চিতাভ্ৰষ্টা – (1748) – দ্বাদশ পৰ্ব

চিতাভ্ৰষ্টা – (1748) – দ্বাদশ পৰ্ব

পুব আকাশে মেঘসঞ্চার হলে সুয্যিঠাকুরের হাজিরা দিতে বিলম্ব হয়ে যায়, শোভারানির হয় না। সুয্যি ওঠার আগেই সে হাজির।

শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা। সেও ক্রমশ একবগ্গা। দুর্গা গাঙ্গুলীর বৈকুণ্ঠলাভের পর এখন একান্নবর্তী পরিবারে কর্তামশাই হয়েছেন

মেজোতরফের কালিচরণ। তাঁর নিষেধে ও কর্ণপাত করে না। কুলীন সংসারে বয়স্থা অরক্ষণীয়ার আর কিছু থাক-না-থাক দাপটটা থাকে। সাতসকালে এসে হাজিরা দেয় তার রুপোদার বাড়িতে। প্রাতরাশের ফলমূল কেটে রেকাবিতে সাজিয়ে দিয়ে রান্না চাপায়। অরক্ষণীয়া কন্যার পাক-করা অন্ন অভক্ষ্য। একবগ্গা ঠাকুর তা মানেন না। দ্বিপ্রহরে রুপোদা আর মামণিকে পরিবেশন করে নিজেও দুটি অন্নগ্রহণ করে। শেষ কাজটা তার নিজের গরজে হয়। ওই অজুহাতে সে গাঙ্গুলীবাড়ির ভাঁড়ার থেকে নিয়ে আসে নানান আনাজ—কলা-মূলা, মানকচু, এঁচোড়, লাউ-কুমড়ো, শাক-সবজি। সেজগিন্নি একদিন কী একটা প্রতিবাদ করা মাত্র শোভা গাঁকগাঁক করে রুখে উঠেছিল- ‘এ-আবাগীও তো ওখানে দুটি গেলে! না কী?” সন্ধ্যায় মামণিকে শুইয়ে দিয়ে সে ফিরে যায় নিজের বাড়িতে। শোভারানির একটাই সমস্যা—ওঁরা তিনজন ক্রমাগত ‘অং-বং-চং’ ভাষায় বাক্যালাপ করেন! এ এক বিড়ম্বনা! সে ভাষাটা শোভার মাথার অনেক উপর দিয়ে চলে যায়। কিন্তু উপায় কী? এটা স্বয়ং বড় একবগ্গার আদেশ!

রাত্রে ইদানীং আর রোগিবাড়ি যান না। শিবনাথের ভরসায় মামণিকে ফেলে রেখে যেতে ভরসা হয় না। জীবন দত্তকে ঠেকা দিতে পাঠিয়ে দেন। ত্রিবেণীতে সোনা-মার কোলে এতদিনে নিশ্চয় এসেছে মামণির ফুটফুটে ভাই কিংবা চুন্নুমুন্নু বোন। বাবার কাছে শুনেছে—তার নাম: হয় শ্যামামালতী অথবা আত্মদীপ, ঠিক কোনটা তা অতবড় পণ্ডিতও জানেন না। সে-যুগে শের শাহ্র ঘোড়ার ডাকের হ্রেষাধ্বনি গৌড়বঙ্গ থেকে শোনা যেত না। দু-দশ ক্রোশ দূরবর্তী আত্মীয়ের কুশল-সংবাদ লাভই ছিল দুর্লভ!

অতি প্রত্যুষে উঠে রূপেন্দ্র পরিদর্শন করে আসতেন তাঁর আরোগ্য নিকেতন। একপ্রহর বেলায় বসত তিনজনের পাঠের আসর। আদিকবি বাল্মীকির মূল রামায়ণ-পাঠ শেষ হয়েছে। তারপর ব্যাসদেবের দিকে যাননি। শুরু করেছেন সংস্কৃত কাব্য। বিক্রমোবর্শীয়ম্, অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ শেষ হয়েছে। এখন চলছে শূদ্রকের মৃচ্ছকটিকম্।

রূপেন্দ্র বলেন, “মৃচ্ছকটিকম্’ কাহিনি বা উপাখ্যান নয়। এটি একটি নাটক। অভিনয়যোগ্য। ‘অভিনয়’-কী বলতো মামণি?

—’অভি পূর্বক নী-ধাতু অ’। অর্থাৎ অভিনবরূপে নিকটে আসা।

–কে কার নিকটে আসছে?

—দর্শক বা শ্রোতা আসছেন কুশীলবদের নিকটে। অভিনব ব্যবস্থাপনায়। আবার ওঁরা দুজনেই একসঙ্গে আসছেন নাট্যকারের কল্পলোকে। নাট্যকারের মূল পরিবেশ্য রসে।

—ঠিক বলেছ।

—আচ্ছা বাবা, আপনি বললেন, মৃচ্ছকটিকম্ ‘কাহিনি’ বা ‘উপাখ্যান’ নয়। এক্ষেত্রে কাহিনি আর উপাখ্যানের প্রভেদ কী?

রূপেন্দ্র শুভপ্রসন্নের দিকে ফিরে প্রশ্ন করেন, তোমার কী অভিমত ভাদুড়ীমশাই? উনি মাঝে মাঝে শুভকে এই বিচিত্র নামে ডাকেন। যদিও সে ‘প্রাপ্তে তু ষোড়শে বর্ষে’ হয়নি তবু মিত্রের মতো এজাতীয় রসিকতা করে পাঠের আসর সরস রাখেন।

শুভপ্রসন্ন বলে, দুটোই সমার্থক। ‘কাহিনি’ শব্দটা এসেছে যাবনিক উৎস থেকে : ‘কহানি’ থেকে। আর উপাখ্যান হচ্ছে উপ-আখ্যান। ওদের প্রভেদ হচ্ছে এই যে : কাহিনি কথাকোবিদ বা কবির কপোল কল্পনা। যেমন ‘মেঘদূতম্’; আর উপাখ্যানের উপাদান হচ্ছে সর্বজনজ্ঞাত কোন ঘটনার—বাস্তব অথবা পৌরাণিক—বর্ণনার উপর প্রতিষ্ঠিত। কবি তাকে কাব্যরসে জারিত করে সেটা সুন্দরভাবে উপস্থাপনা করেছেন মাত্র। যেমন ‘কুমারসম্ভবম্। কবি কালিদাস না লিখলেও আমরা সবাই জানি যে, পতিনিন্দায় সতী দেহত্যাগ করেছিলেন। পরে হিমালয়দুহিতা রূপে তাঁর পুনর্মিলন হয় মহাদেবের সঙ্গে।

হটী প্রতিবাদ করে, আমার মনে হয় শুভদা ঠিক বলেনি। শুভদা এককালে শুধু মাজায় ঘুন্সি বেঁধে ওদের দরদালানে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াত। সেই অজুহাত দেখিয়ে বলা যাবে না যে, শুভদা শিশু!

—এটা তো তোমার ব্যক্তিগত আক্রমণ হল বন্দ্যোঘটি মহাশয়া। কাব্য-সাহিত্য থেকে উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করো এবার

—শুভদা যেটার কথা বলল সেটাই উদাহরণ। মহাকবি কালিদাসের পূর্বযুগে, কেউ ওই উপাখ্যানটা জানত না। কিন্তু আজ যদি প্রশ্ন করা হয়: ‘রামগির্যাশ্রমের যক্ষ তার প্রেয়সীর কাছে কাকে দূত করে পাঠিয়েছিল? তাহলে সমগ্র আর্যাবর্তের পণ্ডিত একবাক্যে বলবেন ‘পুষ্করবংশাবতংস’ মেঘকে! একদিন যা ছিল কল্পকাহিনি আজ তা সর্বজনবিদিত উপাখ্যান!

রূপেন্দ্র শুভপ্রসন্নের দিকে ফিরে বললেন, বন্দ্যোঘটি মহাশয়ার যুক্তিটি কিন্তু অগ্রাহ্য করা চলে না। কী বল?

শুভপ্রসন্নের মুখ তখন আরক্ত। পরাজয়ের গ্লানি? নাকি তাকে ঘুন্সিসৰ্ব স্ব নিরাবরণরূপে এমন প্রকাশ্য বর্ণনায়, সেকথা বোঝা গেল না। আরও একটি হেতু ছিল: রূপেন্দ্রনাথ এ দিকে ফিরতেই হটী তার সহাধ্যায়ীকে জিহ্বা-প্রদর্শন করে মুখ ভেঙচেছিল।

রূপেন্দ্র এবার তাঁর মতামত ব্যক্ত করেন: উপাখ্যান সাধারণত কোনও বৃহৎ সাহিত্য কর্মের খণ্ড কাহিনি: উপ + আখ্যান! যেমন, বাল্মীকির রামায়ণে রামসীতা বিরহ-মিলনের কথাই মূল উপজীব্য; তাই ‘অহল্যাউদ্ধার’ একটি উপাখ্যান! আচ্ছা এবার বলো ‘ব্যাজস্তুতি’ কাকে বলে? মামণি, তুমি এবার প্রথমে বলো?

—’ব্যাজস্তুতি’ মানে আপাতনিন্দার মাধ্যমে স্তুতি করা! শুনলে মনে হয়, নিন্দা করা হচ্ছে, আসলে করা হচ্ছে প্রশংসা বা স্তুতি।

—তোমার কী অভিমত ভাদুড়ীমশায়?

—হটীর প্রত্যুত্তর অসম্পূর্ণ। ব্যাজস্তুতির বিপরীত ব্যবহারও ভাষায় গ্রাহ্য। আপাতপ্রশংসার মাধ্যমে নিন্দাও করা হয়। সেটিও ব্যাজস্তুতি।

—এবার কিন্তু তোমার হার হল মামণি! শুভই পূর্ণ সংজ্ঞা দিতে পেরেছে। বেশ, এবার শ্রীমদ্ভগবত থেকে একটা ব্যাজস্তুতির উদাহরণ দাও, যেখানে আপাত-প্রশংসার মাধ্যমে নিন্দা করা হয়েছে।

ওরা দুজনেই বলল শ্রীমদ্‌ভাগবত থেকে অমন উদাহরণ ওদের অজানা!

আচার্য বলেন, বেশ, উদাহরণটা আমিই দাখিল করছি। তোমরা দুজনে অন্বয়-ব্যাখ্যা দিয়ে আমাকে বুঝিয়ে দাও, এটা কীভাবে প্রশংসার মাধ্যমে নিন্দা। ভাগবতের দ্বিতীয় স্কন্ধের তৃতীয় অধ্যায়ে উনবিংশতিতম শ্লোকে দেখছি নৈমিষারণ্যে শৌনক ঋষি সূতমুনিকে একটি শ্লোক শোনাচ্ছেন :

শ্ববিড্‌রাহোষ্ট্রখরৈঃ সংস্তুতঃ পুরুষঃ পশুঃ।
ন যৎকর্ণোপথোপেতো জাতু নাম গদাগ্রজঃ।।

মামণি তুমি প্রথমে এর অর্থ বল।

হটী বললে, ‘শ্ব’ হচ্ছে কুকুর, উষ্ট্র এবং খর অর্থাৎ গর্দভ এরা সকলে পুরুষপশুকে স্তুতি জানাচ্ছে।

—‘বিড্‌বরাহ’টা বাদ গেল কেন?

—ওর অর্থ আমি জানি না।

সুযোগ পেয়ে শুভপ্রসন্ন বলে, বিড়বরাহ হচ্ছে বিষ্ঠাভোজী শূকর।

—ঠিক বলেছ। আর ‘পুরুষপশু’ কে? তাছাড়া দ্বিতীয় চরণের অর্থ?

—যে ব্যক্তির কর্ণে গদাগ্রজের নাম কখনও প্রবেশ করে না সে পুরুষপশু!

—তা তো বুঝলাম, কিন্তু ‘গদাগ্রজ’ই বা কে আর ‘পুরুষপশুই বা কে?

শুভপ্রসন্ন বলে, ‘গদাগ্রজ’ হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ—যাঁর অগ্রজ গদাধারী বলরাম। বহুীহি সমাস। কিন্তু ‘পুরুষপশু’ যে কে তা ধরতে পারিনি!

—শোনো, বুঝিয়ে বলি। কুকুর বলছে, হে বিষয়ী মানবসন্তান! তুমি আমাদেরই মতো ক্ষুধার অন্নের সন্ধানে ভিক্ষা করে ফিরছ, তাই তোমাকে প্রণাম করি, তুমি মানব-সারমেয়। বরাহ বলছে, হে মানুষ! আমি রাজভোগ ত্যাগ করে বিষ্ঠায় ক্ষুন্নিবৃত্তি করে থাকি। যেমন তোমরা হরিভক্তির অমৃতভোগ অগ্রাহ্য করে বিষয়বিষ্ঠায় মশগুল। তাই তুমি আমার নমস্য। উটের বক্তব্য : আমরা যেমন রক্তাক্ত হওয়া সত্ত্বেও ঘাসপাতা না খেয়ে কণ্টকগুল্ম চর্বণ করে থাকি, তোমরাও সেভাবে হরিসেবা ত্যাগ করে বিষয় বিষে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছ, তাই তোমাকে প্রণাম। আর গর্দভের যুক্তি: আমি বনে ছিলাম, বেশ ছিলাম। তারপর শহরে এলাম মানুষের মোট বইতে। তুমিও, হে ‘অমৃতস্যপুত্ৰ’, সাধ করে আমার মতো স্ত্রীপুত্র-কলত্রাদির মোট পিঠে বহন করে চলেছ। আমি যেমন গাধার মোট পিঠ থেকে নামাতে পারি না, হে গর্দভশ্রেষ্ঠ, তুমিও তেমনি তোমার বোঝা নামাতে পার না। সুতরাং তুমি আমার অগ্রজ! তোমাকে প্রণাম। এইভাবে বিষয়ভোগী মানুষকে ভাগবত বলছেন ‘পুরুষ পশু’। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে চারজন পশু বিষয়ভোগীকে প্রণাম করছে, প্রশংসা করছে। বাস্তবে করছে তিরস্কার।

এরপর ‘মৃচ্ছকটিকম্’ শেষ হল। আচার্য বললেন, তোমরা দেখ, গুপ্তযুগে সমাজ কত উদার ছিল। চারুদত্তের মতো একজন বিশিষ্ট নাগরিক বাসবদত্তার ন্যায় একজন বারবনিতাকে বিবাহ করলেন। সমাজ তা স্বীকার করে নিল। সেকালীন সমাজ আজকের মতো কূপমণ্ডূক ছিল না। আজকের দিনে যদি কোনও সমাজপতি ভালোবেসে কোনও জনপদবধূকে বিবাহ করেন, ঘরে এনে আশ্রয় দেন, তাহলে সমাজ তাঁকে জাতিচ্যুত করবে। শাস্তি দেবে। জনপদবধূ তো দূরের কথা, যদি কোনও ব্রাহ্মণ কায়স্থ-কন্যাকে বিবাহ করতে চায় তাতেও গ্রামপঞ্চায়েতের ঘোরতর আপত্তি! তাকে একঘরে করে ছাড়বে।

এরপর শুরু হল ‘মেঘদূতম্’ পাঠ : “কশ্চিৎকাম্ভাবিরহগুরুণা…”

তিনজনেই পালাপালি করে পাঠ করেন। কিশোর-কিশোরীকে অপ্রচলিত শব্দার্থ আচার্য বুঝিয়ে দেন; ‘নিচুল’ হচ্ছে বনবেতস। পক্ষান্তরে কালিদাসের কবিবন্ধুর নাম। ‘দিঙ্কাগ’ আটটি দিগহস্তী, যথা ঐরাবত, পুণ্ডরীক, বামন, কুমুদ, অঙ্কন, পুষাদণ্ড, সার্বভৌম, ও সুপ্রতীক। পক্ষান্তরে বৌদ্ধদার্শনিক দিঙ্কাগাচার্য। রূপেন্দ্র বুঝিয়ে বলেন, টীকাকার মল্লিনাথের মতে এই শ্লোকে কিছু গুপ্ত শ্লেষ আছে। ‘নিচুল’ ও ‘দিঙ্কাগ’ শব্দ প্রয়োগে। কবি বলতে চান: হে বন্ধুবর মেঘ! তুমি রসিক কবি নিচুলের কাব্যে অবগাহন কর; বৌদ্ধদার্শনিক দিাগাচার্যের তর্কের স্থূলতায় আবদ্ধ হয়ে পড়ে থেকো না।

আরও বলেন, তোমরা লক্ষ্য করে দেখ যে, যক্ষ বিরহী—তার প্রেমে উৎকণ্ঠা থাকলেও অহেতুক ব্যস্ততা নেই। অলকাপুরীর পথনির্দেশ দিতে বসে যক্ষের মন সমগ্র আর্যাবর্ত পরিভ্রমণ করছে। যেখানে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু মধুর, কল্যাণময়, তার বর্ণনা করছে’—এমনকি বলছে “বক্রঃ পন্থা যদমি ভবতঃ প্রস্থিতস্যোত্তরাস্যাং” (উত্তর দিকে তুমি যাচ্ছ তা একটু ঘুরপথেই না হয় গেলে, উজ্জয়িনীটা দেখে যেতে ভুলো না, সেখানকার পৌরাঙ্গনাদের সৌন্দর্য না দেখে গেলে বৃথাই তোমার দৃষ্টিশক্তি।) অথচ মেঘদূতের কবি রূপজ মোহে এবং দৈহিক লালসায় সীমিত নন। কবি সর্বদা সুন্দরমুখী, সুন্দরের উপাসক। সরোবরের গভীর তলদেশে জন্ম নেয় পঙ্কজ, কিন্তু সে তার একান্ত, নিবাত-নিষ্কম্প সাধনায় জলরাশি ভেদ করে জলতলের উপরে উঠে আসে। সূর্যালোক পান করে। কারণ সে সূর্যরশ্মিপায়ী—সূর্যই তার সাধনার ধন। কালিদাসের যক্ষও তেমনি দেহজ কামনার প্রেরণায় প্রথমে তার বিরহিণী যক্ষিণীর প্রসঙ্গ তুললেও ক্রমে সে সমগ্র আর্যাবর্তের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে যায়। তার সাধনা সেই সুন্দরের সঙ্গে মিলনের সাধনা—যক্ষিণীর সঙ্গে দৈহিক মিলন নয়। সে সাধনায় পুরুষ-নারী তাদের পৃথক অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। “ন সো রমণ ন হাম রমণী/ ছুঁহু মন মনোভব পেশল জানি।।” আর সে জন্যই একেবারে শেষ শ্লোকে যক্ষ তার বিরহযন্ত্রণা ভুলতে পেরেছে। স্থিতধী ব্রাহ্মণের মতো মেঘকে শেষ শ্লোকে আশীর্বাদ করতে পেরেছে :

‘মা ভূদেবং ক্ষণমপি চ তে বিদ্যুতা বিপ্ৰয়োগঃ। *

[* “বিদ্যুৎ বিচ্ছেদ জীবনে না ঘটুক বন্ধু, বন্ধুর আজি আশীষ লও’-কবি সত্যেন্দ্ৰনাথ।
‘ঘটে না গো যেন তব সনে ক্ষণ বিচ্ছেদ চপলার’—পণ্ডিত যামিনীকান্ত শৰ্মা।]

‘মেঘদূতম্’ ‘-এর পর মহাকবির ‘কুমারসম্ভবম্’ও একদিন শেষ হল হর-পার্বতীর মিলনে। সপ্তম সর্গের শেষে। রূপেন্দ্র পুঁথিটি বন্ধ করে ললাটে স্পর্শ করলেন। বোঝা গেল না সে প্রণাম কাকে-’জগতঃ পিতরৌ’ না কবীন্দ্র কালিদাস।

রূপমঞ্জরী বলে, ওখানেই শেষ? আরও কিছু ভূর্জপত্র বাকি রয়েছে তো?

