চিত্রনাট্য
খালেদ আরেফিন— সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র। তরুন কবি। মাঝারি শরীর। মুখে হালকা দাড়ি। চেহারা এলোমেলো আর রুক্ষ। চেইন স্মোকার। জিনস বা অন্য কোনো শক্ত কাপড়ের প্যান্ট, রঙচঙে শার্ট বা পাঞ্জাবি পরতে অভ্যস্ত। স্পষ্টভাষী। কথাবার্তায় চৌকস। আবৃত্তি সুন্দর। আচরন পুরুষালী। মাঝে মধ্যে উচ্চস্বরে হেসে ওঠাটা তার রপ্ত করা অভ্যাস। নেশা করে তবে নেশার ছাপ সহজে বোঝা যায় না। কখনো খুব উচ্ছল আবার কখনো একেবারে চুপচাপ। তার কোনো প্রিয় লেখক নেই। সাহিত্যের অধ্যাপকদের উপর তার যেন জন্ম-ক্রোধ। অস্থির। নাজনীনের সাথে তার ভালোবাসার সম্পর্ক।
গলায় খুব আটোসাঁটো একটি রূপোর শিকলাকৃতির চেইন। একাকি একটি ঘরে তার বাসস্থান। পার্ট টাইম সাংবাদিকতা থেকে জীবিকা নির্বাহ হয়।
নাজনীন আকতার— হোসেন গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক আকবর হোসেনের ছোট মেয়ে। বোন বিবাহিতা; প্রবাসী। ছোট ভাইটি কলেজের ছাত্র। স্বাধীনতা-উত্তর কালেই অধিক বিত্তের সংস্পর্শে এসেছে। লম্বা গড়ন। সুন্দরী। খোলামেলা চলাফেরা করতে তার ভালো লাগে। সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্রী। ভার্সিটিতে অভিনয় কোরে নাম করেছে। গানের গলা একেবারে মন্দ না। নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে এবং বাস্তবে চর্চা করার চেষ্টা করে। বাবা-মার সাথে অভিজাত এলাকায় অভিজাত বাড়িতে থাকে। মাঝে মধ্যে বাবার গাড়ি ব্যবহার করে। সামাজিক বৈষম্য তার ভালো লাগে না তবে নিজের জীবনে কষ্টকর দারিদ্র্যও তার পছন্দ নয়। সাজ সজ্জায় আগ্রহ কম। শাড়ির চে’ প্যান্ট কামিজ পরলে বেশি সহজ হতে পারে। উচ্ছল এবং হাসিখুশি থাকার মধ্যেও একাকি হলে উদাসিন অন্যমনস্কতা পেয়ে বসে তাকে। খালেদকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন।
শেখ মাহবুব আলী— সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র। সম্মানের ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। সুদর্শন। নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আগত। ধীর স্থির শান্ত স্বভাব। চশমা পরে। স্বাভাবিক শাদামাটা পোশাক। ইন্টালেকচুয়াল ভাববর্জিত। হাসিখুশি বন্ধুপ্রিয়। হলে থাকে। পড়ার খরচ চালাতে টিউশনি করতে হয়। রাজনীতি সচেতন তবে সক্রিয়ভাবে জড়িত নয়।
বার বার চশমা খোলার মুদ্রাদোষটি সহজে চোখে পড়ে। চেহারায় নাগরিকতা কম। মেয়েদের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে যথেষ্ট সংযত। অনেকে কাছে ঘেঁষলেও বন্ধুত্বের চে’ বেশি সম্পর্ক নেই কারো সঙ্গে। স্বাধীনতা যুদ্ধে বড় ভাই মারা গেছে। বাবা স্কুল শিক্ষক। স্বল্প রোজগার। তার ছোট চারটি ভাই বোন রয়েছে গ্রামের বাড়িতে। দায়িত্ব সম্পর্কে তাকে সচেতন থাকতে হয়। চরিত্রে হালকা রোমান্টিকতা একেবারেই নেই।
মোঃ বশিরউদ্দীন— ফিলসফির ছাত্র। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। লম্বা, রোগাটে চেহারা। চেহারা ও চরিত্রে দ্রুত নাগরিকতার ছাপ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা স্পষ্ট। মেয়েদের ব্যাপারে দুর্বল। সবসময় ফিটফাট থাকার চেষ্টা। উজ্জ্বল পোশাক আশাকে হাল ফ্যাশানের ছোঁয়া। সহজ পথে অর্থ অর্জনের চেষ্টা সারাক্ষন। মস্তান ছেলেদের সাথে ওঠা বসা। মস্তান রাজনীতির সাথে যুক্ত। মেয়েদের সাথে ঘোরার বা গল্প করার সুযোগ পেলে পয়সা খরচে কার্পন্য করে না। ধার কোরেও পয়সা ওড়ায়। হঠাৎ করেই শিরীনকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। যদিও মেয়েটির পুরো সম্মতি মেলেনি এখনো। হলে থাকে ও।
কথাবার্তা এবং সাধারন ধারনা মোটেও তীক্ষ্ণ নয়। স্থুল। পড়াশুনোয়ও ভালো নয়। অন্যের নোট মুখস্থ কোরে পাশ দিয়ে যাচ্ছে। শিরীনের প্রতি তার দুর্বলতা সত্যিই বিস্ময়কর।
রওশন আরা শিরীন- বি, এ পাশ কোরে চাকরির চেষ্টা করছে। অর্থাভাবে পড়া চালানো সম্ভব হচ্ছে না। বাবা একটি শাড়ির দোকানের সেলসম্যান ছিলো। দোকানের এক চুরির সাথে জড়িয়ে তিন বছরের সাজা খাটছে জেলে। ওর ছোটো এক বোন, মা আছে। পুরোনো ঢাকায় দুই রুমের ছোট একটা বাসা। বাবা জেলে যাওয়ার পর থেকে অর্থের জোগান বন্ধ।
এই বিপদে বশির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর সাহায্যেই পরিবারটা কোনো রকমে চলছে। বশিরকে ভালো লাগে কিন্তু ওর সাথে জীবন জড়ানোর কথা এখনো ভাবতে পারে না। বশিরকে সে অস্বীকার করবে কিভাবে।
দেখতে শাদামাটা হলেও শক্ত চরিত্রের মেয়ে। জেদী, শান্ত, পরিশ্রমী। আবেগ অত্যন্ত সংযত। সাহিত্যামোদী।
সৈয়দ রেজাউজর রহমান সিজার— বিত্তবান পরিবারের একমাত্র পুত্র। অর্থনীতির ছাত্র। সুদর্শন, উচ্ছল তরুন। মাঝারি মেধা। অভিজাত আবাসিক এলাকায় মা-বাবার সাথে থাকে। নিজের মোটর বাইকে চড়ে, মাঝে মধ্যে পারিবারিক গাড়ি ব্যবহার করে। আকর্ষনীয় পোশাক। হাসিটি বাড়তি আকর্ষন। পুঁজিবাদী সমাজের প্রতিই তার একান্ত আনুগত্য। নেশা করে, কম। চরিত্রে সামান্য মেয়েলিপনা আছে। মেয়েরা ওকে পছন্দ করে। নাজনীনের প্রতি তার বেশ দুর্বলতা সত্ত্বেও সাড়া মেলেনি।
গায়ত্রি বসু— বাংলার ছাত্রী। ভালো নজরুল গীতি গায়। বিবাহিতা। মিশুক মেয়ে। বেশ সচ্ছল পরিবার। দেখতে সুন্দরী। খুব বড়ো টানা চোখ। আসর জমিয়ে রাখে।
স্বপ্না— শিরীনের বোন। বার দুয়েক চেষ্টা কোরেও স্কুল পাশ করতে পারেনি। বাড়ন্ত শরীর। আকর্ষনীয়া। সৌখিনতায় ঝোঁক বেশি।
মা— শিরীন, স্বপ্নার মা। শাদামাটা মহিলা। তেমন সুশ্রী নয়। চরিত্রে দৃঢ়তা আছে। দরিদ্রের কশাঘাত ম্লান কোরে ফেলেছে তাকে। আচরন স্বাভাবিক
আকবর হোসেন— শিল্পপতি। ব্যস্ত এবং গম্ভীর প্রকৃতির। নিয়মিত গান করেন। চতুর চোখ। পোশাকে আভিজাত্য। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। ক্লীন সেভড্। ধূমপান করেন পাইপে। মুখটা সুদর্শন কিন্তু শরীরে মেদ জ’মে বেঢপ হয়েছে দেখতে। কন্ঠস্বর প্রায় মেয়েলি।
শ্যামল জাকারিয়া— মফস্বলের নবীন লেখক। সাধারন পোশাক-আশাক। চুলটা স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য বড়ো।
১ম ছেলে— প্রথম বর্ষের ছাত্র। চেহারা-পোশাকে উড়নচন্ডী।
২য় ছেলে— হলের ছাত্র। লুঙ্গি শার্ট পরা।
ফরিদ আহমেদ—তরুন শিল্পী। সাধারন পোশাক। অগোছালো চেহারার ও কিছুটা নির্লিপ্ত।
গোলাম রব্বানী—ছাত্র নেতা। বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত। সাধারন চেহারা, পোশাক।
চটপটে রাজনীতিক সুলভ আচরন।
হেলেন—আকবর হোসেনের স্ত্রী। নাজনীনের মা। শীর্নকায়া, দীর্ঘাঙ্গি সুন্দরী মহিলা।
মেয়েদের কলেজ থেকে বিএ পাশ করেছেন।
মোরশেদ ফয়সল—তরুন নাট্যকার। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিশেবে যোগ
দিয়েছে। ছাত্র জীবনের আড্ডাগুলো এখনো ছাড়া সম্ভব হয়নি।
প্ৰথম দৃশ্য
ক্লোজআপে একটি হাত। ক্যামেরা দূরে গেলে দ্যাখা যাবে দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে শুয়ে আছে খালেদ। পরনে প্যান্ট আর বোতাম খোলা শার্ট। বিছানা এলোমেলো। শরীরের আশেপাশে বই-এর স্তূপ। মাথার নিচে বালিশ নেই। একটি বালিশ বুকে জড়িয়ে ধরেছে। আরেকটা বালিশ খাটের পাশে পড়ে আছে। তার উপর এ্যাশট্রে। চারপাশে ছড়িয়ে আছে ছাই আর সিগারেট। টেবিলে বইখাতা ছড়ানো। চেয়ারটা অন্যদিকে মুখ কোরে আছে। আলনার অবস্থা তথৈবচ। এলোমেলো ছড়ানো আর দু একটা চেয়ার বা মোড়া। দেয়ালে একটি মাত্র অদ্ভুত পোস্টার। বইখাতার মধ্যে প্রায় নিমজ্জিত টেবিল ঘড়িটি টিক টিক করছে। জানলা দিয়ে সকাল সাতটার রোদ এসে পড়েছে বিছানায়। ঘরের বালভটি জ্বলছে। পায়ের দিকে টুলে রাখা টেবিল ফ্যানটি আলনার দিকে ফিরে মাঝারি স্পিডে ঘুরে চলেছে। খালেদের পিঠ দ্যাখা যাচ্ছে শুধু। এলোমেলো পেছনের চুল। স্যান্ডেল জোড়ার একটি খাটের পাশে অন্যটি দোর গোড়ায়। হঠাৎ দরোজায় জোরে কড়া নাড়ার শব্দ। একবার। দুইবার। তিনবারের বার জেগে ওঠে সে। পাশ ফিরে সোজা হয়। বুকের বালিশটা পায়ের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে উঠে বসে। আবার কড়া নড়ার শব্দ।
খালেদ : খুলছি। এক মিনিট।
(খাট থেকে নেমে হাই তোলে। শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে এসে দরোজা খোলে, খালেদের ঘাড়ের পাশ দিয়ে একটি গম্ভীর মেয়ের মুখ দ্যাখা যায়। তাকিয়ে আছে খালেদের মুখের দিকে। নাজনীন আকতার।)
খালেদ : ভিতরে এসো। (ঘুম জড়ানো গলা। নাজনীন নিশব্দে ঘরে ঢোকে। খালেদ দরোজা ভেজিয়ে দেয়। নিচের বালিশটা খাটে তুলে রাখে। )
খালেদ : কি ব্যাপার এই সাত সকালে? (হাই তোলে। টেবিলের উপর থেকে বোতল নিয়ে ঢকঢক পানি খায়। নাজনীন সারা ঘরে চোখ বুলায়।
খালেদ : কি হলো, বোসো, কথা বলছো না কেন? (তাকায়, দ্যাখে তার দিকে তাকিয়ে আছে)
নাজ : কাল রাতে কখন ফিরেছো? (কন্ঠে রাগ স্পষ্ট। )
খালেদ : মধ্যরাতের দেড়ঘন্টা পরে। (পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করে)
নাজ : ঘরের এ দুরবস্থা কেন?
