চিজ বার্স্ট

চিজ বার্স্ট

রাতে একটা ফোন কলের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় মানসের৷ মুখ দিয়ে একটা খিস্তি বেরিয়ে আসে তার৷ সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখেছিল এতক্ষণ৷ দেখছিল, ওর বিছানার উপরে উঠে এসেছে অন্তরা৷ নরম আঙুল দিয়ে স্পর্শ করছে ওর পেট, বুক৷

ফোনের বিরক্তিকর শব্দে ঘুমটা ভেঙে যেতেই ফোনটা ছুঁড়ে ফেলতে যাচ্ছিল মানস৷ রাত সাড়ে তিনটে বাজে৷ এমনিতে আজ চার বছর হল অন্তরার পিছনে পড়ে আছে, এখনও ফিরেও তাকায়নি মেয়েটা৷ আজ কী ভাগ্য করে এমন একটা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল, কোন শালা এখন ফোন করে সব কেঁচিয়ে দিল৷

নম্বরটা দেখে একটু অবাক হয় সে, বিদেশের নম্বর৷ ব্যাপার কী? বিদেশে তো তার পরিচিত কেউ থাকে না৷

‘ইজ দিস ম্যান্যাস ম্যান্ডাল?’

নামটার সর্বনাশ করেছে৷ গলাটা শুনে মানসের মনে হল, লোকটারও ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ ইংরেজি নয়৷

‘হ্যাঁ, হু ইজ দিস?’

‘দ্যাট ইজ ইরেলেভেন্ট৷ উই হ্যাভ আন অফার ফর ইয়ু৷’

অফার? বিরক্ত হয়ে মাতৃভাষায় লোকটার মুখের উপরেই একটা গাল দেয় মানস৷ আবার সেই কোটি টাকার লটারির স্ক্যাম৷ ফোনটা রেখে দিতে যাচ্ছিল সে, তখনই একটা চেনা নাম কানে আসে ওর,

‘আন্তারা আধিকারী, ইয়ু মাস্ট বি ইন লাভ উইথ হার৷’

লোকটা কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে একটা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক শোনা যায়, ভায়োলিন বাজছে৷

‘ইয়ে, স্যার, হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?’

‘লিসেন ম্যান, উই হ্যাভ সাম গুড নিউজ ফর ইউ৷ দ্য লেডি উইল ফল ইন লাভ উইথ ইয়ু, ইভেন শি উইল হ্যাভ সেক্স উইথ ইয়ু ম্যান৷’

একটু ঘাবড়ে যায় মানস, অন্তরা ওর সঙ্গে সেক্স করবে? শালা এখনও কথাই বলতে চায় না৷

‘ধুর বাল, তুই রাখ তো৷’

ফোনটা রেখে দেয় মানস৷ আর সঙ্গে সঙ্গে আবার বেজে ওঠে ফোনটা, না, সেই বিদেশি নম্বরটা না৷ মানস অবাক হয়ে দেখে অন্তরা এত রাতে ফোন করছে ওকে৷ গলাটা নরম করে ফোনটা রিসিভ করে মানস৷

‘মানস, ঘুমোচ্ছিলি? বিরক্ত করলাম? আমার না ভীষণ মনে পড়ছে তোর কথা৷ ক্যান উই মিট টুমরো?’

অন্তরার গলাই তো৷ কোনও সন্দেহ নেই৷ কিন্তু কী করে? মেয়েটা এতদিন ফিরে তাকাত না অবধি ওর দিকে৷

‘বললি না তো, দেখা করবি কাল? একটু নিরিবিলিতে?’

‘ইয়ে আমি তো…’

‘কী? করবি না?’

কেমন যেন নেশা লেগে আছে অন্তরার গলায়৷ কোনও সন্দেহ নেই ওর সঙ্গে অন্তরাই কথা বলছে৷ নম্বরটাও এক৷

‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই৷’

‘ওকে৷ সি ইউ, বাই৷’

ফোনটা কেটে যেতে কিছুক্ষণ খাবি খায় মানস৷ সমস্ত কিছু এখনও অবাস্তব লাগছে ওর৷ চোখ দুটো আবার রগড়ে নেয়৷ এখনও কি স্বপ্ন দেখে চলেছে? উঁহুঁ৷ ফোনটা বেজে উঠেছে আবার৷ আবার সেই বিদেশি নম্বরটা৷ দ্রুত সেটা রিসিভ করে মানস, ‘হ্যাঁ, হ্যালো,’

‘নাউ ইউ আর কনভিন্সড মাই ম্যান?’

লোকগুলো কি কোনওভাবে জোর করে অন্তরাকে বলাচ্ছে এসব? উঁহু, তা কী করে হবে? অন্তরা ওর বাড়িতেই আছে৷ গলাতেও একটা মোহময় ভাব৷ কোনও তন্ত্র জাতীয় কিছু তাহলে? যাই হোক, ওর অন্তরাকে পেলেই হবে, কীভাবে পাবে সেটা বড়ো কথা নয়৷

‘ইয়েস আয়াম ইন্টারেস্টেড, হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট৷’

‘মানি, আ হেল লট অব মানি৷’

‘হাউ মাচ?’

ওপাশ থেকে একটা চাপা হাসির শব্দ শোনা যায়, ‘নাও উই আর টকিং মিস্টার ম্যানাস৷’

(২)

পরিচিত স্বরে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠতেই স্ক্রিনের দিকে চোখ চলে গেল শানুর৷ স্পিকারের মধ্যে থেকে যেসু দাসের গলায় গান ভেসে আসছে,

জাহা পাহেলি বার মিলে থে হাম,

জিস জাগা সে সাং চালে থে হাম

নাদিয়া কে কিনারে আজ উসি আমওয়া কে তালে আনা

যাব দীপ জালে আনা, যাব শাম ঢালে আনা৷

এই গানটা আজ দিন তিনেক হল রিংটোন সেট করেছে শানু৷ একটা সময় রীতিমতো হার্টথ্রব ছিল গানটা৷ এখনও অবসর পেলেই ভাঙা এমপিথ্রি প্লেয়ারে গানটা চালিয়ে ইয়ারফোন কানে গুঁজে দেয়৷

কিন্তু এখন গানের সুরে মন দেওয়ার সময় নেই তার৷ নতুন অর্ডার এসেছে৷ স্ক্রিনে ভালো করে লোকেশন দেখে নেয় শানু৷ তবে তার আগে প্রথমে পিৎজা হাট যেতে হবে৷ ডেলিভারির জায়গাটা সেখান থেকে বাইকে অন্তত আধ ঘণ্টা৷

শানুর বিরক্ত লাগে৷ এমনিতে আজ ঝড় বৃষ্টির ওয়েদার বলে ডেলিভারি বয়ের সংখ্যা কম৷ তার উপরে ওর গা-টা সকাল থেকেই গরম লাগছে৷ জ্বর আসবে হয়তো একটু পরে৷ গোটা পঞ্চাশেক ট্রিপ হয়ে গেছে৷ শরীরটা কেমন যেন ঝিমিয়ে আসছে বারবার৷ একটু আগেই ভাবছিল আজকের মতো ঝাঁপ বন্ধ করে বাড়ি ফিরে যাবে৷ কিন্তু বাড়ি ফেরার কথা ভাবলেই ছোটো বোনটার কথা মনে পড়ে যায় তার৷ পরশু আবার ওষুধ কিনতে হবে৷ পরের মাসে একটা মেজর অপারেশন আছে৷ লাখ খানেক টাকা দরকার৷ এইটুকু সময়ের মধ্যে অতগুলো টাকা জোগাড় করতে গেলে শরীরের কথা ভাবলে চলে না৷

অর্ডারটা অ্যাকসেপ্ট করে বাইকটা ঘুরিয়ে নেয় শানু৷ ঘড়িতে সন্ধে সাড়ে আটটা বাজছে৷ এই সময় পিৎজা হাটের কাউন্টারে মেঘনা থাকে৷ ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে কিছুটা অস্বস্তিই হয়৷ মেঘনা আর শানু একসঙ্গে কলেজে পড়ত৷ কলেজে থাকতে মেঘনার উপরে হালকা চাপও খেয়েছিল শানু৷ আগের মাসেই বিয়ে হয়ে গেল৷ তবে বিয়ের পরেও পিৎজা হাটের চাকরিটা ছাড়তে পারেনি মেঘনা৷

মিনিট দশেকের মধ্যে বাইক চালিয়ে পিৎজা হাটের কাউন্টারের সামনে পৌঁছে গেল শানু৷ নীলচে দরজার সামনে বসে-থাকা ছেলেটাকে অর্ডার নম্বর দেখাতেই কনফার্ম করল ছেলেটা৷

‘চিকেন ফার্মহাউস, চিজ বার্স্ট?’

‘হ্যাঁ, তাই তো আছে৷’

‘ওকে৷’

বাইকটা একপাশে দাঁড় করিয়ে কাউন্টারের কাছে এগিয়ে এল শানু৷ ওকে দেখতে পেয়ে মিহি হাসল মেঘনা, ডো-টা হাত দিয়ে চাপতে চাপতে বলল,

‘তোর চোখ-মুখ তো বসে গিয়েছে রে!’

শানু কাধ ঝাঁকায়, ‘আর কী, একে বৃষ্টির দিন তার উপরে সার্জ…’

 ‘এটা করে বাড়ি চলে যা বরং,’ কথাটা বলেই প্রসঙ্গটা পালটে নেয় মেঘনা, হঠাৎ কী যেন মনে পড়েছে তার, ‘তোর বোনের কী খবর রে?’

শানু মাথা নাড়ে, ‘যেমন ছিল, সামনের মাসে অপারেশন আছে৷’

মেঘনা নিশ্চিন্ত হয়ে হাসে, ‘তাহলে আর কী, আজকাল এসব কোনও বড়ো ব্যাপার না৷’

‘হু, কিন্তু টাকাটা বড় ব্যাপার৷ ওটা জোগাড় করতে গিয়েই তো…’

ডো-টা অন্য একজনের হাতে চালান করে দেয় মেঘনা৷ কাউন্টার থেকে একটু বাইরের দিকে বেরিয়ে আসে, উদাস গলায় বলে, ‘শালা আমাদের এত পড়াশোনা শিখে কী লাভ হল বল দেখি!’

‘কেন, তুই খুশি নোস?’

‘খুশি!’ মেঘনা অবাক হয়, ‘শালা চার বছর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে, শেষে কিনা পিৎজা হাটের বাবুর্চি৷ লোকের জন্য পিৎজাই যদি তৈরি করব, তাহলে এত মোটা মোটা বই পড়লাম কেন বল তো?’

তার মুখের দিকে না তাকিয়েই শানু বলে, ‘প্রতি বছর ওরকম ইঞ্জিনিয়ার লাখখানেক বের হচ্ছে৷ অত লোকের চাকরি জুটবে কোথা থেকে?’

‘আচ্ছা, তুই তো পড়াশোনায় খারাপ ছিলি না৷ ভালো লাগে লোকের দরজায় দরজায় খাবার পৌঁছে দিতে?’

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকে শানু, কাউন্টারের টেবিলটার উপর হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘বোনটা সুস্থ হয়ে গেলে এসব ছেড়ে দেব ভাবছি, ভালো একটা কিছুর চেষ্টা করব৷’

মেঘনা আর কথা বাড়ায় না, অর্ডার নম্বর লেখা কাগজটা টেবিলের উপরে পড়েছিল, সেটা তুলে চোখ বোলাতে বোলাতে ভিতরের দিকে চলে যায়৷

শানুর মনে পড়ে, কলেজে পড়তে একবার ওরা বন্ধুরা মিলে কোনও একটা শপিং মলে ঘুরতে গিয়ে পিৎজা খেয়েছিল৷ মেঘনাও ছিল ওর সঙ্গে৷ মেঘনার পিৎজার টাকাটাও ওই দিয়েছিল৷ পিৎজার যে অত দাম হতে পারে, সেটা তখন জানত না৷ ঝোঁকের বশে কাউন্টারে টাকা দিতে গিয়ে চোখ কপালে উঠেছিল৷ মেঘনা অবশ্য পরে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অপ্রস্তুতেই পড়েছিল খানিক৷ ব্যাপারটা ভাবলে এখন হাসি পায় শানুর৷ মাত্র তিনটে বছর কেটেছে, অথচ মনে হয় কত যুগ আগের৷

শানু খেয়াল করেছে বিয়ের পর থেকে একটু অন্যভাবে চুল আঁচড়ায় মেঘনা৷ সরু করে সিঁদুর পরে৷ চুল দিয়ে ঢাকা থাকে বলে ভালো করে দেখা যায় না সিঁদুরটা৷

কলেজের কথা মনে পড়ে যায় শানুর৷ ওদের দু-জনেরই কম্পিউটার সায়েন্স ছিল৷ শানুর স্পেশাল পেপার ছিল নেট-ওয়ার্কিং৷ ক্যাম্পাসিং হয়ে একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে কিছুদিন পিএইচপির কাজ করেও ছিল৷ তারপর একদিন ছাঁটাই হয়ে গেল৷

এর মধ্যে আরও কয়েকটা মেসেজ এসেছে শানুর ফোনে৷ সেগুলো খুলে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়৷ তেমন দরকারি কিছু না৷ একবার মেল বক্সে ঢুকে ইমেল চেক করে৷ কয়েক জায়গায় সিভি জমা দিয়েছিল তারা এখনও কিছু জবাব দেয়নি৷

‘চিকেন ফার্মহাউস, চিজ বার্স্ট?’

কাউন্টারের ছেলেটা ডেকে উঠেছে শানুকে৷ অর্ডারের নামটা শুনেই হুঁশ ফেরে তার৷ জায়গাটা ছেড়ে আবার এগিয়ে যায় কাউন্টারের কাছে৷ একেবারে সামনেই রাখা ছিল পিৎজার বাক্সটা৷ তার উপরে কয়েকটা টিস্যু পেপার আর অরিগানো ফ্লেক্সের প্যাকেট রাখতে রাখতে মেঘনা চাপাস্বরে বলে, ‘এটা শেষ করে বাড়ি চলে যা৷ তোর চোখ-মুখের অবস্থা ভালো না৷’

মেঘনার হাতটা আলতো করে শানুর হাত ছুঁয়ে যায়৷ অদ্ভুত একটা ম্যাজিক খেলে যার ওর ভিতরে৷ কয়েক সেকেন্ড অপলক চোখে মেঘনার দিকে চেয়ে থাকে ও৷

একটা পরিচিত আওয়াজে হুঁশ ফেরে ওর৷ ফোনটা আবার বাজতে শুরু করেছে৷

‘যাব দীপ জালে আনা, যাব শাম ঢালে আনা,’

আননোন নম্বর৷ তবে কে করেছে সেটা খানিকটা আন্দাজ করতে পারে শানু৷ ফোনটা কানে ধরে সে, ‘হ্যালো!’

‘হ্যাঁ দাদা, একটা অর্ডার ছিল আপনার৷ মিত্র-পল্লির এ-দিকটায়৷’ পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে আসে ওদিক থেকে৷

‘চিকেন ফার্মহাউস, চিজ বার্স্ট? এই পিক আপ করলাম৷’ শানু বলে৷

ওপাশে একটা লাজুক হাসির স্বর শোনা যায়, ‘আসলে আমার একটা রিকোয়েস্ট আছে৷ পিৎজাটা আমার ফিয়ন্সের জন্যে… সারপ্রাইজ৷ ও বাড়িতে একা আছে৷’

‘বেশ তো, আমি…’

‘তো আপনি পিৎজাটা নিয়ে পৌঁছানোর আগে ওকে কল করবেন না৷ ইউ ক্যান আস্ক মি ফর দ্য লোকেশন৷’

‘এই নম্বরেই তো?’

‘একদম৷’

‘আচ্ছা ঠিক আছে৷’

মৃদু একটা হাসি হেসে বাইকে স্টার্ট দেয় শানু৷ গরগর শব্দে গতি নেয় সেটা৷ মুহূর্তে ওর কানের পাশ দিয়ে হাওয়া বইতে থাকে৷ মেঘনার নরম মুখটা মুছে গিয়ে হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকা বোনের মুখটা ভেসে ওঠে ওর চোখের সামনে৷ বারো লাখ টাকা৷

মোবাইলের স্ক্রিনের উপর চোখ রেখে, নীল লাইনকে রাস্তা বরাবর ধাওয়া করে শানু লোকেশনে পৌঁছায়৷

(৩)

একটা ছোটো গলির ভিতরে লোকেশনটা টেনে এনেছে ওকে৷ মেন রোড অনেকক্ষণ আগে পিছনে ফেলে এসেছে৷ রাস্তার ধারে কয়েকটা টিমটিমে স্ট্রিট লাইট জ্বলছে৷ ঠিকানাটা আর একবার ভালো করে দেখে নিল শানু৷ একটা অ্যাপার্টমেন্টের নাম লেখা আছে৷ কাবেরি হাউজিং৷ এতক্ষণে রাত ন-টা বেজেছে৷ আর পনেরো মিনিটের মধ্যে ডেলিভারি কমপ্লিট করতে হবে শানুকে৷ না হলে টাকা কাটা যাবে৷

কাবেরী হাউজিং খুঁজে পেতে বেগ পেতে হল না৷ তবে অ্যাপার্টমেন্টের বেশিরভাগ ঘরের আলো আপাতত নেভানো৷ একটা অন্ধকার কুয়াশা যেন ঘিরে রেখেছে বাড়িটাকে৷ বাইরে একটা লোহার বড়ো গেট আছে৷

বাইকটাকে দাঁড় করিয়ে একটু আগের নাম্বারটায় কল ব্যাক করল শানু৷ ওপাশ থেকে সেই লোকটা সাড়া দিল, ‘হ্যাঁ দাদা পৌঁছে গিয়েছেন?’

‘অ্যাপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছি৷ কোন ফ্লোরে যাব?’

‘চার তলা৷’ ঘরের বাইরে নাম লেখা আছে অপর্ণা মিত্র৷ ডোরবেল বাজালেই খুলে দেবে৷ ও জেগেই আছে৷’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে৷’

বাইকটা লক করে হাতে প্যাকেটটা ঝুলিয়ে লোহার গেট দিয়ে ঢুকে আসে শানু৷ অ্যাপার্টমেন্ট পুরনো হলেও বাইরে একটা ছোটোখাটো বাগান আছে৷ তাতে বেশ কিছু শখের ফুলের চাষ করা৷

লিফটে ওঠার নিয়ম নেই, সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসে শানু৷ এতদিনে সিঁড়ি ডিঙোনোর একটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছে৷

তবে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে কেমন যেন খটকা লাগে শানুর৷ বাকি ফ্ল্যাটগুলো থেকে লোকজনের আওয়াজ আসছে না৷ কেমন একটা দমবন্ধ করা নিস্তব্ধতা ঘিরে রেখেছে ফ্ল্যাটটাকে৷ এখানে কি আর কেউ থাকে না? সবক’টা ফ্ল্যাটের দরজাই আঁটোসাঁটো করে বন্ধ৷ দু-একটার বাইরে জুতোর তাকে খোলা চটিজুতো চোখে পড়ল শানুর৷ সম্ভবত সেগুলো ছাড়া বাকি ফ্ল্যাটগুলো ফাঁকা৷

কেমন একটা অস্বস্তি হল ওর৷ সেটা কাটিয়ে চারতলায় পৌঁছে একটা ফ্ল্যাটের বাইরে নামফলকে অপর্ণা মিত্র নামটা চোখে পড়ল৷ এতগুলো সিঁড়ি উঠে খানিকটা হাঁপিয়ে গিয়েছিল৷ বড়ো করে কয়েকটা দম নিয়ে এগিয়ে গিয়ে ডোরবেলটা বাজাল ও৷

ভিতর থেকে মিষ্টি একটা সুর ভেসে এল৷ সেই সঙ্গে ততোধিক মিষ্টি একটা নারীকণ্ঠের আওয়াজ, ‘কে?’

‘ডেলিভারি ছিল ম্যাম৷ দরজাটা একটু খুলবেন?’

‘ডেলিভারি! কিন্তু আমি তো…’

শানু একটু ইতস্তত করে৷ তারপর হাতের প্যাকেটটা কি-হোলের সামনে তুলে ধরে বলে, ‘হ্যাঁ, আপনি অর্ডার দেননি৷ কিন্তু আপনার পরিচিত কেউ আপনার নামে দিয়েছে৷ কল করে জেনে নিতে পারেন৷’

‘পরিচিত কেউ?’ নারীকণ্ঠকে দ্যাখা না গেলেও বোঝা যায় তিনি কিছু একটা ভাবছেন৷ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একটা নির্ভেজাল হাসির শব্দ শোনা গেল ওপাশ থেকে, ‘ও আচ্ছা! বুঝেছি৷ ওই পাগলটা৷ ওয়েট আ মিনিট৷’

ভিতর থেকে খচখচ করে শব্দ হয়ে দরজাটা খুলে গেল৷ শানু চেয়ে দেখল একটা বছর তিরিশের মহিলা দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে৷ গায়ে সাধারণ একটা টি-শার্ট আর হাঁটু অবধি একটা হাফপ্যান্ট৷ মুখটা ভারী মিষ্টি৷ চোখ দুটোর মধ্যে কোথায় যেন একটা আচ্ছন্ন করে ফেলার মতো মোহ আছে৷

দুটো হাত দিয়ে মুখের সামনে এসে পড়া চুল পিছনে ফেলতে ফেলতে মহিলা আবার হাসলেন, ‘ওই জন্য একটু আগে ফোন করে খবর নিচ্ছিল আমি জেগে আছি কিনা!’

শানু হাতের প্যাকেটটা এগিয়ে দেয়, বলে, ‘আপনি একটু জানিয়ে দেবেন যে ডেলিভারি হয়ে গিয়েছে৷’

হাসি মুখে বাক্সটা হাতে নিয়ে একবার সেদিকে ভালো করে তাকান অপর্ণা মিত্র৷ জিজ্ঞেস করেন, ‘এটা কী পিৎজা বলুন তো?’

‘চিকেন ফার্মহাউস চিজ বার্স্ট৷’

বাক্সটার দিকে একঝলক তাকিয়ে নিয়েই শানুর দিকে আবার চোখ তুলে তাকান অপর্ণা, ‘শুধু চিজ বার্স্ট?’

‘হ্যাঁ, তাই তো অর্ডার হয়েছে৷’

‘শিট!’ হতাশ গলায় শব্দটা উচ্চারণ করলেন মহিলা৷ মুখে ছায়া নামল তার৷ এতক্ষণের মুখ জুড়ে ছড়িয়ে পড়া উচ্ছ্বাস যেন এক মুহূর্তে ব্লটিং পেপার দিয়ে শুষে নিল কেউ৷

‘হতভাগাটা ভুলে গিয়েছে তার মানে,’

একটু ইতস্তত করে শানু, ‘কী হয়েছে বলুন তো? কোনও প্রবলেম?’

কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন অপর্ণা মিত্র, মুখ না তুলেই বললেন,

‘দেখুন খাবার-দাবারের ব্যাপারে আমি একটু শৌখিন মানুষ৷ বিশেষ করে এই পিৎজাটা৷ ডাবল চিজ বার্স্ট না হলে আমি খাই না৷ নো ওয়ে৷’

শানুর শরীরটা এতক্ষণে আরও খারাপ লাগতে শুরু করেছে৷ মাথাটা ঝিমঝিম করছে৷ সে প্যাকেটটা সামনে এগিয়ে ধরে বলে, ‘অর্ডার যখন হয়ে গিয়েছে আর কী করা যাবে? এটা অ্যাকসেপ্ট করে নিন না-হয়!’

 ‘বললাম না? নো ওয়ে! আমার তো অবাক লাগছে ও ব্যাপারটা ভুলে গেল কী করে?’

শানু কী করবে বুঝতে পারে না৷ বাড়ি চলে যেতে ইচ্ছা করছে ওর৷ মহিলা সামান্য একটা চিজ বার্স্টের জন্য খুঁতখুঁত করছেন৷ নিশ্চয়ই বড়োলোকের আতুপুতু মেয়ে৷ খানিকটা রাগই হয় তার৷

 ‘শোনো ভাই৷ ও জিনিস আমি অ্যাকসেপ্ট করব না৷ এক কাজ করো, যে অর্ডার দিয়েছে তার কাছেই দিয়ে এসো, না হলে তুমি নিজে খেয়ে নাও৷’

‘আমি!’ একটা চাপা অস্বস্তি ঘিরে ধরে শানুকে৷

‘হ্যাঁ৷ তুমি কেন তুমি পিৎজা খাও না?’

‘সেটা কথা নয়, কিন্তু ব্যাপারটা আন প্রফেশনাল৷’

‘আরে রাখো তোমার প্রফেশন৷ বেশ, ধরে নাও এটা আমার তরফ থেকে তোমাকে একটা ট্রিট৷’

শানুর মাথার ভিতরে সব গুলিয়ে যেতে শুরু করেছে৷ মহিলা সত্যি বলছেন না ফিয়ন্সের উপরে রেগে গিয়ে ইয়ার্কি করছেন, সেটা বুঝতে পারে না৷ হাজার হোক কেউ ভালোবেসেই পাঠিয়েছে জিনিসটা৷ সামান্য একটা কারণে…’

তাকে ইতস্তত করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মহিলার মুখের রেখাগুলো একটু নরম হয়ে আসে৷ মিহি হেসে তিনি বলেন, ‘তুমি এক কাজ করো ভাই৷ অর্ডারটা কমপ্লিট করে দাও৷ আর ভিতরে এসে একটু বসো৷ চোখ-মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে সকাল থেকে খাওনি কিছু৷’

করুণ হাসি হাসে শানু, তারপর ঢুকে আসে ভিতরে, ‘আসলে সকাল থেকেই এতগুলো ট্রিপ করে…’

‘বেশ বুঝেছি৷ তুমি একটু বোসো৷ জল খাবে?’

শানুর জ্বরটা এতক্ষণে বেড়ে উঠেছে৷ সত্যি পা দুটো আর চলতে চাইছে না৷ ঘরের ভিতরে ঢুকে এসে একটা সোফার উপরে বসে পড়ে সে৷ কোথা থেকে ওষুধের গন্ধ আসছে একটা৷ নাকি মদের? রাটকিলার জাতীয় কিছু দেওয়া আছে হয়তো ঘরে৷

চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নেয় সে৷ নিবু নিবু নীলচে আলো জ্বলছে ঘরে৷ চারদিকের জানলার ফিনফিনে আঁচলের মতো পরদা উড়ছে৷ মদের গন্ধ আসছে কি কোথাও থেকে? ঘরের দেওয়াল দুটো পোট্রের্ট ঝুলছে, তবে মুখগুলো অল্প আলোয় বোঝা যাচ্ছে না৷

শানু সোফায় গিয়ে বসতে ভিতরের ঘর থেকে একটা জলের গ্লাস হাতে বেরিয়ে এলেন অপর্ণা মিত্র৷ ঝুঁকে পড়ে পিৎজার বাস্কটা খুলে তার পাশে জলের গ্লাসটা রাখলেন তিনি৷ তারপর উলটোদিকের সোফায় বসতে বসতে বললেন, ‘আমার ফিয়ন্সে বলছিল, অ্যাপে লেখা আছে তুমি নাকি ইঞ্জিনিয়ার?’

 ‘ওই প্রাইভেট কলেজ থেকে আর কী…’ জল খেয়ে গ্লাসটা টেবিলের উপরে রাখতে রাখতে শানু বলল৷

‘কোন স্ট্রিম?’

‘নেট-ওয়ার্কিং’

অপর্ণা মিত্রর শার্টের উপরের একটা বোতাম খুলে গিয়েছে কোন ফাঁকে৷ একটা পায়ের উপরে অন্য পা তুলে বসেছেন তিনি, ‘ও মাই গড! মানে ডার্ক ওয়েবের ব্যাপারে নিশ্চয়ই অনেক জানো তুমি?’

‘ডার্ক ওয়েব?’ শানু একটু ঘাবড়ে যায়৷

‘হ্যাঁ ডার্ক ওয়েব, তোমার তো আমার থেকে অনেক বেশি জানার কথা, ওই যেখানে চাইলেই ক্রিমিনালদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়, কাউকে সুপারি দেওয়া যায়, ভাড়াটে রেপিস্ট, ড্রাগ সাপ্লাই, ব্ল্যাকমেইল…’

শানু একটু হাসে, সোফায় পিঠ এলিয়ে দেয়, ‘আমি একটা চাকরিই জোগাড় করতে পারছি না আবার সুপারি!’

