চিকুর স্বপ্ন
ভোরবেলা বুড়ো লোকটাকে দেখতে পেল চিকু। গোলাপ বাগানের ভেতরে জবুথবু হয়ে বসেছিল সে। পরনে একটা পুরোনো আলখাল্লা। তাতে লাল, নীল, হলদে, সবুজ হরেক রঙের তালি মারা। আর হাতে সাপের মতো আঁকাবাঁকা একটা লাঠি।
রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে চিকু বাগানে বেড়াতে আসে। মা-বাবা তখন ঘুমিয়ে থাকেন। বাড়ির লাগোয়া বিরাট এলাকা জুড়ে বাগান। বাগানে নানা ফুলের গাছ, নানা ফলের গাছ। ফুলে-ফুলে মধু খেয়ে উড়ে বেড়ায় মৌমাছি। গাছের ডালে-ডালে পাখি খেলা করে। সুরেলা শিস দেয়। চিকু দ্যাখে। চিকুর খুব ভালো লাগে। ও বাগানে এলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়ায়।
এমনি করেই হঠাৎ বুড়ো মানুষটার মুখোমুখি হয়ে পড়ল চিকু। গোলাপ বাগানের লাল, হলদে, বেগুনি, নানারকম গোলাপের মাঝে আলখাল্লার লাল, নীল, হলদে রং যেন মিশে গিয়েছিল। তাই হঠাৎ সামনা-সামনি পড়ে গিয়ে চিকু চমকে উঠেছিল। মাথায় ধবধবে সাদা চুলের জঙ্গল। একইরকম গোঁফ-দাড়িতে মুখের অনেকটাই ঢেকে গেছে। চোখ কুঁচকে ছোট। তার চারিদিকে বলিরেখার আঁকিবুকি। গোটা মুখে একইরকম অসংখ্য দাগ। আলখাল্লার বাইরে বেরিয়ে থাকা হাত দুটোরও একই দশা। লাঠি আঁকড়ে ধরা ডানহাতটা অল্প-অল্প কাঁপছিল।
চিকু অবাক হয়ে গেল। এরকম বুড়োমানুষ সে কখনও দেখেনি। আর লোকটা বাগানে এলই বা কোথা থেকে!
কাছে এগিয়ে গেল চিকু। জিগ্যেস করল, ‘তুমি কে?’
বুড়ো লোকটা চমকে উঠল। চোখ আরও ছোট করে চিকুকে দেখতে চেষ্টা করল। তারপর ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। আলখাল্লা মোড়া শরীরটা কাঁপতে লাগল থরথর করে।
চিকু কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। কেন ভয় পাচ্ছে মানুষটা! ও আরও কাছে এগিয়ে গেল। একটা হাত রাখল বুড়ো লোকটার হাতের ওপর। চামড়া কোঁচকানো। পার্চমেন্ট কাগজের মতো খসখসে। চিকু আবার বলল, ‘বলো না, তুমি কে?’
বুড়ো অনেকক্ষণ ধরে চিকুকে দেখল। ভয় কেটে গিয়ে ভরসা ফিরে এল মুখে। সামান্য হাসতে চেষ্টা করল। তারপর পালটা প্রশ্ন করল ঘড়ঘড়ে গলায়, ‘তুমি কে, খোকাবাবু?’
‘আমি চিকু। ওই বাড়িতে থাকি।’ চিকু আঙুল তুলে ওদের বাড়িটা দেখাল।
তারপর একটু থেমে জিগ্যেস করল, ‘তুমি এখানে কোত্থেকে এলে?’
বুড়ো মানুষটা কী একটা বলতে গিয়ে কাশতে শুরু করল। দম ফেটে যাওয়ার মতো কাশি। হিজিবিজি দাগকাটা ফরসা মুখটা টকটকে লাল হয়ে গেল। কাশি থামলে হাঁফাতে-হাঁফাতে সে বলল, ‘আমি এখানে লুকিয়ে আছি প্রাণের ভয়ে, খোকাবাবু। এই ক’দিন হল এসেছি। তুমি কাউকে আমার কথা বোলো না যেন চিকুর অদ্ভুত লাগল। প্রাণভয়ে এই বুড়ো মানুষটা লুকিয়ে রয়েছে কেন! কে ভয় দেখাচ্ছে ওকে!
বাগানে নানা পাখি মিষ্টি সুরে ডাকছিল। মাঝে-মাঝেই অমন ডাক শোনা যায়। শোনা যায় সুরেলা শিসের শব্দ। চিকুর ভালো লাগছিল। কিন্তু বুড়ো মানুষটা শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর আক্ষেপের গলায় বলল, ‘নকল! সব নকল গো, খোকাবাবু! চেহারা আছে, নড়ন-চড়ন আছে, কিন্তু প্রাণ নেই।’
চিকু কিছুই বুঝতে পারছিল না। ও অবাক চোখে বুড়ো লোকটার রংবেরঙের আলখাল্লা দেখছিল। দেখছিল আঁকাবাঁকা লাঠি, আর ধবধবে সাদা চুল-দাড়ি।
বুড়ো চিকুকে ডেকে তার পাশে বসাল। কাঁপা গলায় বলল, ‘চিরটাকাল . এমন ছিল না, খোকাবাবু। আমাদের সময়ে সত্যিকারের ফুল থেকে সত্যিকারের মধু খেত সত্যিকারের মৌমাছি।’
একটা মৌমাছি একটা হলদে গোলাপের আশেপাশে ভেসে বেড়াচ্ছিল। গুনগুন শব্দ উঠছিল বাতাসে। চিকু সেদিকে দেখিয়ে বলল, ‘ওই তো মৌমাছি!’
‘নকল মৌমাছি।’ হতাশ সুরে বলল বুড়ো, ‘এই যে বাগানের গাছপালা, ফুল, ফল, পাখি, কীটপতঙ্গ, স-ব নকল। সবই মানুষের তৈরি, ভগবানের নয়। ভগবানকে মানুষ ছুটি দিয়েছে। একটু আগে ওই যে পাখির শিস শোনা গেল, রোজ সকালে একই সময়ে হুবহু ওই একই সুরে শিস দেবে নকল পাখিটা। এই যে মৌমাছি ফুলকে ঘিরে উড়ে বেড়াচ্ছে, রোজ একই ভঙ্গিতে ওই ফুলটাকে ঘিরেই সে উড়ে বেড়াবে।’
‘কেন?’—চিকু বিশ্বাস করতে পারছিল না লোকটার কথাগুলো। কই, চিকুর মা কিংবা বাবা তো কোনওদিনও এ-সব কথা ওকে বলেননি!
লোকটা আবার কাশল। পাতলা ধোঁয়াশা বেড়াচ্ছে চারদিকে। রোজই এইরকম থাকে। কেমন মেঘলা ঘোলাটে পরিবেশ।
‘খোকাবাবু, এই পাখি, মৌমাছি, সবই তোমাদের বিজ্ঞানীদের তৈরি। ওদের শরীরের কলকবজায় ঠিক যেরকম-যেরকম নির্দেশ দেওয়া আছে, ঠিক সেরকমভাবেই ওরা গুনগুন করে, শিস দেয়, উড়ে বেড়ায়। এই যে সব ফুল—এগুলো বিজ্ঞানীদের হিসেবমতো ফোটে আর ঝরে পড়ে। ফুলের গন্ধও তৈরি হয়েছে তোমাদের ল্যাবরেটরিতে। তারপর সেই নকল সুগন্ধি ভরে দেওয়া হয়েছে ফুলের ভেতরে। ওই যে গাছের ফল, ওগুলো তোমরা কি কখনও খেয়ে দেখেছ? দেখোনি নিশ্চয়ই!’
‘না, মা-বাবা বারণ করেছেন। আমরা তো শুধু ভিটামিন খাই চামচে করে, আর কার্বোহাইড্রেট-প্রোটিন মেশানো ফুড ট্যাবলেট।’
হাসল বুড়ো। মাথা নাড়ল হতাশায়। লাঠিটা নামিয়ে রাখল পাশে। তারপর চিকুর পিঠে হাত রেখে বলল, খোকাবাবু, ‘ওই ফল শুধু দেখবার জন্যে। আর নকল পাখিগুলো বিজ্ঞানীদের তৈরি করে দেওয়া রুটিনমাফিক ওই ফলগুলো মাঝেমাঝে ঠোকরায়। এমনকী খাওয়ার ভানও করে। হায় রে! কী দিনকালই না এল!’
বুড়ো আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মুখ তুলে ওপরে আকাশের দিকে তাকাল। ভুরুর ওপরে হাত রেখে নজর করে দেখতে চেষ্টা করল আকাশটা ঘোলাটে মেঘলা আকাশে অনেক আলো জ্বলছে। শক্তিশালী আকাশ-প্রদীপের মতো সাদা উজ্জ্বল আলোক-পিণ্ডগুলো আকাশে ভাসছে। আলো ছড়াতে চেষ্টা করছে আবছায়া পৃথিবীর বুকে।
চিকুর দিকে তাকিয়ে বুড়ো প্রশ্ন করল, ‘তুমি কোনওদিন সূর্য দেখেছ, খোকাবাবু? সূয্যিমামা?’