—হ্যাঁ মা। এরপরে আছে অষ্টম সর্গ। সেটা থাক।

—কেন বাবা?

রূপেন্দ্র শুভপ্রসন্নের দিকে ফিরে বলেন, ওর প্রশ্নের জবাবটা জানো? কুমারসম্ভবমের অষ্টম সর্গের কথা কিছু শুনেছ তুমি?

শুভপ্রসন্নের মুখ রক্তিম হয়ে উঠল। মুখ নিচু করে বললে, আমি ঠিক জানি না। রূপেন্দ্রনাথের একটি দীর্ঘশ্বাস পড়ল। বেশ কিছুক্ষণ নীরবে কী যেন চিন্তা করলেন। তারপর বলেন, মুখ তোলো। শুভপ্রসন্ন, তাকাও আমার দিকে।

শুভ তার লজ্জারুণ মুখটি তুলে আচার্যের দিকে তাকায়। রূপেন্দ্র বলেন, তুমি জান না, ‘গুরুশিষ্যসম্বাদে’ ‘সত্যঅপ্রিয়ম্’ নীতিটা বর্জনীয়?

রূপমঞ্জরী সরলভাবে জানতে চায়,–অপ্রিয় সত্যটা কী বাবা?

রূপেন্দ্র এবার কন্যার দিকে ফিরে বললেন, হ্যাঁ মামণি, ‘কুমারসম্ভবম্’ কাব্যে অষ্টম সর্গও আছে। সেখানে হরপার্বতীর দৈহিক মিলনের বিস্তারিত বর্ণনা আছে। তা আমরা একত্রে পাঠ করব না।

এতক্ষণে গূঢ়তত্ত্বটা আন্দাজ করতে পেরেছে। এবার বলে, সে অংশটাও কি কবীন্দ্র কালিদাসের রচনা?

—এ বিষয়ে পণ্ডিতেরা দ্বিমত। আমার সিদ্ধান্ত অষ্টম সর্গও কালিদাসের রচনা। কারণ ভাষামাধুর্যে ও কাব্যরসে সেটি সমভাবেই সমুত্তীর্ণ। সম্ভবত রাজাদেশে কালিদাস ওই সর্গটি ইচ্ছার বিরুদ্ধেই রচনা করেছিলেন। এই পুঁথির সঙ্গেই সেটা গাঁথা আছে। তুমি বড় হয়ে পড়ে নি।

কুমারসম্ভবম্ শেষ হল সপ্তম সর্গের ‘অসমাপ্ত গানে’।

রূপেন্দ্র বলেন, কাব্য-নাটক পর্যায় এই পর্যন্তই। আমার সংগ্রহে ভবভূতি, ভাস, এবং কালিদাসের আরও কিছু পুঁথি আছে। তোমরা ইচ্ছামতো তা পড়ে নিও। এবার বরং বলো, আমার কাছে বিশেষ কোন্ মার্গের শাস্ত্র পাঠ করতে চাও। শুভপ্রসন্ন প্রথমে বলো, তুমি কোন্ বিদ্যাগ্রহণে আগ্রহী?

—বিভিন্ন ধর্মমতের মূলতথ্য ও তত্ত্ব। উপনিষদ, থেরবাদী শূন্যবাদ, বেদত্রয়ী এবং বিশেষ করে সর্বেশ্বরবাদ বা ব্রহ্মবাদ।

হটী ওর খুঁৎ ধরতে সদাই উদগ্রীব। তৎক্ষণাৎ বলে, তুমি ‘বেদত্রয়ী’ বললে কেন শুভদা? বেদ তো চারটি! তাই না বাবা?

রূপেন্দ্র ওকে বুঝিয়ে বলেন, চতুর্থ বেদ অর্থাৎ অথর্ববেদ রচিত হয়েছে কালানুক্রমে অনেক পরে। ‘ব্রাহ্মণে’র যুগে, উপনিষদের যুগে তিনটি বেদই প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাই বলা হত ‘বেদত্রয়ী’। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে বেদকে ত্রয়ী’ বলা হয়েছে। প্রাসঙ্গিক সূত্রটি “যমন্ত্রীবিদ্যেঃ বিদুঃ খচঃ সামানি যজুংষি”। তারপর আসে উপনিষদের যুগ। প্রাচীনতম উপনিষদ দুটি। ছান্দোগ্য এবং বৃহদারণ্যক। তাতেও ক্রমাগত তিনটি বেদের উল্লেখ আছে। কিন্তু একটি ‘অনুপপত্তিও বর্তমান। ছান্দোগ্য উপনিষদের প্রথমদিকে দেখছি, দেবতারা মৃত্যুভয়ে বৈদিক ‘ত্রয়ী’ বিদ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন। অপর পক্ষে ওই একই উপনিষদের সপ্তম অধ্যায়ে একটি উপাখ্যান আছে এই ভাবে: নারদমুনিকে তাঁর গুরু সনৎকুমার বললেন, ‘তোমাকে আমি ব্রহ্মবিদ্যা দেব, কিন্তু তার পূর্বে বলো, তুমি কোন্ কোন্ বেদ অধ্যয়ন করেছ? নারদ প্রত্যুত্তরে স্পষ্টভাবে চারটি বেদেরই নামোল্লেখ করলেন—অথর্ববেদ সমেত। একই ভাবে বৃহদারণ্যকের প্রথম অধ্যায়ে ‘ত্রয়ী’ বেদের নাম রয়েছে, চতুর্থ বেদ বাদে। আবার ওই একই বেদের চতুর্থ অধ্যায়ে স্পষ্টভাবে চতুর্বেদের উল্লেখ আছে। সে যা হোক, তুমি কোন্ বিদ্যা আহরণ প্রত্যাশী, মামণি?

—ওই চতুর্থবেদ; অথর্ববেদ!

গুরু ক্ষণকাল নীরব রইলেন। তারপর বললেন, শোনো মা, বিদ্যা দুই স্তরের। প্রথমটার প্রয়োজন জীবিকার প্রয়োজনে। দ্বিতীয়টি ‘জীবন’-এর সন্ধানে। অথর্ববেদ এবং তার অনুক্রম আয়ুর্বেদ, ভেষজবিদ্যা বা চিকিৎসা-বিদ্যা। সেগুলি জীবিকা লাভে সাহায্য করবে; কিন্তু নিজের ‘জীবনে’র জন্য তুমি কিছু শিখবে না?

—সব নিয়মেরই তো ব্যতিক্রম থাকে, বাবা! আপনি তো সর্ববিদ্যা-বিশারদ; কিন্তু আপনার ‘জীবিকা-বিদ্যাই’ কি আপনাকে ‘জীবন’ দেয়নি? মন্দিরে মন্দিরে গিয়ে আপনি পূজা দেন না। ঠাকুরঘরেও আপনাকে যেতে দেখি না। আপনি কি আর্তের সেবার মাধ্যমেই ‘জীবনের অর্থ” খুঁজে পাননি?

রূপেন্দ্র প্রশান্ত হাসি হাসলেন। বোঝা গেল, এ প্রত্যুত্তরে তিনি প্রীত হয়েছেন। বলেন, বেশ! কাল থেকে ভাদুড়ীমশাই বেদত্রয়ী অধ্যয়ন করবে—সেই সঙ্গে উপনিষদ আর থেরবাদী শূন্যবাদ। আর তুমি তো স্ত্রীলোক! তুমি চতুর্থবেদ। এ ভালোই হল, জীবন দত্তও তাই চায়। আমিও খুশি হব তোমাকে সমাজসেবায় ব্রতী হতে দেখলে, বিবাহের পূর্বেই স্বনির্ভর করে তুলতে পারলে।

‘বিবাহ’ শব্দটা উচ্চারণ মাত্র দুজনের চোখাচোখি হল।

ওরা দুজনেই জানে; ভাদুড়ীবাড়ির সকল বধূমাতাই জীবনে সুখী—তাঁরা কেউ স্বনির্ভর নন। সে প্রয়োজন আদৌ হয় না!

শুধু ভাদুড়ীবাড়িতে নয়, গোটা গৌড়বঙ্গেই কোনও মহিলা স্বনির্ভর নন। বাল্যে পিতা, যৌবনে স্বামী এবং বার্ধক্যে পুত্রগণ তাঁদের ভরণপোষণ করে।

ব্রজসুন্দরী মহিলা বিদ্যালয়—এতদিনে তাকে ‘মহা-বিদ্যালয়’ই বলা সমীচীন, কারণ তাতে বর্তমানে দু-দুটি বিভাগ! প্রথম বিভাগে নানান সদ্ধর্মের সূত্র সম্বন্ধে আলোচনা হয়—বেদ, বেদান্ত, বেদাঙ্গ, উপনিষদ, থেরবাদী বৌদ্ধধর্ম। তার আচার্য একজন, ছাত্র ও একটি। সেটির পাঠ অপরাহ্ণ থেকে সায়াহ্ন।

দ্বিতীয় বিভাগের পাঠ শুধুমাত্র অথর্ববেদ। ওই সঙ্গে আয়ুর্বেদ এবং চিকিৎসা-বিজ্ঞান। তার পাঠ সারাদিনই চলে। তারও একজন আচার্য, একজনই ছাত্রী।

বেদত্রয়ীর সঙ্গে অথর্ববেদের প্রধান পার্থক্য উদ্দেশ্যগত। তিন বেদের মূল লক্ষ্য : প্রশস্তি জ্ঞাপন করে দেবতার প্রতি প্রার্থনা নিবেদন। অথচ অথর্ববেদের উদ্দেশ্য হল সংসারে মানুষের জীবনযাপনের উন্নতিবিধান। বেদত্রয়ীর সম্পর্ক শ্রৌতকর্মের, তার লক্ষ্য মানবধর্ম, অথর্ববেদের সম্পর্ক গৃহকর্মের, তার লক্ষ্য মানবজীবন।

অথর্ববেদের সূত্রগুলি বিংশতি কাণ্ডে বিভক্ত। প্রথম সাতটিতে আভ্যুদয়িক কর্মের মন্ত্রই সমধিক। তার মূল লক্ষ্য দীর্ঘ আয়ু লাভ। এগুলি গার্হস্থ্য ও সামাজিক বিষয়সংক্রান্ত, যা ইতিপূর্বের তিন বেদে আলোচিত হয়নি।

দ্বিতীয় ভাগের পাঁচটি কাণ্ডে আভ্যুদয়িক কর্ম ব্যতিরেকেও কিছু দার্শনিক চিন্তা আছে। কিন্তু সেগুলিও মানবসমাজের হিতার্থে। এই ধরনের সূত্রগুলিকে অপর তিন বৈদিক ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা যায় না।

তৃতীয় ভাগের আটটি কাণ্ডের বিষয়বস্তুও সুনির্দিষ্ট।

সুতরাং অথর্বসংহিতায় শ্রৌতকর্মের অপেক্ষা স্মাতকর্মেরই প্রাধান্য।

প্রায় তিনমাস লাগল অথর্বসংহিতা পাঠ শেষ হতে।

তারপর শুরু হল আয়ুর্বেদ-শাস্ত্র। বিভিন্ন রোগ ও তার নিরাময়ের ব্যবস্থা। বায়ু-পিত্ত-কফ-এর লক্ষণ-নির্ণয়। নাড়িজ্ঞান। এই পর্যায়ে আবশ্যিক হয়ে পড়ল মানব শরীরে বিস্তারিত আলোচনা। প্রকট পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে অপ্রকট অন্তরিন্দ্রিয়ের পার্থক্য। দেহের বিভিন্ন অংশের কার্যকারিতা—হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, পাকস্থলী, যকৃৎ, প্লীহা, শিরা ও ধমনি। আবশ্যিকভাবে উপনীত হল নর ও নারীদেহের পার্থক্যের প্রসঙ্গ। বিভিন্ন গ্রন্থী, পুরুষের অণ্ডকোষ, স্ত্রীলোকের অমৃতরস ভাণ্ডের গ্রন্থী, জরায়ু, প্রসবপথ। নৈর্ব্যক্তিক উদাসীনতায় আচার্য তাঁর শিষ্যাকে সবকথা বুঝিয়ে দিলেন। প্রসঙ্গত এল নারীর মাসিক চক্রাবর্তন-ছন্দের কথাও। দ্বাদশবর্ষীয়া বালিকার এ বিষয়ে কোনও জ্ঞান ছিল না। বয়স্কা রমণীর ঘনিষ্ঠ সাহচর্যই কি পেয়েছে এতদিন? মাকে হারিয়েছে জন্মমুহূর্তে, মামণিকে মাত্র পাঁচ-ছয় বছরে। সোনা-মা যখন এ বাড়ি আসেন তখন তাঁর সে চক্রাবর্ত ছন্দ সাময়িকভাবে অবরুদ্ধ। ও অবাক বিস্ময়ে জানতে চাইল: এটা কি সব স্ত্রীলোকেরই হয়, বাবা? প্রতি মাসে?

—হ্যাঁ মামণি। একটু বয়স হলেই। সাধারণত তেরো-চোদ্দো বছর বয়সে। তোমারও হবে। তখন আতঙ্কিত হয়ে পড়ো না। তোমার শোভাপিসি অথবা বড়বাড়ির তারা বৌঠানকে সে কথা জানিও লজ্জা কোরো না—ওঁরা শিখিয়ে দেবেন এ-ক্ষেত্রে কী করণীয়। কীভাবে এই বিড়ম্বনা লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখা যায়।

রূপমঞ্জরী নতনেত্রে শুধু শুনে গেল।

এরপরের ধাপটি: আবশ্যিক কিন্তু অধিকতর বিড়ম্বনার। প্রজননতত্ত্ব। সেটাও ওকে শেখাতে হবে। প্রসবের কথাও। আচার্য তাঁর ছাত্রীকে বুঝিয়ে বললেন, কীভাবে প্রতি মাসে অযুত-নিযুত অনিষিক্ত ডিম্ব রক্তস্রোতে অপব্যয়িত হয়। তারপর হঠাৎ একটি মাত্র ডিম্ব নিতান্ত ঘটনাচক্রে নিষিক্ত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে। সেই নিষিক্ত ডিম্বটি জননীর জরায়ুতে আশ্রয় গ্রহণ করে। সে ভ্রূণে পরিণত হয়। প্রায় আঠারো-উনিশ পক্ষকাল সেখানেই ক্রমবৃদ্ধি লাভ করে। তার নাক-মুখ-চোখ, অন্তরিন্দ্রিয় সব তিল-তিল করে রূপায়িত হয়ে ওঠে। সে কিন্তু শ্বাসগ্রহণ করে না। তার ফুসফুস তখনো কার্যকরী নয়। জননীর রক্তেই তার জীবনীশক্তি ভ্রূণ প্রাণিত হয়ে ওঠে মায়ের আশীর্বাদ শোণিতে।

রূপমঞ্জরী ওই অনিবার্য প্রশ্নটা আদৌ জিজ্ঞাসা করল না। লক্ষ লক্ষ অনিষিক্ত ডিম্বের মধ্যে হঠাৎ একটি মাত্র ডিম্ব কী ভাবে নিষিক্ত হয়ে ওঠে। কী সেই আশ্চর্য প্রক্রিয়া? যাতে আকৈশোরের অবক্ষয়ী রক্তপাত হঠাৎ রুদ্ধ হয়ে যায়?—নারী তার জীবন সার্থক করে। জননী হয়ে ওঠে। ‘গোত্রং নঃ বর্ধতাম্’ মন্ত্রে পূর্ণাহুতি দেয়।

রূপেন্দ্রনাথ বুঝে উঠতে পারেন না—কেন ওই অনিবার্য প্রশ্নটি তাঁর মেধাবী ছাত্রীটি পেশ করল না। সে কি জানে? শুনেছে? বুঝেছে? উনি জানেন না। তবে জিজ্ঞাসিত না হওয়ায় তাঁর একটা স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল। বিড়ম্বনার হাত থেকে মুক্তি- লাভ করেন। উনি শেখাতে থাকেন প্রসূতির কী কী সাবধানতা গ্রহণ আবশ্যিক। কোথায় তারা ভুল করে, কীভাবে তা শোধরানো যায়। সবশেষে প্রসব করানোর কথাও।

একদিনেই সব কিছু হল না। কয়েক সপ্তাহ লাগল। রূপেন্দ্রের অনুমান মামণি তার সমস্যাগুলির কথা—যা তার পিতা স্পষ্টাক্ষরে বলেননি—ইতিমধ্যে জেনে নিয়েছে তার শোভাপিসির কাছে। অথবা বড়বাড়ির পুঁটুরানির কাছে।

দিনসাতেক পরের কথা। আরোগ্য-নিকেতন থেকে অসময়ে হঠাৎ বাড়ি ফিরে আসতে হল। প্রায় মধ্যাহ্নকাল। একটি ঔষধ রাখা আছে ওঁর শয়নকক্ষে। দুর্লভ ঔষধ এবং তীব্র বিষ। তাই সেটি আরোগ্য নিকেতনে রাখেন না। শোভারানি তখন পাকঘরে ব্যস্ত। মামণির কোনও সাড়া পেলেন না। শয়নকক্ষে এসে নির্দিষ্ট সম্পুটক থেকে ঔষধটি সংগ্রহ করার সময় নজর হল—পালঙ্কের অপরপ্রান্তে, প্রায় আত্মগোপন করে, মামণি খুব মনোযোগ সহকারে কিছু পাঠ করছে। তার একাগ্রতা এত তীব্র যে, সে অনুভব করেনি, উনি ঘরে এসেছেন, সম্পুটক উন্মুক্ত করে তাঁর প্রয়োজনীয় ঔষধটি সংগ্রহ করেছেন। রূপমঞ্জরী যখন কিছু পাঠ করে তখন স্বভাবতই তন্ময় হয়ে যায়—কিন্তু এতটা বাহ্যজ্ঞানশূন্য তো হয় না!

রূপেন্দ্র প্রশ্ন করেন, কী পড়ছ ওটা? অত মন দিয়ে?

তড়িতাহতার মতো হটী উঠে দাঁড়ায়। তার হাতে একটি পুঁথি।—দূর থেকেই সেটিকে শনাক্ত করতে পেরেছেন।—তবু প্রশ্ন করেন; কী পুঁথি? কুমারসম্ভবম্?

রূপমঞ্জরী সে প্রশ্নের প্রত্যুত্তর না করে বলে, আপনি কখন এলেন?

রূপেন্দ্র লক্ষ্য করে দেখলেন—পালঙ্কের ওপ্রান্ত দিয়ে মামণি কর্কটগতিতে এগিয়ে গেল—হস্তধৃত পুঁথিটি নির্দিষ্টস্থানে রাখতে।

ক্ষুরধারবুদ্ধি রূপেন্দ্রনাথের বুঝতে কিছু বাকি থাকল না। পুনরায় প্রশ্ন করেন, কী ওই পুঁথিটি? কুমারসম্ভবম্?

শব্দ হল না। শিরশ্চালনে দিল স্বীকৃতি।

—অষ্টম সর্গ?

একটু বিলম্ব হল। মিথ্যাভাষণে অভ্যস্তা নয়। বলতে পারে না। তাছাড়া বাবামশায়ের কাছে মিথ্যাভাষণ তো অকল্পনীয়। পুনরায় নীরবে শিরশ্চালন স্বীকৃতি জানায়।

সহসা রূপেন্দ্রনাথের কী যেন হয়ে গেল! ওর বাহুমূল দৃঢ়হস্তে ধারণ করেন। রূপমঞ্জরী স্তম্ভিতা! বাবামশাই নিষেধ করেছিলেন—সে নিষেধ অগ্রাহ্য করে ও পুঁথিটি পাঠ করছিল। অপরাধবোধ ছিলই! না হলে এই নির্জন গৃহাভ্যন্তরে ও কেন অমন একটা গোপন স্থান নির্বাচন করবে? শোভাপিসি তো দেখলেও বুঝবে না—ও কী পড়ছে! কিন্তু বাবামশাই কখনও তাকে তিরস্কারই করেন না—আজ কি দৈহিক পীড়ন সহ্য করতে হবে? আদেশ লঙ্ঘন করায় ভয় যতটা পেয়েছে, লজ্জা পেয়েছে তার চেয়ে বেশি।

রূপেন্দ্র ওকে জোর করে বসিয়ে দিলেন পালঙ্কের উপর। নিজেও বসলেন তার পাশে। বললেন, তোর মনে আছে মামণি, বহুদিন পূর্বে তোর সোনা-মাকে আমি একটা গল্প বলছিলাম? শঙ্করাচার্য আর উভয়ভারতীর উপাখ্যান?

এই অবান্তর প্রশ্নের প্রাসঙ্গিকতা ও বুঝে উঠতে পারে না। অবাক চোখে বাবার মুখের দিকে তাকায়। রূপেন্দ্র বলেন, সেদিন আমি বলেছিলাম-অন্তরীক্ষের দুজন দেবদেবী প্রত্যেকটি মানুষের মনে সূক্ষ্মদেহে প্রবেশ করেন একটা বিশেষ বয়সে। মনে আছে সে-কথা? কী রে? মনে পড়ে না তোর?

রূপমঞ্জরী অবাক হল অন্য কারণে। বাবামশাই ওকে বরাবর ‘তুমি’ বলে কথা বলেন। হঠাৎ আজ সে ‘তুই’ হয়ে গেছে! ও নতনেত্রে বললে, হ্যাঁ বাবা। মনে আছে। অনঙ্গদেব আর রতি!

রূপেন্দ্র এবার ওর বাহুমূল ছেড়ে দিয়ে সস্নেহে মাথায় হাত রাখলেন। আত্মগতভাবে বললেন, ভ্রান্তি! আমারই ভ্রান্তি!

—কী ভুল বাবা?

—কালের ভ্রান্তি মা-মণি। আমি শারীরবিদ্যার সাধারণ সূত্রটা তোর উপরেও প্রয়োগ করেছিলাম! সেটাই আমার ভ্রান্তি। কিন্তু অনঙ্গদেব তো ভুল করতে পারেন না! যে মেয়ে দ্বাদশ বৎসরে দেবভাষা আয়ত্ত করে ‘কুমারসম্ভবমে’র অষ্টম সর্গের রসগ্রহণে সমর্থা তার ক্ষেত্রে তো সাধারণ সূত্রটি প্রযোজ্য নয়!

নিদারুণ লজ্জায় রূপমঞ্জরী অধোবদন হল। অতি বুদ্ধিমতী সে—বুঝে নিয়েছে বাবামশায়ের আপাত-অসংলগ্ন স্বগতোক্তির গূঢ়ার্থ!

কিছুক্ষণ উভয়েই নীরব। রূপেন্দ্র ওর মাথায়—এখন আর তাতে ‘কাকপুচ্ছ’ থাকে না! কঙ্কতিকাশাসনে ঘন কৃষ্ণ কেশরাজি কাঁধ ছাপিয়ে পিঠের উপর লুটাচ্ছে—হাত বুলাতে থাকেন। একটু পরে বলেন, তুই লজ্জা পাচ্ছিস কেন, মামণি? তুই তো আমার আদেশ লঙ্ঘন করিসনি। আমি তো বলেই ছিলাম; বড় হয়ে নিজে নিজে পড়ে নিতে। ভ্রান্তিটা আমারই। বুঝে উঠতে পারিনি: তুই ইতিমধ্যেই বড় হয়ে গেছিস! মাত্র দ্বাদশ বৎসর বয়সেই।

আবার মাথাটা নেমে যায়!

হঠাৎ একটা অবান্তর প্রশ্ন করে বসেন, একটা কথা বুঝিয়ে বল তো, মামণি। শুভপ্রসন্ন আজকাল তোর সঙ্গে ভালো করে কথা বলে না। কেন? তোদের কি কিছু…মানে মনোমালিন্য হয়েছে?

রূপমঞ্জরী দু-হাতে তার লজ্জারুণ মুখটা ঢাকে।

—দূর পাগলী! আমার কাছে আবার লজ্জা কী? আমি তো শুধু তোর বাবা নই, আমি যে তোর মা-ও!

হঠাৎ কী হল। রূপমঞ্জরী সবলে জড়িয়ে ধরল তার বাবাকে। হু হু করে কেঁদে ফেলে!

অনেকক্ষণ ওর মাথায় নীরবে হাত বুলিয়ে বলেন, আমাকে সব কথা খুলে বল মা! আমি তো জানিই সেই অন্তরীক্ষের দেবদেবী তোদের দুজনের অন্তরে এসে উপস্থিত হয়েছেন। অকালে নয়, সুসময়েই। তোরা দুজনই যে অ-সাধারণ! কিন্তু মনোমালিন্যটা কী কারণে? মতবিরোধের হেতুটা কী?

রূপমঞ্জরী সংকোচ করল না। অধোবদনে বলল, ও হঠাৎ আমাকে অন্য একটা নামে ডেকেছিল। আমি তাতে আপত্তি করেছিলাম। তাতেই ওর রাগ হয়ে গেল। আমার সঙ্গে কথা বলে না আজ নিয়ে চারদিন।

রূপেন্দ্র মনে-মনে হাসলেন। অহোরাত্রের হিসাবটি নিখুঁত—’দিন চার-পাঁচ’ নয়, চা-রদিন। বললেন, ‘অন্য একটা নাম’? কী নাম? ‘মার্জারমুখী’, বা ‘পেচকাননা’ নিশ্চয় নয়! তাহলে তুইও নিশ্চয় তাকে মধুর সম্ভাষণ করতিস : ‘রাসভানন্দ’ কিংবা ‘ছুছুন্দর গন্ধী! ‘

এবার হেসে ফেলে।

—লক্ষ্মীটি! বলে দে মা আমাকে! আমি ওকে শাসন করব। নতনয়নেই বলে, ও আমাকে বরাবর ‘হটী’ নামে ডাকে। সেদিন হঠাৎ নির্জনে আমাকে ডেকে উঠল, “মঞ্জু’।

—মঞ্জু! এ তো সুন্দর নাম। তাতে তুই এত রেগে গেলি কেন?

রূপমঞ্জরী জবাব দেয় না।

—কী হল রে? “মঞ্জু’ তো একটা মিষ্টি নাম। রূপমঞ্জরী>মঞ্জরী> মঞ্জু! অনঙ্গদেবাদেশে অপিনিহিতি কিনা ঠিক জানি না—কিন্তু এমন প্রয়োগ তো অশুদ্ধ নয়। অসুন্দরও নয়।

অধোবদনেই বলে, ওটা যে আমার মায়ের নাম। আপনি মা-কে ওই নামে ডাকতেন না?

—তাতে কী হল? আমি তাই ডাকতাম, তোর বাল্যবন্ধুও না হয় সেই নামেই ডাকল—সে কথা নয়! আমার মনে হল, কথাটা আপনার কানে গেলে আপনার মনে পড়ে যাবে তাঁর কথা—যাঁকে ভুলে থাকতে চান!

রূপেন্দ্রনাথ অশ্রুসজল চোখে হেসে ওঠেন। বলেন, এত বুদ্ধিমতী তুই, আর বোকার মতো ও-কথাটা বললি? তাকে আমি ভুলে থাকতে চাইব কেন রে? সে আমার নয়নসম্মুখে নাই, কিন্তু আন্তরগভীরে তো সর্বদাই আছে। রাত্রে সে স্বপ্নের মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতেও আসে।

—কে? মা? আপনি তো সেকথা কোনওদিন বলেননি? কই আমার স্বপ্নে তো তিনি আসেন না?

—আসেন। তুই তো তাকে দেখিসনি। তাই চিনতে পারিস না। আমার কাছে এসে তোর সম্বন্ধে কত কথা বলেন—

—আমার সম্বন্ধে! কী কথা বাবা?

—মঞ্জু বলে, “মামণিকে যত্ন করে মানুষ করো। আর তার জন্যে একটি টুক্‌টুকে বর পছন্দ করে নিয়ে এস। সে যেন দেবসেনাপতির মতো সুন্দর হয়, আর দেবগুরুর মতো পণ্ডিত।’

রূপমঞ্জরী লজ্জায় মেদিনীনিবদ্ধদৃষ্টি।

তোর মা আরও বলে, ‘ভিন গাঁয়ে ওকে যেতে দিও না বাপু? এই সোঞাই-গাঁয়েই অমন ছেলে তো রয়েছে।’তা আমি বলি, ‘কই, সোঞাই গাঁয়ে তেমন কোনো ছেলে তো আমার নজরে পড়ে না!’ তা শুনে তোর মা আমাকে ধমকে দেয়। ‘তা কেমন করে পড়বে? তুমি যে দিবারাত্র পুঁথির মধ্যে ডুবে আছ! তাই ছুছুন্দরের মতো অন্ধ। সে তো রোজই তোমার কাছে ‘অং-বং-চঙ’ শিখতে আসে।’ দ্বাদশবর্ষীয়া তরুণীটি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠে।

*

পরদিন প্রত্যুষেই উনি যাত্রা করলেন—আরোগ্য নিকেতনের পরিবর্তে জমিদার- বাড়ির দিকে। অশ্বপৃষ্ঠে নয়, পদব্রজে। কন্যাদায়গ্রস্ত ব্রাহ্মণটির সুপাত্র সন্ধানে শুভযাত্রা। সেকালে সামাজিক বিধানের নির্দেশ ছিল: ‘অষ্টম বর্ষে তু ভবেৎ গৌরী।’ একবগ্গার তা মনোনীত নয়। তাঁর মতে—না, সংখ্যাতত্ত্ব বিচারে নয়—আয়ুর্বেদশাস্ত্র- মতে অনূঢ়া কন্যার বিবাহকাল, একটি বিশেষ ছন্দানুসারে। প্রাকৃতিক বিধানে মাসিক চক্রাবর্তন ছন্দ দ্বাদশ পক্ষকাল পুনরাবর্তিত হওয়ার পর সে বিষয়ে অভিভাবক উদ্যোগী হতে পারেন। পাত্রপক্ষের অভিভাবককে গিয়ে অনুরোধ করবেন: আপনার উপযুক্ত পুত্রটিকে কি অনুমতি দেবেন, আমার কন্যাটিকে বি-পূর্বক বহ্-ধাতু ‘ঘ’ করতে?

উনি যখন গৃহদ্বার উন্মোচন করে যাত্রা করছেন তখন শোভারানি তাঁকে দূর থেকে দেখতে পায়। সে এ বাড়িতে নিত্যকর্ম সারতে আসছিল। বাসিমুখে রুপোদা কোথায় যাচ্ছে জানবার দুরত্ত কৌতূহল হয়েছিল। কিন্তু সংস্কারবশে ‘পিছু’ ডাকেনি। রূপমঞ্জরীকে জিজ্ঞাসা করে। হ্যাঁরে মামণি, রুপোদা অমন হন্হন্ করে এই সাতসকালে কোথায় গেলেন? মা-কালী না-করুন, কারও কোনও অসুখবিসুখের খবর পেয়ে অমনভাবে ছুটে গেলেন না তো?

রূপমঞ্জরী হাসি লুকিয়ে শুধু বলল, হুঁ! অসুখই তো করেছে!

—কোন বাড়িতে? কার অসুখ?

—এ বাড়িতেই! আমার।

—তোর? কেন, কী হয়েছে তোর?

ও মা, তা আমি কেমন করে জানব? যার অসুখ করে সে কি জানে তার কী অসুখ করেছে?

শোভারানি ওকে বুকে টেনে নিয়ে বলে, বালাই ষাট! কী কষ্ট হচ্ছে তোর? কোথায়? বুকে?

—হুঁ!

—শুয়ে পড় তাহলে। আমি তোর বুকে মালিশ করে দিই।

খিল্‌ খিল্‌-করে এবার হেসে ওঠে চপলা দ্বাদশবর্ষিয়া কিশোরী বলে, ধুস! আমার কিছু হয়নি। রসিকতা করছিলাম পিসি!

—ছিঃ! এমন বদ রসিকতা কি করতে হয়? অসুখ-বিসুখ নিয়ে?

ভাদুড়ীবাড়ির দোরের কাছেই দেখা হয়ে গেল শুভপ্রসন্নের সঙ্গে। সে কিছু অবাক হল। পদধুলি গ্রহণ করে বলে, বাবামশায়ের সঙ্গে দেখা করবেন তো? এত সকালে?

—হ্যাঁ, তারাদা উঠেছে? কোথায় আছে সে?

—আহ্নিক করছেন। আপনি বসুন, আমি মাকে খবর দিই।

—হ্যাঁ, চল। বৈঠকখানায় গিয়ে বসি। মাকে সংবাদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তোমার সঙ্গে বরং দু-চার কথা বলি।

বৈঠকখানায় একটি চৌকিতে শীতলপাটি বিছানো। ব্রাহ্মণেরা সচরাচর সেখানে উপবেশন করেন। অপর একটি চৌকিতে ফরাসপাতা। সেটা অব্রাহ্মণ অতিথিদের। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কিছু কেদারাও আছে—যবন দর্শনপ্রার্থীদের জন্য সেগুলি চিহ্নিত।

কাল থেকেই তাঁর পিতৃহৃদয়ে এক অনাস্বাদিতপূর্ব প্রফুল্লতার জোয়ার এসেছে: মামণি—বড় হয়ে উঠেছে! কী আনন্দ! তাই প্রথম খেলাতেই রঙের টেক্কাটি নামিয়ে দিয়ে খেলা শুরু করলেন রূপেন্দ্রনাথ। বললেন, আজ নিয়ে পাঁচদিন ধরে তুমি মঞ্জুর সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ করে রেখেছ। কিন্তু কেন ভাদুড়ী-মহাশয়?

শুভপ্রসন্ন স্তম্ভিত। তার দুরন্ত বিস্ময় প্রকাশিত হল একটিমাত্র শব্দের প্রতিপ্রশ্নে: মঞ্জু?

—হ্যাঁ গো। ওই যে আমার বাড়িতে একটা মুখফোড় মেয়ে আছে,—‘হটী’, না কী যেন নাম!

শুভপ্রসন্ন নির্বাক! এ কী ভাষা আচার্যদেবের?

রূপেন্দ্র ওর হাতদুটি টেনে নিয়ে বলেন, বোকা মেয়েটার উপর অহেতুক রাগ পুষে রাখিস না। শোন, ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি :

উনি বুঝিয়ে বলেন যে, রূপমঞ্জরীর মায়ের নাম ছিল ‘কুসুমমঞ্জরী। তাঁকে উনি ‘মঞ্জু’ নামে ডাকতেন। সে নামটা ওঁর কর্ণগত হলে পরলোকগতা স্ত্রীর স্মৃতি ওঁর মনে জাগরূক হবে একথা আশঙ্কা করেই হটী এ সম্বন্ধে আপত্তি করেছিল। আর কিছু নয়।

শুভপ্রসন্ন পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়েই রইল। তার বাক্যস্ফুরণটি হল না। একটি দাসী বোধহয় ওঁকে বৈঠকখানায় বসে থাকতে দেখে গেছে। ভিতর বাড়িতে সংবাদ দিয়েছে। একটু পরেই তারাপ্রসন্ন এসে উপস্থিত। রূপেন্দ্রনাথ তাঁর হবু-জামাতার হাত দুটি ছেড়ে দিলেন। সে তৎক্ষণাৎ পালিয়ে বাঁচে।

—কী ব্যাপার রূপেনভাই? এত সকালে? এ বাড়িতে কেউ অসুস্থ হয়েছে বলে তো জানি না।

—না, তারাদা, সেজন্য আসিনি। আমি আজ এসেছি অন্য একটা উদ্দেশ্য নিয়ে।

—শুনব সে-কথা। তার আগে বলো, আহ্নিক-টাহ্নিক সেরে এসেছ তো? কিছু প্রসাদ আনতে বলি?

—শুধু প্রসাদ কেন? ভরপেট মিষ্টান্নই আহার করে যাব। আগে তুমি রাজি হও। প্রথমে আমার আর্জিটা পেশ করি।

—আর্জি?

—হ্যাঁ, গো। আমি একটি ‘ভিক্ষা’ চাইতে আজ তোমার দ্বারে উপস্থিত।

একটু যেন চমকে ওঠেন। বলেন, ভিক্ষা! তারাপ্রসন্ন ভাদুড়ীর ভদ্রাসনে এই প্রত্যুষে রূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোঘটি ‘ভিক্ষা’ চাইতে এসেছেন! আমি স্বপ্ন দেখছি না তো?

–না! রাজা বলির দ্বারেও তো একদিন এক ‘উদ্বাহুরিব’ বামন ভিক্ষা চাইতে এসেছিলেন!

—সেটা কথা নয়! আমার বাবামশাইকে একদিন তুমিই না বলেছিলে যে, তোমরা দু-পুরুষে কখনও কোনও ভিক্ষা গ্রহণ করনি?

—বলেছিলাম। আমার বাবামশাইয়ের কোনো কন্যাসন্তান ছিল না। তাঁকে অরক্ষণীয়া কন্যার জন্যে কোনওদিন পাত্রসন্ধান করতে যেতে হয়নি।

তারাপ্রসন্ন রীতিমতো চমকে ওঠেন। কথা খুঁজে পান না।

রূপেন্দ্রনাথ পুনরায় বলেন, আশা করি আন্দাজ করেছ আমি আজ তোমার দ্বারে কী ভিক্ষা চাইতে এসেছি!

না বোঝার হেতু নেই। ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। তবু উনি স্বীকার করতে পারলেন না। অস্বীকারও নয়।

রূপেন্দ্রনাথই পুনরায় বলেন, তুমি অবশ্য বলতে পার : এত তাড়াতাড়ি কীসের? তুমি জান, আমি বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে। জ্যাঠামশাইও তাই ছিলেন। শুভপ্রসন্নের বয়স এখন ষোলো। জ্যেঠামশাই তোমার বিবাহ দিয়েছিলেন সতেরো বৎসর বয়সে। পুঁটুকেও পাত্রস্থ করেছিলেন চোদ্দো বছর বয়সে। আমার মনে আছে। কিন্তু কী জান তারাদা? সকলের মানসিক পরিণতি তো একই আঙ্কিক নিয়ম মেনে চলে না। ওরা দুজন সহাধ্যায়ী, পরস্পরকে বাল্যকাল থেকেই চেনে। আমার চোখের সামনেই ওরা বড় হয়ে উঠছে। আমি ঘটনাচক্রে উপলব্ধি করেছি—

—থাম তুমি!

—হঠাৎ বলে ওঠেন তারাপ্রসন্ন

থামব? কেন? তুমি রাজি নও? আমি যে-কথাটা বলতে যাচ্ছিলাম, যা তুমি না শুনেই থামিয়ে দিলে—সেটা তো অন্যায় কিছু নয়! এটা তো একটা প্রাকৃতিক নিয়ম। তবে হ্যাঁ, তুমি বলতে পার : ওরা নিতান্ত বালক-বালিকা। মানছি! বেশ, মামণি আপাতত বাগদত্তাই হয়ে থাক।

—আহ্! তুমি থামবে?

স্তম্ভিত হয়ে গেলেন রূপেন্দ্রনাথ। তারাদা কি কোনো বড় ঘর থেকে পুত্রবধূ সংগ্রহ করতে ইচ্ছুক? প্রচুর যৌতুক, অঢেল বরপণ! কিন্তু তিনিও তো মামণিকে শাঁখা-সিঁদুর-সর্বস্ব করে সম্প্রদান করবেন না। কুসুমমঞ্জরীর যাবতীয় অলংকার—জ্যেঠামশাই যা দিয়েছিলেন, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের উপহার দেওয়া সেই হীরকখচিত শতনরী—সবই তো তারাদার ধনভাণ্ডারে সুরক্ষিত। একটু পরে বলেন, তোমার আপত্তির কারণটা কী বলত? আমি তো অন্যায় কিছু প্রস্তাব পেশ করিনি। আমি কন্যাদায়গ্রস্ত—শুভপ্রসন্নকে আমার অত্যন্ত সুপাত্র বলে মনে হয়েছে। তাছাড়া আমি অনুভব করেছি ওদের দুজনের মধ্যে

হঠাৎ উত্তেজনায় ফেটে পড়েন তারাপ্রসন্ন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, জানি! তুমি মস্ত বড় পণ্ডিত। অনেক কিছু অনুভব করতে পার, যা আমাদের নজরেই পড়ে না—

—এসব কী বলছ তারাদা?

একনিশ্বাসে তারাপ্রসন্ন বলে চলেন, আমি কি জানি না—শুধু পঞ্চগ্রামের ভিতরেই নয়, সারা গৌড়মণ্ডলে অমন একটি রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতীর সন্ধান আমি পাব না? আমি অথবা তোমার বউঠান কি মামণিকে প্রাণের চেয়ে ভালোবাসি না? ও তো আমাদের চোখের সামনেই বড় হয়ে উঠছে। তোমার বউঠান কি ধন্য হয়ে যেতেন না, মামণিকে পুত্রবধূরূপে বরণ করে তুলতে? কিন্তু এ যে হবার নয় রূপেন! এ যে হবে না! অসম্ভব!

বজ্রাহত রূপেন্দ্রনাথ বলেন, কেন তারাদা? বাধা কোথায়?

—তুমি হচ্ছ অদ্বৈত বৈদান্তিক। পাথরের নুড়ি আর শালগ্রাম শিলায় কোনো পার্থক্য দেখতে পাও না। এককালে তুমি মহাপ্রসাদ খেতে রাজি হওনি। নন্দখুড়োর বাড়িতে। মনে আছে? ঠাকুর-দেবতাও নাকি তুমি মান না। এ তোমার সেই পাপের ফল। সারাটা জীবন নিজে ভুগেছ, এখন ভোগাতে থাকবে মামণিকে

অনেকক্ষণ জবাব দিতে পারলেন না। তারপর বললেন, আমার পাপের জন্য আমার মেয়েকে দায়ী করছ কেন তারাদা? সে তো বলির পাঁঠার মাংস প্রত্যাখ্যান করেনি। সে তো বছর বছর তোমাদের পূজা বাড়িতে এসে হাতে-হাতে কাজ করে যায়। সে তো আর অদ্বৈত বৈদান্তিক নয়।

তারাপ্রসন্ন এবার ওঁর হাত দুটি ধরে কেঁদে ফেলেন, আমাকে মার্জনা করো ভাই। তোমার এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে আমার কি বুক ফেটে যাচ্ছে না? মাসতিনেক আগেই আমিই গুরুদেবকে জানিয়ে ছিলেম—একটা বড় রকম যজ্ঞ-টজ্ঞ করলে কি এ বাধা অতিক্রম করা যায় না? তিনি সরাসরি জানিয়ে দিলেন : যজ্ঞের মাধ্যমে অশাস্ত্রীয় অনাচারের অনুমোদন লাভ করা যায় না।

—অশাস্ত্রীয়! কী অশাস্ত্রীয় অনাচার?

—তোমাকে তাও বুঝিয়ে বলতে হবে? তোমরা রাঢ়ী শ্রেণির, আমরা বারেন্দ্র!

—শাস্ত্র কোথায় বলেছেন রাঢ়ী শ্রেণির কন্যার সঙ্গে বারেন্দ্র শ্রেণির পাত্রের বিবাহ অসিদ্ধ? অনাচার?

—আমি জানি না রূপেন। সে তর্ক আমি তোমার সঙ্গে করতে পারব না।

—রাজা বল্লালসেন কনৌজ থেকে যে পঞ্চব্রাহ্মণ আনিয়ে ছিলেন….

—তোমার পাণ্ডিত্য বন্ধ করো রূপেন! আমার আর সহ্য হচ্ছে না। যা হয় না, তা হয় না। হবে না।

—কিন্তু একপুরুষ আগে তোমার বাবামশাই—মানে জ্যেঠামশাই, তো নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ‘সগোত্র’ বিবাহ দিয়েছিলেন? সেটাও তো তোমাদের মতে অশাস্ত্রীয়! তাই নয়?

—হ্যাঁ, দিয়েছিলেন। কিন্তু কেমন করে দিয়েছিলেন তা তুমি জানো? আমি জানি। কুসুমমঞ্জরীর পিতা ছিলেন শাণ্ডিল্য গোত্রের। তোমরাও তাই। সেজন্য তোমাদের বিবাহের পূর্বে বাবামশাই আমাদের কূলগুরুকে ডেকে এনে একটি যজ্ঞ করান। কুসুমমঞ্জরীর গোত্রান্তর হয়। আমাদের কুলগুরুদেব একটি শংসাপত্র লিখে দেন যে অনূঢ়া কুসুমমঞ্জরীর গোত্রান্তর ঘটেছে। তারপর সোঞাই গাঁয়ের সমাজপতিদের বাবামশাই ডেকে পাঠান। সেই শংসাপত্রটি দেখিয়ে জানিয়ে দেন যে, তিনি তাঁর আশ্রিতা কুসুমমঞ্জরীর সঙ্গে তোমার বিবাহ দিচ্ছেন। আমি সে মন্ত্রণাসভায় উপস্থিত ছিলাম। নন্দখুড়ো বলেছিলেন, এজাতীয় বিবাহ সিদ্ধ হলে তো ঘরে ঘরে এই অনাচার চলতে থাকবে। এ বিষয়ে গৌড়বঙ্গের সমাজপতি নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সম্মতি আনালে ভালো হয়। তাতে বাবামশাই প্রচণ্ড আপত্তি করে বলেছিলেন, সোঞাই গ্রাম মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের এলাকার বাহিরে। নন্দখুড়োকে আরও সাবধান করে বলেছিলেন, এটা আমার সিদ্ধান্ত। এর বিরোধিতা যাঁরা করবেন, তাঁরা যেন, স্মরণে রাখেন যে, তাঁরা ভূম্যধিকারীর শত্রুপক্ষ! তারপরে আর কেউ উচ্চবাচ্য করেনি।

—এবারও তেমন কিছু করা যায় না?

—কী আশ্চর্য! সেটা ছিল ‘গোত্রান্তর’, আর এটা যে রাঢ়ী-বারিন্দির! তবু আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি রূপেনভাই। গুরুদেব কিছুতেই রাজি হলেন না। গুরুদেবের নিদান লঙ্ঘন করি কী করে বলো? গুরুশাপ—ব্রহ্মশাপ।

ঠিক তখনি একটি দাসী এসে উপস্থিত হল। একটা কাঁসার রেকাবিতে কিছু ফলমূল মিষ্টান্ন নিয়ে। দেবতার প্রসাদ। সে চলে যাবার পর রূপেন্দ্র উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, এই তোমার শেষ কথা?

—আমার নয় ভাই। গুরুদেবের শেষ নিদান!

—আমি তবে চলি?

—সেকি! প্রসাদটুকু মুখে দিয়ে যাও! রাগ করে প্রসাদ প্রত্যাখ্যান করতে নেই।

—কেন? তুমি তো জানো তারাদা—আমি আচার্য শঙ্করপন্থী—অদ্বৈত বৈদান্তিক! আমার দৃষ্টিতে পাথরের নুড়ি আর শালগ্রাম শিলায় কোনো প্রভেদ নেই। সবই ব্ৰহ্মময়।

দ্বারের দিকে অগ্রসর হয়েও আবার ফিরে আসেন। বলেন, একটা কথা, তারাদা। শুভপ্রসন্নকে তুমি জানিয়ে দিও সে যেন আমার কাছে শাস্ত্রপাঠ নিতে আর না আসে।

তারাপ্রসন্ন বলে ওঠেন, আমার উপর রাগ করে তুমি কি শুভকে শাস্তি দিতে চাইছ?

—না, তারাদা! সেটা অন্য কারণে। তোমাদের ওই সংস্কারের কৈঙ্কর্যে তোমরা আমাকে হত্যা করতে পারবে না, আমার মামণিকেও নয়। আমরা নতুন কোনো পথ খুঁজে নেবই। কিন্তু শুভপ্রসন্নের নিত্য উপস্থিতিতে মামণির বিচলিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা। তোমাকে আগেই বলেছি ওদের পরস্পরের মধ্যে একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠার উপক্রম হয়েছে। তাই এই নিষেধ করছি। শুভকে মামণির দৃষ্টিসীমার বাইরে রাখতে।

উনি একপদ অগ্রসর হতেই পিছন থেকে তারাপ্রসন্ন বলে ওঠেন, কিন্তু এসব কথা তো তাকে বলা যাবে না। তাকে আমি কী কৈফিয়ত দেব? কেন তুমি তাকে পরিত্যাগ করছ?

আবার ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন, সে কথাটাও কি আমাকে বলে দিতে হবে? তোমরা তো শুভবুদ্ধির ধার ধারনা। যুক্তিতর্ক মানো না। তোমার অভ্যস্ত ভাষাতেই ওকে বল, এটাই তোমার পিতার আদেশ! অলঙ্ঘনীয় নিদান। আর মনে রেখো বাবা শুভ, পিতৃশাপ—ব্রহ্মশাপ!

ঘর ছেড়ে বারান্দায় বেরিয়ে এসেই দেখেন শুভপ্রসন্ন চৌকাঠের পাশে প্রস্তরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো সে সব কিছুই শুনেছে। একটু বিব্রত হয়ে পড়েন যেন। শুভপ্রসন্ন কোনও কথা বলল না। আচার্যকে প্রণাম করল নিঃশব্দে। হঠাৎ ওঁর নজর হল শুভপ্রসন্নের চোখ দুটিতে জল টলটল করছে। উনি সবলে তাকে আলিঙ্গন করে ধরলেন। মাথায় হাত রেখে বললেন, আত্মদীপো ভব! আত্মশরণো ভব!! অনন্যশরণোভব!!!

শুভপ্রসন্ন আবার নত হয়ে প্রণাম করল তার গুরুদেবকে।

মাঘের শেষ। শীত কিছুদিন ধরেই যাই-যাই করছে। এখনও বিদায় নিতে পারেনি। রূপেন্দ্রনাথ যখন বাড়ি ফিরে এলেন তখন রৌদ্রতাপ উপভোগ্যা শোভারানি জানতে চায়, সাতসকালে বাসিমুখে কোথায় গেছিলেন?

—বড়বাড়ি।

গ্রামে জমিদার-বাড়িকে অনেকেই ওই নামে উল্লেখ করে।

—ও বাড়ির সবাই ভালো আছেন তো?

—তা আছেন। আমি অন্য একটা কাজে গিয়েছিলাম।

শোভা ওঁর প্রাতরাশের কাটা ফল আনতে যায়। রূপমঞ্জরী তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে বাবাকে লক্ষ্য করতে থাকে। আশ্চর্য মানুষ! মুখ দেখে বোঝা যায় না ভিতরে কী হচ্ছে। দুঃখে অনুদ্বিগ্নমন, সুখে বিগতস্পৃহ! অথচ হটী জানে, কী জন্য উনি এত সকালে ও বাড়ি গিয়েছিলেন। একটা খুশি-খুশি ভাব প্রত্যাশা করেছিল। সেটাই হবার কথা। অথচ মুখ দেখে কিছু বোঝা গেল না।

দ্বিপ্রহরে ওঁদের দুজনকে মধ্যাহ্ন আহার পরিবেশন করে শোভা একটু গা-গড়াতে গেল—সোনা-মার ঘরে। রূপমঞ্জরীর প্রচণ্ড কৌতূহল হচ্ছিল সব কথা জানতে। কী কী কথা হল জ্যেঠামশায়ের সঙ্গে, অথবা জ্যেঠিমা। শুভদার সঙ্গে কি ওঁর দেখা হয়েছে? তাকে কি কিছু বলেছেন? শুভদা কি উৎফুল্ল হয়ে উঠল? নাকি মুখটা নিচু করে মনোভাব লুক্কায়িত করল? সংকোচে সে প্রশ্ন করতে পারল না। রূপেন্দ্রনাথ নিজেই সে সুযোগ করে দিলেন। বললেন, এ ঘরে আয় মা। তোর সঙ্গে কিছু কথা আছে।

বসলেন দুজনে। পালঙ্কে নয়। মাদুর বিছিয়ে। রূপেন্দ্র ধীরে ধীরে সব কথাই খুলে বললেন। কোনও কিছু রেখে-ঢেকে নয়। বজ্রাহতা হয়ে গেল রূপমঞ্জরী। এটা সে একেবারেই আশঙ্কা করেনি। এমনটা যে হতে পারে তা ছিল তার দুঃস্বপ্নেরও অগোচর।

কাহিনি শেষ হল। রূপমঞ্জরী মাদুরের কাঠির উপর হাত বুলাতে বুলাতে বললে, তাহলে কাল থেকে শুভদা আর আপনার কাছে পাঠ নিতে আসবে না? সে কি অন্য কোনও চতুষ্পাঠীতে চলে যাবে?

—সেসব কথা কিছু হয়নি। সেটা শুভপ্রসন্নর ইচ্ছা। এবং তারাদার অনুমতিসাপেক্ষ। ও ত্রিবেণীতে যেতে পারে। ভাটপাড়া, নবদ্বীপ বা কৃষ্ণনগরেও। তবে ও তো আর চতুষ্পাঠী খুলে বসবে না। জমিদারি দেখাশোনা করতে হবে ওকে। ফলে তারাদা এবার হয় তো ওকে জমিদারি সেরেস্তার কাজ শেখাতে চাইবেন।

হটী অনেকক্ষণ মাদুরের নকশার উপর আঙুল বোলালো। তারপর প্রশ্ন করে, আমি কি আর শুভদার সঙ্গে কথা বলব না?

—না, না, তা কেন? আর পাঁচটা ছেলের সঙ্গে যেমন কথা বলিস, গল্পগুজব করিস, ওর সঙ্গেও তেমনি করবি।

—তাহলে আপনি ওকে এ বাড়িতে আসতে বারণ করে দিলেন কেন?

—আমি তো তাকে এ বাড়ি আসতে বারণ করিনি। শুধু বলেছি, তাকে প্রত্যহ পাঠ দিতে পারব না। তুই প্রশ্ন করবি : সেটাই বা কেন? তার কারণ আমি তোদের ঘনিষ্ঠতা আর পছন্দ করছি না। তোদের বন্ধুত্ব যখন কোনো মধুর পরিণতির দিকে যাবেই না, তখন দুজনকেই সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন—অতীতকে ক্রমশ ভুলে যেতে।

একটু নীরব থেকে আবার বলেন, জানি, তুই কী ভাবছিস। অথচ বলতে পারছিস না-কিন্তু মনে মনে ভাবছিস : তাই কি হয়? না, হয় না রে মা। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই জানি তা প্রায় অসম্ভব। আচ্ছা মামণি, তুই কি পীতু-খুড়োর মেয়ে মীনুপিসির কথা শুনেছিস?

—মীনুপিসি না মীনুদিদা? আপনি তাঁকে ‘খুড়িমা’ ডাকতেন না? গাঙ্গুলী বাড়ির বড়কর্তার গৃহিণী তো?

—হ্যাঁ, তার কথাই বলছি। সে এককালে ছিল আমার পাড়াতুতো ছোট বোন। বাল্যসঙ্গিনীই বলতে পারিস। শেষে হয়ে গেল আমার পূজ্যপাদ খুড়িমা।

—শুনেছি তাঁর কথা। সোনা-মার কাছে। তিনি নাকি শেষে আত্মহত্যা করেছিলেন। কেন করেছিলেন তা অবশ্য জানি না।

সেই হতভাগিনীর কথাই আজ তোকে শোনাব।

কোনো সংকোচ করলেন না। জানালেন অনেক কথা। মীনু ছিল ওঁর ছোটবোন কাত্যায়নীর সখী। তাঁর সঙ্গে ওর গড়ে উঠেছিল একটা মধুর সম্পর্ক—ঠিক যেমনটি গড়ে উঠতে চাইছিল মামণি আর শুভপ্রসন্নর মধ্যে। তারপর উনি গেলেন গুরুগৃহে। ফিরে এসে শুনলেন ইতিমধ্যে দুর্গা গাঙ্গুলী মীনুকে তৃতীয় পক্ষ করে ফেলেছেন। মীনুর করুণ জীবনকথা অকপটে বলে গেলেন। সে হতভাগিনীও পারেনি তার কিশোরকালের রুপোদাকে ভুলতে। তারপর নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করলেন তার মর্মান্তিক যন্ত্রণার কথা—তার আত্মহননের ইতিকথাও। প্রসঙ্গত বিনিয়োগ প্রথা’র বীভৎসতার কথাও অকপটে বলে গেলেন। তাঁর সেই অলোকসামান্যা দ্বাদশবর্ষীয়া শ্রোতার কাছে, যে মেয়েটা ওই বয়সেই দেবনাগরী হরফে ‘অষ্টম সর্গের’ রসাস্বাদনে সক্ষমা। শুধু অনুক্ত রইল সেই প্রত্যাখ্যাতা বিপ্রলব্ধার লজ্জার অনুকাহিনি। কোনার্কের সেই দোলপূর্ণিমার রাত্রে তার নারীত্বের সেই অবমাননা। মীনু পরলোকগতা—তবু তার সেই গোপন বেদনার কথাটা সংগুপ্তই থাক না! দুর্গা গাঙ্গুলী যে অলীক মিথ্যাকাহিনির রটনা করছিলেন, মীনু আর রূপেন্দ্রকে জড়িয়ে—সেই সংযুক্তাহরণ কাহিনি—তাই জানালেন এবং কীভাবে বৃদ্ধ মৃতপথযাত্রী সর্বসমক্ষে পাপ স্বীকার করেছিলেন, মীনুকে তার প্রাপ্য মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সে-কথাও।

ডাগর দুটি চোখ মেলে তাঁর শ্রোতা নির্বাক শুনে গেল।

তারপর সে অসংকোচ প্রশ্ন করে, আপনি কি তাঁর কথা সারাজীবনে ভুলতে পারেননি, বাবা?

—তা যে ভোলা যায় না মা। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি সংসার করেছি। মীনুর চিকিৎসা করেছি, হাসি-রসিকতাও করেছি। তোকেও ওই রকম শক্ত হতে হবে। নিরাসক্ত হতে হবে। পারবি না?

—পারব বাবা।

—পারতেই হবে। এই তো সামনেই দোলপূর্ণিমা। প্রতি বছর যেমন বড়বাড়িতে আবির খেলতে যাস এবারও তেমনি যাবি। আবির মাখবি, আবির মাখাবি। তারপর দেখবি স্নানের পর সে দাগ আর মুখে থাকবে না। হয়তো বুকে কিছুটা লেগে থাকবে। তা থাক না—তা তো আর কেউ দেখতে পাবে না। কিছুদিন পরে হয় তো বড়বাড়িতে নতুন বউ আসবে। কোনও বনেদি জমিদার বাড়ি থেকে। সে হবে প্রায় তোর সমবয়সি। তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবি-

—করবই তো। শুভদার বউ তো আমার বউঠান। তার সঙ্গে হয়তো ‘গঙ্গাজল’ পাতাব। কিন্তু একটা কথা বাবা—শুভদা করে করুক, আমি কিন্তু করব না।

—’কী’ তা জানতে চাইলেন না। প্রশ্ন করলেন, কেন?

—আমি সোঞাই গাঁকে ছেড়ে যেতে পারব না। সোঞাই গায়ের সেবা করব বলেই না আয়ুর্বেদ শিখছি!

—না রে মা, সোঞাই গাঁ একটা অজুহাত। আসলে আমাকে ছেড়ে যেতেই তোর মন সরছে না। তুই তো এ বিদ্যা শিখেছিস্ মানবজাতির স্বার্থে! সে আর্ত মানুষটা শিশু কি বৃদ্ধ, ধনী কি দরিদ্র, সোঞাইবাসী না তিজলহাটির মানুষ—

—তিজলহাটি! এত এত গ্রাম থাকতে হঠাৎ আপনি তিজলহাটির নাম করলেন কেন?

—এ কথার জবাব কাল বিকালে দেব। আমি কাল সকালে তিজলহাটি যাচ্ছি!—সেখানে কেউ কি অসুস্থ হয়ে পড়েছে? আপনার ডাক এসেছে?—বললাম যে, সে কথা কাল সন্ধ্যায় আলোচনা করব। তবে তোর অমতে কিছু হবে না। আগে পরিস্থিতিটা দেখে আসি!

হঠাৎ ভিষগাচার্যের আবির্ভাবে কিছু বিস্মিত হলেন পাঁচকড়ি ঘোষালমশাই। তবে অভ্যর্থনার কোনও ত্রুটি হল না। বললেন, কার ভদ্রাসনে রুগি দেখতে এসেছিলেন?

—আজ্ঞে না। রোগী দেখতে তিজলহাটিতে আসিনি। এসেছি।নজের গরজে! চলুন, আপনার বৈঠকখানায় গিয়ে বসি।

দুজনে বসলেন ওঁর অভ্যর্থনাকক্ষে। রূপেন্দ্রনাথ তাঁর বক্তব্য শুরু করার পূর্বেই ঘোষালমশাই বলেন, আমাকে প্রথমে কিছু বলতে দিন। তারপর আপনার বক্তব্যটা শুনব।

—বলুন?

—আমি আপনার কাছে অপরাধী হয়ে আছি। প্ৰতিশ্ৰুতিটা এই কয় বছরের ভিতর রক্ষা করতে পারিনি। আমাদের পঞ্চায়েত আমার প্রস্তাবে স্বীকৃত হননি। সমাজপতিদের ধারণায় সোঞাই গ্রামের একবগ্গা-দীঘির সঙ্গে সে অঞ্চলের আন্ত্রিকরোগের অবলুপ্তি একটা কাকতালীয় ঘটনামাত্র। মায়ের ইচ্ছাতেই সব কিছু হয়। মিত্রমশাইও তাই শুনে ইতস্তত করতে শুরু করলেন। আমার একার পক্ষে অতবড় কাজটা করা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। বিশেষ, পর পর দু-বছর ফসল ভালো হয়নি, অথচ ‘আবওয়াব’-এর চাপ বৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু তাই বলে ভাববেন না আমি কথার খেলাপ করব। আমি ইতিমধ্যেই ভলিমশাইকে বাড়িতে ডেকে পাঠিয়ে একটা ইচ্ছাপত্র লিখে রেখেছি—অকস্মাৎ আমার দেহান্ত হলে আমার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি থেকে প্রথমেই তিজলহাটির জন্য সেই ‘নিপাতনে-সিদ্ধ’ দীঘিটা খনন করা হবে। বাকি অংশ আমার ওয়ারিশদের মধ্যে বণ্টন করা হবে।

—আপনার অকস্মাৎ দেহান্ত হবার আশঙ্কা হল কেন?

—মানুষের জীবন তো পদ্মপত্রে জল! আমার পিতৃদেব এই বয়সেই সন্ন্যাসরোগে দেহরক্ষা করেছিলেন।

—বুঝলাম। প্রত্যাবর্তনের পূর্বে আপনাকেও একবার পরীক্ষা করে যাব। সাবধানতার যদি কোনও প্রয়োজন থাকে, তবে সে ব্যবস্থাও করে যাব। শরীরে কোন অসুবিধা বোধ করছেন ইদানীং?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। ক্ষুধামান্দ্য এবং অনিদ্রা। সে এমন কিছু নয়। এবার বলুন, কী কথা বলতে এসেছেন?

—বলছি। সৌম্যসুন্দর কোথায়? তর্কসিদ্ধান্ত মশাই-এর চতুষ্পাঠীতে? কৃষ্ণনগরে?

—আজ্ঞে না। ওর এক জ্ঞাতি ভগিনীর বিবাহ উপলক্ষে সে এখানেই আছে। আপনার বক্তব্যটা শেষ হোক। তারপর তাকে ডেকে পাঠাচ্ছি।

রূপেন্দ্র বলেন, আপনার আপত্তি যদি না থাকে তাহলে আমি তার সম্মুখেই প্রস্তাবটা রাখতে চাই।

ভ্রূকুঞ্চন হল ঘোষালমশায়ের। তবে তিনি সম্মত হলেন। সৌম্যসুন্দর এসে দাঁড়াল। দুজনকেই পদস্পর্শ করে প্রণাম করল। অনুরুদ্ধ হয়ে বসল চৌকির একান্তে। রূপেন্দ্রনাথ প্রশ্ন করেন, শেষ উপাধি লাভে আর কতদিন লাগবে, বাবা?

সৌম্য নতনেত্রে বলল, আজ্ঞে না, উপাধি লাভে আমার বাসনা নাই। জ্ঞানলাভই একমাত্র লক্ষ্য। বাবামশাই যতদিন অনুমতি দেবেন ততদিনই গুরুগৃহে অতিবাহিত করব।

—খুব আনন্দ পেলাম একথা শুনে। তুমি কিন্তু পুনরায় কিছু কৃশকায় হয়ে গিয়েছ,

বাবা। যোগাভ্যাস করো? প্রাণায়াম?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। দুইটিই করি।

রূপেন্দ্র এবার করজোড়ে ঘোষালমহাশয়ের দিকে ফিরে বলেন, আমি আজ কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা হিসেবে আপনার ভদ্রাসনে এসেছি, ঘোষালমশাই।

একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন পাঁচকড়ি। বাক্যস্ফূর্তি হল না তাঁর।

রূপেন্দ্র পুনরায় বলেন, আমার একটিই সন্তান। রূপমঞ্জরী। সে দ্বাদশবর্ষীয়া। আমি তার পিতা, হয়তো আমার কথাটা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে যাবে, কিন্তু তার রূপ, স্বভাব ও শিক্ষা—

সংবিৎ ফিরে পান ঘোষাল। বলেন, এ তো আমার আশাতীত সৌভাগ্য। আপনি স্বয়ং মদনদেবের মতো সুকান্ত, শুনেছি, আপনার গৃহিণীকে রূপনগরের প্রেমদাস মোহান্ত বাবাজি ‘রাইরানি’ করতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ তিনি ছিলেন তাঁর সময়ে পঞ্চগ্রামের শ্রেষ্ঠা সুন্দরী। আপনাদের দুজনের কন্যা যে রূপে লক্ষ্মী এবং গুণে সরস্বতী হবে সেটা মূর্খেও অনুমান করতে পারে। আমি সর্বান্তঃকরণে এ প্রস্তাবে সম্মত।

—কোন শর্ত নাই? বরপক্ষের তরফে?

—আদৌ না। ঘোষালবংশ ধন্য হয়ে যাবে এ বিবাহে।

—আমার কিন্তু তিনটি শর্ত আছে!

—বলুন?

—প্রথমত, আমি বরপণ দিতে অনিচ্ছুক। অর্থাৎ নগদে। তবে আমি সালংকারা কন্যা সম্প্রদান করব। রূপমঞ্জরী-অর্থাৎ আমার কন্যা, তার মায়ের প্রচুর স্বর্ণালংকার উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছে। দ্বিতীয়ত, বিবাহ আমি এই ফাল্গুন মাসেই দিতে চাই। বিলম্ব করায় কিছু বাধা আছে। তবে আমার কন্যা বালিকামাত্র, তার বয়স দ্বাদশ বৎসর। চার বছর পরে তার দ্বিরাগমন হবে। তখন সে তিজলহাটিতে এসে আপনাদের সেবা করবে। আয়ুর্বেদশাস্ত্রমতে সেটাই বিধেয়। তৃতীয় কথা, আমি মামণিকে আয়ুর্বেদ-শিক্ষিতা করছি। চার-পাঁচ বৎসরের ভিতরেই সে সুদক্ষা চিকিৎসক হয়ে উঠবে। আর্তের সেবা-শুশ্রূষা করতে সক্ষমা হবে। আমার সংকল্প যে-পরিবারে সে এই স্বাধীনতা লাভ করবে—অর্থাৎ নরনারী-নির্বিশেষে রোগাক্রান্তকে নিরাময় করার সুযোগ পাবে—শুধুমাত্র তেমন পরিবারেই তাকে সম্প্রদান করব। চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিসেবে তার অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হবে না এমন প্রতিশ্রুতি পেলেই—

রূপেন্দ্রনাথের বক্তব্যটা শেষ হল না। তার পূর্বেই ঘোষাল বলে ওঠেন, তবে তো মুশকিল হল, ভেষগাচার্য। আপনার শেষ দুটি শর্ত আমি নির্ব্যঢ় শর্তে স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত। আমার বিশ্বাস আমার পুত্রটিও যথেষ্ট আধুনিক-মন। সে তার স্ত্রীর স্বাধীনতায় স্থূল হস্তক্ষেপ করবে না। আমার অবর্তমানেও সে আর্তের সেবায় বাধা দেবে না। কিন্তু আপনার প্রথম শর্তটি যে আমি স্বীকার করতে পারছি না। আমরা কুলীন ব্রাহ্মণ। বরপণ গ্রহণ আমাদের কৌলিক প্রথা। বরপণ গ্রহণ না করে আমি তো আমার পুত্রের অমর্যাদা ঘটাতে পারি না।

রূপেন্দ্রনাথের ভ্রূযুগলে জাগল কুঞ্চন। নাসারন্ধ্র কিঞ্চিত স্ফীত হয়ে উঠল। এ প্রস্তাব তিনি আশঙ্কা করেননি। ঘোষাল রীতিমতো ধনী, অর্থের কাঙাল তাঁর হবার কথা নয়। একটু দ্বিধা করলেন। সৌম্যসুন্দরকে তিনি ভালোবেসে ফেলেছেন। ছেলেটি সুদর্শন এবং প্রখর বুদ্ধিমান! কিন্তু বরপণ! কৌলীন্য প্রথা! দাঁতে-দাঁত দিয়ে বলেন, কী পরিমাণ কৌলীন্যমর্যাদা আমাকে প্রদান করতে হবে বলুন। আমার সাধ্যের মধ্যে যদি কুলায় আমি সৌম্যসুন্দরের সঙ্গেই…

ঘোষাল গম্ভীর হয়ে বলেন, সৌম্যসুন্দরকে চিকিৎসা করে আপনি প্রথমদিন যে পরিমাণ ‘বৈদ্যবিদায়’ আমার কাছ থেকে গ্রহণ করেছিলেন ঠিক সেই পরিমাণই। স্মরণে আছে নিশ্চয় আপনার : একমুষ্টি আতপ তণ্ডুল এবং পাঁচটি কপর্দক। একটিমাত্র কপর্দক কম হলে কিন্তু আমি বর উঠিয়ে নিয়ে ফিরে আসব।

রূপেন্দ্র অট্টহাস্য করে ওঠেন।

ঘোষাল বলেন, হাসির কথা নয় আয়ুর্বেদাচার্য! ‘বৈদ্যবিদায়’ দান যেমন একটি কৌলিক প্রথা, কৌলীন্যমর্যাদা গ্রহণও তাই। ওটা দিতেও হয়। নিতেও হয়!

রূপেন্দ্রনাথ এবার সৌম্যসুন্দরের দিকে ফিরে বলেন, তোমার কোনও শর্ত আছে, বাবা?

সৌম্য নতনেত্রে বলল, আছে আচার্য! নদিয়ায় গুরুদেবের চতুষ্পাঠীতে অদ্বৈতবেদান্তের শিক্ষা শেষ করে আমি আপনার নিকটে অথর্ব বেদ অধ্যয়ন করতে যাব। তিজলহাটিতে কোন চতুষ্পাঠী প্রতিষ্ঠার বাসনা আমার নাই। বাবামশাইয়ের সম্পত্তির দেখাশোনা দাদাই করতে পারবেন, খুড়োমশাইও আছেন। বাবার অনুমতি লাভ করলে আমি এখানে একটি চিকিৎসাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে ইচ্ছুক। আপনাদের আশীর্বাদে যদি সস্ত্রীক সে পুণ্যকর্মের অধিকারী হই নিজেকে ধন্য মনে করব।

রূপেন্দ্র উচ্ছ্বসিত আবেগে উঠে দাঁড়ান। সৌম্যসুন্দরও তৎক্ষণাৎ দণ্ডায়মান হয়। রূপেন্দ্র ওকে বুকে টেনে নিলেন। আবেগে। আনন্দে।

সৈনগুপ্ত বুঝতে পেরেছে তার প্রভু আজ খুশিয়াল। তাঁর দ্রুত গৃহ-প্রত্যাগমনের বাসনা তীব্র। তাই চার-ক্রোশ পথ সে যে সময়ে অতিবাহন করে তার অর্ধেক সময়ে সে ফিরে এল সোঞাই। পূর্ণ আস্কন্দিত গতিচ্ছন্দে।

তিজলহাটি অভিযানের বিবরণ সবিস্তারে জানালেন মামণিকে। ঘোষালমশায়ের বরপণ বিষয়ে কৌতুক, সৌম্যসুন্দরের বিচিত্র শর্তের কথাও। ওই সঙ্গে জানালেন বহুদিন পূর্বে তিনি পাঁচকড়ি ঘোষালমশায়ের জ্যেষ্ঠপুত্র নকড়িকে কীভাবে সর্পদংশনের অনিবার্য মৃত্যু থেকে বাঁচিয়েছেন। নকড়ির সহধর্মিণীর সঙ্গে সেই কৌতুকের কাহিনিও। চোখে চোখে চাইলেই রূপেন্দ্রনাথ নাকি সকলের মনের কথা জানতে পারেন। একথা

শুনে বধূমাতার দিদিশাশুড়ি কেমন করে আঁতকে উঠেছিলেন : এ কী সব্বোনেশে কথা গো! মানুষের মনের ভিৎরি কী হতিছে তা উনি দিব্যদিষ্টিতে জান্তে পারেন!

রূপমঞ্জরী বাবার মুখে সেই প্রাকৃতভাষ শুনে খিলখিল করে হেসে ওঠে।

—তুই আর কিছু জানতে চাস?

—হ্যাঁ, ওঁদের কড়ির হিসাবের মাঝখানে অমন অদ্ভুত নাম রাখা হল কী করে?

—এ তোর কেমন সিদ্ধান্ত হল মামণি? এককড়ি-পাঁচকড়ি-সাতকড়ি তিনকড়ি-নকড়ি নামগুলোয় তোর আপত্তি নেই, শুধু ‘সৌম্যসুন্দর’ নামটাকেই মনে হল অদ্ভুত!

হটী হাসল। বলল, অদ্ভুত নয়, তবে একটু দলছাড়া লাগছে না কি?

—হয়তো কড়িতে ঘাটতি পড়েছিল। একাদশকড়ি, ত্রয়োদশকড়ি নাম তো প্রচলিত নয়। বৃহৎ সংসারে কড়ির টানাটানি তো হতেই পারে। যাক সে-কথা। আর কিছু জানতে চাস না?

—আবার কী?

—তা ঠিক। তুই ও প্রশ্নটা করলেও তো আমি বলতাম ঠিক জানি না’।

হটী বাবার চোখে-চোখে তাকাল। বললে, কী প্রশ্ন?

—তুই যেটা ভাবছিস। কে বেশি সুন্দর?

রূপমঞ্জরী ওঁকে একটা ঠেলা দিয়ে বলে। আপনি না-

—আমি কী?

—আমি মোটেই সে-কথা ভাবছি না।

—কে বেশি সুন্দর তা বলতে পারব না। তবে দুজনের একটা তুলনামূলক আলোচনা করতে পারতাম। কিন্তু তুই যখন ‘মোটেই সে-কথা ভাবছিস না—’! ঠিক আছে ঠিক আছে। শোন। সৌম্যসুন্দর দেহদৈর্ঘ্যে কিছুটা বেশি। গৌরবর্ণ দুজনেই। তবে সৌম্য কিছুটা কৃশকায়। সম্ভবত দৈর্ঘ্যের জন্যই অমন মনে হয়। বয়সে আরও এক বছর বড়। অঙ্কশাস্ত্রের প্রমাণ ব্যতীত সেটার আরও একটি প্রত্যক্ষ প্রমাণ নজর হল। খানাসার নিম্নে কিছু নবোদ্ভিন্ন ওষ্ঠলোম।

রূপমঞ্জরী তখন কর্ণময়, কিন্তু মেদিনীনিবদ্ধদৃষ্টি।

হঠাৎ বহির্দ্বার থেকে কে যেন ডেকে উঠল, রূ-পে-ন! রূপেন আছ?

—তারাদা না? তুই বসে থাক, আমি দেখে আসি।

দ্বার অর্গলমুক্ত করে দেখেন সড়কের উপর দাঁড়িয়ে আছেন তারাপ্রসন্ন। কিছু দূরে দুজন পাইক।

—কী ব্যাপার তারাদা?

—শুভ এসেছিল?

—শুভপ্রসন্ন? না তো! কেন?

—সাতসকালে সে কোথায় চলে গেছে। সারা দিন তার কোনো খবর নেই। দুপুরে খেতে আসেনি। কাউকে কিছু বলেও যায়নি। সারা গাঁ আমার লোকেরা তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। অথচ—

—না তো! সে আমার কাছে আসেনি।

—আমি জানতাম! তোমার বৌঠান তবু জোর করে আমাকে পাঠাল।

হঠাৎ হটী বলে ওঠে, মাঝি-মাল্লাদের কাছে খোঁজ নিয়েছেন? সে ওপারে যায়নি তো?

রূপমঞ্জরী কখন এসে দাঁড়িয়েছে তার বাবার পিছনে। তারাপ্রসন্ন বলেন, না! ওপারে যায়নি। কোন মাঝি-মাল্লাই তাকে পার করেনি। আমার বরকন্দাজেরা তন্নতন্ন করে খোঁজ নিয়েছে।

রূপমঞ্জরী আবার বলে ওঠে, একমুঠি বাবার ওখানে খোঁজ নিয়েছেন?

—একমুঠি বাবা! সেখানে কেন যাবে? …

—না। মানে শুভদা প্রায়ই একমুঠি বাবার আশ্রমে দেখা করতে যেত। কী জানি যদি সেদিন তাঁর একমুঠি না জুটে থাকে!

–সেখানে গেলে তো তার সারাটা দিন লাগবে না!

রূপেন্দ্র প্রশ্ন করেন, অশ্বাবাসে খোঁজ নিয়ে দেখেছ?

—হ্যাঁ! সেখান থেকে একটি ঘোড়া নিয়ে গেছে। অশ্বারোহণে! ঠিক আছে। তুমি ব্যস্ত হোয়ো না রূপেন। সংবাদ পেলেই আমি লোক মারফত জানিয়ে দেব।

বাপ-বেটিতে ফিরে এলেন আবার। মধুর একটা প্রাকবিবাহবাটীর পরিবেশ গড়ে উঠছিল। হঠাৎ যেন কালবৈশাখীর ঝড়ে সব তছনছ হয়ে গেল। এভাবে কোথায় চলে যেতে পারে ছেলেটা?

ঘণ্টাদুই পরে একটি পাইক এসে সংবাদ দিল, ছোটা হুজুর ওয়াপস্ আ গয়ে। চিন্তা মৎ কিজিয়ে।

রূপেন্দ্র প্রশ্ন করেন, কোথায় গিয়েছিল সে?

—মুঝে ন মালুম, বাবাঠাকুর।

রূপেন্দ্র বলেন, একবার খবর নিয়ে আসব?

—নিশ্চয়, এমনভাবে কাউকে কিছু না বলে সে কোথায় গিয়েছিল! কেন? আমিও আপনার সঙ্গে আসব, বাবা?

—না, মা! এখন সেটা ঠিক হবে না, তুই বরং দোরটা দিয়ে অপেক্ষা কর। আমি যাব আর আসব।

বড়বাড়িতে পৌঁছে যে খবর পেলেন তার কোন মাথামুণ্ডু নেই। শুভপ্রসন্ন নাকি গিয়েছিল রূপনগরে। প্রেমদাস বাবাজির আখড়ার ধ্বংসস্তূপ দেখতে! কোন মানে হয়? ধ্বংসস্তূপে দেখার কী আছে? পুঁটুরানি সেকথা জানতে চেয়েছিল। শুভ বলেছিল, সে তুমি বুঝবে না, পিসি!

রূপেন্দ্রনাথের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হল না, সমস্তদিন অশ্বারোহণে—হয়তো অভুক্ত অবস্থায়—কিশোরটি নিতান্ত পরিশ্রান্ত। সন্ধ্যারাত্রেই কিছু আহারাদি সেরে সে শয্যা নিয়েছে।

১০

আমাদের কাহিনির নায়িকার শুভবিবাহ স্থির হয়েছে, শুক্রবার, একুশে ফাল্গুন। ‘ফাল্গুনে মাসি মকররাশিছে ভাস্করে কৃষ্ণেপক্ষে দ্বাদশ্যাং তিথৌ।’ হটা সেকথা শুনে খেপে আগুন। আপনার কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই! আর কি কোন দিন ছিল না?

—কেন থাকবে না? তেইশে, সাতাশেও বিবাহের শুভদিন ছিল। তা একুশেই বা আপত্তি কিসের?

—তিথিটা যে দ্বাদশী! পর পর দুদিন আপনার উপবাস পড়ে যাচ্ছে না?

—ও দু-চারদিন উপবাসে আমার কিছু অসুবিধা হয় না।

—-জানি। আমাদের হয়।

রূপেন্দ্রের একমাত্র কন্যার বিবাহ। কিন্তু উনি আড়ম্বর করেননি কিছু। গ্রামের ভদ্রজনের নিমন্ত্রণ হয়েছে, কিন্তু কর্মসূত্রে যেসব বড় বড় পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল তাঁদের নিমন্ত্রণপত্র পাঠাননি। বস্তুত মধ্যবিত্ত পরিবারে সে আমলে তা সম্ভবপরও ছিল না। আগেই বলেছি, শেরশাহ্র ঘোড়ার ডাকের হ্রেষাধ্বনি তখন সাধারণ গৌড়বাসী শুনতে পেত না। তবে দাদার দেহান্তে কালিচরণ গঙ্গাজল সরবরাহের ব্যবস্থাটা চালু রেখেছেন। তাই মাঝিদের মারফত ত্রিবেণীতে একটি—না, দুটি—নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছিলেন। একটি গুরুদেবকে, অপরটি হটীর পাতানো দাদু মাহেশের ভবতারণ গঙ্গোপাধ্যায়কে। যদিও জানতেন, তাঁরা কেউই আসবেন না।

কিন্তু আশাতীতভাবে এসে উপস্থিত হলেন বাচস্পতিমশাই। সতেরোই ফাল্গুন, সকালে। তাঁকে দেখে অত্যন্ত উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন আমন্ত্রণকর্তা : আসুন, আসুন, বাচস্পতিদাদা! স্বাগত!

—আমি কিন্তু একা আসিনি বন্দ্যোঘটিভাই। আমরা একুনে সওয়া দুইজন অতিথি।

–সওয়া দুইজন? অস্যার্থ?

বাচস্পতিকে অন্বয়-ব্যাখ্যা দাখিল করতে হল। তাঁর পিছন থেকে সাদা থান-পরা একটি অবগুণ্ঠনবতী অগ্রসর হয়ে আসে। তার ক্রোড়ে একটি ঘুমন্ত শিশুকন্যা। কেউই কাউকে প্রণাম করে না। বৌঠান সম্পর্কে বড় হওয়া সত্ত্বেও যে অতবড় পণ্ডিতকে প্রণাম করতে দেন না, এটা সবাই জানে। মালতী অস্ফুটে বলে, আপনি কিন্তু কিছুটা রোগা হয়ে গেছেন ঠাকুরপো।

—আপনার মধ্যদেশও, আমার অনুমানে, বেশ কিছুটা কৃশ হয়ে গেছে।

ডাগর চোখ মেলে মালতী বিস্মিত হবার অভিনয় করে, ও মা, তাই বুঝি? আমি তো টের পাইনি!

রূপমঞ্জরী দূর থেকে দেখতে পায়। ছুটে এসে সবলে জড়িয়ে ধরে তার সোনা-মাকে। হঠাৎ তার নজর পড়ে বাবার কোলে একটি ঘুমন্ত শিশুকন্যা। ছিনিয়ে নেয় তাকে। চুমায় চুমায় ওর গালটা ভরিয়ে দেয়। নিদ্রাভঙ্গে শিশুটি কেঁদে ওঠে।

রূপেন্দ্র হটীকে ধমক দেন, অমন করে ঘুমন্ত শিশুকে চুমো খেতে হয়! দেখ্‌ তো, কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলি শ্যামার।

—শ্যামার?—অবাক হয়ে জানতে চায় হটী—ওর নাম শ্যামা?

রূপেন্দ্র বলেন, ‘শ্যামা’ ওর ডাকনাম। ভালো নাম ‘শ্যামামালতী’।

শুধু হটী নয়, বাচস্পতিও বিস্মিত। বলেন, ঠিক বলেছেন। কিন্তু আপনি এখানে বসে তা কেমন করে জানলেন?

রূপেন্দ্র মৃদু হাসলেন। হটী কিন্তু ছাড়ে না। বলে, বলুন না বাবা! কী করে জানলেন? আমি তো জানতামই না যে আমার ভাই এসেছে না বোন!

রূপেন্দ্র খুশিয়াল হয়ে উঠেছেন, সকন্যা মালতীর আগমনে। কন্যাকে বলেন, বাঃ! সেদিনই বললাম না? আমি ভৃগু আয়ত্ত করেছি! দেখলেই মানুষজনের মনের কথা জানতে পারি।

হটী সেদিনের সেই দিদিশাশুড়ির প্রাকৃত ভাষার অনুকরণ করে। হাসতে হাসতে বলে ওঠে, কী সব্বোনেশে কতা গো!

মালতী তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ঘটি করে পা-ধোওয়ার জল নিয়ে আয়। ও সব বিত্তান্ত পরে হবে।

মালতী রহস্যজালটা ভেদ করে দেয় না। এ নামকরণ করেছিলেন স্বয়ং রূপেন্দ্রনাথ, শ্যামামালতীর জন্মের পূর্বেই।

পথশ্রান্ত বাচস্পতি একটু জিরিয়ে নিয়ে বলেন, এবারও আমার ভূমিকা পত্রবাহকের। আপনার একটি পত্র আছে-

—গুরুদেবের?

—আজ্ঞে না। তবে তাঁর মাধ্যমেই পেয়েছি বটে। পত্রটি এসেছে মাহেশ থেকে। সম্ভবত শ্রীযুক্ত ভবতারণ গঙ্গোপাধ্যায় পাঠিয়েছেন।

মুখবন্ধ লেফাফাটি গ্রহণমাত্র তীক্ষ্ণধী রূপেন্দ্রনাথ বুঝতে পারেন বাচস্পতি-মশায়ের অনুমানটি ভ্রান্ত। লেফাফার উপর তাঁর নামটি বামাহস্তে রচিত।

নির্জনে এসে লেফাফাটিকে বন্ধনমুক্ত করলেন। ঠিকই আন্দাজ করেছেন। পত্রলেখিকা শ্রীমতী তুলসী গঙ্গোপাধ্যায়। গঙ্গোপাধ্যায়? তার মানে তুলসী আজও অরক্ষণীয়া?

শতকোটি প্রণামান্তে তুলসী তার ভগিনীপতিকে জানিয়েছে :

“কী আনন্দ যে হচ্ছে, জামাইবাবু, তা কী বলব? আমার মামণি আজ তার নারীজীবন সার্থক করতে চলেছে! সেই ছোট্ট মেয়েটি! আজ যদি দিদি থাকত…না, সে হতভাগিনীর দুঃখের কথা আজকের আনন্দের দিনে অন্তরালেই থাক। আমি আজও কুলীনঘরের অরক্ষণীয়া। তবে আমারও মুক্তি আসন্ন। শুনছি, আগামী বৈশাখে। যেতে হবে মা গঙ্গার ওপারে। ভাটপাড়ায়। কথা পাকা, তবে পোড়া কপাল তো?—না আঁচালে বিশ্বাস নেই। আপনি আপনার কন্যার বিবাহে বাবামশাইকে নিমন্ত্রণ করেছেন। তা বলে ভাববেন না যে, তিনিও তাঁর কন্যার বিবাহে আপনাকে নিমন্ত্রণ করবেন। দূর থেকেই আশীর্বাদ করুন। আর ভুলে যাবেন না যেন, আমি সুসময়ে আপনার দ্বারস্থ হব। মালিকানা পরিবর্তিত হলেই সে ব্যবস্থা করা যাবে। প্রণামাতে

তুলসী

ওই সঙ্গে মামণিকেও একটি পত্র আর একটি স্বর্ণাঙ্গুরীয় আশীর্বাদ পাঠিয়েছে।

১১

উনিশে ফাল্গুন বুধবার তারাসুন্দরী মামণিকে অব্যুঢ়ান্নের আমন্ত্রণ করেছেন। প্রথা বলে, বিবাহের পূর্বদিন অব্যুঢ়ান্নের আয়োজনের অধিকার কন্যার গর্ভধারিণীর। তাঁর অনুপস্থিতিতে তা করবে হটীর সোনা-মা। উনিশে বড়বাড়িতে ওঁদের তিনজনেরও নিমন্ত্রণ হল—বাচস্পতি, রূপেন্দ্র এবং মালতীর। বিশ তারিখ একাদশী। রূপেন্দ্র আর মালতীর উপবাস। তাই এ ব্যবস্থা।

রূপেন্দ্র আর বাচস্পতি পরে আসবেন। মামণিকে নিয়ে মালতী এল বড়বাড়িতে। হটীকে আজ ঘাটে যেতে দেওয়া হল না। এ-কটা দিন হবু-কনেকে খুব সাবধানে রাখতে হয়। বাসি কাপড়ে ঘরের বাইরে পা দিতে নেই, সুয্যি-ডোবার আগেই চুলের আগায় একটি গ্রন্থী দিয়ে রাখতে হয়। প্রকাশ্য সড়ক ধরে ঘাটে স্নান করতে যাওয়া মানা। বড়বাড়িতে তোলা-জলেই মামণি স্নান করে একটা মুর্শিদাবাদী রেশমবস্ত্র পরিধান করল। এটা তারাসুন্দরীর ‘আইবুড়ো ভাতে’র উপহার। নাতিনী-দিদি ওর চরণদুটি অলক্তকরাগে রাঙিয়ে দিল। পুঁটুরানি সযত্নে কেশবিন্যাস করে দিল। না, কাকপুচ্ছ নয়, জোড়া সাপের আলিঙ্গনাবদ্ধ কেশরচনাচাতুর্য। তারপর বড়বাড়ির ধনভাণ্ডারে সুরক্ষিত কুসুমমঞ্জরীর নানাবিধ অলংকারে সাজিয়ে দিল ওকে। মাথায় জড়োয়া মুকুট। কপালে টায়রা, কর্ণমূলে পান্নাখচিত ঝুমকোদুল, নাকে মুক্তা-নোলক, হাতে আটগাছি করে আয়নামোড়া চুড়ি, বাঁ-হাতে মানতাসা, কণ্ঠে একের-পর-এক শতনরি। সব চেয়ে চটকদার—নদিয়া মহারাজের আশীর্বাদী হীরকখচিত কণ্ঠহার।

পুঁটুরানি ওকে প্রথমে নিয়ে গেল দেবমন্দিরে, তারপর তোষাখানায়। সেখানে প্রাচীরে প্রলম্বিত ভাদুড়ি বংশের পূর্বপুরুষদের তৈলচিত্র। ব্রজেন্দ্রনারায়ণ ও ব্রজসুন্দরীর যুগল তৈলচিত্র—এক ফ্রেমে বাঁধানো। রূপমঞ্জরী একে-একে সবাইকে প্রণাম করল। তারপর তাকে এনে বসানো হল অন্দরমহলের একটি বড় ঘরে। পশমের আসনে। সমুখে প্রকাণ্ড কাঁসার থালায় পুষ্পান্ন। তা ঘিরে সারি সারি বাটিতে নানান ব্যঞ্জন, মিষ্টান্নপাক, দধি, ক্ষীর ও পরমান্ন।

তারাসুন্দরী বলেন, প্রথমে একটু প্রসাদী পরমান্ন মুখে দে মামণি, তারপর শাক-সুক্তো-ভাজার পালা।

—ওরে তোরা শাঁখ বাজা! উলু দে!

উলু-উলু-উলু-উলু!

বৃহৎ কক্ষের ও-প্রান্ত থেকে একটি কিশোর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, আহা যেন লক্ষ্মীঠাকরুণটি!

নতনয়না রূপমঞ্জরী একবার চোখ তুলে দেখল : তার সহাধ্যায়ী বাল্যবন্ধুকে। পুঁটুরানি বলে, তা যা বলেছিস শুভ! তিজলহাটির ঘোষালবাড়িতে মশাল জ্বালার খরচ কমে যাবে। আমাদের মেয়েটাই সে বাড়ি আলোয় আলো করে রাখবে!

—একটা খুঁত রয়ে গেল কিন্তু, পিসি!

—খুঁত! কী খুঁত?

—ওকে তো এখনও ‘বউ’ বলে চেনাই যাচ্ছে না। মাথায় ঘোমটাটা তুলে দাও!

ঘরসুদ্ধ মেয়ে-বউ খিল্‌ খিলিয়ে হেসে ওঠে। কে একজন প্রগল্ভা হটীর মাথার দিকে হাত বাড়াতেই রূপমঞ্জরী বলে ওঠে : ধ্যেৎ!

তারাসুন্দরী মামণিকেই সমর্থন করেন, তা কেমন করে হবে? ও তো এখনও আইবুড়ো!

১২

কর্তারা এবার আহারে বসেছেন। নিমন্ত্রিত পুরুষ কয়জনও। পুঁটুরানি এবার মামণিকে তার শয়নকক্ষে নিয়ে এসে পালঙ্কে বসিয়ে দিল। এক-গা গহনা পরে তার পক্ষে ঘোরাঘুরি করা মুশকিল। অথচ পুঁটুর নানান কাজ। একটু ইতস্তত করে বললে, তুই একটু একা-একা বসে থাক মামণি, আমি একবার ওদিকটা দেখে আসি! ওঁরা সবাই মধ্যাহ্ন আহারে বসেছেন তো!

রূপমঞ্জরী বলে, শুভদাও বসেছে?

—ভালো কথা মনে পড়িয়ে দিলি! শুভ বলেছে সে আমাদের সঙ্গে বসবে। তাকেই ডেকেদি। তুই তার সঙ্গে কতা ক। আমি ওদিকটা দেখে আসি।

মামণিকে জবাব দেবার সুযোগ না দিয়েই পুঁটু হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে যায়।

একটু পরে দ্বারপ্রান্তে দেখা গেল শুভপ্রসন্নকে। গায়ে রেশমের পিরান। বাবা সেদিন ঠিক বলেননি, হয়তো তাঁর লক্ষ্য হয়নি। শুভদার খানাসার নিচেও কচি ওষ্ঠলোমের আভাস।

—ভিতরে আসব?

রূপমঞ্জরী বলল না—’এটা তোমাদের বাড়ি শুভদা, কখন কোথায় যাবে তা কি আমার বলে দেবার কথা?” অথবা, ‘আমি এখনও পরস্ত্রী হয়ে যাইনি, শুভদা!”

বিনা অনুমতিতেই ও পায়ে পায়ে এগিয়ে এল। কাছে এসে বললে, দারুণ সুন্দর দেখাচ্ছে কিন্তু! চপলার চঞ্চলতা নেই। আছে হীরকখণ্ডের দীপ্তি! সৌম্য এবং সুন্দর!

শ্লেষ! ‘শ্লেষ কাহাকে বলে’? ‘একই শব্দের দ্বিবিধ অর্থ!’ উদাহরণ? অতিবড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ। কোনো গুণ নাহি তাঁর কপালে আগুন।’

—কী হল? তুমি কথা বলছ না কেন, মঞ্জু?

‘তুই’ নয় ‘তুমি’! ‘হটী’ না, ‘মঞ্জু’!

বললে, এ-কদিন আমাদের বাড়িতে যাওনি কেন?

—তুমিও তো এ-কদিন আমাদের বাড়িতে আসনি।

প্রতিপ্রশ্ন! ‘প্রতিপ্রশ্ন কী?’ ‘পূর্বপক্ষকে উত্তরপক্ষ একই প্রশ্ন করিয়া যখন উত্তর প্রদান করে তখন তাহাকে বলে প্রতিপ্ৰশ্ন। ‘

মামণি বলে, আমার এখন বাড়ির বাইরে যাবার নানান বিধিনিষেধ আছে, তুমি জানো না?

—ও হ্যাঁ। মনে ছিল না। অপদেবতাদের নজর লাগবে! তুমি সে কুসংস্কারে বিশ্বাস করো?

—বিশ্বাস করি না করি, তা মানতে তো হয়? তোমাকেও তো মানতে হয়। হয় না?

এবার হার স্বীকার করতে বাধ্য হল শুভপ্রসন্ন। ক্ষুরধারবুদ্ধি হটার। সে যে প্রশ্নটি করেছে তা অলংকার-শাস্ত্র মতে ‘তির্যকোক্তি।’ ‘তির্যকোক্তি’ কাহাকে বলে?” “যাহার বাচ্যার্থ আপাত অভিহিতার্থের অতিরিক্ত কোন এক গূঢ় ব্যঞ্জনার ইঙ্গিতবাহী।’

—কই, বললে না, তো—এতদিন কেন পালিয়ে-পালিয়ে বেড়াচ্ছিলে?

—না, তা কেন বেড়াব? ভিষগাচার্য যে আমাকে নিষেধ করেছিলেন।

—’ভিযগাচার্য?’ ‘গুরুদেব’ নয়? ‘আচার্যদেব’ও নয়?

—আমি যে সে সম্বোধনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। তুমি জানো না?

–ভুল কোরো না শুভদা। বাবামশাইও তোমার-আমার মতোই সামাজিক অনুশাসন মানতে বাধ্য। তিনি নিতান্ত নিরুপায়। দোষ করেননি কিচ্ছু!

—জানি, মঞ্জু। ভুল তিনি করেননি, করতে পারেন না। সারাজীবনে তাঁর একটাই মাত্র ভ্রান্তি—একটি মাত্র দোষ।

—দোষ! বাবামশাইয়ের? কী দোষ?

—’কালানৌচিত্য’! ভুল করে তিনি দুই শতাব্দী পূর্বে আবির্ভূত হয়েছেন

কথাটা ভাববার। কিন্তু সময় কোথায়? হঠাৎ কণ্ঠস্বর পালটে বলে, আমাদের হাতে সময় খুব কম। এখনি হয়তো কেউ এসে পড়বে। আমরা কি শুধু তর্কই করে যাব?

ম্লান হাসল শুভপ্রসন্ন। কথা বলল না।

—সেদিন অমন করে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলে?

—আমি গিয়েছিলাম রূপনগরে।

—রূপনগরে? তোমার মামাবাড়ি?

—না। দাদামশায়ের বাড়ি অবশ্য সেখানেই। আমি সেখানে যাইনি আদৌ। আমি গিয়েছিলাম প্রেমদাস বাবাজির আখড়ার ধ্বংসস্তূপ দেখতে।

—ধ্বংসস্তূপ! তাতে দেখবার কী আছে শুভদা?

—আছে। চোখ থাকলে তা দেখা যায়। কী সুন্দর! কী অপরূপ!

—সুন্দর! অপরূপ?

—হ্যাঁ! বাবাজির দোলমঞ্চটা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ঊর্ণনাভ সেখানে কী বিচিত্র জাল বুনেছে। শিশিরবিন্দুর মুক্তাদানায় তা ঝলমল করছে। দেবদাসী নৃত্যের ময়দানবীয় মঞ্চটায় এখন বাস করে শৃগাল, চর্মচটিকা আর গৃহগোধ। সাপ-সাপিনীরাও থাকে।

—এর মধ্যে সুন্দর কোনটা? কোনটা অপরূপ?

—ওই যে বললাম : দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই অপরূপকে দেখা যায়। সমাজের কুসংস্কারকে মূলধন করে প্রেমদাস অতিদর্পিত অহংকারে ব্যভিচারে মেতেছিল। দেখে এলাম মহাকালের মুষলাঘাতে তার চরম পরিণতি! দেখলাম তার বিরাট শৃঙ্গারকক্ষে একটা প্রকাণ্ড ঝাড়লণ্ঠন ধরাশায়ী হয়েছে। ছোট ছোট স্ফটিকখণ্ড ইতস্তত ছড়িয়ে আছে গোটা প্রাঙ্গণে। কী বলব, মঞ্জু—হঠাৎ নজরে পড়ল একটা ছোট্ট আতসখণ্ডের উপর। মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে আছে। একান্তে। আর পাঁচটা স্ফটিকখণ্ডের মতো সে কিন্তু বুক-চাপড়ে কাঁদছে না। অবাক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে ভাঙা ছাদের দিকে। সেই ভাঙা অংশটা দিয়ে মেঝেতে এসে পড়েছে একমুঠো সূর্যের আলো। মৃত্যুর পরেও স্ফটিকখণ্ডটা তার স্বধর্মকে ভোলেনি, ভোলেনি সূর্যপ্রণামের মন্ত্র। চিরটাকাল যা করত আজও তাই করছে : সুন্দরের উপাসনা। জীর্ণ প্রাচীরে আজও এঁকে চলেছে প্রতিসরিত সূর্যরশ্মির সপ্তবর্ণা ইন্দ্রধনু।

হঠাৎ রসভঙ্গ হল পুঁটুরানির আবির্ভাবে : আয় শুভ। এবার খাবি আয়।

১৩

বিবাহের দিন। গোধূলি লগ্নে সম্প্রদান।

তিজলহাটি থেকে এসেছেন একবিংশতিজন বরযাত্রী—বর, বরকর্তা, পরামানিক ও পুরোহিত সমেত। এসেছেন সে অঞ্চলের ভূম্যধিকারী মিত্রমশাই, সপুত্র। ইতিমধ্যে তিনি পিতামহ হবার গৌরব লাভ করেছেন। বরযাত্রীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা বড়বাড়িতে। তারাপ্রসন্ন সে দায়িত্ব স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছেন। সন্ধ্যা সমাগমের পূর্বেই গ্রামস্থ ভদ্র-পঞ্চজন একে-একে এসে উপস্থিত হচ্ছেন। সকলেরই গায়ে পিরান, নিম্নাঙ্গে আগুল্ফবিস্তৃত ধুতি। কারও কারও কাঁধে শাল। কারও বা মাথায় পাগড়ি অথবা শামলা। এসেছেন কালিচরণ, নন্দখুড়ো, শিরোমণি, তারিণীখুড়ো, বাচস্পতি, পীতাম্বর মুখুজ্জে। কিন্তু কী আশ্চর্য! বড়বাড়ি থেকে তো এখনও কেউ আসেনি। বর ও বরযাত্রীর দায়িত্ব তাঁদের। তাঁরা সেখানেই ব্যস্ত। সেটা বিয়েবাড়ির কাজই। কিন্তু তাই বলে তারাবউঠান বা পুঁটুরানি সারাদিন আসতে পারল না! কেন? সকালে গাত্রহরিদ্রায় ‘এয়োস্ত্রী’ হিসেবে তারাসুন্দরীর অভাবটা নিতান্ত অপ্রত্যাশিত। মালতী শেষমেশ শিবনাথকে পাঠিয়েছিল। সে ফিরে এসে জানালো, দূরদেশের কে এক জ্ঞাতি ৺গঙ্গা পেয়েছেন। ওঁদের মৃতাশৌচ হয়েছে। সেই কারণে গাত্রহরিদ্রার শুভ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারছেন না।

কিন্তু তাই বলে তারাদা সারাদিনের মধ্যে একবার এসে দাঁড়াতে পারল না? আর শুভপ্রসন্ন? তার উপর যে অনেকটা নির্ভর করেছিলেন রূপেন্দ্র।

সূর্য পশ্চিম-দিগ্বলয়ে ঢলে পড়েছে। গোধূলি লগ্নের আর বিলম্ব নাই। যে কোন মুহূর্তে বড়বাড়ি থেকে বরযাত্রীরা এসে পড়বেন। বর আসবে অশ্বপৃষ্ঠে। আর সবাই পদব্রজে। তারাদা বরকর্তার জন্য একটি পালকির ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। ঘোষালমশাই প্রত্যাখ্যান করেন—’এক রশি তো দূরত্ব! আমার নিমন্ত্রিত অন্য বরযাত্রীরা যখন পদব্রজে যাবেন তখন আমিও তাই যাব।’

রূপেন্দ্র জীবন দত্তকে জনান্তিকে ডেকে বলেন, কী হল বলতো জীবন? আমার নিমন্ত্রণের কোনও ত্রুটি? তারাদা সারাদিনে একবার এসে দাঁড়াতে পারলেন না? অশৌচ হলে কি মুখ দেখানোও বারণ? তুমি একবার জেনে এসো তো বাবা।

জীবন একই সংবাদ নিয়ে ফিরে এল। নায়েবমশাই বলেছেন, মৃতাশৌচ!

—মৃতাশৌচ? কে লোকান্তরিত হয়েছেন?

হঠাৎ চমকে উঠে বলেন, “কাশীধাম থেকে কোন দুঃসংবাদ আসেনি তো?

—না, না, সেসব কিছু নয়। আমি দূর থেকে বড়কর্তাকে দেখেছি। তাঁর ঊর্ধ্বাঙ্গে পিরাণ—’কাচা’ নয়।

একটু পরেই শোরগোল উঠল! বর এসেছে! বর এসেছে! উলু-উলু-উলু।

হন্তদন্ত হয়ে রূপেন্দ্র এগিয়ে গেলেন প্রবেশদ্বারের দিকে।

১৪

রূপেন্দ্রের শয়নকক্ষে সর্বালংকারভূষিতা রূপমঞ্জরী তখন ‘সোহাগজল’ মাপছে মঙ্গলকলস থেকে ছোট্ট খুরিতে জল তুলছে। আবার কলসেই ঢেলে দিচ্ছে।

‘—সোহাগ জল’ কাকে বলে দাদু?

আঃ। তোমাদের নিয়ে আর পারি না বাপু। শোনো, বুঝিয়ে বলি :

বর আসার আগে কনেকে বসে বসে ‘সোহাগজল’ মাপতে হয়। মাটির কলসিতে গঙ্গাজল। কলসির গায়ে তেলসিঁদুরের মাঙ্গলিক-চিহ্ন। কনের মা-মাসি-পিসি—মানে যাঁরা সধবা, স্বামী-গরবিনী—তাঁরা অঞ্চলপ্রান্ত সে জলে স্পর্শ করান। অর্থাৎ মেয়েটা তো চিরকালের মতো পরের ঘরে চলে যাচ্ছে, তাই এই সোহাগ জানানো—সেও যেন তাঁদের মতো স্বামী-গরবিনী হয়। কনেকে তখন স্থির হয়ে বসে থাকতে হয়। হুটোপুটি করা বারণ এক-গা গহনা পরে। আবার নিষ্কর্মা বসে থাকলেও মনে আসে নানান দুশ্চিন্তা। চোখে আসে জল। তাই তাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেওয়া হয় : ওই ‘সোহাগজল’ মাপা।

সে জলটার কী অত্তিম গতি? কলসিটারই বা কী হয়? শোনো বলি :

মেয়ে যখন বরের সঙ্গে গাঁটছড়া-বাঁধা অবস্থায় প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি যায় তখন মেয়ের মাকে তো দেখতে নেই। তাহলে সে আবাগি করবেটা কী? তাকে স্থির হয়ে বসে থাকতে হয়ে ঘরের কোণে। আবার নিষ্কর্মা বসে থাকলেও মনে আসে নানান দুশ্চিন্তা। দু-চোখে ভরে আসে জল। তাই মেয়ের মাকে একটা কাজ দেওয়া হয়। সে নির্জন ঘরে বসে বসে ওই ‘সোহাগজল’ মাপে—কলসি থেকে জল তুলে আবার কলসিতেই ঢেলে দেয়। গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব!

কলসির সেই জলে চোখের জল মিশে যাওয়া মানা। তেমন অনাচার দেখলে ঘরের ও-প্রান্ত থেকে কায়েত-গিন্নি ধমক দিয়ে ওঠেন : ওটা কী হচ্ছে বাউনদিদি? সোহাগজলে চোখের জল মেশাচ্চো? কাঁদার কী আছে? তোমার মেয়ে তো রাজরানি হতে যাচ্ছে গো?

দাঁতে দাঁত দিয়ে মেয়ের মা বলে, কিন্তু আমার ঘরে সোনার পিদিমটা যে নিবে গেল, দিদি!

—সেটাই যে আমাদের পোড়াকপাল গো! ‘আপনি বুঝিয়া দেখ, কার ঘর কর।’

না, ভুল হল। ও কথা কায়েত গিন্নি বলত না। বলতে পারে না! সে আমলে গাঁ-ঘরে এক লাখের মধ্যে একজন মহিলাকেও খুঁজে পাওয়া যেত না যিনি ওই ‘রাধানাথকে চেনেন।

রাধানাথ : অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীর কবীন্দ্র ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর!

তিনকুড়ি বছর পাড়ি দিয়েছেন, প্রায় সমসংখ্যক শুভবিবাহের সম্প্রদায় কার্যও সুসম্পন্ন করেছেন—রাঢ়ী-বারেন্দ্র-বৈদিক, কুলীন-কাপ-শ্রোত্রীয়, ব্রাহ্মণ-কায়স্থ- বৈদ্য—কিন্তু এমন বিচিত্র অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি। পুরোহিতমশাই যেই ধুয়ো ধরেন ‘ফাল্গুনে মাসি’ অমনি নজরে পড়ে নাসিকাগ্রে যজমানের বামহস্তের পাঞ্জাছাপ হক্‌ক্চকিয়ে থেমে যান। আর যজমান গড়গড়িয়ে গো- গাড়ি চালান ‘ফাল্গুনে মাসি, মকররাশিস্থে ভাস্করে কৃষ্ণে পক্ষে, দ্বাদশ্যাং তিথৌ’ ইত্যাদি। প্রখর স্মরণশক্তি যজমানের। বৃদ্ধ প্রমাতামহীর ক্ষেত্রেও ‘যথানাম্নী’ বলতে হয় না। পুরোহিত যে মাত্র শুরু করেন ‘মধুবাতা ঋতায়তে’ অমনি নাসিকাগ্রে পাঞ্জাছাপ! যজমান উদাত্তকণ্ঠে আবৃত্তি করে বলেন, মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ মাধ্বীর্ণ সত্ত্বোষধীঃ।। মধু- নক্তমুতোষসো মধুমৎ পার্থিবং রজঃ। মধু দ্যৌরস্তু নঃ পিতা। মধুমান্নো বনস্পতিমধুমা নন্তু সূর্য মাধ্বীর্গাবো ভবন্তু নঃ। ওঁ মধু, ওঁ মধু, ওঁ মধু।।”

কচি মেয়েটা কাঁদছে কাঁদুক—সব মেয়েই কাঁদে—কিন্তু অমন তাগড়াই জোয়ান মরদ কেন কেঁদে ভাসাচ্ছে? ব্যাপারটা এই—ঠান্ডা বাতাস বইছে, নদীর জল মিঠে, জ্যোৎস্না রাতও মিষ্টি, মাঘের জমাটি শীতে সূর্যের রোদও বেশ মিষ্টি লাগে। আর দুধেলা গাইয়ের বাঁটে তো মধুই ঝরে! কিন্তু সেসব কথা বলতে গিয়ে মানুষটা কাঁদে কেন? এমনটি তিনি আগে কখনও দেখেননি।

একসময় শেষ হল পুরোহিতের সম্প্রদানীয় ধাষ্টামো। এবার কুশণ্ডিকাপর্ব। রূপেন্দ্রনাথের কোন ভূমিকা নেই। পুরোহিত হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

তবে হ্যাঁ, যজমানের বিবেচনা আছে। উনি মাত্র ‘চার-কড়া’ মন্ত্রোচ্চারণ করেছেন। তবু যথাবিহিত কাঞ্চনমূল্যে দক্ষিণাদানের সময় গণ্ডা পুরিয়েই দিয়েছেন। প্রতিশ্রুতিমতো রজতখণ্ডই।

নারায়ণশিলাকে প্রণামাতে গাত্রোত্থান করলেন অদ্বৈত বৈদান্তিক।

নিমন্ত্রিতরা ততক্ষণ পঙক্তি ভোজনে বসেছেন। এগিয়ে গেলেন সেদিকে। জোড়হস্তে। মালতী ইতিমধ্যে তিনবার দু-দিনের অভুক্ত ব্রাহ্মণটিকে ডেকে পাঠিয়েছে। কর্ণপাত করেননি একবগ্গা ঠাকুর। এ যে নিমন্ত্রণকর্তার সামাজিক কৃত্য। আমন্ত্রিতদের সেবাত্ত না হলে তিনি কী করে উপবাস ভঙ্গ করেন?

শেষে ডাকতে এল শোভারাণী নিজেই : রুপোদা! আপনি একবার বাসরে আসুন। বরকনে আপনাকে জোড়ে প্রণাম করবে।

এবার কর্ণপাত করতে হল। এটাও পিতার কৃত্য!

বাসর জমজমাট। বরকনেকে ঘিরে আছে সালংকারা সুসজ্জিতা পুরনারীরা।

সদ্যোবিবাহিত দম্পতি জোড়ে প্রণাম করল তাঁকে।

—মাথা অমন নামাসনে মামণি। মুকুটটা পড়ে যাবে। হাতে পদস্পর্শ করে ললাট স্পর্শ কর।

অবাধ্য হল রূপমঞ্জরী। যা কখনও হয় না। তার চন্দনচর্চিত ললাটটি নামিয়ে দিল পিতার যুগ্ম চরণকমলে। পদ্মপত্র শিশিরসিক্ত হল যেন! উনি নিচু হয়ে স্বর্ণমুকুটটার স্থানচ্যুতি ঠেকাতে গেলেন। দু-হাতে চেপে ধরলেন ওর লাজবস্ত্র-অবগুণ্ঠিত মস্তক। বাবার কানে কানে অস্ফুটে কী যেন বলল মামণি। সকলের শ্রুতিগোচর হল না। তারা শুনল বিব্রত পিতার প্রত্যুত্তর : আমার নজরে পড়েনি মা, আমি তো ব্যস্ত ছিলাম নানা কাজে।

মালতী বোধহয় স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গেল। সর্বসমক্ষে চেপে ধরল তার ঠাকুরপোর মণিবন্ধ। বলল, আপনি এঘরে আসুন তো! কিছু মুখে দিন আগে।

মীনুর মা সায় দেন, হ্যাঁ বউমা! এবার পাগলটাকে দুটি খাইয়ে দাও। দু-দুটো দিন উপোস করে আছে!

মালতী ওঁকে টেনে নিয়ে গেল পাশের ঘরে। সেখানে একটি আসন পাতা আসনের সম্মুখে কিছু ফল-মূল-মিষ্টান্ন-পরমান্ন। পাশেই একটি পাত্রে বেলের পানা। রূপেন্দ্র বিনাবাক্যব্যয়ে তুলে নিলেন পানপাত্রটা। একনিশ্বাসে বেলের পানা নিঃশেষ করে পাত্রটি বৌঠানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আমাকে মার্জনা করবেন বৌঠান! ওর ওই প্রশ্নটার সদুত্তর না জানা পর্যন্ত আমি কিছু মুখে দিতে পারব না।

—কী জানতে চেয়েছিল মামণি?

রূপেন্দ্র তখন চলতে শুরু করেছেন। দ্বারপ্রান্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ও বলেছিল : ‘শুভদা আসেনি’?

১৬

ভাদুড়িবাড়ি নিস্তব্ধ। কৃষ্ণা দ্বাদশীর এক-আকাশ তারার চালচিত্রের সম্মুখে নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে আছে মৌন প্রাসাদটা। কোনও ঘরে আলো জ্বলছে না। কোনও সাড়াশব্দ নেই। দারোয়ান আভূমি নত হয়ে প্রণাম করে বললে, আইয়ে বাবা!

—তারাদা কোথায়? ঘুমিয়ে পড়েছেন?

—জি নহি! সবকোই জাগত্ হ্যয়। যাইয়ে না ভিতর

—কে মারা গেছেন মিশিরজি?

—মুঝে নহি মালুম, বাবাঠাকুর।

গলিপথে সেজবাতি জ্বলছে। দাসদাসীরা তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে বিনা নির্দেশেই। সোপানশ্রেণি অতিক্রম করে দ্বিতলে উঠে এলেন। খোলা বারান্দায় তারাপ্রসন্ন একটি আরামকেদারায় অর্ধশায়িত। পদশব্দে ওঁর দিকে তাকিয়ে দেখেন। কী যেন বলতে গেলেন—বাক্যস্ফূর্তি হল না।

রূপেন্দ্রনাথ বসে পড়েন তাঁর পায়ের কাছে। পাথরের মেঝেতেই। তারাদার একটি হাত নিজ মুষ্টিতে তুলে নিয়ে কাতরভাবে প্রশ্ন করেন : কী হয়েছে তারাদা?

তারাপ্রসন্ন নিজের হাতটি বন্ধনমুক্ত করে দু-হাতে মুখ ঢাকেন। উচ্ছ্বসিত আবেগে ভেঙে পড়েন পাঁজরভাঙা কান্নায়। রূপেন্দ্রনাথ এদিক-ওদিক দেখেন। ভদ্রাসনটি যেন জনমানবহীন। আধো-আলো, আধো-অন্ধকারে কাউকে দেখতে পান না। না তারাবৌঠান, না পুঁটুরানি, না শুভপ্রসন্ন। এমনকি দাসদাসীরাও যেন এক অজ্ঞাত গৃহদাহে ভস্মীভূত। হঠাৎ নজর হল, তারাদার মুঠিতে ধরা আছে একটি ভূর্জপত্র। সেটি তিনি ওঁর দিকে যেন বাড়িয়ে ধরেছেন। মৌনমুখ শোকাহত মানুষটি যেন ইঙ্গিতে সেটি দেখাতে চাইছেন তাঁর অনুজপ্রতিম রুপো-বাঁড়ুজ্জেকে।

রূপেন্দ্রনাথ পত্রটি গ্রহণ করলেন। যথেষ্ট আলোকের অভাব। পড়া গেল না। তাই প্রশ্ন করেন, কীসের এ মৃতাশৌচ? কে? কে মারা গেছেন তারাদা?

এতক্ষণে বজ্রাহত মানুষটি খুঁজে পেলেন তাঁর কণ্ঠস্বর : আমি!

বুঝতে পারেন এই মানুষটার কাছ থেকে এখন প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করা অসম্ভব। সম্ভবত রহস্যমঞ্জুষার কুঞ্চিকা ওই পত্রটি। এগিয়ে গেলেন দূরপ্রান্তস্থিত দীপাধারের দিকে। নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখা অচঞ্চল। পার্থিব শোকে বেপথুমান হওয়া তার স্বধর্মবিরুদ্ধ। মুহূর্তে আলোকিত হয়ে গেল সমস্যাটা—

পত্রের লেখক : শ্রীমান শুভপ্রসন্ন দেবশর্মনঃ

পত্রের প্রাপক : তদীয় পিতৃদেব।

পত্রটির নির্গলিতার্থ : কিশোর ব্রাহ্মণটি আত্মসন্ন্যাস গ্রহণ করেছে। তাই গৃহত্যাগ করেছে আজই প্রত্যুষে। সে সুন্দরের অভিসারে মানসযাত্রী। সদগুরুর সন্ধানে। আক্ষেপ করে জানিয়েছে মনোমতো সদগুরু সে স্বগ্রামেই লাভ করেছিল। কিন্তু কূপমণ্ডূক ব্রাহ্মণ্য সমাজ কুসংস্কারের কৈঙ্কর্যে তার সেই গুরুদেবকে বাধ্য করেছে ওই সুন্দর-সন্ধানীকে পরিত্যাগ করতে। জানিয়েছে : পৈতৃক সম্পত্তির জীমূতবাহন-সূত্রের দায়ভাগ-অধিকার—সে স্বেচ্ছায় নির্ব্যঢ় স্বত্বে পরিত্যাগ করে যাচ্ছে। ভূম্যধিকারী তাঁর ইচ্ছামতো অন্যান্য ওয়ারিশদের ভিতর সম্পত্তি বণ্টন করলে তার বিন্দুমাত্র আপত্তি নাই। পত্রান্তে সে একটি মাত্র অনুরোধ জানিয়েছে : যেন তাকে অনুসরণ না করা হয়, যেন তল্লাশ না করা হয়। অর্থাৎ তাকে আত্মহননে বাধ্য করা না হয়। কারণ সে জীবিত থাকতে চায়—ভূমার স্পর্শ পেতে চায়, সত্যশিবসুন্দরের আশীর্বাদ লাভ করতে ইচ্ছুক।

পত্রের সঙ্গে বাবলাকাঁটায় আর একটি ক্ষুদ্র ভূর্জপত্র অনুবিদ্ধ :

পরমকল্যাণীয়াসু

মঞ্জুভাষিণী!
মা ভূদেবং ক্ষণমপি চ তে সুন্দরাৎ বিপ্রয়োগঃ।।*

[* এটি মেঘদূতম্ কাব্যের শেষ শ্লোকের শেষার্ধের সজ্ঞানকৃত ভ্রান্ত-উদ্ধৃতি।
যক্ষ মেঘকে আশীর্বাদ করে বলেছিল ‘বিদ্যুতা’—’বিদ্যুৎ হইতে’, অপাদানে পঞ্চমী স্থলে তৃতীয়া বিভক্তি। মঞ্জুভাষিণীকে আশীর্বাদ করতে শুভ বলেছে ‘সুন্দরাৎ’। পংক্তিটির অনুবাদ : “হে মঞ্জুভাষিণী! আশীর্বাদ করি সারাজীবনে ক্ষণকালের জন্যও তুমি, যা কিছু ‘সুন্দর’ তা-থেকে বিচ্যুত হোয়ো না।”]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *