চার পা ছেড়ে দু-পা
সেই সব প্রাইমেট-যাদের একদল বংশধরের নাম হলো বনমানুষ—আজকের পৃথিবীতে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এমন কি, ওই সব আধামানুষ হোমিনিডরা-যাদের একদল বংশধরের নাম হয়েছে শুধু মানুষ— আজকের দিনে তাদেরও আর দেখা নেই।
কিন্তু কথা হলো, বনমানুষের একদল বংশধর বদলাতে বদলাতে, বদলাতে বদলাতে, শেষ পর্যন্ত কেমন করে মানুষ হয়ে গেল?
মনে রাখতে হবে, এই সব বনমানুষদের আড্ডা ছিল গাছের ওপর। তাদের গায়ে লোম, মুখে লোম আর তাদের ছিল চারটে করে পা।
কিন্তু গাছে গাছে ঘুরে বেড়াবার সময় এই চারটে পায়ের মধ্যে খানিকটা তফাত দেখা দিলো। কেননা, গাছে থাকতে গেলে সামনের পা-জোড়া কাজে লাগে অনেক বেশি। গাছের ডাল আঁকড়ে ধরা থেকে শুরু করে ফলমুল জোগাড় করা, ফলমূল মুখে পোরা, সব কিছু ব্যাপারেই পেছনের পায়ের চেয়ে সামনের পা-জোড়ার কাজ অনেক বেশি।
এমনতরো অবাক কাণ্ড দুনিয়ায় খুব কমই ঘটেছে। ওই চারপেয়ে বনমানুষদের মধ্যে একদল বনমানুষ গাছের বাসা ছেড়ে নেমে এলো সমান জমির ওপর। চার পা ছেড়ে দুপায়ের ওপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
কি জন্য নেমে এলো তারা মাটিতে? আরো ভালো খাবারের জন্য। এই খাবার জোগাড় করবার জন্য তার থাবার মুঠোয় ধরা থাকতো পাথরের টুকরো, যা দিয়ে তারা মাটি খুঁড়তো, আর মাটি খুঁড়ে তুলে আনতো শেকড়-বাকড়। তাহলে ওই পাথরের টুকরোটাকে তো হাতিয়ার বলতে হয়। আর হাতিয়ার ধরতে পারে যে থাবা সেটা মোটেই আর বনমানুষের থাবা নয়। সেটা ওই আধা-মানুষের ‘হাত’। সে অনেক বছর আগেকার কথা। নিদেনপক্ষে এক কোটি বছর তো হবেই। কেমন ছিল তখনকার পৃথিবী চেহারাটা?
আবহাওয়াটা আবার বদলাতে শুরু করলো। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে শুরু করলো আর তার সঙ্গে অনেক জায়গায় পুরু হয়ে জমতে লাগলো বিশাল বিশাল বরফের চাদর। এই ঠাণ্ডায় আগেকার ওই বিশাল ঘন বন-জঙ্গল সব মুছে সাফ হয়ে যেতে লাগলো। আর ওই জঙ্গলের অধিবাসী যতো জানোয়ারের দল পালাতে লাগলো দলে দলে এমন জায়গার খোজে যেখানে গিয়ে বাঁচা যাবে।
সেই অবস্থায় বেঁচে গেল কিন্তু একদল। ওই আধা-মানুষ হোমিনিডরা। কি করে? আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল ওদের, সবরকম খারাপ অবস্থার সঙ্গে কোনোমতে মানিয়ে চলবার, আর তাই টিকে যাবার। মাটির ওপর দুপায়ে ভর দিয়ে সোজা হয়ে হেঁটে-চলে বেড়ানো তো শুরু হয়েই গেছে, সেই সঙ্গে এসে গেছে ওই কন্কিনে ঠাণ্ডায় প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে নতুন নতুন হাতিয়ার, আর সেই হাতিয়ার ধরতে ওস্তাদ ‘হাত’।
ওই আধা-মানুষ থেকে আমরা যে মানুষ হয়েছি তা আসলে আমাদের এই হাতের গুণেই। আর কোনো জানোয়ারের এ-রকম হাত নেই যে-রকম আছে আমাদের। শিম্পাঞ্জীর থাবা বা গরিলার থাবা কিন্তু হাত নয়। তাই দিয়ে বড়জোর একটা কিছুকে আঁকড়ে ধরা যায়। কিন্তু তাই দিয়ে হাতিয়ার বানানো যায় না। একমাত্র মানুষই হাত দিয়ে হাতিয়ার বানাতে পারে। আর কেউ তা পারে না। হাতের গুণেই হাতিয়ার। আবার হাতিয়ারের গুণেই হাত। আর এই হাত আর হাতিয়ারের গুণেই মানুষ হয়েছে মানুষ। পশু নয়। আর।
হাতিয়ার কাকে বলে? যা হাতে নিয়ে আমরা পৃথিবীর সঙ্গে লড়াই করি তাকে বলে হাতিয়ার। যেমন আমাদের কাস্তে কুডুল, তীর ধনুক, কোদাল হাতুড়ি সব কিছুই।
কিন্তু পৃথিবীর সঙ্গে লড়াই করা মানে? আসলে, ওইখনেই তো বাকি সব জানোয়ারের সঙ্গে মানুষের মস্ত তফাত। বাকি সবাই বেঁচে থাকে পৃথিবীর মুখ চেয়ে পৃথিবীর দয়ার ওপর নির্ভর করে। যদি খাবার জোটে তাহলেই তাদের পেট ভরবে, নইলে নয়। যদি মাথা গোঁজবার জায়গা জোটে তাহলেই মাথা গুজতে পারবে, নইলে নয়। মানুষ কিন্তু এ-রকম অসহায়ের মতো, এ-রকম নিরুপায়ের মতো বেঁচে থাকতে রাজি নয়। মানুষ শিখেছে পৃথিবীর কাছ থেকে নিজের দরকার মতো জিনিস জোর করে আদায় করে নিতে। তাই মাটির বুক চিরে ফসল আদায় করা, মাটি পুড়িয়ে আর পাথর কেটে বাড়ি গাঁথতে শেখা। আকাশকে জয় করবার জন্যে মানুষ উড়োজাহাজ বানিয়েছে, পাতালকে জয় করবার জন্যে পরেছে ডুবুরীর পোষাক। আর মানুষ যে পৃথিবীকে এমন করে জয় করতে শিখেছে তার আসল কারণ হলো মানুষের ওই হাতিয়ার।
কি বুদ্ধি? তুমি হয়তো তর্ক তুলে বলবে, মানুষের এতো-যে কীর্তি তার আসল কারণ হলো মানুষের ওই বুদ্ধি-ই। আর কোনো জানোয়ারের তো মানুষের মতো বুদ্ধি নেই! নিশ্চয়ই নেই। কিন্তু কেন? শেষ পর্যন্ত কিন্তু তার কারণ মানুষের ওই হাত, ওই হাতিয়ার। কেননা, বুদ্ধি বলে ব্যাপারটা নির্ভর করে মাথার খুলির মধ্যে মগজ বলে যে জিনিস আছে সেই জিনিসটার ওপর। মানুষের মগজটা অনেক বড়, মানুষের মগজের গড়নটা অনেক ভালো, আর এই জন্যেই তো এতো বুদ্ধি। কিন্তু মগজটা এতো ভালো হলো কী করে? শিম্পাঞ্জীর মগজ আর ওরাঙওটাঙের মগজ তো এতো ভালো হয় নি! তার কারণ, ওই হাত, মানুষের হাত। আসলে শরীরের নিয়মই এই যে, তার মধ্যে কোনো একটা অঙ্গ বাকি অঙ্গগুলোকে বাদ দিয়ে, শুধু নিজে নিজে, আলাদাভাবে, বদলাতে পারে না। একটা অঙ্গ বদল হবার সঙ্গে সঙ্গে অন্য অঙ্গগুলোও বদলাতে থাকে। তাই বনমানুষদের সেই ফালতু পা দুটোর জায়গায় যতোই মানুষের হাত দেখা যেতে লাগলো ততোই অন্য রকম হয়ে যেতে লাগলো বাকি সব অঙ্গগুলোর সঙ্গে মাথার খুলির মধ্যে মগজ বলে জিনিসটাও। আর তাই শেষ পর্যন্ত মানুষের চেহারা মানুষের মতো হলো, মানুষের মাথায় এতো বুদ্ধি দেখা দিলো।