খালেদ : আফটার এফেক্ট।
নাজ : কিসের আফটার এফেক্ট?
খালেদ : গতকাল খালেদ আরেফিনের একক রজনী ছিলো।
নাজ : মানে?
খালেদ : মানে, কাল কলেজের বন্ধুরা সবাই রিইউনিয়ন করলাম। ঝাড়া তিন ঘন্টা আবৃত্তি করেছি। বোসো না। (কাঁধ ধ’রে বসিয়ে দেয় চেয়ারে। খালেদ টেবিলে উঠে বসে। )
নাজ : শুধু আবৃত্তি?
খালেদ : আয়োজন ছিলো। শুধু মুখে কি আর গাধার খাটুনি দেয়া যায়?
নাজ : তোমার হয়েছে কি খালেদ? আজকাল তুমি বড্ডো বেশি করছো। ডুয়িং এক্সট্রিম। গত তিনদিন তোমার কোনো খবর নেই। তুমি ক্লাসে যাও না, ক্যাম্পাসে যাও না। পত্রিকা অফিসে টেলিফোন কোরে তোমাকে পাওয়া যায় না। সত্যি কোরে বলো তো, তুমি কি আমাকে এড়িয়ে চলছো?
খালেদ : ছিঃ তোমাকে এড়িয়ে চলার প্রশ্নই আসে না! লক্ষী নাজ, তুমি জানো না কাল সন্ধে পর্যন্ত আমি কি রকম ব্যস্ত ছিলাম।
নাজ : কিসের এতো ব্যস্ততা তোমার? (কন্ঠস্বর ভেজা মনে হয়)
খালেদ : দুই দুটো ফৰ্মা ছাপা হলো এই দুদিনে। দুদিন প্রেসেই কাটিয়েছি।
নাজ : একটা টেলিফোন করতে পারতে!
খালেদ : আসলে আমার মনেই হয়নি যে, দুটো দিন অনেক সময়।
নাজ : এতো উদাসিন তুমি, এতো বেখেয়াল! (দীর্ঘশ্বাস ফেলে)
খালেদ : (কপালের চুল সরিয়ে দিতে দিতে) মন খারাপ কোরো না প্লীজ। আজ থেকে একদম ফ্রি আমি। বোসো একটু, হু। (বাথরুমে যায়। ট্যাপ থেকে পানি পড়ার শব্দ আসতে থাকে। নাজনীন আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসে। লাইট ও ফ্যান অফ কোরে খাটের দু চারটে বই সরায়। ফিরে এসে টেবিলের বই খাতাগুলো একপাশে সরিয়ে রাখে। লেখার খাতাটা পড়তে থাকে। চুল ব্রাশ করতে করতে বেরিয়ে আসে খালেদ। টেবিলের কাছে আসে। নাজ তাকায়।)
খালেদ : নোতুন লেখা।
নাজ : শোনাও না।
খালেদ : শেষ হয়নি এখনো। শোনাবো।
নাজ : এটুকুই ভালো লাগলো। আগের লেখা থেকে একেবারে আলাদা।
খালেদ : ভালো লাগছে? সত্যি?
নাজ : হ্যাঁ। লেখাটা আসলেই ভালো হচ্ছে।
খালেদ : (আলনায় শার্ট বদলাতে বদলাতে) আমি খুব সংশয়ে ছিলাম। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কেমন হচ্ছে।
নাজ : তোমার ঘরে কিচ্ছু নেই? খুব চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো।
খালেদ : বাউন্ডুলের তবু একখানা ভাড়া ঘর আছে। বেরোই চলো। ক্যাম্পাসে গিয়ে চা খাবো।
নাজ : নাস্তা খাবে কোথায়?
খালেদ : কেন মধুর ক্যান্টিনে। (খালেদ যথাসম্ভব ঘরটা গোছানোর চেষ্টা চালাতে থাকে।)
নাজ : আমার ভাল্লাগে না। তারচে’ টি.এস.সি-তে নাস্তা করো।
খালেদ : নাহ, স্ন্যাকসে আমার পোষায় না। কেন মধুতে খারাপ লাগার কি হলো।
নাজ : সারাক্ষন মারামারি হয় ওখানে…
খালেদ : (হা হা কোরে হেসে ওঠে) সব মেয়েদের এই এক রোগ। কী যে ভাবো তোমরা মধুর ক্যান্টিনকে। আমার সাথে তো কতোদিন গেছো। হয়েছে কিছু?
নাজ : না, তবু ভাল্লাগে না। ভিড়, হৈ চৈ, শ্লোগান, মিছিল….
খালেদ : আমার তো এসবই ভালো লাগে। ভীষন প্রানবন্ত মনে হয়। (সিগারেট ধরিয়ে খাটে বসে।) কি ব্যাপার গ্যাট হয়ে বোসেছো, উঠবে না?
নাজ : সাড়ে নটা থেকে ক্লাস। (খালেদ ঘড়ি দ্যাখে। নাজের দিকে তাকিয়ে এক মনে সিগারেট টানে। নাজ টেবিলে মুখ নামিয়ে খাতায় আঁকিবুকি কাটে।)
নাজ : তোমাকে একটা কথা জানানো দরকার।
খালেদ : কি বলো?
নাজ : তোমার সাথে আমার মেলামেশাটা বাসায় পছন্দ করছে না।
(হঠাৎ টেবিল ঘড়িতে এলার্ম বেজে ওঠে। চমকে তাকায় নাজ। খালেদ উঠে এসে বন্ধ করে)
খালেদ : তো এখন আমার সাথে সম্পর্ক ছেদ করতে চাও?
নাজ : আমি কি তাই বলেছি? আচ্ছা খালেদ, তুমি কি তোমার এই জীবন যাপন পাল্টাতে পারো না? একটু স্বাভাবিক হতে পারো না?
খালেদ : গৃহপালিত মানুষের মতো জীবন— আমি ভাবতেই পারি না।
নাজ : পড়াশুনাটা ঠিক মতো করলে অনেকের চে’ তোমার রেজাল্ট ভালো হতো।
খালেদ : এই শিক্ষাপদ্ধতির উপর আমার বিন্দুমাত্র আস্থা নেই।
নাজ : তাহলে ইউনিভার্সিটিতে পড়ছো কেন?
খালেদ : পড়ছি এই শিক্ষা পদ্ধতির সাথে যুক্ত না থেকে একথা বল্লে লোকে বলতো সুযোগ না পাওয়ার আক্রোশ— তাই।
নাজ : জানো, কেউ তোমাকে ভালো বলে না। অনেকেই তোমার লেখা পছন্দ করে কিন্তু তোমাকে পছন্দ করে না।
খালেদ : (মৃদু হেসে) সে কথা তোমার চে’ অনেক বেশি কোরে আমি জানি, বুঝি।
নাজ : তবু তুমি ভালো হতে চাও না? ভালো থাকতে চাও না?
খালেদ : ভালোর কি নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা আছে?
