1 of 2

চিঠিচুরি – পাঁচকড়ি দে

চিঠিচুরি – পাঁচকড়ি দে

যখন শ্রীমান অক্ষয়কুমারকে প্রবেশিকার দ্বার-সম্মুখে উপনীত দেখিয়া ক্রুদ্ধা সরস্বতী দুই হস্ত আন্দোলন করিয়া তাহাকে দুই-দুই বার বিতাড়িত করিলেন, তখন শ্রীমানও মা সরস্বতীর প্রতি একেবারে ভক্তিশূন্য হইয়া পড়িলেন। এবং পড়াশুনা বন্ধ করিয়া প্রায় তিন চারিটি বৎসর বাটীতে বসিয়া অতিবাহিত করিলেন।

সংসারের ভার দাদার স্কন্ধে ছিল, সুতরাং সংসারের ভাবনা অক্ষয়কে কিছুমাত্র ভাবিতে হইত না। এই তিন চারিটি বৎসর হাসিয়া খেলিয়া, বেড়াইয়া, গল্প করিয়া তাহার পরম নির্বিঘ্নে কাটিয়া গেল।

বহুদিন পূর্বে পিতার কাল হইয়াছিল, তখন অক্ষয়ের বয়স আট বৎসর মাত্র। অক্ষয়ের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বিনয়কুমার বয়সে অক্ষয়ের অনেক বড়, তখন তাঁহার বয়ঃক্রম পঞ্চবিংশতি বৎসর; তিনি চিকিৎসাবিদ্যায় কৃতবিদ্য হইয়া কিছু কিছু উপার্জন আরম্ভ করিয়াছিলেন। তাঁহার যত্নে স্নেহে অষ্টমবর্ষীয় শ্ৰীমান অক্ষয়কুমার লালিত পালিত এবং কিঞ্চিৎ শিক্ষিত হইয়া এখন দ্বাবিংশ বৎসরে পদার্পণ করিয়াছে। জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠের শিক্ষার জন্য অনেক চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কনিষ্ঠ স্কন্ধে ভারস্থাপন করিয়া নিশ্চিন্ত হইলেন। বলা বাহুল্য জ্যেষ্ঠ সে জন্য যথেষ্ট মনঃক্ষুণ্ণ হইলেন।

যখন বিদ্যাশিক্ষা সম্বন্ধে হস্তপদ ধৌত করিয়া অক্ষয়কুমার উঠিয়া বসিলেন, তখন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ডাক্তার বিনয়কুমারের পসার এমন অপরিসীম হইয়া উঠিল যে মস্তক কণ্ডূয়নের অবসরও তাঁহার ঘটিয়া উঠিত না। সুতরাং বেকার অক্ষয়কুমারের সম্বন্ধে কোন চিন্তা তাঁহার হৃদয়ে স্থান পাইত না। দিনে দিনে মাস—মাসে মাসে বৎসর অজ্ঞাতবাসে কাটিতে লাগিল।

কিন্তু শেষে বসিয়া বসিয়া অক্ষয়কুমারের দিন আর কাটে না। যখন বিদ্যালয়ে গমনাগমন ছিল তখন দিনগুলো এত শীঘ্র কাটিয়া যাইত যে, খেলা করিবার সময় না পাইয়া অক্ষয় সাতিশয় বিস্মিত হইত। কিন্তু এখন এক-একটা ঘণ্টাকে দিনের মত দীর্ঘ হইতে দেখিয়া ততোধিক বিস্মিত হইল এবং এখন তাহা তাহার পক্ষে অত্যন্ত অসহ্য বোধ হইতে লাগিল। তখন অক্ষয়কুমার স্বয়ং এক নূতন উপায় উদ্ভাবন করিল। প্রথমে রেনল্‌ড্‌স্‌-রচিত ইংরেজি উপন্যাসগুলি কিনিয়া কিনিয়া পাঠ করিতে লাগিল, তখন পুনরপি খঞ্জপায়ে-হাঁটা দিনগুলি অশ্বারোহণে সবেগে ধাবিত হইতে লাগিল। পড়িয়া পড়িয়া যখন রেন‌ল্‌ড্‌সে অরুচি ধরিল, তখন চিত্তোত্তেজক ডিটেকটিভ স্টোরি পাঠে মনোনিবেশ করিল। পাঠকালে গল্প-লেখকদিগের অদ্ভুত কল্পনার অসাধ্যসাধক ডিটেকটিভদিগের অসম্ভব কার্যকলাপে অক্ষয়কুমারের মন তন্ময় হইয়া উঠিত; এবং তাহাদিগের অলৌকিক চরিত্র প্রত্যেক পৃষ্ঠায় অক্ষয়ের হৃদয়ে অতুল মহিমাময় ও গৌরবময় বলিয়া অনুভূত হইত। তখন নিজের ভবিষ্যৎ ঠিক করিতে তাহাকে আর বিশেষ চেষ্টা করিতে হইল না। মনে মনে স্থির করিল, যেমন করিয়া হউক, পুলিশ বিভাগে ঢুকিতে হইবে।

যখন মনের এই আগ্রহটা একান্ত অদম্য হইয়া উঠিল, তখন একদিন অক্ষয়কুমার দাদাকে সুযোগমত নিরিবিলি পাইয়া, তাঁহার নিকট অত্যন্ত উৎসাহের সহিত সেই প্রস্তাব করিল; এবং তদ্বিষয়ে তাঁহার মতামত জানিতে চাহিল।

দাদা বিনয়কুমার প্রথমে সাতিশয় বিস্ময়ের সহিত কথাটা শুনিলেন এবং ভ্রাতার মুখের দিকে আকুলভাবে চাহিয়া রহিলেন। এমন কি তখন তাঁহার নিজের চক্ষু কর্ণকে বিশ্বাস করিতে প্রবৃত্তি রহিল না। অনেকক্ষণ পরে কহিলেন, ‘অকু, কি হইয়াছে বল্‌ দেখি? ডিটেকটিভের কথা কি বলিতেছিস?’

দাদার মুখের ভাব দেখিয়া মনের ভাব বুঝিতে অক্ষয়ের কিছুমাত্র বিলম্ব হইল না। জড়িত কণ্ঠে কহিল, ‘মনে করিতেছি, ডিটেকটিভের কাজ করিব—কত দিন আর বসিয়া বসিয়া কাটাইব।’

এবার দাদা যেন আকাশ হইতে পড়িলেন; চক্ষু কপালে তুলিয়া বলিলেন, ‘ডিটেকটিভের কাজ! আমার ভাই হইয়া তুই পুলিশের কাজ করিবি?’

