চার নম্বর ডাকাত

চার নম্বর ডাকাত

দুপুরের ট্রেনে অনেকেই ঝিমোয়৷ কেউ খবরের কাগজ পড়তে পড়তে ঘুমোয়৷ কেউ জানলায় মাথা রেখে ঘুমোয়৷ কারুর মাথা ঘুমে ঢলে পাশের লোকের কাঁধে গিয়ে পড়ে৷

বেলা এখন সোওয়া তিনটে৷ ট্রেনটা আপন মনে ছুটছে৷

বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল একটা লোক, তার মুখে রুমাল বাঁধা৷ শুধু চোখ দুটি ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না৷ তার হাতে একটা রিভলভার৷ সে কামরার চারদিকে একবার চেয়ে নিয়ে বলল, সবাই শোনো! কেউ নিজের জায়গা থেকে নড়বে না৷ কেউ ওঠার চেষ্টা করলে গুলি চালাব৷ যার কাছে যা গয়না, টাকা-পয়সা আছে সব দিয়ে দাও৷ কেউ কিছু লুকোবে না!

যারা একটু একটু ঘুমোচ্ছিল, তারা চমকে ভয় পেয়ে গেল৷ যারা গভীর ঘুমে রয়েছে, তারা কিছু শুনতেই পেল না৷

এবার কামরার অন্য দু’দিক থেকে উঠে দাঁড়াল দুটি ছেলে৷ তারাও এতক্ষণ ঘুমের ভান করে মুখ গুঁজে ছিল৷ এখন দেখা গেল, তাদের মুখেও রুমাল বাঁধা৷ দু’জনের হাতেই লম্বা লম্বা ছুরি৷

সেই ছুরিওয়ালাদের একজন একটি ঘুমন্ত লোককে ধাক্কা দিয়ে বলল, এই, ওঠ! টাকা-পয়সা কী আছে বার কর৷

লোকটি চোখ মেলেই চেঁচিয়ে উঠল, ডাকাত! ডাকাত!

ছুরিওয়ালাটি তার মুখে মারল এক ঘুঁষি৷

এবারে কামরার মধ্যে চ্যাঁচামেচি, কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেল৷ কেউ কেউ ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বলতে লাগল, হে ভগবান, এ কী হল! মেরে ফেলবে, ডাকাতরা মেরে ফেলবে!

রিভলভারধারী ডাকাতটি ধমক দিয়ে বলল, কেউ গোলমাল করবে না, চুপ! একদম চুপ! যার যা আছে সব দিয়ে দিলে কেউ প্রাণে মরবে না৷

একজন মহিলা আগেই তাঁর গলা থেকে হার খুলে দিলেন৷

ছুরিওয়ালা একজন রুক্ষ স্বরে জিজ্ঞেস করল, এটা সোনার?

মহিলাটি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, তা তো জানি না বাবা!

ছুরিওয়ালা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, নিজের গলায় হার পরেছেন, জানেন না সেটা সোনার কিনা! দেখি, ব্যাগের মধ্যে কত টাকা আছে?

রিভলভারধারী ঘুরে ঘুরে পাহারা দিতে লাগল৷ আর ছুরিওয়ালা দু’জন লোকদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা আর গয়না-টয়না নিয়ে ভরতে লাগল একটা থলিতে৷

একজন বুড়ো লোক ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠে বললেন, আমার মেয়ের বিয়ের জন্য গয়না গড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে৷ আমার মেয়ের আর বিয়ে হবে না৷ প্রভিডেন্ট ফান্ডের সব টাকা আজই তুলে এনেছি, আমায় ছেড়ে দাও!

ডাকাতরা তাকেও দয়া করল না৷ জোর করে কেড়ে নিল সব৷

এত গোলমাল, কান্নাকাটির মধ্যেও একজন লোক অঘোরে ঘুমোচ্ছে৷ জানলার কাছে হেলান দিয়ে আছে মাথা, কোলের ওপর একটা ইংরেজি ডিটেকটিভ বই খোলা৷ লোকটির বয়েস হবে চুয়াল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ, প্যান্ট আর নীল হাওয়াই শার্ট পরা৷

একজন ছুরিওয়ালা তার কাছে এসে বলল, এটা এখনো ভূতের মতন ঘুমোচ্ছে!

হাঁটু দিয়ে একটা ধাক্কা মেরে বলল, এই গাধা, ওঠ! কী আছে বার কর৷

ঘুমন্ত লোকটি স্প্রিংয়ের মতন লাফিয়ে উঠে বিরাট জোরে একটা ঘুষি কষাল সেই ডাকাতটির মুখে৷ এত জোর ঘুঁষি সে জীবনে খায়নি৷ দেওয়ালে তার মাথা ঠুকে গেল, তারপর মেঝেতে পড়ে গিয়েই অজ্ঞান!

নীল শার্ট পরা লোকটি সঙ্গে সঙ্গে তার ছুরিটা তুলে নিয়ে বলল, আপনারা কেউ ভয় পাবেন না, ওই রিভলভারটা খেলনা রিভলভার৷ ও কিচ্ছু করতে পারবে না৷

রিভলভারধারী হিংস্র মুখ করে বলল, খেলনা? দেখবি, দেখবি, তোকে শেষ করে দেবো?

এই বলতে বলতে সে দরজার দিকে সরে গেল, তারপর এক লাফ মারল চলন্ত ট্রেন থেকে৷

বাকি রইল একজন ছুরিওয়ালা৷ সে বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে৷ এক হাতে উঁচু করে আছে ছুরিটা৷

নীল জামা পরা লোকটি তার দিকে এগোতে এগোতে বলল, লড়বি আমার সঙ্গে? আয়, লড়বি আয়৷ আমার নাম মানিক ঘোষ, আমার সঙ্গে লড়তে পারিস তো বুঝব তোর হিম্মত?

মানিক ঘোষের স্বাস্থ্য ভালো৷ সেই তুলনায় ছুরিওয়ালা ডাকাতটা রোগা-প্যাঁকলা৷ তার হাত কাঁপছে৷

সে লড়াই করার কোনো চেষ্টাই করল না৷ অন্য দরজার দিকে ছুটে গিয়ে পড়ি মরি করে দিল এক লাফ!

রেললাইনটা এখানে বেশ উঁচু৷ জানলা দিয়ে দেখা গেল সেই ডাকাতটা এবড়ো-খেবড়ো পাথরের উপর দিয়ে গড়াচ্ছে৷ হাত-পা কিছু একটা ভাঙবে নিশ্চয়ই৷

নীল শার্ট পরা লোকটা বলল, অন্য ছেলেটাকে ধরে রাখুন, ওকে পালাতে দেবেন না৷ ধরুন ধরুন!

কামরার যে-সব লোক এতক্ষণ ভয়ে শুকনো কাঠ হয়ে ছিল, তাদেরই মধ্যে তিন-চারজন এখন ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই লোকটার ওপর৷

তাকে এমন চড়-চাপড় মারতে লাগল যে তাতেই তার জ্ঞান ফিরে এল৷

একটু আগে ছিল চ্যাঁচামেচি, কান্নাকাটি৷ এখন অন্যরকম শোরগোল শুরু হয়ে গেল৷ ডাকাতদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া গেল এত সহজে? কেউ যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না৷ টাকা-পয়সা-গয়নার থলে দুটোও ওরা ফেলে গেছে৷

নীল শার্ট পরা মানিক ঘোষ নামের লোকটি যেন সিনেমার নায়ক৷ তাকে ঘিরে ধরল সবাই৷ যে-বুড়ো ভদ্রলোক মেয়ের বিয়ের গয়নার কথা বলেছিলেন, তিনি মানিক ঘোষের গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, বাবা, তুমি ভগবান! তুমি আমাকে বাঁচালে, আমার মেয়েকে বাঁচালে!

মানিক ঘোষ লজ্জা পেয়ে বলল, এ কী বলছেন! আমি ভগবান হতে যাবো কেন? আমি সাধারণ মানুষ!

অন্য একজন বলল, আপনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের বাঁচালেন৷ যদি আগেই আপনাকে ছুরি মেরে দিত!

আর একজন জিজ্ঞেস করল, দাদা, আপনি কী করে বুঝলেন যে ওটা খেলনার রিভলভার ছিল?

মানিক ঘোষ বলল, দেখলেই তো বোঝা যায়৷ আপনারাও তো ছেলেমেয়েদের জন্য খেলনা বন্দুক-পিস্তল কিনে দেন, সেগুলো ভালো করে দেখেন না?

বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, দেখে বোঝা খুব শক্ত৷ বাই চান্স যদি আসল হত?

মানিক ঘোষ বলল, তা হলে আর কী হত, বড়জোর গুলি চালাত আমার দিকে৷ গুলি চালালেই যে ঠিক লাগাতে পারত, তারও কোনো মানে নেই৷ এর আগে একবার আমেদপুর বাজার থেকে ফিরছি সন্ধেবেলা, এক ব্যাটা আমার দিকে গুলি চালাল৷ হাতে একদম টিপ নেই৷ আমি এখানে, গুলিটা চলে গেল দু’হাত দূর দিয়ে!

একজন জিজ্ঞেস করল, আগেও একবার গুলি চালিয়েছিল আপনার দিকে? দাদা, আপনি কি পুলিশ নাকি?

মানিক ঘোষ বলল, না, না, পুলিশ হতে যাবো কোন দুঃখে? আমি ডিমের ব্যবসা করি৷

লোকটি বলল, না, অত জোরে ঘুঁষি মারলেন তো, তাই জিজ্ঞেস করছি!

মানিক ঘোষ বলল, পাড়ার ক্লাবে কিছুদিন বক্সিং শিখেছি৷ ডিমের ব্যবসা করলে কি বক্সিং শেখা যায় না?

বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, গুলিগোলার শব্দ শুনলেই তো ভয়ে প্রাণ উড়ে যায়!

মানিক ঘোষ বলল, আজকাল যা দিনকাল পড়েছে, গুলিগোলার শব্দ তো শুনতেই হবে৷ অত ভয় পেলে কি চলে দাদু!

তিনজন লোক ধরা-পড়া ডাকাতটিকে মাটিতে শুইয়ে রেখে তার বুকের ওপর পা দিয়ে চেপে রেখেছে৷

সে একবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই কয়েকজন এগিয়ে এসে তাকে চড়-ঘুঁষি মারতে লাগল৷

মানিক ঘোষ বলল, দাঁড়ান, দাঁড়ান, অত মারবেন না৷ বাঙালিরা আগে কিছু করতে পারে না৷ চোর ধরা পড়লে তারপর তাকে মারতে সবাই খুব ওস্তাদ৷ এ ছেলেটাকে নিয়ে এখন কী করা যায়?

তিন-চারজন একসঙ্গে বলল, সামনের স্টেশানে ট্রেন থামলে ওকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে৷ পুলিশ ওকে ধরে খুব করে ঠ্যাঙালেই ওর দলের সন্ধান বলে দেবে৷

অন্য একজন বলল, পুলিশ আজকাল কিছুই করে না৷ ঘুষ খেয়ে ছেড়ে দেবে!

আর একজন বলল, আজকাল যখন-তখন ডাকাতি! আর পারা যায় না৷ আমাদেরই উচিত ওকে শাস্তি দেওয়া৷

মানিক ঘোষ জিজ্ঞেস করল, কী শাস্তি দেবেন?

একজন বলল, মারতে মারতে মেরে ফেলুন না? একজন ডাকাত তো অন্তত কমবে?

মানিক ঘোষ বলল, কে মারবে, আমি? তারপর আমি যে খুনের দায়ে ধরা পড়ব!

সেই লোকটি বলল, তাহলে আমরা সবাই মিলে মারব! কারুর নামে দোষ পড়বে না! ওকে খুন করাই উচিত৷

মানিক ঘোষ বলল, ওরে বাবা, একেবারে খুন! আপনারা সবাই তাই চান?

অনেক লোক একসঙ্গে হ্যাঁ বলে উঠল৷ দু-তিনজন অবশ্য বলল, না, না, পুলিশে দেওয়াই ভালো৷ কিন্তু তাদের কথায় কেউ কান দিল না৷

ডাকাতটা ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, না, না, আমায় খুন করবেন না৷ আপনাদের পায়ে পড়ছি৷ আর কোনোদিন এমন করব না৷ আমি ভদ্দরলোকের ছেলে!

মানিক ঘোষ বলল, তবে ওর বিচার হোক আগে৷ ওকে ছেড়ে দিন৷ সবাই ঘিরে থাকলে ও পালাতে পারবে না!

ছেলেটা কামরার দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসল৷ সবাই নিজের নিজের জায়গা ছেড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল চারপাশে৷ শুরু হল বিচারসভা৷

মানিক ঘোষ জিজ্ঞেস করল, এই ভদ্দরলোকের ছেলে, তোর নাম কী?

ডাকাতটি বলল, জয় মুখার্জি৷

মানিক ঘোষ অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, এ কী সত্যি কথা বলছে? এর এই নাম হতে পারে?

অনেকে মিলে একসঙ্গে বলে উঠল, বানিয়েছে, বানিয়েছে! মুখার্জি না ছাই!

একজন বলল, কোনো মুখার্জি বাড়ির ছেলে এই কাজ করতে পারে না৷

ডাকাতটি আর্তগলায় বলে উঠল, মা কালীর দিব্যি বলছি, বিশ্বাস করুন৷ আমার নাম জয় মুখার্জি৷ আমার বাবার নাম সোমনাথ মুখার্জি৷

বাড়ি কোথায় তোর?

সোদপুর৷

শিয়ালদা লাইনের ছেলে হাওড়া লাইনে ডাকাতি করতে এসেছিস? কবে থেকে এই কাজ শুরু করেছিস?

এই প্রথম!

সবাই বলে এই প্রথম!

আমি কলেজে পড়তাম! সেকেন্ড ইয়ার পর্যন্ত পড়েছি৷

কলেজে-পড়া ডাকাত, অ্যাঁ! কলেজে-পড়া ভদ্রলোকের ছেলে হয়ে তুই এই কাজ শুরু করলি কেন?

বাবার খুব অসুখ৷ দাদা অন্য জায়গায় থাকে, কিছু সাহায্য করে না৷ মা সব সময় কাঁদে৷ বাবার চিকিৎসার পয়সাও নেই, তাই একজন বলল, এ কাজে—

যে বলল, সেও কলেজে-পড়া?

হ্যাঁ৷

মানিক ঘোষ মুখ ফিরিয়ে অন্য যাত্রীদের জিজ্ঞেস করল, আপনাদের কী মনে হয়, সত্যি কথা বলছে?

কেউ এক কথায় ঠিক উত্তর দিল না৷ নানাজনের নানা মত৷ হতেও পারে কলেজে-পড়া৷ ছেলেটা স স করে কথা বলছে না৷

মানিক ঘোষ বলল, কয়েকটা কলেজে-পড়া ছেলে একটা খেলনা পিস্তল আর দুটো সামান্য ছুরি জোগাড় করে ভাবল ডাকাতি করবে৷ ডাকাতি করা এত সোজা? খুব সহজে টাকা রোজগার করা যায়৷ এত সোজা হয়ে গেছে, কারণ আমরা সবাই ভীতু! তাই না?

আবার সে ডাকাতটিকে জিজ্ঞেস করল, যখন এ কাজে এলি, তখন ভাবিসনি যে ধরা পড়লে কী হবে? খবরের কাগজে পড়িসনি যে গ্রামের দিকে ডাকাতরা ধরা পড়লে লোকে তাদের আর পুলিশে দেয় না, নিজেরাই মেরে ফেলে!

ছেলেটি চুপ করে রইল৷

মানিক ঘোষ আবার বলল, মনে কর, তুই এই কামরার একজন যাত্রী, সঙ্গে তোর বাবা রয়েছে, এই বুড়ো ভদ্রলোকের মতন৷ তোর বাবা মেয়ের বিয়ের জন্য গয়না কিনে নিয়ে যাচ্ছেন৷ প্রভিডেন্ট ফান্ডের সব টাকা তুলে নিয়ে সঙ্গে রেখেছেন৷ এমন সময় ডাকাত উঠল৷ সব কেড়ে নিল৷ তারপর ডাকাতরা হঠাৎ ধরা পড়ে গেল৷ তখন যাত্রী হিসেবে তোর কী মনে হত? তুই ডাকাতদের কী শাস্তি দিতে চাইতিস!

ছেলেটি এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল৷ জামার হাতা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, আপনারা আমাকে মেরেই ফেলুন৷ হ্যাঁ, মেরে ফেলুন৷ আমার বাবা জানতে পারলে লজ্জায় দুঃখে আত্মহত্যা করবেন৷ আমার মা…তার চেয়ে আমার মরে যাওয়াই ভালো!

মানিক ঘোষ বলল, এতক্ষণ ও সত্যি কথা বলেছে কিনা জানি না, কিন্তু এবার সত্যি বলেছে৷ ও যখন নিজেই মরতে চাইছে, তখন ওর আত্মসম্মানজ্ঞান আছে৷ তার মানে এটাই ওর প্রথমবার৷ তাহলে ওকে ছেড়ে দেওয়াই উচিত!

কাছাকাছি লোকেরা কপালে ভুরু তুলে বলল, বলেন কী দাদা? ওকে ছেড়ে দেবো, কিছুতেই না৷

মানিক ঘোষ বলল, ধরা পড়ে ওর শিক্ষা হয়ে গেছে৷ ভদ্দরলোকের ছেলে, আর এ পথে আসবে না!

লোকেরা বলল, কিচ্ছু বিশ্বাস নেই, কিচ্ছু বিশ্বাস নেই! আবার ঠিক এ লাইন ধরবে৷ একটা অন্তত ডাকাতকে মেরে আমরা হাতের সুখ করে নিই!

মানিক ঘোষ বলল, ঠিক আছে, মারুন তাহলে৷ আপনাদের ইচ্ছে হয় তো মারুন৷ আমি ওসবের মধ্যে নেই!

বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি অনেকক্ষণ থেকেই গুনগুন করে কী যেন বলছিলেন, কেউ পাত্তা দেয়নি৷ এবার তিনি গলা চড়িয়ে বললেন, আমাদের জিনিসপত্তরগুলো কী হবে? ফেরত পাবো না? এইবার দিয়ে দাও না ভাই!

থলে দুটো একজন ভারিক্কি চেহারার লোক চেপে ধরে আছে৷ সে বলল, কী করে বোঝা যাবে কোন জিনিসটা কার? আর কার কত টাকা ছিল?

একজন টাক-মাথা লোক বলল, আমার তিনশো পঞ্চাশ টাকা ছিল৷

তার পাশের লোকটি বলল, সে কি মশাই, আমি দেখলুম, আপনার মোটে তিনখানা পঞ্চাশ টাকার নোট ছিল৷

আবার শুরু হয়ে গেল হৈচৈ৷

একজন মহিলা মানিক ঘোষের কাছে এসে কাকুতি-মিনতি করে বললেন, বাবা, তুমি এই ভার নাও৷ তুমি আমায় বাঁচিয়েছ, তোমার কথা সবাই মানবে!

বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ ভাই, তুমিই বিচার করে যার যার জিনিস দিয়ে দাও৷

মানিক ঘোষ থলি দুটো হাতে নিয়ে খুলে দেখল৷

আপন মনে বলল, টাকা-পয়সা আর গয়নাগাঁটি মন্দ পড়েনি দেখছি৷ এগুলো তাহলে আমার হাতে তুলে দিচ্ছেন?

উঠে দাঁড়িয়ে সে হঠাৎ ছুরিটা বাগিয়ে বাজখাঁই গলায় বলল, খবর্দার! কেউ আমার কাছে আসবে না৷ এলেই গলা কেটে দেবো৷ আমাকে চেনো না তোমরা৷ মানিক ঘোষের নাম শোনোনি? এ লাইনে বিখ্যাত ডাকাত মানিক ঘোষের নাম কে না জানে!

এক হাতে থলি দুটো ধরে, অন্য হাতে ছুরি দুটো তুলে সে এক-পা এক-পা করে সরে যেতে লাগল দরজার দিকে৷

সবাই স্তম্ভিত৷ কেউ টুঁ শব্দ করছে না৷

মানিক ঘোষ বলল, রক্ষকই ভক্ষক, তাই না? চিনতে পারোনি আমায়৷ তোমরা ওই পুঁচকে ডাকাতটাকে মেরে হাতের সুখ করতে চাও তো করো৷ আমি এগুলো নিয়ে চললুম৷

ট্রেনের গতি কমে এসেছে৷ কাছেই স্টেশান৷ এখান থেকে অনায়াসে লাফিয়ে নেমে পড়া যায়৷

দরজার কাছে এসে মানিক ঘোষ বলল, কী, আমাকে বাধা দেবার সাহস হল না তো কারুর? সে মুরোদ নেই! আমি ডাকাত ধরে দিলুম, তারপর তোমরা তাকে মারার জন্য ব্যস্ত৷ মারো তাহলে? আমি এগুলো নিয়ে চললুম৷

গলা ফাটিয়ে সে হা-হা করে হেসে উঠল৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *