চিড়িয়াখানায়
আমার এই অতি হাস্যকর লেখক-জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ঘটেছিল চিড়িয়াখানায়। ঘটনাটা অনেক সময় হাসতে হাসতে অনেককে বলেছি, তবে কখনও লিখিনি। এখনও লিখতে একটু সংকোচ হচ্ছে, একটু আত্মপ্রচারের মতো হয়ে যাচ্ছে। তবু লিখছি, বুদ্ধিমান পাঠক ও বুদ্ধিমতী পাঠিকা দয়া করে লক্ষ করবেন নেহাত মজার গল্পের খাতিরেই ঘটনাটা লিখছি, আর কোনও উদ্দেশ্য নেই।
যোলো-সতেরো বছর আগেকার কথা। সেটা উনিশশো একাত্তর সাল। বাংলাদেশ যুদ্ধের বছর। আমার নিজের লোকেরা সব দেশ থেকে শূন্য হাতে কর্পদকহীন অবস্থায় কোনওরকমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে। রীতিমতো উদ্বেগ ও আর্থিক কষ্টের মধ্যে দিন যাচ্ছে। ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ স্বাধীন হল, বাবা-মা এবং আর সবাই বাড়ি ফিরল। স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বাঁচলাম।
স্পষ্ট মনে আছে তারিখটা, নববর্ষের সকাল, বাহাত্তর সালের পয়লা জানুয়ারি। ডোডো আর তাতাইকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে গেছি। তাতাই আমার ছেলে, ডোডো তার বন্ধু। সেই সময়ে আমি সোমবারের আনন্দবাজারের আনন্দমেলার পাতায় সপ্তাহে সপ্তাহে ধারাবাহিক ‘ডোডো-তাতাই’ লিখছি।
এই সব দিনে যেমন হয়, সেদিন চিড়িয়াখানায় ভয়াবহ ভিড়। শোনা যায় এই সব ছুটির দিনে বিশেষত শীতকালে চিড়িয়াখানায় লক্ষাধিক লোক হয়। এক লক্ষ লোক অবশ্য এক সঙ্গে ঢোকে না। সারাদিন ধরে লম্বা লম্বা লাইন দিয়ে ঢোকে। তবে কোনও কোনও সময় অন্তত হাজার পঞ্চাশেক লোক চিড়িয়াখানার ভিতরে থাকে। তার মানেই গাদাগাদা মানুষ, গিজগিজে ভিড়।
ওই ভিড়ের মধ্যে বার বার ডোডো-তাতাই চোখের আড়াল হয়ে যাচ্ছিল। তখন তারা খুবই ছোট, বড় জোর পাঁচ-ছয় বছর বয়েস। চিড়িয়াখানার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে যেখানে গণ্ডারের মত রয়েছে সেই খন্দ রেলিংয়ের একপাশে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি ডোডো-তাতাইকে সাপের ঘর দেখতে পাঠালাম, সেখানে বিরাট লাইন দেখে আমি আর নিজে ঢুকলাম না। অনেকক্ষণ পরে ওরা ওখান থেকে বেরিয়ে এসে দিক ভুল করে আমি যেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম তার বিপরীতে দিকে হন-হন করে রওনা হল। আমি ‘ডোডো-তাতাই, এই ডোডো-তাতাই’ বলে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলাম।
আমার সামনে দিয়ে একদল লোক যাচ্ছিল, পরনে ধুতি-শার্ট, গায়ে র্যাপার মফস্বলের লোক, কথার টান দেখে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মানুষ বলে মনে হল। তারা আমার মুখে ‘ডোডো-তাতাই’ ডাক শুনে থমকে দাঁড়াল, ততক্ষণে ডোডো-তাতাই ছুটে আমার কাছে চলে এসেছে। ওরা বুঝতে. পারল, এই দু’জনের নাম ডোডো আর তাতাই। দলের মধ্যে একজন লোক বাচ্চা দুটোকে ভাল করে দেখে নিয়ে তারপর আমার প্রতি কটাক্ষপাত করে আমাক শুনিয়ে বেশ জোরে জোরে বলল, ‘শালা, আদেখলে, খবরের কাগজ দেখে ছেলেদের নাম রেখেছে।’
বলা বাহুল্য এই মন্তব্যে আমি সেদিন যথেষ্টই গৌরবান্বিত বোধ করেছিলাম এবং আমার রচনার এ রকম স্বীকৃতি পাব কখনওই আশা করিনি।
এই একটি ঘটনা ছাড়া চিড়িয়াখানা-জনিত আমার বাকি যা কিছু স্মৃতি বা অভিজ্ঞতা তা খুব মধুর নয়। বানরের খাঁচার গায়ে খুব ছোট ছোট অক্ষরে কী একটা জটিল লেখা ছিল, সেটা কাছে গিয়ে ভাল করে পড়তে যাচ্ছি, শিকের মধ্যে দিয়ে হাত বাড়িয়ে একটা পাজি বানর আমার চোখ থেকে চশমাটা কেড়ে নেয়। তখন জেনেছিলাম, নোটিশটিতে অতি ক্ষুদ্র হরফে যা লেখা আছে তার মর্ম হল:-
‘পাজি বানর আছে।
খাঁচার নিকটে আসিবেন না।’
এ ছাড়া অনেক আগে একবার ছোলা খাওয়াতে গিয়ে একটা কালো রাজহাঁস আমার হাতে ঠুকরে দেয়, অমন দীর্ঘগ্রীবা, ঝলমলে, রাজকীয় সৌন্দর্যময় একটি প্রাণী যে এত হিংস্র হতে পারে তা ভাবাই কঠিন।
শুধু রাজহাঁস কেন, একবার একটা জেব্রাও আমার হাত থেকে খাবার খেতে গিয়ে আচমকা ডানহাতের তর্জনীটা এমন চিবিয়ে দেয় যে একসঙ্গে দশ-পাতার বেশি লিখলেই এখনও আঙুলটা টনটন করে, বেশ ফুলে ওঠে। ফলে এ-জীবনে আবার কোনও বড় লেখা, এমনকী পুজোর উপন্যাস পর্যন্ত লেখা হল না। এর জন্য কোনও কোনও পাঠক অবশ্য জেব্রাটিকে প্রভূত ধন্যবাদই দেবেন।
আমি যখন যে শহরেই যাই, খুব অসুবিধা না হলে সেই শহরে একটা চিড়িয়াখানা থাকলে সেখানে একবার যাওয়ার চেষ্টা করি।
দার্জিলিং চিড়িয়াখানার গা-ঘেঁষেই বিশাল পাহাড়ি খাদ। হরিণের খাঁচার পাশ বরাবর ঢালু খাদ নেমে গেছে। সেদিকে তাকিয়ে আমি চিড়িয়াখানার এক কর্মচারীকে বলেছিলাম, ‘এই খাদে নিশ্চয় মাঝে মাঝে কেউ কেউ পড়ে যায়।’ সেই ব্যক্তি ঠোঁট উলটিয়ে আমাকে জবাব দিয়েছিল, ‘মাঝে মাঝে পড়ে না, পড়লে এবারই পড়ে। পাঁচশো ফুট খাদের নীচে মাঝে মাঝে পড়ার সুযোগ কোথায়?’
বিদেশে আরও গোলমালে পড়েছিলাম। লস এঞ্জেলস শহরে এক মেমসাহেবকে আমি বলেছিলাম যে আমি জু দেখতে চাই। আমার বাঙাল উচ্চারণে ‘জু’ (Zoo) বোধহয় মেমসাহেবের কানে ‘Jew’ অর্থাৎ ‘ইহুদি’ হয়ে গিয়েছিল। তিনি পরপর দু’বার যাচাই করলেন সত্যি আমি কী দেখতে চাই। আমি যখন তৃতীয়বারেও ‘জু’ বললাম, তিনি ধরে নিলেন, আমি নিশ্চয়ই কোনও ইহুদিকে দেখতে চাইছি। তিনি নিজে ইহুদি, দু’-পা এগিয়ে একদম আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘দেন সি মি, আই অ্যাম এ জু (Then see me, I am a Jew)। ব্যাপারটা বুঝে উঠতে আমার বেশ সময় লেগেছিল।