অক্ষয় মৃদু হাস্যে বলিল, ‘হুঁ, আমার অত্যন্ত ইচ্ছা হইয়াছে, আপনি কি বলেন?’

দাদা কিছুই বলিলেন না, স্তম্ভিতবৎ তাহার মুখের দিকে অবাঙ্মুখে চাহিয়া রহিলেন। দাদাকে সেইরূপ ভাবে নিজের দিকে চাহিতে দেখিয়া অক্ষয়কুমার বলিতে লাগিল, ‘দেখুন, দাদা, আমি যদি বেশ কাজের লোক হইতে পারি, এ কাজে বেশ উপায় আছে! এমন কি, তাহা হইলে পুলিশের কাজ ছাড়া বাহির হইতেও দুই-একটা সন্ধান সুলুকের কাজ মধ্যে মধ্যে সংগ্রহ করিয়া বেশ উপায় করিতে পারিব, এমন মনে হয়। তাহা ছাড়া আর কি করিব? এই তো কত দিন বাড়িতে বসিয়া রহিয়াছি, নিজের তেমন টাকা নাই যে কোন একটা ব্যবসায় করিব, আর আমি যেরূপ কাজের লোক, আপনি তাহা সবিশেষ জানেন, তাহাতে কোন ব্যবসায়ের জন্য যে আপনি আমাকে কিছু টাকা বিশ্বাস করিবেন, সে বিশ্বাস আমার আদৌ নাই। যাহাই হোক, ডিটেকটিভগিরি কাজের জন্য আমার মনে অত্যন্ত আগ্রহ হইয়াছে—যাহার যে কাজে বিশেষ আন্তরিকতা এবং আগ্রহ থাকে, সে অধিকাংশ স্থলেই সেই কাজে যথেষ্ট উন্নতি করিতে পারে। আমারও মনে হয়, একদিন হয়তো আমিও মাথা তুলিয়া উঠিতে পারিব।’

বিনয়কুমার কহিলেন, ‘বাড়িতে বসিয়া বসিয়া তোর মাথাটা যেরূপ বিগড়াইয়া গিয়াছে দেখিতেছি, তাহাতে ও মাথা আর কোন কালে খুলিবে না। নতুবা আমার ভাই হইয়া তোর এমন নীচ প্রবৃত্তি! তোর মনের যে এমন একটা দুর্গতি হইবে, তা আমি স্বপ্নেও একবার ভাবি নাই।’

অক্ষয়কুমার বিষন্নভাবে কহিল, ‘তবে দাদা, আপনি যদি—’

বাধা দিয়া হস্ত ও মস্তক যুগপৎ আন্দোলন করিয়া দাদা বলিলেন, ‘এখন যা, এখন যা—আর কোন কথা শুনিতে চাই না, আর কোন কথা নয়।’

এই বলিয়া ডাক্তার বিনয়কুমার একখানি ইংরেজী সংবাদপত্র টানিয়া লইয়া পড়িতে আরম্ভ করিলেন; আর কোন কথা না কহিয়া অক্ষয়কুমার ধীরে ধীরে নিঃশব্দে ঘরের বাহির হইয়া গেল।

ভাই তাহার দাদার মন জানিত, বুঝিতে পারিল, যখন দাদা একবার ‘না’ বলিয়াছেন, তখন দৈবানুগ্রহ ব্যতিরেকে ‘হ্যাঁ’ হইবার সম্ভাবনা একেবারে নাই।

পরদিন সায়াহ্নে অক্ষয়কুমার বেড়াইতে বাহির হইবার উদ্যোগ করিতেছে, এমন সময়ে পুরাতন ভৃত্য বৃদ্ধ বংশী আসিয়া সংবাদ দিল, ‘বড়বাবু আপনাকে একবার ডাকিতেছেন। তিনি বাহিরের ঘরে আছেন।’

অক্ষয় কহিল, ‘হঠাৎ আমাকে ডাক পড়িল কেন? কি হইয়াছে?’

বংশী কহিল, ‘কি জানি কি হইয়াছে, বাবু; তিনি রাগিয়া একেবারে আগুন হইয়া উঠিয়াছেন।’

অক্ষয়কুমার কহিল, ‘দাদার রাগের কথা আমি বেশ জানি, একটু কিছুতেই বাড়ি মাথায় করিতে থাকেন। আচ্ছা, আমি এখনই যাইতেছি।’

অক্ষয়কুমার তাড়াতাড়ি দাদার সহিত দেখা করিতে চলিল। এবং যেমন সে দ্বিতলের সোপানাবতরণ আরম্ভ করিয়াছে, কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া ডাক্তার বিনয়কুমারের একমাত্র পুত্র দশম বর্ষীয় সুশীল এক হাতে কাকার জামা টানিয়া ধরিল, তাহার অপর হস্তে একটা প্রকাণ্ড লাটাই ও একখানা তদধিক প্রকাণ্ড ঘুড়ি। ঘুড়িখানার দুই-এক জায়গায় ছিঁড়িয়া গিয়াছে—সংস্কার প্রয়োজন।

নৃত্যভঙ্গি সহকারে সুশীল আবদার করিয়া বলিতে লাগিল, ‘কাকাবাবু, আমার ঘুড়ি উড়িয়ে দেবে, এস না, মা আমার ঘুড়ি ছিঁড়ে দিয়েছে, তুমি চল না, কাকাবাবু, আমার ঘুড়ি উড়িয়ে দেবে।’

অক্ষয়কুমার প্রবোধ দিয়া বলিল, ‘তাই তো, আজ একবার ঘুড়ি উড়াইতে হইবে বৈকি। কিন্তু এখন নয়, এখন ছাদে বড় রোদ।’ বলিতে বলিতে সবেগে অক্ষয়কুমার সিঁড়ি হইতে নামিয়া গেল।

তাড়াতাড়ি দাদার ঘরে গিয়া যাহা দেখিল, তাহাতে অক্ষয়কুমার সহজেই হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিল যে, আজ একটা কিছু বেশি রকমের দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে। দাদা একবার চেয়ার ঠেলিয়া উঠিতেছেন, একবার টানিয়া বসিতেছেন, উঠিয়া বসিয়া কিছুতেই তিনি চিত্ত স্থির করিতে পারিতেছেন না।

