চার ফুট নয় ইঞ্চি টুর্নামেন্ট
স্কুলজীবনের বহু টুকরো টুকরো স্মৃতি আজও মনে উজ্জ্বল হয়ে জেগে আছে। তার মধ্যে একটা হলো ওয়ার্কশপে কাজ করার স্মৃতি। স্কুলের মূল ভবন থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত ছিল। টিনের ছাদওয়ালা একটা লম্বা ধাঁচের চালাঘর। সেখানে কিছু যন্ত্রপাতি ও কয়েকটা টেবিল ছিল। করাত, র্যাদা, তুরপুণ, ছুরি, শিরিষ কাগজ, আঠা ইত্যাদি সরঞ্জামে সজ্জিত ওই ওয়ার্কশপে আমরা উপরের ক্লাসের ছাত্ররা সপ্তাহে দু’দিন কাজ করতাম, ছোটখাটো কাঠের জিনিস বানাতাম।
এর জন্য কোনো নম্বর ছিল কিনা তা স্পষ্ট মনে নেই, তবে ওই ক্লাস করা ছিল বাধ্যতামূলক। আমার ভালোই লাগত। মনে আছে দুপুরের বিরতির সময় টিফিনের ব্যবস্থার কথা। স্কুল থেকে টিফিন দেয়া হতো। প্রায়ই রুটি-তরকারি। ওই সময়ে ঢাকার কয়েকটা স্কুলে ছাত্রদেরকে দুপুরের টিফিন দেয়ার রেওয়াজ ছিল। এজন্য, সম্ভবত, বেতনের সঙ্গে সামান্য কিছু বাড়তি অর্থ দিতে হতো, তবে স্কুল ভালো অঙ্কের ভর্তুকি দিত, তা না হলে ওই ব্যবস্থা চালু থাকতে পারত না। টিফিন হিসাবে সাধারণত দেয়া হতো কোনো দিন দুটো রসগোল্লা অথবা ওই জাতীয় কোনো মিষ্টি, কোনো দিন রুটি অথবা লুচি এবং সঙ্গে একটুখানি নিরামিষ তরকারি। আমরা ছাত্ররা স্কুলের সামনের মাঠে শ্রেণী অনুযায়ী সারি বেঁধে দাঁড়াতাম বা বসতাম, দু’জন পিওন ঝকঝক করে মাঝা পিতলের বালতি এবং পিতলের বড় চ্যাপ্টা চামচ নিয়ে টিফিন পরিবেশন করত, একজন শিক্ষক তাদের সঙ্গে সঙ্গে চলতেন ও সব কিছু তদারক করতেন।
টিফিন নিয়েই আমরা লাইন থেকে সরে গিয়ে মাঠের বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে খেয়ে নিতাম। সতর্ক থাকতে হতো যেন কাক, চিল বা অন্য কোনো পাখি ছোঁ মেরে হাত থেকে খাবার ছিনিয়ে না নেয়। টিফিনের সময়টায় ছাত্রদের হৈ-হল্লা ও চেঁচামেচির সঙ্গে পাখিদের তীক্ষ্ণ ডাক অবধারিতভাবে মিশে যেত। রুটি-তরকারি ছাড়াও মাঝে-মাঝে টিফিন পেতাম কলা, কমলা, ডালপুরি, মিষ্টি।
আরো একটি মজার স্মৃতি আছে, তাহলো খেলাধুলাকে কেন্দ্র করে। তখন ঢাকার সব স্কুলেই সংলগ্ন খেলার মাঠ ছিল, তবে তা ছিল আকারে ছোট, সেখানে অনুশীলনের কাজ ভালো চললেও সে-মাঠ প্রতিযোগিতামূলক খেলার জন্য উপযুক্ত ছিল না। তাই আন্তঃস্কুল বা ওই রকম প্রতিযোগিতামূলক খেলায় অংশ নিতে হলে আমাদের পল্টনের বড় কোনো ক্লাবের খেলার মাঠ ব্যবহার করার অনুমতি নিতে হতো। স্কুল কর্তৃকপক্ষ ক্লাবগুলির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তার ব্যবস্থা করতেন। সেই সময় বড় ক্লাবগুলির মধ্যে ছিল ওয়ারী স্পোর্টিং ক্লাব, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব প্রভৃতি। তাদের নিজস্ব খেলার মাঠ ছিল, সেদিনের প্রশস্ত পল্টন অঞ্চলে, ছোট হলেও ওই সব ক্লাবের প্যাভিলিয়ন ও ক্লাবঘরও ছিল। আর তখন ফুটবলই প্রধান খেলা ছিল, আর ফুটবলের চাইতে কম খেলা হলেও হকিও তখন বেশ খেলা হতো। আমি হকি খেলেছি নবাববাড়ি আহসান মঞ্জিলের সামনের মাঠে। মাহুতটুলি থেকে আমি আর আমার পাড়ার এক বন্ধু বেশ খানিকটা হেঁটে ওই মাঠে হকি খেলতে যেতাম। তখন বড়দের হকি খেলায় একজন খুব বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন, তার নাম আজও আমার মনে আছে, ইউসুফ রেজা। আমার ছেলেবেলার হকি খেলার আগ্রহ আমি পরবর্তীকালেও বজায় রাখি এবং ১৯৪০-৪৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয় হকি একাদশে জায়গা করে নিতে সক্ষম হই। সেই সময় হকি ব্লু হওয়ার স্মৃতি আজও আমাকে আনন্দ দেয়।
কিন্তু আমি বলতে চেয়েছিলাম ফুটবলের কথা। সে প্রসঙ্গেই ফিরে যাই। কলেজিয়েট স্কুলে খেলাধুলার ওপর বেশ জোর দেয়া হতো। আমি স্কুলের ফুটবল দলে নিয়মিত খেলতাম। তখন ফুটবল মৌসুমে একটা কৌতূহলোদ্দীপক আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতা হতো। তার নাম ছিল “চার ফুট নয় ইঞ্চি টুর্নামেন্ট”। তার অর্থ, কোনো ছাত্রকে ওই টুর্নামেন্টে অংশ নিতে হলে তার দৈহিক উচ্চতা ৪ ফুট ৯ ইঞ্চির মধ্যে থাকতে হবে, এর ঊর্ধ্বে তার উচ্চতা সামান্য ভগ্নাংশ বেশি হলেও অযোগ্য ঘোষিত হবে। মাঠের এক পাশে উচ্চতা মাপার যন্ত্র বসানো থাকত, খেলার আগে সেখানে সকল প্রতিযোগী ছাত্রের উচ্চতা পরীক্ষিত হতো এবং তার ফলাফল অনুযায়ী তাকে পাস বা ফেল ঘোষণা করা হতো। আমার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হতো না, আমি অনেকটা বেঁটের দিকেই ছিলাম, তবে আমাদের দলের দু’জনের পরিস্থিতি ছিল প্রান্তিক, তারা কোমর শক্ত করে বেল্ট বেঁধে, ঘাড় ছোট করে ও আরো নানা উপায়ে নিজেদের উচ্চতা যথাসম্ভব কম করে দেখাবার চেষ্টা করত। সেই সব সময়ের বহু মজার অভিজ্ঞতার স্মৃতি আজও মাঝে মাঝে আমার মনে দোলা দেয়।
ম্যাচের দিন আমরা খেলোয়াড়রা সবাই স্কুলে একত্র হয়ে সেখান থেকে ঘোড়ার গাড়ি করে নবাবপুর হয়ে খেলার মাঠে আসতাম। তিন-চারটা গাড়ি করে আসলেও খরচ এক টাকার বেশি পড়তো না। ম্যাচের পর হারজিত যাই হোক নিজ নিজ স্কুলের পক্ষ থেকে আপ্যায়ন করা হতো। আমরা মাঠ থেকে বেরিয়ে রাস্তা ধরে হেঁটে নবাবপুর রেলক্রসিং পার হয়ে ঠিক মোড়ের কাছে একটা দোকানে এসে জমায়েত হতাম। সারা গা ঘামে ভিজে সপসপ। কেউ পায়ে ব্যথা পেয়েছে, ল্যাংচাচ্ছে। তবু খেলা নিয়ে কী তুমুল আলোচনা। জিতলে সবার মুখে হাসি ও সানন্দ উত্তেজনা। যে গোল করেছে বা অনবদ্য পাস দিয়েছে বা কঠিন গোল থামিয়েছে তার মুখে ঈষৎ গর্বের ভাব। আর হারলে পর সবার মুখ ভারি, থমথমে, বিষণ্ণ। ক্রীড়া শিক্ষকের সান্ত্বনা দান সত্ত্বেও সবাই কেমন চুপচাপ। খাওয়া-শেষে সবাই যে যার বাড়ির পথে। এবার আর এক সাথে নয়, তবে একদিকে বাড়ি পড়লে একসঙ্গে কিছুদূর যাওয়া যেত। খেতাম বড় এক গ্লাস করে ঘোলের শরবত, প্রচুর বরফ দেয়া। কী অপূর্ব যে লাগত। নবাবপুরের প্রান্তসীমায় অবস্থিত ওই দোকানের ঘোলের শরবত ছিল বিখ্যাত। শরবত ছাড়া দেয়া হতো হয় একটা শিঙ্গাড়া কিংবা নিমকি কিংবা রসগোল্লা। ওই ছিল মাথাপিছু বরাদ্দ। কিন্তু সেই খাওয়া আর খেলার পর বিচার- বিশ্লেষণ আর সমালোচনা, আর আগামী খেলার প্রস্তুতি আর সম্ভাব্য কৌশল নিয়ে ভাবনা-চিন্তা।
আজ যেখানে ঢাকা স্টেডিয়াম সে অঞ্চলেই ছিল আমাদের সেদিনের খেলার মাঠ। এমনিতে আমরা স্কুল প্রাঙ্গণেই খেলতাম কিন্তু প্রতিযোগিতার খেলা হতো পুরানা পল্টনের নির্ধারিত মাঠে।
কলেজিয়েট স্কুলের সহপাঠীদের মধ্যে অমল, সুশীল আর অজিতের সঙ্গে সাতচল্লিশে উপমহাদেশ ভাগ হয়ে যাওয়ার পর আর দেখা হয়নি। হিমাংশুরা অনেকদিন পর্যন্ত ঢাকাতেই ছিল। পরে সেও কলকাতায় চলে যায়। সে ছিল আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি যখন ১৯৭২ সালে কলকাতায় যাই তখন ওর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ও তখন ভীষণ অসুস্থ, প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী। হিমাংশুর কথা পরে বড় করে বলব।
সুশীল ছিল খুব চটপটে। একদিন ক্লাসে গিয়ে দেখি ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে সে চক দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে লিখছে : শীলা চঞ্চল, দিদি চঞ্চল!! তখনো ঘণ্টা পড়েনি, স্কুল বসার একটু দেরি আছে। শিক্ষক ঘরে ঢুকবার আগেই সে লেখা মুছে ফেলল। কে শীলা, কে দিদি, কেনই-বা তারা চঞ্চল আমি কিছুই বুঝলাম না। টিফিনের সময় রহস্যটা পরিষ্কার হলো। সুশীলই বুঝিয়ে দিল। ঢাকাতে নিউ থিয়েটারের নতুন সাড়া জাগানো ছায়াছবি এসেছে, দিদি। ছোট বোনের নাম শীলা। সুন্দরী, চঞ্চল, দিদির পরম আদরের ধন, পিতৃমাতৃহীন। শীলার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন নবাগত লালীদেশাই। আর দিদি হলেন প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী চন্দ্রাবতী। বিরাট কারখানার মালিক এবং তার ব্যবস্থাপনা পরিষদের প্রেসিডেন্ট। প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বের অধিকারী কিন্তু তাঁর চিত্তেও চাঞ্চল্য জাগায় কারখানার এক শ্রমিক কর্মী। সে-ই নায়ক। তার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, সে যুগের অসামান্য জনপ্রিয় গায়ক অভিনেতা, কে এল সায়গল। দু’বোনই প্রেমে পড়ে তার, কিন্তু দিদির ভালোবাসার কথা লুকানোই থাকে। এই ছবির কথাই সুশীল তার সাঙ্কেতিক ভাষায় সহপাঠীদের জানিয়ে দিতে চেয়েছিল।