নাজ : না, তা নেই। তবু সমাজে তো ভালোর একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে। সবাই মোটামুটি একটা মানদন্ড মেনে নিয়েছে।
খালেদ : না, সবার মানদন্ড এক নয়।
নাজ : কেন এক নয়? সবাই ভালো থাকতে চায়। সবাই সুখি হতে চায়।
খালেদ : তোমার ভালো থাকতে চাওয়া আর একজন কৃষকের ভালো থাকতে চাওয়া কখনোই মিলতে পারে না। আর সুখ? সে তো এক অনন্ত বিতর্কের ব্যাপার।
নাজ : তুমি সব কিছুই উল্টো কোরে ভাবো। তত্ত্ব আর জীবন যে এক নয় তা তোমার ভালো কোরেই জানা আছে।
খালেদ : আচ্ছা তুমি আমাকে কি রকম ভালো থাকতে বলো?
নাজ : কি রকম আবার। এখন থেকে সিরিয়াসলি পড়াশানা করবে যাতে এম এ-তে ফার্স্ট ক্লাস পেতে পারো। একটু চেষ্টা করলেই তুমি পারবে। তারপর একটা ভালো চাকরির চেষ্টা করবে। তোমার ভালো পরিচিতি আছে। এই সুযোগটা তুমি অনায়াসেই ব্যবহার করতে পারো। আর লেখা তো তোমার থাকছেই। সচ্ছলতা না থাকলে তুমি লেখার চিন্তা করবে কখন? আর এই বাউন্ডুলে জীবন ছাড়ো। তুমি কি সুখি হতে চাও না?
(দরোজায় কড়া নাড়ার শব্দ। খালেদ উঠে দরোজা খোলে।)
শ্যামল : আমি আপনার কাছে এছি। দুদিন ক্যাম্পাসে খুঁজে না-পেয়ে ভাবলাম বাসায় পাওয়া যাবে।
খালেদ : আসেন, ভেতরে আসেন। (শ্যামল ভিতরে এলো। কিছুটা সংকোচ ভাব) বসেন। (উভয়ে বসে। নাজ টেবিলে মুখ নিচু কোরে কিছু পড়তে থাকে।) কি ব্যাপার। বলেন?
শ্যামল : আমি আসছি কুমিল্লা থেকে। পরশুদিন আমাদের কবিতা সন্ধা। ঢাকা থেকে কবিরা যাচ্ছেন, আপনাকেও যেতে হবে।
খালেদ : পরশু!
শ্যামল : আমরা আপনার নাম প্রচার করেছি, কার্ডে ছেপেছি।
খালেদ : আগে থেকে না জানিয়ে নাম প্রচার করা কি ঠিক হয়েছে?
শ্যামল : গত মাসে আমরা যোগাযোগ করতে এসেছিলাম, কিন্তু আপনার সাথে দ্যাখা করতে পারিনি। রফিক ভাই বল্লেন অসুবিধে হবে না, ছেপে দিও।
খালেদ : ঠিক আছে। যাবার ব্যবস্থা কি?
শ্যামল : সবাই বাসে যাবেন। সকাল সাতটায় ফুলবাড়িয়ায় আসলেই হবে। আমরা আগে থেকে টিকিট কেটে রাখবো। দেরি করবেন না। আর যদি বলেন তো আমরা কেউ এসে নিয়ে যাবো।
খালেদ : না, আসার দরকার নেই। আপনার নামটা জানা হলো না।
শ্যামল : শ্যামল জাকারিয়া।
খালেদ : ঢাকা থেকে আর কে কে যাচ্ছে?
শ্যামল : গুনদা, রফিক ভাই, মহাদেব সাহা, তরুন দু একজন যাবে আরো…
খালেদ : আপনারা কোনো রাজনীতির সাথে জড়িত?
শ্যামল : ঠিক জড়িত নই। তবে প্রগতিশীল রাজনীতির প্রতি আস্থা আছে আমাদের। এই যে আমাদের অনুষ্ঠানের কার্ড, আর লিফলেট। (একটা খাম দেয়) খালেদ ভাই আমি এখন যাবো। আরো দু এক জায়গায় যেতে হবে।
খালেদ : ঠিক আছে। কোনো আপ্যায়ন করতে পারলাম না ভাই।
শ্যামল : না না না ঠিক আছে। ঠিক সাতটায় পৌঁছাতে চেষ্টা করবেন। চলি।
খালেদ : আচ্ছা। (শ্যামল বেরিয়ে যায়। দরোজা লাগিয়ে খালেদ টেবিলের কাছে আসে। নাজের কাঁধে হাত রাখে।) বসবে আরো?
নাজ : হু। তাড়িয়ে দিতে চাচ্ছো কেন?
খালেদ : কৈ?
নাজ : আসার পর থেকেই তো চলো উঠি, চলো বেরোই করছো। (খালেদ জোরে হাসে, সিগারেট ধরায়।) খালি পেটে একটার পর একটা সিগারেট খেও না তো। (কেড়ে নিতে চেষ্টা করে)
খালেদ : আরে কিচ্ছু হবে না।
নাজ : মরবে।
খালেদ : অতো সহজে মরছি না। এই সমাজে যখন বেঁচে থাকতে পারছি তখন এই সামান্য সিগারেট আমার কিছুই করতে পারবে না। বুঝলে?
নাজ : হু, বুঝলাম, তোমার মাথার চিকিৎসা করাতে হবে। (উঠে আসে নাজ। খালেদের শার্টের বুকের একটা বোতাম লাগায়। বুকে, গলায় হাত বুলায়। গলার চেনটা ধরে।)
নাজ : তোমাকে এতো না-করি, তবু এই চেনটা পরো।
খালেদ : (হেসে) সমাজ আমাদের প্রত্যেকের গলায় যে একটা কোরে শিকল পরিয়ে রেখেছে এটা তার ভিজ্যুয়াল।
নাজ : আমি তোমাকে একটা সুন্দর চেন দেবো, এটা পোরো না। আমার ভাল্লাগে না।
খালেদ : একটা সুন্দর চেন পরে আমি কি আমার গলার অদৃশ্য অসুন্দর শিকলটি সরাতে পারবো? পারবে তুমি? তাহলে?
নাজ : তুমি এতো সিরিয়াস হচ্ছো কেন?
খালেদ : শৃংখলের কোনো সুন্দর অসুন্দর নেই। শৃংখল মানেই বন্দিত্ব। আর বন্দিত্ব সবসময় কুৎসিত, কদাকার। আমি আমার গোলামিকে সাজিয়ে গৌরব করতে পছন্দ করি না। আমার গলার অদৃশ্য শিকলটিকে আমি ছিঁড়ে ফেলতে চাই।
নাজ : আসলে আমার দেয়া কোনো জিনিশই তুমি নিতে চাও না।
খালেদ : শৃংখল ছাড়া আর সব জিনিশ নিতে আমি প্রস্তুত।
নাজ : তার মানে ওই শিকলটাই তুমি পরবে।
খালেদ : দ্যাখো নাজ, এটা কোনো ব্যাপারই না। এটা পরলেও কিছু না, না পরলেও কিছু না। শুধু শুধুই এ নিয়ে তুমি মন খারাপ করছো।
নাজ : না খালেদ, শুধু শুধুই না। আমি খুব খেয়াল কোরে দেখেছি, কোথায় যেন তোমার সাথে আমার মেলে না। একটা খুব সূক্ষ ফাঁক থাকে, ফারাক থাকে। আমি যেন তোমাকে ঠিক বুঝতে পারি না।
খালেদ : কোথায় মেলে না জানো? আকাংখায়। স্বপ্নে। তুমি যে জীবনের স্বপ্ন দ্যাখো, যেভাবে জীবন যাপন করতে চাও, আমি ঠিক সেভাবে চাই না। সেভাবে পারি না। তোমার পারিবারিক বিত্ত, সচ্ছলতা তোমার ভেতরে যে স্বপ্নের জন্ম দিয়েছে, যে আকাংখার জন্ম দিয়েছে, তোমার প্রতিবেশ তোমার যে রুচি নির্মান করেছে, তুমি তাকে কি কোরে অস্বীকার করবে?
নাজ : তুমি তো জানো, বিত্তের ওই ঝলোমলো জগৎ কখনোই আমার ভালো লাগে না। ওই কৃত্রিম আভিজাত্যে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। কেবলি আমার পালাতে ইচ্ছে হয়। ওই ফাঁপা চকচকে মানুষগুলোকে আমি একদম সহ্য করতে পারি না। আমিও তো চাই এই বৈষম্যের সমাজ কাঠামো ভেঙে পড়ুক।
খালেদ : তোমার এই চাওয়ার ভেতর এখনো আবেগের ভাগটাই বেশি।
নাজ : না। মানব সভ্যতার ইতিহাস আমি জানি। সমাজ বিবর্তনের ইতিহাস আমি পড়েছি। আমার শ্রেনী অবস্থান সম্পর্কে আমার ধারনা স্পষ্ট। আমি জানি সমাজ বিকাশের প্রয়োজনেই আজকের এই সমাজ ভেঙে যাবে। ভেঙে যেতে বাধ্য সে। তোমার আমার চাওয়া না চাওয়ায় কিছু যায় আসে না। আমি সুন্দরভাবে বাঁচতে চাই। সুন্দর একটা জীবন চাই আমি। খালেদ, কৃত্রিম ওই কাচের পৃথিবীতে আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আমি মানুষকে বিশ্বাস করতে চাই।
খালেদ : কিন্তু এই সমাজ তোমার স্বপ্নকে গলা টিপে মারার জন্যে সারাক্ষন হাত বাড়িয়ে আছে।
নাজ : সে কথা আমিও জানি। কিন্তু তুমি আমাকে বুঝতে চাও না কেন?
খালেদ : বুঝতে চাই। বুঝতে চেষ্টা করি। মানুষের তো একটাই জীবন।
নাজ : খালেদ, প্লিজ, তুমি ওরকম উচ্ছৃংখল জীবন যাপন কোরো না। একটু স্থির হও। (নাজ খালেদের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। খালেদের মাথাটা নাজের কাঁধে নেমে আসে। আলতো আঙুল বুলায় নাজ খালেদের চুলে। দুজনেই নিরব। শুধু টেবিল ঘড়ির টিক টিক শব্দ শোনা যায়।)
নাজ : চলো উঠি। (খালেদ মাথা তোলে, তাকায়, নাজ প্রশ্রয়ে হাসে, বিনিময়ে সে-ও)
খালেদ : চলো। (উঠে দু একটা বইখাতা নেয়। নাজ ড্রেসটা ঠিক আছে কিনা দ্যাখে। নাজ আগে বেরোয়। তালা চাবি হাতে খালেদ পেছনে। ক্লোজ- আপে দরোজাটা বন্ধ হতে দ্যাখা যায়)
দ্বিতীয় দৃশ্য
ক্যামেরা ক্লোজ। ৩০৯ নম্বর দরোজার সামনে একটি যুবক দরোজার তালা খুলছে। দরোজা খুলে ভেতরে ঢুকে মেঝে থেকে চিঠিটি কুড়িয়ে নিলো। ক্যামেরা পেছন থেকে তাকে অনুসরন করছে। ঘরে সন্ধার আগের হালকা আলো। সে সুইচ টিপে আলো জ্বালে। টেবিলে বইখাতা রাখে। হলের সিঙ্গেল রুম। বেশ গোছানো। খামটা ছিঁড়ে খাটে বোসে চিঠিটি পড়তে শুরু করে। এখন তার মুখ দ্যাখা যায়। শেখ মাহবুব আলী।
স্নেহের মাহবুব,
পরম করুনাময়ের ইচ্ছায় আশা করি কুশলে আছো। দিন পনেরো হইল আমি অসুখে আক্রান্ত হইয়া শয্যাশায়ী। তুমি দুশ্চিন্তা করিবে এ কারনে এতদিন তোমাকে জানাই নাই। আমাদের মোস্তফা ডাক্তারের ঔষধ খাইতেছি। শরীরে শক্তি পাই না। রোগেরও কোনো উপশম হইতেছে না। জানি না এ যাত্রায় ফিরিতে পারিব কিনা। মন ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। তোমার ছোট চারটি ভাই বোন আছে। উহাদের তুমি ত্যাগ করিও না। দরিদ্র ইস্কুল শিক্ষক পিতাকে অভিসম্পাত করিও না। আমি সারাজীবন তোমাদের শিক্ষার পথে পরিচালিত করিতে যথাসাধ্য করিয়াছি। জীবনে কোনো অন্যায় পন্থা গ্রহন করি নাই। মনে একটা কষ্ট থাকিয়া থাকিয়া জাগিয়া উঠে। দারিদ্র্যের অভিশাপে তোমাদের মানুষ হইতে হইতেছে। সংসারে সমস্যার কথা জানাইয়া তোমাকে আর চিন্তায় ফেলিতে চাই না। সম্ভব হইলে একবার বাড়ী আসিও। রোকেয়ার একটি পাত্র ঠিক করিয়াছি। ছেলেটি ভালো। পড়াশুনার যত্ন নিও। আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন।
ইতি
তোমার আব্বা
(চিঠি প’ড়ে চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে মাহবুব। চশমাটি বার বার খোলে। চেয়ার থেকে উঠে পায়চারী করে। খাটে বসে। মাথার নিচে হাত দিয়ে আধশোয়ার ভঙ্গিতে থাকে। দরোজার কাছে জুতোর শব্দ।)
সিজার : হ্যালো মাহবুব। (রুমে ঢোকে সিজার। মাহবুব তাকায়, ওঠে না।)
মাহবুব : কি খবর? বোসো। (চেয়ার টেনে বসে)
সিজার : সন্ধের সময় শুয়ে আছো, শরীর খারাপ?
মাহবুব : না। (উঠে বসে। বুকের দুটো বোতাম খোলা।) পরীক্ষা কেমন হলো?
সিজার : নট ব্যাড।
মাহবুব : ফওজিয়ার খবর কি? ও কেমন দিয়েছে?
সিজার : পরীক্ষার পর দ্যাখা হয়নি। শুনলাম ভালো। ওর পরীক্ষা তো ভালো হবেই। (রুমের সামনে দিয়ে দু একজন এদিক ওদিকে যাচ্ছে। তারা হলের ছাত্র।)
মাহবুব : মোর্শেদ ভাই ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেছে শুনলাম।
সিজার : হ্যা, গতকাল। পুরো একটা বছর বসিয়ে রাখলো বেচারাকে।
মাহবুব : যাক তবু হলো শেষ পর্যন্ত।
সিজার : সে-ই। আজকালকার দিনে ভদ্রলোক হলে ভোগান্তির শেষ থাকে না।
মাহবুব : উনি তো একেবারে আপাদমস্তক ভদ্রলোক!
সিজার : আমাদের কবিবন্ধুর খবর কি?
মাহবুব : আছে। ভালোই। তোমার সাথে দ্যাখা হয় না?
সিজার : বেশ কিছুদিন দ্যাখা হয় না। আচ্ছা, নাজনীনের সাথে ওর সম্পর্ক আজকাল কি রকম?
মাহবুব : ভালোই তো দেখি। কেন? (মাহবুব সতর্ক চোখে তাকায়)
সিজার : ওদের কি প্রেম? আই মিন ইজ ইট এ লাভ এ্যাফেয়ার?
মাহবুব : ওরা দুজন তো তোমারও ভালো বন্ধু, তুমি জানো না?
সিজার : ডোন্ট মাইন্ড মাহবুব, আমি আসলে কনফার্ম হতে চাচ্ছি। তোমার ক্লাসমেট তো আমার চে’ তুমি অনেক বেশি কাছাকাছি থাকো। তোমার কি তেমন মনে হয়েছে?
মাহবুব : সবাই তো বলাবলি করে যে ওদের প্রেম!
সিজার : সবার কথা বাদ দাও। ক্যাম্পাসে একটা মেয়ের সাথে একটা ছেলে হাঁটলেই তো সবাই প্রেম ভাবে। তোমার কি মনে হয়?
মাহবুব : সিজার, ওদের দুজনকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেই তো ব্যাপারটা মিটে যায়।
(সিজারকে সামান্য চিন্তিত ও অস্থির মনে হয়। সিগারেট ধরায় সে। ) আচ্ছা, নাজনীন কি খালেদের বাসায় যায়?
মাহবুব : অনেকেই তো যায়।
সিজার : ও কি প্রায়ই যায়?
(দরোজায় একটি ছেলে দাঁড়ায়। একটু ইতস্তত কোরে ঢুকে পড়ে)
ছেলেটি : মাহবুব ভাই, কলমটা একটু দেবেন? দুই মিনিট। আমাদের রুমে লেখার কিছুই নেই। একটা ঠিকানা লিখবো।
সিজার : (বিরক্ত ভাবে) স্ট্রেঞ্জ। ছাত্রদের ঘরে লেখার কিছু নেই?
ছেলেটি : (ফিরে) ও সিজার ভাই! সালামালেকুম, ভালো আছেন? (হেসে) আমাদের রুমটা হইছে ভাদাইমাদের আড্ডাখানা। কিচ্ছু থাকে না ঘরে।
মাহবুব : মাঝে মধ্যে তো রুমটাই থাকে না। (কলম দেয়। ছেলেটি যেতে যেতে)
ছেলেটি : জেনারেল কি আজ আসবে?
মাহবুব : ঠিক নেই, আসতেও পারে। ওর তালের কোনো ঠিক আছে নাকি!
সিজার : জেনারেল কে?
মাহবুব : কবি খালেদ আরেফিন। ওদের ওস্তাদ।
সিজার : কি রকম?
মাহবুব : কি রকম আবার! সব মারফতি লাইনের। দিন রাত ধুনের উপরে আছে। তুমিও তো এ লাইনের সদস্য ছিলে এক সময়।
সিজার : নাহ্। আমি অকেশনাল! ছেলেটিকে তো ফার্স্ট ইয়ার ফার্স্ট ইয়ার মনে হলো।
মাহবুব : ওসব এখন আর ইয়ার টিয়ারের মধ্যে নেই। সব সমান কোরে ফেলেছে ওরা। (উঠে শার্ট খোলে। টেবিল থেকে খালি পানির বোতল নিয়ে বেরোয়।) একটু বোসো। (সিজার চিন্তিত মুখে সিগারেট টানে। আর একটি ছেলে উঁকি দেয়। )
২য় ছেলে : মাহবুব ভাই নেই?
সিজার : বাথরুমে। (ছেলেটি চলে যায়। একজন উচ্চস্বরে গান গাইতে গাইতে দরোজা পার হয়। )
(মাহবুব ফিরে আসে। বোতলটা টেবিলে রাখে। মুখ মোছে গামছায়। )
সিজার : আচ্ছা মাহবুব, তোমার কি মনে হয় নাজনীন সত্যি সত্যি খালেদের মতো একটা বাউন্ডুলেকে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করবে?
মাহবুব : ব্যাপারটা কি বলো তো সিজার? ওদের নিয়ে তুমি খুব চিন্তায় পড়েছো মনে হচ্ছে?
সিজার : না… আসলে… মানে ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
মাহবুব : কি?
আই মিন, নাজনীন আসলেই কাউকে ভালোবাসে কিনা! ওকে ঠিক বুঝতে পারি না আমি!
মাহবুব : ও আমাদের সাথে যেরকম ফ্রিলি মেশে তাতে বাইরের কেউ দেখলে অন্য কিছু ভাববে তাতে সন্দেহ নেই।
সিজার : সেজন্যেই তো আমি কনফার্ম হতে চাই। খালেদের সাথে ওর রিলেশন আমার শুধু ফ্রেন্ডশিপ মনে হয় না।
মাহবুব : আমি অবশ্য খালেদকে কখনো জিজ্ঞেস করিনি। খালেদও বলেনি কিছু আমাকে। কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমি যথাসম্ভব কম নাক গলাতে পছন্দ করি।
সিজার : নাজনীন তোমাকে কিছু বলে না? আই মিন, খালেদের ব্যাপারে।
মাহবুব : স্পষ্ট কোরে কখনোই তেমন কিছু বলেনি। তবে খালেদের ব্যাপারে যে ও একটু বেশি ভাবে তা বোঝা যায়। খালেদকে ও আমাদের চে’ একটু বেশিই গুরুত্ব দেয়।
সিজার : সেটা হয়তো খালেদের পরিচিতি বা ক্রিয়েটিভিটির কারনে— হতে পারে না?
