চিত্ত ও চিত্র

চিত্ত ও চিত্র

হেমেন্দ্রনাথ মজুমদারের “অভিযান” চিত্রটি দেখিয়া )

চিত্র-শিল্পের মডেল সে।

পঙ্কে তাহার জন্ম; কিন্তু বোধ করি, বিধাতা সে কথা ভুলিয়া গিয়াছিলেন, তাহার অম্লান রূপ দেখিলে এই রকমই মনে হয়। মানুষও সে রূপের সমুচিত সম্বর্ধনা করিয়াছে; সুতরাং জীবনে তাহার ক্ষোভের আঁচড়টুকু পড়িতে পায় নাই। ‘বেলা’ বলিতে লোকে যেটুকু বুঝিত, অর্থাৎ সেরা ভাস্করের হাতে কোঁদা প্রস্তরমূর্তির মতো নিখুঁত নিটোল একটি দেহযষ্টি, তাহার যাহা পাওনা, লোকে তাহা অকার্পণ্যে মিটাইয়া আসিয়াছে। তাহার অভাব নাই কোনোখানেই—না রূপে, না যৌবনে, না আদরে, না অর্থে। জীবন-শতদলের সব পলাশগুলিই একটি একটি করিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে; আর সে ইহাকেই তাহার নারীত্বের চরম পূর্ণতা মানিয়া লইয়া ইহারই মাদকতায় বিভোর ছিল।

শিল্পী তরুণ, নবীন তাহার প্রতিভা। বেলা সৌন্দর্যের রানী, আর হাবভাবের অলঙ্কার দিয়া সে সৌন্দর্য সাজাইতে দক্ষ; সুতরাং চলিল ভালোই। শিল্পীর প্রতিভার সহিত বেলা যেটুকু সংযোগ করিয়া দিত, তাহার ফলে চিত্রগুলি একেবারে অপরূপ হইয়া দাঁড়াইত। শিল্পী অন্তরের ভাবের ঐশ্বর্যে তন্ময় হইয়া মডেলকে কত ভঙ্গিমায় বসায়, শায়িত করে, কত ঠামে দাঁড় করায়, তাহার পর আঁকিবার আসনে আসিয়া দেখে তরুণী আবার তাহাতে পলকে শতগুণ সৌন্দর্য ফুটাইয়া তুলিয়াছে—কখনও সামান্য পাঁচটি অঙ্গুলির ললিত বিলাসে, কখনও নয়ন-কোণের কোথাও একটু কুটিল চপলতাকে সংযত করিয়া, কখনও গ্রীবার একটি অলস হেলনে, আবার কখনও বা এমন অনির্বচনীয় একটা কিছুর দ্বারা, যাহা অঙ্গের কোনোখানেই ঠিক ধরা পড়ে না, অথচ যা সৌরভের মতো সমস্ত অঙ্গটিকে আচ্ছন্ন করিয়া থাকে।

শিল্পী পাগল হইয়া যায়। কি আঁকিবে সে? তুচ্ছ এ তুলির বর্ণে কতটুকু বা ধরা দেয়? বাস্তব যেখানে সীমাহীন, অনুকরণ তাহার কতটুকুকে সীমাবদ্ধ করিবে?

বাহিরে তসবির প্রকাশিত হয়। রসজ্ঞেরা বাহবায় দেশের হাওয়া মাতাইয়া ভোলে। কিন্তু সে প্রশংসার উচ্ছ্বাস শিল্পীর মনের যেখানটা খালি থাকিয়া যায়, সেখানটা কিছুতেই পূৰ্ণ করিতে পারে না। দ্রষ্টারা দেখে যতখানি হইয়াছে, তাহাতে উল্লসিত হইয়া উঠে; চিত্রী ভাবে কতখানি যে হয় নাই তাহাই, তাহার অন্তরের হাহাকার শান্ত হয় না, অনায়ত্তের জন্য চিত্ত উদ্‌ভ্রান্ত হইয়া থাকে।

এতই সুন্দর সে বেলা, আর এমনই মুগ্ধ সে চিত্রকর। কিন্তু এ মোহের মধ্যে একটা বিশেষত্ব ছিল। শিল্পী রূপটিকে মানুষ হইতে সম্পূর্ণ আলাদা করিয়াই দেখিয়া আসিয়াছে, এবং সেই জন্যই রূপের যে একটা বৈষয়িক দিক আছে, সেদিক দিয়াই তাহার সমাদর করিয়া আসিয়াছে। অর্থাৎ অর্থের বিষয়ে সে একেবারে উদার হইয়া পড়িল। বাঁধা মাহিনা যাহা ছিল বেলার, তাহার উপর সে কত পাইত, তাহার আর হিসাব ছিল না। ইহার কারণ ছিল, শিল্পী যে রূপ তুলির দ্বারা মাপিয়া উঠিতে পারিত না, তাহা অর্থের দ্বারা মাপিয়া অনেকটা আশ্বস্ত হইত। তাহার ছবির ক্রেতা যেমন সমুচিত মূল্য দিয়া তাহার ছবির সমাদর করিত, সেও বেলার মাধুর্য সম্বন্ধে সেই পন্থাই অবলম্বন করিয়াছিল, কারণ দাম জিনিসটা পরিমাপের একটা সুস্পষ্ট উপায়; মূল্য দিয়া বেশ সহজে অনেকটা বুঝানো যায়, জিনিসটার এই পরিমাণ কদর, এতটা যোগ্যতা।

এ বন্দোবস্ত বেশ চলিয়া যাইতেছিল। বেলা নিয়মমত আসিত, বসিত; শিল্পী মনের মতো করিয়া তাহার ভঙ্গিমাটুকু চুনিয়া লইত। প্রয়োজনের বাহিরে দুই-একটা কথা কোনোদিন হইত, কোনোদিন বা হইত না। তাহার পর বেলার ছুটি হইয়া যাইত; আর শিল্পী রঙের সমাবেশে মশগুল হইয়া পড়িত।

