চিড়িক্দাস
পুণায় বন্যার সময় যে কাঠবেরালিটা আমার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল সেটা ধাড়ি কাঠবেরালি নয়, বাচ্চা। শেষ পর্যন্ত সে আমার বাড়িতেই রয়ে গেল।
তার নাম রেখেছি চিড়িক্দাস। গৃহিণী তার প্রতি বিশেষ অনুরক্ত হয়ে পড়েছেন; নাতি তাকে পকেটে নিয়ে বেড়ায়; আমার কুকুর কালীচরণ তার প্রতি খুব প্রসন্ন না হলেও তাকে অবজ্ঞাভরে সহ্য করে। চিড়িক্দাস সারাদিন চিড়িক্ চিড়িক্ শব্দ করে বাড়িময় ঘুরে বেড়ায়, ক্ষিদে পেলে গৃহিণীর কোলে উঠে বসে।
গৃহিণী চিড়িক্দাসের দৈনন্দিন আহারের যে ব্যবস্থা করেছেন তা দেখলে হিংসে হয়। সকালবেলা চা এবং বিস্কুট, দুপুরে দুধ-ভাত, বিকেলে আবার চা-বিস্কুট, রাত্রে শয়নের পূর্বে চীনাবাদাম, ভিজে ছোলা এবং কড়াইশুঁটি প্রভৃতি নানাপ্রকার দানা। একটি পুরাতন অব্যবহৃত পাখির খাঁচায় তার রাত্রিবাসের ব্যবস্থা হয়েছে, সন্ধ্যা হলেই সে খাঁচায় ঢুকে ন্যাক্ড়া মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে।
চিড়িক্দাস যত সুখে আছে পুণার মনুষ্যসম্প্রদায় কিন্তু তত সুখে নেই। যাদের বাড়ি-ঘর ভেসে গিয়েছিল তাদের তো কথাই নেই, অন্যরা এখনো নাকানি-চোবানি খাচ্ছে। নদীর ব্রিজগুলো বেঁকে তেউড়ে এমন ত্রিভঙ্গ-মুরারি মূর্তি ধারণ করেছে যে, তার ওপর লোক চলাচল বিপজ্জনক, গাড়ি-ঘোড়া তো দূরের কথা। বৈদ্যুতিক আলো এসেছে বটে, কিন্তু নিত্যব্যবহার্য জলের অভাবে মানুষ হাহাকার করে বেড়াচ্ছে। জল যে মানুষের জীবনে কত বড় পরম পদার্থ তা এ রকম অবস্থায় না পড়লে বোঝা যায় না।
চিড়িক্দাসের জীবনে কিন্তু কোনও সমস্যা নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠে সে নিজের ল্যাজটি দৃঢ়মুষ্টিতে উঁচু করে ধরে চাট্তে আরম্ভ করে, তারপর অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিষ্কার করে। প্রসাধন শেষ হলে দু’হাত জোড় করে উঁচু হয়ে বসে। গৃহিণী তখন তাকে চা-বিস্কুট দেন; সে প্রথমেই চা-টুকু চুক্চুক্ করে খেয়ে ফেলে, তারপর বিস্কুট দু’হাতে ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খেতে থাকে। আমি বসে বসে তার বিচিত্র ক্রিয়াকলাপ দেখি : সে যখন মুখে চিড়িক্ চিড়িক্ শব্দ করে তখন তার ল্যাজটি তালে তালে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে থাকে। ওর স্বরযন্ত্রের সঙ্গে ল্যাজের বোধ হয় ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে।
আমার একটি বর্ষীয়সী প্রতিবেশিনী চিড়িক্দাসকে দেখে বললেন, ‘কাঠবেরালি পুষেছেন ভালই করেছেন, সকালবেলা কাঠবেরালি দেখা খুব সুলক্ষণ। কিন্তু ওরা পোষ মানে না। যতদিন বাচ্চা আছে আপনার কাছে থাকবে, বড় হলেই পালিয়ে যাবে।’
বনের জন্তু যদি বনে চলে যায় আপত্তি করবার কী আছে? তবু মনটা বিমর্ষ হল; চঞ্চল ছোট্ট জন্তুটার ওপর মায়া পড়ে গিয়েছে। গৃহিণী বললেন, ‘কখ্খনো না, চিড়িক্দাস কি আমাদের ছেড়ে যেতে পারে! ও পালাবে না, তুমি দেখে নিও।’
দিন কাটছে। পুণা শহরের সর্বাঙ্গে ঘা, রাস্তা খুঁড়ে নতুন জলের পাইপ বসানো হচ্ছে। আমার বাড়ির সামনে দিয়ে গভীর খাত চলে গিয়েছে, সেই খাত ডিঙিয়ে বাড়ি থেকে বেরুতে হয়; গাড়ি-ঘোড়ার চলাচল বন্ধ। অসুবিধার অন্ত নেই। ভরসা কেবল এই, মহারাষ্ট্রের মুখ্য-সচিব বলেছেন, পুণা শহরকে তিনি নতুন করে গড়ে তুলবেন, মর্ত্যে অমরাবতী তৈরি করবেন। শিবাজীর পুণা, পেশোয়াদের পুণা যদি ভাঙা-চোরা অবস্থায় পড়ে থাকে তাহলে মারাঠীদের লজ্জার অন্ত থাকবে না।
এদিকে চিড়িক্দাসের ক্ষুদ্র শরীরটি ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে; পিঠের কালো ডোরা গাঢ় হয়েছে, ল্যাজ মোটা হয়েছে। সে আর ক্ষিদে পেলেই গিন্নীর কোলে উঠে বসে না, দূর থেকে চিড়িক্ চিড়িক্ শব্দ করে আবেদন জানায়। কিন্তু সন্ধ্যের পর নিয়মমত খাঁচার মধ্যে ঢুকে শুয়ে থাকে। বুঝতে বাকি রইল না, চিড়িক্দাসের যৌবনকাল সমাগত, কোন্ দিন চুপিসারে চম্পট দেবে।
গিন্নীও মনে মনে চিড়িক্দাসের মতিগতি বুঝেছিলেন, তিনি একদিন রাত্রে চিড়িক্দাসের খাঁচায় ঢোকবার পর খাঁচার দোর বন্ধ করে দিলেন। পরদিন সকালবেলা চিড়িক্দাসের সে কি লম্ফঝম্ফ। খাঁচার চারিধারে বেরুবার রাস্তা খুঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর চিড়িক্ চিড়িক্ শব্দ করে চেঁচাচ্ছে। গিন্নী তাকে বাইরে থেকে চা বিস্কুট দুধ-ভাত দিলেন, সে সব খেয়ে ফেলল। কিন্তু তার প্রাণে শান্তি নেই; সে স্বাধীনতা চায়, বন্ধন দশায় থাকবে না।
গিন্নী বললেন, ‘দু’চার দিন খাঁচায় বন্ধ থাকলেই অভ্যেস হয়ে যাবে, তখন আর পালাতে চাইবে না।’
চিড়িক্দাসকে কিন্তু ধরে রাখা গেল না। একদিন দুপুরবেলা দেখি, খাঁচা খালি, চিড়িক্দাস পালিয়েছে। গিন্নী বোধ হয় অসাবধানে খাঁচা ভাল করে বন্ধ করেননি, চিড়িক্দাস সেই পথে বেরিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে।
নাতি তাকে খুঁজতে বেরুলো। কিন্তু কোথায় পাবে তাকে? আমি মনে মনে আশা করেছিলাম সন্ধ্যে হলে চিড়িক্দাস ফিরে আসবে, কিন্তু এল না। গিন্নী বিলাপ করতে লাগলেন, ‘কি বেইমান জন্তু। এত খাওয়ালুম দাওয়ালুম, এত যত্ন করলুম, তা একটু কি কৃতজ্ঞতা নেই! হয়তো শেয়ালে কুকুরে ছিঁড়ে খাবে, নয়তো চিলে ছোঁ মারবে—’
তাঁকে আশ্বাস দেবার জন্যে বললাম, ‘কিচ্ছু ভেবো না, চিড়িক্দাস সেয়ানা ছেলে। সামনে পেশোয়া পার্ক, অনেক বড় বড় গাছ আছে, ওখানে গিয়ে গাছের কোটরে বাসা বেঁধেছে। হয়তো একটি অর্ধাঙ্গিনীও জুটিয়ে ফেলেছে।’
দু’দিন চিড়িক্দাসের দেখা নেই। ভাবলাম সে আর আসবে না। কিসের জন্যেই বা আসবে? বনে-জঙ্গলে সে নিজের স্বাভাবিক খাদ্য পেয়েছে, অবাধ স্বাধীনতা পেয়েছে, মানুষের ‘লালন-ললিত যত্ন’ তার দরকার নেই।
তারপর তৃতীয় দিন সকালবেলা সদর দরজা খুলে দেখি—
চিড়িক্দাস হাত জোড় করে দোরের সামনে উঁচু হয়ে বসে আছে।
গিন্নী ছুটে এলেন, ‘ওমা, চিড়িক্ এসেছে! আয় আয়।’ তিনি তাকে ধরতে গেলেন, সে তুড়ুক্ করে সরে গেল, আবার ধরতে গেলেন, আবার সরে গেল, কিন্তু পালিয়ে গেল না। গিন্নী তখন খাঁচা এনে তার সামনে ধরলেন; কিন্তু চিড়িক্দাস খাঁচায় ঢুকল না। দূরে সরে গিয়ে আবার হাত জোড় করে দাঁড়াল।
আমার মাথায় হঠাৎ বুদ্ধি খেলে গেল, বললাম, ‘শিগ্গির চা আর বিস্কুট নিয়ে এস।’
পিরিচে চা এবং বিস্কুট এনে মেঝেয় রাখতেই চিড়িক্ গুটি গুটি এগিয়ে এল। প্রথমেই চুক্চুক্ করে চা-টুকু খেয়ে ফেলল, তারপর দু’হাতে বিস্কুট ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খেতে লাগল।
গিন্নী এই সুযোগে আবার তাকে ধরতে গেলেন। এবার সে বিস্কুটের অবশিষ্ট অংশটুকু মুখে নিয়ে তীরবেগে পালাল। আর তাকে দেখতে পেলাম না।
বললাম, ‘ব্যাপার বুঝলে? চিড়িক্দাসকে চায়ের নেশায় ধরেছে। ধন্য চায়ের নেশা! ও আবার আসবে।’
আমার অনুমান মিথ্যে নয়। বিকেলবেলা চায়ের সময় চিড়িক্দাস এসে হাজির, দরজার সামনে হাত জোড় করে বসল। চা এবং বিস্কুট খেয়ে, আধখানা বিস্কুট মুখে নিয়ে চলে গেল।
তারপর থেকে চিড়িক্দাস রোজ দু’বেলা আসে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তার একটি প্রণয়িনী জুটেছে। নইলে আধখানা বিস্কুট সে কার জন্যে নিয়ে যায়?
৮ ফান ১৩৬৮