দাদাকে অক্ষয়কুমার যেমন অতিশয় ভক্তি করে, তেমনি আবার তদপেক্ষা ভয়ও করে। দাদার সেইরূপ ভাব দেখিয়া সে প্রথমে কথা কহিতে পারিল না। তাহার পর কিছু সাহস সংগ্রহ করিয়া বলিল, ‘বংশীর মুখে শুনিলাম, আপনি আমাকে ডাকিয়াছেন।’

বিনয়কুমার কহিলেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তাহাই বটে, তা এত দেরি হইল? বড়ই আশ্চর্য ব্যাপার অকু, বড়ই আশ্চর্য ব্যাপার। কেবল আশ্চর্য ব্যাপার নয়, একেবারে সর্বনাশ হইয়া গিয়াছে, এই টেবিলের উপরে একখানা কাগজ—কাগজ কেন? একখানা গোপনীয় চিঠি রখিয়াছিলাম, সেখানা এখন কোথায় গেল, কিছুতেই খুঁজিয়া পাইতেছি না।’

‘কখন রাখিয়াছিলেন?’

‘এইমাত্র।’

‘দাদা, আমি আপনার কথা ভাল বুঝিতে পারিলাম না।’

‘কথাটা আমি বুঝাইয়া বলিতেছি।’ বলিয়া বিনয়কুমার বলিতে লাগিলেন, ‘কাল তুই ডিটেকটিভ্‌গিরি কাজ শিখিবার জন্য আমার মতামত জানিতে আসিয়াছিলি, আজ থেকে আমার সেই চিঠিখানার ডিটেকটিভগিরি কর দেখি। তোর মনের ধারণা, পুলিশের কাজে তুই মাথা তুলিয়া একজন বেশ পাকা নামজাদা ডিটেকটিভ হইতে পারিবি; আজ আমার চিঠিখানা খুঁজিয়া বাহির করিয়া দিলে তোর সে ধারণা যে কতদূর সত্য, বেশ বুঝিতে পারিব। আর তোর বিদ্যাদুদ্ধির কতদূর দৌড়, জানা যাইবে।’

অক্ষয়কুমার সাভিনিবেশ অনুসদ্ধিৎসু দৃষ্টিতে ক্ষণকাল দাদার মুখের দিকে চাহিয়া বুঝিতে পারিল, তাঁহার তখনকার সে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা মিথ্যা নহে। বরং তিনি তাহা ঢাকিবার জন্য সবিশেষে চেষ্টা করিতেছেন।

বিনয়কুমার বলিলেন, ‘ঝি ডাকিতে আসিলে, পত্রখানা টেবিলের উপর রাখিয়া একবার বাড়ির ভিতরে উঠিয়া গিয়াছিলাম।’

অ। পত্রখানিতে কি লেখা ছিল?

বি। যাহাই লেখা থাকুক না কেন, সে কথায় দরকার কি? বিশেষ গোপনীয় পত্র, যে লোকের পত্র সে কিম্বা আমি ছাড়া আর কাহারও নজরে যদি সে পত্রখানা পড়ে, তাহা হইলে আমাকে ভয়ানক বিপদে পড়িতে হইবে, এমনকি তাহা হইলে আমার মান সম্ভ্রম আর কিছুতেই থাকিবে না, একেবারে সকল দিকে সর্বনাশ ঘটিবে।

অ। কে আপনাকে সে পত্র লিখিয়াছিলেন?

বি। কেহ লেখেন নাই—আমিই কোন লোককে লিখিতেছিলাম। লিখিয়া প্রায় শেষ করিয়া আনিয়াছিলাম, এমন সময় ঝি আমাকে ডাকিতে আসিয়া এই গোল বাধাইয়া দিল।

অ। কোন ঝি আপনাকে ডাকিতে আসিয়াছিল?

বি। মঙ্গলা, তাহার উপর সন্দেহ করিবার কোন কারণ দেখি না। আমি যখন এখান হইতে উঠিয়া যাই, তখন সে আমার সঙ্গে সঙ্গে উপরে গিয়াছিল। উপরের শোবার ঘরে এখনও সে কাজ করিতেছে—নিচে নামে নাই।

অ। কতক্ষণ আপনি এখানে অনুপস্থিত ছিলেন?

বি। দশ মিনিট? দশ মিনিটও হইবে না। সেই পত্রখানা টেবিলের উপর ফেলিয়া গিয়াছিলাম বলিয়া, আমি আরও তাড়াতাড়ি এই ঘরে ফিরিয়া আসি।

অ। যাইবার সময় কি আপনি দরজা বন্ধ করিয়া গিয়াছিলেন?

বি। হ্যাঁ, ফিরিয়া আসিয়াও আমি সেইরূপ বন্ধ থাকিতে দেখিয়াছিলাম।

অ। পত্রখানি ছাড়া কি আর কোন জিনিস চুরি গিয়াছে?

বি। আর কিছু না, আর কোন জিনিসে কেহ হাত দেয় নাই। এমনকি টেবিলের উপরে যেখানে যে জিনিসপত্র যেমন ভাবে থাকিতে দেখিয়া গিয়াছিলাম, ফিরিয়া আসিয়া ঠিক তেমনই দেখিয়াছি।

অ। টেবিলের উপর ঠিক কোন স্থানে আপনার চিঠিখানি ছিল?

বি। ব্লটিং প্যাডের উপরে ছিল। মঙ্গলা যখন আমাকে ডাকিতে আসে, তখন আমি লিখিতেছিলাম, যাইবার সময় ব্লটিং প্যাডের উপর চিঠিখানা চাপিয়া, উঠিয়া যাই।

অ। আপনি বেশ জানেন যে, উঠিয়া যাইবার সময় চিঠিখানা ব্লটিং প্যাডের উপর চাপিয়া গিয়াছিলেন?

বি। না, সে কথা আমি এখন ঠিক বলিতে পারি না। আমার এখন তাহা ঠিক মনে পড়িতেছে না।

অ। মঙ্গলা কি আপনাকে সেই চিঠি লিখিতে দেখিয়াছিল?