মাহবুব : কি জানি। আমি অতোটা ভাবিনি।
সিজার : খালেদের সাথে পরিচয় হবার অনেক আগেই নাজনীনের সাথে আমার ফ্রেন্ডশিপ। ও একটু বেশি মাত্রায় রোমান্টিক। আপস্টার্ড সোসাইটিকে ও ঘৃনা করে। ওর ধারনা ওর বাবা অন্যায়ভাবে বেশি সম্পদ ভোগ করছে। লেফ্ট পলিটিক্সের রোমান্টিসিজমে ভোগে ও। প্রাক্টিক্যাল লাইফে এলে এসব মোহ থাকবে না আমি জানি। কারোরই থাকে না। কতো দেখলাম। কিন্তু …
মাহবুব : সিজার, এমনও তো হতে পারে নাজনীন যা ভাবে তার সবটাই রোমান্টিসিজম নয়! পারে না?
সিজার : আমার মনে হয় না। ওর মা বাবার ম্যাল এ্যাডজাস্টমেন্টই ওকে এইসব ধারনার দিকে ঠেলে দিয়েছে। ওদের ফ্যামিলির সবই আমি জানি। ওর বাবা ফুললি ম্যাটিরিয়ালিস্ট। আর ওর মা রাতদিন পীর আউলিয়া নিয়ে ব্যস্ত। এরকম একটা আনহ্যাপী পরিবেশে বড়ো হয়েছে বোলে ও ওর ক্লাসকে, ওর সোসাইটিকে ঘৃনা করে।
মাহবুব : হতে পারে। আমি কখনো ওদের বাসায় যাইনি। তোমার কি ধারনা যে নাজনীন এ কারনেই তোমাকে ততোটা পছন্দ করে না?
সিজার : আমি ঠিক জানি না। হয়তো তাই।
মাহবুব : তুমি বরং নাজনীনের সাথে খোলাখুলি আলাপ করো। এরকম কনফিউশনে থাকার চেয়ে সেটাই ভালো হবে।
সিজার : কিন্তু… কিন্তু ও যদি রিফিউজ করে! (বাইরে শিস দিতে দিতে কেউ দরোজায় আসে।)
বশির : ভালো ছাত্রের খবর কি? সিজার কেমন আছেন?
সিজার : খবর তো এখন আপনাদের। (বশির ভেতরে আসে। সিজারের সাথে হ্যান্ডশেক করে। শাদা প্যান্ট শাদা শার্ট। মাহবুবের পাশে বোসে পিঠে একটা চাপড় দেয়। )
বশির : কিরে দোস্ত মন মরা কেন্। শইল খারাপ নাকি?
মাহবুব : বাড়ির খবর ভালো না।
বশির : আমাদের কারই বা বাড়ির খবর ভালো তুই ক? চিন্তা ঝাইড়া খাড়া হয়া দাঁড়া, দেখবি সব ঠিক। জীবনের আসল সময়টাই গেল টেকার চিন্তায় (সিজারের দিকে) জীবনে মৌজ কইরা গেলেন আপনারা। বাড়ি, গাড়ি, টেকা, মাইয়ামানুষ— কোনো চিন্তা নাই। চালাইয়া যান।
সিজার : (একটু অস্বস্তি বোধ করে। সিগারেট বের করে বশিরকে একটা দেয়। ধরায়।) দূর থেকে ওই রকম মনে হয়। আসলে ঘটনা একই।
বশির : একই না ভাইজান, একই না। টেকা, টেকা, নো মানি, কুত্তায়ও জিগাইব না। কতো হালারে দেখলাম ইভার্সিটির বেঞ্চে গুয়া ঘ’ষতে ঘ’ষতে গুয়ার ছাল উঠায়া ফ্যালাইল— কুনো কামে আসে নাই। সার্টিফিকেট কি ধুইয়া খাওনের জিনিশ— টেকা, বুঝলেন মামু, টেকা।
মাহবুব : ঘরে ঢুইকাই লেকচার শুরু করলি, ব্যাপারটা কি?
বশির : ব্যাপার টেকা। মাথা গরম। টেকা নাই।
মাহবুব : তোর কাছে আবার টাকা নাই! কেউ বিশ্বাস করবে?
বশির : না দোস্ত কামাই রোজগার খারাপ। সব শালা সেয়ানা হয়া গ্যাছে। এখন টেকা কামানো বহুৎ কঠিন। পাবলিক হালায় বহুৎ সেয়ানা।
মাহবুব : তোমরাও তো তারচে’ বেশি সেয়ানা।
বশির : হইলে কি হইবো। অসুবিধা মামু অস্-সুবিদা! (উঠে বোতল থেকে পানি খায়। টেবিলের খামটা হাতে নিয়ে আবার রেখে দেয়। ) তোমাগোর চিন্তা কি। ভালো ছাত্র, ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট হইবা, ডিপার্টমেন্ট ডাইকা লইবো, মাস্টার হইবা। পোলাপান পড়াইবা। বিয়া শাদি কইরা মৌজ করবা। আমাগো কপালে কিছুই জুটলো না। হালার পোড়া কপাল। আল্লা হালায় বানাইছিলো মন্দ না, চেহারা সুরতটা দিছিলো চলনের মতোই মগর মাথায় মাল দেয় নাই। এক্কেরে বাজে কোয়ালিটির মগজ ভইরা দিছে। রেশন ডিলারের পোলার মাথায় কতো আর ভালো মগজ দিবো। বাপে হালায় মালে ভেজাল মারতাছে আল্লায়ও পোলার মাথায় ভেজাল মাল চালায়ে দিছে।
সিজার : উঠি মাহবুব। একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
বশির : আরে বসেন, বসেন।
মাহবুব : কিছুক্ষন বোসো না। এক সাথেই উঠবো।
সিজার : ওকে। আটটার মধ্যেই কিন্তু উঠতে হবে।
মাহবুব : ঠিক সাড়ে সাতটায় উঠবো। ছাত্র পড়াতে যেতে হবে আমাকে।
সিজার : আপনাদের রাজনীতির খবর কি?
বশির : আমাদের আবার রাজনীতি! ওই নীতি-ফিতির রাজনীতির আমি করি না। আমার হইলো টেকা, টেকার রাজনীতি। সেই কথাই তো কইতেছিলাম। অবস্থা ভালো না বিশেষ। নিজেগো মধ্যে হাউকাউ। সবাই বস হইবার চায়।
সিজার : আপনার নাম-টাম তো শুনি আজকাল খুব।
বশির : ফাটাইলে ফুটাইলে ওরম নাম একটু হয়ই। নাম দিয়া কি করুম কন্! আমার দরকার টাকা।
সিজার : বিজনেসে নেমে পড়েন না কেন?
বশির : পুঁজি কোথায়? মস্তানির পুঁজি দিয়া বিজনেস করতে গেলে ভালো কোয়ালিটির মগজ দরকার। হেইডাই তো নাই।
মাহবুব : কাশেমের সাথে নাকি তোর ঠোকাঠুকি হইছে?
বশির : হ। হালার পো একটা ইতর। সিটির পোলা, হলে আইসা মাস্তানি মারায়। দিছি জায়গা মতো। হাসপাতালে দু একদিন বেড়ায়া আইতে পারবো। দোস্ত শান্তি নাই। নিজেরে বেইচা দিয়া আইলাম এই লাইনে। সুখ নাই। দুনিয়ায় সুখ নাই দোস্ত।
খালেদ : আছে, আছে দুনিয়ায় সুখ আছে এখনো। (ঘরে ঢোকে সাথে ফরিদ।)
বশির : আরে শ্যা-লা, কয় গ্যালন?
খালেদ : না দোস্ত ট্যাংকি খালি। আরে সিজার খবর কি তোর?
সিজার : ভালোই।
খালেদ : পরিচয় করিয়ে দিই, আমার বন্ধু ফরিদ আহমেদ, ইয়াং পেইন্টার। ও কুখ্যাত বশির, কৃতি ছাত্র মাহবুব, আর এই হলো সিজার। সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। (ফরিদ সবার সাথে হ্যান্ডশেক করে। খালেদ টেবিল থেকে বোতল নিয়ে ঢক ঢক কোরে পানি খায়। )
মাহবুব : বসেন। আপনার ছবি দেখলাম কালকে প্রদর্শনীতে
ফরিদ : ভালো লাগলো?
মাহবুব : দুটো কাজ খুবই ভালো লেগেছে। রিয়েলিস্টিক কাজ আমার খুব ভালো লাগে।
ফরিদ : (বশিরকে) আপনাকে আমি চিনি। রনিদের ক্লাস-মেট না আপনি?
বশির : হ্যাঁ। আপনার সাথে কি কখনো আলাপ হইছিলো?
ফরিদ : না, ঠিক আলাপ হয়নি।
খালেদ : বশির মিয়ার খবর কি বলো? চেহারা সুরত তো দিন দিন পাল্টায়ে যাচ্ছে।
বশির : হ, ফিলিমে নামতাছি। তা তোর খবর কি? ভাবী সায়েবার সাথে মহব্বত চলতাছে কেমন?
খালেদ : ভাবী সায়েবাটা আবার কে?
বশির : এ্যাডভান্স কইলাম আর কি! (হেসে) নাজনীন কেমন আছে?
খালেদ : ভালোই। কিরে মাহবুব তোর টিউশনি নেই আজ?
মাহবুব : যাবো একটু পরে। সিজার একেবারে চুপ মেরে গেলে?
খালেদ : সিজার নাকি বাইরে যাচ্ছিস?
সিজার : কোথায় শুনলি?
খালেদ : কে যেন বলছিলো সেদিন। খুব সম্ভব রুমা।
সিজার : এখনো হয়নি কিছু।
বশির : আমিও বাইরে যাইতাছি।
মাহবুব : মিডিল ইস্ট?
বশির : না, ছাগলনাইয়া। (সবাই হেসে ওঠে। বিব্রত হয় সিজার) মাইন্ড কইরেন না ভাই।
(১ম ছেলেটি দরোজায় দাঁড়িয়ে সালামের ভঙ্গিতে হাত তোলে, হাতে কলম।)
খালেদ : কিরে খবর কি তোদের?
১ম ছেলে : খুঁইজাই পাই না তোমারে। কই থাকো? পরশু মহাসম্মেলন হয়ে গেল।
খালেদ : বেশি পাইতে চাইও না এখন। ব্যস্ত আছি।
১ম ছেলে : মাহবুব ভাই এই যে কলমটা। (কলম দেয়। ফিরে) রুমে যাবা এখন?
খালেদ : এখন না পরে। কে কে আছে?
১ম ছেলে : সবাই। বশির ভাই ভালো আছেন?
বশির : আছি আর কি! (ছেলেটি যেতে থাকে) কই যাও, শোনো। তোমাদের ওস্তাদ আইছে, খাওন দাওন কিছু পাঠাও। (হাসতে হাসতে চ’লে যায় )
সিজার : উঠবো, তোরা আড্ডা দে।
মাহবুব : খালেদ, রাতে থাকবি?
খালেদ : বোধহয়।
মাহবুব : রুমে থাক তাহলে, আর বাইরে গেলে তালা দিয়ে যাস। আমি দশটার মধ্যে ফিরবো। বশির থাক তুই। ফরিদ, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি ভাই। আসবেন মাঝে মধ্যে। প্রায়ই আমি রুমে থাকি।
সিজার : ফরিদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে) চলি।
ফরিদ : দ্যাখা হবে। (সিজার, মাহবুব বেরিয়ে যায়।
বশির : এই পোলাটারে আমি দুই চোখে দেখবার পারি না। হালায় একটা মাইগ্যা পোলা।
ফরিদ : দেখতে তো বেশ হ্যান্ডসাম।
বশির : আমার পছন্দ হয় না। কাল দুপুরের পরে তুই ফ্রি আছিস, খালেদ?
খালেদ : দুপুর দুটো থেকে অপিস। কেন?
বশির : সন্ধ্যায়?
খালেদ : সন্ধায় ফ্রি। কেন কি ব্যাপার?
বশির : আছে, ব্যাপার আছে। তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাবো।
খালেদ : কৈ?
বশির : গিয়াই দেখিস। তোর এক ভক্ত আছে, তোর সাথে আলাপ করার খুব শখ।
খালেদ : পুরুষ না নারী?
বশির : নারী।
খালেদ : বাহ্ চমৎকার।
ফরিদ : মেয়ে ভক্ত শুনেই একেবারে আটখানা!
(১ম ছেলেটি একটি সিগারেট হাতে ঢোকে। খালেদকে দেয়। খালেদ নেড়ে চেড়ে ধরায়। )
১ম ছেলে : তোমার কবিতা আবৃত্তি চলতাছে।
খালেদ : চালাতে থাকো। দুএকটা নির্দোষ সিগারেট পাঠাস তো।
বশির : সিগারেট আছে আমার কাছে। (প্যাকেট বের কোরে খাটে রাখে। খালেদ দুইটান দিয়ে বশিরের দিকে সিগারেট বাড়িয়ে দিতেই বাড়ানো হাতটি ফ্রিজ হয়ে যায়। )
(সাউন্ডট্র্যাকে—এল্ এল্ এল্ ভা-ন্ডা-রি-ই–ই… ভাও কইরা দিছ মুরশি- দ, এল, এল, এল। ১ম ছেলেটি বেরিয়ে যায়। ঘরে ঢোকে ছাত্র নেতা গোলাম রব্বানী। সবার হাতেই জ্বলন্ত সিগারেট।)
রব্বানী : আরে কান্ড। ভালো আছেন সবাই?
ফরিদ : ভালোই। আপনাদের খবর কি?
রব্বানী : খবর, সামনে সম্মেলন, খুব ব্যস্ত। বশির ভাই ভালো?
বশির : জ্বি ভাই।
খালেদ : বসেন। (রব্বানী চেয়ারে বসতে বসতে)
রব্বানী : আপনার লেখা-টেখা চলছে কেমন? কিছু গরম লেখা-টেখা লেখেন। রাজনীতির পাশাপাশি শ্রেনীসচেতন সাহিত্যও দরকার।
খালেদ : সাহিত্যের নামে শ্লোগান লিখতে চাই না আমি। লিখছি তো, তবে সাহিত্যকে প্রথমে সাহিত্য হয়ে উঠতে হবে। তারপর তার বিষয়।
রব্বানী : শ্রেনী শোষনের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে উচ্চারন হলে কি তাকে আপনি শ্লোগান বলবেন?
খালেদ : সেটা নির্ভর করে আপনার উপস্থাপনার উপর, আপনার শৈল্পিক ক্ষমতার উপর। কোনো বিষয়কে আপনি কতোটা শিল্পসম্মত করতে পারবেন তার উপর।
রব্বানী : শিল্পসম্মত ব্যাপারটারই তো একটা অস্পষ্ট ব্যাপার। কোনো কিছু সরাসরি বোল্লে আপনারা মনে করেন শিল্প হয়নি।
ফরিদ : না না না, তা হবে কেন, সবকিছুরই একটা পদ্ধতি আছে না!
খালেদ : অবশ্যই! যে মাধ্যমে আপনি কাজ করছেন তার গ্রামার মানবেন না আপনি? সব কাজেরই নিজস্ব একটা ভাষা আছে। ছবি আঁকতে গেলে আপনাকে রং তুলি ক্যানভাস ব্যবহার করতে হবে, লাইন টানতে জানতে হবে। ছাগল এঁকে তো আপনি বলতে পারবেন না যে মানুষ এঁকেছি। (বশির হেসে ওঠে।)
বশির : আমি ভাই মর্ডান ছবি বুঝি না। গাদা গাদা রং ছিটায়া নিচে লিখা রাখলো কম্পোজিশন।
ফরিদ : রঙেরও নিজস্ব একটা ভাষা আছে। আপনাকে তো সেটা বুঝতে হবে।
বশির : মাপ চাই। ক্ষমা কইরা দেন।
খালেদ : রাখ তো। আপনাদের এবারের সংকলনে কবিতা হিশেবে যে লেখাগুলো ছেপেছেন তাতে না হবে বিপ্লবের কোনো উপকার না হবে সাহিত্যের। মাঝখান থেকে বিভ্রান্ত হবে পাঠক।
রব্বানী : কি যে বলেন! এবারের দুটো কবিতা তো সবাই খুব পছন্দ করেছে।
ফরিদ : জনপ্রিয়তা দিয়ে শিল্পের মান বিচার করা যায় না।
রব্বানী : আমরা শিল্পের মান দিয়ে কোনো লেখাকে বিচার করতে চাই না। আমরা দেখতে চাই বিপ্লবের পক্ষে তার উপযোগিতা কতোখানি।
খালেদ : আমরা যারা পজিটিভ সাহিত্যের কথা বলি, আমরাও চাই সাহিত্য শ্রেনী সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে উঠুক।
রব্বানী : আপনারা এখনো বুর্জোয়া মানবতাবাদের মোহ কাটিয়ে উঠতে পারেননি। মধ্যযুগীয় ধ্যান ধারনাও দেখেছি অনেকের মধ্যে।
খালেদ : টেবিলে বোসে দল ভাঙা ছাড়া আপনারাই বা কি করতে পেরেছেন? তত্ত্বের কচকচানি ছাড়া আর কি করেছেন আপনারা?
রব্বানী : একটি সঠিক তত্ত্ব ছাড়া একটি সঠিক পার্টি গ’ড়ে উঠতে পারে না। আর একটি সঠিক পার্টির নেতৃত্ব ছাড়া সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয়।
খালেদ : কথাটি মন্ত্রের মতো আওড়ানোর জন্যে নয়, প্রাক্টিসের জন্যে। আর টেবিলে বোসে সেটি প্র্যাক্টিস করা সম্ভব নয়। আপনারা তো এদেশের ইতিহাসই জানেন না, আবহাওয়া জানেন না। যাদের পক্ষে লড়াই করার কথা বলেন, তাদের ভাষাও বোঝেন না আপনারা।
রব্বানী : আপনি উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন।
খালেদ : রাতারাতি সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দিয়ে আপনারা হাজার হাজার ব্রাইট ছেলের জীবন নষ্ট করেছেন। অস্বীকার করতে পারেন?
রব্বানী : এইসব মৃত্যুই আমাদের ভুলগুলো চিনিয়ে দিয়েছে। সহস্র মৃত্যু দিয়েই আমরা ছিনিয়ে আনবো আমাদের বিজয় সূর্য।
খালেদ : আন্দোলনে আপনাদের নেতারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, করছে এখনো।
রব্বানী : আন্দোলনের বিরুদ্ধ শক্তি হিশেবে এরা চিহ্নিত হচ্ছে, এটা ভাল লক্ষন। আগে ভাগেই শত্রু চিনে নিতে পারলে বিপদের সম্ভাবনা কম।
বশির : বিপদ যাগো, তাগো সবসময়ই বিপদ। উপরে থাইকা ঘি মাখন খাইতাছে যারা তারা সব সময়ই আরামে থাকবো। বুঝলেন, ভোল পাল্টায়ে মিশা যায়। তারা পানির নাহান। নদীতেও থাকবার পারে, বোতলের মধ্যেও থাকবার পারে। মইধ্যে মরন আমাদের। পয়সা না থাকলে শান্তি নাই।
রব্বানী : সুবিধাবাদীর চরিত্রই তো এই, যখন যে পাত্রে তখন সেরকম। জঘন্যতম চরিত্র। কুকুরের চে’ও খারাপ।
বশির : বহুৎ অসুবিধায় আছি মামু, সুবিধাবাদী হইতে চাই। পয়সা-আলারা দুনিয়ায় মৌজ কইরা যাইবো আর আমরা খালি আদর্শের আঙুল চুষুম, আমি নাই এর মধ্যে। সুবিধাবাদী হমু ভাই। (উঠে দরোজায় দাঁড়ায়) গায়ে একটু হাওয়া বাতাস লাগায়ে আসি। (বেরিয়ে যায়)
রব্বানী : অল্প কদিনেই অনেকের টার্গেট হয়ে গেছে। ওর একটু সাবধানে থাকা উচিত। প’ড়ে যেতে পারে। (আলো নিভে যায়) এই, গেল, ইলেক্ট্রিসিটি গেল। (হৈ চৈ-এর শব্দ। বিচিত্র আওয়াজ)
কোলাহল : ওই গেলি— ধর ধর— ক্যাডা-রে-এ-এই ওই আবু বকর… ইত্যাদি
তৃতীয় দৃশ্য
নাজনীনের বাসা। ড্রয়িংরুমে কাছাকাছি সিজার ও নাজনীন বসা। নাজনীনের মাথাটা বুকের ‘পর ঝুঁকে পড়েছে। হাতদুটো প্রায় নমস্কারের ভঙ্গিতে কপালে ঠেকানো। অবসাদগ্রস্ত। সিজার যেন কোনো প্রশ্ন কোরে উত্তরের অপেক্ষা করছে। নিশব্দ পরিবেশ। (হঠাৎ ভেতরে ঘর থেকে চিৎকার করতে করতে ড্রয়িং রুমের ভেতর দিয়ে পার হতে থাকে টয়। স্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্র। নাজনীনের ভাই)
টয় : আই হেট, আই হেট অল দিজ থিংকস্। শীট্, শীট্, আমি থাকবো না এখানে।
নাজনীন : টয়!
টয় : না। ডোন্ট সে এনি থিং….
নাজনীন : কোথায় যাচ্ছো?
টয় : জানি না (দুমদাম কোরে বেরিয়ে যায়) প্রায় পেছন পেছন ছুটে যায় আর্দালি গোছের একটি লোক। সিজার উঠে দাঁড়িয়েছে।)
নাজনীন : দ্যাখো তো খালেক ও কোথায় যায়।
খালেক : জ্বি আপামনি। (বেরিয়ে যায়)
সিজার : টয় ওরকম ক্ষেপেছে কেন?
নাজনীন : কিছুক্ষন আগে…
সিজার : কি, কি হয়েছে? (নাজকে আরো অবসাদগ্রস্ত মনে হয়। এলিয়ে দেয় শরীরটা)
নাজনীন : মাঝে মধ্যেই যা হয়… মা-র পীর, আর বাবার মদ… এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে… উহ্― (অনেকটা আপন মনে) এই সাজানো নরক থেকে আমি মুক্তি চাই। কী বীভৎস এই কাচের দেয়াল। কেউ কাউকে ছুঁতে পারে না। কেউ কাউকে বুঝতে পারে না। আমার চারপাশের এই কাচগুলো আমি ভেঙে ফেলতে চাই— চারপাশের— এই কাচের দেয়ালগুলো— আমি ভেঙে ফেলতে চাই। (অবসন্ন হয়ে পড়ে। সিজার উঠে কাছে আসে। ঘাড়ে হাত রাখে, নাজ আস্তে কোরে হাতটি সরিয়ে দেয়।)
সিজার : ডোন্ট গেট এক্সাইটেড, টুকু, শান্ত হও প্লিজ।
নাজ : (মাতালের মতো) আমাকে ছুঁয়ো না সিজার। তোমার ওই হাতটি, তোমার ওই আগুলগুলো কাচে মোড়ানো। আমাকে ধোরো না প্লিজ। আমরা সব কাচের মানুষ। আমরা সব কাচের মানুষ। আমি একজন রক্তমাংশের মানুষ চাই।
সিজার : টুকু, (মাথায় হাত রাখে) তুমি কাউকে ভালোবাসো?
নাজ : (সোজা হয়ে বসে) না। আমি কাউকে ভালোবাসতে চাই। কাউকে আমি বিশ্বাস করতে চাই। এই কাচের পৃথিবীতে কোথাও বিশ্বাস নেই, কোথাও ভালোবাসা নেই।
সিজার : আমি তোমাকে ভালোবাসি টুকু।
নাজ : না। তুমি আমাকে দখল করতে চাও।
সিজার : বিশ্বাস করো তোমার জন্য আমি…
নাজ : সিজার, ডোন্ট বি সেন্টিমেন্টাল! আমি খালেদকে পেতে চাই।
সিজার : খালেদের মতো একটা মাতাল, ভবঘুরে… কি এমন আছে খালেদের! খালেদ তোমারও বন্ধু সিজার। (সিজার মাথা নিচু কোরে চুল টানতে থাকে। হঠাৎ টেলিফোন বাজে। নাজ উঠে ধরে।)
নাজ : হ্যালো?… বলছি… নারে শরীরটা ভীষন খারাপ… জানি না। হ্যা প্রোগ্রাম ঠিক আছে।… না ও কুমিল্লা যাবে… বোলে লাভ নেই… দেখি যদি সিজার যেতে চায়… ঠিক আছে… সাড়ে দশটায়… আচ্ছা। রাখি। (ফোন রেখে এসে বসে)
পরশু আমরা ন্যাশনাল পার্কে যাচ্ছি, যাবে তুমি?
সিজার : প্লিজ টুকু, আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে ভাবতেই পারি না। আই ওয়ান্ট টু ম্যারিড ইয়্যু। আমাকে তুমি…
নাজ : পাগলামো কোরো না সিজার। তোমাকে আমি বন্ধু হিশেবেই দেখতে চাই।
সিজার : টুকু তুমি… (হাত ধরে)
নাজ : সরি সিজার! রাত হয়েছে, বাসায় যাও। (হাত ছাড়িয়ে ভেতরে চ’লে যায়। সিজার ওর যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। পরাজয়ের গ্লানি আর ক্ষোভ চোখে মুখে। সিজার উঠে দাঁড়ায়। জনান্তিকে বলে)
সিজার : ওহ্ ব্লান্ডার কোরে ফেললাম। এ মুহূর্তে নাজনীনকে প্রোপোজ করা বোকামি হয়ে গেল। এমনিতেই ওর মন মেজাজ ভালো নেই। শেম! এতো সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়েছিলাম আমি! সঠিক সময়টির জন্যে আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। আইল্ ওয়েট ফর দা লাস্ট।
.
(ড্রয়িংরুমের খোলা দরোজা দিয়ে সিজার বেরিয়ে যায়। ক্যামেরা ড্রয়িং রুমের বিভিন্ন ইলেকট্রোনিক্স সামগ্রির উপর ক্লোজ আপ করতে থাকে। নেপথ্য থেকে একটি পুরুষ উচ্চকন্ঠ ভেসে আসে। কন্ঠস্বরটি আকবর হোসেনের।)
আকবর : তোমার জন্য, তোমার জন্যই ছেলেমেয়েরা এমন অবাধ্য হতে শিখেছে। (মেয়ে কণ্ঠটি শোনা যায় কিন্তু কথা বোঝা যায় না। চাপা নিচু কণ্ঠ।) না নয়তো কি? ফানি মেয়েছেলে— সংসারের দিকে কোনো খেয়াল নেই। সব সময় ওই এক পীর ফকির নিয়ে বেলেল্লাপনা।
হেলেন : বাজে কথা বলবা না। কিসের বেলেল্লাপনা? বেলেল্লাপনা করছেটা কে? তুমি না আমি? রাতদিন তো আছো বোতলের মধ্যে মাথা চুবিয়ে। বাইরে আরো না জানি কি করো। (বলতে বলতে ড্রয়িংরুমে ঢুকে পড়ে। পেছন পেছন ত্রস্ত আকবর)
আকবর : স্টপ! (ক্যামেরা আকবরের মুখে ক্লোজ আপ। চোখ ঢুলু ঢুলু।) দ্যাখো হেলেন, আমার ব্যক্তিগত জীবনযাপন নিয়ে আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। আমি কাউকে কৈফিয়ৎ দিতে রাজি নই।
হেলেন : (ফুঁসে ওঠে) তাহলে আমার কাছে কৈফিয়ৎ চাও কেন?
আকবর : (দৃঢ়তা আনতে চেষ্টা করে কণ্ঠে) চাই এই জন্যে যে তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করো না। সংসারের দিকে তোমার খেয়াল নেই।
হেলেন : সংসার কি শুধু আমার একার? তোমার কোনো দায়িত্ব নেই?
আকবর : আমার দায়িত্ব তো আমি পালন করছিই। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টাকা কামাই করছি। তোমাদের আরামে রাখতে যা যা দরকার সবই তো আমি ব্যবস্থা করছি।
হেলেন : শুধু টাকা দিয়ে সংসারের দায়িত্ব পালন হয় না। (ফুঁপিয়ে ওঠে। কন্ঠস্বর ভেজা মনে হয়।) টাকা তো আমিও রোজগার করতে পারি। তুমিই তো আমাকে চাকরি করতে দাওনি। তোমার বাবা বেঁচে থাকতে তার দোহাই পেড়েছো।
আকবর : টাকা রোজগারের চেয়ে মেয়েদের ঘর সামলানোটাই বেশি জরুরি।
হেলেন : ওই সব বড়ো বড়ো বুলি কপচেই তো তোমরা মেয়েদের ঘরে আটকেছো। আর টাকা কামাই করার নামে, ব্যবসার নামে, চাকরির নামে যা ইচ্ছা তাই কোরে বেড়াচ্ছো। তোমরা তো পুরুষ!
নাজনীন : (চিৎকার কোরে প্রবেশ করে) ওহ্ অসহ্য! তোমরা কি থামবে?
আকবর : (ধমক দিয়ে) তুই থাম! মাতবরী করতে হবে না। (হেলেনের দিকে ফিরে) দরোজা তো খোলাই আছে, যাও না। কে আটকে রেখেছে তোমাকে। (হেলেনের মধ্যে একধরনের দ্বিধা কাজ করে। তাকে হতভম্ব দেখায়। কি করবে বা বলবে যেন বুঝে উঠতে পারছে না।)
নাজনীন : এই তো তোমাদের কৌশল! বছরের পর বছর খাঁচায় আটকে রেখে এখন বলছো উড়তে। মাকে তোমার প্রথমেই চাকরি করতে দেয়া উচিত ছিলো। আর তোমার উচিত ছিলো… (হেলেন ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে এবং ফোঁপাতে থাকে।)
আকবর : আর পক্ষ নিয়ে তোমাকে আর লেকচার দিতে হবে না। হেএ নারী স্বাধীনতা!
চতুর্থ দৃশ্য
(খালেদ এবং নাজনীন মুখোমুখি বোসে আছে। মুলিবাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা একটা ছাপড়া মতো রেস্টুরেন্ট। লম্বা বেঞ্চি এবং হাইবেঞ্চের চেয়ে সামান্য চওড়া লম্বা টেবিল ঘিরে কোনের দিকে আরো দু একজন ছেলে এবং মেয়ে বসা। সবাই ছাত্র। নাজনীন মুখ নিচু কোরে টেবিলে নোখ দিয়ে খুঁটছে।)
খালেদ : কি ব্যাপার, মন খারাপ কেন?
নাজনীন : এমনি!
খালেদ : বলো না, শুনি।
নাজনীন : থাক, বাদ দাও।
খালেদ : ও কে, বাদ দাও তাহলে। গফুর ভাই, আলগা পাত্তি দিয়ে দু’কাপ কড়া চা। (হৈ হৈ করতে করতে গায়ত্রি, বশির ও মাহবুবের প্রবেশ। প্রত্যেকের দিকে আঙুল তুলে তুলে) চা? চা? চা? গফুর ভাই পাঁচ কাপ। (টেবিল ঘিরে সবাই বেঞ্চিতে বোসে পড়ে)
গায়ত্রি : কিরে খালেদ, গোপনে গোপনে পানি খাওয়া হচ্ছে, না?
খালেদ : গোপনে গোপনে কোথায়? এতো প্রকাশ্যেই। আর পানি নয়, খাওয়া হচ্ছে চা।
বশির : বেশ, বেশ, গফুর ভাই আমার চাড়া একটু পরে দ্যান। আগে এক প্লেট হর্স পাওয়ার। আর কারো চলবে নাকি?
গায়ত্রি :হর্স পাওয়ারটা কি জিনিশ?
নাজনীন : সেদ্ধ ছোলা।
মাহবুব : বশির, আমি আছি। গফুর ভাই দুই প্লেট।
গায়ত্রি : কিরে নাজনীন, মুখ হাঁড়ি কেন?
খালেদ : মন খারাপ।
গায়ত্রি : দুটো কবিতা শুনিয়ে দে, ওষুধের কাজ করবে।
বশির : ওষুধে কি আর মন ভালা হয়? (ছোলা ও চা পরিবেশন করা হয়)
মাহবুব : হয়, হয় মন ভালো হবার ওষুদও আছে, তাই না রে খালেদ?
খালেদ : এ ব্যাপারে মইনুস হলো বিশেষজ্ঞ, ও বলতে পারবে।
গায়ত্রি : আর তুমি কি? বিশেষ ভাবে অজ্ঞ?
(সবাই হেসে ওঠে। নাজনীনের মন ভালো হতে থাকে।)
বশির : হায়রে অধপতিত তরুন সমাজ! তোমরাই হইলা গিয়া জাতির ভবিষ্যৎ। জাতি তোমাগো দিকে চোখ ছানাবড়া কইড়া তাকায়া আছে, আর তোমরা মন ভালো করনের ওষুদ খাইতাছো।
গায়ত্রি : জাতির লাথি খেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
খালেদ : আসলে জাতির লাথিটা যাদের খাওয়া দরকার তারাই বার বার পিছলে সরে যাচ্ছে। সবার এক কথা তরুনরা হতাশাগ্রস্ত, তরুনরা বিপথগামী, এরাই জাতির ভবিষ্যৎ। আরে বেটা জাতির বর্তমানটা কি? ভবিষ্যৎ তো পরের ব্যাপার। বর্তমানে হচ্ছেটা কি?
নাজনীন : : আসলেই, তরুনদের তো কোনো দোষই আমি দেখি না। বুড়োরাই সব নষ্টের মূল। তাদের বিপথগামিতার জন্যেই তো যত সমস্যা, আর দোষ দেয় তরুনরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
গায়ত্রি : এক মত। (দূর থেকে একটি মিছিল যাওয়ার ধ্বনি পাওয়া যায়)
খালেদ : মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হয় গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দিই সবটা—
মুর্শেদ : সেটা নিতান্তই হঠকারিতা হবে হে। স্বেচ্ছাচারিতাও বলতে পারে অনেকে। কেউ কেউ এর মধ্যে সাম্রাজ্যবাদের গোপন ইঙ্গিত খুঁজে পেয়ে চমকে উঠতে পারে। সেক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদী বোলে তোমাকে চিহ্নিত করাই হবে সবচে’ নিরাপদ। (বলতে বলতে ঢোকে)
নাজনীন : এক্সসিলেন্ট মুর্শেদ ভাই! (সবার হৈ হৈ)
গায়ত্রি : পরশু আপনার নাটক দেখলাম। রাহুল চরিত্রটা দারুন। আর শেষ দৃশ্যটার কথা আমি ভাবতেই পারিনি—অপূর্ব—রিয়েলি (মুর্শেদ বোসে পড়তে পড়তে)
মুর্শেদ : বেশ জমিয়েছো দেখছি। গফুর ভাই মাথা গুনে চা দেন।
গফুর : মুর্শেদ ভাই মিষ্টি খাওয়াইলেন না? বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন—
মুর্শেদ : আর মিষ্টি! জীবনে এতো তিতা খাইছেন— একটু মিষ্টিতে আর কি হবে। ঠিক আছে খাওয়াবো। চা দেন। সবাই ভালো?
খালেদ : কাদের মিছিল দেখলেন নাকি মুর্শেদ ভাই?
মুর্শেদ : রক্ষনশীল জাতীয়তাবাদীদের মিছিল।
বশির : এরা আবার কারা?
মাহবুব : নোতুন দল নাকি?
মুর্শেদ : সবগুলো দলের ভূমিকার কথা একটু চিন্তা করো তাহলেই পেয়ে যাবে এটা কোন দল।
নাজনীন : মুর্শেদ ভাই, একটা জিনিশ লক্ষ্য করেছেন, মৌলবাদীরা যেভাবে একত্রিত হচ্ছে, নিজেদের ছোটখাটো বিরোধ মিটিয়ে নিচ্ছে, সমাজতন্ত্রীরা কিন্তু সেভাবে এগুতে পারছে না। বরং টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।
খালেদ : আসলে এরা সমাজতন্ত্রী নয়, সমাজতন্ত্রের রোমান্টিক ভক্ত।
মুর্শেদ : এক্সাক্টলি ভাই। গনতন্ত্রীদের অবস্থা দ্যাখো, নিজেরাই জিনিশটা চৰ্চা করে না। আরে বাবা এটাতো চাওয়া-চায়ির বস্তু না, এটা অনুশীলনের বিষয়।
বশির : আমি কিন্তু আপনাগো লগে একমত না। ওইসব তন্ত্র মন্ত্র আছিলো সেই মুনিঋষিগো আমলে। অহন একটাই মন্ত্র, একটাই বাদ— সুবিধাবাদ। (কোনের দিক থেকে এক তরুন দাঁড়িয়ে মুর্শেদের দৃষ্টি আকর্ষন কোরে বসে)
২য় ছাত্র : স্যার, আমরা নোতুন একটা শ্লোগান বানাইছি ‘মুক্তির একই পথ’ (টেবিলে বসা দুজন বলে)
কোরাস : হিজরত-হিজরত।
২য় ছাত্র : এখানে স্যার দল বদল অর্থেও হিজরত শব্দটি দিতে পারেন। (সকলে হো হো কোরে হেসে ওঠে)
বশির : মারহাবা! মারহাবা!
মুর্শেদ : খালেদের বই-এর কাজ কতোদূর এগুলো?
খালেদ : ছাপা শেষ। বাজারে আসতে বিশ/পঁচিশ দিন লাগবে।
গায়ত্রি : আমাকে কিন্তু সৌজন্য কপি দিবা খালেদ।
বশির : তাইলেই হইছে। খালেদের যে পরিমান বান্ধবী তাতে প্রকাশক ধরাস্।
মাহবুব : না, না আমরা ওর বই কিনেই নেব। আমরা বন্ধুরাই তো বই-এর প্রথম সংস্করন শেষ কোরে দিতে পারি।
খালেদ : শুনতে খুব মধুর শোনালো। গফুর ভাই একটা চা, চিনি বেশি।
নাজনীন : খালেদ ক্লাস আছে, (ঘড়ি দেখে) ওঠো।
খালেদ : মাত্র আড্ডাটা জমতে শুরু করেছে— (নরোম কন্ঠে) তুমি বরং ক্লাসটা কোরে এসো।
নাজনীন : এই হলো তোমার অসুবিধা (রাগত) গায়ত্রি, চল আমরা যাই।
খালেদ : প্লিজ নাজনীন, রাগ কোরো না। জানোই তো এটা কোনো ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস না। গাব্বু স্যার কি পড়াবে জানাই আছে।
(নাজনীন ও গায়ত্রি বেরিয়ে যায়)
গায়ত্রি : মুর্শেদ ভাই থাকবেন কিন্তু, ক্লাস কোরে আসি।
মাহবুব : আমাকেও উঠতে হবে— (বেরিয়ে যায়)
খালেদ : লে হালুয়া— একে একে নিবিছে দেউটি—
মুর্শেদ : ভালোই হলো। মেয়েরা থাকলে প্রান খুলে কথা বলা যায় না। তাছাড়া এখন হয়েছি স্যার। খুবই মুশকিল।
বশির : ঠিকই কইছেন মুর্শেদ ভাই। খিস্তি না দিতে পারলে কি আর মনে সুখ আসে, কন তো হালায়!
খালেদ : আমার অবশ্য কিছুই মনে হয় না। ছেলে মেয়ে যে কারো সামনেই যে কোনো কথা বলতে পারি। মজা পাই।
মুর্শেদ : তুমি একটা সঠিক ইবলিস।
খালেদ :আর আপনারা সব ভুয়া আজাজিল, তাই না? (সবাই হাসে)
[ অসমাপ্ত ]