‘না।’ মাথা নাড়ল চিকু। তবে সূর্যের কথা ও শুনেছে মা-বাবার কাছে। বছর কুড়ি আগেও নাকি সূর্য দেখা যেত পৃথিবীর আকাশে। পুবে উঠত, পশ্চিমে অস্ত যেত। দিন ছিল উজ্জ্বল আলোময়, রাত ছিল ঘন অন্ধকার। এখন দিন আর রাতের তফাত বেশ কমে এসেছে। পরিবেশ গাঢ় হয়ে, ঘন হয়ে, সূর্য ঢেকে গেছে। বুদ্ধিমান মানুষ এখন নতুন ধরনের আলোর উৎস তৈরি করেছে। হাউইয়ের মতো আলোকপিণ্ড ছুড়ে দিয়েছে আকাশে। সেগুলো ভারী বায়ুমণ্ডলে ভেসে থাকে। আলো ছড়ায়। মাসখানেক পরে সেগুলোর জ্যোতি কমে আসে। নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। তখন নতুননতুন আলোক পিণ্ড ছুড়ে দেয় মানুষ। আবার আলো হয়।
বিশাল আলখাল্লার ভেতর থেকে একটা কাপড়ের ঝোলা বের করল বুড়ো। ঝোলাতেও আলখাল্লার মতো রংবেরঙের অজস্র তালি। হাতড়ে হাতড়ে তার ভেতর থেকে একটা বিবর্ণ প্যাকেট বের করল। হলদেটে কাগজে মোড়া। কাগজ বেশ কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। চিকু আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে ছিল। কাঁপা হাতে প্যাকেট থেকে কয়েকটা রঙিন ফটো বের করল সে। বহুদিনের হাওয়ায় ফটোগুলোর রঙের জৌলুস অনেক ফিকে হয়ে গেছে। চিকুর বেশ কৌতূহল হল। এরকম ফটোগ্রাফের ব্যবহার আজকাল প্রায় নেই বললেই চলে। এখন শুধু মাইক্রোফিল্ম, মাইক্রোভিডিয়ো, মাইক্রো-টিভি ক্যামেরা—এসবের যুগ।
প্রথম ছবিটা চিকুকে দেখাল বুড়ো। সূর্য উঠছে পূর্ব দিক থেকে। লাল। গোল বলের মতো। আকাশে অল্প-অল্প মেঘ। মেঘের কিনারে লাল রেখা। একপাশে কিছু সবুজ গাছপালা। তার পাশ দিয়ে ধুলো উড়িয়ে একপাল গরু নিয়ে যাচ্ছে একটি ছেলে। খালি গা। হাতে লিকলিকে খাটো বেত।
‘রাখাল ভোরবেলায় যাচ্ছে গরু চরাতে।’ বুড়ো বিড়বিড় করে বলল। চিকু ছবিটার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। গরু শুধু ও মিউজিয়ামের ছবিতেই দেখেছে। গরু দেখতে সুন্দর নয় বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। তাই তাঁরা নকল গরু তৈরি করে নকল তৃণভূমিতে নিশ্চয়ই রাখেননি। তা ছাড়া বইতেও পড়েছে, একসময়ে মানুষ গরুর দুধ খেত। গরু ছিল গৃহপালিত পশু। কিন্তু এখন তো ওসব খাদ্য বা পানীয় দূষিত। চিকু কখনও দুধ দেখেনি।
ছবিটা দেখতে-দেখতে ওর নাকে ধুলো উড়ে আসছিল। কী সুন্দর! তারপর দ্বিতীয় ছবিটা দেখাল বুড়ো। কুলকুল করে বয়ে যাওয়া নদী। নদীর বুকে কালো ছায়ার মতো নৌকো ভেসে যাচ্ছে। ওপারে অস্ত যাচ্ছে টকটকে লাল সূর্য। আকাশে নানা রঙের মেঘ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ভাসছে। অপূর্ব!
‘নদীর তীরে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। আবার বিড়বিড় করল বুড়ো। তারপর বাকি ছবিগুলোও একে-একে দেখাল সে। ছেলেমেয়েরা পার্কে ছুটোছুটি করে খেলা করছে। বাগানে রংবেরঙের ফুলের উৎসব! দীপাবলির আলোকসজ্জা। কত চিত্রবিচিত্র পাখি…।
ছবিগুলো দেখানো শেষ হলে সেগুলো আবার প্যাকেটে ভরে রাখতে লাগল বুড়ো। বলল, ‘এখন সূর্যও নেই, আর এসব কিছুও নেই, খোকাবাবু। আরও অনেক ফটো ছিল আমার কাছে…নষ্ট হয়ে গেছে। এই বুড়ো শরীরে পালিয়ে বেড়ানো কি কম ধকলের কাজ!’ খকখক করে কাশতে শুরু করল সে। কিছুক্ষণ পর কাশি থামলে জড়ানো গলায় বলল, ‘এই নোংরা বাতাসে আমি শ্বাস নিতে পারি না। চারদিকে সব কেমন ধোঁয়াটে মেঘলা। অক্সিজেন কত কমে গেছে। চারদিকে শুধু বিষ-বাতাস।’ কথা আটকে গিয়ে বুড়ো আবার কাশতে লাগল।
শ্বাস নিতে চিকুর কোনওরকম কষ্ট হচ্ছিল না। ও জানে, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে এখন অক্সিজেন শতকরা আট ভাগ। বাকি অংশে নাইট্রোজেন ছাড়াও রয়েছে কার্বনডাই-অক্সাইড, কার্বন-মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড। গত পঞ্চাশ বছরে ক্ষতিকর গ্যাসগুলো পরিমাণে অনেক বেড়ে গেছে। কলকারখানা-যানবাহনের ধোঁয়া বিপদসীমা ছাড়িয়ে গিয়ে পৃথিবীর আবহাওয়াই গেছে পালটে। সূর্য ঢাকা পড়ে গেছে। আকাশ-বাতাস মেঘলা, ঘোলাটে। সেইজন্যেই কি আসল পশুপাখিগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে? মরে গেছে আসল ফুল, ফল, গাছ? তাই যদি হয়, তা হলে মানুষ সুস্থভাবে বেঁচে রইল কেমন করে! সবকিছুই কেমন দুর্বোধ্য আর রহস্যময় ঠেকছিল চিকুর কাছে। ওর কোনও শ্বাসকষ্ট হচ্ছে না, অথচ এই বুড়ো মানুষটার কাশতে-কাশতে প্রাণ বেরুবার জোগাড়।
সেই কথাই ও জিগ্যেস করল লোকটাকে।
লোকটা কাশি থামিয়ে আলখাল্লার হাতায় মুখ মুছছিল। বারদুয়েক গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, ‘আমি পুরোনো দিনের মানুষ, খোকাবাবু। জানি না, আমার মতো আর ক’জন এখনও লুকিয়ে-চুরিয়ে প্রাণে বেঁচে আছে। আর তোমরা হলে গিয়ে নতুন বিজ্ঞানের যুগের নতুন জাতের মানুষ। তোমাদের কাছে এই নোংরা বিষবাতাসই প্রিয়।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল বুড়ো। তারপর ঝোলার ভেতরে হাতড়ে-হাতড়ে কী যেন খুঁজতে লাগল। আপনমনেই নীচু গলায় বলল, ‘বাতাস পরিষ্কার করতে আমরা বহু চেষ্টা করেছিলাম গো, খোকাবাবু। পরিষ্কারও হয়েছিল। ফলে মানুষের আয়ু গিয়েছিল বেড়ে।’
চিকুর দিকে তাকাল সেঃ ‘এই আমাকেই দ্যাখো না। কত বুড়োটি হয়েও বেঁচে আছি। যাই হোক…তারপর যুদ্ধ বাধল। ভয়ানক যুদ্ধ। বাতাসে বিষ ছড়িয়ে পড়তে লাগল দিনের পর দিন। মানুষ বিষে মরতে লাগল। বাতাস পরিষ্কার করার চেষ্টাও গেল থেমে। কলকারখানা, গাড়িঘোড়ার ধোঁয়া আকাশে-বাতাসে জমতে লাগল। ওঃ, সে কি আজকের কথা! আমরা কিছু মানুষ গোপন জায়গায় অক্সিজেন সঞ্চয় করে বেঁচে রইলাম। দূষিত বাতাস পরিষ্কার করার জন্যে লড়াই করে চললাম গোপনে। কিন্তু পারলাম না। বাতাস আরও বিষিয়ে যেতে লাগল, আমরাও বুড়ো হয়ে গেলাম ধীরে-ধীরে, আর অক্সিজেনও এল ফুরিয়ে। তখন নিরুপায় হয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম মাঠে-ঘাটে-পথে—দূষিত পরিবেশে। একইসঙ্গে চালিয়ে যেতে লাগলাম বাঁচার লড়াই—।’
বুড়ো আবার কাশতে শুরু করল। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টায় লাঠিটা আঁকড়ে ধরতে গেল। চিকুর কেমন ভয়-ভয় করছিল। কী করবে, কী করা উচিত, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। এমনসময় দূর থেকে ওর নাম ধরে কেউ ডাকল, ‘চিকু—উ!’
ও চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বুড়োকে বলল, ‘যাচ্ছি। মা ডাকছেন।’
‘আমার কথা কাউকে বোলো না, খোকাবাবু। তুমি বরং কাল আবার এসো। তোমাকে পুরোনো দিনের অনেক গল্প শোনাব, কেমন! কী করে ফুল ফুটত, পাখি ডাকত, মৌমাছি মধু খেত—সব।’
‘আচ্ছা, আসব।’ বলে গোলাপ বাগানের মধ্যে দিয়ে বাড়ি লক্ষ করে ছুটে চলল চিকু। ওর নাকে ফুলের সুগন্ধ ভেসে আসছিল। শুনতে পাচ্ছিল গাছের ডালে বসে পাখি ডাকছে সুরেলা গলায়। চিকু ছুটতে-ছুটতেই মনে-মনে বলল, ‘নকল গন্ধ। নকল পাখি। বিচ্ছিরি।’
বুড়োর দেখানো বিবর্ণ ফটোগ্রাফের ছবিগুলো ওর মনে জীবন্ত হয়ে ভেসে উঠছিল বারবার।
কম্পিউটার-শিক্ষকের সামনে বসে লেখাপড়া করছিল চিকু। কিন্তু বারেবারেই ও আনমনা হয়ে পড়ছিল আর কম্পিউটার-শিক্ষকের ধমক টেলিভিশন পরদায় ফুটে উঠছিল, ‘তুমি অমনোযোগী হয়ে পড়ছ। তোমার নম্বর কাটা যাচ্ছে।’
প্রতিদিন লেখাপড়ার জন্যে আলাদা নম্বর আছে। সারাদিন পড়াশোনার শেষে বাবা কিংবা মা কম্পিউটারের বোতাম টিপলেই নম্বর ফুটে ওঠে পরদায়, তাতে অন্যমনস্কতার জন্য কত নম্বর কাটা গেছে তাও লেখা থাকে। সেটা দেখলেই মা-বাবা বকাবকি করবেন।
চিকুর একটুও ভালো লাগছিল না। তবুও কোনওরকমে পড়া শেষ করে মা-র কাছে গেল। বলল, ‘মা, মা, জানো, আমাদের বাগানের পাখিগুলো সব নকল —বিজ্ঞানীদের তৈরি।’
মা মাইক্রো-টিভি হাতে নিয়ে খবর শুনছিলেন, হাত থেকে টিভি পড়ে গেল। অবাক চোখে ছেলের দিকে তাকালেন।
চিকু এক নিশ্বাসে বলে গেল পুরোনো দিনের কথা। আসল ফুলের কথা, আসল পাখির কথা, আসল মৌমাছির কথা। একদিন সূর্য ছিল আকাশে। দিনে থাকত উজ্জ্বল আলো, আর রাতে গাঢ় অন্ধকার।
মা কাছে এগিয়ে এলেন। হাঁটুগেড়ে বসে পড়লেন ছেলের সামনে। ওর দুকাঁধে হাত রাখলেন, ‘তুই এসব কার কাছে শুনেছিস?’
চিকু হঠাৎ যেন একটা ধাক্কা খেল। মনে পড়ল, বুড়ো লোকটা ওকে বারবার করে বারণ করেছিল, তার কথা কাউকে না বলতে। বললে সাঙ্ঘাতিক বিপদ হবে।
সুতরাং মা-র কথার জবাব না দিয়ে চিকু বলল, ‘বলো না মা, এসব সত্যি?’ মা-র কপালে ভাঁজ পড়ল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারপর বললেন, ‘সব সত্যি। কিন্তু কে তোকে এসব কথা বলল! তোর বাবা জানতে পারলে…।’
বাবা ঘরে ছিলেন না। অফিসে গেছেন। অফিস বলতে বাড়ির লাগোয়া একটা ছোট ঘর। সেখানে নানারকম সব কম্পিউটার বসানো আছে। আর আছে চারচারটে রঙিন টিভি। বাবা রোজ সেই ঘরে যান। সারাদিন বসে-বসে শুধু ছোটবড় বোতাম টেপেন। টিভির পরদা খুঁটিয়ে লক্ষ করেন। কম্পিউটার থেকে যেসব ছাপা কাগজ বেরিয়ে আসে সেগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়েন। বাবা বলেন, সারা দেশ জুড়েই নাকি এরকম শক্তিশালী কম্পিউটার যোগাযোগ রয়েছে। দেশের প্রতিটি কোণের গোপন খবরাখবর আদানপ্রদান হয় হাজার-হাজার কম্পিউটারের মাধ্যমে।
‘তোর বাবা জানতে পারলে ভীষণ রাগ করবেন। এসব কথা তোর বাবাকে বলিস না যেন।’ মা অবাক চোখে ছেলেকে দেখছিলেন। চিকু যেন কোনও স্বপ্নের দেশে মগ্ন হয়ে গেছে। ওকে বুকে টেনে নিয়ে মা বললেন, ‘তুই খুব সাবধানে থাকিস। তোর জন্যে আমার ভয় করছে।’
চিকু মা-র ভয়ের কারণ বুঝতে পারল না। ও শুধু বিস্ময়ে ভাবছিল, সমস্ত নকল জিনিসের মধ্যে থেকেও মা-বাবা কেমন নিশ্চিন্ত হাসিখুশি রয়েছেন। অথচ এই ভয়ঙ্কর রহস্যটা ফাঁস হয়ে যেতেই চিকুর বুকের ভেতরে কষ্ট হচ্ছে।
সেদিন রাতে নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে চিকু শুনতে পেল বাবা-মা চাপা গলায় কথা বলছেন। কী কথা তা স্পষ্ট না বুঝতে পারলেও চিকুর আন্দাজে মনে হল আলোচনাটা ওকে নিয়েই।
কিছুক্ষণ পরে বাবার একটা কথা কানে এল ওর, ‘ঠিক আছে। কাল ওকে আমার সঙ্গে অফিসে নিয়ে যাব। সব বুঝিয়ে বলব। ও এখন বড় হয়েছে। সব ওর জানা দরকার।’
তারপরই চিকু ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমের মধ্যে সত্যিকারের ফুল, পাখি, লতাপাতা, মেঘ, সূর্য, স-ব এসে ভিড় করল ওর চোখের সামনে। ও দেখল, সত্যিকারের ফুল থেকে সত্যিকারের মধু খাচ্ছে সত্যিকারের মৌমাছি।
পরদিন আরও ভোরে উঠে পড়ল চিকু। পা টিপেটিপে চুপিচুপি বেরিয়ে পড়ল বাগানে।
চারদিক মেঘলা, ধোঁয়াটে। আবছা আলোয় বাগানের গাছপালা চোখে পড়ছে। চিকু গোলাপ বাগানের দিকে এগোল। লক্ষ করল, ফোঁটা-ফোঁটা শিশির জমে আছে রঙিন গোলাপের পাপড়ির ওপরে। এই শিশিরের ফোঁটাও কি নকল! ভাবল চিকু। আর তখনই ওর চোখে পড়ল, গোলাপ বাগানের ভেতরে মাটির ওপরে শুয়ে আছে আলখাল্লা পরা বুড়ো লোকটা। চিকু ঝুঁকে পড়ল নীচু হয়ে। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে চলে গেল তার কাছে।
বুড়ো মানুষটার দু-চোখ বোজা। হাঁফাচ্ছে। লাল-নীল তালি মারা আলখাল্লা
নিশ্বাসের তালে-তালে ওঠানামা করছে। পুঁটলি আর লাঠি পড়ে রয়েছে পাশেই। হয়তো কেউ এসেছে টের পেয়েই বুড়ো মানুষটা চোখ খুলল। প্রথমে ভয় পেয়েছিল, কিন্তু চিকুকে দেখেই ভয় কেটে গেল। ধবধবে সাদা দাড়ির ফাঁকে মলিন হাসল বুড়ো। ঘড়ঘড়ে স্বরে কোনওরকমে বলল, ‘এসেছ, খোকাবাবু?’
সঙ্গে-সঙ্গে কাশির দমক শুরু হল। সাদা মাথাটা ঝাঁকিয়ে উঠল বারবার। চোখ-মুখ লালচে হয়ে গেল।
চিকু বুঝল, মানুষটার খুব কষ্ট হচ্ছে। ও তার বুকে হাত রাখল। কাশি থামলে লোকটা হাঁ করে শ্বাস নিতে লাগল। তারপর হাতড়ে পুঁটলিটা টেনে নিল। অতিকষ্টে ভেতর থেকে বের করল একটা পলিথিনের স্বচ্ছ প্যাকেট। তার মধ্যে রয়েছে একটা শুকনো বিবর্ণ ফুল। গোলাপ।
বুড়ো মানুষটা অস্পষ্ট গলায় বলল, ‘সত্যিকারের গোলাপ, খোকাবাবু। কতদিন ধরে আগলে-আগলে রেখেছি, আর পারব না। আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে।’
চিকুর হাতে তাপ লাগছিল। ও লোকটার চুল সরিয়ে কপালে হাত রাখল। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।
‘তুমি আমাদের বাড়িতে চলো। বাবা ওষুধ দিলেই তুমি সেরে উঠবে।’ চিকুর উদ্বেগে বুড়ো যেন মজা পেল। বলল, ‘কোনও ওষুধেই আমি আর সেরে উঠব না গো। এ-যুগের ওষুধ আমার সইবে না। তা ছাড়া, তোমার বাবামা জানতে পারলে আমাকে…নাঃ, থাক খোকাবাবু, খোলা আকাশের নীচেই আমি থাকব।’
আবার কাশি। চিকুর খুব খারাপ লাগছিল বুড়ো মানুষটার জন্যে। আজ আর কোনও গল্প শোনা হল না ওর। তবে ওই সত্যিকারের গোলাপটা দেখা গেল। মুগ্ধ চোখে শুকিয়ে যাওয়া গোলাপ ফুলটা দেখছিল চিকু। হাজারটা টাটকা নকল ফুলের চেয়ে একটা শুকিয়ে যাওয়া আসল ফুল অনেক বেশি দামি।
এমন সময় বাবার ডাক শোনা গেল, ‘চিকু! চিকু!’
বুড়ো মানুষটা চোখ বুজে শুয়ে ছিল। শুকনো গোলাপটা বুকের ওপরে।
শ্বাস-প্রশ্বাসের তালে-তালে বুকটা উঠছে নামছে।
‘পরে আবার আসব।’ বলে চিকু উঠে এল বুড়োর পাশ থেকে। কিন্তু মানুষটার কাছ থেকে কোনও সাড়া পাওয়া গেল না।
রঙিন টেলিভিশনের পরদাগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল চিকু। বাবা ওকে বাঁহাতে আলতো করে জড়িয়ে রেখেছেন, আর ডানহাতে বেশ অভ্যস্ত ভঙ্গিতে নানান বোতাম টিপছেন। একইসঙ্গে কথা বলছিলেন বাবা।
‘চিকু, তুমি কি জানো, কেন আমরা নকল গাছপালা, নকল ফুল, নকল পাখি—এসব তৈরি করেছি?’
টেলিভিশন-পরদায় বিভিন্ন জটিল অঙ্ক আর নকশা দেখতে-দেখতে চিকু জবাব দিল, ‘জানি বাবা, জানি।’
অসুস্থ বুড়ো মানুষটার ছবি ওর চোখের সামনে ভাসছিল।
বাবা নরম গলায় বললেন, ‘অনেক দিন আগে—আমার জন্মেরও আগে— নানান কারণে পৃথিবীর আবহাওয়া বিষিয়ে উঠেছিল। সেই বিষাক্ত বাতাসে একেএকে মরতে শুরু করল গাছপালা, লতাপাতা, ফুল-ফল, পশু-পাখি—এমনকী মানুষও। তখন প্রাণে বাঁচার জন্যে বিজ্ঞানীরা মরিয়া হয়ে পথ খুঁজতে লাগলেন। সারা পৃথিবী জুড়েই চলল বেঁচে থাকার লড়াই। মানুষের সামান্য যা ক্ষমতা ছিল তা দিয়ে ওই ভয়ঙ্কর দূষিত বাতাসকে বিশুদ্ধ করার কোনও পথ ছিল না। ফলে বিজ্ঞানীরা ঠিক করলেন, মানুষকেই যেমন করে হোক ওই বিষাক্ত পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। চলল বহুরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা। বেশিরভাগই সদ্যোজাত শিশুদের নিয়ে। কারণ বিজ্ঞানীরা চাইছিলেন, আগামী দিনের মানুষের যেন দূষিত পরিবেশে কোনওরকম অসুবিধে না হয়। শিশুদের ফুসফুসে, শ্বাসনালীতে, নানারকম অস্ত্রোপচার করা হল। দূষিত বাতাসের চেম্বারে রেখে ওদের আচারআচরণ লক্ষ করা হল। এ ছাড়া আরও কত কী! তারপর একদিন বিজ্ঞানীরা সফল হলেন—
বাবা কয়েকটা বোতাম টিপলেন। একটা মাইক্রোফোনে সাঙ্কেতিক কয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করলেন। কম্পিউটার থেকে বেরিয়ে আসা একটা ছাপা কাগজ ছিঁড়ে নিয়ে তাতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, ‘এইভাবে মানুষ টিকে গেল। আমরা দূষিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিলাম। অবশ্য তখন মানুষের গড় আয়ু অনেক কমে গেল। কারণ পরিবেশের সঙ্গে মোটামুটি খাপ খেয়ে গেলেও মানুষের শরীরের কলকবজাগুলো তাড়াতাড়ি অকেজো হয়ে পড়তে লাগল…।’
চিকু বুঝল, কেন ও আগে কখনও বাগানের লোকটার মতো বুড়ো মানুষ দেখেনি। ও ঘুরে বাবার দিকে তাকাল। বাবা কত সহজভাবে শুনিয়ে যাচ্ছেন পুরোনো ইতিহাস। বাগানের বুড়ো লোকটার মতো বাবার চোখে স্বপ্ন নেই, গলা কেঁপে উঠছে না আবেগে। বাবা শুধু বিজ্ঞানের কথা শোনাচ্ছেন, বিজ্ঞানীদের সাফল্যের কথা শোনাচ্ছেন।
‘অবশ্য যতই নতুন-নতুন জেনারেশান আসবে গড় আয়ু ধীরে-ধীরে ততই বাড়বে। কারণ মানুষ ক্রমশ আরও বেশি করে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবে পরিবেশের সঙ্গে।’
‘কিন্তু বাবা, গাছপালা, পাখি, এসব…।’
‘ও, হ্যাঁ। বিজ্ঞানীরা মানুষের সমস্যার সমাধান করে দিলেন বটে, কিন্তু গাছপালা, ফুল-ফল, পাখি, কীটপতঙ্গ, এসব বাঁচিয়ে রাখতে পারলেন না। একেএকে সব মরুভূমি হয়ে যেতে লাগল। মুছে যেতে লাগল প্রকৃতির সৌন্দর্য।’
চিকু পলিথিনের প্যাকেটে মোড়া শুকনো গোলাপটার কথা ভাবছিল। প্রকৃতির সৌন্দর্য কবে মুছে গেছে কে জানে! শুধু স্মৃতি রয়ে গেছে। ও বলল, ‘সেইজন্যেই নকল গাছপালা-পাখি তৈরি করে দিলেন বিজ্ঞানীরা?’
‘হ্যাঁ। না তৈরি করলে আমাদের অসুবিধে হচ্ছিল। প্রকৃতির সৌন্দর্য না থাকায় মানুষের মন খারাপ হচ্ছিল, মনটা খিটখিটে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিল, ফলে মানুষের কাজ করার ক্ষমতাও কমে যাচ্ছিল। তাই মনোবিজ্ঞানীরা পরামর্শ দিলেন, মানুষের মন ভালো রাখতে, মনে আনন্দ-ফুর্তি বজায় রাখতে, নকল প্রকৃতি তৈরি করা হোক। নইলে দেশের উন্নতির কোনও আশা নেই। তখন হাজার-হাজার বিজ্ঞানী বছরের পর বছর পরিশ্রম করে তৈরি করলেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য । পরিবেশ ক্রমশ গাঢ় ঘোলাটে হয়ে ওঠায় সূর্যের আলো নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল—সূর্যকে তো আর দেখাই যেত না। তখন বিকল্প হিসেবে তৈরি হল ভাসমান আলোকপিণ্ড। তুমি তো সবই দেখেছ।’
বাবাকে নতুন মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। যেন একটা অচেনা লোক বসে আছে চিকুর সামনে। লোকটা বিষাক্ত বাতাসে দিব্যি শ্বাস নিচ্ছে। প্রকৃতি আসল না নকল তা নিয়ে লোকটার কোনও মাথাব্যথা নেই। শুধু বাইরের চেহারাটা ঠিক থাকলেই সে খুশি। আজ যদি চিকু মানুষ না হয়ে একটা রোবট হত তা হলে বাবার বোধহয় কোনও অসুবিধে হত না। শুধু রোবটের চেহারাটা আসল চিকুর মতো হলেই হল!
বাবা এবার ওকে কাছে টেনে নিলেন। আদরের গলায় বললেন, ‘চিকু, এখন বলো তো, তামাকে পুরোনো দিনের সমস্ত কথা কে বলেছে?’ তোমার মা বলছিলেন, ‘তুমি নাকি কারও কাছে ওসব কথা শুনে এসেছ? কে বলেছে তোমাকে?’
চিকুর শরীরটা কেমন কাঠ হয়ে গেল। এ-কথার উত্তর দিলেই অসুস্থ বুড়ো লোকটা হয়তো বিপদে পড়বে। কিন্তু কেন? ও পালটা প্রশ্ন করল, ‘বাবা যখন সবকিছু আসল ছিল তখনকার মানুষেরা কেউ বেঁচে নেই?’
বাবার কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বাবা ধীরে-ধীরে বললেন, ‘বেঁচে থাকা উচিত নয়। এই দূষিত পরিবেশে বেঁচে থাকতে তাদের অসুবিধে হবে। কিন্তু তবুও যে কেউ-কেউ বেঁচে নেই তা নয়। তাদের খুঁজে পেলে বর্তমান সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। তা নইলে তারা পুরোনো দিনের সব গালগল্প শুনিয়ে এখনকার মানুষের মন অকারণে দুর্বল করে তুলবে। সেইজন্যেই তো তোমাকে বলছি, যার কাছে ওসব আজেবাজে কথা শুনেছ সে কে?’
চিকু কিছুক্ষণ গুম হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল, ‘গতকাল সামনের রাস্তায় একজন লোকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সে কথাগুলো আমাকে বলেই ছুটে পালিয়ে গেল।’
বাবার সামনে এই প্রথম মিথ্যে বলল চিকু। ওর মনে হল, ভালো কাজের জন্য মিথ্যে বললে কোনও পাপ নেই।
বাবার চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ল। আনমনাভাবে বললেন, ‘হুঁ, ওরা বেছে-বেছে ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদেরই এসব আজগুবি গল্প শোনাচ্ছে।’
ডানহাত বাড়িয়ে অভ্যস্ত ক্ষিপ্রতায় বাবা কতকগুলো বোতাম টিপলেন। কী সব দুর্বোধ্য শব্দ উচ্চারণ করলেন মাইক্রোফোনে। তারপর ঠান্ডা গলায় ছেলেকে বললেন, ‘ঠিক আছে। তুমি এখন যাও। মন দিয়ে পড়াশোনা করো। কারও আজেবাজে কথায় কান দিয়ো না।’
চিকু থমথমে মুখে অফিস-ঘর ছেড়ে চলে এল। বুড়ো মানুষটা এখন কেমন আছে সে-কথা জানতে ওর মন ছটফট করছিল।
সারাদিনে আর মা-বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে বাগানে বেরোতে পারেনি চিকু। সুযোগ এল পরদিন ভোরে।
গোলাপ বাগানে এসেই চিকু যেন একটা ধাক্কা খেল। রঙিন আলখাল্লা পরা শরীরটা টান-টান হয়ে শুয়ে আছে মাটিতে। শ্বাস-প্রশ্বাসের তালে-তালে কোনওরকম ওঠানামা নেই। মানুষটার বুকের ওপরে পলিথিনের প্যাকেটে মোড়া একটা শুকনো গোলাপ আর কয়েকটা মলিন ফটো। দেখামাত্রই জিনিসগুলো চিনতে পারল চিকু। ও ছুটে আরও কাছে এগিয়ে গেল। বুড়ো মানুষটার হাতে হাত রাখল। কপাল ছুঁয়ে দেখল। বরফের মতো ঠান্ডা। চোখ বোজা। তবু যেন এক চিলতে হাসি লেগে রয়েছে মুখে। সাদা দাড়ি-গোঁফে হিমের ফোঁটা। হিমকণা রয়েছে ফটোগুলোর ওপরে, পলিথিন প্যাকেটের ওপরে। আঁকাবাঁকা লাঠি আর তালি মারা রঙিন পুঁটলি পড়ে আছে একপাশে।
চিকুর গলার ভেতরে ব্যথা করতে লাগল। বুকের মধ্যে এক অদ্ভুত কষ্ট। বাগানে পাখিরা শিস দিচ্ছিল। মৌমাছি ফুলকে ঘিরে নেচে বেড়াচ্ছিল। কতশত রঙের গোলাপ ফুটে রয়েছে বাগানে। কিন্তু সবকিছুর চেয়ে সুন্দর যেন ওই শুকনো গোলাপ আর পুরোনো ফটোগুলো। তা ছাড়া, বুড়ো মানুষটার আলখাল্লার রংবেরঙের তালিগুলো যেন এক-একটা তাজা ফুল। সেই ফুলের বিছানায় ফুটে রয়েছে পুরোনো দিনের আসল প্রকৃতির সজীব ছবি। রাখাল ভোরবেলা যাচ্ছে গরু চরাতে। কুলকুল করে বয়ে যাওয়া নদী। নদীর তীরে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। আকাশে নানা রঙের মেঘ। ছেলেমেয়েরা পার্কে ছুটোছুটি করে খেলা করছে। বাগানে রংবেরঙের ফুলের উৎসব। চিত্র-বিচিত্র কত পাখি।
চিকু মানুষটার বুকের ওপর থেকে শুকনো ফুল আর ফটোগুলো তুলে নিল। সেগুলো ছেঁড়া কাগজে জড়িয়ে লুকিয়ে নিল পকেটে। এগুলো ও চোখের মণির মতো আগলে রাখবে। বিষ-বাতাসের সঙ্গে ও লড়াই করবে। ওর বয়েসি সব ছেলেমেয়েদের ডেকে শোনাবে সত্যিকারের দিনগুলোর আশ্চর্য নানান ঘটনা। দেখাবে এই মলিন ছবি আর গোলাপ। তারপর চিকুরা দল বেঁধে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করবে আসল প্রকৃতিকে। তখন আবার সত্যিকারের ফুল থেকে সত্যিকারের মধু খাবে সত্যিকারের মৌমাছি। পৃথিবী আবার আগের মতো সুন্দর হয়ে উঠবে।
এমনসময় বাবা-মা দুজনের ডাক শুনতে পেল চিকু। ওর নাম ধরে দুজনে ডাকছেন। ও শেষবারের মতো তাকাল বুড়ো মানুষটার দিকে। হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলল অস্ফুট স্বরে, ‘তোমার জিনিসগুলো আমি নিলাম।’
তারপর ছুট লাগাল বাড়ির দিকে। ওর ছোট্ট মনের ভেতরে ধীরে-ধীরে একটা অদ্ভুত প্রতিজ্ঞা তৈরি হয়ে যাচ্ছিল। ও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল, সত্যিকারের ফুল থেকে সত্যিকারের মধু খাচ্ছে সত্যিকারের মৌমাছি।