়, নৈতিক ও সামাজিক আদর্শ, উদ্দেশ্য এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা রাষ্ট্র সংস্থার নীতি ও কৃতির মাধ্যমেই রূপায়িত হয়। কাজেই আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আলাদা ধর্মীয়, সামাজিক বা নৈতিক আদর্শ-চর্চার কোনো প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্রই যখন জীবন-জীবিকার প্রতিভূ এবং প্রতীক, তখন সমাজে, সাহিত্যে, শিল্পে, স্থাপত্যে সেই আদর্শ একান্তই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রাদর্শানুগ তথা গণতান্ত্রিক হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
কেননা ব্যক্তিস্বার্থে ও আদর্শে কোনো বিরোধ নেই। মৌল ও বৃহত্তর অর্থে যা ব্যষ্টির তাই রাষ্ট্রের আর যা রাষ্ট্রের তাই ব্যষ্টির। এ উপলব্ধি থেকেই আজকাল কেবল সার্বভৌমত্বই রাষ্ট্রের চরম ও পরম লক্ষ্য বলে গণ্য হয় না, নাগরিক জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকেও সমগুরুত্ব দেয়া হয়। এজন্যেই সার্বভৌমত্বের অভিযান ত্যাগ করে কোনো কোনো ক্ষুদ্র রাষ্ট্র জনকল্যাণের খ্যাতিরে অপর রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত বা যৌথ সংস্থাও গঠন করেছে। বিশেষ দৃষ্টিতে UNO-ও রাষ্ট্র কল্যাণের বনামে জনকল্যাণকামী প্রতিষ্ঠান।
এখন একটি কঠিন প্রশ্ন জাগছে : রাষ্ট্রের আদর্শ নির্ণয় ও নির্ধারণ করবে কে? যারা ভোট পেয়ে রাষ্ট্র পরিচালক হন তাঁরা, না যারা ভোট দেয় সেই জনসমাজ? এর সহজ জবাব হয়তো এই যে যেহেতু জনসাধারণ তাদের পছন্দসই লোককে রাষ্ট্র পরিচালনের ভার দেয়, অর্থাৎ তাদের পক্ষ হয়ে চিন্তা ও কর্ম করবার দায়িত্ব অর্পণ করে, অন্যকথায় তাঁদের রাষ্ট্রিক চিন্তায় ও কর্মে প্রতিনিধিত্ব করবার অধিকার দেয়, সেজন্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই রাষ্ট্রাদর্শ নির্ধারণ ও শাসন পরিচালন ব্যাপারে সার্বিক ক্ষমতার অধিকারী। আপাতদৃষ্টিতে এ জবাব যুক্তিপূর্ণ মনে হলেও এ একান্তই স্কুলবোধ প্রসূত। কেননা, অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি নির্বাচকরা শিক্ষিত হলেও প্রয়োজনানুরূপ দায়িত্ব সচেতন ও চৌকশ নয় এবং নির্বাচিত ব্যক্তি মাত্রেই যোগ্য নয়। কাজেই এ ব্যাপারে ভোটাধিক্যে গুরুত্ব দেয়া যাবে না, মেধা-মাহাত্মে তথা মনীষাকেই মূল্য দিতে হবে। তাহলে সমাজের চিন্তানায়ক, সাহিত্যিক, দার্শনিক, মনীষী প্রভৃতি গুণী-জ্ঞানী বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশের মতামতকে জনমত বলে মর্যাদা ও স্বীকৃতি দিতে হয়। এঁদের নির্ভরযোগ্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব এই যে এঁরা বাক-চাতুর্যে, চিন্তার প্রাখর্যে, বুদ্ধির দীপ্তিতে দূর ও অখণ্ড দৃষ্টির তীক্ষ্ণতায় বর্তমানের স্বরূপ এবং ভবিষ্যতের দিশা সহজেই খুঁজে পান, আর সহজেই মন ও মত গঠন করতে পারেন। জনমত সৃষ্টি ও পুষ্টি সাধনে বা বিনষ্ট করণে, কিংবা সভা, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে বা ভাঙ্গনে এঁদের জুড়ি নেই। এঁরা যথার্থ অর্থে জনগণ মন অধিনায়ক। পৃথিবীর ইতিহাস-ধৃত চিন্তানায়কগণের কথা স্মরণ করলেই এর যাথার্থ বোঝা যাবে। কাজেই রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই দেশের ঐতিহাসিক, শিক্ষক, সাহিত্যিক, দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী প্রভৃতি গুণী-জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবীদের অবাধ চিন্তার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা আবশ্যক।
পাকিস্তানে একজন রাষ্ট্রপতি একবার এর ন্যায্য গুরুত্ব উচ্ছ্বাসবেশে উচ্চারণ করেছিলেন : Feel free in your mind, act freely in your expression and react freely to the environments around you. Let not the edge of your sensitivity be blunted by any sense of fear or expediency. On my behalf I cannot do better than assure you in the spirit of Voltair, that I may differ, even protest, against what you say but I will defend your right to say it unless it is directed against the very existence of our homeland.
এ উদাত্তবাণী কেবল শ্লাঘ্য নয়, যুগান্তকরও। এ নীতি সরকার কর্তৃক অনুসৃত হলে জীবনে ও সমাজে শান্তি ও মুক্তির স্বাচ্ছন্দ্য আসত।