বি। দেখিয়াছিল; সে যখন ঘরের ভিতরে আসিয়াছিল, তখন, সে অবশ্যই দেখিয়াছিল। কিন্তু আমি কি লিখিতেছি, কি না লিখিতেছি, সে কি করিয়া জানিবে? আমি পূর্বেই বলিয়াছি, তাহার উপর সন্দেহ করিবার কোন কারণ নাই।

অ। তাহাকে আমি কোন সন্দেহ করিতেছি না। আপনি এরকম একখানা গোপনীয় চিঠি এ সময়ে লিখিবেন, এ কথা বাড়ির আর কেহ জানেন?

বি। কেহ না—কেহ না—জনপ্রাণীও না।

বলিতে বলিতে ডাক্তার বিনয়কুমারের উদ্বেগ ক্ষোভ যুগপৎ সীমাতিক্রম করিয়া উঠিল, ‘যেমন করিয়া হউক পত্রখানি সন্ধান করিয়া বাহির করিতে হইবে। এমন বিপদে আমি আর কখনো পড়ি নাই। তোর উপরই চিঠিখানার সন্ধান করিবার ভার রহিল।’

অ। দাদা, আপনি আমার উপরে নির্ভর করিয়া নিশ্চিন্ত হইতে পারেন। আপনার সে চিঠিখানার একটা প্রতিকার না করিয়া আমি ছাড়িব না। এখন বলুন দেখি, যখন আপনি এখানে অনুপস্থিত ছিলেন, তখন আর কোন লোক কোন কারণে এ ঘরে ঢুকিয়াছিল কি না, সে সন্ধান লইয়াছেন কি?

বি। সে সন্ধান আমি আগেই লইয়াছি। বংশীকে জিজ্ঞাসা করায়, সে বলিল, ‘আমি খুব জানি বাবু, আপনার ঘরে আর কেহ যায় নাই।’

অ। বংশী আর কি বলিল?

বি। আর কিছু নয়। কেন, তাহার উপর কোন সন্দেহ হয় না কি?

অ। না, তাহাকে আমি সন্দেহ করিতেছি না, বংশীকে আমি খুব ভাল জানি। সে আমাকে বুকে পিঠে করিয়া মানুষ করিয়াছে। কিন্তু, সে কিরূপে এমন নিশ্চয় করিয়া বলিল যে, আপনার এ ঘরে তখন আর কেহ প্রবেশ করে নাই?

বি। তখন সে এই সামনের ঘরে কাজ করিতেছিল। আমার ঘরে কেহ ঢুকিলে সে অবশ্যই তাহাকে দেখিতে পাইত। বিশেষত এ ঘরের দরজাটা ঠেলিয়া খুলিবার সময় এক প্রকার শব্দও হয়।

অ। তাহা যেন হইল। কিন্তু দরজা দিয়া না আসিয়া কেহ যদি জানালা দিয়া আসিয়া থাকে, সে সম্বন্ধে আপনি কি বলেন?

বি। জানালা এখন যেমন খোলা আছে, তখনও এমনি খোলা ছিল। জানালা দিয়া কেহ আসে নাই। জানালাগুলি অনেক দিনের পুরাতন হইলেও গরাদেগুলি এখনও বেশ মজবুত আছে।

অক্ষয়কুমার তথাপি নিজে একবার প্রত্যেক গরাদেটি পরীক্ষা করিয়া দেখিল—দাদার কথা সত্য।

অনন্তর অক্ষয়কুমার দাদার নিকট ফিরিয়া আসিয়া দাঁড়াইল। সেই সময়ে উপরিস্থিত কোন একটি দ্রব্যের উপর তাহার নজর পড়িল। চকিতে সেই দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল, ‘এ কি এ?’

বিনয়কুমার সেই দিকে চাহিয়া দেখিলেন। দেখিলেন, টেবিলের এক পার্শ্বে গঁদ বা তৈলের মত কি একটু লাগিয়া রহিয়াছে। বলিলেন, ‘কি জানি বলিতে পারি না। যখন আমি উঠিয়া যাই, কই, তখন ইহা ছিল না। বোধ হয় কোন আটা হইবে।’

অক্ষয়কুমার দাদার রিডিংল্যাম্প লইয়া অবনত দেহে ভূন্যস্তজানু হইয়া সেই তৈলবৎ পদার্থটি বিশেষ করিয়া পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিল। ক্ষণেক পরে উঠিয়া বলিল, ‘দাদা, আপনার কথাই ঠিক, গঁদের আটা। এখন আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি, কিরূপে আপনার পত্র চুরি গিয়াছে; বাঁখারিতে গঁদের আটা মাখাইয়া কেহ জানালার বাহির হইতে চিঠিখানা তুলিয়া লইয়াছে। হয়তো কোন লোকের পরামর্শে কেহ এই কাজ করিয়া থাকিবে।’

বিনয়কুমার নির্নিমেষনেত্রে ক্ষণেক নীরবে অক্ষয়ের মুখের দিকে চাহিয়া পরে বলিলেন, ‘কে এমন কাজ করিবে? কাহাকে তোমার সন্দেহ হয়? সেই চিঠিখানাই যে ঠিক সেই সময়ে টেবিলের উপর পড়িয়া থাকিবে, সে কিরূপেই বা জানিতে পারিল? এমন অনেক দিন অন্যান্য পত্রও তো টেবিলের উপর পড়িয়া থাকে। আজ আমি ঠিক ওই চিঠিখানিই লিখিব, লিখিতে লিখিতে হঠাৎ ফেলিয়া উঠিয়া যাইব, এ সকল কে আগে জানিতে পারিবে, এ কথা ঠিক নহে।’

অক্ষয়কুমার কহিল, ‘আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা ঠিক। সে যাই হোক, যেমন করিয়া পারি, আমি আপনার চিঠিখানি সন্ধান করিয়া বাহির করিবই; আপনার কি বেশ মনে হয় যে, আপনি এই টেবিলের উপরেই চিঠিখানি ফেলিয়া গিয়াছিলেন?’

বিনয়কুমার বলিলেন, ‘হ্যাঁ, আমার এখন মনে পড়িতেছে, যেন যাইবার সময় আমি তাড়াতাড়ি চিঠিখানি ব্লটিংপ্যাডের উপর উলটাইয়া দুই একবার চাপিয়া রাখিয়া যাই।’

অক্ষয়কুমার কিছুক্ষণ নীরবে কি ভাবিতে লাগিল। তাহার পর বলিল, ‘যদি আমি আপনার চিঠিখানি খুঁজিয়া বাহির করিয়া দিই দাদা, আমাকে আপনি কি পুরস্কার দিবেন, বলুন দেখি? সে চিঠি কেহ পড়ে নাই, আপনি ভিন্ন আর কেহ তাহার মর্ম জানিবে না, এইরূপ অবস্থায় সে পত্র আপনি ফিরিয়া পাইবেন।’

বিনয়কুমার বলিলেন, ‘তাহা হইলে তুই জানিস, সে চিঠিখানা কোথায়।’

অক্ষয়কুমার বলিল, ‘কিছুই না। আপনার মত আমি এখনও অন্ধকারেই আছি। তথাপি আমি একবার চেষ্টা করিয়া দেখিব, আপনার এই অপহৃত পত্রের ডিটেকটিভগিরি করিয়া কিছু করিতে পারি কি না। আপনার অপহৃত পত্রের পুনরুদ্ধারের ভার আমার উপরেই রহিল। যদি আমি আপনাকে আমার ডিটেকটিভ বুদ্ধির প্রকৃষ্ট পরিচয় দিতে পারি, বলুন, আপনি কি পুরস্কার দিবেন? আমি আর কোন পুরস্কার চাই না। বলুন আমাকে পুলিশলাইনে ঢুকিতে আপনি সম্মতি দিবেন?’

বিনয়কুমার অপরিসীম আগ্রহের সহিত বলিলেন, ‘তাহা হইবে, সেই চিঠির মর্ম. আর কেহ না জানিতে পারে, এমন অবস্থায় যদি তুই চিঠিখানি আনিয়া আমার হাতে দিতে পারিস, তাহা হইলে আমি যে তোকে কেবল পুলিশ-কর্মচারী হইতে সম্মতি দিব—তা নয়, তোর এই প্রথম ডিটেকটিভগিরির ফি বা পারিশ্রমিক স্বরূপ তোকে আরও আড়াই শত টাকা দিব। দেখি, তোর ডিটেকটিভ বুদ্ধির দৌড় কত।’

‘আমিও দেখি, আপনার পত্রখানার কোন কিনারা করিতে পারি কি না।’ এই বলিয়া অক্ষয়কুমার গমনোদ্যত হইল।

বাধা দিয়া বিনয়কুমার বলিলেন, ‘তাড়াতাড়ি কোথায় যাইতেছিস—সে চিঠি কোথায় আছে?’

অক্ষয় উপন্যাসের ডিটেকটিভদের ন্যায় কৌতূহলোদ্দীপক গম্ভীরভাবে কহিল, ‘এখন আমার কাছে কোন কথা পাইবেন না। সেজন্য আমাকে ক্ষমা করিবেন; যদি আমি কৃতকার্য হই, তখন সকল কথাই আপনাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ করিয়া বলিব।’

বলিতে বলিতে অক্ষয়কুমারের প্রস্থান।

অক্ষয়কুমার চলিয়া গেলে, তাহার দাদা অনেকক্ষণ ধরিয়া সে অপহৃত পত্রের সন্ধানে বহু ইতস্তত করিলেন। কোন ফল হইল না। ঘর্মাক্ত কলেবরে ঘরের বাহির হইয়া দ্বারে চাবি লাগাইলেন এবং বাড়ির ভিতরে চলিয়া গেলেন।

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইলে বিনয়কুমার শয়নগৃহ হইতে বাহির হইলেন এবং সেই সময়ে বংশীকে সম্মুখে দেখিতে পাইয়া—যেন বংশী আজ বধির, এমন অপরিমিত উচ্চকণ্ঠে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি রে বংশী, ছোটবাবু গেল কোথা রে?’

বংশী বলিল, ‘কই, বাড়িতে নাই, বোধ হয় বাহিরে গেছেন।’

বিনয়কুমার বিরক্ত হইয়া পূর্ববৎ কণ্ঠে কহিলেন, ‘বাহিরে কোথায়?’

বংশী কহিল, ‘তা বাবু, আমি ঠিক বলিতে পারি না, এই কতক্ষণ আগে তিনি বাহির বাড়ির উঠানে বেড়াইতেছিলেন।’

বিনয়কুমার ভিতর-বাটী হইতে, পুনরপি বাহিরে ঘরে আসিয়া বসিলেন। ঘরের ভিতরে সকল স্থান তন্ন-তন্ন করিয়া দেখা হইয়াছে, সুতরাং পত্রের সন্ধানে পরিশ্রম স্বীকারের আর তিনি কোন আবশ্যকতা দেখিলেন না। একখানা চেয়ারের উপর করতললগ্নশীর্ষ হইয়া বসিলেন এবং আপন মনে বলিতে লাগিলেন, ‘কি আপদ, আমি অকুর কথায় নির্ভর করিয়া নিশ্চিন্ত আছি, আমার মত এমন নির্বোধ আর দুটি নাই! যে চিঠি চুরি করিয়াছে, সে এতক্ষণে তিনক্রোশ তফাতে চলিয়া গিয়াছে। কি সর্বনাশ! চিঠিখানির জন্য আমার মানসম্ভ্রম সকলই নষ্ট হইবে, দেখিতে পাই। যেমন করিয়া হোক, চিঠিখানি আমার পাওয়া চাই। কি করি, আর নিশ্চিন্ত থাকিলে চলিবে না। এখনই আমি একজন ভাল ডিটেকটিভের জন্য টেলিগ্রাফ করিব।’ এমন সময়ে বাহিরে কাহার পদশব্দ শুনিতে পাইলেন। মাথা তুলিয়া উচ্চকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কে ওখানে?’

‘আমি।’

বিনয়কুমার চাহিয়া দেখিলেন, সম্মুখে ঈষদুন্মুক্ত দরজায় কড়ার উপর হাত রাখিয়া অক্ষয়কুমার দাঁড়াইয়া। দেখিয়া বিনয়কুমার আরও বিরক্ত হইলেন। বলিতে লাগিলেন, ‘দেখ অক্ষয়, আমি এখন বেশ বুঝিতে পারিতেছি, তোর কথার উপর নির্ভর করিয়া আমি ভাল কাজ করি নাই। ব্যাপারটা বড় সহজ নহে, এমনকি চিঠিখানা যদি না পাওয়া যায়, আমার মানসম্ভ্রম সকলই যাইবে। আমি লোকের কাছে মুখ দেখাইতে পারিব না। তোর নিজের অপেক্ষা তোর বুদ্ধিবৃত্তির উপর আমার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি, সে সম্বন্ধে কোন কথা তোর কাছে এখন প্রকাশ করিয়া আমি তোকে নিরুদ্যম করিতে চাহি না। আমি মনে করিতেছি, কোন একজন ভাল ডিটেকটিভের জন্য টেলিগ্রাফ করিব।’

সেই ভাবে দরজার বাহিরে দাঁড়াইয়া মৃদুহাস্যের সহিত অক্ষয়কুমার বলিল, ‘মন্দ কি দাদা, আপনি যাহা ভাল বুঝিবেন, তাহাই করিবেন। কিন্তু আমি জানিতে চাই, আপনি সেই চিঠিখানা পাইবার পূর্বে না পরে টেলিগ্রাফ করিবেন?’

‘এ আবার কি কথা—আমি বুঝিলাম না।’

‘প্রকৃত কথা—সেই চিঠিখানা পাওয়া গিয়াছে।’

‘পাওয়া গিয়াছে! সত্য না কি!’ বলিতে বলিতে বিস্ময়স্তম্ভিত বিনয়কুমার, চেয়ারে বসিয়াছিলেন, আরও বসিয়া গেলেন। তাহার পর একেবারে সবেগে উঠিয়া দাঁড়াইয়া ব্যগ্রকণ্ঠে বলিলেন, ‘কই সে চিঠি? কে চুরি করিয়াছিল?’

অক্ষয়কুমার কহিল, ‘আপনার চিঠি আপনি নিজে চুরি করিয়াছিলেন।’

‘আমি চুরি করিয়াছি! অকু, এখন আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি যে পূর্বজন্মকৃত মহাপাতকের ফলেই আমি তোর দাদা হইয়াছি। তুই আমার সামনে দাঁড়াইয়া আমার অপমান করিস্!’ বলিতে বলিতে অতি দুঃখিতভাবে বিনয়কুমার একখানা চেয়ার টানিয়া পুনরুপবেশন করিলেন।

অক্ষয়কুমার কহিল, ‘দাদা, আপনি আমার উপর রাগ করিবেন না, আমি সত্য কথাই বলিয়াছি।’

বিনয়কুমার আরও রাগিয়া উঠিয়া, রাগে-দুঃখে মহা-খাপ্পা হইয়া বলিলেন, ‘আমি চোর? তুই আমার সামনে থেকে এখনই সরে যা।’ মুখভঙ্গি সহকারে ‘সত্য কথা বলিয়াছি! সরে যা, চালাকি করিবার জায়গা নাই বটে! তুই না আমার সহোদর ভাই! ভাল, সে চিঠি যদি পাওয়া গিয়াছে, কই নিয়ে আয় দেখি।’

‘এই দেখুন আপনার সেই চিঠি।’ বলিয়া অক্ষয়কুমার দরজাটা সম্পূর্ণভাবে উন্মুক্ত করিয়া বলিল, ‘সুশীল, একবার আমার সঙ্গে ঘরের ভিতরে এস তো।’

সুশীল এতক্ষণ বাহিরে দাঁড়াইয়াছিল। এখন অক্ষয়কুমারের সহিত সে সভয়ে পিতার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার বামহস্তে একটা মস্ত লাটাই, এবং দক্ষিণহস্তে তেমনি এক প্রকাণ্ড ঘুড়ি, এবং সেই প্রকাণ্ড ঘুড়িখানায় তদধিক প্রকাণ্ড একটা লেজুড়—ভূলুণ্ঠিত হইতেছে। অক্ষয়কুমার তাহার হাত হইতে ঘুড়িখানা লইয়া দাদার সম্মুখে ধরিয়া বলিল, ‘এই দেখুন, আপনার সেই পত্র।’

তাড়াতাড়ি চশমাখানি চোখে লাগাইয়া বিস্ময়পূর্ণ দৃষ্টিতে ঘুড়ির দিকে চাহিতে চাহিতে বিনয়কুমার বলিলেন, ‘কই, সে পত্র কই?’

‘এই যে, দেখিতে পাইতেছেন না?’ বলিয়া অক্ষয়কুমার ঘুড়িখানা দাদার টেবিলের উপর ফেলিয়া দুইপদ পশ্চাত হটিয়া দাঁড়াইল। অক্ষয়কুমারের ভয় হইয়াছিল, এইবার বুঝি সবেগে দাদার রুলটা তাহার মাথায় সশব্দে আসিয়া পড়ে। নিতান্ত নিরীহ দাদার রুল অনেকবার তাহার মাথায় পড়িয়াছে। কিন্তু দাদা আপাতত তাহা করিলেন না এবং ঘুড়ির দিকে চাহিয়াও দেখিলেন না। নিতান্ত মর্মভেদী কণ্ঠে বলিলেন, ‘দেখ অকু, তুই মনে মনে নিশ্চয় জানিস, অপরাপর লোকের ন্যায় তোর দাদারও সহ্যগুণের একটা সীমা আছে।’

অক্ষয়কুমার বলিল, ‘আপনার সহ্যগুণের সীমা আছে কি না, তাহাতে আমার কোন আবশ্যকতা নাই। আমি আপনাকে মিথ্যা বলি নাই।’ অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া: ‘ওই দেখুন, আপনার সেই পত্র রহিয়াছে। সুশীলের ঘুড়ির যে লম্বা লেজুড় দেখিতেছেন’—সুশীলের প্রতি—‘ঘুড়িটায় লম্বা লেজুড় লাগাইয়া দিতে ঘুড়িখানা কোনদিকে কান্নিক না টানিয়া বেশ উড়িতেছিল, না সুশীল?’ পুনরপি দাদার প্রতি: ‘সুশীল কাগজের লম্বা ফালিতে ঘুড়ির প্রকাণ্ড লেজুড় তৈয়ারি করিয়াছে, আপনি নিচের দিককার আধখানা লেজুড় কাটিয়া নিন। তাহা হইলেই আপনি আপনার সেই চুরি-যাওয়া পত্ৰখানা দেখিতে পাইবেন।’

বিনয়কুমার কহিলেন, ‘আর চালাকি করিতে হইবে না, তুই যা, আর আমার রাগ বাড়াসনি।’

অক্ষয়কুমার কহিল, ‘আপনি না কাটেন, আমি কাটিয়া দেখাইতেছি। পত্রখানা যে এখনও কেহ পড়ে নাই, আপনি নিজে কাটিয়া না দেখিলে তাহা বুঝিতে পারিবেন না বলিয়া, আমি ঘুড়ি এবং ঘুড়ির মালিককে সুদ্ধ আপনার সম্মুখে আনিয়াছি, নিজে কাটিতে সাহস করি নাই। এখন আপনার সম্মুখে আমি কাটিলে তেমন কোন দোষ হইবে না।’

দশ-বারো টুকরা কাগজের সরু সরু ফালিতে সুশীল সূতার গাঁট দিয়া তাহার ঘুড়ির মস্ত বড় একটা লেজুড় তৈয়ারি করিয়াছিল। অক্ষয়কুমার সেই লেজুড়ের নিচের দিককার অনেকটা অংশ কাটিয়া লইয়া সহাস্যমুখে দাদার হাতে দিল।

বিনয়কুমার সেই ঘুড়ির ছিন্ন লেজুড়টা উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিতে দেখিতে বলিতে লাগিলেন, ‘তাই তো—তাই তো—এ যে আমারই’—তখন তাঁহার মনের যেরূপ অবস্থা হইল, তাহা মুখে তিনি কিছুতেই প্রকাশ করিতে পারিলেন না—বলিতে বলিতে থামিয়া গেলেন। ক্ষণেক পরে সুশীলের প্রতি গর্জন করিতে করিতে চেয়ার হইতে লাফাইয়া উঠিলেন; বলিলেন, ‘পাজি ছেলে! এই চিঠিতে তুই হাত দিয়াছিলি কেন?’

অক্ষয়কুমার তাড়াতাড়ি দাদাকে ধরিয়া ফেলিল। বলিল, ‘সুশীলের উপর আপনি কেন রাগ করিতেছেন। সুশীল আপনার পত্র চুরি করে নাই। আপনি স্থির হইয়া বসুন—যাহা ঘটিয়াছে, সমুদয় আপনাকে বুঝাইয়া বলিতেছি।’ বলিয়া সুশীলের দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘সুশীল, এই তোর ঘুড়ি নে। তুই এখান থেকে যা। আমি একটু পরে গিয়া তোর ঘুড়ির আবার একটা এর চেয়ে খুব বড় লেজুড় করিয়া দিব।’

অক্ষয়কুমারের মুখের কথা শেষ হইতে না হইতে সুশীলচন্দ্র তাহার অগ্নিশর্মা পিতার ঘর থেকে ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল। সে এখনও নিজের ভয়ের কারণ ভালরকম বুঝিতে না পারিলেও, পিতার রুদ্রচণ্ড মূর্তি দেখিয়া যথেষ্ট ভীত হইয়াছিল। পলায়নপর সুশীলচন্দ্র দৃষ্টি বহির্ভূত হইয়া গেলে তাহার পিতা সেই পত্রের ছিন্ন টুকরাগুলি লইয়া অতি সন্তর্পণে নীরবে পর পর সাজাইতে লাগিলেন। মানসিক আনন্দাতিশয্যে তখনও কোন কথা তাঁহার মুখ দিয়া বাহির হইল না।

দাদাকে নীরব দেখিয়া অক্ষয়কুমার কহিল, ‘দাদা, এখন বোধ হয় আমি আপনার নিকট আমার প্রাপ্য পুরস্কারের দাওয়া করিতে পারি?’

দাদা কহিলেন, ‘অবশ্যই। আমি আরও আড়াই শত টাকা বেশি দিব।’ এই বলিয়া ড্রয়ারের ভিতর হইতে একখানা চেকবুক টানিয়া বাহির করিলেন। এবং চেক লিখিবার জন্য কলম কালি লইয়া প্রস্তুত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এ পত্র যে কেহ পড়ে নাই, তাহা কিরূপে বিশ্বাস করিব?’

অ। আপনি সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন, কেহই আপনার এ পত্র পড়ে নাই। যখন আমি প্রথম এ পত্রের সন্ধান পাইলাম, তখন দেখি ইহা আকাশমার্গে বিরাজ করিতেছে। আমি জানি আমি যে আপনার বিনানুমতিতে কোন কাজ করি না, সে বিশ্বাস আপনার খুব আছে। সুতরাং আমার সম্বন্ধে আপনাকে কোন কথা বলিতে হইবে না। বিশেষত সুশীল যেরূপভাবে পত্রখানি টুকরা টুকরা করিয়াছে, তাহাতে পুনরায় ঠিক করিয়া জুড়িয়া না লইলে এ পত্র কাহারো পাঠযোগ্য হইতে পারে না। সেইজন্য আমি ঘুড়িশুদ্ধ ঘুড়ির মালিককে আনিয়া আপনার কাছে হাজির করিয়া দিলাম। সে কথা যাক; যখন আপনার মুখে প্রথম শুনিলাম যে, আপনি আজ এই পত্রখানি লিখিবেন, তাহা কেহই জানে না, তখন আমি বুঝিতে পারিলাম আপনি উঠিয়া গেলে আপনার এ পত্র চুরি করিবার জন্য জানালা বা দরজা দিয়া কেহই ঘরের ভিতরে আসে নাই। এরূপ স্থলে এ চুরির জন্য আপনিই একমাত্র দায়ী, আর কেহ নহে।

‘তবে কি ভূতে চুরি করিতে আসিয়াছিল?’

অক্ষয়কুমার বলিতে লাগিল, ‘তাহার পর যখন টেবিলে ওই গঁদের দাগ দেখিতে পাইলাম, আপনার পত্রখানি কিরূপে অদৃশ্য হইয়াছে, তখন সেটা আর আমার বুঝিতে বাকি রহিল না।’

বি। কিন্তু আমি তো এখনও কিছু বুঝিতে পারিতেছি না।

অ। না পারিবারই কথা। কথাটা অতি সহজ। এখন যাহা আপনার ভোজবাজির মত নিতান্ত বিস্ময়জনক বোধ হইতেছে, কিন্তু ব্যাপারটা শুনিলে ইহাতে বিস্ময়ের বিন্দুমাত্র দেখিবেন না। ইতিপূর্বে আমি আপনার আলমারিতে গঁদের এই ভাঙা-ফাটা শিশিটা দেখিতে পাই। এই দেখুন, শিশির এই ফাটা মুখ দিয়া ঝরিয়া অনেকটা গঁদ আলমারিতেও পড়িয়াছে।

বি। হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক বটে, ওই আলমারি হইতে যখন ওই রিপোর্ট-বইখানা টানিয়া বাহির করিতে যাই, শিশিটা আমার পায়ের উপর পড়িয়া যায়। কিন্তু শিশিটা যে ফাটিয়া গিয়াছে, ব্যস্ত থাকায় তখন আমি তাহা অত লক্ষ্য করি নাই।

অক্ষয়কুমার কহিল, ‘তাহাই হইবে। যাই হোক, তাহার পর টেবিলের উপরও এই গঁদের দাগ দেখিয়া আমি বুঝিতে পারিলাম, যখন আপনি রিপোর্ট-বইখানা আলমারি হইতে টানিয়া বাহির করিতেছিলেন, সেই সময়ে হউক বা পরে যখন উহা পুনরায় যথাস্থানে রাখিতে যান, ওই গঁদ আপনার কামিজের আস্তিনে লাগিয়াছে। আপনি তাহা কিছু জানিতে পারেন নাই।’

এই বলিয়া অক্ষয়কুমার দাদার কামিজের দক্ষিণহস্তের আস্তিনটা ঘুরাইয়া ধরিল। বিনয়কুমার দেখিলেন, বাস্তবিক তাহাই বটে!

অক্ষয়কুমার বলিতে লাগিলেন, ‘তাহার পর যখন আপনি চিঠিখানি ব্লটিংপ্যাডের উপর উল্টাইয়া দুই-একবার ডান-হাত দিয়া চাপিয়াছিলেন, সেই সময়ে চিঠিখানা আপনার জামার আস্তিনের গঁদে লাগিয়া যায়। এবং বাড়ির ভিতরে যাইবার জন্য আপনি তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া পড়েন, সেজন্য চিঠিখানার উপর তখন আপনার নজর পড়ে নাই। তখন আমি মনে করিলাম, আপনার অজ্ঞাতসারে আস্তিন হইতে চিঠিখানা কোথায় খুলিয়া পড়িয়াছে, সন্ধান করিয়া দেখিতে হইবে। এই ঘরের ভিতরে যখন চিঠিখানা পড়ে নাই, তখন অবশ্যই বাহিরে কোনস্থানে পড়িয়া থাকিবে। দ্বিতলে উঠিবার পূর্বেই চিঠিখানা আস্তিন হইতে খুলিয়া পড়াই সম্ভব। কেননা, দ্বিতলে উঠিলে বউদিদি অবশ্যই চিঠিখানা আপনাকে দেখাইয়া দিতেন। তাহার পর আমি ইতস্তত করিতে করিতে দ্বিতলে উঠিবার সিঁড়ির নিচে কতকগুলা কাগজের টুকরা দেখিতে পাইলাম। তন্মধ্যে আপনার চিঠির মত কিছু দেখিতে পাইলাম না। তখন সহসা সুশীলচন্দ্রের কথা মনে পড়িল। তাহার ঘুড়ি উড়িতে চায় না দেখিয়া সে বিব্রত হইয়ছিল, এবং আমাকেও সেজন্য একবার বিব্রত করিয়া তুলিয়াছিল। অবশ্যই সে আপনার পত্রখানিতে তাহার ঘুড়ির লেজুড় করিয়া থাকিবে মনে করিয়া আমি তাহার সন্ধানে ছাদের উপর উঠিলাম। উঠিয়া দেখিলাম, এক দীর্ঘ লেজুড় লইয়া সুশীলচন্দ্রের ঘুড়ি আকাশে নিঃশব্দে বিচরণ করিতেছে। তাহার পর ঘুড়িখানা নিচে নামাইয়া আনিয়া দেখি, যাহা সন্দেহ করিয়াছিলাম, তাহাই ঘটিয়াছে। তখন আমি সলাঙ্গুল-ঘুড়িলাটাই-সমেত সুশীলকে আপনার কাছে লইয়া আসিলাম। আপনার চিঠিখানা যে আর কেহ পড়ে নাই, এখন বোধ করি, আপনি সে সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হইতে পারিবেন। আমি সুশীলকে জিজ্ঞাসা করায় সে বলিল, সেখানা সে সিঁড়ির পাশে কুড়াইয়া পাইয়াছে। আপনার হাতের লেখা পাঠ করা সম্বন্ধে সুশীলের ক্ষমতা যে কতদূর, তাহা আপনি সবিশেষ জানেন। পত্রখানি অদৃশ্য হওয়ায় আপনি প্রথমে যতদূর আশ্চর্যান্বিত হইয়াছিলেন, এখন বোধ করি, ইহাতে আশ্চর্যের তেমন কিছু নাই, দেখিতেছেন?’

‘আশ্চর্যের কিছুই নাই বটে, কিন্তু পত্রখানি যে এত অল্প সময়ের মধ্যে এমন দশ-দশা প্রাপ্ত হইবে, তাহা কে জানিত!’ বলিতে বলিতে বিনয়কুমার পুনরায় এক কলম কালি লইয়া চেক লিখিতে লাগিলেন। পাঁচশত টাকার একখানি চেক অক্ষয়কুমারের হাতে দিয়া কহিলেন, ‘আমার হাতে এই তোর ডিটেকটিভগিরি বউনি হইল। যাহাতে এখন অপরের নিকট হইতে এই কাজে তোর আরও চেকপ্রাপ্তি ঘটে, সেজন্য চেষ্টা কর গিয়া—আমার আর অমত নাই।’

অক্ষয়কুমার চেক লইল না। দাদাকে ফেরত দিয়া বলিল, ‘আমি পুলিশবিভাগে কাজ করিবার জন্য আপনার সম্মতিমাত্র পাইবার আশা করিয়াছিলাম। চেকের আশা করি নাই। টাকা আমি লইব না।’

বিনয়কুমার আর কোন প্রতিবাদ করিলেন না। লিখিত চেকখানি লইয়া পুনরায় ড্রয়ারের ভিতরে রাখিয়া দিলেন।

সেইবার শারদীয়া পূজার সময় বিনয়কুমার তাঁহার ভ্রাতৃ-বধূকে পাঁচ শতাধিক টাকার একজোড়া স্বর্ণবলয় কিনিয়া দিলেন।

বলা বাহুল্য, তখন অক্ষয়কুমার দাদার অনুমতিক্রমে পুলিশ কর্মচারী-শ্রেণীভুক্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *