1 of 2

চিন্টুদের বাড়ি

চিন্টুদের বাড়ি

আজ অফিস যাইনি। ছুটি জমে গেছিল অনেক। বাইরে ছেলেরা গলিতে ক্রিকেট খেলছিল, প্রচণ্ড চেঁচামেচি করে। সকাল বেলায়, রোদে পিঠ দিয়ে বসে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে কেন জানি না, এই চেঁচামেচির প্রেক্ষিতে, এই কলকাতার হাজারো আওয়াজের প্রেক্ষিতে আমার। ছেলেবেলার পাচিপুরের কথা মনে পড়ে গেল। অনেকই কথা। বিশেষ করে চিন্টুদের বাড়ির কথা।

স্কুল থেকে ফেরার পথে পাটকিলে-রঙা মিষ্টি-গন্ধ ধুলোর পথ বেয়ে যখন আমরা ক-জন সহপাঠী হেঁটে এসে পাকুড়তলির মোড় থেকে, নন্দীদের মস্ত দিঘিটাকে বাঁ পাশে রেখে কুমোরপাড়ার দিকে ডান দিকে ঘুরতাম তখন চিন্টু বলত, যাচ্ছি রে। কাল তোরা আর ডাকিস না আমাকে।

আমার মেসো আসবেন রানাঘাট থেকে মাসিমাকে নিয়ে, একদিনের জন্যে। কাল আমি স্কুলে যাব না।

তখন স্কুল কামাই করাটা মানুষ খুন করার মতন অপরাধ বলে গণ্য হত না। আমাদেরমা-বাবারা আমাদের ভবিষ্যৎ-চিন্তায় অনুক্ষণ উৎকণ্ঠিত হয়ে, কাঁটা হয়ে থাকতেন না। ভবিষ্যৎ নিয়ে–বিশেষ করে ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁদের কারোই আজকালকার মা-বাবাদের মতন হাইপারটেনশান ছিল না। কিন্তু ওইরকম অবহেলার মধ্যে লালিত-পালিত হয়েও আমরা কেউই তো গোরু-গাধা হইনি।

চিন্টুদের বাড়িটা ছিল অনেকই ভিতরে। বাইরে এলা রঙের বাউন্ডারি ওয়াল ছিল অনেকখানি জায়গা জুড়ে। লোহার ফটক। নানারকমের আম, জাম, দু-রকমের, গোলাম জাম এবং কালো জাম, জলপাই, কাঁঠাল, চালতা, বাতাবিলেবু, গন্ধরাজলেবু, লিচু, কাঁঠালিচাপা ইত্যাদি নানা গাছ ছিল ওদের বাড়িতে।

আমার ছেলে রূপ এসব গাছের কোনোটাই চেনে না।

বাংলো প্যাটার্নের লাল টিনের ছাদওয়ালা অনেকগুলো ঘরওয়ালা বাড়িটা ভালো করে দেখাই। যেত না বাইরে থেকে। নানারকমের গাছগাছালির জন্যে। বাড়িতে ঢোকার লাল সুরকির পথের দুধারে ছিল রঙ্গন, কাঠটগর, মুসুন্ডা, লালপাতিয়া এবং অমলতাসের সারি। সেই সময়ে গাছপালাও আমাদের প্রতিবেশী ছিল। তারা ছিল আমাদের অনুষঙ্গ। আমাদের জীবন আজকের মতন এমন ছায়াহীন হয়ে দাবদাহ হয়ে যায়নি। একটি বড়ো জলপাইগাছের নীচে বসে চিন্টুর দাদু উপনিষদ পড়তেন। গাছপালার ফাঁক দিয়ে দেখা যেত তাঁকে গরমের দিনে, সকালে স্কুলে যাওয়ার সময়ে।

চিন্টুর দাদু কৃষ্ণনগর রাজ কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। বহু বছর হল রিটায়ার করে এই আধা শহর পাচিপুরে পিতৃপুরুষের ভিটেতে এসে থিতু হয়েছিলেন। নানা পাঠ্যবই থেকে তাঁর আয় ছিল। প্রচুর। অধ্যাপনা ছেড়ে রিটায়ার করলেও চরিত্রে চিরদিন ছাত্রই ছিলেন। কোনোদিনও চিন্টুদের বাড়িতে গিয়ে বসে থাকতে দেখিনি তাঁকে একমুহূর্তও। সবসময়েই কিছু-না-কিছু করতেনই। গরমের দিনে ধুতি আর হাতাওলা গেঞ্জি পরে, শীতকালে পায়ে মোজা থাকত ছাইরঙা–তার উপরে বিদ্যাসাগরি চটি আর উর্ধ্বাঙ্গে ছাইরঙা ফ্ল্যানেলের পাঞ্জাবি।–সম্ভবত মাত্ৰ-দুটি পাঞ্জাবিই ছিল। কোনোদিনও তাঁকে অন্য কোনো রঙের পাঞ্জাবি পরতে দেখিনি। শীত বেশি পড়লে মাথায় ঠাকুমার হাতে বোনা একটি ছাইরঙা উলের টুপি এবং ছাইরঙা আলোয়ান।

পুজোর সময়ে চিন্টুর চার কাকা আর এক জ্যাঠা বিভিন্ন জায়গা থেকে দেশের বাড়িতে আসতেন। দুর্গাপুজো হত প্রতিবছরই। আর্থিক অবস্থা ভায়েদের সকলের আদৌ সমান ছিল না, কিন্তু মিলমিশ ছিল খুব সকলের মধ্যে।

যৌথ-পরিবার যে কত সুন্দর, কত আনন্দের, কত নিরাপত্তার হতে পারে, তা চিন্টুর দাদু, জ্যাঠা, বাবা এবং কাকাদের দেখে বোঝা যেত। তেমনই ভাব ছিল সব জায়েদের মধ্যেও। কে যে কার ছেলে-মেয়ে তা বোঝা পর্যন্ত যেত না, আদর তো বটেই, বকা-ঝকা, এমনকী কানমলার বহর দেখেও।

চিন্টুর বাবা পাচিপুরেই থাকতেন এবং চিন্টুদের জমিজমা, চাষবাস দেখাশোনা করতেন। শুনেছিলাম চিন্টুর বাবা, আমাদের মিন্টুকাকা পড়াশোনাতে ভালোই ছিলেন। কিন্তু দাদুই ওঁকে ম্যাট্রিকের পর আর পড়াননি। বলেছিলেন, এইসব কাজ করাটাও জরুরি। বি এ, এম এ পাস। করলেই লেজ গজায় না। সকলেরই যে চাকরি বা পেশাতে যেতে হবেই তার কোনো মানে নেই। তা ছাড়া এইসব কাজ করতে এর চেয়ে বেশি পড়াশোনার দরকারও নেই কোনো। খামোখা। পড়াশোনা করলে মানুষের গুমোর হয়, গুণরহিত গুমোর।

চিন্টুরা খুবই বড়োলোক ছিল আমাদের অনেকেরই তুলনাতে কিন্তু কোনোরকম চালিয়াতিই ছিল

তাদের পুরো পরিবারে। বাহুল্য ছিল না কোনো ব্যাপারেই। বাড়ি-ভরতি ইংরেজি, বাংলা, আরবি, সংস্কৃত, ফার্সি বই ছিল। তখনকার দিনে শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে ইংরেজি বাংলা ছাড়াও সংস্কৃত তো অবশ্যই, আরবি অথবা ফার্সিও অনেকেই জানতেন।

২.

আমাদের আধা-শহর, আধা-গ্রামে ঘুঘু ডাকত গরমের শান্ত দুপুরে। বসন্তে কোকিল পাগল করে দিত। হলুদবসন্ত পাখি কিশোরের বুকের মধ্যে হঠাৎ উদ্দীপনা জাগিয়ে সবুজ গাছে গাছে উড়ে। বেড়াত। চাঁদনিরাতে চমক তুলে তুলে ডাকত পিউ-কাঁহা সারা রাত। মাঝরাতে কখনো হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়াতে কাক-জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া বাগান ও পুকুরের দিকে চেয়ে মনে হত এখনই। বুঝি হরিসভার সামনের বিরাট দিঘিতে জিন-পরিরা জলকেলি করতে নামবে।

আমার মায়ের যে দাই ছিল, ফুলমতিয়া, বিহারের মুঙ্গের না মুজফফরপুর কোথায় যেন বাড়ি, সে আমাদের জিন-পরির গল্প বলত। সেই বলত, অমন রাতে কালো গভীর দিঘিতে জিন-পরিরা জলকেলি করতে নামে। সেই সময়ে বিবসনা তাদের কেউ দেখতে পেলে তাকে ভুলিয়ে নিয়ে। জলে ডুবিয়ে মারে। আমাদের গোরুদের দেখাশোনা করত বিহারি। বিহারে তার বাড়ি ছিল বলে তার নামই হয়ে গেছিল বিহারি। তার আসল নাম কী তা আমরা ভুলেই গেছিলাম।

ফুলমতিয়া এবং বিহারিকে একদিনও দেশে যেতে দেখিনি। দেশে কেউ ছিল কি না তাও জানি না। ওরা একে অপরকে চিনত না পর্যন্ত। আমাদের বাড়িতে থাকতে থাকতেই ভাব হয়েছিল। ফুলমতিয়া বিহারির চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়ো ছিল বয়সে। কিন্তু ওরা স্বামী-স্ত্রীর মতন একই সঙ্গে থাকত। গোয়ালগরের পাশে ওদের জন্যে আলাদা ঘর করে দিয়েছিলেন জ্যাঠাবাবু। দুপুরে ওরা আমাদের জন্যে যা রান্না হত তাই খেত, কিন্তু রাতে নিজেরা খনা পাকাত।

ফুলমতিয়া যখন খনা পাকাত, ঘি আর কাঁচালঙ্কা সম্বার দেওয়া অড়হর ডাল, লাউয়ের চোকা এবং আটার মোটা রুটি, গনগনে আঁচের মাটির উনুনের সামনে বসে, মায়ের দেওয়া চওড়া লাল। পাড়ের মিলের শাড়ি পরে, তখন বিহারি তার ঘরের বাইরে বসে, শীতকালে কাঠের আগুনের। সামনে, আর গ্রীষ্মকালে ফুটফুটে চাঁদের আলোতে রামচরিত মানস পড়ত গুনগুনিয়ে সুর করে। গানের মতো শোনাত তার সেই পাঠ, চাঁদে শিশিরে টিনের ছাদে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার ঝমঝমানি শব্দের পটভূমিতে। আমাদের ছেলেবেলার স্মৃতির সঙ্গে বিহারি ও ফুলমতিয়া, অড়হর ডালে ঘি আর কাঁচালঙ্কা সম্বার দেওয়ার গন্ধ, গোয়ালের গোরুর হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস, হাঁসেদের ঘরের। প্যাঁকপ্যাকানি সবই ছন্দোবদ্ধ হয়ে প্যাস্টেল-রঙা হালকা বেগুনি রঙের ফ্রেমে যেন চিরদিনের জন্যে বাঁধানো হয়ে গেছে। বড়ো শান্তি ছিল তখন চারদিকে। লোভ ছিল না এত, এমন কামড়াকামড়ি ছিল না নিছক বেঁচে থাকারই জন্যে। প্রত্যেক মানুষ তাদের জীবনকে ভালোবাসত, ভোগ্যবস্তুকে এমন করে আঁকড়ে ধরেনি সুখের উৎস ভেবে।

তখন প্রত্যেক মানুষের কাছেই দিনটা ছিল কাজের জন্যে আর রাতটা ছিল বিশ্রামের, আরামের, অবকাশের, গানের, সাহিত্য-পাঠের গল্পগুজবের। দিন ও রাতের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট সীমারেখা ছিল সেইসব বিজলিবিহীন দিনগুলিতে।

ভারি ভালো লাগছিল সেই ছুটির সকালে, আমার ছুটির। মনে মনে অতগুলো বছর পেছনে ফিরে গিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করতে। কে জানে চিন্টুরা কেমন আছে? কোথায় আছে? তাদের সেই বাড়ি এবং বাড়ির মানুষজন কি তেমনই আছেন সুখে-শান্তিতে?

এমন সময়ে হঠাই বিচ্ছিরি শব্দ করে ফোনটা বেজে উঠল। গভীর সুখে ডুবে গিয়ে অতীত রোমন্থন করছিলাম। ফোনটা বেজে উঠতেই স্বপ্নের জাল ছিঁড়ে গেল।

আমার আট বছরের একমাত্র পুত্র রূপ এখনই স্কুলে যাবে। আমি তো অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। কিন্তু চামেলির অফিস তো আর ছুটি নেই। সে চানে গেছে রূপকে ইউনিফর্ম পরিয়ে স্কুলের জন্যে তৈরি করে খেতে বসিয়ে দিয়ে। আজ বাতাসি আসেনি। এমনিতেই আজ চামেলির মেজাজ চড়া। আরও বেশি চড়া, আমার অফিস আজ নেই বলে।

উঠে গিয়ে ফোনটা ধরলাম।

হ্যালো, কে রে? রিনি? কী হল? তাই? কখন? কোথায় আছে? তোর মাসি তো চানে গেছে। ঠিকানাটা বল। একটু ধর, কাগজ নিয়ে আসি।

কলম-কাগজ আনতে আনতে চানঘরের দরজাতে দাঁড়িয়েই চেঁচিয়ে চামেলিকে বললাম, এই যে! শুনছ! সুবোধদার হার্ট-অ্যাটাক হয়েছে সকালে, নার্সিংহোমে আছেন।

ওপাশ থেকে জলের আওয়াজের সঙ্গে ঝংকার উঠল, ঠিক আছে। হার্ট-অ্যাটাক হওয়ার আর দিন পেল না। ঠিকানাটা লিখে নিয়ে তুমি রূপকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ওঁকে দেখে এসো। আমার আজ মরারও সময় নেই। আজকেই আমাদের নতুন কমিশনার জয়েন করছেন। ভীষণ কড়া। এ সি। বলেছেন, এক মিনিট দেরি হলে তুলকালাম কাণ্ড হবে। বলে দাও রিনিকে। চাকরি চলে গেলে কি সুবোধদা খাওয়াবে আমাকে? কাল শনিবার, ছুটি আছে। কাল যাব ধীরে সুস্থে। যদি সময় করতে পারি এবং যদি সুবোধদা কাল অবধি বেঁচে থাকে।

কয়েকদিন থেকেই চামেলির কাছে শুনছি যে, সেলস ট্যাক্সের নতুন কমিশনার হয়ে জয়েন করছেন তরুণ জহর সরকার। প্রবীণ স্বপন চক্রবর্তী অন্যত্র যাচ্ছেন। দুজনেই আই এ এস। তবে চক্রবর্তীসাহেব বহুদিন ওই পদে ছিলেন। কমার্শিয়াল ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের সকলেই তাঁর রীতি প্রকৃতি জানতেন। এই নতুন কমিশনার নাকি দারুণ প্রাগম্যাটিক এবং আনপ্রেডিকটেবল। টাইফুন বা টোর্নাডোর মতন। কখন যে কোন কোণ থেকে উঠে, কোন আকাশ ফুঁড়ে, কোন বাতাসে দক্ষযক্ষ আরম্ভ করবেন কেউই জানে না। তাই দিন সাতেক হল চামেলি অত্যন্তই টেনশানে আছে।

রিনির কাছ থেকে নার্সিংহোমের ঠিকানাটা নিয়ে বললাম, আমি যাচ্ছি রে একটু পরে। তোর মাসির আজ খুব ঝামেলা অফিসে।

এই তুলকালাম শব্দটির মানে যে কী তা ঠিক জানি না আমি। বাড়িতে একটিও বাংলা অভিধান নেই। সত্যি কথা বলতে কী, একটিও বাংলা বই নেই। দক্ষিণ কলকাতার ইংরেজি-জানা মোটামুটি স্বচ্ছল মানুষেরা ট্রাশ বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে আর কোনোই ইন্টারেস্ট রাখেন না, শিশু থেকে বৃদ্ধ। না। কেউই না।

৩.

রূপকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আমি সুবোধদাকে দেখে এলাম নার্সিংহোম থেকে। অবস্থা মোটেই ভালো নয়। এই সুবোধদাই শুনেছি, চামেলির বিয়ের সময়ে অনেক খরচ করেছিলেন। এখন। রিটায়ার করেছেন। ভালোবাসার তো কোনো অর্থমূল্য নেই। টাকার ব্যাপারটাই শুধু মাপা যায়, ভালোবাসা সে অর্থে মূল্যহীন, মূল্যমানহীনও।

ঘুষের চাকরি ছিল সুবোধদার কিন্তু পয়সা করেননি বাঁ হাতে। এখন পিস্তলে কী হবে? চামেলি বলে। ফরেস্ট সেক্রেটারি বা ফরেস্ট মিনিস্টার কি মরে গেলে একটি মালাও পাঠাবেন সততার পুরস্কার হিসেবে সুবোধদাকে? সৎ মানুষদের যদি সমাজ অথবা সরকার এককণাও সম্মান এবং মূল্য দিতেন এই লুঠমারের দিনে, তাঁদের রক্ষা করতেন এই অগ্নিমল্য বাজার আর মুদ্রাস্ফীতির হাত থেকে, তা হলেও হয়তো এই সাংঘাতিক বিপজ্জনক সময়েও অনেক মানুষই সৎ থাকতে পারতেন, থাকতে চাইতেন। উপায় থাকতে কে আর ইচ্ছে করে অসৎ হতে চায়? হয়তো কেউ কেউ চায়। কিন্তু তাঁদের সংখ্যা খুবই কম। অথচ সততা আর মূর্খতা আজ প্রায় সমার্থকই হয়ে গেছে।

তবে সুবোধদার প্রতি আমার এক গভীর দুর্বলতা আছে। আমাদের উনি অনেক জায়গার জঙ্গল দেখিয়েছেন। যেখানেই ডি এফ ও ছিলেন সেখানেই ছোটো শালি আর ভায়রাভাইকে সমাদরের সঙ্গে নিয়ে গেছেন। আমার অরণ্যপ্রীতি, বলতে গেলে সুবোধদার জন্যেই গড়ে উঠেছিল।

আমার সবচেয়ে খারাপ লাগে, লজ্জা লাগে ওঁর প্রতি চামেলির ব্যবহারের কারণে। আজকে সুবোধা আর বড়দির প্রতি চামেলির আর কোনো ফিলিংসই নেই।

মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, চামেলি খুবই স্বার্থপর। অতীতের কথা আজকাল আর কেউই মনে রাখে না। মই-এরই মতন ব্যবহার করে সকলেই অতীতকে। বর্তমানের উচ্চতাতে পৌঁছোনো মাত্রই অতীতকে দু-পায়ে ঠলে ফেলে দেয় নীচে। কৃতজ্ঞতাবোধ ব্যাপারটা নিশ্চিহ্নই হয়ে যাচ্ছে আধুনিক মানুষের মানসিকতা থেকে। চামেলি এদেরই একজন।

ভারি হাসিখুশি, প্রাণখোলা, দিলদরিয়া মানুষ ছিলেন সুবোধদা। ওঁদের বড়ো মেয়ে-জামাই থাকে দুবাইতে। আরও টাকা, অনেক টাকার জন্যে ওরা সপরিবারে চলে গেছে পাঁচ বছরের জন্যে। ফিরে এসে ডলারের পাহাড় বানিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বাকি জীবন খাবে বলে। পরিশ্রমেও বড়ো অনীহা আজকাল আমাদের প্রজন্মের সকলেরই। অথচ চাই সবই। তাই ঘুষ-ঘাষ ছাড়া চলেই-বা কী করে? চুরি করতে হয়, ব্যবসার জিনিসে ভেজাল দিতে হয়, স্মাগলিং করতে হয়। টাকা যে চাইই, যেমন করে হোক। অনেক টাকা চাই।

চামেলিদের সেলস ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের স্বপন চক্রবর্তী, জহর সরকার এঁরা নাকি খুব সৎ। শুনলেও ভালো লাগে। এই দেশে এখন অনেকই শেষান সাহেবের দরকার। তবে তাও মনে হয়। দেরি হয়ে গেছে অনেকই। আর কি কিছু করা যাবে? যা হবার তা হয়ে গেছে।

আমি নার্সিংহোমে থেকে যাব কি না জিজ্ঞেস করেছিলাম বড়দিকে। বড়দিই বললেন, কী করতে থাকবি? এঁরা থাকতে তো দেবেনও না। গাড়িটাড়ি থাকলে, আমাদের অথবা তোর, তাও না-হয় তাতে বসে থাকতে পারতিস। তোর স্কুটারে কতক্ষণ আর বসে থাকবি?

তাই ফিরেই এসেছিলাম। বলে এসেছিলাম, বিকেলে আবার আসব। মধ্যে যে কোনো দরকার হলে ফোন কোরো। আমি বাড়িতেই থাকব।

এখন শীতকাল। রোদে বসে থাকতে ভালোই লাগে। বাড়িতেও এখন কেউই নেই। রূপের স্কুল ছুটি হবে চারটেতে। ফেরার সময়ে সে স্কুলবাসেই আসে। চামেলির ফিরতে ফিরতে ছটা হবে কম করেও। তার আগেই আমি বেরিয়ে পড়ে আবার আসব নার্সিংহোম-এ। আমাদের তিনজনের কাছেই চাবি থাকে বাইরের দরজার। অফিস থেকে ফেরার পর চামেলির মেজাজ তুঙ্গে থাকে। তখন ওকে এড়িয়ে চলাই ভালো, নেহাতই শান্তির কারণে। তা ছাড়া, আমাদের দাম্পত্য শরীর বলতে আর কিছু নেই। আর হয়তো মন বলতেও নেই। এই দাম্পত্য একটা অভ্যেস, একটা ইঁদুর-কল। আজকাল সকলেরই কি এরকমই?

জানতে ইচ্ছে করে। অথচ আমার সবে চল্লিশ পেরিয়েছে। চামেলির আটত্রিশ। আমাদের মধ্যে সবসময়ে শুধু টাকারই কথা হয়, অভাবের কথা, পরনিন্দা, পরচর্চা। অভাবটাও প্রকৃত অভাব হলে না-হয় বোঝা যেত। আমরা কখনো গান শুনি না, বই পড়ি না। শুধু টিভির গুনগুনানি। মাঝে মাঝে আমার উদভ্রান্তর মতন লাগে।

একতলার ঘোষদের ফ্ল্যাটে বিরাট স্ক্রিনের নতুন টি ভি এসেছে ফিলিপস কোম্পানির। তিনতলার মিসেস মিত্তির বলছেন ওনিডা কিনবেন। দেতালারা চ্যাটার্জিসাহেব বলছেন সোনি থাকতে আর কিছু কিনবেন না। চ্যাটার্জিসাহেব ডিজেল-অ্যাম্বাসাডর নিয়েছেন হায়ারপারচেজ-এ। উলটোদিকের বাড়ির ঘোষসাহেবের পৈতিক বাড়ির তিনতলাটা ভেঙেচুরে নতুন ঝাঁ-চকচকে ফ্ল্যাট বানিয়েছেন–তা নিয়ে তাঁদের যৌথ পরিবারে অশেষ অশান্তি। ঘোষসাহেব একটি মারুতি ZEN নাকি বুক করে দিয়েছেন। ডিজেল-অ্যাম্বাসাডরের ওপরে টেক্কা মারার জন্যে। হায়ার পারচেজে। সুদ দিতে দিতে জান কয়লা হয়ে যাবে। সব পরিবারেই এই ক্রমাগত ঠোকরা-ঠুকরি, মারামারি-শালাদের মধ্যে, ভায়েদের মধ্যে, ভায়রাভাইদের মধ্যে, প্রতিবেশীদের মধ্যে। এইসব অপ্রয়োজনের, তৈরি-করা প্রয়োজন থেকে যে অভাববোধ, সেটা যে আদৌ অভাব নয়, স্বভাবেরই দোষ একথা বোঝে বা বোঝায় এমন মানুষ আজকাল একজনও দেখি না। সবসময়েই চাই। চাই। চাই। খাই। খাই। খাব। খাব। খাব চিকার চারদিকে। তুমিও কিছু নাও, তুমিও কিছু খাও, তুমিও ভালো থেকো, তুমিও খুশি হও এসব কথা আদৌ আর কারো মুখেই শুনি না। মনে আসে কি না জানি না।

সকালে বাতাসি আসেনি। চামেলিও রান্না করেনি। রূপকে ডিমের পোচ করে দিয়েছিল আর টোস্ট। চা-টা অবশ্য নিজে হাতেই বানিয়েছিল। রোজই বানায়। মিথ্যে বলব না। বাতাসি তো আসেনি তাই আজ রাতে কী খাওয়া হবে তা চামেলির মর্জির ওপরে নির্ভর করবে। রান্না করে না। চামেলি নিজে হাতে। বলে, ছোটোলোকের কাজ। পাড়ার মোড়ে নবেন্দুর ভ্যাগাবন্ড ছোটো ভাই বিংকু চাইনিজ-এর দোকান দিয়েছে। এমন এমন দিনে সেই ভরসা।

মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছে করে মেইনল্যান্ড চায়না থেকে একজন রিয়্যাল চীনেম্যানকে ধরে এনে যদি, এই বিংকু-পিংকু-চিংকুরা, যারা অগ্রণ্য চাইনিজ খাবারের দোকান দিয়েছে কলকাতার সব। পথের মোড়ে মোড়ে, অথবা বাতাসি পেঁচি, ন্যাবার মা অথবা তাদের মালকিনেরা চামেলি, শেফালি, চুমকি, কিটিকিটি বা চিক-টুইরাও ঘরে ঘরে যে চাইনিজ রান্না করে কলকাতায়, সেই সব চাইনিজ খাবার কোনোক্রমে একবার খাইয়ে দেওয়া যেত, তবে সব চীনেরা তিববত আর লাদাখ থেকে বাপ বাপ করে সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে যেত। এইসব চাইনিজ খেয়ে সব রিয়াট্যাল চাইনিজই এখানেই ফওত হয়ে যেত যে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। গুলি ছুঁড়তে হত না। একটিও।

নার্সিংহোম থেকে ফেরার সময়ে ঘেঁটুজ-এর দোকান থেকে একটা মাটন রোল কিনে এনেছিলাম। সেটাকে খেয়ে, এক গ্লাস জল খেয়ে, কাগজটা একটু দেখার চেষ্টা করলাম।

ওপরের বারান্দাতে বসেছিলাম রোদে পিঠ দিয়ে। কাক ডাকছিল। একতলার এই বারান্দাটাই আমাদের ড্রয়িং রুম, ডাইনিং রুম, আমার স্কুটারের গারাজ। এতে কোনো অসুবিধে ছিল না। ভালো পাড়াতে তো থাকি। মোটামুটি খেয়ে-পরেও থাকি। একই সন্তান। কিন্তু সব সুখই খেয়ে ফেলেছে চামেলির লোভ। টিভিতে, কাগজে সর্বক্ষণ ভোগ্যপণ্যের বিজ্ঞাপন, যে সবের কোনো কিছুই আমাদের না-থাকলেও জীবনযাত্রার কোনো হেরফরই হত-না, হত-না সুখের, প্রেমের, শরীর-মনের, দাম্পত্যের, অপত্যর। বরং সেসব এই বীভৎস সর্বব্যাপী লোভ না থাকলে অনেকই গভীর হত। কিন্তু…

দু-মাস হল খুবই ধরেছে চামেলি। হেঁজি-পেঁজি সকলেরই একটা করে মারুতি আছে। প্রেস্টিজ থাকে না। তোমার আমার পিএফ থেকে লোন নিয়ে আর বাকিটা ফিনান্সিয়ারের কাছ থেকে নিয়ে, কেননা না একটা মারুতি। সকলেই সুদ দেয়, আমরাও দেব। মুখ দেখানো যায় না একটা গাড়ি ছাড়া। ট্রামে-বাসে-ট্যাক্সিতে আর ভালো লাগে না।

কী রঙের নেবে বাবা?

রূপ বলেছিল। পরম উৎসাহে মা-কো বেটা!

আমার মনে হয়েছিল রূপেরও যেন তার বাবার স্কুটারের পেছনে বসে স্কুলে যেতে আর স্কুলবাস এ করে ফিরে আসতে বন্ধুদের সামনে প্রেস্টিজ থাকছে না।

প্রেস্টিজ!

মাই ফুট!

আমরা আড়াই মাইল হেঁটে খাকি প্যান্ট আর খাকি শার্ট পরে পাচিপুরের স্কুলে যেতাম। অনেকের পায়ে জুতোও থাকত না। আমার আর চিন্টুর পায়ে অবশ্য ছিল জুতো। নটি-বয় শু। কিন্তু কখনো প্রেস্টিজ চলে যাবার ভয় হয়নি। জীবনে কোনো সময়েই না।

আমাদের প্রত্যেকের বাড়ি-ভরতি বাংলা বইও ছিল। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল, আশাপূর্ণা দেবী। রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, চণ্ডী, প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যেতে লক্ষ্মীপুজোর শাঁখের শব্দে আর ঘরে ঘরে মা-মাসিদের লক্ষ্মীর পাঁচালি গুনগুন সুর করে পড়ার শব্দে কী যে এক মোহময়, শান্তিময়, শান্তি স্নিগ্ধ আবেশ তৈরি হত! বাংলার ঘরে ঘরে তখন প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপুজো অবশ্যই হত, কিন্তু সেই লক্ষ্মীর সেবিকারা কেউই রাক্ষুসী ছিলেন না। সর্বগ্রাসী ছিল না তাদের খিদে। লক্ষ্মী শব্দটির মানেই অন্যরকম ছিল। লক্ষ্মী বলতে সেদিন শুধু অর্থকে বোঝাত না। এক জীবনে কতটুকুর দরকার, ন্যূনতম প্রয়োজন কী? কোন কোন জিনিসের দরকার মানুষের মতন বেঁচে থাকতে তা নিয়ে কোনো নারী বা পুরুষের মনে বিন্দুমাত্রও সংশয় ছিল না। কোজাগরী পূর্ণিমার দিনে কলাগাছের আর নারকেলগাছের পাতায় পিছলে যাওয়া জ্যোৎস্নায় ভেসে যদি কখনো কারো বাড়ি দুধ-সাদালক্ষ্মীপেঁচা উড়ে এসে বসতও, তাতে প্রতিবেশীদের মধ্যে কারোই ঈর্ষা হত না, আনন্দই হত।

আমার যদি কিছুমাত্রও ক্ষমতা থাকত, তবে আইন করে দিতাম যে কোনো স্কুলের ছেলে বা। মেয়ের কোনো বাহনে করে স্কুলের পাঁচশো মিটারের মধ্যেও আসতে পারবে না। সকলকেই হেঁটে আসতে হবে। স্কুলের ইউনিফর্ম পরে আসার নিয়মের পেছনে আসল উদ্দেশ্য ছিল ধনী দরিদ্রর মধ্যে কোনোরকম বৈষম্য না করা। বড়োলোকের ছেলে-মেয়েরা যেন স্কুলে এসে বডোলোকি দেখিয়ে অন্যদের মনে কষ্ট এবং লোভ জাগাতে না পারে। এই ছিল ইউনিফর্মের উদ্দেশ্য। এখন যদিও ইউনিফর্ম পরেই স্কুলে যায় সকলে (সেও তে এক র‍্যাফেটই! সেও এক মহার্ঘ্য ব্যাপার!), কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের গাড়ি চড়ে এসে নামাতে ইউনিফর্ম-এর প্রথা যে কারণে প্রবর্তিত হয়েছিল, সেই কারণটিই মিথ্যা হয়ে গেছে।

লোভের বীজাণু গিজগিজ করছে চারপাশে অনুক্ষণ। টাকা চাই! আরও টাকা। যেন-তেন প্রকারেণ। চুরি করো, ঘুষ খাও, স্মাগলিংকরো, যা খুশি করো, কিন্তু টাকা নিয়ে এসো। টাকাই যেন সর্বসুখের মূল। সর্বদুঃখহারী।

হাঃ।

ফোনটা বাজল।

ইয়েস।

ভাবলাম, চামেলি ফোন করেছে সুবোধদার খোঁজ নেবার জন্যে।

না। নার্সিংহোম থেকে রিনি বলছে।

কী রে রিনি?

বাবার অবস্থা ভালো নয় বুড়ুমেসো। তুমি একটু খবর দেবে সবাইকে?

তোর কাকারা কোথায়?

কাকারা আছে কলকাতাতেই, তবে তারা কেউই আসবে না।

কেন?

বাবা তাদের চোর বলেছিল তাই।

কেন চোর বলেছিল?

চুরি করেছিল বলে?

কী চুরি?

দাদুর কেষ্টনগরের বাগান অনেক বেশি দামে বিক্রি করেও বাবাকে কিছুই দেয়নি বলতে গেলে। বাবা যে পায়নি, সেজন্যে বাবার দুঃখ ছিল না। কিন্তু বাবার ছোটো ভাইটাও যে চোর হয়ে গেছে, ফোরটোয়েন্টি, এই দুঃখটাই বেশি দুঃখ দিয়েছিল বাবাকে। থাক সেসব কথা এখন। তবে একথা ঠিক যে, তারপর থেকে বড়োলোক, সমাজের মান্যগণ্য আমার কাকারা বাবার সঙ্গে আর সম্পর্কই রাখেন না। রিটায়ার্ড ডি এফ ও কোনো কাজে আসে কার? বলো মেসো, এই সোশ্যাল ক্লাইম্বিং-এর যুগে? বাবাকে তো কাকারা তাড়িয়েও দিয়েছে দাদুর বাড়ি থেকে। আমি কোনওদিনও বলতাম, না, আজ বাবার এরকম…এদিকে পাড়াতে সকলকে বলেছে যে, বাবা। ভালো থাকবে, ভালো খাবে বলে আলাদা থাকতে চায়।

সে কী রে! তোরা এখন আর তোদের সেই হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে থাকিস না? একসঙ্গে?

সে কী! তোমাকে এতদিনেও বলেনি ছোটোমাসি! তুমি তো জামশেদপুরে ছিলে দু-বছর। কিন্তু ফিরেও তো এসেছ দু-মাস হল! আশ্চর্য! আমরা তো এখন ভাড়া বাড়িতেই থাকি। নাকতলাতে। দেড় বছর হল।

ফোন নাম্বার কত?

ফোন নেই মেসো। বাড়িতে ফোন নেই। আমি যাই। মা একা আছে। কাঁদছে খুব। বাবা ভালো নেই।

রিনির গলার স্বর বুজে এল।

ফোনের বই খুলে চামেলির সব আত্মীয়স্বজনের ফোন নাম্বার লিখে নিয়ে একে একে ফোন করবার আগে চামেলির অফিসে একটা ফোন করলাম।

ওর একজন কলিগ, মিছি বললেন, ও ক্যান্টিনে গেছে। খেয়ে আসেনি নাকি! ঝগড়া করেছে নাকি মশায়?

না, না। ঝগড়া নয়।

তারপর একমুহূর্ত চুপ করে থেকে ওঁকে বললাম, চামেলিকে বলবেন যে, ওর জামাইবাবুর অবস্থা ভালো নয়। ঠিকানাটা আর নার্সিংহোম-এর ফোন নাম্বারটা লিখে নিন প্লিজ। ও এলেই বলবেন। এও বলবেন যে কতগুলি জরুরি ফোন সেরেই আমি যাচ্ছি নার্সিংহোমে।

ঠিক আছে।

বলল, মিছি।

আজকাল মানুষের সময়ের এতই অভাব যে শব্দের পুরোটা উচ্চারণ করারও সময় নেই কারো।

ধন্যবাদ।

বলেই, ফোনটা রেখে দিলাম আমি।

তারপর যাদের ফোন করার ছিল করে, কোটটা আর হেলমেটটা নিয়ে স্কুটারটা ঠেলে বের করলাম বারান্দা থেকে। বাইরে বেরিয়ে দরজা লক করে স্কুটারে বসে স্টার্ট করলাম।

আমার ছোটোভাই শ্যামলকে খবর দিতে পারতাম। দেওয়া উচিত ছিল। কারণ সুবোধদা তাদের জন্যেও কম করেননি একটা সময়ে। কিন্তু তার শালার অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশন হয়েছিল। বেলভিউ নার্সিংহোম-এ। অপারেশন চলাকালীন আমি যেহেতু অফিস কামাই করে নার্সিংহোম এর ড্রাইভে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকতে ফুকতে আমার concern দেখাইনি, সেজনে নাকি ওর শ্বশুরবাড়িতে ওর ইজ্জৎ চলে গেছিল। যেমন চামেলির আর রূপের প্রেস্টিজ চলে যাবে, আমি মারুতি না কিনলে। সেদিনই শ্যামল, চামেলিকে বলে দিয়েছিল যে, দাদার শ্বশুরবাড়ির কারো কিছু হলে আমাকে পাবে না বউদি। তাই…

শ্যামলের শ্বশুরমশায়রা সুদের কারবারি। বন্ধকি ব্যবসাও করতেন। কত বিধবা আর অনাথের দীর্ঘশ্বাস যে জড়ানো ছিল তাঁদের স্বাচ্ছল্যে। নকশাল ছেলেরা যে কেন এদের মারল না তা কে জানে! হয়তো মারবে কোনোদিন ভবিষ্যতে। বহু পুরুষের মেহনতহীন কামাই-এর বহুত পয়সা ওদের। তারই গুমোরে তাঁদের পা পড়ে না মাটিতে। শ্যামল অনেক ফন্দি-ফিকির করে পুষির সঙ্গে প্রেম করে জাত-এ উঠেছে। ভেবে পাইনি শ্বশুরবাড়ির কল্যাণে যে জাতে ওঠা যায়, সে জাতের নাম কী?

যেতে যেতে সুবোধদার কথা মনে পড়ছিল। অনেকই করেছেন মানুষটি আমাদের জন্যে। অনেক জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, নিজে গাড়ি চালিয়ে। খাওয়ানো-দাওয়ানো, হই-হুল্লোড়। বিয়ের আগে এবং বিয়ের সময়ে কী কী করেছেন তার সব না জানলেও কিছু কিছু শুনেছি চামেলির কাছে। আমার মনে হয়েছে সুবোধদার সঙ্গে চামেলির একটা রোমান্টিক সম্পর্কও ছিল। মনে হয় যে, অবশ্যই ছিল এবং সেই জন্যেই হয়তো দিদির সঙ্গে চামেলির সম্পর্কটা তেমন ভালো ছিল না।

জানি না, আমি ভুলও হতে পারি।

আমি যখন নার্সিংহোম-এ গিয়ে পৌঁছোলাম তখন ক্রাইসিস কেটে গেছে। কার্ডিওলজিস্টডাঃ এ কে বিশ্বাসকে এনেছিল ওরা বেলভিউ নার্সিংহোম থেকে। চমৎকার মানুষ। ডাক্তার তো খুবই ভালো। বেরিয়ে যাবার সময়ে ডাঃ বিশ্বাস বললেন, ভয় নেই। এখন Stable, তবে থাকতে হবে অন্তত দিন পনেরো। তারপর বাড়িতে গিয়েও সাবধানে থাকতে হবে। এক মাস।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, সাবধানে মানে?

মানে, পরিপূর্ণ বিশ্রাম। আনন্দ, গান শোনা, ভালো ছবি দেখা টি ভি-তে, ভালো বই পড়া, সাহিত্য। সাহিত্য হচ্ছে জীবনের এলিক্সার। বুঝলেন মশাই। আর ভালোবাসা। এ সবেরই দরকার। শেষের দুটিরই সবচেয়ে বেশি। আমি দিদি ও রিনিকে সাহচর্য দেবার জন্যে রাত নটা অবধি থাকলাম নার্সিহোম-এ। তারপর ট্যাক্সিতে ওদের তুলে দিয়ে আমার অফিসের ফোন নম্বরটা দিয়ে রিনিকে বললাম যে, প্রয়োজন হলে ফোন করিস। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে, অফিসে অথবা বাড়িতে যেখানেই হোক।

না, একথা বললাম সুবোধদা শুধু আমার ভায়রাভাই বলেই নয়, মানুষটার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতাবোধ, আমি মানুষ বলেই, গভীর ছিল।

চামেলি বাড়ি ফিরতেই যেন ঝড়ের মুখে পড়লাম।

নার্সিংহোমে সুবোধদাকে দেখতে তো চামেলি যায়ইনি, উলটে আমাকে আক্রমণ করল। বলল, রাতের খাবার কে আনবে? আমি কি তোমার ঝি? আমিও রোজগার করি। পরিশ্রম করি। নিজে তো ছুটি কাটাচ্ছ বসে বসে পায়ের ওপর পা তুলে। রাতের খাওয়ার কী হবে সেটুকুও বন্দোবস্ত করে রাখতে পারোনি?

আমি বললাম, সুবোধদার…

তিনি গেছেন না আছেন?

কী বলছ কী তুমি!

গেলেই খুশি হতাম। দিদির তেল একটু কমত।

সুবোধা আমাদের জন্যে, বিশেষ করে তোমার জন্যে কত কীই…

আমি বললাম।

ছাড়ো তো!

কেন? তুমি এমন করে বলছ কেন?

আমি চামেলির হৃদয়হীনতাতে আহত হয়ে বললাম।

ও বলল রাগতস্বরে, গত শনিবারে দিদির কাছে গেছিলাম একটা বালুচরি শাড়ি চাইতে। রবিবার দুপুরে ক্যালকাটা ক্লাবে নেমন্তন্ন করেছিলেন সেলস ট্যাক্সের একজন বড়ো উকিল। তুমি জান যে দিদি দিল না শাড়িটা! বলল, আমাদের দেওয়ার দিন শেষ হয়ে গেছে রে চামি। প্রায় সব শাড়িই দিয়ে দিয়েছি। সামান্য কটা আছে। একটা রিনির জন্যে থাক। ওর বিয়ে অবধি হয়তো আমাদের দুজনের কেউই বেঁচে থাকব না। বুড়ো বয়সের মেয়ে তো!

আমি কি তোমার শাড়ি নিয়ে নেব নাকি?

আমি বলেছিলাম দিদিকে।

চামেলি বলল।

নিবি না তো জানি। কিন্তু বহু মানুষে শাড়ি পরতে নিয়ে ফেরত দেয়নি। নইলে ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেরত দিয়েছে। তোর সুবোধদার তো রোজগার নেই এখন কোনোই। সঞ্চয়ও তেমন নেই। আমার ওই একটাই বালুচরি শাড়ি।

রিনি কী বলল?

আমি জিজ্ঞেস করলাম।

রিনি বলল, দিয়ে দাও না, মাসিকে। আমি তো শাড়ি পরিই না, সালোয়ার-কামিজই পরি।

কিন্তু দিদি বলল, না, আমি দেব না।

তারপর চামেলি বলল, এর পরেও তুমি আমাকে দিদির বরকে দেখতে যেতে বলো নার্সিংহোম-এ?

আমি হতবাক হয়ে বললাম, সুবোধদার কি দিদির বর ছাড়া অন্য কোনোই পরিচয় নেই তোমার কাছে? উনি কি শুধুমাত্রই তোমার দিদির বর? তা ছাড়া দিদি তোমার জন্যে কী করেছিল আর কী করেনি সবই ভুলে গেলে?

কী আবার করেছে! অমন সব দিদিই করে।

আর বোনেরা?

বেশি কথা বোলো না, আমি ভীষণ টায়ার্ড।

আমি চুপ করে গেলাম।

আমার চোখের সামনে পাচিপুরের চিন্টুদের বাড়িটা যেন ফুটে উঠল। দাদু, ঠাকুমা, জ্যাঠাবাবু, চিন্টুর বাবা এবং সব কাকারা, চিন্টুর দুই পিসেমশাই। মনে আছে, তাঁদের একজন থাকতেন পুরুলিয়াতে আর অন্যজন জলপাইগুড়িতে। কাকিমারা, জ্যাঠতুতো, খুড়তুতো, পিসতুতো বোনেরা,নতুন তাঁতের শাড়ি পরে, চান-করে-ওঠা চুল পিঠের ওপরে ছড়িয়ে দিয়ে চিন্টুর ঠাকুমা, জেঠিমা, কাকিমা, পিসিমা বোনেরা সকলে পাশাপাশি ফল কাটছেন, দুর্বো ছিড়ছেন ডাকের সাজের গর্জন-তেল-মাখা প্রতিমার সামনে বসে। আর সাধন রায় আগমনী গান গাইতেন।

নাঃ। এই কলকাতার, বালিগঞ্জের পৃথিবীটাই বড়ো লোভী, বড়ো স্বার্থপর, বড়ো অকৃতজ্ঞ, বড়ো। বিচ্ছিন্নতাবাদী, বড়োই অর্থগৃধু হয়ে গেছে। মানুষের চেহারার প্রাণীতেও ভরে গেছে পৃথিবী। কিন্তু এখানে মানুষ বড়োই কম। বড়ো কম। আমার স্ত্রী-পুত্রকেও আমি মানুষ বলে গণ্য করি না। সত্যিই করি না।

চিন্টুদের বাড়িটা এক সুন্দর স্বপ্ন হয়েই থাকবে আমার কাছে বাকি জীবন। এক সুন্দর স্নিগ্ধ

অমলিন স্বপ্ন।

স্বপ্ন, এই জন্যে যে, আমি এও জানি যে, এটাও নির্মম সত্য যে, যদি পাচিপুরে গিয়ে খোঁজ করি আজ, তবে জানব যে…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *