চিত্রনায়ক দস্যু বনহুর (১৫)
০১.
স্টুডিও থেকে ফিরতে রাত প্রায় দুটো বেজে গেলো বনহুরের। স্বয়ং প্রযোজক তাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন। সেদিনের সেটে ভিলেন বিশু রায়ের সঙ্গে জ্যোছনা রায়ের কাজ ছিলো, কাজেই পরিচালক নাহার চৌধুরী আসতে পারলেন না। সুটিং শেষ হতে ভোর হয়ে যেতে পারে। কাজেই বনহুরের কাজ হয়ে যেতেই আর বিলম্ব না করে বাসায় ফিরে এলো সে।
পথে গাড়িতে বসে অনেক কথা হলো আরফানউল্লাহর সঙ্গে বনহুরের। আরফানউল্লাহ বললেন তার মত একজন সুদর্শন যুবককে তাঁর ছবির নায়ক হিসেবে পেয়ে অনেক খুশি হয়েছেন তিনি। অনেকদিন থেকে তিনি এমনি একটা ছেলেকে খুঁজছিলেন—এ কথাটাই বারবার বললেন আরফানউল্লাহ। অদৃষ্ট প্রসন্নতাই পেয়েছেন নাকি তাকে। আরও বললেন, একদিন তার বাড়িতে বনহুরকে নিয়ে যাবেন। আতিয়া নাকি তাঁর সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য অত্যন্ত আগ্রহী।
বনহুর এ কথায় বলেছিলো, তার বাড়িতেই রয়েছি, অথচ আজও তার সাথে পর্যন্ত দেখা হলো না। আমারই কি কম আগ্রহ তাঁর সঙ্গে পরিচিত হবার! নিশ্চয়ই যাবো–কথা দিয়েছে বনহুর।
বাসায় ফিরে সর্বাগ্রে নূরীর কক্ষে প্রবেশ করলো বনহুর।
খাটের উপর অঘোরে ঘুমাচ্ছে নূরী।
যে মেয়েটাকে নূরীর দেখাশোনার জন্য রেখেছে বনহুর সে তখনও জেগে ছিলো, বনহুর ফিরে আসতেই সে বললো–আমি এবার যাই হুজুর।
বনহুর বললো-তুমি ঘুমাওনি?
না হুজুর।
বেশ যাও, ঘুমাওগে।
মেয়েটা কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলো নিজের কক্ষের দিকে।
নিজের অজ্ঞাতে নূরীর ঘুমন্ত মুখের দিকে বনহুরের দৃষ্টি চলে গেলো আবার। কিছুক্ষণ নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে রইলো বনহুর তার মুখের দিকে।
হঠাৎ ইয়াসিনের কণ্ঠস্বরে সম্বিৎ ফিরে এলো বনহুরেরসাহেব, টেবিলে আপনাগো খাবার দেওয়া অইছে।
কে, ইয়াসিন?
দরজার বাইরে থেকে আবার শোনা গেলো ইয়াসিনের কণ্ঠস্বর–হ সাহেব, আমি ইয়াসিন। টেবিলে খাবার দেওয়া অইছে।
আচ্ছা আসছি। বনহুর কথাটা বলে নিজের কক্ষে ফিরে আসে। জামাকাপড় ছেড়ে বাথরুমে প্রবেশ করে বনহুর।
অনেকক্ষণ ধরে ঠাণ্ডা পানিতে হাতমুখ ঘোয়। এখন বেশ স্বস্তি বোধ করছে সে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে বসে সে।
ইয়াসিন জড়োসড়োভাবে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে।
খেতে খেতে বললো বনহুর-ইয়াসিন, তুমি ঘুমাওনি?
না সাহেব, আপনি না খাইলে আমি কি ঘুমাইতে পারি?
সত্যি, তুমি খুব ভাল।
কিন্তু বাড়ির মালিক কন, আমি নাকি একেবারে অকেজো।
না না, ঠাট্টা করে ওকথা তোমাকে বলেন তিনি। আচ্ছা, ইয়াসিন?
কন হুজুর!
তুমি কতদিন হয় আছে এখানে?
তা সায়েব বছর বিশ-একুশ অইব—
ওঃ তুমি তো তাহলে খুব পুরোনো লোক।
সাহেবের মাইয়ার যখন সাত বছর বয়স তখন আমি আইছি।
এখন বুঝি সাহেবের মেয়ে খুব বড় হয়েছে?
কার কথা কইছেন, আতিয়া আপার কথা?
হাঁ।
মস্ত বড়, আপনাগো দুইডা অইব।
তাই নাকি?
হ।
এমনি নানা কথাবার্তার মধ্য দিয়ে বনহুরের খাওয়া শেষ হলো।
কিন্তু বিছানায় শুয়ে কিছুতেই দুচোখ বন্ধ করতে পারলো না সে। ঘুম পেলে জোর করে তো ঘুমানো যায় না। বিছানায় ছটফট করলো কিছুক্ষণ। তারপর উঠে বসলো—কি যেন ভাবলো, আবার বালিশটা আঁকড়ে ধরে শুয়ে পড়লো। আজকের ঘটনাগুলো ভেসে উঠলো তার মনের পর্দায়। সুটিংয়ের অবসরে যখন বনহুর বিশ্রামকক্ষে একটা সোফায় বসে সিগারেট পান করছিলো, তখন জ্যোছনা রায় প্রবেশ করলো সেই কক্ষে।
এ কক্ষটা শুধু নায়কের বিশ্রামের জন্যই নির্দিষ্ট করা।
বনহুর পদশব্দে ফিরে তাকাতেই অবাক হলো।
অসময়ে তার কক্ষে জ্যোছনা রায়কে দেখে উঠে দাঁড়ালো বনহুর। কিছু পূবেই জ্যোছনা রায়ের সঙ্গে বাসর কক্ষের একটা দৃশ্যের শুটিং হয়েছে। এখনও জ্যোছনা রায়ের দেহে নববধুর ড্রেস শোভা পাচ্ছে। মেকআপের উপর চন্দনের ফোটাগুলো বড় সুন্দর লাগছিলো।
বনহুর হেসে অভ্যার্থন জানালো—আসুন মিস রায়।
সুন নয়, এসো বলুন-যেমন একটু আগে বলেছিলেন।
তাহলে আপনি খুশি হবেন মিস রায়?
খুব খুশি হবো। জ্যোছনা রায় বসে পড়লো একটা সোফায়।
বনহুর তখনও দাঁড়িয়ে। সিগারেট থেকে একরাশ ধোঁয়া নির্গত করে বললো—এখানে আপনি?
গোটা রাত কাজ আছে, ভাল লাগছে না।
বনহুর একটু হাসলো। আজ কয়েকদিন হলো সে লক্ষ্য করেছে—জ্যোছনা রায় তার সঙ্গে যখন কাজ করে তখন তার মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখা দেয়। চোখে মুখে ফুটে ওঠে একটা উচ্ছসিত ভাব, যা অতি চেষ্টা করেও গোপন রাখতে সক্ষম হয় না জ্যোছনা রায়। বনহুরের সঙ্গই যেন তার কামনা। তবে কি জ্যোছনা রায় তাকে ভালবেসে ফেলেছে!–বনহুরের ললাট কুঞ্চিত হয়ে উঠলো।
স্টুডিওর সবাই বনহুরকে মকছুদ চৌধুরীর পরিবর্তে শুধু মিঃ চৌধুরী বলে সম্বোধন করতো।
জ্যোছনা রায়ের কথায় সম্বিৎ ফিরে পায় বনহুর, বলে সে-অস্বস্তি বোধ করছেন না তো! বলুন তাহলে ডাক্তার ডাকি।
না না, অসুস্থ নয়–কিছু বলতে গিয়ে জ্যোছনা রায় থেমে গেলো।
বনহুর বুঝতে পেরেছে, তবু না বোঝার ভান করে বললো–এ ড্রেসে বুঝি আপনার কাজ আছে আরও?
হাঁ।
কার সঙ্গে?
বিশু রায়ের সঙ্গে।
একটু থেমে বললো জ্যোছনা রায়-মিঃ চৌধুরী, আপনি কি এখনই চলে যাবেন?
আমার কাজ যখন শেষ হয়েছে তখন আর রাত জেগে কি হবে বলুন?
জ্যোছনা রায়ের মুখমণ্ডল মলিন হয়ে উঠলো, উঠে দাঁড়ালো সে-চলি, গুড নাইট।
বনহুর তাকালো জ্যোছনা রায়ের দিকে সে মুখে বনহুর দেখতে পেলো একটা ব্যথারুণ আভাস। কি বলতে এসেছিলো জ্যোছনা রায়, যা সে বলতে চেয়েও বললো না।
বাড়ি ফিরে আসার পর বারবার জ্যোছনা রায়ের কথাই মনে পড়ছে বনহুরের। স্টুডিওতে আর একটা ব্যাপার বিশেষভাবে তার দৃষ্টিতে পড়েছিলো এবং সেই কারণেই বনহুর জ্যোছনা রায়ের মনের কথা জানার বাসনা থাকলেও এড়িয়ে গেছে সাভাবে।
বনহুর আর জ্যোছনা রায়ের যখন কথা হচ্ছিলো ঠিক সেই মুহূর্তে কক্ষের শার্শির ফাঁকে দুটো চোখ ভেসে উঠে মিলিয়ে গিয়েছিল।
বনহুর চিনতে পারেনি। তার চিনতে পারাও অসম্ভব ছিলো। কারণ শুধুমাত্র দুটো চোখই সে দেখতে পেরেছিলো।
আরও কয়েকবার বনহুর এই চোখ দুটি দেখেছে।
যখনই জ্যোছনা তার কাছে এসেছে তখনই বনহুর লক্ষ্য করেছে কে যেন তাদেরকে দেখছে।
কিন্তু কে সে? যার দৃষ্টি জ্যোছনা রায় ও তার মধ্যে একটা অদৃশ্য প্রাচীর সৃষ্টি করেছে?— এ চোখ দুটো শুধু বনহুরই লক্ষ্য করেছে, জ্যোছনা রায় বিন্দুমাত্র টের পায়নি।
বনহুর জ্যোছনা রায়কে ইচ্ছা করেই বলেনি কথাটা। কিন্তু সে নিজে সব সময় সংযত রয়েছে, জ্যোছনা রায় তার পাশে এলেই বনহুর তাকে নিজের কাছ থেকে দূরে রেখেছে-কিছু বলতে গেলে কথার মোড় অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়ে সাবধান হয়েছে কিন্তু কোন্ অদৃশ্য ব্যক্তির এ চোখ দুটি!
শুনেছিলো বনহুর-চিত্রনায়ক অরুণ সেন গভীরভাবে ভালবাসতো জ্যোছনা রায়কে–তবে কি–
বনহুর চুলে আঙ্গুল চালাতে লাগলো। যেন অস্বস্তি বোধ করছে সে। না, আর ওসব কথা ভেবে মন চঞ্চল করবে না। চোখ বন্ধ করলো বনহু, ঘুমাবে এবার। কিছুক্ষণ নিপ পড়ে রইলো, কিন্তু ঘুম এলো না তার চোখে। এপাশ ওপাশ করতে লাগলো বনহুর। তারপর হঠাৎ শয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালো, স্লিপিং গাউনটা আলনা থেকে টেনে পরে নিলো গায়ে। কিছুক্ষণ অস্থিরভাবে পায়চারী করলো সে। কক্ষের মাঝের দরজার দিকে তাকালো। ওপাশে নূরীর কক্ষ।
কখন যে সে নূরীর বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বনহুর নিজেই
খেয়াল করতে পারেনি।
কক্ষে. ডিমলাইট জ্বলছিলো, বনহুর নির্নিশেষ নয়নে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে। তারপর সাবধানে আলগোছে হাত রাখলো নূরীর কপালে।
সঙ্গে সঙ্গে নূরীর ঘুম ছুটে গেলো, চমকে উঠে বসলো বিছানায়। সম্মুখে তাকিয়ে ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললো সে আপনি!
বনহুর সোজা হয়ে দাঁড়ালো, কোনো কথা বললো না।
নূরী রাগে ফোঁস করে উঠলো-শুধু আজ নয়, আরও কয়েক দিন আপনি কথা শেষ করতে পারে না নূরী।
বনহুর নূরীর পাশে বসে পড়ে, ওর দক্ষিণ হাতখানা মুঠোয় চেপে ধরে অবেগভরা কণ্ঠে বলে-নূরী!
আমি বলছি আমি নূরী নই, আপনি ভুল করছেন।
নূরী, তুমি কি হয়ে গেছে! আজও তুমি আমাকে চিনতে পারলে না! নূরী তাকিয়ে দেখো, ভাল করে তাকিয়ে দেখো আমার মুখের দিকে।
না, কোনো কথাই আমার স্মরণ হচ্ছে না। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আমাকে রেহাই দিন–
এবার বনহুর রাগতকণ্ঠে বললো-নূরী, কি চাও তুমি?
আমাকে বিদায় দিন, যেদিকে আমার দুচোখ যায় চলে যাবো।
গর্জে উঠলো বনহুর-নূরী!
শিউরে উঠলো নূরী। বনহুরের গম্ভীর কঠিন কষ্ঠে নূরীর বুক কেঁপে উঠলো।
বনহুরের নিশ্বাস দ্রুত বইছে, দৃষ্টিতে ঝরে পড়ছে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।
বনহুরের এ রুদ্রমূর্তি দেখে নূরী ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো, বুকটা ওর ধকধক করতে লাগলো। এতদিনের মধ্যে নূরী কোনোদিন বনহুরকে এমনভাবে রাগান্বিত হতে দেখেনি।
বনহুরের হাতের মুঠায় হাত দুখানা যেন নিষ্পেষিত হয়ে যাচ্ছিলো, খুব কষ্ট হচ্ছিলো নূরীর।
গম্ভীর স্থিরকণ্ঠে বললো বনহুর-আজ আমি নিঃসহায় সঙ্গীহীন–তুমি–তুমি–কি হলো তোমার! বেশ, আর তোমাকে বিরক্ত করবো না-বনহুর নুরীকে ছেড়ে দিয়ে নিজের কক্ষে ফিরে যায়। স্লিপিং গাউনটা খুলে ছুড়ে ফেলে দেয় দূরে মেঝেতে। তারপর ধপ করে শুয়ে পড়ে বিছানায়। দুহাতে নিজের মাথার চুল টানতে লাগলো, একি হলো নূরীর! তার সম্বিৎ কোনোদিন কি আর ফিরে আসবে না? নূরীকে বনহুর গভীরভাবে ভালবাসে-যেমন বাসে মনিরাকে।
অসহ্য একটা ব্যথা গুমড়ে কেঁদে ফিরতে লাগলো বনহুরের মনে, কিন্তু কোনো উপায় নেই–নূরী আজ সম্বিৎহারা।
বনহুর চলে আসতেই নূরী সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিলো।
চমকে উঠলো বনহুর। দরজাটা যেন তার বুকের পাজরে ধাক্কা মারলো।
এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো বনহুর।
সুন্দর দীপ্ত মুখমন্ডলে তখনও ফুটে রয়েছে গভীর চিন্তার সুস্পষ্ট ছাপ।
ওদিকে দরজা বন্ধ করে বিছানায় এসে বসলো নূরী। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় লাল হয়ে উঠছে ওর চোখ দুটো। কেমন যেন এলোমেলো লাগছে সব ওর কাছে। অনেক ভেবে আজও নূরী স্মরণ করতে পারেনি-কে এই যুবক, যে তার জন্য মরণের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে উদ্ধার করে এনেছে। সত্যিই কি তার পরিচিত লোক ঐ যুবক? কিন্তু কই, মনে পড়ে না তো, ওকে কোথাও কোন সময় দেখেছে বা পরিচয় ছিলো তার সঙ্গে।
বেশি ভাবতে গেলেই নূরীর মাথা টনটন করে ওঠে। সব যেন কেমন এলোমেলো হয়ে যায়।
খুব ভোরে শয্যা ত্যাগ করলো নূরী। গত রাতের কথা স্মরণ হলো। যুবকটার জন্য মনটা হঠাৎ চিন্তিত হয়ে পড়লো। বনহুরকে চিনতে না পারলেও ওর জন্য মায়া হলো নূরীর। কিন্তু কেমন যেন সহ্য করতে পারতো
সে ওকে। দূর থেকেই নূরী বনহুরকে দেখতো, সুন্দর লাগতো ওকে। ভালো লাগতো, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতো, কেবল সে কাছে এলে তার বুক কেমন যেন দুরু দুরু করে কাঁপতো। নূরী কোনো সময় নিজে বনহুরের কাছে যেতো না বা কথা বলতো না। একজন অপরিচিত যুবকের সঙ্গে কি কথা বলবে সে।
গত রাতের কথা মনে করে নূরীর অনুশোচনা হলো। ব্যথার খোঁচা লাগলো মনের কোণে। দরজা খুলে এ ঘরে প্রবেশ করলো নূরী। তাকিয়ে দেখলো, দুগ্ধফেনিল শুভ্র বিছানায় অঘোরে ঘুমাচ্ছে বনহুর।
ভীতা হরিণীর মত লঘু পদক্ষেপে পা পা করে এগিয়ে এলো সে বনহুরের বিছানার পাশে।
মেঝেতে পড়ে থাকা বনহুরের স্লিপিং গাউনখানা স্পর্শ করতেই নূরীর সমস্ত শরীরে একটা অভূতপূর্ব শিহরণ জাগলো। বুকে চেপে ধরে-মুখে গালে লাগালো। তারপর তুলে রাখলো আলনায়।
খাটের পাশে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ অপলক নয়নে তাকিয়ে রইলো বনহুরের মুখের দিকে।
মনের মধ্যে আশঙ্কা জাগলো নূরীর, হঠাৎ যদি জেগে ওঠে-তখন কি হবে, পালাবার পথ পাবে না সে।–যেমন মন্থর গতিতে এসেছিলো তেমনি তাড়াতাড়ি চুপি চুপি বেরিয়ে গেলো নূরী।
আজ একটু বেলা করে ঘুম ভাঙলো বনহুরের। ইয়াসিন অনেকক্ষণ চা টেবিলে রেখে শিয়রে দাঁড়িয়েছিলো। বার দুই ডেকেও ছিলো সে, কিন্তু ঘুম ভাঙলো না বনহুরের।
গোটা রাত অনিদ্রায় কাটিয়ে ভোরের দিকে ঘুমিয়েছিলো, তাই জাগতে এত বেলা হয়েছিলো।
ঘুম ভাঙতেই বললো ইয়াসিন-সাহেব, একজন ভদ্রলোক আপনাগো লগে দেখা করতে আইছেন।
চায়ের কাপ হাতে তুলে নিয়ে থেমে পড়লো বনহুর, বললো-কোথায় তিনি?
বসবার ঘরে বইসেছেন।
আচ্ছা, চলো দেখি। চা
যে ঠাণ্ডা অইয়া যাইবো?
হতে দাও। বনহুর শয্যা ত্যাগ করে নেমে দাঁড়ালো, স্লিপিং গাউনটার দিকে হাত বাড়াতেই মনে পড়লো, ওটা কাল মেঝেতে পড়েছিলো-আলনায় রাখলো কে? তবে কি ইয়াসিন ওটা উঠিয়ে রেখেছে? স্লিপিং গাউনটা হাতে নিয়ে পরতে পরতে বললো বনহুর-ইয়াসিন, এটা তুমি উঠিয়ে রেখেছিলে?
মাথা চুলকে বলে ইয়াসিন-না সাহেব, ওটা আলনাতেই ছিলো।
বনহুর আর কোনো কথা না বলে একটু অন্যমনস্কভাবে কি যেন ভাবলো, তারপর বললো-দুকাপ চা ড্রইংরুমে পাঠিয়ে দিও।
আচ্ছা সাহেব।
বনহুর ড্রইংরুমে প্রবেশ করতেই অবাক হলো, অরুণ কুমার সেন বসে আছে তার প্রতীক্ষায়।
বনহুর আদাব জানালো।
অরুণ কুমার বনহুরের আদাব গ্রহণ না করেই বললো-মিঃ চৌধুরী, আপনাকে সকাল বেলা বিরক্ত করলাম, করতে বাধ্য হলাম।
হেসে আসন গ্রহণ করলো বনহুর। বললো-হঠাৎ কি মনে করে এলেন। মিঃ সেন?
অরুণ কুমার গম্ভীর মুখে বসে ছিলো, গম্ভীর কণ্ঠেই বললো–একটা কথা আছে আপনার সঙ্গে।
বলুন? প্রশ্নভরা দৃষ্টি মেলে তাকালো বনহুর অরুণ কুমারের মুখের দিকে।
অরুণ কুমার কক্ষে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বললো-মিঃ চৌধুরী, আপনি নিশ্চয়ই জ্ঞানী, বুদ্ধিমান…..
বনহুর বললো-ভূমিকার দরকার নেই, বলুন?
বনহুরের কথায় অরুণ কুমারের মুখমণ্ডল মুহূর্তে রাঙা হয়ে পরক্ষণেই স্বাভাবিক হলো। ভ্রূকুঞ্চিত করে বললো সে-আপনি জানেন আমি. মিস রায়কে ভালবাসি।
বনহুরের মুখখাভাবে কিছুমাত্র পরিবর্তন পরিলক্ষিত হলো না। স্বচ্ছকণ্ঠে বলে সে-এ কথা শোনাবার জন্যই কি আপনি…..
হাঁ মিঃ চৌধুরী, শুধু এ কথা শোনাবার জন্যই আমি এই সাত সকালে ছুটে এসেছি। জানি আপনি সারাদিন ব্যস্ত থাকেন, অন্য সময় আপনাকে পাওয়া মুশকিল, তাই….।
তাই আপনি অনুগ্রহ করে এসেছেন মিস রায়কে ভালোবাসেন কথাটা জানাতে!
হাঁ তাই। অরুণ কুমারের মুখমণ্ডল অমাবস্যার রাতের মত অন্ধকার হয়ে
কাজেই আমি যেন আপনার পথে বাধার সৃষ্টি না করি, তাই না? বললো বনহুর।
এমন সময় ইয়াসিন ট্রে হাতে কক্ষে প্রবেশ করলো।
ট্রে টেবিলে নামিয়ে রাখতেই বনহুর এক কাপ চা অরুণ কুমারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো-নিন।
চা আমি খাই না। বললো অরুণ কুমার।
বনহুর একটা কাপ হাতে উঠিয়ে নিতে নিতে মুখ নীচু করে একটু হাসলো। তারপর কাপে চুমুক দিয়ে বললো-ভয় নেই, আপনার চলার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াবো না।
ধন্যবাদ। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো অরুণ কুমার।
বনহুর কিছু বলবার পূর্বেই কক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে গেলো সে। পরক্ষণেই বাইরে মোটর স্টার্টের শব্দ হলো।
বনহুর আপন মনেই হেসে উঠলো-হাঃ হাঃ হাঃ, হাঃ হাঃ হাঃ…
ইয়াসিন সে হাসির শব্দে ছুটে এলো।
নূরীও ঘরে বসে সে হাসির শব্দ শুনতে পেলো, চমকে উঠলো সে।
বনহুরের হাসি শেষ হতেই কক্ষে প্রবেশ করলেন প্রযোজক আরফান উল্লাহ-গুড মনিং মিঃ চৌধুরী!
বনহুরের হাসির রেশ তখনও ড্রইংরুমের মধ্যে ছড়িয়ে আছে। আরফান উল্লাহকে দেখে জবাব দিলো-গুড মর্নিং, আসুন!
আরফান উল্লাহ তাঁর বিরাট বপু নিয়ে এগিয়ে এসে একটা সোফায় বালির বস্তার মত ধপ করে বসে পড়লেন।
বনহুর উঠে দাঁড়িয়েছিলো, পুনরায় আসন গ্রহণ করলো। একটা প্রশ্ন উঁকি দিলো বনহুরের মনে। রাতেই দেখা হয়েছে তার সঙ্গে, তাছাড়া স্বয়ং আরফান উল্লাহই তাকে পৌঁছে দিয়ে গেছেন অথচ ভোরেই আবার এমন কি প্রয়োজন যার জন্য তিনি ছুটে এসেছেন তার কাছে।
বনহুর লোকমুখে শুনেছে, নিজেও গোপন অনুসন্ধান নিয়ে জেনেছেআরফান উল্লাহ শুধু এক চলচ্চিত্র ব্যবসা নিয়েই থাকেন না, তার আরও বিভিন্ন কারবার আছে। শুধু ছবিই তাঁকে লাখ লাখ টাকা এনে দেয় না, এমন কিছু গোপনীয় ব্যবসা তিনি করেন, যা তাঁকে অগাধ ঐশ্বর্যের অধিকারী করেছে।
আরফান উল্লাহ আসন গ্রহণ করে বললেন-আমার কন্যা মিস্ আতিয়া আজ আপনার এখানে আসবে।
কথাটা শুনে মনে মনে বিরক্তি বোধ করলেও মুখোভাব প্রসন্ন রেখে বললো বনহুর-আমার পরম সৌভাগ্য মিঃ উল্লাহ। কিন্তু উনি কষ্ট করে না এসে, বরং আমিই….।
ভেবে দেখলাম তা হয় না, আপনি আমাদের সম্মানিত অতিথি, কাজেই আতিয়া নিজেই আসবে আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে।
ধন্যবাদ। কিন্তু কবে আসবেন উনি?
সে কথা জানাবার জন্যই আমি এলাম মিঃ চৌধুরী, আপনি তাকে আসার অনুমতি দিলেই সে…..
ছিঃ ছিঃ, কেন আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন মিঃ উল্লাহ! তার বাড়ি, তিনি যখন খুশি আসতে পারেন।
থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ। শুনে খুশি হলাম মিঃ চৌধুরী।
বনহুর ইয়াসিনকে ডাকলো-ইয়াসিন?
ইয়াসিন এসে দাঁড়ালো-জ্বী সাহেব। সঙ্গে সঙ্গে আরফান উল্লাহর উপর নজর পড়তেই বিবর্ণ হলো ইয়াসিনের মুখমণ্ডল। লম্বা সালাম ঠকে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ালো।
বনহুর বললো-ইয়াসিন, চা-নাস্তা নিয়ে এসো।
আরফান উল্লাহ ব্যস্তকণ্ঠে বলে উঠলেন-মাফ করবেন, এইমাত্র নাস্তা করে এসেছি।
শুধু এক কাপ চা।
তা-ও না।
আচ্ছা, তাহলে উনি…মানে আপনার কন্যা মিস আতিয়াকে কবে কখন নিয়ে আসছেন? আমার এবার একনাগাড়ে কদিন সুটিং আছে কিনা!
এ কদিন কি জ্যোছনা রায়ের সঙ্গেই আপনার কাজ হবে?
সে কথা এখনও মিঃ নাহার আমাকে সঠিক জানাননি।
আচ্ছা। উঠে দাঁড়িয়ে অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন-গুড বাই।
বনহুর একটা সিগারেটে অগ্নিংসযোগ করে অন্তঃপুরের দিকে পা বাড়ালো। ভোর হতে না হতে পর পর দুজন ব্যক্তির আগমন-একজন তার পথ হতে সড়ে দাঁড়াবার জন্য অনুরোধ, অপরজন তাকে কন্যার সঙ্গে পরিচিত করার জন্য আগ্রহশিল।
আজ বনহুরের কোন সুটিং ছিলো না, গোটা দিনটা তার হাতে। বই পড়ে, শুয়ে থেকেও সময় কাটতে চায় না তার। কয়েকবার নূরীর কক্ষে উঁকি দিয়ে দেখেছে বনহুর-নূরী আপন মনে বসে আছে, কখনও বা রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে শূন্য আকাশের দিকে। এত কাছে নূরী, তবু যেন কত দূরে। বনহুরের বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস।
বিকেলে বনহুর বাইরে বের হবার জন্য তৈরি হচ্ছে। কাপড় পরা তার হয়ে গেছে, চিরুণী দিয়ে মাথা আঁচড়াচ্ছিল, এমন সময় নূরী এসে দাঁড়ায় তার পাশে।
হঠাৎ পাশে শব্দ শুনে ফিরে তাকায় বনহুর, বিস্ময়ে বলে ওঠে-তুমি!
নূরী আজ এই প্রথম স্বেচ্ছায় এসেছে বনহুরের পাশে।
বনহুর বললো-কিছু বলবে?
নূরীর ঠোঁট দুখানা কেঁপে উঠলো, কিছু বলতে চায় সে।
বনহুর ঝুঁকে পড়লো নূরীর মুখের কাছে-বলো, বলো নূরী? নূরী বনহুরের চোখের দিকে তাকিয়ে ছুটে পালাতে যাচ্ছিল, বনহুর খপ করে ধরে ফেললো ওর হাতখানা-নূরী যেও না।
ছেড়ে দিন, ছেড়ে দিন আমাকে। নূরী বনহুরের হাতের মুঠা থেকে নিজের হাত দুখানা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে লাগলো।
কিন্তু বনহুরের হাতের মুঠা থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে পারলো।
বনহুর বললো-কি বলতে চাও নূরী, বলো?
নূরী ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো, বললো-আমাকে ছেড়ে দিন।
নিশ্চয়ই ছেড়ে দেবো, বলল কি বলতে এসেছিলে তুমি?
আপনি চলে গেলে একা একা আমার বড্ড খারাপ লাগে।
নুরী!
বনহুর খুশির আবেগে নুরীকে টেনে নিলো কাছে। এই প্রথম নূরীর মুখে স্বাভাবিক স্বর শুনতে পেলো। আবেগভরা কণ্ঠে বললো বনহুর নূরী, নূরী…আমার নূরী। বনহুর নূরীকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে ফেললো।
নূরী বনহুরের বাহুবন্ধনে ঘেমে উঠলো।
পালাবার জন্য অস্থির হয়ে পড়লো সে।
ঠিক সেই মুহূর্তে বাইরে মোটরের হর্ন বেজে উঠলো। পরক্ষণেই ইয়াসিনের কণ্ঠস্বর-সাহেব, সাহেব, মালিক আইসেছেন-মালিকের মাইয়াও আইসেছেন।
বনহুর নূরীকে মুক্ত করে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
নূরী ছাড়া পেয়ে দ্রুত পালিয়ে গেলো সেখান থেকে। বনহুর বেরিয়ে এলো কক্ষ থেকে।
ইয়াসিন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো, বললো-বসবার ঘরে তারা বইছেন।
বনহুর এগিয়ে গেলো ড্রইংরুমের দিকে।
কক্ষে প্রবেশ করার পূর্বে টাইটা ঠিক করে নিলো বনহুর।
আরফান উল্লাহ এসেছেন তার কন্যা আতিয়াকে নিয়ে পরিচয় করাতে। কিন্তু আজ কতদিন হলো এসেছে সে এই বাড়িতে-কই, আতিয়া তো একদিনও এলো না, অথচ আরফান উল্লাহ কন্যার গল্পে পঞ্চমুখ-সে নাকি তার সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য অত্যন্ত আগ্রহশিল!
বনহুরও কম আগ্রহান্বিত নয় আতিয়ার সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য।
যার এত আছে, বাড়ি-গাড়ি, নিজস্ব স্টুডিও, ইণ্ডাস্ট্রি আরও কত কি, না জানি সে কেমন!
যে বাড়িটাতে বনহুর এখনও বসবাস করছে, সে বাড়িও তো তার। বাড়িটার সৌন্দর্য বনহুরকে মুগ্ধ করেছিলো। বনহুর কল্পনায় বাড়ির অধিনায়িকার যে ছবি মনের পর্দায় এঁকে রেখেছিলো তা মনোমুগ্ধকর এক নারীর।
এ বাড়িতে আসবার পর হতে বনহুরের ইচ্ছা বাড়ির অধিনায়িকার সঙ্গে পরিচিত হওয়া, কিন্তু আরফান উল্লাহ কেন যে তার কন্যাকে এতদিনেও আনলেন না এবং তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন না বুঝতে পারে না কস্তু।
আজ বনহুর অত্যন্ত আগ্রহশিল হয়ে প্রবেশ করলো ড্রইংরুমে।
রুমে প্রবেশ করেই মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো বনহুর। সম্মুখস্থ সোফায় বসে আছেন আরফান উল্লাহ, পাশে একটা তরুণী-পিপে বা তেলের জালা বললেও ভুল হবে না! তরুণীর গায়ের রঙ আবলুসের মত কালো। মাথায় ঝাঁকড়া চুল, মেমদের মত বক করে ছাটা।
বহুর প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেও পরক্ষণে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বললো-হ্যালো মিঃ উল্লাহ?
আরফান উল্লাহ হেসে বললেন-মিঃ চৌধুরী, এ আমার কন্যা মিস আতিয়া। আর উনি মিঃ চৌধুরী।
বনহু হাত তুলে বললো-আদাব! আতিয়া হাসলো একটু, যেন মেঘের কোলে বিদ্যুৎ চমকালো।
বনহুর জীবনে বহু নারীর সঙ্গে পরিচিত হয়েছে, কিন্তু মিস আতিয়ার মত নারী সে কোনোদিন দেখেছে কিনা সন্দেহ।
আতিয়াই কথা বললো প্রথম-বসুন। বন থ মেরে গিয়েছিলো, বসবে না দাঁড়িয়ে থাকবে, না আর একবার অন্তপুরে প্রবেশ করে নিজেকে স্বচ্ছ করে আসবে, ভেবে পাচ্ছিলো না।
এমন সময় শুনলো আতিয়ার চিকন বাশির মত সুর-বসুন।
বনহুরের এই বুঝি প্রথম কোনো নারীর সামনে হকচকিয়ে যাওয়া। আসন গ্রহণ করলো বনহুর। কি বলবে বা কি বলে কথা শুরু করবে ভেবে পেলো না। নিজের অজ্ঞাতেই বার কয়েক দৃষ্টি তার চলে গেলো মিস আতিয়ার মুখের দিকে।
সর্বনাশ! এমন মেয়েও জন্মে পৃথিবীতে। বনহুর হাঁপিয়ে উঠছিলো।
আরফান উল্লাহই কথা বললেন-মিঃ চৌধুরী, আপনি বুঝি বাইরে বেরুচ্ছিলেন?
হাঁ, মানে একটু কাজ আছেবাইরে কিনা…বনহুর অবশ্য সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা বলে মিঃ আরফান উল্লাহ ও তাঁর কন্যা মিস আতিয়ার হাত থেকে রেহাই পেতে চেষ্টা করলো।
কিন্তু হলো বিপরীত, আতিয়া আনন্দধ্বনি করে উঠলো-কোথায় যাবেন, চলুন না আমি পৌঁছে দিয়ে আসি।
হাঁ ঠিক বলেছো মা, আর তার যখন বাইরে কাজ আছে তখন তাঁকে আটকে রাখা ঠিক হয় না। তুমি যাও তাঁকে তার গন্তব্যস্থানে পৌঁছে দিয়ে এসোগে। আর একদিন এসে বসা যাবে।
বনহুর মনে মনে প্রমাদ গুণলো, সবে পরিচয় তাতেই এত-সর্বনাশ হয়েছে এবার! এতদিন পরিচয় না ঘটে ভালই ছিলো।
বনহুর বললো-একটু চা-নাস্তা……
আরফান উল্লাহ বললেন-তা আতিয়া তো কোনোদিন আসেনি। বুঝতেই পারছি, আপনি ছাড়বার পাত্র নন, বেশ, বলুন আনতে।
বনহুর ডাকলো-ইয়াসিন?
নিকটে কোথাও ছিলো ইয়াসিন। ছুটে এসে হাত জুড়ে দাঁড়ালো-সাহেব, আমাকে ডাকতেছেন।
হাঁ, চা-নাস্তা নিয়ে এসো।
ইয়াসিন চলে যাচ্ছিলো, আরফান উল্লাহ বললেন-দেখেশুনে ধীরে সুস্থে চা-নাস্তা তৈরি করে আনবি।
ইয়াসিন মাথা দুলিয়ে বললো-জ্বী আচ্ছা। চলে গেলো সে। আরফান উল্লাহ বললেন-জানেন, আতিয়া যেমন তেমন জিনিস খেতে পারে না। ছিমছাম আর পরিস্কার জিনিস ওর পছন্দ।
হাঁ, তা তাঁকে দেখেই আমি বুঝতে পেরেছি মিঃ উল্লাহ।
কি আর বলবো মিঃ চৌধুরী, এই একটি মাত্র মেয়েই আমার সম্বল-ওর জন্যই সবকিছু।
তা আমি জানি। বললো বনহুর।
জানেন আপনি? হাঁ, আর জানবেনই না বা কেন? সবাই জানে আতিয়া ছাড়া আমার সবকিছু অন্ধকার।
এক মেয়ে যখন তখন তো হবেই।
দেখুন মিঃ চৌধুরী, আতিয়ার সুখের জন্য কি না করেছি।
আমি সব অবগত আছি মিঃ উল্লাহ।
বনহুর কথা যতই সংক্ষিপ্ত করে আনতে চায় ততই আরফান উল্লাহ চান কথা বাড়িয়ে লম্বা করে আনতে ছোটবেলায় মা মরা মেয়ে, কত কষ্ট করেই না মানুষ করেছি! আতিয়া আমার ছেলে-মেয়ে উভয়ই। মেয়েটা আমার লক্ষী-যেমন আদর্শবতী, তেমনি জ্ঞানবতী, রুচিশিলা, দেখছেন না এ বাড়িটা আমার আতিয়ার রুচিমতেই তৈরি করা হয়েছে।
পিতার প্রশংসায় আতিয়া খুশিতে ডগমগ। মুখখাভাবে একটা অহেতুক লজ্জাবোধ ফুটে ওঠে। মাঝে মাঝে শাড়ির আঁচলখানা দাঁতে কামড়ে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করছিলো, আসলে সত্যিই ছিড়বার জন্য নয়-লজ্জায়।
বনহুর চোখ তুলে তাকাতেই আতিয়ার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো, ক্ষুদে পিটপিটে আঁখি দুটিতে যেন ঝরে পড়ছে অফুরন্ত প্রেম নিবেদন।
অসহ্য, অসহ্য-বনহুরের দমন বিষিয়ে উঠলো কিছুক্ষণের মধ্যে।
ইয়াসিন আজ যেন একেবারে কুঁড়ে বনে গেছে, চা-নাস্তা আনতে এত বিলম্ব করছে কেন। বনহুর উঠে দাঁড়ালো-দেখি ইয়াসিন এমন দেরী করছে কেন?
আরফান উল্লাহ বলে ওঠেন-আসতে দিন, এত তাড়া কিসের?
আমার একটু শিঘ্র যেতে হবে কি না……
তা আতিয়া আপনাকে পৌঁছে দেবে, মা আতিয়া নিজেই ড্রাইভ জানে..
না, না, তাকে কষ্ট করতে হবে না, আমার ড্রাইভার আছে।
আতিয়া হেসে বললো-এতে আমার কোন কষ্ট হবে না মিঃ চৌধুরী।
হাঁ, বরং আতিয়া এসব কাজে আনন্দ পায়।
বনহুর স্বাভাবিক মানুষ নয়, তার কঠিন মন, কঠিন হৃদয়, অল্পে সে কোনোদিন কাবু হয় না, আজ বনহুর নাচার হয়ে পড়লো যেন। বাপ আর মেয়ের নাগপাশ থেকে মুক্তি পাবার উপায় খুঁজতে লাগলো।
এমন সময় ইয়াসিন ট্রে হাতে কক্ষে প্রবেশ করলো।
আরফান উল্লাহ বললেন-নাও মা, আরম্ভ করো-উনি আবার বাইরে যাবেন….
হাঁ, আরম্ভ করুন মিস আতিয়া।
আপনি নেবেন না?
এইমাত্র ওসব সেরে নিয়েছি।
আরফান উল্লাহ ততক্ষণে খেতে শুরু করেছেন।
আতিয়াও খেতে আরম্ভ করলো।
বনহুর অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো পিতা ও কন্যার মুখের দিকে।
খেতে খেতে বললেন আরফান উল্লাহ-চমক্কার নাস্তা তৈরি করেছিস ইয়াসিন।
ইয়াসিন হাত কচলাতে লাগলো।
বনহুর ততক্ষণে সিগারেটের পর সিগারেট নিঃশেষ করে চললো।
আরফান উল্লাহ এবার খেতে খেতে বনহুরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলেন-জানো মা আতিয়া, মিঃ চৌধুরী শুধু দেখতেই অপূর্ব নন, তার অভিনয়ও অদ্ভুত।
কই, একদিনও তুমি আমাকে সুটিং দেখতে আনলে না?
এবার তো মিঃ চৌধুরীর সঙ্গে পরিচিত হলে, যখন খুশি এসো-উনাকে সঙ্গে করে স্টুডিওতে গিয়ে কত সুটিং দেখবে দেখো..কি বলেন মিঃ চৌধুরী, সত্যি কি না?
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই-কিন্তু আমি তো, মানে সব সময় বাড়ি থেকে সুটিংয়ে যাই না, কখনো বাইরে থেকেই চলে যাই..
বনহুর যতই যা বলুক আরফান উল্লাহ ও আতিয়ার কবল থেকে রক্ষা পাওয়া মুশকিল। •
শেষ পর্যন্ত আতিয়ার গাড়িতে বনহুরকে বেরুতে হলো। কিন্তু যাবে কোথায়? সত্যি বাইরে তো আজ তার কোনো কাজ নেই। বনহুর বেরুচ্ছিলো হয় ক্লাব বা কোনো লেকের ধারে কিংবা পার্কে যাবার জন্য।
আতিয়া স্বয়ং ড্রাইভ করছে। পাশের আসনে বনহুর।
গাড়ি জন মুখর রাজপথ বেয়ে চলেছে।
আতিয়া বললো-কোথায় যাবেন বললেন না যে?
যে কাজ ছিলো এখন গিয়ে আর হবে না, কোথায় যাই ভাবছি।
বড় দুঃখের বিষয় মিঃ চৌধুরী, আপনার কাজটা আমাদের জন্যই হলো না।
আতিয়ার থ্যাবড়া মুখে চিকন সুর বড় বেখাপ্পা লাগছিলো। বনহুর ভেতরে ভেতরে রাগলেও মুখে হাসি টেনে বললো-না না, তেমন জরুরী। কাজ নয়, তা এখন কোথায় যাওয়া যায় বলুন তো? বাসায় ফিরে যাওয়া যাক, কেমন?
আতিয়া বলে উঠলো-মিঃ চৌধুরী, আপনি এরই মধ্যে ফিরতে চান? কিন্তু কেন?
ভাল লাগছে না।
প্লিজ মিঃ চৌধুরী, চলুন পার্কে যাই।
বনহুর ভীষণ অস্বস্তি বোধ করছিলো, কিন্তু মুখোভাবে তা প্রকাশ না করে ভ্রু কুঁচকে বললো-পার্কে? কিংবা লেকের ধারে?
না!
চলুন না, প্লিজ…
বনহুর গাড়ির মধ্যে যেন অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো, বললো সেচলুন যেখানে আপনার মন চায়।
থ্যাঙ্ক ইউ মিঃ চৌধুরী, থ্যাঙ্ক ইউ, নির্জন লেকের ধারেই ভাল লাগবে এখন।
বনহুর কোনো কথা বলে না, নিশ্চুপ বসে থাকে স্থবিরের মত। লেকের ধারে গাড়ি রেখে নেমে পড়লো আতিয়া-আসুন মিঃ চৌধুরী।
আতিয়া বনহুরের হাতখানা মুঠায় চেপে ধরে বললো-চলুন।
বনহুর সুবোধ বালকের মত গাড়ি থেকে নেমে পড়লো।
আতিয়ার হাতের মুঠায় বনহুরের বলিষ্ঠ হাতখানা ঘেমে উঠলো যেন, একটা মাংসপিণ্ডের মধ্যে তার হাতখানা যেন বসে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
লেকের ধারে এসে দাঁড়ালো আতিয়া-পাশে বনহুর। বনহুরের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো আতিয়া-কেমন লাগছে আপনার?
আতিয়ার প্রশ্নে বনহুরের সারা শরীর জ্বালা করে উঠলো, দাঁতে দাঁত পিষলো, কিন্তু মুখে হাসি টেনে বললো-স্বপ্নময়, অপূর্ব।
সত্যি মিঃ চৌধুরী, এটা আপনার মনের কথা?
মনের নয়, অন্তরের।
বনহুরের কথায় আতিয়ার চোখ দুটো চক চক করে উঠলো। প্রেমে ঢল ঢল হয়ে পড়লো আতিয়া। বনহুরের হাত ধরে বললো-ঠাট্টা করছেন না তো?..
ছিঃ ঠাট্টা করবো আপনার সঙ্গে, কি যে বলেন!
দেখুন মিঃ চৌধুরী, সবাই আমার উপরের চেহারাটা দেখে ঘৃণায় নাসিকা কুঞ্চিত করে-কেউ আমার মনের সন্ধান জানে না বা নেয় না। আসুন ওদিকে গিয়ে বসি…..বললো আতিয়া।
বনহুর স্বপ্নগ্রস্তের মত অনুসরণ করলো তাকে। লেকের ধারে একটা নিজন স্থান বেছে নিয়ে বসলো আতিয়া। বনহুরকে হাত ধরে বসিয়ে দেয় নিজের পাশে।
আবেগভরা কণ্ঠে বললো আতিয়া–মিঃ চৌধুরী, ওরা জানে না আমারও হৃদয় আছে, প্রেম-ভালবাসা, স্নেহ-মায়া-মমতা সব আছে…তবু..আমাকে কেউ ভালবাসতে পারে না। কথা বলতে বলতে কণ্ঠ ধরে আসে আতিয়ার!
বনহুরের মনে একটা আঘাত করে। চোখ তুলে তাকায় বনহুর আতিয়ার মুখের দিকে।
আতিয়ার মুখটা বেদনায় আরও বিকৃত দেখাচ্ছে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে ওর ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু।
আতিয়া রুমাল দিয়ে নিজের চোখের পানি মুছে ফেললো, তারপর বললো আবার অনেকেই আমার ঐশ্বর্যের লোভে আমাকে বিয়ে করতে এসেছে কিন্তু আমাকে দেখেই তারা পালিয়ে গেছে। আমি কি ক্ষতি করেছি তাদের, কেন তারা এভাবে চলে যায়…দুহাতে মুখ ঢেকে আবার উচ্ছসিতভাবে কেঁদে ওঠে আতিয়া।
বনহুরের বুকের মধ্যে তখন প্রচণ্ড ঝড় বইছে।
বৈচিত্রময় জীবন বনহুরের। এ বয়সে সে অনেক অবস্থায় পড়েছে। কিন্তু আজকের মত অবস্থা বুঝি তার জীবনে কোনোদিন আসেনি! কি বলবে, কি কি বলে সান্ত্বনা দেবে বনহুর ওকে, ভেবে পায় না।
কান্নার আবেগে আতিয়ার দেহটা কেঁপে কেঁপে উঠছে।
বনহুর কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো আতিয়ার দিকে। একটু প্রেমভালবাসা স্নেহ বই তো নয়–ক্ষতি কি, জ্যোছনা রায়ের সঙ্গে তাকে ছবির জন্য অভিনয় করতে হচ্ছে, আর একটি প্রাণের জন্য সে পারবে না একটু স্বার্থ ত্যাগ করতে? ছবির জন্য তাকে অভিনয় করতে হচ্ছে আর এখানে করতে হবে একটা অবলা নারীকে সান্ত্বনা দেবার জন্য…বনহুর মনস্থির করে নেয়।
বনহুর হাত রাখলো আতিয়ার পিঠে-কাঁদবেন না।
মুহূর্তে আতিয়ার কান্না থেমে গেলো, একটা আনন্দময় মধুর হাসি ফুটে উঠলো তার চোখেমুখে, গদগদ কণ্ঠে বললো-মিঃ চৌধুরী, আপনি কত ভাল!
বনহুর এবার রুমাল দিয়ে আতিয়ার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো-মিস আতিয়া, আপনার মনের ব্যথা কেউ না বুঝলেও আমি বুঝতে পেরেছি।
আতিয়া বনহুরের হাতখানা নিবিড়ভাবে টেনে নেয়, গালে-ঠোঁটে ঠেকিয়ে আবেগভরা কণ্ঠে বলে-মিঃ চৌধুরী।
বনহুর নিজের হাতখানা আতিয়ার হাতের মধ্যে ছেড়ে দেয়, ইচ্ছে করেই টেনে নেয় না সে।
দস্যু হলেও বনহুরের হৃদয়ে ছিলো অপরিসীম দয়া। লক্ষ লক্ষ টাকা বনহুর ডাকাতি করে, আবার তেমনি বিলিয়ে দেয় দীন-দুঃখীদের মধ্যে অকাতরে। নরপিশাচ শয়তানদের যেমন সে শত্ৰু, তেমনি অসহায় বিপদগ্রস্তদের সহায়ও। এ দুনিয়ায় এমন কোনো কাজ নেই যা সে পারে না বা করেনি। শুধু একটু ভালবাসা কি আতিয়াকে দিতে পারবে না সে।
আতিয়া এখন অনেকখানি শান্ত স্থির হয়ে এসেছে।
বনহুর বললো এবার চলুন ফেরা যাক।
আতিয়া বললো-আর একটু বসবেন না?
আজ আর নয়।
উঠে দাঁড়ালো বনহুর।
এবার বনহুর স্বয়ং ড্রাইভ করে চললো।
আতিয়া বসে রইলো বনহুরের পাশে ঘনিষ্ঠভাবে।
বনহুরের দৃষ্টি গাড়ির সম্মুখভাগে, আতিয়া তাকিয়ে আছে ওর মুখের দিকে।
০২.
বনহুরের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে জ্যোছনা রায়। জ্যোছনা রায়ের শরীরে আজও পূর্ব দিনের ড্রেস, সেই নববধূর পরিচ্ছদ। ললাটে চন্দনের টিপ, খোপায়, গলায়, হাতে ফুলের মালা। আজ ঘোমটায় মুখ ঢাকা নয় জ্যোছনা রায়ের। ঘোমটা আজ খসে পড়ে আছে কাঁধের ওপর।
বনহুরের শরীরেও বিবাহের ড্রেস।
গলায় ফুলের মালা, চোখে সুরমার রেখা, মুখে মিষ্টি হাসির ছোঁয়াচ।
অদূরে ক্যামেরায় চোখ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন অনন্ত বাবু। সার্চ লাইটগুলো তৈরি রয়েছে পরিচালকের আদেশের অপেক্ষায়।
মাথার উপরে ঝুলছে শব্দ যন্ত্র।
সহকারী পরিচালকদ্বয় সেটের জিনিসগুলো ঠিক করে দিচ্ছিলো। মেহগনি খাটের উপর মালাগুলো লম্বা করে ঝুলছে। সেগুলো আর একটু নেড়েচেড়ে ঠিক জায়গায় সরিয়ে দিয়ে সরে দাঁড়ালেন পরিচালক নাহার চৌধুরী।
স্ক্রিপ্ট খুলে আর একবার নায়ক-নায়িকাকে বুঝিয়ে দিলেন তাদের ভুমিকা।
এবার নাহার চৌধুরী দ্রুত সরে এলেন ক্যামেরার পাশে, অনন্ত বাবুর পাশ কেটে নিজে একবার দেখলেন তাকিয়ে। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে বললেন-রেডি! লাইট!
সঙ্গে সঙ্গে অনন্ত বাবু ক্যামেরায় চোখ রাখলেন।
পুনরায় পরিচালকের উচ্চকণ্ঠ-ক্যামেরা, সাউণ্ড…
বনহুর এবার জ্যোছনা রায়ের মুখটা তুলে ধরলো-রত্না!
লজ্জাভরা দৃষ্টি তুলে তাকায় রত্নার ভূমিকায় জ্যোছনা রায় বনহুরের মুখে-বলো!
আমি মুসলমান, আর, তুমি ব্রাহ্মণ-কন্যা-এ বিয়েতে তুমি কি সুখী হবে রত্না? বললো মাসুদের ভূমিকায় বনহুর।
তোমাকে স্পর্শ করে আমি শপথ করছি, আমি…
জ্যোছনা রায়ের কথা শেষ হয় না, একটা সুতীক্ষ্ণধার ছোরা এসে গেঁথে যায় জ্যোছনা রায়ের কাছে…..।
পরিচালক নাহার চৌধুরী চীৎকার করে ওঠেন-কাট।
সঙ্গে সঙ্গে সার্চ লাইটের আলো নিভে যায়।
ক্যামেরা থেকে সরে দাঁড়ান অনন্ত বাবু।
পরিচালক আনন্দধ্বনি করে ওঠেন-গুড!
পরবর্তী শ্যুটের জন্য প্রস্তুত হন নাহার চৌধুরী।
বনহুর উঠে দাঁড়ায়, জ্যোছনা রায় বনহুরের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসে-সত্যি বড় নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম।
বনহুর জ্যোছনার কথায় বলে-বেশ করেছেন কিন্তু।
নাহার চৌধুরী এগিয়ে আসেন-আপনারা উভয়েই চমৎকার অভিনয় করেছেন।
ঠিক সেই মুহূর্তে বনহুরের দৃষ্টি চলে যায় অদূরে ক্যামেরার ওপাশে শার্শীটার দিকে। কক্ষের উজ্জ্বল আলোতে দেখা যায়-দুটি চোখ শার্শীর ফাঁকে জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠলো। পরক্ষণেই সরে গেলো চোখ দুটো।
বনহুর ওদিকে শার্শীটার দিকে তাকিয়ে ছিলো।
জ্যোছনা রায় তাকালো সেইদিকে-কি দেখছেন?
বনহুর স্বাভাবিক হয়-কিছু না।
জ্যোছনা রায়ের সঙ্গে বনহুরের আরো কয়েকটা শট নিলেন নাহার চৌধুরী। এবার ছুটি হলো জ্যোছনা রায়ের। নাহার চৌধুরী বললেন-মিস রায়, আপনি যেতে পারেন। আমাদের স্টুডিওর গাড়ি আপনাকে পৌঁছে দেবে।
হঠাৎ কেন যেন বনহুরের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো মিস রায়, আপনি আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, এই শটটার পর আমি আপনাকে পৌঁছে দেবো। কারণ, আজ আর আমার কোনো কাজ নেই।
ধন্যবাদ মিঃ চৌধুরী। জ্যোছনা রায়ের কণ্ঠে একরাশ আনন্দ।
বনহুরের কাজ শেষ হতে বেশি বিলম্ব হলো না।
বনহুর আর জ্যোছনা রায় গাড়িতে এসে বললো।
এমন সময় হঠৎ বনহুর দেখতে পেলো-স্টুডিওর ছাদে একটা থামের আড়ালে সরে গেলো অরুণ কুমার সেন।
বনহুর গাড়িতে স্টার্ট দিলো কিন্তু মনটা তার কেমন যেন আনমনা হয়ে গেলো। মনে পড়লো কিছু দিন আগের এক সকালের কথা। অরুণ কুমার এসেছিলো বনহুরের কাছে। কি উদ্দেশ্যে এসেছে বনহুর তা জানতো। তাই সে বলেছিলো; ভয় নেই অরুণ বাবু, আমি আপনার পথে কাঁটা হবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
বনহুর সে কথাই ভাবছিলো।
জ্যোছনা রায় বনহুরকে গম্ভীর মুখে গাড়ি চালাতে দেখে হেসে বললো-হঠাৎ আপনাকে বড় ভাবাপন্ন লাগছে মিঃ চৌধুরী?
জ্যোছনা রায়ের কথায় বনহুরের সম্বিৎ ফিরে আসে।
বললো বনহুর-মিস রায়, একটা কথা আপনাকে বলবো?
বলুন?
আপনি নিশ্চয়ই জানেন, অরুণ কুমার সেন আপনাকে গভীরভাবে ভালবাসেন!
মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো জ্যোছনা রায়ের মুখমণ্ডল। কিন্তু পরমুহূর্তেই মুখোভাব স্বাভাবিক করে বললো সে-এ কথা তিনি আমাকে অনেকবার বলেছেন। কিন্তু আমি তাকে ভালবাসতে পারিনি। মিঃ চৌধুরী, তিনি জানেন না, মনের ওপর কারও জোর চলে না।
বনহুর স্তব্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছিলো জ্যোছনা রায়ের কথাগুলো।
বলে চলেছে জ্যোছনা রায়-অরুণ বাবু এমনও বলেছেন, তিনি আমার জন্য সব করতে পারেন, এমন কি নিজের জীবন পর্যন্ত দিতেও নাকি কুণ্ঠিত নন।
এত জেনেও আপনি তাকে বিমুখ করে ফিরিয়ে দিতে পেরেছেন মিস রায়?
আপনিও অবুঝের মতো কথা বললেন মিঃ চৌধুরী, কারণ অরুণ বাবুকে আমি শত চেষ্টা করেও ভালবাসতে পারিনি, পারবোও না।
কিন্তু ওর মনের দিকটা তো আপনার ভেবে দেখা উচিত।
তা হয় না মিঃ চৌধুরী।
কেন হয় না?
তা আপনাকে বোঝাতে পারবো না। এই যে আমার বাড়ি এসে গেছে। আসুন না আজ আমাদের ওখানে?
আজ নয়, আর একদিন আসবো।
অমন অনেকদিন বলেছেন, এসেছেন কোনোদিন। আসুন মিঃ চৌধুরী, এখানে আমার মা আর আমি থাকি। আপনার সঙ্গে পরিচিত হলে মা অনেক খুশি হবেন।
অগত্যা বনহুরকে নামতে হলো। জ্যোছনা রায়কে অনুসরণ করলো বনহুর। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। ওরা দুজন। জ্যোছনা রায় বললো-আসুন, বসবার ঘরে নয়, একেবারে মায়ের ঘরে।
সেকি উনি..
না না, উনি কিছু মনে করবেন না। আমার মা কিন্তু খুব ভাল-মা মা, দেখ কে এসেছেন!
প্রথমে কক্ষে প্রবেশ করলো জ্যোছনা রায়। বনহুর পেছনে। কক্ষে প্রবেশ করে সামনে তাকালো বনহুর, মধ্যবয়স্কা এক ন্দ্র মহিলা বৈদ্যুতিক ল্যাম্পের সামনে বসে বই পড়ছিলেন। জ্যোছনা রায়ের কণ্ঠস্বরে বইখানা বন্ধ করে সোজা হয়ে বসলেন। চোখে সোনার ফ্রেমে বাঁধানো পাওয়ার ওয়ালা চশমা। একটা চওড়া লালপেড়ে শাড়ি পরনে। কপালে সিঁদুরের টিপ, সিথিতেও সিদুরের রেখা। হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন মহিলা-জ্যোছনা।
হাঁ মা, দেখ কাকে আজ ধরে এনেছি।
বনহুরের দিকে তাকিয়ে বললেন ভদ্রমহিলা-তোদের স্টুডিওর লোক বুঝি?
জ্যোছনা রায় বললো-উনি কুন্তিবাঈ ছবির হিরো।
বসুন, আপনার বিপরীতেই বুঝি জ্যোছনা কাজ করছে?
ভদ্রমহিলা চশমাটি ঠিক করে নিয়ে বললেন আবার-জ্যোছনার মুখে আপনার অনেক প্রশংসা শুনেছি। সত্যি বাবা, আজ আপনাকে দেখে অনেক খুশি হলাম।
বনহুর বুঝতে পারলো-জ্যোছনা রায় তার সম্বন্ধে আগেই মায়ের কাছে অনেক কিছু বলেছে। বনহুর কোনো জবাব না দিয়ে চুপ রইলো।
কিন্তু বনহুর এভাবে বেশিক্ষণ বসে থাকার মত শান্ত লোক নয়। উসখুস করতে লাগলো তার মন। কিন্তু উঠি বললেন তো ওঠা হবে না। এসেছে যখন কিছু কথাবার্তা বলতে হবে। কাজেই বনহুর বললো-আপনি আমাকে তুমি বলবেন।
হ্যাঁ ঠিক বলেছো বাবা, আপনি বলতে আমারও কেমন বাধছিলো। কিন্তু কথা দাও, এখন থেকে আসবে তুমি?
হঠাৎ পরিচয় হতেই ভদ্রমহিলা একেবারে নিজের করে নিলেন যেন।
এবার জ্যোছনা রায় হেসে বললো-দেখলেন তো মিঃ চৌধুরী, বলেছিলাম না আমার মা খুব ভাল। এবার থেকে মায়ের অনুরোধ ফেলতে পারবেন না নিশ্চয়ই।
বনহুর বললেন-পরিচয় যখন হলো, সুযোগ পেলেই আসবো।
না না, তা হবে না, ওসব সুযোগ টুযোগ বুঝি না। দেখো বাবা, একা একা থাকি, সময় কাটতে চায় না-জ্যোছনার সঙ্গে এলে অনেক খুশি হবো।
জ্যোছনা রায় উঠে দাঁড়ালো, সেও মায়ের পাশে আসনে বসে পড়েছিলো, বললো-যাই, একটু জলযোগের ব্যবস্থা করিগে।
বহু বাধা দিয়ে বললো-মোটেই না। উঠি আজ?
উঠি বললেই কি ওঠা হয় বাবা? এসেছো যখন তখন একটু যা হয় মুখে দিয়ে তবে যেতে হবে।
জ্যোছনা রায় ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে কক্ষ থেকে!
জ্যোছনা রায় বেরিয়ে যাবার পর ভদ্রমহিলা সোফায় আরও জেঁকে বললেন, বললেন বনহুরকে-দেখো বাবা, জ্যোছনা আমার ঘরের লক্ষ্ণী। ও যতক্ষণ বাইরে থাকে, মনে আমি এতটুকু শান্তি পাই না। কিন্তু কি করবো, বাধ্য হয়েছি ওকে বাইরে পাঠাতে। তুমি হয়তো মনে করবে অভিনয় করানো আমাদের পেশা আসলে তা নয়, জ্যোছনার সখ-ও অভিনয় করবে।
বেশ তো, এটা মন্দ কি?
কিন্তু আমার ভাল লাগে না? শুধু ওর আর ওর বাবার ইচ্ছায়….
জ্যোছনা রায় এসে পড়ায় চুপ হলেন ভদ্রমহিলা।
বনহুরও কোনো কথা তুললো না এর পরে।
জলযোগের পর বনহুর বিদায় গ্রহণ করলো। জ্যোছনা রায়ের জননীর ব্যবহারে খুশি হলো বনহুর।
বিদায়কালে ভদ্রমহিলা বনহুরকে বারবার অনুরোধ জানালেন আবার আসতে।
বনহুর গাড়িতে চেপে বসলো, হঠাৎ পাশে হাতের কাছে একটা ভাজকরা কাগজ দেখতে পেলো সে।
বনহুর কাগজখানা পকেটে রেখে গাড়িতে স্টার্ট দিলো।
জ্যোছনা রায় বনহুরকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে এসেছিলো। বনহুর তার অলক্ষ্যেই কাগজখানা সরিয়ে ফেলেছিলো।
বাড়ি ফিরে সর্ব প্রথম বনহুর আলোর কাছে গিয়ে সেই ভাজকরা কাগজখানা মেলে ধরলো। মাত্র কয়েক লাইন লেখা
এত করে বলা সত্ত্বেও আপনি পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ালেন না। এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়ংঙ্কর। পুনরায় সাবধান করে দিচ্ছি।
.
হঠাৎ অদ্ভুতভাবে হেসে উঠলো বনহুর। হাসি থামিয়ে ফিরে তাকাতেই চমকে উঠলো সে, আতিয়া দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনে, মুখে বিকৃত হাসি। হাতে একটা বেতের তৈরি ভ্যানিটি ব্যাগ। মূল্যবান শাড়ি এবং অলঙ্কারে সজ্জিত।
বনহুর তাকাতেই বললো আতিয়া-হ্যালো মিঃ চৌধুরী।
বনহুর বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো-আপনি কখন এলেন।
কখন থেকে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি মিঃ চৌধুরী। কথা বলতে বলতে আতিয়া বনহুরের গা ঘেঁসে দাঁড়ালো।
বুঝতে পারলো বনহুর, আতিয়া এ বাড়িরই কোনো কক্ষে ছিলো এতক্ষণ।
বনহুর সংকুচিতভাবে একটু সরে দাঁড়ালো। নূরী যদি দেখে ফেলে কি যে মনে করবে!
আতিয়া বললো-আব্বা, আমাকে স্টুডিও থেকে ফোন করেছিলেন, আপনি নাকি বেশ কিছুক্ষণ হলো স্টুডিও থেকে বেরিয়েছেন।
মিঃ উল্লাহ স্টুডিওতে ছিলেন নাকি? কই, তার সঙ্গে তো আমার সাক্ষাৎ হয়নি? বনহুর অন্যমনস্কভাবে কি যেন ভাবতে লাগলো।
আতিয়া বললো-আপনার বোন এখানে আছেন-কই তার সঙ্গে তো আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন না?
চোখ তুললো বনহুর-বোন। হাঁ আছে, কিন্তু তার শরীরটা তেমন ভাল নয়, কাজেই…।
ও, উনি বুঝি অসুস্থ?
ঠিক অসুস্থ না, তবে মাথায় একটু-মানে—
মাথায় গণ্ডগোল আছে বুঝি আপনার বোনের?
হাঁ, একটা দুর্ঘটনায় তার মাথায় কিছুটা গণ্ডগোলের সৃষ্টি হয়েছে। চলুন ড্রইংরুমে গিয়ে বসি?
বনহুর এতক্ষণ আতিয়াকে এ ঘরে বসার জন্য অনুরোধ জানায়নি।
আতিয়া বললো-চলুন।
বনহুর যখন আতিয়ার সঙ্গে বেরিয়ে গেলো তখন নূরী দরজার আড়াল থেকে লক্ষ্য করছিলো।
নূরীর মুখমণ্ডল কালো হয়ে উঠলো, নতমুখে কি যেন ভাবতে লাগলো সে।
এর পূর্বে আরও কয়েকদিন আতিয়া এসে বনহুরকে জোর করে নিয়ে গেছে বাইরে। বনহুরের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে টেনে নিয়ে যায়। নূরীর মনকে এ দৃশ্য কেমন যেন চঞ্চল করে তোলে, ভাবে কত কথা। কিন্তু সব এলোমেলো হয়ে যায়। নূরী তখন শয্যায় শুয়ে থাকে চুপ করে।
ইয়াসিন অনেকদিন বলেছে, বেগম সাহেবা, আপনি অমন চুপ চাপ থাকেন কেন?
বাড়ির অন্যান্য চাকর বাকর প্রশ্ন না করলেও অবাক হয়েছে নূরীর নীরবতা লক্ষ্য করে।
কিন্তু কেউ জবাব পায়নি।
নূরী নির্বিকার পুতুলের মত গোটা দিন বসে থাকে নিজের শয়নকক্ষে। নূরীর দেখাশুনার জন্য যে মেয়েটাকে রাখা হয়েছিলো, সে সব সময় নূরীকে নাওয়া-খাওয়া করাতো-কোনো কোনো সময় বাগানে নিয়ে গিয়ে দস্যু বসতো, চুল আঁচড়ে দিতো, গল্প করতো, কিন্তু নূরী চিত্রাপিতের ন্যায় গল্প শুনতো বা যা বলতো সেই কাজ করতো।
আতিয়ার সঙ্গে বনহুরের কদিন মেলামেশা লক্ষ্য করে নুরীর মধ্যে একটু যেন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হলো। আর কেউ এটা লক্ষ্য না করলেও ধৰা পড়ে গেলো বনহুরের কাছে।
বনহুর যখন আতিয়ার সঙ্গে ড্রইংরুমের দিকে যাচ্ছিলো তখন মুরীর ওপর তার চোখ দুটো চলে গিয়েছিলো। একটা জিনিস বনহুর লক্ষ্য করেছিলো যা তার মনে এনেছিলো ক্ষীণ আশ্বাসবাণী। আতিয়ার সঙ্গে তাল মেলামেশাটা নূরীর কাছে সন্তোষজনক নয় বলে মনে হয়েছিলো। একটা হাসির রেখা। ফুটে উঠেছিলো তখন বনহুরের ঠোঁটের কোণে।
ড্রইংরুমে আতিয়ার পাশে এসে বসলো বনহুর-মিস আতিয়া এত রাতে হঠাৎ কি মনে করে?
যদি বলি আপনাকে দেখতে? কিন্তু….
না, কিন্তু নয়, কারণ এত রাতে আমি এমনিই আসিনি।
আপনি জানতেন আজ আমার সুটিং ছিলো। তবু জেনেশুনে কেন এত কষ্ট করে এসেছেন এবং আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।
মিঃ চৌধুরী, আব্বার মুখে শুনেছিলাম সন্ধ্যার পরই আপনার কাজ শেষ হবার সম্ভাবনা আছে, কাজেই…
কিন্তু শেষ নাও তো হতে পারে, এটাও আপনার ভেবে দেখা উচিত ছিলো।
কি জানি মিঃ চৌধুরী, সব সময় আপনাকে মনে-আপনার পাশে থাকবার। বাসনা আমার মনকে অস্থির করে রাখে।
আতিয়ার প্রেম গদ গদ কণ্ঠস্বরে বনহুরের মন বিষিয়ে ওঠে। ভ্রুকুঞ্চিত করে তাকায় সে ওর মুখের দিকে।
বনহুর মনে মনে বিরক্তি বোধ করলেও আতিয়ার যাওয়া-আসা বেড়েই উঠলো দিনের পর দিন।
বনহুরকে নিবিড় করে পাবার জন্য আতিয়া যেন উম্মাদ হয়ে উঠলো। আরফান উল্লাহ কন্যাকে যোগাতে লাগলেন উৎসাহ আর প্রেরণা। মিঃ চৌধুরীকে চিরদিনের জন্য আবদ্ধ করার এই একমাত্র উপায়। যেমন করে হোক তাকে কন্যার সঙ্গে বিয়ে দিতে পারলেই তিনি যেন নিশ্চিন্ত হন।
একসঙ্গে কন্যার জামাতা লাভ এবং নিজের ছবির হিরো সংগ্রহ! কিন্তু বনহুর নির্বোধ নয়। প্রথম দিন আরফান উল্লাহর সঙ্গে পরিচিত হয়েই সে বুঝতে পেরেছিলো তার মনোভাব সুবিধার নয়। লোকটার উদ্দেশ্যমূলক কথাবার্তা তার মনে জাগিয়েছিলো সন্দেহের দোলা।
বনহুর সতর্ক হয়ে গিয়েছিলো নিজের ব্যাপারে।
ইচ্ছা করলেই বনহুর আরফান উল্লাহ এবং নাহার চৌধুরীর নাগপাশ থেকে যে কোন মুহূর্তে মুক্ত হয়ে উধাও হতে পারতো। বনহুরকে আটকায় এমন কেউ নেই এ দুনিয়ায়, কিন্তু সে আপন ইচ্ছাতেই রয়ে গেছে, তা উদ্দেশ্যবিহীনভাবে নয়। ছবিতে.লক্ষ টাকা চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন আরফান উল্লাহ। শুধু অর্থের জন্যও নয়, পেছনে আর একটা ব্যাপার রয়েছে। বনহুর গোপনে সন্ধান নিয়ে জানতে পেরেছে প্রযোজক আরফান উল্লাহ একজন অসৎ ব্যবসায়ী।
বনহুর ছবির কাজ শেষ করে টাকা নেবে এবং সেই সঙ্গে আরফান উল্লাহর অসৎ ব্যবসার অবসান ঘটাবে।
গভীর রাত।
একটা গাড়ি এসে থামে আরফান উল্লাহর বাড়ির পেছনভাগে। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো একজন জমকালো আলখেল্লাধারী। সমস্ত শরীর কালো আলখেল্লায় ঢাকা। মুখে কালো মুখোশ। শুধু চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে জুলছিলো আলখেল্লার ভেতরে।
আলখেল্লাধারী অতি কৌশলে পেছন প্রাচীর টপকে প্রবেশ করলো অন্তঃপুরে। একবার প্যান্টের পকেটে হাত রেখে রিভলবারের অস্তিত্ব অনুভব করে নিলো।
সোজা এসে দাঁড়ালো আলখেল্লাধারী দোতলার পেছনের দিকে। অতি নিপুণতার সঙ্গে পাইপ বেয়ে উঠতে লাগলো উপরে।
যে কক্ষটার পাইপ বেয়ে আলখেল্লাধারী উপরে উঠলো সেই কক্ষের মধ্যে তখন আরফান উল্লাহ ও আর একজন লোক বসে অতি নিম্নস্বরে আলোচনা হচ্ছিলো।
আলখেল্লাধারী পাইপ বেয়ে একেবারে জানালার শার্শির পাশে এসে পৌঁছলো।
ঠিক সেই মুহূর্তে কক্ষ হতে ভেসে এলো আরফান উল্লাহর চাপা কণ্ঠ-আহমদ, আবার তোমাকে বলে দিচ্ছি-রাত একটায় গঞ্জপুর থেকে রওয়ানা দেবে, জোড়াপুলের উপর পৌঁছতে যেন রাত দুটো হয়। কারণ, তখন ট্রাফিক পুলিশ জোড়াপুলের মুখ থেকে সরে পড়বে। তারপর নিশ্চিন্তে পৌঁছে যাবে আমার গুদামে। সেখানে পৌঁছলে আর কোনো ভয় থাকবে না। সাবধান! কেউ যেন টের না পায়-ট্রাকের চিনির বস্তার মধ্যে সোনা আছে।
নাহি বাবু সাব, টের না পাবে। হামি লোক বহুৎ হুঁশিয়ার আছি! চিনির বস্তায় সোনা আছে-কেউ টের না পাবে।
আলখেল্লাধারীর চোখ দুটে জ্বলে উঠলো।
কক্ষে এবার শোনা গেলো-হামি এবার চলি?
যাও আহমদ, মনে রেখো-তুমি আমার অন্তরঙ্গ বন্ধুদের মধ্যে একজন।
হাসির শব্দ-হামাকে তা বলতে হবে না। সালাম বাবু সাব।
আরফান উল্লাহর কণ্ঠ–সালাম।
আলখেল্লাধারী যেমন এসেছিলো তেমনি পাইপ বেয়ে তর তর করে নেমে গেলো নিচে।
বাড়ির পেছন অংশে পৌঁছতেই আলখেল্লাধারী শুনতে পেলো মোটর ষ্টার্টের শব্দ। বাড়ির দক্ষিণ অংশে কোনো গোপন জায়গা আছে, যেখানে গাড়ি রাখলে সামনে থেকে কেউ দেখতে পায় না।
আলখেল্লাধারী যখন তার শব্দবিহীন গাড়িখানা নিয়ে বাড়ির সামনে দিয়ে পেছন দিকে আসছিলো, তখন বাড়ির সামনের গাড়ি বারান্দায় কোনো গাড়ি, ছিলো না।
আলখেল্লাধারী গাড়িতে বসে ষ্টার্ট দিলো।
মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেলো গাড়িখানা।
পরদিন।
রাত দুটো বাজবার কিছু বিলম্ব আছে।
আলখেল্লাধারী নিজের গাড়িখানা জোড়াপুরে অদূরে একটা ঝোপের আড়ালে রেখে নেমে দাঁড়ালো। অন্ধকারে রেডিয়াম হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো, এখনো দুটো বাজতে পঁচিশ মিনিট বাকী।
শহর ছেড়ে প্রায় একশ মাইল দূরে এই জোড়াপুল। মধুগঙ্গার উপর দিয়ে ঝুলানো এই পুলখানা চলে গেছে গঞ্জপুরের দিকে। পুলটার ঠিক মাঝখানে একটা জোড়া রয়েছে, তাই এর নাম জোড়াপুল।
মধুগঙ্গা দিয়ে যখন বড় বড় নৌকা বা ষ্টিমার চলে তখন জোড়াপলের জোড়া খুলে যায়।
পুলের দুই মাথায় দুজন ট্রাফিক পুলিশ দণ্ডায়মান থাকে, তারাই পুলের জোড়া খুলে দেয়। পুলের দুপাশে দুটো হ্যাণ্ডেলের মত জিনিস রয়েছে, সেটা জোরে সামনে ঠেলে দিলে পুল স্বাভাবিক হয়ে যায়, আর পেছনে ঠেলে দিলে মাঝখান ফাঁক হয়ে যায়। তখন যে কোনো স্টিমার বা বড় বড় নৌকা পাল তুলে অনায়াসে এদিক থেকে সেদিক চলে যায়।
আলখেল্লাধারী এসে দাঁড়ালো পুসের সামনে যেখানে রয়েছে পুলের চাবিকাঠি।
ঠিক সেই মুহূর্তে মধুগঙ্গার ওপারে রাস্তায় দুটো লাইটের আলো তীরবেগে ছুটে আসছে জোড়াপুলের দিকে।
আলখেল্লাধারীর চোখ দুটোও জ্বলে উঠলো ঠিক ঐ দুটো লাইটের আলোর মতই।
স্পীডে এগিয়ে আসছে একটা ট্রাক।
এখানে হ্যাণ্ডেলে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে আলখেল্লাধারী। আর মাত্র কয়েক মিনিট-তাহলেই তার দক্ষিণ হাতখানা নুয়ে পড়বে একপাশে।
আলখেল্লাধারীর দৃষ্টি ঐ সার্চলাইটের আলোর ওপর স্থির হয়ে আছে।
গাড়িখানা সবেগে উঠে পড়লো জোড়াপুলের উপর। তীরবেগে এগিয়ে আসছে। মাত্র কয়েক সেকেণ্ড, জোড়াপুলের মাঝখান ফাঁক হয়ে গেলো আচম্বিতে।
ঝপ করে একটা শব্দ হলো।
একটা ক্ষীণ আর্তনাদ বাতাসে ভেসে উঠে মিলিয়ে গেলো মুহূর্তে।
পরক্ষণেই একটা অট্টহাসিতে মুখর হয়ে উঠলো মধুগঙ্গার তীর। আলখেল্লাধারী এবার হাসি থামিয়ে গাড়ির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
ভোরে ঘুম ভাঙতেই পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ, হোসাইন দেখলেন তার নামে একখানা জরুরী চিঠি এসেছে। মুখহাত না ধুয়েই খুলে ফেললেন চিঠিখানা। মাত্র দুটো লাইন লেখা আছে
ইন্সপেক্টার, গত রাত দুটোয় জোড়াপুলের মাঝখানে মধু গঙ্গায় একটি ট্রাক নিমজ্জিত হয়েছে। ট্রাকে চিনির বস্তার মধ্যে বহু সোনা আছে। বিলম্ব না করে উদ্ধার করুন।
–অজ্ঞাত
ইন্সপেক্টার মিঃ হোসাইন কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তার হাতে চিঠিখানা তখনও ধরা। মধুগঙ্গায় ট্রাক নিমজ্জ্বিত, চিনির বস্তায় সোনা–কয়েকবার পড়লেন মিঃ হোসাইন চিঠিখানা।
হাতমুখ ধোয়া বা নাস্তা খাওয়া কোনোটাই তাঁর হলো না, তখনই তিনি চিঠিখানাসহ ছুটলেন পুলিশ অফিসে।
সহকারী মকসুদ মিয়াকে তখনই আদেশ দিলেন কয়েকজন পুলিশ নিয়ে মধুগঙ্গায় জোড়াপুলের নিকটে যেতে। অল্পক্ষণ পর তিনি আসছেন বলে জানালেন।
হঠাৎ মধুগঙ্গায় জোড়াপুলের নিকটে কি প্রয়োজন ভেবে পান না মকসুদ মিয়া।
মিঃ হোসাইন আরও বলে দিলেন-তিনি পৌঁছবার পূর্বে কেউ যেন মধুগঙ্গায় না নামে।, মকসুদ মিয়া কোনো প্রশ্ন করতে পারলেন না, তিনি কয়েকজন পুলিশ নিয়ে রওয়ানা হলেন মধুগঙ্গার দিকে।
সহকারী মকসুদ মিয়া বিদায় হতেই মিঃ হোসাইন চিঠিখানা নিয়ে পুলিশ সুপারের নিকটে হাজির হলেন।
চিঠিখানা তাঁর হাতে দিয়ে বললেন-স্যার, চিঠির কথা সত্য মিথ্যা জানি না, তবু আমি আমার সহকারী মকসুদ মিয়াকে কয়েকজন পুলিশসহ মধুগঙ্গার তীরে পাঠিয়েছি। এবার কি করা যায় বলুন?
পুলিশ সুপার বেশ কিছুক্ষণ চিঠিখানার দিকে তাকিয়ে থেকে কি যেন ভাবলেন, তারপর বললেন-যতদূর বিশ্বাস চিঠির লেখা সত্য বলেই মনে হচ্ছে।
তাহলে আমি ডুবুরী নিয়ে জায়গাটা পরীক্ষা করে দেখবো?
নিশ্চয়ই দেখতে হবে।
পুলিশ সুপারের সঙ্গে যখন পুলিশ ইসপেক্টার মিঃ হোসাইন নিমজ্জিত ট্রাক, সোনা চিঠি নিয়ে আলাপ আলোচনা করছিলেন, তখন বনহুর নিজের ড্রাইরুমে বসে চা পান করছিলো।
এমন সময় পাগলের মত এলোমেলো বেশে কক্ষে প্রবেশ করলেন মিঃ আরফান উল্লাহ-মিঃ চৌধুরী, সর্বনাশ হয়েছে, আমার সর্বনাশ হয়েছে–মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন তিনি।
বনহুর শশব্যস্তে ওঠে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো-হঠাৎ কি হলো, আপনার মিঃ উল্লাহ?
মিঃ চৌধুরী, সর্বনাশ হয়ে গেছে।
সর্বনাশ হয়ে গেছে! আতিয়ার কোনো অমঙ্গল ঘটেনি তো? বনহুর চোখেমুখে আশংকাভাব টেনে কথাটা বললো।
আরফান উল্লাহ বললেন-না, না, আতিয়ার কোনো অমঙ্গল ঘটেনি মিঃ চৌধুরী।
তবে কি হলো?
দুলাখ টাকা, দুলাখ টাকা আমার চলে গেছে মিঃ চৌধুরী ও হো হো হো আকুলভাবে কেদে উঠলেন.আরফান উল্লাহ।
বনহুর যেন কিছু বুঝতে পারলো না এমনি থ বনে যায়।
আরফান উল্লাহর মুখমণ্ডল কালো হয়ে উঠেছে। গা ঘেমে দরদর করে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে।
বনহুর ফ্যানের স্পীড বাড়িয়ে দিলো।
আরফান উল্লাহ বললেন কি করবো বলুন, কি করবো?
বলুন কি ঘটনা ঘটেছে? না বললে বুঝবো কি করে?
মিঃ চৌধুরী, আপনাকে আমি বিশ্বাস করি—
হাঁ বলুন?
আমার দুলাখ টাকার সোনা কাল মধুগঙ্গার বুকে নিমজ্জিত হয়েছে।
দুলাখ টাকার সোনা। বনহুর যেন আকাশ থেকে পড়লো।
হ্যাঁ হ্যাঁ, মিঃ চৌধুরী শুনুন–কাল রাতে গঞ্জপুর থেকে এক ট্রাক। বোঝাই চিনি আসছিলো–
চিনি।
হ্যাঁ, সে চিনির বস্তার ভেতরে ছিলো আমার দুলাখ টাকার সো–না–কথাটা তার বুক চিরে বেরিয়ে এলো যেন।
বনহুর বললো–কি করে জানলেন সেগুলো মধুগঙ্গায় নিমজ্জিত হয়েছে?
ড্রাইভার–মিঃ চৌধুরী, কোনো রকমে সাঁতার কেটে ড্রাইভার প্রাণে বেঁচে ফিরে এসেছে।
বনহুর ভ্রূকুঞ্চিত করে কি যেন চিন্তা করলো, তারপর বললো ড্রাইভার প্রাণে বেঁচে ফিরে এসেছে।
হাঁ, তার মুখেই সংবাদ পেলাম মিঃ চৌধুরী। এখন কি করি বলুন? কি করে আমার সোনাগুলো উদ্ধার করি?
বনহুর এবার শান্তকণ্ঠে বললো-ভয় নেই মিঃ উল্লাহ। মধুগঙ্গার পানিতে আপনার চিনির বস্তা দিয়ে সরবৎ তৈরি হলেও বস্তার মধ্যে সোনার দলা গলে যাবে না।
কিন্তু দিনের আলোতে কি করে এগুলো উদ্ধার করা যাবে? আমার মাথা গুলিয়ে গেছে, আমি কিছুই ভেবে পাচ্ছি না–
এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করলো গত রাতের আহম্মদ। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো-মিঃ উল্লাহ সাহেব, বহুত খারাপ বাত আছে!, আরফান উল্লাহ ব্যস্ত কণ্ঠে বলে উঠলো-কি খবর বলল, বলো আহম্মদ? ঐ খবরের পর আর কি খারাপ থাকতে পারে বলো?
হামাকে আপনি মধুগঙ্গার ধারে পাঠাইয়া এখানে আসিলেন। কিন্তু আমি যাইয়া দেখিলাম-বহুত পুলিশ মধুগঙ্গার জোড়াপুলে ভীড় জমিয়া গিয়াছে।
পুলিশ!
হাঁ, পুলিশ। আরও দেখিলাম উহারা পানিতে নামিবার জন্য তৈরি হইতেছে।
আহম্মদের জামার আঙিন চেপে ধরলেন আরফান উল্লাহ, আকল কণ্ঠে বললেন-পুলিশ কি করে টের পেলো? আহম্মদ, পুলিশ কি করে টের পেলো?
বনহুর দুচোখ কপালে তুলে বললো-সর্বনাশ তো তখন হয়নি, হলো এখন। পুলিশ যখন সন্ধান পেয়েছে তখন আর কোনো–
উপায় নেই! কথাটা টেনে টেনে হতাশার সুরে বললেন আরফান উল্লাহ।
আরফান উল্লাহকে তখন এমন দেখাচ্ছিলো যেন তার দেহে প্রাণ নেই।
বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে বললেন আরফান উল্লাহ মিঃ চৌধুরী, আমি কাউকে বিশ্বাস করি না, শুধু আপনার ওপর আমার দৃঢ় বিশ্বাস–
বলুন কি প্রয়োজন?
পুলিশ যখন জানতে পেরেছে তখন করবার আর কিছু নেই, কিন্তু কথাটা যেন বাইরে প্রকাশ না পায়, মানে সোনাগুলো যে আমার—
জানতে পারবে না মিঃ উল্লাহ। সোনাগুলোই শুধু হারিয়েছেন, আপনি বেঁচে গেছেন।
আরফান উল্লাহ বনহুরের দক্ষিণ হাতখানা চেপে ধরলেন– একথা শুধু আপনি জানলেন মিঃ চৌধুরী।
হাঁ, ভয় নেই কোন।
আরফান উল্লাহ যখন বনহুরের ওখান থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন, তখন মনে হলো তার দেহে প্রাণ নেই, কোনো রকমে দেহকে টেনে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন।
পরদিন পত্রিকায় বড় বড় অক্ষরে প্রকাশ পেলো গত দিনের সোনা উদ্ধারের খবরটা?
পুলিশ কর্তৃক মধুগঙ্গা থেকে প্রচুর সোনা উদ্ধার ও নম্বরবিহীন একটি নিমজ্জিত ট্রাক ও কয়েকখানা বস্তা উদ্ধার করা হয়েছে।
শহরে একটা ভীষণ চাঞ্চল্য দেখা দিলো। একি অদ্ভুত ঘটনা। ট্রাকই বা। এলো কোথা হতে আর সোনাই বা এলো কি করে, কিন্তু এর জবাব কেউ দিতে পারলো না।
আরফান উল্লাহ বেশ কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছিলেন। দুলাখ টাকা তার পানিতে ভেসে গেছে, কম কথা নয়। পুলিশের হাতে চলে যাওয়া মানে পানিতে ভেসে যাওয়ার মতই।
আরফান উল্লাহ ঝিমিয়ে পড়লেও একেবারে ভেঙে পড়লেন না। ভেঙে পড়লে তার চলবে কেন? মেরুদণ্ড সোজা করে আবার তিনি পা বাড়ালেন সামনের দিকে।
বিদেশিদের সঙ্গে বছরে তার বেশ কয়েক লাখ টাকার গোপন কারবার চলতো। তাছাড়া অন্যান্য অনেক চোরা কারবার ছিলো আরফান উল্লাহর, কাজেই আরফান উল্লাহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেন।
এতগুলো টাকা বিনষ্ট হওয়ায় আরফান উল্লাহ ঝিমিয়ে পড়লেও তার অনুচর ও কর্মচারীরা নীরব ছিলো না। তারা ঠিকভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলো।
কুন্তিবাঈ ছবির সুটিং কয়েকদিন বিশেষ কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো, আবার শুরু হলো।
সেদিন আউটডোর সুটিংয়ের জন্য একটা গ্রামাঞ্চলে যেতে হলো। কুন্তিবাঈ ছবির ইউনিটকে।
আজকের সুটিংয়ে খুব বেশি লোকজনের দরকার হবে না।
পরিচালক নাহার চৌধুরী, ছবির নায়ক মিঃ চৌধুরী, নায়িকা জ্যোছনা রায় এবং সহনায়ক বিশু সেন ও অন্যান্য লোক নিয়ে রওয়ানা দিলেন শহর ছেড়ে দশ মাইল দূরে একটি গ্রামের উদ্দেশ্যে।
দুখানা ট্যাক্সি আর একটা ট্রাক নিয়ে রওয়ানা দিলেন নাহার চৌধুরী। সামনের ট্যাক্সিতে পরিচালক স্বয়ং এবং নায়ক-নায়িকা ও সহনায়ক। মাঝখানে ইউনিটের বিভিন্ন লোক এবং খাবার জিনিসপত্র। পেছনের ট্রাকে ক্যামেরা এবং অন্য আসবাবপত্র–ছবির জন্য প্রয়োজন। শহর ছেড়ে গাড়িগুলো দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। ড্রাইভারের আসনের পাশে বনহুর আর জ্যোছনা রায় বসেছে। পেছন আসনে নাহার চৌধুরী ও সহনায়ক বিশু সেন।
অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ জ্যোছনাকে বেশ গম্ভীর ভাবাপন্ন লাগছিলো, দুএকটা হুঁ না ছাড়া তেমন কোনো কথা আজ বলেনি জ্যোছনা রায়।
অন্য কেউ লক্ষ্য না করলেও বনহুর লক্ষ্য করেছিলো-হাস্যময়ী জ্যোছনা রায় আজ বেশ চুপচাপ।
এবার জিজ্ঞাসা করলো বনহুর-মিস রায়, এমন নিশ্চুপ রয়েছেন কেন?
জ্যোছনা রায় একটু হেসে বললো-না,কিছু না।
জ্যোছনা রায় মুখে কিছু না বললেও মনের গহনে তার ঝড় বইছিলো। কারণ রওয়ানা দেবার পূর্বমুহূর্তে একটি ঘটনা ঘটে গেছে। বিদায়ের কিছু পূর্বে জ্যোছনা রায় যখন তার বিশ্রামকক্ষে ড্রেস পরিবর্তন করছিলো ঠিক সে মুহূর্তে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছিলো অরুণ কুমার।
দুচোখে তার অসহায় দৃষ্টি।
জ্যোছনা রায় অরুণ কুমারকে দেখে আচম্বিতে চমকে ওঠে। দুচোখে রাগ–ক্রোধ ঝরে পড়ে, বিরক্তিভরা কণ্ঠে বলেছিলো জ্যোছনা রায়-এখানে–আপনি কার হুকুমে এসেছেন?
অরুণ কুমার বলেছিলো-জ্যোছনা, আমি কারও হুকুমে এখানে আসিনি, মনের আকর্ষণে ছুটে এসেছি। আমি তোমাকে ভালবাসি।
এ কথা আরো অনেকবার আপনার মুখে আমি শুনেছি।
আজও বলছি জ্যোছনা আমার প্রতি সদয় হও!
না, যা হবার নয় তা কোনোদিন হবে না। জ্যোছনা! অস্ফুট শব্দ করে উঠেছিলো অরুণ কুমার। তারপর দাঁতে দাঁত পিষে বলেছিলো-যদি তোমাকে কোনোদিন না পাই তবে জানো কি হবে তোমার পরিণতি?
জানতে চাই না-যান, যান আপনি।
জ্যোছনা, মনে রেখো আমার হাত থেকে তোমার পরিত্রাণ নেই। যেখানেই যাবে তুমি, সেখানেই আমার দৃষ্টি তোমাকে অনুসরণ করবে-হয় তোমাকে পাবো, নয় তোমাকে এ দুনিয়া থেকে চিরবিদায় দেবো।
জ্যোছনা সে ভয়ে ভীত নয়।
তাই নাকি?
হাঁ, মরতে হয় মরবো, কিন্তু তবু আপনাকে—
জ্যোছনার মুখ চেপে ধরেছিলো অরুণ কুমার, কথা শেষ করতে পারেনি। সে মুহূর্তে বাইরে ভেসে উঠেছিলো নাহার চৌধুরীর কণ্ঠস্বর-হালো মিস রায়, আপনার হলো?
সঙ্গে সঙ্গে অরুণ বাবু অদৃশ্য হলেছিলো ড্রেসিং টেবিলের আড়ালে।
নাহার চৌধুরীর কণ্ঠস্বর পুনরায় ভেসে এসেছিলো বাইরে থেকে আসতে পারি?
শুষ্ক কণ্ঠে বলেছিলো জ্যোছনা রায়–আসুন।
হয়েছে আপনার?
হয়েছে।
চলুন।
নাহার চৌধুরীকে অনুসরণ করেছিলো জ্যোছনা রায়।
এখন বনহুরের পাশে বসে সে কথাই ভাবছিলো জ্যোছনা রায়। মনের মধ্যে তার ঝড়ের তাণ্ডব শুরু হয়েছিলো। বারবার মনে পড়ছিলো অরুণ কুমারের কথাগুলো-যেখানেই যাবে তুমি সেখানেই আমার দৃষ্টি তোমাকে অনুসরণ করবে। হয় তোমাকে পাবো, নয় তোমাকে এ দুনিয়া থেকে বিদায় দেবো।–জ্যোছনা রায়ের চিন্তাস্রোতে বাধা পড়ে।
পরিচালকের কণ্ঠস্বর-ঐ সামনে ফাঁকা জায়গাটায় গাড়ি রাখো।
অল্পক্ষণের মধ্যেই জ্যোছনা রায়দের গাড়ি একটা বনানী ঘেরা ফাঁক, জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়লো।
পাশাপাশি তিনখানা গাড়ি এসে দাঁড়ালো। দুখানা জিপ আর একটা ট্রাক।
কুন্তিবাঈ ইউনিট নেমে পড়লো জায়গাটায়। বনহুর জ্যোছনা রায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো আবার বেশ জায়গাটা, না?
ছোট্ট একটা শব্দ করলো জ্যোছনা রায় হ্যাঁ।
অন্যদিন হলে হাসি-খুশি আনন্দে চঞ্চল হরিণীর মত এতক্ষণ ছুটাছুটি শুরু করে দিতো জ্যোছনা রায়। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল খুব প্রিয় স্থান জ্যোছনা রায়ের।
বনহুরের সঙ্গে এগুতে লাগলো জ্যোছনা রায়।
পরিচালক স্বয়ং তার অন্যান্য সহকারীকে নিয়ে স্থান নির্বাচনে আত্মনিয়োগ করলেন।
অন্যান্য সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। বনহুর ঘুরেফিরে জায়গাটা দেখছিলো।
হঠাৎ নজর চলে গেলো পাশে-কই, জ্যোছনা রায় নেই তো! গেলো কোথায়? চারদিকে দৃষ্টি মেলে দেখতে লাগলো। দেখলো বনহুর অদূরে একটি গাছের নীচে ঘাসের উপর বসে আছে জ্যোছনা রায়।
আরে আপনি এখানে! বনহুর গিয়ে দাঁড়ালো জ্যোছনা রায়ের পাশে।
জ্যোছনা রায় বললো-এখানে একটু ঠাণ্ডা মিঃ চৌধুরী, তাই বসলাম।
হাঁ, জায়গাটা বেশ আরামদায়ক।
সত্যি যেখানে জ্যোছনা রায় বসে পড়েছিলো, সে জায়গাটা একটা বকুল ফুলের গাছতলা। ফুলে ফুলে গাছটা যেন নুয়ে এসেছে একেবারে।
ফুরফুরে হাওয়ায় বকুলের মিষ্টি গন্ধ জায়গাটাকে যেন স্বর্গিয় করে তুলেছিলো।
বনহুর বিলম্ব না করে বসে পড়লো জ্যোছনা রায়ের পাশে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে নিয়ে বললো-সত্যি করে বলুন তো আজ আপনার কি হয়েছে?
বললাম তো কিছু হয়নি।
মিথ্যে কথা। আর একবার চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে বললো বনহুর-আসার পূর্বে অরুণ বাবুর সঙ্গে আপনার কি কথা হয়েছিলো মিস রায়?
চমকে উঠলো জ্যোছনা রায়-আপনি কি করে জানলেন।
আমি সব জানি মিস রায়।
আশ্চর্য! আপনি তখন—
যদিও গাড়িতে ছিলাম তবুও—
মিঃ চৌধুরী।
মিস রায় অরুণ বাবু আপনাকে এমন কোনো কথা শুনিয়েছিলো যে অত্যন্ত অপ্রীতিকর।
হাঁ, আপনার অনুমান মিথ্যা নয় মিঃ চৌধুরী। একটু চিন্তা করে বললো জোছনা রায়-অরুণ বাবু আমাকে ভয় দেখিয়ে বলেছিলো-যেখানেই যাবে। তুমি সেখানেই আমার দৃষ্টি তোমাকে অনুসরণ করবে।
কথাটা শোনামাত্র বনহুরের মুখমণ্ডলে ফুটে ওঠে একটা চিন্তারেখা, গম্ভীর কণ্ঠে বললো সে।
জোছনা রায় বললো আবার–মিঃ চৌধুরী, অরুণ বাবু আরও বললো-তোমাকে যদি না পাই, মনে রেখো-এ দুনিয়াতে তোমাকে বাঁচতে দেবো না।
বনহুর স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো-মিস রায়, এসব জানার পর আপনি কি জবাব দিয়েছিলেন?
বলেছি মৃত্যুভয়ে জ্যোছনা রায় ভীত নয়। মরতে হয় মরবো তবু আপনাকে আমি গ্রহণ করতে পারবো না। কথাগুলো বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়ে জ্যোছনা রায়।
বনহুর মুখে হাসি টেনে বললো-মিস রায়, কেন আপনি ওর প্রতি এত নারাজ?
এর কোনো জবাব দিতে পারবো না মিঃ চৌধুরী।
অরুণ বাবু বড়লোকের একমাত্র সন্তান-রূপ গুণ সব আছে তার। সুপুরুষ সে, অথচ জানি না কেন আপনি–
মিঃ চৌধুরী, আপনাকে আমি এর উত্তর দিতে রাজী নই। শুধু আজ নয়, সে আমার পেছনে বেশ কয়েক বছর ধরে ঘুরে ফিরছে।
আপনার প্রথমেই তাকে বলে দেওয়া উচিত ছিলো।
দিয়েছিলাম।
তবু?
হাঁ, তবুও সে সব সময় আমাকে বিরক্ত করতো।
বনহুর কিছু বলতে যাচ্ছিলো, ঠিক সেই মুহূর্তে মেকআপ ম্যান ডাক দিলেন-আসুন মিঃ চৌধুরী, মিস জ্যোছনা রায়, আপনাদের এখন মেকআপ নিতে হবে।
বনহুর উঠে দাঁড়ালো-চলুন মিস রায়।
জ্যোছনা রায়ও উঠে পড়লো–চলুন।
ছবির কাজ শুরু হলো।
ক্যামেরাম্যান অনন্ত বাবু ক্যামেরার পাশে এসে দাঁড়ালেন।
সেনাপতি জয় সিংহের ভূমিকায় ভিলেন বিশু সেন ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে আসছে। পাশে রাজা পরশ রায়ের ভূমিকায় দেব শর্মা।
পরিচালক নাহার চৌধুরী চীৎকার করে বললেন-ক্যামেরা। সঙ্গে সঙ্গে দেব শর্মা ও বিশু সেন ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো।
ক্যামেরা ঘোড়াসহ দেবশর্মা ও জয়সিংকে ধরে নিয়ে পেছনে সরতে লাগলো।
জয়সিংবেশি বিশু সেন এবার ঘোড়াসহ ক্যামরার সামনে এসে, দাঁড়িয়ে পড়লো। পাশে দেবশর্মা।
নাহার চৌধুরী এতক্ষণ স্ক্রিপট ধরে তাকিয়ে ছিলেন জয় সিং ও দেবশর্মার দিকে।
এবার উচ্চকণ্ঠে বললেন-কাট।
অনন্তবাবু ক্যামেরা থেকে সরে দাঁড়ালেন, বললেন-গুড শট হয়েছে।
পরবর্তী দৃশ্যের জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন নাহার চৌধুরী।
এবারের দৃশ্যে থাকবে হিরো মাসুদের ভূমিকার মিঃ চৌধুরীবেশি দস্যু বনহুর। রত্নাদেবীর ভূমিকায় জ্যোছনা রায়। রাজা পরশ রায়ের ভূমিকায় আহম্মদ আলী এবং সেনাপতি জয় সিংয়ের চরিত্রে বিশু সেন। সহনায়িকা নাসিমা বানু থাকবে জ্যোছন রায়ের সঙ্গে। নাসরিনের ভূমিকায় অভিনয় করছে নাসিমা বানু। মাসুদের পিতা মাহমুদের চরিত্রে থাকবেন আসগর হোসেন। অদুরে পাশাপাশি কয়েকটা তাবু পড়েছে।
তাবুর অদুরে একটা খাটিয়ার বসে রাজা পরশ রায় ও জয়সিং। একটা মোড়ার মত বসবার আসনে বসে মাহমুদ। তিনজনের মধ্যে আলাপ হচ্ছে।
ক্যামেরা তাদের ধরে নিয়ে এগুলো।
পরিচালক উচ্চকণ্ঠে বললেন-কাট।
এবার ক্যামেরা এলো তাবুর মুখে, জ্যোছনা রায় ও নাসিমা বানু বেরিয়ে এলো বাইরে। উভয়ে উভয়ের মুখে তাকিয়ে হাসছে। জয়সিং ইঙ্গিত করলো রাজা পরশ রায়কে।
রাজা পরশ রায় আর জয়সিং তাকিয়ে আছে ওদিকে।
পেছনে এসে দাঁড়ালো মাসুদ–কি দেখছেন?
চমকে একসঙ্গে ফিরে তাকালো রাজা পরশ রায় আর জয়সিং।
জ্যোছনা রায় আর নাসিমা বানুর মুখ থেকে ক্যামেরা এসে পড়লো রাজা পরশ রায় আর রাজা জয় সিংয়ের ওপর।
পরিচালক বললেন-কাট।
শটের পর শট গ্রহণ চললো।
সন্ধ্যা অবধি একটানা সুটিং চলার পর শেষ হলো পরিচালক নাহার চৌধুরীর কাজ।
কুন্তিবাঈ ইউনিট ফিরে চলার জন্য সবাই গাড়িতে উঠে বসলো।
এবারও সামনের গাড়িতে ড্রাইভ আসনের পাশে বসলো বনহুর আর। জ্যোছনা রায়।
পেছনের আসনে পরিচালক নাহার চৌধুরী, বিশু সেন ও আহম্মদ আলী।
ড্রাইভার গাড়িতে ষ্টার্ট দিতে যাবে ঠিক সে মুহূর্তে একটা সুতীক্ষ্ণধার ছোরা এসে বিধে গেলো খচ করে জ্যোছনা রায়ের কাঁধের পাশ ঘেষে ড্রাইভারের পিঠে।
একটা তীব্র আর্তনাদ করে ড্রাইভার উবু হয়ে পড়ে গেলো গাড়ির হ্যাণ্ডেলের ওপর।
মুহূর্তে এতবড় একটা অঘটন ঘটে গেলো।
পেছনে আসনের দরজা খুলে ব্যস্তভাবে নেমে পড়লেন নাহার চৌধুরী ও তাহার সহকর্মিগণ।
বনহুর ততক্ষণে ছোরাখানা ড্রাইভারের পিঠ থেকে তুলে নিয়েছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে।
কি ভয়ঙ্কর কাণ্ড।
কোন দিক থেকে ছোরাটা এলো–কেন ছোরা মারা হয়েছে, কে মেরেছে–হই হই পড়ে গেলো গোটা ইউনিটে।
কিন্তু কেউ এর সঠিক জবাব খুঁজে পেলো না।
তবে এটা স্পষ্ট বুঝা গেলো-যেখান থেকেই ছোরাটা এসে থাকুক বা যেই মেরে থাকুক জ্যোছনা রায়কে উদ্দেশ্য করেই ছোরাটা নিক্ষিপ্ত হয়েছিলো। ছোরাটা তার দেহে না লেগে গেঁথে গিয়েছে ড্রাইভারের পিঠে।
জ্যোছনা রায়কে হত্যা করার উদ্দেশ্যেই যে ছোরাখানা নিক্ষেপ করা হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
যেদিক থেকে ছোরাখানা এসেছিলো সেদিকে অনেক সন্ধান করা হলো কিন্তু কারও খোজ পাওয়া গেলো না।
হঠাৎ এই দুর্ঘটনার জন্য গোটা ইউনিট চিন্তিত এবং ব্যথিত হয়ে পড়লো। নাহার চৌধুরী একেবারে বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন। এত বড় একটা ঘটনা কম কথা নয়।
সেদিনের পর থেকে জ্যোছনা রায় ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো। জীবনের মায়া কার না আছে। জ্যোছনা রায়ের সম্পূর্ণ সন্দেহ ছোরা নিক্ষেপকারী অন্য কেউ নয়-অরুণ বাবু।
কথাটা এক সময় বললো জ্যোছনা রায় বনহুরকে-মিঃ চৌধুরী, আপনি যাই বলুন, আমাকে লক্ষ্য করে ছোরা নিক্ষেপ করেছিলো অরুণ বাবু।
হেসে বললো বনহুর-সেই যে ছোরা নিক্ষেপ করেছিলো তার প্রমাণ কি?
সুটিংয়ে যাবার পূর্বে সে আমাকে মৃত্যুভয়ে ভীত করতে চেষ্টা করেছিলো।
বনহুর বললো আবার-সত্যি যদি অরুণ বাবু আপনাকে ভালবেসে থাকে মিস রায়, তাহলে সে আপনাকে যতই মৃত্যুভয় দেখাক আসলে আপনাকে হত্যা করতে পারবে না।
মিঃ চৌধুরী, আপনার কথায় সাহস পাচ্ছি না, কিন্তু একটু থেমে বললো জ্যোছনা রায়-মিঃ চৌধুরী, ভালবাসা কোনোদিন জোর করে আদায় করা যায় না। অরুণ কুমারকে আমি কোনোদিন ভালবাসতে পারবো না।
তার অপরাধ?
অপরাধ তার কিছু নেই। একদিন বলেছি-মনের ওপর কারও হাত নেই।
নিহত ড্রাইভারকে ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে আবার কুন্তিবাঈ ইউনিট শহর অভিমুখে রওয়ানা দিলো।
এবার জ্যোছনা রায়কে গাড়ির মাঝখানে বসিয়ে নেয়া হলো। নাহার চৌধুরীর দুশ্চিন্তার অন্ত নেই, জ্যোছনা রায় নিহত হলে শুধু চিত্রজগতেরই ক্ষতি হবে না, তিন লাখ টাকা ব্যয়ে কুন্তিবাঈ ছবিটাও সমুলে বিনষ্ট হবে। ছবির তিন ভাগ কাজ শেষ হয়ে গেছে, এখন এক ভাগ কাজ বাকী।
পথে আর কোনো বিপদ হলো না সত্য, কিন্তু সকলের মুখোভাব মলিন বিষণ্ণ, কারও মুখে কোনো কথা নেই।
ব্যাপারটা যখন প্রযোজক আরফান উল্লাহর কানে গেলো তখন তিনি একেবারে যেন ভেঙ্গে পড়লেন। একে তার বহু সোনা মধুগঙ্গার বুকে সমাধিস্থ হয়েছে তারপর তার ছবির নায়িকার ওপর এই অদ্ভুত হামলা আরফান উল্লাহকে একেবারে ভাবিয়ে তুললো।
কে এমন ব্যক্তি তার পিছু লেগেছে যে তার সর্বান্তকরণে অমঙ্গল চায়। তাকে সর্বস্বান্ত করেই সে খুশি নয়, তাঁর ছবিটাকেও সমুলে নষ্ট করতে চায়?
কিন্তু অনেক ভেবেও কোনো সন্দিগ্ধজনের সন্ধান আরফান উল্লাহ পেলেন না।
মিস রায়, এ কথা আমিও জানি। কথাটা বলে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপনে চেপে গেলো বনহুর।
জ্যোছনা রায়ের সঙ্গে ড্রইংরুমে কথা হচ্ছিলো বনহুরের।
এমন সময় বাইরে মোটরের শব্দ হয়।
ইয়াসিন এসে জানায়-স্যার, আপামনি আইসেছেন।
বনহুর স্বকণ্ঠে বলে-আসতে বলল।
চলে যায় ইয়াসিন।
আতিয়ার আগমনের খবর শুনে জ্যোছনা রায় বেশ চঞ্চল হয়ে উঠলো মুহূর্তে তার মুখমণ্ডলে একটা উৎকণ্ঠার ভাব ফুটে উঠলো।
বনহুরের তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তা ধরা পড়ে গেলো, যদিও জ্যোছনা রায় বনহুরের কাছে নিজের উদ্বেগ গোপন করবার চেষ্টা করছিলো।
কিন্তু বেশিক্ষণ ভাববার সময় পেলো না বনহুর, কক্ষে প্রবেশ করলো আতিয়া।
বনহুর উঠে দাঁড়িয়ে আতিয়াকে সাদর সম্ভাষণ জানালো-হ্যালো মিস আতিয়া।
গুড ইভনিং মিঃ চৌধুরী–আতিয়ার কথা শেষ হয় না, জ্যোছনা রায়ের ওপর দৃষ্টি পড়তেই তার মুখোভাব কঠিন হয়ে উঠলো।
জ্যোছনা রায় জড়োসড়োভাবে দাঁড়িয়ে রইলো।
বনহুর একবার জ্যোছনা রায় ও আতিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো, বললো-বসুন মিস আতিয়া।
আসন গ্রহণ করলো আতিয়া। তার চোখেমুখে ফুটে উঠেছে ক্রুদ্ধ ভাব।
জ্যোছনা রায় বললো এবার-চলি মিঃ চৌধুরী।
আতিয়াই জবাব দিলো জ্যোছনা রায়ের কথায়–যাবেন কেন, বসুন।
কথাটা স্বাভাবিক হলেও আতিয়ার কণ্ঠস্বর অস্বাভাবিক শোনালো। কেমন যেন বেসুরো লাগলো বনহুরের কাছে।
জ্যোছনা রায় বসে পড়লো।
আতিয়া বললো আবার মিস জ্যোছনা, আপনার কাজ স্টুডিওতে, এখানে নয়। আমি শুনেছি, আপনি নাকি প্রায়ই এখানে আসেন, কিন্তু কেন, জানতে পারি কি? তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকালো আতিয়া জ্যোছনা রায়ের মুখের দিকে।
জ্যোছনা রায় শিক্ষিতা আধুনিকা তরুণী। আতিয়ার পিতার অর্থের বিনিময়ে কাজ করলেও সে কাউকে ভয় করে না। ভয় করে সে আত্মমর্যাদার হানি হওয়াকে।
আতিয়ার কথায় জ্যোছনা রায়ের মুখমণ্ডল কালো হয়ে উঠলো, অধর দংশন করতে লাগলো সে।
বনহুর কোনো কথা না বলে উভয়ের মুখোভাব লক্ষ্য করছিলো।
আতিয়ার প্রশ্নের জবাবে বললো জ্যোছনা রায়-মিস আতিয়া আপনি ভুল করছেন। আপনাদের ছবিতে কাজ করি বলেই স্টুডিওর বাইরে যাওয়া আমার মানা নেই।
বোমার মতই ফেটে পড়ে আতিয়া-এত সাহস আপনার মিস জ্যোছনা। জানেন আমি যা খুশি তাই করতে পারি?
যা খুশি তাই করতে পারলেও আমার জীবনপথে কোনো বাধা সৃষ্টি করতে সক্ষম হবেন না-এটাও আমি জানি।
মিস জ্যোছনা, এত বড় কথা আমার মুখের ওপর বলতে সাহস হলো আপনার!
আপনার আপত্তিজনক কথাগুলোই আমাকে বলতে সাহসী ও বাধ্য করেছে।
মিস জ্যোছনা, মনে রাখবেন এটা আমার বাড়ি–
এবার যেন জ্যোছনা রায়ের চেহারা কেমন বিমর্ষ দেখালো। নিজের অলক্ষ্যে দৃষ্টি চলে গেলো বনহুরের মুখের দিকে।
আতিয়া বললো-এর পর আর কোনোদিন যেন এ বাড়িতে আপনাকে না দেখি।
আতিয়ার কথা শেষ হয় না, বনহুর ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললো–মিস আতিয়া, এ বাড়ি এখন আমার! এ বাড়িতে কাউকে আসতে নিষেধ করলে তা আমিই করবো, আপনি নন।
আতিয়া ভীষণ ক্রোধভরে উঠে দাঁড়ালো–মিঃ চৌধুরী, আপনি-আপনি এত বড় কথা–
হাঁ, আমাকে যখন আপনি এ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবেন তখন মিস রায়কেও দিতে পারবেন, তার পূর্বে নয়।
আতিয়ার কুৎসিত মুখমণ্ডল আরও কুৎসিত হয়ে উঠলো। যেন একটা মাটির পাতিলের তলা। একবার বনহুর আর একবার জ্যোছনা রায়ের মুখে তাকিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলো সে কক্ষ থেকে।
হঠাৎ যেন প্রচণ্ড একটা দমকা হাওয়ায় কক্ষের বাতিগুলো দপ্ করে নিভে গেলো মুহূর্তে।
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো বনহুর আর জ্যোছনা রায়।
জ্যোছনা রায়ই প্রথমে কথা বললো-মিঃ চৌধুরী, আমার জন্য কেন আপনি নিজের অমঙ্গল ডেকে আনলেন।
হঠাৎ অদ্ভুতভাবে হেসে উঠলো বনহুর-হাঃ হাঃ হাঃ–হাঃ হাঃ হাঃ–হাঃ হাঃ হাঃ–
হাসি যেন থামতে চায় না বনহুরের।
জ্যোছনা রায় হতবাক স্তম্ভিত হয়ে পড়লো, তাকিয়ে রইলো সে কিংকর্তব্যবিমূঢ়র মত। এমন হাসি সে কোনোদিন শোনেনি।
হাসি থামিয়ে বললো বনহুর-অমঙ্গল। আমাকে এ বাড়ি ছাড়তে হবে, এইতো? মিস রায়, আপনি মনে রাখবেন-যতক্ষণ কুন্তিবাঈ ছবি শেষ না হবে ততদিন শুধু আমাকেই নয়, এ বাড়ি থেকে আপনাকেও তাড়াতে সক্ষম। হবে না আতিয়া।
আপনি জানেন না মিঃ চৌধুরী আতিয়া কত ভয়ঙ্কর মেয়ে! ভয়ঙ্কর তার চেহারা, কিন্তু মনটা সত্যি ভয়ঙ্কর নয়। আজকের ঘটনার পরও আপনি ওর সম্বন্ধে এমন উক্তি করতে পারলেন মিঃ চৌধুরী,
মিস আতিয়ার আসল রূপ আমি দেখেছি মিস রায়, মুখে বললেও সত্যি সে হৃদয়হীনা নয়।
জ্যোছনা রায় গম্ভীর হলো।
বনহুর বললো-চলুন কোথাও বেড়াতে যাওয়া যাক।
মন ভাল নেই, আজ থাক।
মন ভাল নেই বলেই তো যাবো। উঠুন মিস রায়।
জ্যোছনা রায় এবার আর কোনো আপত্তি করতে পারলো না।
বনহুর সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে কক্ষের বাইরে বেরুলো।
জ্যোছনা রায় অনুসরণ করলো তাকে।
আরফান উল্লাহ বিশ্রামকক্ষে বসে কি যেন একটা হিসাব নিকাশ করছিলেন। মনের অবস্থা খুব ভাল নয়। এ মাসে তার সবদিকে প্রচুর লোকসান গেছে।
আজও একটা গোপন ব্যবসার হিসেব দেখছিলেন আরফান উল্লাহ।
এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করলো আতিয়া। চোখেমুখে তার ক্রুদ্ধভাব ফটে উঠেছে।
কন্যার পদশব্দে চোখ তুলে তাকালেন আরফান উল্লাহ, বললেন–আতিয়া, খবর কি মা?
আব্বা, তুমি আমার সম্মান চাও, না অর্থ চাও?
একি কথা একি কথা বলছো মা?
সত্যি কথা!
কি হয়েছে বলো? বললেন আরফান উল্লাহ।
রাগত কণ্ঠে বললো আতিয়া–মিঃ চৌধুরী আমাকে অপমান করেছেন।
মিঃ চৌধুরী তোমাকে অপমান করেছেন, বলো কি!
হাঁ, কিন্তু আসলে তার কোনো দোষ নেই।
মানে? ভ্রূকুঞ্চিত করে তাকালেন আরফান উল্লাহ কন্যার মুখের দিকে।
আতিয়া পিতার পাশের সোফায় ধপ করে বসে পড়ে বললো-জ্যোছনা রায়ের কারণেই মিঃ চৌধুরী আমাকে অপমান করলেন।
একটা অদ্ভুত হাসির রেখা ফুটে উঠলো আরফান উল্লাহর মুখে, বললেন-মিস রায়?
হাঁ, আব্বা, আমি আরও লক্ষ্য করেছি-সুটিংয়ের পর প্রায়ই সে মিঃ চৌধুরীর সঙ্গে বাইরে যায়, এটা কিন্তু ভারী অন্যায়। আব্বা তুমি বলেছো মিঃ চৌধুরীকে তুমি–ভাবী জামাতা–
হাঁ, তাকেই আমি জামাতা করবো, এটা ঠিক। শুধু জামাতা নয়, মিঃ চৌধুরীকে আমার ছবির কাজের জন্য চিরদিনের জন্য আটকে রাখবো, এও ঠিক–
আর যদি মিস জ্যোছনা রায়–
হেঃ হেঃ হেঃ জ্যোছনা রায়! জ্যোছনা রায় আমার কাজে বাদ সাধবে। লক্ষ জ্যোছনা রায় এলেও আমার কাজে বা আমার ইচ্ছায় বাধা দিতে পারবে না। মিঃ চৌধুরীকে আমি জামাতা করবোই।
কিন্তু আব্বা—
না, রাগ বা অভিমান নয়। মিঃ চৌধুরী যাতে ক্ষুন্ন না হয়, তাই করবে আতিয়া।
আমি সেখান থেকে রাগ করে চলে এসেছি।
তাতে কি আছে, আবার যাবে।
এতে আমার সম্মানে বাধবে না?
স্বার্থের জন্য সম্মানবোধ বিসর্জন দিতে হবে মা! তুমি গিয়ে মিঃ চৌধুরীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবে।
তা আমি পারবো না আব্বা।
পারতে হবে মা, পারতে হবে।
তুমি আমার সঙ্গে যাবে আব্বা?
বেশ, আমিও যাবো তোমার সঙ্গে।
সেদিন সুটিং শেষ করে বনহুর আর জ্যোছনা রায় স্টুডিও থেকে বেরিয়ে এলো বাইরে। ঐ দুর্ঘটনার পর জ্যোছনা রায়ের মা বাসন্তী দেবী পরিচালক নাহার চৌধুরীকে ডেকে বলেছিলেন-দেখুন, আমাদের একমাত্র কন্যার কোনো কিছু যেন না হয়।
আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন নাহার চৌধুরী-আপনারা নিশ্চিন্ত থাকবেন, জ্যোছনা রায়ের দায়িত্বভার আমি গ্রহণ করছি। ছবি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি নিজে তার প্রতি লক্ষ্য রাখবে এবং বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাবো। আমার কোনো অসুবিধা থাকলে প্রযোজক মিঃ আরফান উল্লাহ নিজে পৌঁছে দেবেন।
কিন্তু জ্যোছনা রায় তার পৌঁছানোর দায়িত্বটা স্বেচ্ছায় তুলে দিয়েছিলো মিঃ চৌধুরীর ওপর। অনুরোধ করে বলেছিলো সে–মিঃ চৌধুরী, আমাদের বাসার পথ হয়েই আপনাকে ফিরতে হয়। আমাকে একটু পৌঁছে দিয়ে যাবেন রোজ। একথাও বলেছিলো জ্যোছনা রায়-কারও কাজ আগে হয়ে গেলে আমরা উভয়ে উভয়ের জন্য অপেক্ষা করবো, কেমন?
বনহুর হেসে জবাব দিয়েছিলো-আচ্ছা; কিন্তু যেদিন আমার কাজ একেবারেই থাকবে না সেদিন?
জ্যোছনা রায় চিন্তিতভাবে বলেছিলো-সেদিন অগত্যা বেছে নেবো একজনকে। নাহার চৌধুরী কিংবা মিঃ আরফান উল্লাহর গাড়িতে ফিরবো।
এমন সময় নাহার চৌধুরী এসেছিলেন সেখানে। পকেট থেকে কপালের ঘাম মুছে রুমালখানা পকেটে রাখতে রাখতে বলেছিলেন-আমরা দুজনে অগত্যা, কেমন?
একসঙ্গে চমকে উঠছিলো বনহুর আর জ্যোছনা।
জ্যোছনা রায়ের কথাগুলো তাহলে শুনে ফেলেছেন নাহার চৌধুরী।
জ্যোছনা রায় লজ্জায় এতটুকু হয়ে গেলো যেন। নাহার চৌধুরী হেসে বললেন-তবু যে আমাদের গাড়িতে যেতে চাইলেন এটাও আমাদের কম সৌভাগ্য নয় মিস রায়।
সে কথাও অবশ্য মিথ্যা নয়। তখন চলচ্চিত্র জগতে নায়িকা হিসেবে জ্যোছনা রায় সর্বশ্রেষ্ঠ। জ্যোছনা রায়ের বিপরীতে কাজ করার জন্য সবগুলো নায়ক অতি আগ্রহান্বিত!
কিছুদিন আগে একসঙ্গে বেশ কয়েকখানা ছবিতে জ্যোছনা রায়কে কাজ করতে হয়েছে। বিভিন্ন ছবির হিরো ছিলো বিভিন্ন জন। অনেকগুলো নায়কের বিপরীতে নায়িকার চরিত্রে কাজ করেছে সে।
কিন্তু ইদানীং জ্যোছনা রায় কুন্তিবাঈ ছবি ছাড়া কোনো ছবিতে অভিনয় করছে না। তার কারণ, আরফান উল্লাহ্ তার ছবির নায়িকাকে অন্য ছবিতে কাজ করতে দিতে রাজী নন, অবশ্য এজন্য আরফান উল্লাহ জ্যোছনা রায়কে মোটা টাকা দিয়েছিলেন।
কুন্তিবাঈ ছবি করাকালীন বহু ছবিতে অভিনয় করতে জ্যোছনা রায়ের ডাক এসেছে, কিন্তু জ্যোছনা রায় নিরুপায়-কুন্তিবাঈ ছবি শেষ না হলে কোনো ছবিতে সে কাজ করতে পারবে না।
বহু ছবির হিরো গোপনে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেছে। অনেকে প্রকাশ্যে বলেছে জ্যোছনা রায় ছাড়া তার নাকি মুড আসে না।
জ্যোছনা রায়ের প্রতীক্ষায় অনেক প্রযোজক দিন গুণছেন, কুস্তিবাঈ শেষ হলে ছবির কাজ শুরু করবেন না।
জ্যোছনা রায়কে পেয়ে কে না ধন্য হবে বলুন? এবারও বললেন নাহার চৌধুরী।
হাসলো বনহুর।
কিন্তু জ্যোছনা রায় মিঃ চৌধুরী ছাড়া কারও গাড়িতেই ফিরতে চায় না। এটা যেন তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
বনহুর কোনো আপত্তি করতে পারে না।
সেদিন স্টুডিও থেকে বেরিয়ে বনহুর আর জ্যোছনা রায় পাশাপাশি গাড়ির। দিকে এগুচ্ছিলো।
উভয়ে উভয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন কথা নিয়ে হাসাহাসি করছিলো।
পেছন থেকে ডাকলেন নাহার চৌধুরী-মিস রায়! থমকে দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে তাকালো জ্যোছনা রায় এবং বনহুর।
নাহার চৌধুরী এগিয়ে এলেন-আংগুলের ফাঁকে ধুমায়িত অর্ধ দগ্ধ সিগারেট।
জ্যোছনা রায় এবং বনহুরকে লক্ষ্য করে বললেন নাহার চৌধুরী–আপনাদের কাজ তো হয়ে গেছে।
হ্যাঁ, আমাদের কাজ হয়ে গেছে। বললো জ্যোছনা রায়।
নাহার চৌধুরী হস্তস্থিত অর্ধগ্ধ সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সিগারেটের টুকরাটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেললেন। তারপর বললেন-মিস রায়, আপনার সঙ্গে কথা আছে।
জ্যোছনা তাকালো বনহুরের মুখের দিকে।
নাহার চৌধুরী হেসে বললেন-আজ না হয় আমার সঙ্গেই যাবেন।
বনহুর বললো–মিস রায়, তাই যাবেন। তাছাড়া আজ একটু আমাকে অন্য পথে ফিরতে হচ্ছে।
জ্যোছনা রায়, কোনো কথা বললো না।
বনহুর জ্যোছনা রায় ও নাহার চৌধুরীকে লক্ষ্য করে বললো–গুডবাই।
জ্যোছনা রায় অস্ফুট কণ্ঠে বললো–গুডবাই।
নাহার চৌধুরী বললেন-আসুন মিস রায়।
জ্যোছনা রায় নাহার চৌধুরীকে অনুসরণ করলো।
স্টুডিওর বিশ্রামকক্ষে প্রবেশ করলেন নাহার চৌধুরী।
পেছনে জ্যোছনা রায়।
বিশ্রামকক্ষে প্রবেশ করে চমকে উঠলো জ্যোছনা রায়, কক্ষে একটা সোফায় বসে আছে আতিয়া, দুচোখে তার আগুন ঠিকরে পড়ছে যেন।
জ্যোছনা রায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। তাকালো সে নাহার চৌধুরীর মুখের দিকে।
কথা বললেন নাহার চৌধুরী প্রথমে-মিস রায়, আপনি জানেন কুন্তিবাঈ ছবির নায়িকার চরিত্রে কাজ করছেন আপনি, আর নায়কের চরিত্রে কাজ করছেন মিঃ চৌধুরী।
বলুন! রাগতকণ্ঠে বললো জ্যোছনা রায়।
নাহার চৌধুরী এবার ভূমিকা ত্যাগ করে বললেন-ছবির নায়ক এবং নায়িকা সম্পর্ক আপনার আর মিঃ চৌধুরীর মধ্যে। বলুন সত্য কি না?
হাঁ।
মিঃ চৌধুরীর সঙ্গে ছবির কাজ ছাড়া আপনার মেলামেশা অত্যন্ত অসন্তোষজনক। আমরা চাই না আপনি তাঁর সঙ্গে বাড়ি ফেরেন বা মেশেন।
জ্যোছনা রায় ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলে উঠলো-আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমি কারও কথা শুনতে রাজী নই। জ্যোছনা রায় কথাটা শেষ করে দ্রুত বেরিয়ে গেলো।
নাহার চৌধুরী তাকালেন আতিয়ার মুখের দিকে।
আতিয়া কুদ্ধ নাগিনীর মত ফোঁস ফোঁস করছে।
হেসে বললেন নাহার চৌধুরী-দেখুন মিস আতিয়া, ছবি শেষ না হওয়া পর্যন্ত মিস জ্যোছনা রায়কে কঠিনভাবে কিছু না বলাই ভাল। তা ছাড়া আজ তাকে কথাটা অমনভাবে বলা উচিত হয়নি, যদিও আমিই বলেছি–
কি উচিত কি অনুচিত আমি জানি মিঃ নাহার। কথাটা বলে বেরিয়ে গেলো আতিয়া।
নাহার চৌধুরী হাসলেন আপন মনে।
বাসায় ফিরে জ্যোছনা রায় নিজের ঘরে গিয়ে শয্যায় শুয়ে পড়লো। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো সে।
তার মা মেয়েকে কাঁদতে দেখে ব্যস্ত, উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়লেন। একমাত্র কন্যাই তাঁদের সম্বল, আশা-ভরসা সব। সংসারে এমন অভাব নেই যার জন্য জ্যোছনা রায়কে চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে হচ্ছে। অভিনয় জ্যোছনার পেশা নয়-নেশা।
যদিও পিতামাতার ইচ্ছা ছিলো না তবু কন্যার জিদেই বাধ্য হয়ে তারা কন্যাকে মত দিয়েছিলেন অভিনয়ে।
জ্যোছনা অল্পদিনেই শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর আসন লাভ করতে সক্ষম হয়েছে।
কন্যার কৃতিত্বে জননীর মন ভরে উঠেছে। একটা উজ্জ্বল আশার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন তাকে মোহগ্রস্ত করে তুলেছে। তিনি সব সময় ওর মঙ্গল কামনা করেন।
কন্যাকে স্টুডিও থেকে বিষণ্ণ মুখে ফিরে বিছানায় লুটিয়ে পড়তে দেখে মায়ের প্রাণ আশঙ্কিত হলো, ব্যাকুলভাবে ছুটে এলেন তিনি কন্যার পাশে। পিঠে হাত রেখে ডাকলেন-জ্যোছনা, মা-কি হয়েছে তোর?
মায়ের স্নেহভরা কথায় জ্যোছনার মন আরও আকুলভাবে কেদে উঠলো। অনেকক্ষণ মায়ের কোলে মাথা রেখে কাঁদলো জ্যোছনা রায়।
মা নীরব রইলেন কিছুক্ষণ, ভাবলেন কেঁদে মেয়ে কিছুটা শান্ত হয়েনিক। এবার জিজ্ঞাসা করলেন-মা, কি হয়েছে তোর?
জ্যোছনা রায় মুখ তুলে তাকালো মায়ের দিকে-মা, তুমি জানো আমি মিঃ চৌধুরীকে ভালবাসি। তিনি সত্যিই একজন মহৎ ব্যক্তি—
মায়ের কোলে মাথা রেখে যখন জ্যোছনা রায় কথাগুলো বলছিলো ঠিক সেই মুহূর্তে বনহুর দরজার বাইরে এসে থমকে দাঁড়ালো। তার কানে ভেসে এলো জ্যোছনা রায়ের কথাগুলো। বনহুর স্টুডিওতে লক্ষ্য করেছিলোজ্যোছনা রায়কে পরিচালক নাহার চৌধুরী ডেকে নিয়ে যাবার সময় তার মুখোভাব খুব প্রসন্ন ছিলো না, হঠাৎ জ্যোছনাকে এভাবে ডেকে নিয়ে যাবার কারণ কি থাকতে পারে–বনহুরকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছিলো ব্যাপারটা। তাই সে জ্যোছনা রায়ের সঙ্গে এসেছে দেখা করতে–কেন তাকে নাহার চৌধুরী ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন তা জানতে। যদিও এটা স্বাভাবিক ব্যাপার তবুও বনহুরের মনে হঠাৎ আজ কেন যেন একটা আশঙ্কা বারবার উঁকি দিচ্ছিলো বাসায় ফিরে কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলো না বনহুর। কাজেই চলে এসেছে জ্যোছনার নিকট সব জানতে।
বনহুর পর্দার ওপাশে দাঁড়িয়ে শুনতে পেলো জ্যোছনা রায়ের বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠস্বর-মা, আমি তাকে ভালোবেসে কোনো ভুল করিনি। তার বাইরের সৌন্দর্যের চেয়েও ভেতরটা আরও সুন্দর যার তুলনা হয় না। এতটুকু কুৎসিত ইংগিত নেই তাঁর মধ্যে–মা, আমি জানি না কেন ওরা আমাকে মিঃ চৌধুরীর সঙ্গে মিশতে দিতে চায় না? কেন তারা আমাকে সন্দেহ করে–আজ আমাকে তার সঙ্গে এক গাড়িতে আসতে দিলো না, ডেকে নিয়ে গেলেন পরিচালক, কথা আছে নাকি আমার সঙ্গে। জানো মা, গিয়ে কি দেখলাম?
বিছানায় সোজা হয়ে বসলো জ্যোছনা রায়।
জ্যোছনার মা ব্যাকুলকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন-কি মা, কি দেখলি?
মা, সে অতি বিস্ময়কর দৃশ্য। নাহার চৌধুরীর সঙ্গে বিশ্রাম কক্ষে প্রবেশ করে স্তম্ভিত হলাম। মিস আতিয়া বসে আছে, দুচোখে যেন তার আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে।
প্রযোজক আরফান উল্লাহর মেয়ে আতিয়া?
হাঁ মা।
কেন রে, কেন সে অমনভাবে সেখানে বসেছিলো?
সে কথাই তোমাকে বলছি মা, শোনো। মিস আতিয়া আমাকে দেখে অধর দংশন করতে লাগলো। আমাকে সে যে সহ্য করতে পারে না, এটা আমি জানতাম। কি করেছি, কেন আমাকে ডেকে আনা হলো সে কথাই আমি ভাবছিলাম। আমি মিস আতিয়ার মুখে তাকাতেই সে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো। বললেন নাহার চৌধুরী-মিস জ্যোছনা রায়,আপনাকে কেন ডেকেছি শুনুন–মিঃ চৌধুরীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ছবির সুটিং মুহূর্তে-তারপর নয়। ছবির কাজের বাইরে আপনাদের মেলামেশা সন্তোষজনক নয়। আমরা চাই না আপনি তাঁর সঙ্গে বাড়ি ফেরেন বা মেশেন–মা, বলো কি এমন অপরাধ করেছি যে, তাঁর সঙ্গে মিশতে পারবো না।
জ্যোছনা, আমি আগেই বলেছিলাম ওসব ভালো নয়, আজ বুঝতে পারছিস তো?
মা, আমি আর অভিনয় করবো না।
পাগলী মেয়ে, তা কি হয়।
কেন হবে না–সত্যি আমি আর অভিনয় করবো না।
এমন সময় পর্দা ঠেলে কক্ষে প্রবেশ করে বনহুর।
জ্যোছনার মা বলে ওঠেন–বাবা তুমি এসেছো?
আজকাল জ্যোছনার সঙ্গে প্রায়ই বনহুরকে এ বাড়িতে আসতে হতো, জ্যোছনার তা তাই তাকে তুমি বলেই সম্বোধন করতেন।
বনহুর একটা আসনে বসে পড়ে বললো-মিস রায় কখন এসেছেন?
এই তো কিছুক্ষণ হলো।
আমি জানতে এলাম উনি পৌঁছেছেন কিনা! চলি তাহলে?
না না, একটু বসো বাবা। বললেন জ্যোছনার মা। একটু থেমে পুনরায় বললেন-জানো, জ্যোছনা আর ছবিতে কাজ করতে রাজী নয়।
হাসলো বনহুর-মুখে রাজী নয় বলা সহজ, আসলে অতো সহজ নয়, কারণ উনি চুক্তিবদ্ধ বিশেষ করে কুন্তিবাঈ ছবি ওঁকে শেষ করতেই হবে, তারপর ইচ্ছা করলে অভিনয় থেকে সরে আসতে পারেন।
তাই ভালো হবে। তাই ভালো হবে বাবা।
এবার বললো জ্যোছনা রায়-কিন্তু তাদের কথা অনুযায়ী কাজ করতে রাজী নই আমি।
শান্তকণ্ঠে বললো বনহুর-এই তো সামান্য আর কিছুদিন। কৃত্তিবাঈ ছবির সুটিং শেষ হতে আর মাসখানেক লাগতে পারে–
হাঁ, এরপর আমি আর কোনো ছবিতে কাজ করবো না।
বেশ, তাই হবে। জ্যোছনা রায়ের কথায় বললো বনহুর।
জ্যোছনার মা উঠে দাঁড়ালেন-বসো বাবা, তোমাদের জন্য একটু জলখাবার নিয়ে আসি।
না থাক। বললো বনহুর।
কিন্তু ততক্ষণ বেরিয়ে গেছেন জ্যোছনার মা।
জ্যোছনা রায় তাকিয়ে ছিলো বনহুরের দিকে। তার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হতেই বললো সে-মিঃ চৌধুরী, জানেন আমাকে আজ পরিচালক কেন তখন ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন? ছবির কাজের বাইরে আপনার সঙ্গে–
মিস রায়, আমি সব শুনেছি; আপনি যখন মায়ের কাছে বলছিলেন তখন দরজার বাইরে আমি দাঁড়িয়েছিলাম।
মিঃ চৌধুরী।
হাঁ মিস রায়, আপানি নাভাস হবেন না।
কিন্তু–থামলো জ্যোছনা।
বলুন?
কিন্তু আমার নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমি কারও কথা শুনতে রাজী নই। ছবির কাজের বাইরে আমার ইচ্ছামত যা খুশি তাই করবো বা করতে পারি।
আচ্ছা, আমি পরিচালক নাহার চৌধুরীকে বলবো আপনার কথাটা।
তাকে নয়, আরফান উল্লাহকে বলবেন দয়া করে। একটু থেমে বললো জ্যোছনা রায়–জানি না, আতিয়া কেন আমাকে বারবার এমনভাবে অপমান করছে।
কুন্তিবাঈ ছবির পর সব শেষ হয়ে যাবে মিস রায়। কারণ, আতিয়ার যত আক্রোশ আমার ওপর।
আপনার ওপর!
হাঁ, আমার ওপর, আর তারই জের চলছে আপনার ওপর বুঝলেন?
জ্যোছনা রায় সরে এলো বনহুরের পাশে–মিঃ চৌধুরী, আমার মনে হয় মিস আতিয়া আপনাকে–
ভালবাসে এই তো বলতে চাইছেন?
হাঁ মিঃ চৌধুরী, নাহলে সে কিছুতেই আপনার পাশে আমাকে সহ্য করতে পারছে না কেন?–আপনি ঠিকই বলেছেন মিস রায়।
তবে কি–তবে কি আপনি–আপনি–
সঙ্গে সঙ্গে জ্যোছনা রায় দুহাতে মাথাটা টিপে ধরলো। তারপর স্থিরদৃষ্টি মেলে তাকালো বনহুরের সুন্দর দীপ্ত মুখমণ্ডলে।
বনহুরও তাকিয়ে আছে।
জ্যোছনা রায়ের শরীর যেন টলছে-পড়ে যাবে এই মুহূর্তে।
বনহুর এগিয়ে এসে ওকে ধরে ফেললো।
জ্যোছনা রায় বনহুরের কাধে মাথা রাখলো, কোনো কথা তার মুখ দিয়ে বের হলো না।
বনহুর পুনরায় বললো-মিস রায়? আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন?
হাঁ, আমাকে শুইয়ে দিন।
বনহুর জ্যোছনা রায়কে শয্যায় শুইয়ে দিয়ে বললো-মিস রায়, আপনি ঘুমান, আমি চললাম।
জ্যোছনা কোনো জবাব দিলো না। বনহুর লঘু পদক্ষেপে কক্ষ ত্যাগ করলো।
পরমুহূর্ত কক্ষে প্রবেশ করলেন জ্যোছনার মা, হাতে তার জল খাবারের ট্রে। অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন-সে কই জ্যোছনা?
চলে গেছে।
চলে গেছে! বলিস কি, আমি জলখাবার আনতে গেলাম।
কেন গেলো মা? তুমি জানো না–মিঃ চৌধুরীর মনও পাল্টে গেছে। আমি বড় হতভাগি–দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলো জ্যোছনা রায়।
জ্যোছনার মা হতবাক স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, কন্যার বুকের ব্যথা মায়ের অন্তরেও আঘাত করলো।
০৩.
বনহুরের অন্তর্ধানের পর আস্তানায় একটা বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে সত্য, কিন্তু তাই বলে এতগুলো অনুচর একেবারে চুপচাপ বসে থাকতে পারে না।
সর্দারের অনুপস্থিতিতে রহমান তার অনুচরগণকে পরিচালনা করছে বটে কিন্তু বনহুরের অভাব তারা সব সময় অনুভব করছে। বিশেষ করে অশ্ব তাজ একেবারে জীর্ণশিৰ্ণ হয়ে পড়েছে। বনহুর নিজে ওকে ছোলা, ঘাস খাওয়াতে, গা নেড়ে আদর করতো। তাজ সবচেয়ে বেশি প্রিয় দস্যু বনহুরের।
আজ কতদিন মনিবের স্পর্শ পায়নি তাজ, সে একেবারে ঝিমিয়ে পড়েছে।
রহমানের মনের অবস্থাও তাই; কতকটা তাজের মতোই। কিন্তু, তাজ পশু আর রহমান মানুষ। মনকে শক্ত করে নিয়েছে রহমান, ভেঙ্গে পড়লে তার চলবে না। সর্দারের এত পরিশ্রমে গড়া আস্তানা নষ্ট হতে দেবে না সে।
রহমান শুধু আস্তানাই ঠিক রাখেনি, মাঝে মাঝে শহরে গিয়ে সর্দার গৃহিণীর সন্ধানও জেনে আসে।
একদিন মনিরা দোতলার রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে, হঠাৎ তার নজর চলে গেলো সামনের বাগানে। বাগানে খেলা করছিলো নূর। অদূরে একটা পাথরাসনে বসে নূরকে খেলা দিচ্ছিলেন বৃদ্ধা সরকার সাহেব।
একটা বল নিয়ে ছুটাছুটি করছিলো নূর। বৃদ্ধ সরকার সাহেব হাসছিলেন।
হঠাৎ মনিরা লক্ষ্য করলো-বাগানের মধ্যে হাস্নাহেনা ঝোপের আড়ালে গালপাট্টা বাঁধা একটা লোক উঁকিঝুকি মারছে। লোকটার বলিষ্ঠ চেহারা, দীর্ঘ দেহ।
সন্দেহ হলো মনিরার।
কে এই লোক, কি এর উদ্দেশ্য, কেনই বা অমনভাবে উকিঝুঁকি মারছে? উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই মহৎ নয় কিন্তু কি উদ্দেশ্য ওর? নূরকে চুরি করতে এসেছে নিশ্চয়ই–মনিরা দ্রত কক্ষে প্রবেশ করে বন্দুকটা বের করে গুলি ভরে নিলো। তারপর ফিরে এসে দাঁড়ালো পূর্বের সেই স্থানে যেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নূর এবং সরকার সাহেবকে।
কিন্তু সরকার সাহেব কই, একটু পূর্বেই সরকার সাহেবকে যে স্থানে বসে থাকতে দেখেছিলো মনিরা সেখানে তিনি নেই।
অবশ্য সরকার সাহেব ঠিক সেই দণ্ডে কোনো একটা কাজে বাগানের গেটে গিয়েছেন, এক্ষুণি ফিরে আসবেন তিনি।
মনিরা চমকে উঠলো, নূর কোথায়, কিন্তু পরক্ষণেই বিষ্ময়ে স্তম্ভিত হলো, গালপাট্টা বাঁধা লোকটা নূরের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে নূরকে আদর করছে।
রুদ্ধ নিঃশ্বাসে মনিরা বন্দুকটা বাগিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
এক সেকেণ্ড–তাহলেই লোকটার বুকে গিয়ে বিদ্ধ হবে মনিরার বন্দুকের গুলী, কিন্তু ছুড়তে পারছে না-কারণ লোকটার কোলে তখন নূর।
মনিরার নিঃশ্বাস দ্রুত বইছে। লোকটা নিশ্চয়ই নুরকে চুরি করতে এসেছে। কিন্তু আজ মনিরা কিছুতেই শয়তানটাকে ক্ষমা করবে না।
লোকটা নূরকে তখনও আদর করছে। মাঝে মাঝে সচকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকাচ্ছে এদিক ওদিক।
মনিরা অধর দংশন করছে। শয়তানটা তার নুরকে নিয়ে পালাবে এবার মনে হচ্ছে। কিন্তু কি আশ্চর্য! লোকটা নূরকে আদর করে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। এবার লোকটা চলে গেলো ঝোপটার আড়ালে। বারকয়েক লুকিয়ে ঝুকে দেখলো নূরকে, তারপর চলে গেলো সেখান থেকে বাগানের বেড়া টপকে ওপারে।
মনিরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। বন্দুকসহ হাতখানা নামিয়ে নিলো নীচে।
সরকার সাহেব ততক্ষণে এসে পড়েছেন নুরের পাশে। মনিরা ফিরে এলো নিজের কক্ষে, ভাবতে লাগলো–কে এই লোকটা? কি উদ্দেশ্যে সে এখানে এসেছিলো? নূরকে অমন করে আদর করলোই বা কেন?
মনিরা ভাবছে, কিন্তু ভেবে ভেবে কোনো জবাব খুঁজে পেলো না।
এমন সময় নূর বল হাতে ছুটে এলো মনিরার পাশে। সরকার সাহেব পেছনে পেছনে এসে দাঁড়ালেন সেখানে।
মনিরা তখনও সেই চিন্তা করছিলো। নূর আর সরকার সাহেবকে দেখে বললো সে-আপনারা এসেছেন!
সরকার সাহেব বললেন-নূরের খেলা শেষ হয়েছে মা মণি!
নূর জড়িয়ে ধরলো মনিরাকে–আম্মা, জানো একটা লোক আমাকে আদর করলো–
মনিরা বললো এবার সরকার সাহেবকে লক্ষ্য করে-সরকার চাচা, আপনি নূরকে ছেড়ে কোথায় গিয়েছিলেন?
কেন মা?
আপনি যখন বাগান থেকে সরে গিয়েছিলেন তখন একটা গাল-পাট্টা বাঁধা লোক নূরকে কোলে নিয়ে আদর করছিলো–
তারপর? তারপর মা?
তারপর আমি তো মনে করলাম নিশ্চয়ই কোনো দুষ্ট লোক নূরকে চুরি করতে এসেছে। কারণ, আমি রেলিংয়ের ধারে তখন দাঁড়িয়েছিলাম। লোকটার সন্দেহজনক গতিবিধি লক্ষ্য করে আমি ছুটে এসে বন্দুকটা বের করে গিয়ে দাঁড়ালাম, যদি নূরকে নিয়ে পালাবার চেষ্টা করে তাহলে শেষ করে দেব। কিন্তু আশ্চর্য, লোকটা নূরকে আদর করে পুনরায় নামিয়ে দিলো কোল থেকে। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম।
সরকার সাহেব অবাক হয়ে শুনলেন, অস্ফুট কন্ঠে বললেন–কই, আমি তো কিছু জানিনা মা?
আপনি তখন সরে গিয়েছিলেন ওপাশে।
ওঃ আমাকে একজন লোক ডেকে জিজ্ঞেস করছিলো-এটাই কি চৌধুরীবাড়ি? আমি তার প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলাম কিন্তু তা তো সামান্য কয়েক মিনিট?
হাঁ সরকার চাচা, ঐ সময়ের মধ্যেই গালপাট্টা বাঁধা লোকটা এসেছিলো সেখানে।
সত্যি আমি আশ্চর্য হচ্ছি। নিশ্চয়ই সে কোনো কুমতলব নিয়ে এসেছিলো। কথাগুলো বললেন সরকার সাহেব।
মনিরা বললো-সরকার চাচা, আমার মনে হয় সে যেই হোক, কোনো খারাপ মতলব নিয়ে আসেনি। কারণ, সে প্রচুর সময় পেয়েছিলো, নূরকে নিয়ে পালাতে পারতো। অবশ্য পালাবার পূর্বেই আমি তাকে যমালয়ে পাঠাতাম।
মনিরা নূরকে বুকে তুলে নিয়ে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলো ওর গাল দুটো।
নূর কচি দুটি হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো মার গলা।
সরকার সাহেব হাসতে লাগলেন।
এমন সময় মরিয়ম বেগম এলেন কক্ষে। যদিও তিনি পুত্রশোকে মুহ্যমান। তবু মনিরা ও নূরকে পেয়ে তার বুকে একটা অনাবিল আনন্দ ও শান্তিধারা বয়ে যায়। মরিয়ম বেগম খুশিভরা কণ্ঠে বললেন-মা-ছেলে খুব যে আনন্দ করা হচ্ছে!
এখানে নূরকে নিয়ে সরকার সাহেব, মরিয়ম বেগম এবং মনিরা যখন আনন্দে আত্মহারা, তখন কান্দাই বনের পথে দুজন অশ্বারোহী পাশাপাশি এগিয়ে চলেছে।
অশ্বারোহীদ্বয় একজন রহমান, দ্বিতীয়জন কায়েস।
কিছুক্ষণ পূর্বে চৌধুরীবাড়ির বাগানে গালপাট্টা বাঁধা যে ব্যক্তি নূরকে আদর করছিলো সে ব্যক্তি অন্য কেউ নয়-বনহুরের প্রধান অনুচর রহমান।
মাঝে মাঝে রহমান গোপনে মনিরার সন্ধান নিতে আসতো।
আজও কায়েসকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলো সে মনিরার সন্ধান নিতে।
একটা চাকরের নিকট মনিরার সুসংবাদ গ্রহণ করে যখন ফিরছিল রহমান তখন হঠাৎ তার দৃষ্টি চলে গিয়েছিলো বাগানে খেলায়রত নূরের ওপর। কেমন যেন চমকে উঠেছিলো রহমান-এ যে তার সর্দারের হুবহু প্রতিচ্ছবি-সেই চোখ, সেই মুখ; সেই নাক–অবিকল দেখতে তারই মত। বিস্ময় জেগেছিলো রহমানের মনে, নিশ্চয়ই এটা তাদের সর্দারের সন্তান।
কায়েসকে ডেকে দেখিয়ে বলেছিলো রহমান-কায়েস, দেখতে পাচ্ছো?
কি?
ঐ দেখো বাগানের দিকে তাকিয়ে।
কায়েস তাকিয়ে থ বনে গেলো হঠাৎ আনন্দধ্বনি করতে যাচ্ছিলো কায়েস, রহমান ওর মুখে হাতচাপা দিয়ে বললো-চুপ।
কায়েস সামলে নিলো নিজেকে। তাই তো, এ যে একেবারে রাজপুত্র। আনন্দ বিগলিত কণ্ঠে বললো কায়েস-এ যে আমাদের সর্দারের ছেলের মত মনে হচ্ছে।
রহমান বললো-মনে হচ্ছে নয়, নিশ্চয়ই তার সন্তান।
কিন্তু তা কেমন করে হয়। একটু ভেবে বললো কায়েস।
রহমান গম্ভীর গলায় বললো-আমি বললাম এই শিশু আমাদের সর্দারের সন্তান না হয়েই পারে না।
রহমান আর বিলম্ব না করে বাগানের বেড়া টপকে প্রবেশ করে ছিলো ভেতরে। তারপর, শিশুটাকে আদর করবার সুযোগ করে নিয়েছিলো। সাবধানে।
রহমান বললো এবার কায়েসকে–কায়েস, আমি শপথ করে বলছি, এটাই সেই ছেলে-যাকে নূরী একদিন সন্তানের মত মানুষ করেছিলো–
কেমন করে বুঝলে রহমান?
যদিও বেশ বড় হয়েছে, কিন্তু চিনতে আমার ভুল হয়নি। কিন্তু আর একটা কথা, আমি খোকাকে নাম জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
কায়েস আগ্রহভরা কণ্ঠে বললো-তারপর?
খোকা বললো, আমার নাম নূর। কিন্তু নূরীর শিশুটার নাম ছিল মনি।
কায়েস চমকে উঠলো—কি বললে রহমান, খোকা তার নাম বললো নূর?
হাঁ, ঐ নাম সে বলেছে।
কায়েসের মুখে হাসি ফুটে উঠলো-বললো নূর–সে নূর–ঠিক ধরেছো। রহমান, এটাই আমাদের সর্দারের সন্তান নূর-বৌরাণীর ছেলে।
মনিরা ও নূরের কাহিনী সব বললো কায়েস রহমানের কাছে। তারপর থেকেই রহমান প্রায়ই যেতে শুরু করলো শহরে। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে আসতো নূরকে। কোনোদিন ফলমূল, কোনোদিন সোনার আংটি, কোনোদিন সোনার মালা পরিয়ে দিয়ে আসতো তার গলায়।
মনিরার বিস্ময় চরমে উঠলো, কে এই লোক-যে তার সন্তানকে এভাবে এসব দিতে শুরু করেছে। মনে মনে ভাবলো মনিরা নিশ্চয়ই কোনো অভিসন্ধি নিয়ে এসব দিচ্ছে লোকটা।
একদিন মনিরা সরকার সাহেব বা নকীবের সঙ্গে নূরকে বাইরে না পাঠিয়ে সে নিজে এলো বাগানে নূরের সঙ্গে। নূরকে খেলতে দিয়ে চুপ করে সরে গেলো মনিরা আড়ালে।
নূর বল নিয়ে খেলা করছে আপন মনে। কিন্তু লোকটা এলো না।
একদিন দুদিন তিনদিন কেটে গেলো–লোকটার সাক্ষাৎ নেই। মনিরা অনেক সুযোগ দিয়েছে, নূরকে একা রেখে সরে থেকেছে আড়ালে।
সেদিনও মনিরা এলো নূরকে নিয়ে বাগানে। প্রতিদিনের মত আজও মনিরা নূরকে খেলায় মাতিয়ে দিয়ে সরে পড়লো। একটা পাইন ঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে দেখতে লাগলো।
প্রায় ঘন্টাখানেক কেটে গেলো, মনিরা ভাউলো–লোকটা আজও আসবেনা। পাইন ঝাড়ের আড়াল থেকে যেমনি বের হতে যাবে, অমনি একটা খস খস শব্দ কানে এলো মনিরার। সচকিতভাবে সরে দাঁড়ালো মনিরা, পাইন ঝাড়ের আড়ালে তাকিয়ে দেখলো-হাঁ, সেই লোকটা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে লোকটা।
অদূরে নূর বল নিয়ে ছুটাছুটি করছে।
মনিরা রুদ্ধ নিঃশ্বাসে প্রতীক্ষা করতে লাগলো, আজ সে হাতে নাতে ধরে ফেলবে। কে ঐ লোকটা যে দিনের পর দিন তার নূরকে এভাবে আকর্ষিত করছে?
লোকটা নূরের পাশে গিয়ে আস্তে শিস দিলো।
নূর অমনি ফিরে তাকালো তার দিকে, সঙ্গে সঙ্গে বল ছেড়ে ছুটে এলো লোকটার পাশে।
লোকটা দুহাত প্রসারিত করে ওকে তুলে নিলো কোলে।
মনিরা শুনতে পেলো নূরের কণ্ঠস্বর-সিপাহী, আজ আমার জন্য কি এনেছো?
মনিরা স্তব্ধ হয়ে শুনছে ওর কথাবার্তা।
ফিস ফিস করে বললো লোকটা-কি নেবে তুমি বলো?
নূরের কণ্ঠ–আমি–আর কিছু নেবো না।
কেন?
আম্মা বকবেন।
এই দেখো কি এনেছি তোমার জন্য–
সঙ্গে সঙ্গে মনিরা বেরিয়ে এলো পাইন ঝাড়ের আড়াল থেকে। নূর এবং লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে কঠিন কণ্ঠে বললো সে-কে তুমি? শয়তান কোথাকার–
রহমান নূরকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
মনিরা নূরকে টেনে নিলো নিজের কাছে। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো সে, ঠিক সেই মুহূর্তে বেরিয়ে এলো আড়াল থেকে কায়েস–বৌরাণী, বৌরাণী–ও শয়তান নয়, রহমান–
মনিরা চমকে উঠলো, কোথায় যেন এই স্বর সে শুনেছে? কোথায় যেন দেখেছে ওকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালো মনিরা কায়েসের দিকে।
কায়েস বললো-বৌরাণী, আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি-আমিই সে কায়েস–
মনিরা অস্ফুটধ্বনি করে উঠলো-কায়েস।
হাঁ, আমি কায়েস আর আপনার সামনে যে দণ্ডায়মান সে সর্দারের প্রধান অনুচর রহমান। কিন্তু বৌরাণী, এই শিশু কে? বলুন-বৌরাণী, এই কি আপনার সেই নূর?
কায়েস, সত্যিই ধরেছে, এটাই আমার সেই হারানো ধন নূর। মনিরা রহমানের দিকে তাকালো-আমাকে মাফ করো রহমান, আমি তোমাকে চিনতে না পেরে–
রহমান বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো-বৌরাণী!
নূর এবার বুঝতে পারলো-তার আম্মা লোকটার ওপর প্রথমে বিরক্ত হলেও পরে বেশ স্বচ্ছ হয়ে এসেছে। নূর একবার আম্মা আর একবার রহমানের মুখে তাকাচ্ছে।
রহমান নূরকে টেনে নিলো আবার কোলের কাছে। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো-বৌরাণী, আমরা সর্দারকে হারিয়ে একেবারে মূহ্যমান হয়ে পড়েছি। জানিনা তিনি জীবিত না মৃত—
মনিরা নিশ্চল পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু।
কায়েস আর রহমানের চোখও অশ্রু হল হল করছে।
মনিরা বললো এবার-জানি, তোমরাও আমারই মত ব্যথিত দুঃখিত তোমাদের সর্দারের জন্য। কিন্তু মনে রেখো রহমান, তোমাদের সর্দার মৃত নয় জীবিত আছে-আমার মন বলছে সে জীবিত আছে।
রহমান আর কায়েসের মুখমণ্ডল প্রসন্ন হয়ে উঠলো, বললো। রহমান-বৌরাণী, আপনার কথা যেন সত্য হয়।
আচ্ছা, আমরা তাহলে চলি বৌরাণী? বললো কায়েস।
মনিরা আঁচলে চোখের পানি মুছে বললো-বসবে না?
রহমান বললো আমরা আবার আসবো–নূরকে আদর করে বললো-সর্দারের অভাব আমরা ওকে দিয়েই পূরণ করবো বৌরাণী। আচ্ছা, আজ যাই আমরা?
এসো। বললো মনিরা।
রহমান আর কায়েস অদৃশ্য হলো বাগানের ওপাশে।
মনিরা নূরকে কোলে করে দাঁড়িয়ে রইলো ওদের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে।
০৪.
সেদিনের পরে জ্যোছনা রায় বনহুরের গাড়িতে একটা দিনও বাড়ি ফেরেনি বা ইচ্ছা করে কোনো সময় তার সঙ্গে কথা বলেনি। বনহুর বুঝতে পেরেছে-জ্যোছনা রায় সেদিন তার ঐ কথার পর ভীষণ মুষড়ে পড়েছে। তার অন্তরে যে একটা ব্যথার জ্বালা তাকে অহরহ দগ্ধীভূত করছে, জ্যোছনা। রায়ের মুখোভাবে তা স্পষ্ট বোঝা যায়।
বনহুর যতদূর সম্ভব জ্যোছনা রায়কে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করতো। সুটিং ছাড়া জ্যোছনা রায়ের সঙ্গে সে তেমন কোনো কথা বলতো না। বরং আতিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে দিলো।
এখন আতিয়া সুটিংয়ের পর নিজে বনহুরকে নিয়ে যায় প্রতিদিন। পৌঁছে দেয় তার বাসায়।
জ্যোছনা রায় চেয়ে দেখে, কোনো কিছু বলে না।
সুটিংয়ের অবসরেও আতিয়া জ্যোছনা রায়কে দেখিয়ে দেখিয়ে বনহুরের হাত ধরে স্টুডিওর বাগানে গিয়ে বসে, হাসে, গল্প করে, কখনও বা বাগান থেকে গোলাপ ছিঁড়ে গুঁজে দেয় তার কোটের কলারের ফাঁকে।
জ্যোছনা রায় স্টুডিওর রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখে। একটা ক্ষুব্ধ ভাব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তার মনে। সরে যায় তখন সে রেলিংয়ের পাশ থেকে।
হয়তো গিয়ে দাঁড়ায় ওদিকের নির্জন রেলিংটার ধারে। আজ কাল জ্যোছনা রায়ের কাছে নির্জনতাই যেন বেশি প্রিয়। ছবিতে কাজ না করলে নয় তাই সে আসে স্টুডিওতে। যতক্ষণ ছবির প্রয়োজন ততক্ষণই স্টুডিওতে থাকে। সুটিং শেষ হলেই আস্তে স্টুডিওর সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে নীচে। গাড়িতে বসে ড্রাইভারকে বলে–চলো।
প্রযোজক কিংবা পরিচালক কারও গাড়িতেই সে যায় না, তাদের নিতান্ত অনুরোধেও জ্যোছনা রায় রাজী হয়নি তাদের গাড়িতে যেতে।
ইতিমধ্যে জ্যোছনা রায় স্টুডিওর বিশ্রামকক্ষে বসে আর এক দিন অরুণ কুমারের একখানা চিঠি পেয়েছিলো। চিঠিটা এইরূপঃ
জ্যোছনা,
তোমার অভাবে আজ আমি অন্ধকার দেখছি। এতটুকু দয়া-মায়া তুমি করলে না। কিন্তু মনে রেখো-হয় তুমি আমার হবে, নয় যমের ঘরে যাবে। হত্যা তোমাকে আমি করবোই। কেউ তোমাকে রক্ষা করতে পারবে না।
অরুণ
এ চিঠি পাবার পরও জ্যোছনা রায় এতটুকু ঘাবড়ে যায়নি বা বিচলিত হয়নি।
পরিচালক নাহার চৌধুরী চিঠিখানা পুলিশে ডায়রী করে দিয়েছেন, তাঁদের ছবির নায়িকার জীবন হানি যাতে না হয় তার জন্য নাহার চৌধুরী এবং আরফান উল্লাহ পুলিশের সাহায্য কামনা করে অনুরোধ জানিয়েছেন।
হঠাৎ যদি কোনো একটা অঘটন ঘটে বসে তাহলে সম্পূর্ণ ছবি নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। কাজেই সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় পড়েছেন আরফান উল্লাহ এবং এ কারণেই তিনি নিজে জ্যোছনা রায়কে সাবধানে চলাফেরার জন্য বারবার বলে দিয়েছেন।
কিন্তু জ্যোছনা রায় কারও কথা কানে নেয় না, নিজের প্রতি আজকাল সে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে পড়েছে।
আজ সুটিং শেষে জ্যোছনা রায় যখন রেলিংয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, তখন তার দেহ মন শিথিল হয়ে এসেছে। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে নির্জন রেলিংটার ধারে এসে দাঁড়ালো সে।
একটু পূর্বে জ্যোছনা রায়ের সামনে দিয়ে আতিয়া মিঃ চৌধুরীকে ধরে নিয়ে গেলো বাগানের দিকে। কি যেন কথা নিয়ে হাসছিলো আতিয়া।
মিঃ চৌধুরীর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হতেই জ্যোছনা রায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছিলো অন্যদিকে।
আতিয়ার চিকন হাসির সুর এখনও কানে লেগে আছে জ্যোছনা রায়ের। রেলিংয়ে ভর দিয়ে তাকিয়েছিলো সে সামনের ধূসর আকাশের দিকে। মনের আকাশেও তার কালো মেঘ জমাট বেঁধে উঠেছে। কত প্রশ্নই না আজ উঁকি দিয়ে যাচ্ছে তার হৃদয়ের কোণে। বিশ্বাস হয় না জ্যোছনা রায়ের, মিঃ চৌধুরী তাকে এতদিন ছলনা করে এসেছেন। মিথ্যা অভিনয় তিনি করেছেন, তার সঙ্গে…না না, বিশ্বাস হয় না তার এ কথা –এতদিনের কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে তার সাথে। আজ সব তার মানসপটে স্পষ্ট ভেসে উঠছে।
কখন যে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে খেয়াল নেই জ্যোছনা রায়ের।
সে স্টুডিওর বিপরীত দিকে নির্জন রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়েছিলো। অন্য সবাই চলে গেছে, মিঃ আরফান উল্লাহ এবং নাহার চৌধুরী জ্যোছনা রায়ের খোঁজ করেছিলেন কিন্তু তাঁরাও জ্যোছনা রায় চলে গেছে মনে করে স্টুডিও ত্যাগ করেছিলেন।
কিন্তু বনহুর লক্ষ্য করেছিলো, জ্যোছনা রায় আজ স্টুডিও থেকে যায়নি। সে বাগানে আতিয়ার পাশে বসে থাকলেও দৃষ্টি ছিলো স্টুডিওর পথে। কে যায় বা আসে সেদিকে খেয়াল ছিলো তার।
জ্যোছনা রায় স্টুডিও থেকে বেরিয়ে যায়নি সে তা দেখেছে। মিঃ আরফান উল্লাহ যখন জ্যোছনা রায়ের খোঁজে ব্যতিব্যস্ত হয়ে এসে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন-মিঃ চৌধুরী, মিস রায় কি চলে গেছে?
বনহুর জবাব দেবার পূর্বেই বেশ কড়া মেজাজে বলে উঠেছিলো আতিয়া-জ্যোছনা রায়ের খোজ উনি কি করে বলবেন? খুঁজে দেখোগে আব্বা। তোমাদের ছবির হিরোইন শেষে হারিয়ে না যায়!
বনহুরের মনে কথাটা যেন বিষ ছড়িয়ে দিয়েছিলো। একটা ঘূণার ভাব তার অন্তরে খোঁচা দিতে শুরু করেছিলো, তবে কোনো কথাই আর বলেনি বন তখন।
আতিয়া যখন পুনরায় বলেছিলো-মিঃ চৌধুরী, অমন হয়ে পড়লেন কেন? বনহুর হেসে বলেছিলো-আতিয়া, ভুলেই গিয়েছিলাম, আমার একটু দরকার আছে। ফিরতে বিলম্ব হবে। তুমি বরং আজ তোমার আব্বার সঙ্গে যাও। কিন্তু মনে রেখো, কাল সকালে তোমার জন্য চায়ের টেবিলে অপেক্ষা করবো।
বনহুরের মুখের কথাগুলো তার কানে মধু বর্ষণ করলো। অন্যদিন হলে আপত্তি করে বসতো-তা হবে না, চলুন আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে তবে বাড়ি ফিরবো। কিন্তু আজ আতিয়া সে ব্যাপারে কোনো কথা বললো না।
একটু হেসে বললো-নিশ্চয়ই আসবো মিঃ চৌধুরী। তারপর পিতাকে লক্ষ্য করে বললো আতিয়া-আব্বা, ওনার আজ একটু কাজ আছে। চলো, আমরা যাই।
আরফান উল্লাহ কি যেন ভেবে বললেন-আমারও কিছু কাজ আছে। বাসায় ফিরতে দেরি হবে, তুমি বরং একাই যাও মা।
আতিয়া হাসিমুখে বললো-বেশ, আজ তোমরা না গেলে, আমিই চললাম।
ভ্যানিটি দুলিয়ে গাড়ির দিকে পা বাড়ালো আতিয়া।
আরফান উল্লাহ বনহুরের কাছ থেকে বিদায় নিলেন-স্টুডিওর অফিসে আমার কাজ আছে। চলি, গুড বাই!
বনহুর অস্ফুটকণ্ঠে বললো-গুড বাই।
সন্ধ্যার ঝাপসা অন্ধকারে চিত্রার্পিতের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে জ্যোছনা রায়। বনহুরের সাথে বিগত দিনের স্মৃতি মন্থন করে চলেছে সে।
০৫.
ক্রমে সন্ধ্যার অন্ধকার কখন যে জমাট বেঁধে উঠেছে খেয়াল নেই জ্যোছনা রায়ের।
হঠাৎ চমকে উঠলো জ্যোছনা রায়, কে যেন পাশে এসে দাঁড়ালো বলে মনে হলো তার। বললো জ্যোছনা রায়-কে?
অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর-আমি।
আপনি এখানে কেন?
জ্যোছনা, এখনও তমার দিব্যচক্ষু খুললো না?
অরুণ বাবু, আমি আপনার কোন কথা শুনতে রাজি নই।
কবেই বা তুমি আমার কথা শুনেছো বা শুনতে রাজী হয়েছে?
জ্যোছনা রায় কুদ্ধকণ্ঠে বললো-আমাকে কোনো কথা বলে লাভ হবে না অরুণ বাবু।
চাপাস্বরে হেসে উঠলো অরুণ কুমার, তারপর হাসি থামিয়ে বললো-জ্যোছনা, ভুল করে আলেয়ার আলোর পেছনে ধাওয়া করো না। মিঃ চৌধুরী তোমাকে চায় না, আর তুমি তার জন্য পাগল। হাঃ হাঃ হাঃ, অদ্ভুত মেয়ে তুমি!
জ্যোছনা রায় অন্ধকারে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালো অরুণ কুমারের দিকে, তারপর দ্রুত চলে যাচ্ছিলো, অরুণ কুমার খপ্ করে ধরে ফেললো জ্যোছনা রায়ের হাত-জ্যোছনা, আজ তোমাকে ছাড়ছি না।
ছেড়ে দিন, ছেড়ে দিন বলছি।
কিছুতেই ছাড়বো না।
আমি চীৎকার করবো।
স্টুডিও বন্ধ হয়ে গেছে, কেউ নেই এদিকে।
ছেড়ে দিন, নইলে ভাল হবে না বলছি।
ভাল আর কবে হলো, জানি হবেও না কোনোদিন। জ্যোছনা রায়কে জোর করে টেনে নিয়ে চললো অরুণ কুমার স্টুডিওর গেটের দিকে।
জ্যোছনা রায় চীৎকার করে উঠলো-বাঁচাও, বাঁচাও…..। ঠিক সেই মুহূর্তে কে একজন অন্ধকারে দ্রুত এসে চেপে ধরলো অরুণ কুমারের গলা। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড একটা ঘুষি এসে পড়লো তার নাকের ওপর।
অরুণ কুমার টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলো মাটিতে।
জ্যোছনা রায় দাঁড়িয়ে রইলো থ মেরে।
আক্রমণকারী পুনরায় ঝাঁপিয়ে পড়লো অরুণ কুমারের ওপর। চললো ভীষণ ধস্তাধস্তি।
ইতিমধ্যে জ্যোছনা রায়ের আর্তচীৎকারে টুডিওতে যে দুতিনজন তখনও কর্মরত ছিলো, তারা ছুটে এলো ব্যস্তভাবে।
যে স্থানে এই ঘটনা ঘটেছিলো সেই স্থানটি ছিলো সম্পূর্ণ অন্ধকার। কয়েকজন টর্চলাইট নিয়ে ছুটে এলো সেখানে। আলো জ্বলতেই চক্ষুস্থির সকলের। দেখলো সবাই, অরুণ কুমারের বুকে বসে তার টুটি টিপে ধরেছে মিঃ চৌধুরী।
মুখে আলো পড়তেই মিঃ চৌধুরী মানে দস্যু বনহুর উঠে দাঁড়ালো, রাগে অধর দংশন করছে সে।
দুজন লোক এগিয়ে গিয়ে অরুণ কুমারকে উঠিয়ে শরীরের ধুলো ঝেড়ে দিতে লাগলো। নাক দিয়ে তখন রক্ত গড়িয়ে পড়ছিলো তার। ক্রুদ্ধ হিংস্র দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলো অরুণ কুমার বনহুর আর জ্যোছনা রায়ের মুখের দিকে।
জ্যোছনা রায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাথরের মূর্তির মত।
বনহুরের মুখোভাবে কোনো পরিবর্তন নেই। সে গুটানো জামার আস্তিন খুলে নিচ্ছিলো।
এমন সময় অন্ধকার থেকে এগিয়ে এলেন আরফান উল্লাহ। বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন-এসব কি কাণ্ড? তারপর জ্যোছনা রায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন-আপনি এখনও স্টুডিওতে ছিলেন মিস রায়? আমরা মনে করেছি চলে গেছেন।
অরুণ কুমার গায়ের ধুলো ঝাড়ছিলো। তার চোখেমুখে হিংস্র ক্রুদ্ধভাব ফুটে উঠেছে।
তীক্ষ্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বনহুর ও জ্যোছনা রায়কে দেখে নিচ্ছিলো সে, দুচোখে যেন অগ্নিবাণ বর্ষিত হচ্ছে অরুণ কুমারের। অন্যান্য কারও মুখে কোনো কথা নেই। আরফান উল্লাহর আগমনে উপস্থিত সকলেই নিশ্চুপ হয়ে পড়েছিলো। কারণ, তার সামনে কে কোন কথা বলে অপরাধী হবে!
আরফান উল্লাহ গর্জন করে উঠলেন-মিঃ কুমার, আপনাকে বারণ করা।
সত্ত্বেও আপনি স্টুডিওতে কেন এসেছেন? .
জবাব দিতে আমি রাজী নই। কথা শেষ করে দ্রুত বেরিয়ে গেলো অরুণ কুমার।
জ্যোছনা রায় তাকালো বনহুরের মুখের দিকে।
বনহুর জ্যোছনা রায়ের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। দৃষ্টি বিনিময় হতেই চোখ নামিয়ে নিলো জ্যোছনা রায়।
আরফান উল্লাহ বললেন-চলুন মিস রায়, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
জ্যোছনা রায় বললো-আমাকে পৌঁছে দিতে হবে না মিঃ উল্লাহ। আমি একাই বাসায় ফিরে যেতে পারবো। জ্যোহনা রায় আর মুহূর্ত বিলম্ব না করে বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে।
আরফান উল্লাহ চিন্তিত কণ্ঠে বললেন-পথে না আবার কোনো বিপদ ঘটে! আসুন মিঃ চৌধুরী, ভাগ্যিস আপনি ছিলেন, নইলে পাজি অরুণ বাবু কি যে কাণ্ড করে বসতো!
পায়ে পায়ে এগিয়ে চললেন আরফান উল্লাহ ও বনহুর। স্টুডিওর দিকেই এগুচ্ছেন তারা।
এমন সময় নাহার চৌধুরী ব্যস্তসমস্তভাবে সামনে এসে দাঁড়ালেন-এই যে মিঃ চৌধুরী, কি একটা বিশ্রী ঘটনা ঘটে গেলো!
বিশ্রী ঘটনা নয় মিঃ নাহার, অতি মনোরম…..কথাটা বললো বনহুর।
মিঃ আরফান বললেন-মিঃ নাহার চৌধুরী, আমাদের কাজ আর কতদিনে শেষ হতে পারে?
আমার মনে হয় এক সপ্তাহের মধ্যেই সুটিং শেষ হবে। বাকী কাজ শেষ হতে মাসখানেক লাগবে।
আরফান উল্লাহ বললেন, জ্যোছনা রায়ের শেষ শট কবে নাগাদ শেষ হচ্ছে?
মিস রায়ের আর একদিন সুটিং আছে মিঃ চৌধুরীর সঙ্গে…তাহলেই ওর কাজ শেষ!
বনহুর আর বিলম্ব না করে আরফান উল্লাহ এবং নাহার চৌধুরীর কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
বনহুর জানে, জ্যোছনা রায় আরফান উল্লাহর গাড়িতে এসেছিলো। কাজেই ফিরবার পথে ভাড়াটে গাড়ি ছাড়া তার উপায় নেই। শহর ছেড়ে স্টুডিও বেশ দূরে, কাজেই সব সময় সেখানে গাড়ি পাওয়া মুশকিল। স্টুডিও ছেড়ে বেশ খানিকটা পথ চলার পর তবেই গাড়ি মিলবে। বনহুর বুঝতে পারে, জ্যোছনা রায় এখনও গাড়ির স্ট্যান্ডে পৌঁছতে পারেনি।
বনহুর নিজে রাগ করে স্টুডিও থেকে বেরিয়ে এলো। স্পীডে চালিয়ে যেতে যেতে পথের দুপাশে লক্ষ্য করে দেখতে লাগলো। দুশ্চিন্তায় মনটা ভরে উঠলো বনহুরের। জ্যোছনা রায়ের এভাবে একা যাওয়া কি উচিত হয়েছে? জানে না সে–তার বিপদ এগিয়ে আসছে।
অরুণ বাবু তাকে পুনরায় আক্রমণ করেছে কিনা কে জানে!
বনহুর এসব চিন্তা করছিলো, আর পথের দুপাশে সতর্ক দৃষ্টি রেখে গাড়ি চালাচ্ছিলো।
অনেকটা পথ চলে গেলো বনহুর, কোথাও জ্যোছনা রায়ের সন্ধান পাওয়া গেলো না। আর কিছু দূরেই গাড়ির স্ট্যান্ড। এমন সময় হঠাৎ বনহুর দেখলো অদূরে একটা তরুণী এগিয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই জ্যোছনা রায় ছাড়া অন্য কেউ নয়। বনহুর গাড়ি নিয়ে তার পাশে গিয়ে ব্রেক কষে থামিয়ে ফেললো।
থমকে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকালে জ্যোছনা রায়।
বনহুর ঝুঁকে বললো-আসুন মিস রায়।
দরকার হবে না, স্ট্যাণ্ডে এসে গেছি।
মিস রায়, আপনার এ সময় ভাড়াটে গাড়িতে যাওয়া মোটেই নিরাপদ নয়। আসুন।
জ্যোছনা রায় কেন যেন আজ অভিমান করতে পারলো না, বনহুরের পাশে উঠে বসলো।
গাড়ি পুনরায় ছুটতে শুরু করলো।
বেশ কিছুক্ষণ উভয়েই নিশ্চুপ রইলো!
প্রথম কথা বললো বনহুর-মিস রায়, রাগ করেছেন?
না।
মিথ্যা বললেন আপনি!
কোনো জবাব দিলো না জ্যোছনা রায়। মুখ ফিরিয়ে বসে রইলো চুপ করে।
বললো আবার বনহুর-আপনি বড় অবুঝ মিস রায়। আপনি অভিনয় করেন, কিন্তু অভিনয় বোঝেন না।
জ্যোছনা রায় তাকালো বনহুরের মুখের দিকে। লাইট পোস্টের আলোতে উভয়েরই চোখাচোখি হলো। বনহুর। বললো-মিস রায়, একমাত্র আমার জন্য আজ আপনি বিপদগ্রস্ত। বলুন, তাই নয় কি?
জ্যোছনা রায় এবারও কোনো জবাব দিলো না।
বনহুর বলে চললো-সত্যি করে বলছি, আমি আতিয়ার সঙ্গে শুধু অভিনয় করে চলেছি। কিন্তু কেন জানেন? শুধু আপনার জন্য।
আমার জন্য!
হাঁ, শুধু আপনার জন্য। মিস রায়, সব কথা ঐ দিন বলবো যেদিন আমাদের ছবির কাজ শেষ হবে।
জ্যোছনা রায় নিশ্চুপ শুনে যাচ্ছিলো। একটু পূর্বেই মিঃ চৌধুরীর অন্তরের পরিচয় সে পেয়েছে। মিঃ চৌধুরীই তাকে রক্ষা করেছেন, নইলে কি যে হতো! কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠলো জ্যোছনা রায়ের মন!
বনহুর জ্যোছনা রায়কে তার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ফিরে এলো নিজের বাসায়।
গোটা রাত ঘুমাতে পারলো না সে।
কত কথা আজ বনহুরের মনের আকাশে ভেসে উঠে বিলীন হয়ে যাচ্ছিলো।
স্বদেশে ফিরবার জন্য মন তার আকুলি-বিকুলি করছে।
বহুদিন বাইরে কাটালো সে। নানা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলেছে সে। না জানি তার আস্তানার অবস্থা কি। রহমান তার অনুপস্থিতিতে কি করছে। তারা কেমন আছে। মায়ের কথা স্মরণ হতেই অশ্রুসজল হলো বনহুরের চোখ দুটো। মনিরা কেমন আছে, নিশ্চয়ই সে কেঁদে কেঁদে আকুল হয়ে পড়েছে। মনিরার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য বনহুরের মন চঞ্চল হয়ে পড়লো।
এদিকে নূরীর চিকিৎসার আশু প্রয়োজন।
আস্তানায় ফিরে না গেলে কিছুই হচ্ছে না।
ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় নতুন এক পথে পা বাড়িয়েছিলো সে। দস্যু হয়ে চিত্রনায়করূপে.আত্নপ্রকাশ করেছে। ছবির কাজ শেষ, এবার তার ছুটি।
কিন্তু স্বদেশে ফিরে যাবার পূর্বে আর একটা কাজ তাকে করে যেতে হবে। জ্যোছনা রায়কে বুঝিয়ে দিতে হবে, সে স্বাভাবিক মানুষ নয়। বনহুরকে পাবে না কোনোদিন, কারণ সে দস্যু-মানুষ নামের কলঙ্ক।
০৬.
কয়েক দিন কেটে গেলো।
আজ কুন্তিবাঈ ছবির শেষ সুটিং চলছে।
নাহার চৌধুরী অত্যন্ত ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটাছুটি করছেন।..
ক্যামেরাম্যান অনন্ত বাবুর অবস্থাও তাই। আজ তিনি যেন বেশি করে। ঝুঁকে পড়েছেন কাজে। ইউনিটের প্রায় সবাই আজ এসেছেন স্টুডিওতে।
বনহুর আর জ্যোছনা রায়ের মধ্যে শেষ শট নেওয়া হবে। বনহুর আর জ্যোছনা রায় মেকআপ নিচ্ছে।
আজ ওদের দুজনকে অপূর্ব সুন্দর লাগছে। বিশেষ করে মিস জ্যোছনা রায়কে আজ মেকআপে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে।
সুটিং শুরু হলো।
সেটে বনহুর আর. জ্যোছনা রায়।
জ্যোছনা রায়ের মন থেকে সব অভিমান মুছে গিয়েছিলো।
একটা কৃতজ্ঞতার ছাপ গোটা অন্তরে ছড়িয়ে পড়েছিলো তার।
বনহুরও আজ জ্যোছনা রায়ের সঙ্গে অপূর্ব অভিনয় করলো। ছবির শেষ দৃশ্য নাহার চৌধুরীর মনে এনে দিলো অফুরন্ত আনন্দ ও পরিতৃপ্ত।
পরিচালক নাহার চৌধুরী বনহুর আর জ্যোছনা রায়কে আন্তরিক ধন্যবাদ জানালেন।
বনহুর অবাক হলো-আজ শেষ সুটিংয়ের দিন অথচ মিঃ আরফান উল্লাহ স্টুডিওতে নেই। মিস আতিয়া ছিলো, কিন্তু কিছুক্ষণ বসার পর সরে পড়েছে সে। বোধ হয় মিঃ চৌধুরীর সঙ্গে জ্যোছনা রায়ের অভিনয় সহ্য করতে পারেনি।
সুটিং আজ থেকে শেষ, স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো জ্যোছনা রায়। স্টুডিওর বিশ্রামকক্ষে প্রবেশ করে একটা সোফায় গা এলিয়ে দিলো। অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ মনটা তার বেশ স্বচ্ছ মনে হচ্ছে। মিঃ চৌধুরী সম্বন্ধে তার অন্তরে যে একটা দ্বন্দ্ব ছিলো সেটা মুছে গেছে তার মন থেকে।
মিঃ চৌধুরী লোককে দেখান তিনি আতিয়াকে ভালবাসেন কিন্তু সে কথা তাঁর মনের কথা নয়। আতিয়াকে মিঃ চৌধুরী কখনও ভালবাসতে পারেন না। ধন, সম্পদ, অর্থই সবচেয়ে বড় কথা নয়। অন্তর বলে একটা জিনিস আছে, যা কোনদিন ঐশ্বর্যের প্রাচুর্যে পুর্ণ হয় না। তাছাড়া মিঃ চৌধুরীকে সে। এতদিন বেশ ভালো করেই জেনেছে, অর্থের লালসা তার নেই। নিজেই তিনি একটা ঐশ্বর্যের সম্ভার।
মিস জ্যোছনা রায়ের মুখমণ্ডল উজ্জ্বল দীপ্তিময় হয়ে ওঠে। বিশ্রামকক্ষে আসার পূর্বে মিঃ চৌধুরীর সঙ্গে তার কয়েক মিনিট কথা হয়েছে। নির্জন রেলিংয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো মিঃ চৌধুরী ও জ্যোছনা রায়।
আজ থেকে কাজ শেষ মিস রায়। বলেছিলো বনহুর।
হাঁ, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। জবাব দিয়েছিলো জ্যোছনা রায়। কিছু সময় নিশ্চুপ থেকে বলেছিলো বনহুর-যা বলার আজ বলবো মিস রায়। কারণ আবার কখন কোথায় দেখা হবে কে জানে!
বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলেছিলো জ্যোছনা রায়-কেন?
বলে চলে বনহুর-আতিয়াকে আমি ভালবেসেছিলাম শুধু আপনাকে রক্ষা। করার জন্য। কারণ আমি সবাইকে দেখাতে চেয়েছি-আমি আতিয়ার প্রেমে আত্মহারা, জ্যোছনা রায়ের সঙ্গে আমার অভিনয়ের সম্বন্ধ ছাড়া কোনো সম্পর্ক নেই। মিস রায়, আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না, মিস আতিয়ার। সঙ্গে আমার যে ঘনিষ্ঠতা দেখেছেন তা শুধু অভিনয় ছাড়া কিছু নয়…. .
মিঃ চৌধুরী।
হাঁ, আপনি আমাকে বিশ্বাস করুন। মিস আতিয়াকে আমি কোনো দিন ভালবাসিনি-ভালবাসতে পারিনি।
অনাবিল একটা আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছিলো জ্যোছনা রায়ের হৃদয় আকাশে। গভীর আবেগে হারিয়ে ফেললো সে নিজের সত্তা, বনহুরের বুকে মাথা রেখে বললো-মিঃ চৌধুরী, আমাদের অভিনয় তো সত্য?
বনহুরের দৃষ্টি সেই মুহূর্তে চলে গেলো স্টুডিওর ওদিকে একটা শার্শীর ফাঁকে….একজোড়া চোখ দ্রুত সরে গেলো শার্শীর ফাঁক থেকে।
বনহুর চট করে জ্যোছনা রায়কে সরিয়ে দিতে পারলো না, মোহগ্রস্তের মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো…..
জ্যোছনা রায় বিশ্রামকক্ষে বসে তখনকার কথাগুলোই স্মরণ করলো। আজ তার মনের সমস্ত অন্ধকার দূর হয়ে গেছে, স্বচ্ছ নির্মল হয়েছে তার হৃদয়। মিঃ চৌধুরী মিস আতিয়াকে ভালবাসেননি, বাসতে পারেন নি….
বনহুর স্টুডিওর অন্যান্য কাজ শেষ করে গাড়ির দিকে এগুতেই মনে পড়লো জ্যোছনা রায়ের কথা। কথা দিয়েছিলো, তাকে নিয়ে তবে বাসায় ফিরবে।
বনহুর মিঃ আরফান উল্লাহ, পরিচালক নাহার চৌধুরী ক্যামেরাম্যান অনন্ত বাবু এবং অন্যান্য সকলের কাছে বিদায় নিয়ে পা বাড়ালো জ্যোছনা রায়ের বিশ্রামকক্ষের দিকে।
ছবির কাজ আজ থেকে সমাধা হলো, এবার নিশ্চিন্ত হলো বনহুর। শুধু স্টুডিও থেকেই বিদায় নিচ্ছে না, বিদায় নিচ্ছে চলচ্চিত্র থেকে। অভিনয় শুধু সে ক্যামেরার সামনেই করেনি, অভিনয় করেছে প্রতিটি ব্যক্তির সঙ্গে। আপন মনেই হাসলো বনহুর…দস্যু বনহুর হয়েছে চিত্রনায়ক।
দ্রুত প্রবেশ করলো সে জ্যোছনা রায়ের বিশ্রামকক্ষে। সঙ্গে সঙ্গে অকুটধ্বনি করে থমকে দাঁড়ালো-উঃ!
বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে দেখলো বনহুর-সোফায় অর্ধশায়িত অবস্থায় বসে আছে মিস জ্যোছনা রায়। বুকে একটা সুতীক্ষ্ণধার ছোরা সমূলে বিদ্ধ হয়ে আছে। লাল টকটকে তাজা রক্তে ভেসে যাচ্ছে বক্ষবসন। কিছুটা রক্ত গড়িয়ে পড়েছে মেঝেতে কার্পেটের ওপর। চোখ দুটো ভোলা, তাকিয়ে আছে যেন সামনের দিকে।
বনহুর মুহূর্তে স্থির হয়ে দাঁড়ালো।
চোখ দুটো তার ঝাপসা হয়ে এলো খানিকের জন্য। প্রাণহীন জ্যোছনা রায়ের কপালে হাত রাখলো-মিস রায়, আপনার কাজ শেষ হয়েছে। ধীরে ধীরে দক্ষিণ হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে দিলো ওর।
ঠিক সেই মুহূর্তে দুটো চোখ শার্শির ফাঁকে ভেসে উঠে সরে গেলো।
বনহুরের দৃষ্টি বিনিময় হলো শার্শীর চোখ দুটির সাথে। এমন সময়ে বাইরে পদশব্দ শোনা গেলো!
বনহুর ক্ষিপ্ত পদক্ষেপে পেছনে খোলা জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেলো বাইরে।
সঙ্গে সঙ্গে কক্ষে প্রবেশ করলেন নাহার চৌধুরী-মিস রায়, চলুন মিঃ উল্লাহ আপনাকে ডাকছেন-কথা শেষ করেই আর্তচীৎকার করে উঠলেন তিনি-খুন, খুন, খুন….
চারদিক থেকে ছুটে এলো লোকজন। অল্পক্ষণের মধ্যেই আরফান উল্লাহ, ক্যামেরাম্যান অনন্ত বাবু এবং ইউনিটের সবাই জ্যোছনা রায়ের বিশ্রামকক্ষে এসে জড়ো হলেন। সকলেরই চোখেমুখে ভীত উৎকণ্ঠা ভাব। সবাই স্তম্ভিত হতবাক। জ্যোছনা রায় কেন খুন হলো, কে তাকে খুন করলো, কি করে খুন হলো-কিন্তু কে জবাব দেবে এই হত্যা রহস্যের? যে তাকে খুন করেছে সেই জানে আর জানে মৃত জ্যোছনা রায়।
.
আপন কক্ষে পায়চারী করছে বনহুর। মুখমণ্ডল গম্ভীর। ললাটে গভীর চিন্তারেখা ফুটে উঠেছে। মাঝে মাঝে অধর দংশন করছে সে। মিস জ্যোছনা রায়ের হত্যাকাণ্ড নিয়ে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন সে।
কে এই নির্মম হত্যাকারী যে একটা নিষ্পাপ ফুলের মতো জীবন চিরতরে বিনষ্ট করে দিলো? কার ঐ চোখ দুটো যা সর্বক্ষণ জ্যোছনা রায়কে অনুসরণ করতো? ঐ চোখ দুটি যার সেই যে জ্যোছনা রায়ের হত্যাকারী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কার ঐ চোখ দুটো….বনহুর পায়চারী। করছে আর মনোযাগ দিয়ে স্মরণ করছে, কার ঐ চোখ দুটো?
পুরুষের না নারীর!
ঢং ঢং করে দেয়াল ঘড়িটা রাত বারোটা ঘোষণা করলো।
বনহুর থমকে দাঁড়ালো। পাশের কামরায় ঘুমিয়ে আছে নূরী। ইয়াসিন ছাড়া চাকর বাকর সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।
ড্রয়ার খুলে রিভলবার বের করে আনলো বনহুর, প্যান্টের পকেটে রেখে, চাবির গোছা তুলে নিলো হাতে-আলমারী খুলতে যাবে, এমন সময় বাইরে মোটর থামার শব্দ হলো।
বনহুর তাড়াতাড়ি আলমারীর চাবি বন্ধ করে শয্যায় এসে শুয়ে একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলো।
এমন সময় ইয়াসিন এসে দরজার বাইরে থেকে বললো-সাহেব, মালিক আইছেন।
বনহুর ধড়মড় করে উঠে বসলো–বলো গিয়ে আসছি।
চলে যায় ইয়াসিন।
বনহুর দ্রুত শরীরের পোশাক পাল্টে নাইট ড্রেস পরে নেয়। তারপর চুলগুলো আংগুল দিয়ে এলোমেলো করে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখোভাব স্বাভাবিক করে নেবার চেষ্টা করে। আরফান উল্লাহ যেন বুঝতে না পারেন জ্যোছনা রায়ের হত্যাকাণ্ডের কথা সে জানে।
স্লিপিং গাউনটা পরে নিয়ে বেল্টের ফিতা বাঁধতে বাঁধতে কক্ষ থেকে। বেরিয়ে আসে বনহুর। সে যেন হত্যাকাণ্ডের কিছুই জানে না, এমন স্বাভাবিক ভাব মুখে ফুটিয়ে তোলে।
হলঘরে প্রবেশ করতেই বনহুর দেখতে পেলো হলঘরের মেঝেতে উৎকণ্ঠিত এবং ব্যস্তভাবে পায়চারী করছেন আরফান উল্লাহ। মুখোভাব গম্ভীর থমথমে, আষাঢ়ের আকাশের মতোই অন্ধকার।
বনহুর কক্ষে প্রবেশ করেই হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললো-হ্যালো মিঃ উল্লাহ, আপনি!
আরফান উল্লাহ ফিরে তাকালেন বনহুরের মুখে, ঢোক গিলে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন-মিঃ চৌধুরী, বড় দুঃসংবাদ!
দুঃসংবাদ! বনহুর চোখে মুখে বিস্ময় টেনে বললো।
হাঁ, মিস জ্যোছনা রায় নিহত হয়েছেন।
কি বললেন, মিস রায় নিহত হয়েছেন!
হাঁ। তার কাজ হয়ে গেছে-কথাটা বলে বনহুর আরফান উল্লাহর মুখে সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।
আরফান উল্লাহ বনহুরের কথায় যেন একটু চমকে উঠলেন!
বনহুর বললো-বসুন মিঃ উল্লাহ।
আরফান উল্লাহ বসে পড়লেন একটা সোফায় ধপ করে।
বনহুরের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠলো, বললো যে একটা উজ্জ্বল তারকা খসে পড়লো চিরতরে।
হাঁ মিঃ চৌধুরী, আপনি সত্য কথা বলেছেন। জ্যোছনা রায় একটা দীপ্ত প্রতিভা ছিল।
কে সেই দীপশিখা নিভিয়ে দিলো বলতে পারেন?
আমি-আমি কেমন করে বলবো মিঃ চৌধুরী?
সে কথা সত্য, আপনি কি করে বলবেন মিস রায়ের হত্যাকারী কে। কিন্তু আমি জানি কে তাকে হত্যা করেছে।
আপনি-আপনি জানেন? জানেন কে জ্যোছনা রায়কে হত্যা করেছে?
জানি। কারণ আমি জানতাম, মিস রায় নিহত হবে।
জানতেন!
হাঁ, জানতাম মিঃ উল্লাহ। আপনি ঐ কক্ষের শার্শীর ফাঁকে দেখুন, হত্যাকারী ঐ কক্ষে আছে। বনহুর পাশের কক্ষে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো।
মিঃ উল্লাহ উঠে দাঁড়ালেন এবং বেরিয়ে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে।
হাঁ, সেই দুটি চোখ।
ফিরে এলো বনহুর ড্রইংরুমে।
কয়েক মিনিট পর এলেন আরফান উল্লাহ-ও ঘরে তো কাউকে দেখলাম না মিঃ চৌধুরী?
আশ্চর্য! একটু পূর্বেই তো আমি ও ঘরে অরুণ বাবুকে বসিয়ে রেখে এসেছিলাম।
বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বললেন আরফান উল্লা–অরুণ বাবু! একটু থেমে বললেন-আমারও ঐ রকম সন্দেহ হয়েছিলো।
কিন্তু এই হত্যার মূল কারণ আমি।
আপনি! বলেন কি মিঃ চৌধুরী।
যা সত্য তাই বলছি মিঃ উরাহ, আমিই জ্যোছনা রায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী!
আরফান উল্লাহ অবাক কণ্ঠে বললেন-আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আপনার কথা।
বুঝতে পারবেন, যেদিন হত্যাকারী আপনার সামনে উপস্থিত হবে।
অরুণ বাবুকে আমারও সন্দেহ হয়েছিলো প্রথম থেকে। কারণ সে তাকে হত্যার হুমকি দিয়ে চিঠি দিয়েছে।
বনহুর একটা শব্দ করলো-লাশ মর্গে পাঠানো হয়েছে?
হাঁ, পুলিশ তদন্তের পর লাশ মর্গে পাঠানো হয়েছে।
তার বাড়িতে সংবাদ দেওয়া হয়েছে? মানে মিস জ্যোছনা রায়ের বাড়িতে তার হত্যার সংবাদ দিয়েছেন?
হাঁ, তার মা এসেছিলেন আহা, বেচারী একেবারে পাগলিনী হয়ে পড়েছেন।
বনহুর কোনো কথা বললো না।
আরফান উল্লাহ বলে চলেছেন-মিস জ্যোছনা রায়কে হারিয়ে আমি অত্যন্ত শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি। আমার ব্যবসারও ভীষণ ক্ষতি হলো ওকে হারিয়ে।
না হলে আপনি এত রাতে আসবেন কেন? যাক, যা ওর ভাগ্যে ছিলো হয়ে গেছে।
হাঁ সে কথা অবশ্য সত্যি। অমন হিরোইন আর পাবো কিনা সন্দেহ।
তা মিস আতিয়া…..
ঠাট্টা করছেন?
ঠাট্টা নয়, আপনার পরবর্তী ছবির হিরোইন হবে আতিয়া।
আর হিরো?
আমি, আমিই আতিয়ার বিপরীতে কাজ করবো। মিঃ উল্লাহ, সেই ছবি হবে অদ্ভুত-অপূর্ব! সে ছবি বক্স অফিস হিট করবে।
আনন্দের আতিশয্যে অস্ফুটধ্বনি করলেন আরফান উল্লাহ-মিঃ চৌধুরী।
যা গেছে তা নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই, আপনি আগামী ছবির জন্য প্রস্তুত হোন মিঃ উল্লাহ।
আমি আনন্দে আত্মসংযম হারিয়ে ফেলছি মিঃ চৌধুরী। পরবর্তী ছবিতে আপনি যত টাকা চাইবেন দেবো! যা চাবেন পাবেন।
ভ্রূকুঞ্চিত করে আরফান উল্লাহর মুখে তাকিয়ে রইলো বনহুর।
খুশিতে দুলে উঠছে আরফান উল্লাহর ভুঁড়িটা।
বনহুর বললো এবার-মিঃ উল্লাহ, রাত বেড়ে আসছে।
হাঁ, দুটোর বেশি হয়ে গেছে। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন আরফান উল্লাহ।
বনহুর হাই তুলে উঠে দাঁড়ালো-মিস আতিয়াকে, সকালে আসতে বলবেন, কথা আছে তার সঙ্গে।
আস্থা, নিশ্চয়ই বলবো। খুশিতে আরফান উল্লাহর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো।
বনহুর আরফান উল্লাহকে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিলো।
বাড়ি ফিরে আরফান উল্লাহ নিশ্চিন্ত মনে শয্যা গ্রহণ করলেন। রাজপ্রাসাদের মত মস্ত বাড়ির দ্বিতল একটা কক্ষে, দুগ্ধফেননিত বিছানায় গা ঢেলে দিলেন আরফান উল্লাহ। রাত তখন চারটে বাজতে কয়েক মিনিট বাকী। শিয়রে আলমারী। লক্ষ লক্ষ টাকা, প্রতিদিন আলমারীতে এসে জমা হচ্ছে। অর্থলোভী আরফান উল্লাহ দুলাখ টাকা মূল্যের সোনা মধুগঙ্গার বুকে, হারিয়ে উম্মাদ হয়ে উঠলেন-আরও অর্থ চাই তার, আর চাই মিঃ চৌধুরীকে-এমন সুপুরুষ যুবককে তার প্রডাকশনের প্রতিটি ছবির নায়ক রূপে পেলে অর্থের কোনো অভাব হবে না। হিরো পাওয়া খুব মুশকিল নয়, অর্থ হলে সব হয়। শুধু ছবির হিরোর জন্য আরফান উল্লাহ ব্যস্ত নন-তার একমাত্র আদরিণী কন্যার জামাতারূপেও মিঃ চৌধুরী অপূর্ব!
মিঃ চৌধুরী অনেকখানি নমনীয় হয়ে এসেছে। আতিয়াকে এবার সে। বিয়ে করতে রাজী হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
পাশের কামরায় আতিয়া তখন বিছানায় ঘোৎ ঘোৎ করে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। দূর থেকে মনে হচ্ছে যেন গুড় গুড় করে আষাঢ়ে মেঘ ডাকছে।
বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছেন আরফান উল্লাহ। বালিশের তলায় আলমারীর চাবির গোছা একবার হাত দিয়ে দেখে নিয়ে যথাস্থানে রেখে দিলেন। তারপর নিশ্চিন্তে চোখ দুটো বন্ধ করলেন।
ঠিক সেই মুহূর্তে পেছন জানালার শার্শী খুলে গেলো। সারা শরীরে জমকালো পোশাক পরিহিত, মুখে মুখোশ, দক্ষিণ হাতে সুতীক্ষ্ণধার ছোরা, কক্ষে প্রবেশ করলো এক ব্যক্তি।
একটা শব্দ হতেই আরফান উল্লাহ বিছানায় দ্রুত উঠে বসলেন, ফিরে তাকাতেই বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো তার মুখমণ্ডল।
ততক্ষণে জমকালো পোশাক পরিহিত মূর্তি ছোরা উদ্যত করে আরফান, উল্লাহর সামনে এসে দাঁড়ালো।
ভীত কম্পিত কণ্ঠে বললেন আরফান উল্লাহ-কে তুমি?
গভীর চাপা কণ্ঠস্বর জমকালো মৃর্তির-যমদুত!
ঢোক গিলে বললেন আরফান উল্লাহ-কি চাও তুমি?
জানতে চাই জ্যোছনা রায়কে কেন তুমি হত্যা করেছে?
আমি-আমি জ্যোছনা রায়কে হত্যা করিনি!
মিথ্যা কথা বলতে চেষ্ট করোনা।
কে তুমি?
একটু পরেই আমার পরিচয় পাবে। তার পূর্বে জবাব দাও-জ্যোছনা রায়কে কেন তুমি হত্যা করেছো?
আমি তাকে হত্যা করিনি।
তুমি তাকে হত্যা করোনি?….বাম হাতে আরফান উল্লাহর টুটি টিপে ধরলো জমকালো মূর্তি, তার হাতের ছোরাখানা ডিমলাইটের আলোতে ঝক্ঝক করে উঠলো।
আরফান উল্লাহর চোখ দুটো ছানাবড়ার মত হয়ে উঠেছে। মুখটা হা হয়ে গেছে, গোঁ গোঁ শব্দ করে বললেন-আমাকে প্রাণে মেরো না। আমাকে প্রাণে মেরো না, বলছি….বলছি….
জমকালো মূর্তি সোজা হয়ে দাঁড়ালো, বাম হাত আরফান উল্লাহর গলা থেকে সরিয়ে বললো-বলো?
আমি….আমিই জ্যোছনা রায়কে হত্যা করেছি। আমিই তাকে…হত্যা..ক..রে..ছি… আরফান উল্লাহর চোখেমুখে ফুটে উঠলে খুনীর সুস্পষ্ট ছাপ।
জমকালো মূর্তি পুনরায় চাপস্বরে গর্জে উঠলো-কি অপরাধ সে করেছিলো তোমার?
অপরাধ! অপরাধ…সে…থামলেন আরফান উল্লাহ।
জমকালো মূর্তি দাঁতে দাঁত পিষে বললো-একটা কথা মিথ্যা উচ্চারণ করলেই এই ছোরা তোমার বুকে বিদ্ধ হবে-ভুলে যেও না, তুমি যমদুতের সামনে কথা বলছে।
আরফান উল্লাহ ভয়ার্ত চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাতে লাগলেন ছোরাখানার দিকে। একখানা মৃতুমলিন বিবর্ণ মুখ ভেসে উঠলো সেই মুহূর্তে তার চোখের সামনে। অসহায় করুণ দুটি নিষ্পাপ চোখ। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়ভরা করুণ কণ্ঠস্বর….আপনি…আমাকে হত্যা করবেন…কি অপরাধ আমি করেছি…কোনো জবাব সে পায়নি, একখানা সুতীক্ষ্ণধার ছোরা সমূলে বিদ্ধ হয়েছিলো জ্যোছনা রায়ের বুকে। একটা তীব্র আর্তনাদ শুধু ক্ষণিকের জন্য ছড়িয়ে পড়েছিলো কক্ষে-দৃশ্যটা আরফান উল্লাহর চোখে ফুটে উঠলো। ভয়বিহ্বল দৃষ্টি মেলে তাকালেন তিনি জমকালো মূর্তির দিকে।
আরফান উল্লাহ এবার বললেন-অপরাধ সে কিছুই করেনি কিন্তু-কিন্তু…
কেন তুমি তাকে হত্যা করলে?
আমার কন্যা আতিয়ার সুখের জন্য….
বলো থামলে কেন?
মিঃ চৌধুরীকে আমার আতিয়া ভালবাসে কিন্তু মিঃ চৌধুরী ভালবাসে মিস জ্যোছনা রায়কে…তাই…তাই পথের কাঁটা আমি সরিয়ে ফেলেছি। তাই …হত্যা করেছি ওকে…
একটানে মুখের কালো আবরণ খুলে ফেললো জমকালো মূর্তি।
সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়ভরা অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন আরফান উল্লাহ মিঃ চৌধুরী…আপনি…
হাঁ, কিন্তু মিঃ চৌধুরী নয়, দস্যু বনহুর।
দস্যু বনহুর! আমার কুন্তিবাঈ ছবির নায়ক দস্যু বনহুর! এ্যাঃ এ্যাঃ…আপনি…আপনি-আমার আতিয়া তবে-তবে সে ভুল করেছে-কোনোদিন সে মিঃ চৌধুরীকে পাবে না?
শুধু আতিয়াই ভুল করেনি, ভুল করেছো তুমি-জ্যোছনা রায়কে হত্যা করে যে ভুল তুমি করেছো তার প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করো–
সঙ্গে সঙ্গে বনহুরের হাতের ছোরা সমূলে বিদ্ধ হলো কুন্তিবাঈ ছবির প্রযোজক আরফান উল্লাহর বুকে। তীব্র একটা আর্তনাদ করে মুখ থুবড়ে গড়িয়ে পড়লেন তিনি খাটের নীচে। চীৎ হয়ে পড়ে রইলো আরফান উল্লাহ। তাজা লাল টকটকে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগলো মেঝের মূল্যবান কার্পেটের ওপর।
বনহুর সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
প্যান্টের পকেট থেকে মূল্যবান ছোট টেপ রেকর্ডার বের করে টেবিলে রাখলো। এতক্ষণ বনহুরের পকেটে চালু ছিলো টেপরেকর্ডার। প্রথম থেকে আরফান উল্লাহর সঙ্গে বনহুরের যে কথাবার্তা হয়েছিলো সব রেকর্ড হয়ে গেছে। এবার সুইট টিপে টেপরেকর্ডটা বন্ধ করে দিলো বনহুর।
তারপর বালিশের তলা থেকে বের করে নিলো চাবির গোছা। এগুলো আলমারীটার দিকে যার মধ্যে সঞ্চিত রয়েছে আরফান উল্লাহর উপার্জিত লাখ লাখ টাকা।
০৭.
পুলিশ অফিস।
ইন্সপেক্টারের টেবিলে ফোনটা বেজে উঠলো ক্রিং ক্রিং করে। ফোনটা বেজেই চলেছে সশব্দে।
ভোর সাড়ে পাঁচটা।
দুজন পুলিশ পাহারারত। অফিস-ইনচার্জ ও, সি ধরলেন—হ্যালো-হ্যালো–
ওদিক থেকে ভেসে এলো দস্যু বনহুরের কণ্ঠস্বর-মিঃ আরফান উল্লাহ খুন হয়েছেন। এইমাত্র তাকে খুন করা হলো–
ওসির হাত থেকে রিসিভার খসে পড়তে যাচ্ছিলো, শক্ত করে ধরে বললেন তিনি-হ্যালো, আপনি কে কথা বলছেন? কোথা থেকে বলছেন?
ওদিক থেকে ভেসে এলো বনহুরের গলা-দস্যু বনহুর কথা বলছি। কুন্তিবাঈ ছবির প্রযোজক আরফান উল্লাহর বাড়ি থেকে।
দস্যু বনহুর!
মুহূর্ত বিলম্ব না করে চলে আসুন। পুলিশ ফোর্সসহ চলে আসুন…হ্যালো, দেরী করবেন না, চলে আসুন-ওদিকে রিসিভার রাখার শব্দ হলো।
ওসির হাত কাঁপছিলো, তাড়াতাড়ি রিসিভার রেখে একটু সুস্থ হয়ে নিলেন, পরক্ষণেই আবার রিসিভার হাতে তুলে নিয়ে ইন্সপেক্টারকে ফোন করলেন-আরফান উল্লাহ খুন হয়েছেন। এক্ষুণি সেখানে যেতে হবে–
পুলিশ ভ্যান যখন আরফান উল্লাহর বাড়ির গেটে এসে থামলো তখনও আতিয়ার ঘুম ভাঙ্গেনি।
ওদিকে তখন দস্যু বনহুর নূরীসহ তার নতুন গাড়িখানা নিয়ে অজানা পথ ধরে স্পীডে এগিয়ে যাচ্ছে। রাত ভোর হবার পূর্বেই এ শহর ছেড়ে দূরে-বহুদূরে চলে যেতে হবে তাকে।