‘বলো কী ভাই!’ একটু এগিয়ে আসেন অপর্ণা মিত্র, ‘চাকরি জোগাড় করার থেকে এসব অনেক সোজা৷ জাস্ট ‘টর’ বলে একটা ব্রাউজার ইনস্টল করতে হবে তোমাকে, তারপর প্রক্সি আইপি কিংবা ভিপিএন দিয়ে…’ বোঝা যায় মহিলা আজ গল্পের মুডে আছেন৷

পিৎজার একটা টুকরো তুলে নিয়ে তাতে একটা কামড় দেয় শানু, ‘আপনি এসব নিয়ে বেশ পড়াশোনা করেছেন মনে হয়৷’

লাজুক হাসে অপর্ণা মিত্র, ‘ওই অনলাইনে যেটুকু জানা যায় আর কী! বেশি জানতে গেলে আবার ঝামেলা হয়ে যাবে, বুঝলে তো? তবে একবার চেষ্টা করেছিলাম৷’

‘কী চেষ্টা?’

‘ওই ডার্ক ওয়েবে লগ ইন করার৷’

‘তাই নাকি?’ পিৎজা চেবাতে চেবাতে জিজ্ঞেস করে শানু৷ মহিলার মুখ দেখে মিথ্যে বলছে বলে মনে হয় না, ‘তারপর?’

মহিলার হাতে কি ওটা মদের গ্লাস? হ্যাঁ৷ শানুর নাকে অ্যালকোহলের গন্ধ আসতে শুরু করেছে৷ গ্লাসে মৃদু চুমুক দিয়ে তিনি বলেন, ‘তারপর আর কী, এদিক-ওদিক একটু ঘোরাফেরা করলাম৷ তবে একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম, জানো?’

‘কী ব্যাপার?’

‘লোকে ডার্ক ওয়েব নিয়ে যতটা ভয় খায় ব্যাপারটা তেমন ভয়ের কিছু না৷ লোককে সুপারি দেওয়া, জীবন্ত মানুষের গলা কাটার ভিডিও, গ্যাং রেপের এমএমএস, এইসব পাওয়া যায় বটে কিন্তু সেসব একটা সাইড৷ ওসব ছাড়া কিছু লো-লেভেল ক্রাইমও হয়, যা তোমার-আমার মতো লোকের জন্য পারফেক্ট৷’

‘তার মানে?’

গ্লাসটা থুতনির কাছে ধরে কী যেন ভাবেন অপর্ণা মিত্র, ‘মানে এই ধরো ছোটোখাটো জাতের ব্ল্যাকমেল৷ চাইল্ড পর্নোগ্রাফি… গোটা ডার্ক ওয়েব ঘুরে দুটো জিনিস ইন্টারেস্টিং লাগে আমার৷ তার মধ্যে সেকেন্ডটা হল ব্ল্যাকমেইল৷’

‘ইন্টারেস্টিং!’ একটু অবাক হয় শানু, একটু আগের অস্বস্তিটা ফিরে আসতে শুরু করেছে৷ মহিলার কোনও খারাপ উদ্দেশ্য নেই তো?

‘ইয়েস স্যার৷ তবে বুঝতেই পারো আজকালকার জগতে কাজটা রিস্কের৷ পুলিশ সব ফোন নম্বর ট্রেস করতে পারে… ডার্ক ওয়েবে এর একটা সলিউশন আছে৷’

শানু উত্তর দেয় না৷ ওর মাথা ঘুরতে শুরু করেছে৷ একটু আগে যে জলটা খেল সেটার স্বাদ কেমন যেন কষাটে লেগেছিল৷ কিছু মেশানো ছিল কি?

 ‘এখানে তোমার কাজটা হল কনটেন্ট সাপ্লায়ার৷ মানে, ধরো, তোমার কাছে একটি বছর কুড়ির মেয়ের কিছু আপত্তিকর ফটো আছে৷ মে বি, সে তোমার এক্স গার্লফ্রেন্ড৷ এদিকে তাকে ব্ল্যাকমেল করার সাহস তোমার নেই৷ তুমি ভেবে-চিন্তে একটা উপায় বের করলে৷ ডার্ক ওয়েবে একটা অ্যাকাউন্ট খুললে তুমি৷ সেইসব ছবিগুলো নিজের প্রোফাইলে আপলোড করে রাখলে৷ কেবল মেয়েটার মুখটা ব্লার করে দিলে৷ নেক্সট স্টেপ ইজ… গেস করো দেখি?’

‘আপনি, আপনি আমার জলে…’ কথাটা শেষ করতে পারে না শানু৷ তার শরীর ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে আসছে৷

‘উঁহুঁ, অন্য কথা বললে আমি খেই হারিয়ে ফেলব৷ শোনো মন দিয়ে৷’ সোফা ছেড়ে উঠে পায়চারি করতে থাকে অপর্ণা মিত্র, ‘হ্যাঁ তো যা বলছিলাম৷ দ্যা নেক্সট স্টেপ৷ এবার তুমি সেই ছবিগুলো ভালো মালদার পার্টি দেখে বিক্রি করবে, কিন্তু উঁহুঁ দিস ইজ নট পর্নোগ্রাফি৷ দিস ইজ সামথিং এলস৷ তুমি খদ্দেরকে বললে তোমাকে সার্টেন অ্যামাউন্টের বিট কয়েন আই মিন টাকা দিলে তুমি শুধু ব্লার সরিয়ে ছবিগুলোই তাকে দেবে না, সেই সঙ্গে মেয়েটার আইডেন্টিটি, ফোন নম্বর, বাড়ির ঠিকানা, বাড়িতে কখন কখন একা থাকে এইসব ইনফো তার হাতে তুলে দেবে… বলছিলাম না, কনটেন্ট সাপ্লায়ার…’

শানুর মাথাটা সোফায় নুয়ে পড়ে, দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে এতক্ষণে৷ কেবল শব্দগুলো কানে আসতে থাকে তার৷

‘এবার ধরো, এই খদ্দের লোকটা, মে বি, সে বসে আছে আফ্রিকা কিংবা মিডল ইস্টের কোনও এঁদো বস্তিতে৷ এদিকে তার কাছে আছে মেয়েটার সোশ্যাল মিডিয়া লিঙ্ক, ওয়াটস্যাপ নম্বর, এবং কিছু মশালাদার ন্যুডস৷ বিদেশি লোকটা কিছুদিন মেয়েটার ফেসবুক ইনস্টাগ্রাম ফলো করল৷ খুঁজে খুঁজে দেখল কোন কোন মালদার ছেলেরা মেয়েটার পিছনে হত্যে দিয়ে পড়ে আছে৷ এরকম জনা পাঁচেক ক্যান্ডিডেট বের করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করল লোকটা৷ দাবি খুব সিম্পল, যে মেয়েটির পিছনে তুমি কুকুরের মতো পড়ে আছো, রোজ রাতে স্বপ্নে যাকে দেখে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলছ সে আগামী এক ঘণ্টার মধ্যে নিজে এসে তোমাকে ধরা দেবে৷ তুমি চাইলে তোমার সঙ্গে শুতে রাজি হয়ে যাবে, তোমাকে শুধু খানিকটা টাকা বিট-কয়েনে ট্রান্সফার করে একটা স্যুইস অ্যাকাউন্টে পাঠাতে হবে৷’

‘আপনি আমাকে প্লিজ…’ শানুর কথাগুলো জড়িয়ে গেল৷ ঘরের দেওয়ালগুলো ভিতর দিকে ঢুকে আসছে যেন৷

‘দিস ইজ রেপ৷ তাই না শান্তনু? একটা মেয়ের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে তাকে দিয়ে কারও সঙ্গে প্রেম করিয়ে নেওয়া, শুতে বাধ্য করা৷ রাতের পর রাত তার সঙ্গে নোংরা চ্যাট করতে ফোর্স করা…’

‘কিন্তু আপনি আমাকে এসব…’

এগিয়ে আসেন অপর্ণা মিত্র, ‘তোমাকে এসব কেন বলছি, তাই তো? কারণ ইউ, মিস্টার শান্তনু রায়, আর আ প্রফেশনাল কনটেন্ট সাপ্লায়ার৷’

‘মানে?’ শানু অস্থির গলায় বলে৷

‘আজ থেকে দু-বছর আগে তোমার প্রথম ফুটস্টেপ পড়ে ডার্ক ওয়েবে৷ মেঘনা ঘোষাল৷ তোমার প্রথম ভিক্টিম৷ তোমার পাঠানো ছবি দিয়ে তাকে ব্ল্যাকমেইল করা হয়৷ যে ছবিগুলো তাকে দেখানো হয়, সেগুলো হোটেলের হিডেন ক্যামেরা দিয়ে তোলা৷ মেঘনা আজও জানে না হিডেন ক্যামেরাগুলো হোটেলের কারও না৷ তোমার নিজের সেট করা ছিল৷ কাজটা করে মোট দেড় লাখ টাকা পাও তুমি৷ কিন্তু তাতে তোমার টাকার খাঁই মেটে না৷ আরও টাকা চাই তোমার৷ এদিকে আর কারও নোংরা ছবিও নেই তোমার কাছে৷ বুদ্ধি করে একটা প্রফেশন চুজ করলে তুমি, ফুড সাপ্লায়ার৷’

‘মেয়েদের একটা অদ্ভুত স্বভাব আছে, জানো তো৷ বাড়িতে কেউ না থাকলেই বেজায় খিদে পায়৷ থেকে থেকে পিৎজা-বার্গার অর্ডার করতে থাকে৷ তুমি এদের চিনে রাখতে৷ কখন কে বাড়িতে একা থাকে, কোন রেস্টুরেন্ট থেকে অর্ডার করতে ভালোবাসে, সব ইনফরমেশান জোগাড় করলে এক বছর ধরে৷ তারপর কাজ শুরু হল তোমার৷

বাড়িতে কেউ না থাকলে খাবারে একটা বিশেষ ওষুধ মেশাতে তুমি৷ রোহিপনল৷ এই রোহিপনল এক ধরনের ডেট-রেপ ড্রাগ৷ ডেট-রেপ ড্রাগ কাকে বলে তোমাকে তো আর বলে দিতে হবে না৷ সামান্য পরিমাণ শরীরে গেলেই মেয়েটি আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে৷ তুমি বললে সে স্বেচ্ছায় দরজা খুলে দেয় তোমাকে৷ কোনও কিছুতেই আর আপত্তি জানায় না৷ অভিয়াসলি জিনিসটা লিগাল মার্কেটে পাওয়া যায় না৷ কিন্তু ডার্ক ওয়েবে অ্যাভেলেভেল৷ সব ইনফরমেশন কুক্ষিগত থাকায় তোমাকে বেশি বেগ পেতে হত না৷ ড্রাগের ঘোরে মেয়েটার মনেও থাকত না তার সঙ্গে কী হয়েছে, এদিকে তার কিছু বিশেষ ছবি কোনও ভিনদেশি সাইবার ক্রিমিনালের হাতে চলে যেত৷’

শানুর অবচেতন দেহটার পাশে এসে বসে পড়েন অপর্ণা মিত্র, ‘সব সময় মেয়েটার ন্যুডস ব্যবহার করতে না তুমি৷ ওয়াটস্যাপ খুলে তার বয়ফেন্ডকে পাঠানো ছবি৷ যে কোনও সিক্রেট ইনফরমেশন, মোট কথা যা কিছু দিয়ে তাকে ব্ল্যাকমেইল করা যায় আর কী! কী মজার ব্যাপার না? আজ অবধি কেউ জানতেও পারেনি তুমি তাদের সঙ্গে কী করেছ৷’

শানুর দেহটা সোফার একদিকে এলিয়ে পড়ে৷ অপর্ণা মিত্র তার বুকের উপরে একটা হাত রেখে কী যেন জরিপ করেন৷ তারপর শরীরটাকে কাছে এনে কপালে একটা চুমু খান, ‘এখন শান্ত ছেলে হয়ে একটু ঘুমোও তো দেখি, এতগুলো কাজ করে আজ ভীষণ টায়ার্ড তুমি…’

(৪)

শানুর চোখ খোলে একটা প্রায় অন্ধকার ঘরে৷ জ্ঞান ফিরতেই উঠে বসার চেষ্টা করে সে৷ সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে কয়েকটা শক্ত দড়ি দিয়ে তার হাত আর পা বাঁধা৷ সামনেই একটা টেবিলের উপরে ঝুঁকে কী যেন দেখছেন অপর্ণা মিত্র৷ তার গায়ে একটা অ্যাপ্রন পরা আছে৷ তার সর্বাঙ্গে লাল লাল ছোপ৷

শানু চিৎকার করার চেষ্টা করে৷ কিন্তু তার গলা দিয়ে শব্দের বদলে একটা মিহি আর্তনাদ বেরিয়ে আসে৷

সেটা কানে যেতেই ঘুরে তাকান অপর্ণা মিত্র, জিভের ফাঁকে একটা চুকচুক শব্দ করেন, ‘এই তো উঠে পড়েছ ভাই৷ শরীর খারাপ লাগছে না তো?’

‘আপনি কী চাইছেন, আমাকে এভাবে বেঁধে রেখেছেন কেন?’ অপর্ণা মিত্র একটু অবাক হন, ‘ও মা! ইউ ওয়ার সাপোজড টু ডেলিভার মি ফুড৷’

‘দেখুন আমি যা করেছি আমার বোনের মুখ চেয়ে করেছি৷ এই বাজারে সৎ পথে থেকে এতগুলো টাকা…’

‘অসম্ভব, তাই তো?’ এগিয়ে আসেন অপর্ণা মিত্র, ‘বুঝি রে ভাই, বুঝি৷ আসলে আমাদের সবার মধ্যেই না কিছু আনন্যাচারাল চাহিদা আছে, একসঙ্গে অনেকগুলো টাকা, উইয়ার্ড সেক্স পোজিশন্স, ইল্লিগাল ড্রাগস, দীর্ঘদিন কোর্টশিপ করার পরেও পাত্তা দেয় না এরকম মেয়ের শরীর৷ এসব কী আর সোজা পথে পাওয়া যায়? আই রেসপেক্ট ইয়োর চাহিদা ভাই, ধরে নে আমারও এরকম আনন্যাচারাল একটা চাহিদা আছে৷’

‘কী? কী চাইছেন আপনি?’ চিৎকার করে ওঠে শানু৷ এ-ঘর থেকে চিৎকার করলে সম্ভবত বাইরে আওয়াজ যায় না৷

মহিলা ওর মাথার চুল হাত দিয়ে আঁচড়ে দেয়, ‘বলছি, তার আগে একটা কথা শোন৷ তোর কোনও এক ভিক্টিম৷ আই মিন তোর কোনও একটা কনটেন্টের সাবজেক্ট, শালা মহা ধড়িবাজ৷ মালটা কোনওভাবে বুঝে যায় ওর বাড়িতে বার্গার দিতে এসে ওকে অজ্ঞান করে ওর কিছু ন্যাংটো ছবি তুলেছিস তুই৷ মুশকিল হল, সে মেয়েটাও তোর মতো আন-এমপ্লয়েড ইঞ্জিনিয়ার৷ নেটওয়ার্কিং নিয়ে কিছু জানে বোঝে মে বি৷ তোর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সে-ও ডার্ক ওয়েবে লগ ইন করে৷ সেখান থেকেই আমার কথা জানতে পারে মেয়েটা৷ বেচারির চাহিদাটাও সোজা পথে পূরণ হওয়ার নয়—রিভেঞ্জ৷’

‘আপনি কী বলছেন আমি বুঝতে পারছি না৷’

‘তুই কখন কোথায় কোথায় ডেলিভারি দিস সেটা নজরে রাখে কিছুদিন৷ তারপর ইচ্ছা করে পিৎজা অর্ডার দেওয়ার নাম করে তোকে আমার ঠিকানায় পাঠায়৷’

‘তাতে লাভ?’

মিহি একটা হাসি খেলে যায় অপর্ণা মিত্রর মুখে, ‘তোকে বলেছিলাম মনে আছে? ডার্ক ওয়েবে ঢুকে মোট দুটো জিনিসে আগ্রহ পেয়েছিলাম আমি৷ সেকেন্ডটা হল ব্ল্যাকমেইল, প্রথমটা জিজ্ঞেস করলি না তো!’

টেবিল থেকে একটা অস্ত্র তুলে শানুর দিকে এগিয়ে আসেন অপর্ণা মিত্র, শানু চেয়ে দেখে অস্ত্রটা একটা সার্জিকাল স৷

‘ইউ জাস্ট ডেলিভার্ড মি মাই ফুড ফর টুনাইট৷’

শানুর মাথা থেকে পা অবধি একটা ঠান্ডা স্রোত খেলে যায়৷ খানিক পরে তার থেকেও ঠান্ডা একটা স্পর্শ ধীরে ধীরে তার গলা স্পর্শ করতে থাকে৷

 (৫)

ঘণ্টাখানেক পর নিজের ডাইনিংরুমে একটা প্লেট নিয়ে ডিনার করতে বসেন অপর্ণা মিত্র৷ প্লেটের ঠিক পাশেই অভুক্ত পিৎজাটা পড়ে আছে৷ বিরক্তি ভরে হাত দিয়ে দূরে সরিয়ে দেন সেটা৷

প্লেটের খাবারটায় হাত দিতে গিয়েও থমকে যান তিনি৷ এহে, একেবারে ভুলে গিয়েছেন৷ ফ্রিজ থেকে বের করে চিজের প্যাকেটটা নিয়ে আসেন তিনি৷ মোট দুটো পুরু লেয়ার মাংসটার উপরে চাপিয়ে দেন৷ ডাবল চিজ বার্স্ট৷ খাবার ব্যাপারে ভারি শৌখিন মানুষ তিনি৷ মহানন্দে ঝলসানো মাংসের দলা মুখে তুলে নেন অপর্ণা মিত্র৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *