গীতাঞ্জলির কয়েকটি গানের ছন্দ সম্বন্ধে কৈফিয়ত চেয়েছ। গোড়াতেই বলে রাখা দরকার গীতাঞ্জলিতে এমন অনেক কবিতা আছে যার ছন্দোরক্ষার বরাত দেওয়া হয়েছে গানের সুরের ‘পরে। অতএব, যে-পাঠকের ছন্দের কান আছে তিনি গানের খাতিরে এর মাত্রা কম-বেশি নিজেই দুরন্ত করে নিয়ে পড়তে পারেন, যাঁর নেই তাঁকে ধৈর্য অবলম্বন করতে হবে।
১। “নব নব রূপে এসো প্রাণে’– এই গানের অন্তিম পদগুলির কেবল অন্তিম দুটি অক্ষরের দীর্ঘহ্রস্ব স্বরের সম্মান স্বীকৃত হয়েছে। যথা “প্রাণে’ “গানে’ ইত্যাদি। একটিমাত্র পদে তার ব্যতিক্রম আছে। এসো দুঃখে সুখে, এসো মর্মে– এখানে “সুখে’র এ-কারকে অবাঙালি রীতিতে দীর্ঘ করা হয়েছে। “সৌখ্যে’ কথাটা দিলে বলবার কিছু থাকত না। তবু সেটাতে রাজি হই নি, মানুষ চাপা দেওয়ার চেয়ে মোটর ভাঙা ভালো।
২। “অমল ধবল পা- লে লেগেছে মন্দমধুর হাওয়া’– এ গানে গানই মুখ্য, কাব্য গৌণ। অতএব, তালকে সেলাম ঠুকে ছন্দকে পিছিয়ে থাকতে হল। যদি বল, পাঠকেরা তো শ্রোতা নয়, তারা মাপ করবে কেন। হয়তো করবে না — কবি জোড়হাত করে বলবে, “তালদ্বারা ছন্দ রাখিলাম, ত্রুটি মার্জনা করিবেন।’
৩। চৌত্রিশ-নম্বরটাও গান। তবুও এর সম্বন্ধে বিশেষ বক্তব্য হচ্ছে এই যে, যে-ছন্দগুলি বাংলার প্রাকৃত ছন্দ, অক্ষর গণনা করে তাদের মাত্রা নয়। বাঙালি সেটা বরাবর নিজের কানের সাহায্যে উচ্চারণ করে এসেছে। যথা —
বৃষ্টি পড়ে- টাপুর টুপুর, নদেয় এল- বা- ন, শিবু ঠাকুরের বিয়ে- হবে- তিন কন্যে দা- ন।
আক্ষরিক মাত্রা গুনতি করে একে যদি সংশোধন করতে চাও তাহলে নিখুঁত পাঠান্তরটা দাঁড়াবে এই রকম —
বৃষ্টি পড়ছে টাপুর টুপুর, নদেয় আসছে বন্যা, শিবু ঠাকুরের বিবাহ হচ্ছে, দান হবে তিন কন্যা।
রামপ্রসাদের একটি গান আছে —
মা আমায় ঘুরাবি কত যেন। চোখবাঁধা বলদের মতো।
এটাকে যদি সংশোধিত মাত্রায় কেতাদুরস্ত করে লিখতে চাও তাহলে তার নমুনা একটা দেওয়া যাক–
হে মাতা আমারে ঘুরাবি কতই চক্ষুবদ্ধ বৃষের মতোই।
একটা কথা তোমাকে মনে রাখতে হবে, বাঙালি আবৃত্তিকার সাধুভাষা-প্রচলিত ছন্দেও নিজের উচ্চারণসম্মত মাত্রা রাখে নি বলে ছন্দের অনুরোধে হ্রস্বদীর্ঘের সহজ নিয়মের সঙ্গে রফানিষ্পত্তি করে চলেছে। যথা–
মহাভারতের কথা অমৃতসমান,
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান্।
উচ্চারণ-অনুসারে “মহাভারতের কথা’ লিখতে হয় “মহাভারতের্কথা’, তেমনি “কাশীরাম দাস কহে’ লেখা উচিত “কাশীরাম দাস্কহে’। কারণ, হসন্ত শব্দ পরবর্তী স্বর বা ব্যঞ্জন শব্দের সঙ্গে মিলে যায়, মাঝখানে কোনো স্বরবর্ণ তাদের ঠোকাঠুকি নিবারণ করে না। কিন্তু, বাঙালি বরাবর সহজেই “মহাভারতে- র্কথা’ পড়ে এসেছে, অর্থাৎ “তে’র এ-কারকে দীর্ঘ করে আপসে মীমাংসা করে দিয়েছে। তারপরে “পুণ্যবান্’ কথাটার “পুণ্যে’র মাত্রা কমিয়ে দিতে সংকোচ করে নি, অথচ “বান’্ কথাটার আক্ষরিক দুই মাত্রাকে টান এবং যতির সাহায্যে চার মাত্রা করেছে।
৪। “নিভৃত প্রাণের দেবতা’ — এই গানের ছন্দ তুমি কী নিয়মে পড় আমি ঠিক বুঝতে পারছি নে। “দেবতা’ শব্দের পরে একটা দীর্ঘ যতি আছে, সেটা কি রাখ না। যদি সেই যতিকে মান্য করে থাক তাহলে দেখবে, “দেবতা’ এবং “খোলো দ্বার’ মাত্রায় অসমান হয় নি। এসব ধ্বনিগত তর্ক মোকাবিলায় মীমাংসা করাই সহজ। লিখিত বাক্যের দ্বারা এর শেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব হবে কিনা জানি নে। ছাপাখানা-শাসিত সাহিত্যে ছন্দোবিলাসী কবির এই এক মুশকিল– নিজের কণ্ঠ স্তব্ধ, পরের কণ্ঠের করুণার উপর নির্ভর। সেইজন্যেই আমাকে সম্প্রতি এমন কথা শুনতে হচ্ছে যে, আমি ছন্দ ভেঙে থাকি, তোমাদের স্তুতিবাক্যের কল্লোলে সেটা আমার কানে ওঠে না। তখন আকাশের দিকে চেয়ে বলি, “চতুরানন, কোন্ কানওয়ালাদের’পরে এর বিচারের ভার।’
৫। “আজি গন্ধবিধুর সমীরণে’ — কবিতাটি সহজ নিয়মেই পড়া উচিত। অবশ্য, এর পঠিত ছন্দে ও গীতছন্দে প্রভেদ আছে।
৬। “জনগণমন-অধিনায়ক’ গানটায় যে মাত্রাধিক্যের কথা বলেছ সেটা অন্যায় বল নি। ঐ বাহুল্যের জন্যে “পঞ্জাব’ শব্দের প্রথম সিলেব্ল্টাকে দ্বিতীয় পদের গেটের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখি —
পন্। জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা ইত্যাদি।
“পঞ্জাব’কে “পঞ্জব’ করে নামটার আকার খর্ব করতে সাহস হয় নি, ওটা দীর্ঘকায়াদের দেশ। ছন্দের অতিরিক্ত অংশের জন্যে একটু তফাতে আসন পেতে দেওয়া রীতি যা গীতি-বিরুদ্ধ নয়।
এই গেল আমার কৈফিয়তের পালা।
তোমার ছন্দের তর্কে আমাকে সালিস মেনেছে। “লীলানন্দে’র যে-লাইনটা নিয়ে তুমি অভিযুক্ত আমার মতে তার ছন্দঃপতন হয় নি। ছন্দ রেখে পড়তে গেলে কয়েকটি কথাকে অস্থানে খণ্ডিত করতে হয় ব’লেই বোধ হয় সমালোচক ছন্দঃপাত কল্পনা করেছেন। ভাগ করে দেখাই —
নৃত্য। শুধু বি । লানো লা । বণ্য ছন্দ।
আসলে “বিলানো’ কথাটাকে দুভাগ করলে কানে খটকা লাগে।
নৃত্য শুধু লাবণ্যবিলানো ছন্দ
লিখলে কোনোরকম আপত্তি মনে আসে না, অর্থহিসাবেও স্পষ্টতর হয়। ঐ কবিতায় যে-লাইনে তোমার ছন্দের অপরাধ ঘটেছে সেটা এই —
সংগীতসুধা নন্দনে (র) সে আলিম্পনে।
ভাগ করে দেখো —
সংগী । ত সুধা । নন্দ । নের সে আ । লিম্পনে।
যদি লিখতে —
সংগীতসুধা নন্দনেরি আলিম্পনে
তাহলে ছন্দের ত্রুটি হত না।
যাক। তারপরে “ঐকান্তিকা।’ ওটা প্রাকৃত ছন্দে লেখা। সে ছন্দের স্থিতিস্থাপকতা যথেষ্ট। মাত্রার ওজনের একটু-আধটু নড়চড় হলে ক্ষতি হয় না। তবুও নেহাত ঢিলেমি করা চলে না। বাঁধামাত্রার নিয়মের চেয়ে কানের নিয়ম সূক্ষ্ম; বুঝিয়ে বলা বড়ো শক্ত, কেন ভালো লাগল বা লাগল না। “ঐকান্তিকা’র ছন্দটা বন্ধুর হয়েছে সে-কথা বলতেই হবে। অনেক জায়গায় দূরান্বয়ের জন্যে এবং ছন্দের বিভাগে বাক্য বিভক্ত হয়ে গেছে ব’লে অর্থ বুঝতে কষ্ট পেয়েছি। তন্ন তন্ন আলোচনা করতে হলে বিস্তর বাক্য ও কাল-ব্যয় করতে হয়। তাই আমার কান ও বুদ্ধি অনুসরণ করে তোমার কবিতাকে কিছু কিছু বদল করেছি। তুমি গ্রহণ করবে এ আশা করে নয়, আমার অভিমতটা অনুমান করতে পারবে এই আশা করেই।
১ কার্তিক, ১৩৩৬