সাধারণত এরূপ ক্ষেত্রে তরুণ-তরুণীর মনস্তত্ত্ব লইয়া একটু গোলমাল হইয়া থাকে বটে; কিন্তু এ স্থলে সে ভয় ছিল না, কারণ মনের দিকটা, আকাঙ্ক্ষার দিকটা একেবারেই বাদ পড়িয়া গিয়াছিল উভয় তরফেই। তরুণ চাহিয়াছিল উৎকর্ষের দিকটায়। মডেলের কোন ভঙ্গিমাটিতে কতটুকু মধুরিমা ফুটিল, কতটুকু ইঙ্গিত হইয়াই রহিল; তাহার মধ্যে আবার সেই বা কতটুকু ছানিয়া লইতে পারিল, কতটুকু তুলির সূক্ষ্মতাকেও এড়াইয়া গেল—এই লইয়াই সে ব্যস্ত থাকিত। তাহার নয়নে লাগিয়া থাকিত রূপের বিস্ময় অথবা চিত্রের সৌকর্যের জন্য আত্মপ্রসাদ। তাই হাজার মধুর হইলেও কোনো ভঙ্গিমাই তাহার মনটাকে শিথিল করিয়া ফেলিতে পারিত না। বাহির হইতে দেখিলে বোধ হইত, কী এ তপস্বীর মতো সংযম! কিন্তু এ সংযমের মধ্যে তাহার বিশেষ কোনো প্রয়াসই ছিল না। কারণ সে ছিল শিল্পের সাধন লইয়া বিভোর, বাসনার স্থানই ছিল না সেথায়।

আর তরুণীর ছিল রূপই বেসাতি। তাই নিজের শরীরের এক-একটা ভঙ্গিমায় নিজেরই মনে যে এক-এক রকম ভাব জাগায়, সে কথা সাধারণে খাটিলেও বেলার পক্ষে খাটিত না। তাহার উদ্দেশ্য দেখানো, এবং সে দেখানোয় আর্টের যতটা ব্যঞ্জন থাকে, ততই তার বেশি মূল্য তাহার পক্ষে। প্রথম প্রথম যেটুকু বা আন্তরিকতা ছিল, অভ্যাসে আবার তাহা একেবারেই লুপ্ত হইয়া গিয়াছে। প্রতীক্ষার তীব্র উৎকণ্ঠা, কি সোহাগের তারল্য দেখানো এখন চলাফেরা-শোওয়া-বসার মতোই সহজ স্বতঃস্ফূর্ত হইয়া পড়িয়াছে; মনকে আর জাগাইতে হয় না।

.

কিন্তু এ ভাবে আর বেশিদিন চলিল না। কারণ মনের সুপ্তি এক দিক দিয়া যেমন নিবিড়, অন্য দিকে আবার তেমনই লঘু, কখন একটা কুসুমের মতো পেলব স্পর্শে সে যে জাগিয়া উঠে, বলা যায় না।

কারণটা ঠিক ধরা গেল না—একদিন যেন অহৈতুক ভাবেই বেলার সমস্ত মনের উপর একটা কিসের ব্যথা ছাইয়া গেল। এ অদ্ভুত বেদনা কোনো একটা আকার পরিগ্রহ করিল না। বেলার শুধু এইটুকুই মনে হইল, যেন একটা মস্ত বড় ফাঁকির মধ্যে এতদিন সে কাটাইয়া দিয়াছে, পৃথিবী যেন একটা অলীক মোহের ফাঁদে ফেলিয়া তাহাকে নিষ্ঠুরভাবে বঞ্চনা করিয়া আসিয়াছে এতদিন। অথচ পৃথিবী বিশেষ কেহ নয়, কাহার কাছেই বা অনুযোগ করে সে! তা ছাড়া কি-ই বা এমন প্রাপ্য ছিল তাহার, যাহা সে পায় নাই?

এসব কথার কোনও সঙ্গত উত্তর পাওয়া গেল না, তবে বেদনাটা ধীরে ধীরে এমনই বিপুল বিস্তৃত হইয়া পড়িল যে, তাহার সমস্ত জীবনটা যেন নিতান্তই অর্থহীন, লঘু এবং শূন্যময় হইয়া উঠিল।

এমনই করিয়া কয়েকদিন গেল; অবশেষে একদিন এই মূক ব্যথার সঙ্গীত একটা সামান্য আঘাতে তাহার হৃদয়ের তারে ক্রন্দনের মীড়ে জাগিয়া উঠিল।

একদিন শিল্পী বেলার সামনে একটা অনেকদিনের পুরানো ছবি আনিয়া ধরিল; হাসিয়া বলিল, “পৃথিবীতে সব জিনিসেরই দেখছি একটা দাম আছে! এই ছবিটাও শেষ পর্যন্ত বেশ দামে বিকোতে চলল। এর যে কখনও কদর হবে, তা স্বপ্নেও ভাবি নি।”

কার চোখে কিসে নেশা ধরায়, বলা যায় কি? “দেখি, কোন ছবিটা?”–বলিয়া বেলাও হাসিয়া ছবিটা হাতে করিয়া লইল; কিন্তু ছবিটা এবং তলায় তাহার নামটাতে দৃষ্টিপাত করিতেই তাহার মনটা হঠাৎ যেন বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল এবং ক্রমে হাসিটা মিলাইয়া গিয়া চক্ষু দুইটা ঈষৎ সিক্ত হইয়া উঠিল।

একটা সামান্যই ছবি। নিতান্ত একটা সাধারণ বেষ্টনীর মধ্যে নিরালায় কিশোরী নিজের অন্তরের পানে চাহিবার অবসর পাইয়া যেন কাহার স্মৃতিতে নিমগ্ন হইয়া গিয়াছে। কেহই কাছে নাই; কিন্তু কিসের শরম, কিসের শঙ্কা এবং শরম-শঙ্কাজড়িত কি এক মাধুর্যে মাথাটি নুইয়া পড়িয়াছে। মনে হয়, অন্তরে যে দেবতা জাগিয়াছে, তাহার মানসী মূর্তির কাছে কিশোরী নিরবশেষভাবে আপনাকে নিবেদন করিয়া দিতেছে। নীচে লেখা আছে, “সমৰ্পণ”।

বেলা যেন আত্মবিস্মৃত হইয়াই চাহিয়া রহিল। পূর্বেও ছবিটা এই ঘরের ছবির ভিড়ের মধ্যে নিশ্চয় দেখিয়াছে; কিন্তু আজ নূতন করিয়া তাহার মনে হইল, যেন তাহারই অন্তরের ব্যথা এই বর্ণ আর রেখার ভাষায় মুখর হইয়া উঠিয়াছে, যেন সে তাহার দয়িতের কাছে নিতান্তই আজ ধরা পড়িয়া গেল। তাই শিল্পী কথা কহিতেই সে হঠাৎ সচকিত হইয়া মুহূর্তেই লজ্জাবতী লতাটির মতো সঙ্কুচিত হইয়া পড়িল।

শিল্পী বলিল, “তোমায়ই দেখে, অনেক দিন আগে, বোধ হয় প্রথম আঁকা ছবি।”

আবার বলিল, “তখন রঙ ফলানোয় আর আঁকার ভঙ্গিমায় তেমন হাত খোলে নি, কিন্তু তা হলেও আত্মনিবেদনের ভাবটা জীবন্ত হয়েছিল খুব, না? আমার চোখেও যেন নতুন করে ভালো লাগছে।”

আশা-আশঙ্কায় বেলার অন্তরটা যেন মথিত হইয়া উঠিল। ছবি হইতে আরম্ভ করিয়া শিল্পীর সমস্ত কথাগুলো পর্যন্ত আজ নূতন অর্থে অর্থবান হইয়া উঠিয়াছে।

শিল্পী আবার বলিয়া চলিল, “যিনি কিনবেন, নতুন বিয়ে করেছেন শুনলাম, ছবিটি বড় চোখে লেগেছে। যাক্, আমাদের কাজটা তবুও সার্থক হল।”

হায়, ভুল আশা! বেলার বুক ঠেলিয়া ক্রন্দন উঠিতেছিল—ওগো, আমার সার্থকতা এতে নয়—এতে নয়। সে কথা তোমায় আজ কি করে বোঝাই? আমার প্রাণের নিবেদনকে তুলি দিয়ে একটু একটু করে আহরণ করে যে ছবি সৃষ্টি করে তুললে, তা অপরের কাছে অর্থপূর্ণ হয়ে উঠল; কিন্তু তোমার বুকেই কেবল এতটুকুও স্পন্দন জাগাতে পারলে না? কি করে তোমায় জানাই যে, এ চিত্রে সত্যই আমারই অন্তরের প্রতিচ্ছায়া ফুটে উঠেছে, সমস্তটাই তোমার কল্পনার লীলা নয় এ? হে উদাসীন, একবার আজ নিবিষ্ট হয়ে দেখ, চিরদিনই কি এই রকম ভাবে ভুল বুঝে আমায় বিড়ম্বিত করবে?

অত কথা কিন্তু বলা গেল না; নিতান্তই মিনতিক্লিষ্ট স্বরে বেলা শুধু বলিতে পারিল, “এ ছবিটা আর ঘর থেকে যেতে দিয়ে কাজ নেই সরোজবাবু, কাজ নেই বেচে।”—এটুকুও যে কি রকম করিয়া মুখ দিয়া বাহির হইল, সে নিজেই বুঝিতে পারিল না।

প্রথমটা সরোজ যেন একটু বিস্মিত হইয়া গেল। তাহার পর একবারে হো-হো করিয়া উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল, “ওঃ, বুঝছি; সত্যিই ছবিটা দেখতে তেমন নয়, কাঁচা হাতের আঁকা কিনা; তুমি ভাবছ, বাজারে বদনাম হয়ে পড়বে। এক হিসেবে ঠিক ধরেছ বটে; তবে রিটাচ করে-টরে অনেকটা সামলে আনব।”

বেলা শিল্পীর মুখের দিকে চাহিয়া নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, আর একটা কথাও তাহার মুখ দিয়া বাহির হইল না।

দুই দিন পরে আবার যখন আসিল, দেখিল ছবিটি নাই। সে কোনো প্রশ্ন করিল না, শুধু অসম্ভব সব জায়গায় ব্যাকুলভাবে চাহিতে লাগিল, মন যেন জানিয়াও নিদারুণ সত্যটা বিশ্বাস করিতে চাহে না। সরোজ হাসিয়া বলিল, “নিয়ে গেছে সেটা, যে তাগাদা যদি দেখতে! তুমি একটু বস।”—বলিয়া বাড়ির মধ্যে চলিয়া গেল।

বেলার বক্ষে একটা রূঢ় আঘাত লাগিল। তাহার মনে হইল, তাহার যৌবন-আরম্ভের সেই সামান্য প্রতিমূর্তিটার একটা মূক ভাষা ছিল। সেটা যে সরোজের এই ঘরটিতে টাঙানো ছিল এবং সরোজকে যে মাঝে মাঝে দেখিতে হইত, এসবের ভিতর তাহার জীবনের অনেকটা সাফল্য ছিল! এ কথাটি পূর্বে কখনও এমন করিয়া মনে উদয় হয় নাই এবং আজও ইহার সম্যক অর্থ ধরা গেল না; কেবল মনে অকারণ একটা করুণ সুর ঘনাইয়া উঠিতে লাগিল—বেলা যেন আজ চলিয়া গিয়াছে, সরোজ তাহার অন্তরের নিবেদন, তাহার কৈশোরের প্রথম নিবেদন, তাহার নারী-হৃদয়ের চিরন্তন নিবেদন গ্রাহ্য করে নাই, তাহাকে বিদায় করিয়া দিয়াছে। অর্থই এই লুব্ধ শিল্পীকে অন্ধ ও বধির করিয়া তুলিয়াছে। কথাটা ফেনাইয়া ফেনাইয়া এই রকম ভাবেই মনে জমিয়া উঠিতে লাগিল।

কিন্তু এ আবার কবেকার কোন্ বেলা ছিল, আর কিসের জোর তাহার এই শিল্পীর উপর, যাহা অর্থের উপরও আত্মপ্রতিষ্ঠা করিতে চায়? মন এ কথারও উত্তর দিতে পারে না।

সরোজ হাসিতে হাসিতে প্রবেশ করিল, হাতে একমুঠো টাকা। ছবির দামের একটা মোটা অংশ, বেলাকে দিবে। অপ্রত্যাশিত সফলতায় মনটা উদার করিয়া দিয়াছিল, এ তাহারই একটা নিদর্শন।

“বেশ দামে বিকোল ছবিটা, রাখ এ টাকাগুলো।”—বলিয়া তাহার সঙ্কুচিত দক্ষিণ অঞ্জলি খুলিয়া ধরিবার চেষ্টা করিল।

বেলা অঞ্জলি খুলিল না। নির্বাকভাবে খানিকক্ষণ সরোজের মুখের পানে চাহিয়া রহিল। তাহার পর কহিল, “না না, আমায় মাফ করুন সরোজবাবু, এ টাকা আমায় স্পর্শ করতে বলবেন না। তখন আমার এত হাবভাব ছলাকৌশল শেখা হয় নি, আমার ও-ছবিতে কোনো কৃতিত্ব ছিল না, আপনার পায়ে ধরি, টাকা দিয়ে আর আমার জীবনের সমস্তটাই ভরিয়ে নিরেট করে দেবেন না—”

তাহার পর কথাগুলো একেবারেই অস্পষ্ট হইয়া গেল এবং চক্ষের কূল ছাপাইয়া অঝোর ধারায় অশ্রু নামিল।

জীবনে এ এই প্রথম।

.

চিত্রকর একদিন শুনিল, বেলা থিয়েটারে অভিনেত্রীর পদে ইস্তফা দিয়াছে। ব্যাপারটা খুবই সাধারণ, আকছারই হইয়া আসিতেছে। সে আর ইহাতে বিস্ময় মানিল না। সাধারণত ইহার যে গোটাকতক ধরা-বাঁধা কারণ আছে, তাহা দিয়াই সমস্যাটুকু পূরণ করিয়া লইল, অর্থাৎ ভাবিল, অন্যত্র টাকা পাইয়াছে বেশি, কাজেই পূর্বের দল ছাড়িয়া দিয়াছে, কিংবা নাম বাহির হইয়াছে, সুতরাং মূল্য বাড়াইবার এ একটা ফন্দি, অথবা এই রকম গোছের একটা কিছু হইবে। কিন্তু তাহার একটু ধাঁধা লাগিল, যখন প্রশ্ন করায় বেলা ছোট্ট করিয়া জবাব দিল, “এমনিই ছেড়ে দিলাম। না, অন্য জায়গায় কাজ পাইনি!”

সরোজ বিস্মিতভাবে মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “কিন্তু বড় লোকসান হল যে?”

বেলা বলিল, “অত লাভ-লোকসান খতিয়ে দেখি নি; ওসব আর তেমন ভালো লাগে না, তাই ছেড়ে দিলাম।—” বলিয়া মুখের দিকে চাহিয়া অপ্রতিভভাবে একটু হাসিল।

সরোজ মাথাটা নীচু করিয়া একটু নিরুত্তর রহিল। কথাটা তেমন সে বুঝিতে পারিতেছিল না। সচরাচর যে কারণগুলো খাটে, তাহার কোনোটা এ-ক্ষেত্রে লাগে না দেখিয়া সে একটা অস্বস্তি অনুভব করিতেছিল! যেন নিজের মনেই বলিতে লাগিল, “ভালো করলে কি? এ সময় অভিনয়গুলো তোমার বেশ স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। বাজারে বেশ—”

অসহিষ্ণুভাবে বেলা বলিল, “অভিনয় স্বাভাবিক করবার জন্যে নিজেকে কতটা অস্বাভাবিক করে এনেছি জানেন সরোজবাবু? থাক সে কথা। নিন, বলুন, আজ কি করবেন আমায় নিয়ে! এখনও তো এই দাঁড়ানো-বসা-শোওয়ার অভিনয় চলবেই; না হয় কথার অভিনয়েই জবাব দিয়ে এসেছি।”

মডেলের স্বরে আজকাল প্রায়ই এই রকম একটা মিশ্রণ থাকে, যাহা তাহার চিরন্তন হর্ষ-কৌতুকের নয়। সরোজ লক্ষ্য করিল, একটু ভাবিলও, তাহার সেই দিনটার কথাও মনে পড়িয়া গেল, কিন্তু বেশি ভাবিয়া অবসর নষ্ট করিল না। উঠিয়া মডেলকে বলিল, “হ্যাঁ, নাও তো, আজ দাঁড়াতে হবে এই ভাবে। রসো, আইডিয়াটা আগে তোমায় বলে দিই; ধরো সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, সে এসেছে নদীর ঘাটে জল নিতে। সমস্ত পথটা ঘোমটা ছিল; এখানে এসে নিশ্চিন্দি হয়ে খুলতে যাবে, এমন সময় খানিকটা দূরে কোনো নৌকোতেই, কিংবা ডাঙাতেই কাউকে দেখে, হঠাৎ আধখানা ঘোমটা খুলে থেমে গেছে। সন্ধ্যার অস্পষ্ট আলোয় স্পষ্ট কিছু বুঝতে পারছে না বলে ঘাড় বাঁকিয়ে ভ্রুদুটি চোখের ওপর চেপে দাঁড়িয়ে আছে। দুটি পা সিঁড়ির দুটি ধাপে উঁচু-নীচু হয়ে আছে, কলসিটি কাঁকাল থেকে নামিয়েছে, এখন কলসি রেখে ঘোমটাটি খুলবে কি তার আড়াল থেকে সন্দেহটা একেবারে মিটিয়েই নেবে, তা ঠিক করতে পারছে না। আমার ছবিটা হবে ঠিক এই সময়কার, বুঝলে? কাঠের সিঁড়ি এই তোয়ের করে রেখেছি; এই কলসিটা ধর। নাও, দাঁড়াও দিকিন।”

“বাবা বাবা, মাথায় এতও খেলে আপনার!”—-বলিয়া একটু হাসিয়া বেলা কাঠের সিঁড়ির প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে পা দিয়া, সুগৌর বাম হস্তটিতে কলসি লইয়া এবং নিজের যৌবনশ্রীমণ্ডিত অপরূপ দেহখানির হিল্লোল সংযত বসনের রেখা-তরঙ্গে ফুটাইয়া বঙ্কিম ঠামে দাঁড়াইয়া রহিল। বলিল, “তাড়াতাড়ি সেরে নেবেন; আজ কি অপরাধে বেঞ্চির ওপর দাঁড় করানো হল, জানি না।”

আঁচলের ঝুল, কি কাপড়ের ভাঁজ, কি কোথাও ঘোমটার পাড়ের একটা বাঁক ঠিক করিতে করিতে চিত্রকর হাসিয়া জবাব দিল, “থিয়েটারের চাকরি ছেড়ে নিজের প্রতি যে অন্যায় করেছ, তার জন্যে। তুমি আজকাল বেজায় দুষ্টু হয়ে পড়েছ বেলা!”—বলিয়া একবার ভালো করিয়া দেখিয়া লইয়া আঁকিতে শুরু করিয়া দিল।

একটা রেখার টানে একটু সন্দেহ হওয়ায় দেখিয়া লইবার জন্য মুখ তুলিল। দেখিল, মডেলের মুখের ভাব বদলাইয়া গিয়াছে। শুধরাইয়া দিবার জন্য বলিল, “উঁহু, বদলে ফেলেছ যে! ভ্রূ আরও নামিয়ে দাও, আর চাউনিটা আর-একটু আড়ে হবে, সন্দেহের ভাবটি ঠিক ফোটে নি যে!”

বেলার ঠিক করিয়া লইতে দেরি হইল না। চিত্রকর আঁকিতে লাগিল। একটু পরে চোখ তুলিয়া দেখিল, সে আবার সব মাটি করিয়া বসিয়াছে। কি যে হইয়াছে তাহার, বলা যায় না। গ্রীবার ঈষৎ ঝোঁকটিতে যে একটা আচম্বিতের ভাব ফুটিয়া উঠিয়াছিল, সেটা আর নাই এবং তীক্ষ্ণ কৌতূহলের ভাব তিরোহিত হইয়া চোখে একটা উদাস আনমনা ভাব আসিয়া পড়িয়াছে। সরোজ একটু অসহিষ্ণু হইয়া পড়িল। মডেলের কাছ হইতে আজ সে মোটেই সহযোগ পাইতেছিল না অথচ এই-ই পূর্বে একই ভঙ্গিমায় এবং একই ভাব ফুটাইয়া একটানা প্রয়োজনমতো দাঁড়াইয়া থাকিত। সে হাসিয়া বলিল, “তোমার কি হয়েছে বেলা? তোমায় দেখে বোধ হচ্ছে, বেচারা ঘাটে এসে এমন কাউকে দেখেছে, যাকে দেখে একেবারে মন হারিয়ে ফেলেছে, সতর্ক স্ত্রীলোকের যে ত্রস্ত অথচ সুসংযত ভাব থাকে, সেটা কই? এ যেন বেচারার সব এলোমেলো হয়ে গেছে। এ ভাবটা যদি তোমার মনে এতই আধিপত্য করে থাকে, অমন একদিন না হয় তোলা যাবে’খন; আজকে আমার ভাবটা একেবারে নষ্ট করছ যে!”—বলিয়া সরলভাবে হাসিতে লাগিল। বেলা নিতান্ত অপ্রতিভ হইয়া পড়িল। শুধরাইবার চেষ্টা করিল বটে, কিন্তু সরোজ ক্রমাগতই অপছন্দসূচক ঘাড় নাড়িতে লাগিল। তখন আর সে পারিল না, নামিয়া আসিয়া একটা সোফায় লজ্জিতভাবে বসিয়া পড়িল, কহিল, “না সরোজবাবু; আজ কেমন হয়ে উঠছে না।”

সরোজ পেন্সিলটা রাখিয়া দিল। তাহার পানে চাহিয়া বলিল, “থাক তবে এখন, কিন্তু এ আবার কি হল?”

“হবার তো কিছু দেখি না, বোধ হয় কদিন থেকে শরীরটা তেমন—মরুক গে, আবার কবে হাজির দিতে হবে বলুন।”—বলিতে বলিতে দুয়ারের নিকট চলিয়া গেল।

সরোজ উত্তর করিল, “খবর দোবখ’ন।”

“বেশ।”—বলিয়া বেলা বাহির হইয়া গেল।

চিত্রকর একটু অন্যমনস্ক ভাবে চিন্তা করিয়া নিজের মনেই বলিল, “হুঁ।” তাহার সেদিনকার ঘটনাও মনে পড়িল, কিন্তু আর সময় নষ্ট না করিয়া অন্য একটা ছবিতে রঙ ফলাইতে বসিয়া গেল।

এই রকমই হইতে লাগিল। দুইমাস গেল, চার মাস গেল, একখানা আর ভালো ছবি শেষ করা হয় না। ছিন্নতন্ত্রী বীণার সুরের মতো সবগুলাই অসময়ে গতিহীন হইয়া পড়ে, আর কিছুই করা যায় না। শিল্পী নিজের খেয়াল ছাড়িয়া দিয়া মডেল যে ভাবে আবিষ্ট থাকে, তাহাই তাহার চিত্রফলকে মুদ্রিত করিবার চেষ্টা করে। কিন্তু বৃথা, নির্বোধ ঔদাসীন্যের সময় তাহার কোথা হইতে যে সঙ্কোচ আসিয়া পড়ে এবং গভীর সঙ্কোচের মাঝে কখন যে মনটা মুক্তপক্ষ হইয়া দূর দিগন্তে বিলীন হইয়া যায় কিছু বলা যায় না। চিত্রকর তুলিকা ছাড়িয়া দেয় এবং অপ্রকাশের ব্যথা লইয়া হতাশভাবে বসিয়া থাকে।

সত্তপ্ত চিত্তে বেলা প্রতিদিনই অনুরোধ করে, “আমায় ছেড়ে দিন, আমি কোনো মতেই পেরে উঠছি না, হাজার চেষ্টা করেও না। আমি নিজেই অন্য কাউকে না হয় ঠিক করে দিচ্ছি।”

শিল্পী বলে, “সে না হয় হল; কিন্তু কি হয়েছে তোমার বল দিকি?”

তবুও ছাড়ে না। ভাবে, ইহাকে লইয়াই তাহার এত প্রতিষ্ঠা; মানসিক চাঞ্চল্যের সময়ই এটা; দুই দিন কাটিয়া গেলে পরে আবার ঠিক হইয়া যাইবে। চাই কি ইহার মধ্য দিয়াই এই তরুণীর একটা নূতন রূপ ফুটিতে পারে, সেটা তাহার চিত্ররচনায় একটা অভিনব সম্পদ হইয়া দাঁড়াইবে। এই রকম গোছের একটা আশাও ছিল, তা ছাড়া এই ঘরের প্রত্যেক জায়গাটির সহিত, তাহার নিজের আঁকা প্রত্যেক ছবিটির সহিত বেলার স্মৃতি একান্তভাবে জড়িত। তাহার সৌন্দর্যসৃষ্টির ইতিহাসে যে এতটা স্থান জুড়িয়া আছে, তাহাকে বিচ্ছিন্ন করিবার কথা কি ভাবিতে পারা যায়?

তাহা না যাক, কিন্তু বেলার তরফ হইতে ছুটির তাগাদা বড় জোর হইয়া পড়িল। তাহার মনে যে বেদনা, সেটা বেশিদিন কিছু তাহার কাছে রহস্যাবৃত রহিল না। তখন সে মনে মনে শিল্পীকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, আমার দেহ অর্থাৎ দেহের ললিত ভঙ্গিমা লইয়াই তো তোমার কারবার? সে দিকটা যখন আমার চিরদিনের মতো অন্তর্হিত হইয়া গিয়াছে, তখন আর কেন? আমাকে বিদায় দাও। নিজের হাতে বাঁধন ছিঁড়িয়া যাইব, সে শক্তি আমার রাখ নাই; তাই ভিক্ষা—তুমি নিজের মুখেই বিদায় দাও; এইটিই তোমার মহাদান বলিয়া মনে রাখিব।

এই রকম আরও সব কথা, যার একটাও স্পষ্ট করিয়া বলিতে পারে না।

মুখ ফুটিয়া বলে শুধু, “আমি পারি না সরোজবাবু, আমায় ছেড়ে দিন, আমায় মুক্তি দিন।”

তাহার পর দুইটি মর্মাহত প্রাণীর ক্লিষ্ট নীরবতায় ঘরের হাওয়াটা থমথম করিতে থাকে!

.

একদিন নিতান্ত আড়ম্বরহীন বেশে অসময়ে স্টুডিওতে প্রবেশ করিয়া বেলা একটায় সোফায় বসিয়া পড়িল, অশ্রুনিরুব্ধ ভারি আওয়াজে বলিল, “আজ বিদায় নিতে এলাম।”

সরোজ অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া তুলি লইয়া নিতান্ত নিবিষ্ট মনে কি একটা আঁকিতেছিল একেবারে তন্ময় হইয়া। মুখ না ফিরাইয়া, তুলির একটা দীর্ঘ টান দিতে দিতে অন্যমনষ্ক ভাবেই বলিল, “নিতান্তই বিদা—য়। তা বেশ।”—বলিয়া আঁকিয়া চলিল; কাজটুকু শেষ হইবার পূর্বেই কিন্তু তাহার চমক ভাঙিল, সন্ত্রস্তভাবে কি একটা বলিবার জন্য ফিরিয়া দেখিল, বেলা নাই।

একটা বিষম আঘাত লাগিল, এবং সেই সংযত শিল্পীর মনের দুর্গে এতদিনে এই আঘাতটি একটা বিদারণ-চিহ্ন অঙ্কিত করিল। হঠাৎ মনে হইল, বোধ হয় এইমাত্র উঠিয়া গিয়াছে, ফিরাইয়া আনি; এ ভাবে বিদায় দেওয়া নিতান্ত নিষ্ঠুরতা। কিন্তু নিম্নতল পর্যন্ত নামিয়া রাস্তায় গিয়াও দেখিল, সে নাই। সে ফিরিয়া আসিয়া সোফাটায় হেলিয়া পড়িল এবং অনুভব করিল, তাহার অস্তিত্বের কোনখানটায় হঠাৎ খানিকটা যেন বেজায় শূন্যময় হালকা ঠেকিতেছে।

তাহার আর সেদিন আঁকা হইল না। এতদিন কাজের সময়টাকে সে নিতান্ত সমাদরের চোখে দেখিত। আজ কিন্তু তাহার মনে হইল, যেন সময়ের এবং সেই সময়টাকে পূর্ণ করিবার জন্য যে কর্ম, জীবনে তাহার বিশেষ কোনো সার্থকতা নাই।

কেন এমন হইল, ভাবিতে গিয়া চিত্রীর ভূতে সংশয়ের কুঞ্চন ফুটিয়া উঠিল, এমন কি চক্ষু দুইটাও দুই বিন্দু অশ্রুর আলোকে ঝলমল করিয়া উঠিল; এবং অনেকক্ষণ পরে যখন সে উঠিল, তখন একটা উষ্ণ দীর্ঘশ্বাসে জানাইয়া দিল যে, ভিতরে তাহার একটা জায়গা উত্তপ্ত হইয়া উঠিয়াছে।

.

বেলা বিদায় লইল। ভাবিল, অভিমানের একটা প্রচণ্ড আঘাত দিয়া সে ইহকালের জন্য সুদূর হইয়া পড়িবে। এই শহর, এই দেশ, এমন কি শেষে এই পৃথিবী হইতে এত আলাদা হইবে যে, কখনও যদি অনুতপ্ত শিল্পী প্রয়োজন বোধ করে, তাহা হইলে তাহাকে আর খুঁজিয়া পাইবে না। তখন যে একটা বেশ প্রতিশোধ লওয়া হইবে, সে চিন্তা তাহাকে বড় তৃপ্তি দিল, যদিও সে ভাবিয়া দেখিল না, কিসের সে প্রতিশোধ, অপরাধ কোনখানটায় এবং তাহার এ অভিমানের দাবিই বা উদয় হইল কোথা হইতে!

সুদূর এবং অলভ্য হইতে চাহিল বটে, কিন্তু তাহাও আবার সহজ হইল না। বহুদিনের বাড়িটা ত্যাগ করিল; কিন্তু শহর না ছাড়িয়া সরোজের বাড়ির আরও নিকটে একটা বাসায় আসিয়া উঠিল এবং তাহাতে নিজের প্রতি বিরক্ত হইল। একটা বড় রকম সক্ষমতায় এই ক্ষুদ্র দুর্বলতাকে চাপা দিবার জন্য সে একেবারে দেশ ছাড়িবার জন্যই আয়োজন জুড়িয়া দিল।

কিন্তু তাহাও আর শেষ হইয়া উঠে না। কিছুই গুছাইবার নাই। বিলাস সম্পর্কিত আলয় ব্রহ্মচর্যের কঠোর দৈন্যে শূন্য হইয়া গিয়াছে; শৌখিন পরিচ্ছদ, অলঙ্কার, আসবাব বিশেষ কিছুই আর নাই; কিন্তু তবু তাহার আর গোছানো হইয়া উঠে না। তাহার প্রবল উৎসাহ সমস্ত ব্যস্ততার মধ্যে হঠাৎ নিবিয়া যায়; সজল নয়নে বেলা নিশ্চলভাবে বসিয়া থাকে। জোয়ারের জল যেমন ভিতর হইতে ফুলিয়া সাগরের প্রান্তে চাপিয়া ধরে, একটা নিদারুণ অভিমান তেমনই করিয়া তাহার মনের শেষ সীমা পর্যন্ত ঠেলিয়া উঠে; এবং সেই আত্মনিরুব্ধ অভিমান কাহারও উপর উচ্ছ্বসিত হইয়া পড়িতে পায় না বলিয়া অসহ্য বেদনায় বক্ষের শিরা-উপশিরাগুলি চাপিয়া ধরে।

শহর দেশ কিছুই ছাড়া হইল না, সুদীর্ঘ একটা বৎসর এই দূরত্বহীন কঠোর অজ্ঞাতবাসে কাটিয়া গেল; এবং সকলের অপেক্ষা বিস্ময়কর ব্যাপার এই হইল যে তরুণী একদিন হঠাৎ শিল্পীর গৃহে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার মনে কি যে তর্ক উঠিল যাহার এই অদ্ভুত মীমাংসা, তাহা বলা যায় না; তবে এই পর্যন্ত দেখা গেল, বেলা এক গ্রীষ্মাবসানের মন্ধ্যাহ্নে দর্পণের সামনে বসিয়া সুচারুরূপে কেশ বাঁধিল, মণিবন্ধে সোনার চুড়ি এবং বাহুতে বহুদিনের অনাদৃত অনন্ত পরিল, একটা খয়ের রঙের বেনারসী শাড়িতে তাহার তরুণ যৌবনখানি মুড়িয়া কটিতে চন্দ্রহার দুলাইয়া দিল এবং রক্তাধরে তাহার সকলের চেয়ে মদির হাস্যটি ফুটাইয়া গাড়িতে উঠিল। যাইবার সময় হুকুম রাখিয়া গেল, আজ সব যেন প্রস্তুত থাকে, এখানে আজ শেষ দিন।

দাসী জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় যেতে হবে?”

দর্পণের সামনে তোলা হাসিটিকে বেলা নষ্ট হইতে দিল না; তেমনই ভাবে বলিল, “জাহান্নমে, কারণ আমার দুনিয়ায় মাত্র দুটি বিভাগ আছে : এক—এই স্বর্গ, দ্বিতীয়- জাহান্নম।”

দাসদাসীরা পরস্পরের সহিত দৃষ্টি বিনিময় করিল, অর্থাৎ শুভ লক্ষণ, কর্ত্রীর মুখে অভিনয়ের বুলি দেখা দিয়েছে, বোধ হয় এবার দিন ফিরিবে।

এক বৎসর পরে বেলা আবার সেই ঘরটিতে প্রবেশ করিল। শিল্পী তখন ছিল না। বেলা পুরাতন অভ্যাসমতো সোফাটায় গিয়া বসিল, কিন্তু বসিবার আগে সেটাকে একবার ভালো করিয়া ঝাড়িয়া লইতে হইল, কেননা চিরন্তন প্রথানুযায়ী যেরূপ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা উচিত, সেটা সেরূপ ছিল না। শুধু তাহাই নয়, বেলা লক্ষ্য করিল, ঘরটার আর সর্বত্রও একটা করুণ শ্রীহীনতা ছড়াইয়া রহিয়াছে। সামনে বদ্ধ জানালার খড়খড়িতে ধূলা জমিয়াছে এবং তাহার উপর কয়েকটা মাকড়সা সূক্ষ্ম জালের পর্দা বুনিয়া নিরুপদ্রবে বসবাস করিতেছে। বুঝিতে পারিল, অনেকদিন ওই জানালা খোলা হয় নাই। দেওয়ালে ঠেস দেওয়া ছবিগুলায়ও ধূলা, এমন কি ঘরের মেঝেয়ও অনেকদিন ঝাঁট পড়ে নাই, এবং বেশি যে কেহ ঘরটাতে প্রবেশ করে না, তাহাও স্পষ্ট বোঝা গেল।

সৌন্দর্যের অধিষ্ঠান গৃহটির এই আতুর ভাবটি বেলার মনের এক জায়গায় বেদনা জাগাইল বটে, কারণ সে ইহাতে অভ্যস্ত ছিল না, কিন্তু সেই বেদনার পাশে একটা সুখের আভাস যে না ফুটিল এমন নয়, কারণ অন্তরের অন্তরে সে বুঝিতে পারিল এ তাহারই অভাবে।

বেলা অন্যমনস্ক ভাবে উঠিল এবং জানালাটি খুলিয়া দিয়া একে একে ছবিগুলা ঝাড়িতে লাগিল।

সবগুলিই প্রায় তাহারই দেহপ্রাণের সহিত জড়িত, তাহারই সৌন্দর্যের মূক সাক্ষী। আজ কি একটা ভাবিয়া বেলা অনেকদিন পরে নিজের হতাদর যৌবনশ্রীর পানে চাহিয়াছে, সুতরাং একান্ত নূতনভাবে সে তাহারই এই আলেখ্যগুলোকে আজ ভালোবাসিল। এক- একটাকে সে দুরন্ত আবেগভরে বক্ষে চাপিয়া ধরিল। এই স্ফুট-চেতনা, ব্যথিতা, নিঃসঙ্গা নারীর মনে হইল, তাহার রক্তমাংসের প্রতিরূপ, এই চিত্রগুলায় তাহার মর্মের হাহাকারও বোধ হয় সঞ্চারিত হইয়া থাকিবে, বক্ষের কাছে চাপিয়া ধরিলে সমবেদনাময়ী সখীর মতো ইহাদেরও বুঝনো যাইবে, তাহার বেদনা কিসে এবং কতই না গভীর!

হঠাৎ একটি ছবির উপর তাহার চোখ পড়িয়া নিস্পন্দ হইয়া রহিল। পুরাতন ছবি, যে মালিক, সে বোধ হয় সংস্কারের জন্য রাখিয়া গিয়াছে। এক লতাকুঞ্জের দ্বারে হেলান দিয়া একটি নারী দাঁড়াইয়া আছে, দৃষ্টি তাহার বহুদূরে নিবদ্ধ, যেখানে বিতানের সঙ্কীর্ণ পথ অস্পষ্ট হইয়া চক্রবালরেখায় মিলাইয়া গিয়াছে। বসন্ত বহিয়া গিয়াছে। রিক্ত কুঞ্জ, সুখের ক্ষীয়মাণ স্মৃতির মতো দুই-একটা ফুল এখানে-ওখানে ধরিয়া রাখিয়াছে, নিদাঘের উষ্ণ নিশ্বাসে সেগুলাও তেমন ভালো করিয়া ফুটিতে পায় নাই, কেমন যেন মুছিয়া গিয়াছে। এই ম্রিয়মাণ সৌন্দর্যের সহিত একই ছন্দ মিলানো সেই রমণীমূর্তি। তাহার পূর্ণায়ত চক্ষে বেদনার গাঢ় ছায়া, আবেগের উগ্র শিখা আর আশার সৌম্য জ্যোতি কেমন করিয়া মিলিয়া গিয়া এক অতল রহস্যের সৃষ্টি করিয়াছে। নীচে লেখা আছে, “প্রতীক্ষা”। প্রতি বর্ণের প্রতি অণুপরমাণু হইতে একটা ব্যাকুল ভাষা যেন মৌনতা ভাঙিয়া আসিতে চায় : ওগো নিষ্ঠুর, কেন ‘আসি’ বলিয়া এখনও আসিলে না? আর কতদিন এ বিফল পথ-চাওয়া? হে অবিচারী, তোমারই জন্য সজ্জিত এ কুঞ্জশোভা লুব্ধ কাল তিল তিল করিয়া হরণ করিয়া লয় যে! হে নিষ্ঠুর, কি সে তোমার কঠোর বৈরাগ্য, যাহা এই মর্মন্তুদ কাহিনীর কাছেও এত অটল? কুঞ্জের বসন্ত কাঁদিয়া ফিরিয়া গিয়াছে, আর হে দেবতা, এ যৌবন-পুষ্পপাত্রের সব ফুল যে শুষ্কপ্রায় : তবুও এস, এ জীবনে এই বিপুল ব্যর্থতার অর্ঘ্য দিয়াই তোমার পূজা সাঙ্গ হইবে। তোমার হৃদয়হীন পাষাণমূর্তিতে এই চিরপ্রতীক্ষমাণা ভক্তই অন্তরের নিবিড় বেদনা দিয়া প্ৰাণপ্রতিষ্ঠা করিবে। তুমি শুধু সকল নিরাশার মধ্যে একটি মাত্র আশা সফল করিও; তোমার বাণী চাহি না, তোমার স্পর্শ চাহি না, শুধু একটি মুহূর্ত-যুগব্যাপী প্রসন্ন দৃষ্টিতে এই ব্যর্থ জীবন একটি স্মৃতিমাত্রের সম্বল দিয়া, এই ক্ষুদ্র অপ্রয়োজনের নিকট হইতে সংসারের নির্মম প্রয়োজনে ফিরিয়া যাইও।

কিন্তু কে শোনে অন্তস্তলের এই গভীর ক্রন্দন?

তীব্র অভিমানে বেলার হৃদয় পূর্ণ হইয়া উঠিল। সেই কঠিন গৃহ-প্রাচীরের গায়ে বাম হস্তের আবেষ্টনীর মধ্যে বদ্ধকবরী মস্তকটি রাখিয়া পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। সোনার কাজ-করা ভারি আঁচলখানি সোনার দেহ হইতে বস্ত্রাবরণ খসাইয়া দিয়া ভূমে লুটাইতে লাগিল, এবং স্থানভ্রষ্ট কটিহারটা গতাশ্রয়া ক্ষুদ্র লতিকার মতো ক্ষীণ কটির একটা লঘু বাঁকের অবলম্বন ধরিয়া অধোদেশ ঘেরিয়া দুলিতে লাগিল। দেহটি দুই-তিন স্থানে নুইয়া গিয়াছে—যেন অন্তরের অভিমান-ভরেই।

এই অনাদৃতা যুবতী আজ নিজেই উন্মুখ হইয়া আসিয়াছিল বটে; কিন্তু স্থির করিল, না, আর কথা কহিবে না, হাজার সাধিলেও না। শিল্পীর একটা অনুতপ্ত কাল্পনিক মূর্তিকে নিজের পার্শ্বে দাঁড় করাইয়া সে অভিমানে মুখ ফিরাইয়া রহিল। এমনসময় সরোজ তাহার সত্য-মূর্তিতেই ঘরে প্রবেশ করিল এবং অসংযত ভাবে চিৎকার করিয়া উঠিল, “বেলা!”

কোনো উত্তর হইল না। শুধু সেই দেহবল্লরী ঈষৎ স্পন্দিত হইয়া আবার নিশ্চল হইয়া গেল।

সরোজ একটু দাঁড়াইল; তাহার পর ধীরে ধীরে কাছে গিয়া বেদনার স্বরে বলিল, “বিদায় কি ওই ভাবেই নেয় বেলা?”—ইচ্ছা হইল, অন্তত কাঁধের উপর একটা হাত দিয়া কথাটা বলে; কিন্তু কি ভাবিয়া তাহা করিল না।

মনে হইল, যেন রুদ্ধ অভিমানের ঢেউ ভিতর হইতে উচ্ছ্বসিত হইয়া এই তন্বীর দেহটিকে ভাঙিয়া খানখান করিয়া দিবে। বেলা ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতেছে; কোনো কথা বলিল না কিংবা ফিরিয়াও চাহিল না।

সরোজ নির্বাকভাবে অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল। এই বিক্ষুব্ধা সুন্দরীর পাশে দাঁড়াইয়া সৌন্দর্য-উপাসক পুরুষের মনে কি হইতেছিল, কে বুঝিবে? সে একটাও সান্ত্বনার কথা বলিতে পারিল না। তাহার স্থির ঈষৎ সিক্ত চক্ষে হৃদয়ের মধ্যকার একটা তুমুল দ্বন্দ্বের আভাস ফুটিয়া উঠিতেছিল। ক্রমে এই সংযমী যুবার বাহুদ্বয় অবশভাবে আলিঙ্গনের আকারে সেই ক্রন্দমানা রমণীর দেহ ঘিরিয়া ফেলিল, কিন্তু স্পর্শ হইবার পূর্বেই তাহার চমক ভাঙিয়া গেল।

তখন এই মনুষ্যটির মধ্যে ব্যথিতের পরিবর্তে চিত্রীই প্রধান হইয়া পড়িল। সে ভাবিল, অনুশোচনার কথা, সান্ত্বনার কথা বলিবার ঢের সময় পাওয়া যাইবে, কিন্তু সাক্ষাৎ অভিমানের মূর্তি ধরিয়া এই যে একটি নবীনা তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া—এ সুবিধাটুকু ছাড়িয়া দিলে আর তাহার আপসোস রাখিবার কি ঠাঁই থাকিবে? বেলা তো ফিরিয়াই আসিয়াছে, তাহার সাময়িক চাঞ্চল্য কাটিয়া গিয়াছে, কিন্তু এই সুদীর্ঘ বর্ষাকাল পরে নিতান্ত অজ্ঞাতসারে সে যে একটিমাত্র নিখুঁত ভাবের ভঙ্গিমা তাহার সামনে ধরিয়াছে, তাহার মধ্যে এতটুকুও কৃত্রিমতার খাদ নাই—সেটিকে যদি বিচলিত করিয়া নষ্ট করে তো সে ভুল কি আর সারা জন্মে মিটাইতে পারিবে? তাহার চিত্তে যে দরদ উঠে নাই এমন নয়, তবে সে দরদ তাহার গভীর সৌন্দর্যানুভূতিকে লুপ্ত করিতে পারিল না। সে এই অভিমানীর শোকবিদীর্ণ অভ্যন্তর হইতে চক্ষু সরাইয়া বাহিরে ন্যস্ত করিল, মুগ্ধ নেত্রে দেখিতে লাগিল, অবশ অঙ্গের প্রতি রেখায় রেখায় এবং ত্রস্ত বসনের পরতে পরতে কি পূর্ণভাবেই না সেই শোক ফুটিয়া উঠিয়াছে!

তা, এইসময় সমব্যথার পিয়াসী নারীর হৃদয় যখন রুদ্ধ বিক্ষোভের ঝড় তাহার প্রতি শিরা-উপশিরা টানিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিতেছিল, সেই সময় চোরের মতো অতি সন্তর্পণে, সৌন্দর্যের ভাণ্ডার হইতে কিছু সঞ্চয়ের জন্য সেই যশস্বী শিল্পী তুলিকা লইয়া বসিয়া গেল। সে ভাবিল, বেলা তো ফিরিয়াই আসিয়াছে, তাহার দুই দিনের চাঞ্চল্য কাটিয়া গিয়াছে, কিন্তু সৌন্দর্যের সাগরে মুহূর্তের জন্য এই যে হিল্লোলটি উঠিয়াছে, ইহাকে তো আর ধরিয়া রাখা যাইবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *