চার অধ্যায় ০৫

চতুর্থ অধ্যায়

“আবার অখিল!–পালিয়েছিস বোডিং থেকে! তোর সঙ্গে কোনোমতে পারবার জো নেই। বারবার বলছি, এ-বাড়িতে খবরদার আসিস নে। মরবি যে।”

অখিল কোনো উত্তর না দিয়ে গলার সুর নামিয়ে বললে, “একজন দাড়িওয়ালা কে পিছনের পাঁচিল টপকিয়ে বাগানে ঢুকল। তাই তোমার এ-ঘরে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলুম।–ওই শোনো পায়ের শব্দ।” অখিল তার ছুরির সব-চেয়ে মোটা ফলাটা খুলে দাঁড়াল।

এলা বললে, “ছুরি খুলতে হবে না তোমাকে, বীরপুরুষ। দে বলছি।” ওর হাত থেকে ছুরি কেড়ে নিলে।

সিঁড়ি থেকে আওয়াজ এল, “ভয় নেই, আমি অন্তু।”

মুহূর্তে এলার মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে এল–বললে, “দে দরজা খুলে।”

দরজা খুলে দিয়ে অখিল জিজ্ঞাসা করলে, “সেই দাড়িওয়ালা কোথায়?”

“দাড়ি নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে বাগানে, বাকি মানুষটাকে পাবে এইখানেই। যাও খোঁজ করো গে দাড়ির।” অখিল চলে গেল।

এলা পাথরের মূর্তির মতো ক্ষণকাল একদৃষ্টে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বললে, “অন্তু, এ কী চেহারা তোমার?”

অতীন বললে, “মনোহর নয়।”

“তবে কি সত্যি?”

“কী সত্যি?”

“তোমাকে সর্বনেশে ব্যামোয় ধরেছে।”

“নানা ডাক্তারের নানা মত, বিশ্বাস না করলেও চলে।”

“নিশ্চয় তোমার খাওয়া হয় নি।”

“ও কথাটা থাক্‌। সময় নষ্ট করো না।”

“কেন এলে, অন্তু, কেন এলে? এরা যে তোমাকে ধরবার অপেক্ষায় আছে।”

“ওদের নিরাশ করতে চাই নে।”

অতীনের হাত চেপে ধরে এলা বললে, “কেন এলে এই নিশ্চিত বিপদের মধ্যে। এখন উপায় কী?”

“কেন এলুম সেই কথাটা যাবার ঠিক আগেই বলে চলে যাব। ইতিমধ্যে যতক্ষণ পারি ওই কথাটাই ভুলে থাকতে চাই। নিচের দরজাগুলো বন্ধ করে দিয়ে আসি গে।”

খানিক পরে উপরে এসে বললে, “চলো ছাদে। নিচের তলাকার আলোর বাল্‌বগুলো সব খুলে নিয়েছি। ভয় পেয়ো না।”

দুজনে ছাদে এসে ছাদে প্রবেশের দরজা বন্ধ করে দিলে। বন্ধ দরজায় ঠেসান দিয়ে বসল অতীন, এলা বসল তার সামনে।

“এলা, মন সহজ করো। যেন কিছু হয় নি, যেন আমরা দুজনে আছি লঙ্কাকাণ্ড আরম্ভ হবার আগে সুন্দরকাণ্ডে। তোমার হাত অমন বরফের মতো ঠাণ্ডা কেন? কাঁপছে যে। দাও গরম করে দিই।”

এলার হাত দুখানি নিয়ে অতীন জামার নিচে বুকের উপর চেপে রাখলে। তখন দূরের পাড়ায় বিয়েবাড়িতে সানাই বাজছে।

“ভয় করছে, এলী?”

“কিসের ভয়?”

“সমস্ত কিছুর। প্রত্যেক মুহূর্তের।”

“ভয় তোমার জন্যে, অন্তু, আর কিছুর জন্যে নয়।”

অতীন বললে, “এলী, মনে করতে চেষ্টা করো আমরা আছি পঞ্চাশ কি এক-শ বছর পরেকার এমনি এক নিস্তব্ধ রাতে। উপস্থিতের গণ্ডিটা নিতান্ত সংকীর্ণ, তার মধ্যে ভয়ভাবনা দুঃখকষ্ট সমস্তই প্রকাণ্ডতার ভান করে দেখা দেয়। বর্তমান সেই নীচ পদার্থ যার ছোটো মুখে বড়ো কথা। ভয় দেখায় সে মুখোশ পরে–যেন আমরা মুহূর্তের কোলে নাচানো শিশু। মৃত্যু মুখোশখানা টান মেরে ফেলে দেয়। মৃত্যু অত্যুক্তি করে না। যা অত্যন্ত করে চেয়েছি তার গায়ে মোটা অঙ্কের দাম লেখা ছিল বর্তমানের ফাঁকির কলমে, যা অত্যন্ত করে হারিয়েছি তার গায়ে দুদিনের কালি লেবেল মেরে লিখেছে অপরিসীম দুঃখ। মিথ্যে কথা! জীবনটা জালিয়াত, সে অনন্তকালের হস্তাক্ষর জাল করে চালাতে চায়। মৃত্যু এসে হাসে, বঞ্চনার দলিলটা লোপ করে দেয়। সে হাসি নিষ্ঠুর হাসি নয়, বিদ্রূপের হাসি নয়, শিবের হাসির মতো সে শান্ত সুন্দর হাসি, মোহরাত্রির অবসানে। এলী, রাত্রে একলা বসে কখনো মৃত্যুর স্নিগ্ধ সুগভীর মুক্তি অনুভব করেছ, যার মধ্যে চিরকালের ক্ষমা?”

“তোমার মতো বড়ো করে দেখবার শক্তি আমার নেই অন্তু,–তবু তোমাদের কথা মনে করে উদ্বেগে যখন অভিভূত হয়ে পড়ে মন,–তখন এই কথাটা খুব নিশ্চিত করে অনুভব করতে চেষ্টা করি যে মরা সহজ।”

“ভীরু, মৃত্যুকে পালাবার পথ বলে মনে করছ কেন? মৃত্যু সব-চেয়ে নিশ্চিত–জীবনের সব গতিস্রোতের চরম সমুদ্র, সব সত্যমিথ্যা ভালোমন্দর নিঃশেষ সমন্বয় তার মধ্যে। এইরাত্রে এখনই আমরা আছি সেই বিরাটের প্রসারিত বাহুর বেষ্টনে আমরা দুজনে–মনে পড়ছে ইবসেনের চারিটি লাইন–

Upwards
Towards the peaks,
Towards the stars,
Towards the vast silence.”

এলা অতীনের হাত কোলে নিয়ে বসে রইল স্তব্ধ হয়ে। হঠাৎ অতীন হেসে উঠল। বললে, “পিছনে মরণের কালো পর্দাখানা নিশ্চল টানা রয়েছে অসীমে, তারই উপর জীবনের কৌতুকনাট্য নেচে চলছে অন্তিম অঙ্কের দিকে। তারই একটা ছবি আজ দেখো চেয়ে। আজ তিন বছর আগে এই ছাদের উপর তুমি আমার জন্মদিনের উৎসব করেছিলে, মনে আছে?”

“খুব মনে আছে।”

“তোমার ভক্ত ছেলের দল সবাই এসেছিল। ভোজের আয়োজন ঘটা করে হয় নি। চিঁড়ে ভেজেছিলে সঙ্গে ছিল কলাইশুঁটি সিদ্ধ, মরিচের গুঁড়ো ছিটানো, ডিমের বড়াও ছিল মনে পড়ছে। সবাই মিলে খেল কাড়াকাড়ি করে। হঠাৎ মতিলাল হাতপা ছুঁড়ে শুরু করলে, আজ নবযুগে অতীনবাবুর নবজন্মের দিন–আমি লাফ দিয়ে উঠে তার মুখ চেপে ধরলুম, বললুম, বক্তৃতা যদি কর, তবে তোমার পুরোনো জন্মের দিনটা এইখানেই কাবার। বটু বললে, ছী ছী অতীনবাবু, বক্তৃতার ভ্রূণহত্যা?–নবযুগ, নবজন্ম, মৃত্যুর তোরণ প্রভৃতি ওদের বাঁধাবুলিগুলো শুনলে আমার লজ্জা করে। ওরা প্রাণপণে চেষ্টা করেছে আমার মনের উপর ওদের দলের তুলি বুলোতে, –কিছুতে রঙ ধরল না।”

“অন্তু, নির্বোধ আমি; আমিই ভেবেছিলুম তোমাকে মিলিয়ে নেব আমাদের সকল পদাতিকের সঙ্গে এক উর্দি পরিয়ে।”

“তাই আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ওদের সঙ্গে ঘোরতর দিদিয়ানা করতে। ভেবেছিলে আমার সংশোধনের পক্ষে কিছু ঈর্ষার প্রয়োজন আছে। স্নেহযত্ন কুশলসম্ভাষণ বিশেষ মন্ত্রণা আনাবশ্যক উদ্বেগ মনিহারির রঙিন সামগ্রীর মতো ওদের সামনে সাজিয়ে রেখেছিলে তোমার পসরায়। আজও তোমার করুণ প্রশ্ন কানে শুনতে পাচ্ছি, নন্দকুমার তোমার চোখমুখ লাল দেখছি কেন। বেচারা ভালোমানুষ, সত্যের অনুরোধে মাথাধরা অস্বীকার করতে না-করতে ছেঁড়া ন্যাকড়ার জলপটি এসে উপস্থিত। আমি মুগ্ধ তবু বুঝতুম এই অতি অমায়িক দিদিয়ানা তোমার অতি পবিত্র ভারতবর্ষের বিশেষ ফরমাশের। একেবারে আদর্শ স্বদেশী দিদিবৃত্তি।”

“আঃ চুপ করো, চুপ করো অন্তু।”

“অনেক বাজে জিনিসের বাহুল্য ছিল সেদিন তোমার মধ্যে, অনেক হাস্যকর ভড়ং– সে কথা তোমাকে মানতেই হবে।”

“মানছি, মানছি এক-শবার মানছি। তুমিই সে সমস্ত নিঃশেষে ঘুচিয়ে দিয়েছ। তবে আজ আবার অমন নিষ্ঠুর করে বলছ কেন?”

“কোন্‌ মনস্তাপে বলছি, শোনো। জীবিকা থেকে ভ্রষ্ট করেছ বলে সেদিন আমার কাছে মাপ চাইছিলে। যথার্থ জীবনের পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছি অথচ সেই সর্বনাশের পরিবর্তে যা দাবি করতে পারতুম তা মেটে নি। আমি ভেঙেছি আমার স্বভাবকে, কুসংস্কারে অন্ধ তুমি ভাঙতে পারলে না তোমার পণকে যার মধ্যে সত্য ছিল না; এজন্যে মাপ চাওয়া কি বাহুল্য ছিল? জানি তুমি ভাবছ, এতটা কী করে সম্ভব হল।”

“হাঁ অন্তু, আমার বিস্ময় কিছুতেই যায় না–জানি নে আমার এমন কী শক্তি ছিল।”

“তুমি কী করে জানবে? তোমাদের শক্তি তোমাদের নিজের নয়, ও মহামায়ার। কী আশ্চর্য় সুর তোমার কণ্ঠে, আমার মনের অসীম আকাশে ধ্বনির নীহারিকা সৃষ্টি করে। আর তোমার এই হাতখানি, ওই আঙুলগুলি, সত্যমিথ্যে সব-কিছুর ‘পরে পরশমণি ছুঁইয়ে দিতে পারে। জানি নে, কী মোহের বেগে, ধিক্‌কার দিতে দিতেই নিয়েছি স্খলিত জীবনের অসম্মান। ইতিহাসে পড়েছি এমন বিপত্তির কথা, কিন্তু আমার মতো বুদ্ধি-অভিমানীর মধ্যে এটা যে ঘটতে পারে কখনো তা ভাবতে পারতুম না। এবার জাল ছেঁড়বার সময় এল, তাই আজ বলব তোমাকে সত্য কথা, যত কঠোর হোক।”

“বলো, বলো, যা বলতে হয় বলো। দয়া করো না আমাকে। আমি নির্মম, নির্জীব, আমি মূঢ়–তোমাকে বোঝবার শক্তি আমার কোনোকালে ছিল না। অতুল্য যা তাই এসেছিল হাত বাড়িয়ে আমার কাছে, অযোগ্য আমি, মূল্য দিই নি। বহুভাগ্যের ধন চিরজন্মের মতো চলে গেল। এর চেয়ে শাস্তি যদি থাকে, দাও শাস্তি।”

“থাক্‌, থাক্‌, শাস্তির কথা। ক্ষমাই করব আমি। মৃত্যু যে ক্ষমা করে সেই অসীম ক্ষমা। সেইজন্যেই আজ এসেছি।”

“সেইজন্যে?”

“হাঁ কেবলমাত্র সেইজন্যে।”

“না-ই ক্ষমা জানাতে তুমি। কিন্তু কেন এলে এমন করে বেড়া-আগুনের মধ্যে? জানি, জানি বাঁচবার ইচ্ছে নেই তোমার। তা যদি হয় তাহলে কটা দিন কেবলমাত্র আমাকে দাও, দাও তোমার সেবা করবার শেষ অধিকার। পায়ে পড়ি তোমার।”

“কী হবে সেবা! ফুটো জীবনের ঘটে ঢালবে সুধা! তুমি জান না, কী অসহ্য ক্ষোভ আমার। শুশ্রূষা দিয়ে তার কী করতে পার, যে-মানুষ আপন সত্য হারিয়েছে!”

“সত্য হারাও নি অন্তু। সত্য তোমার অন্তরে আছে অক্ষুণ্ন হয়ে।”

“হারিয়েছি, হারিয়েছি।”

“বলো না বলো না অমন কথা।”

“আমি যে কী যদি জানতে পারতে তোমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত শিউরে উঠত।”

“অন্তু, আত্মনিন্দা বাড়িয়ে তুলছ কল্পনায়। নিষ্কামভাবে যা করেছ তার কলঙ্ক কখনোই লাগবে না তোমার স্বভাবে।”

“স্বভাবকেই হত্যা করেছি, সব হত্যার চেয়ে পাপ। কোনো অহিতকেই সমূলে মারতে পারি নি, সমূলে মেরেছি কেবল নিজেকে। সেই পাপে, আজ তোমাকে হাতে পেলেও তোমার সঙ্গে মিলতে পারব না। পাণিগ্রহণ! এই হাত নিয়ে! কিন্তু কেন এ-সব কথা! সমস্ত কালো দাগ মুছবে যমকন্যার কালো জলে, তারই কিনারায় এসে বসেছি। আজ বলা যাক্‌ যত সব হালকা কথা হাসতে হাসতে। সেই জন্মদিনের ইতিবৃত্তটা শেষ করে দিই। কী বল, এলী?”

“অন্তু, মন দিতে পারছি নে।”

“আমাদের দুজনের জীবনে মন দেবার যোগ্য যা-কিছু আছে সে কেবল ওইরকম গোটাকয়েক হালকা দিনের মধ্যে। ভোলবার যোগ্য ভারি ভারি দিনই তো বহুবিস্তর।”

“আচ্ছা, বলো অন্তু।”

“জন্মদিনের খাওয়া হয়ে গেল। হঠাৎ নীরদের শখ হল পলাশির যুদ্ধ আবৃত্তি করবে। উঠে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে গিরিশ ঘোষের ভঙ্গিতে আউড়িয়ে গেল–

কোথা যাও ফিরে চাও সহস্র কিরণ,

বারেক ফিরিয়া চাও ওগো দিনমণি।

নীরদ লোক ভালো, অত্যন্ত সাদাসিধে, কিন্তু নির্দয় তার স্মরণশক্তি। সভাটা ভেঙে ফেলবার জন্যে আমার মন যখন হন্যে হয়ে উঠেছে তখন ওরা ভবেশকে গান গাইতে অনুরোধ করলে। ভবেশ বললে, হার্মোনিয়ম সঙ্গে না থাকলে ও হাঁ করতে পারে না। –তোমার ঘরে ওই পাপটা ছিল না। ফাঁড়া কাটল। আশান্বিত মনে ভাবছি এইবার উপসংহার, এমন সময় সতু খামকা তর্ক তুললে, মানুষ জন্মায় জন্মদিনে না জন্মতিথিতে? যত বলি থামো সে থামে না। তর্কের মধ্যে দেশাত্মবোধের ঝাঁজ লাগল, চড়তে লাগল গলার আওয়াজ, বন্ধুবিচ্ছেদ হয় আর কি। বিষম রাগ হল তোমার উপরে। আমার জন্মদিনকে একটা সামান্য উপলক্ষ্য করেছিলে, মহত্তর লক্ষ্য ছিল কর্মভাইদের একত্র করা।”

“কোন্‌টা লক্ষ্য কোন্‌টা উপলক্ষ্য বাইরে থেকে বিচার করো না অন্তু। শাস্তির যোগ্য আমি, কিন্তু অন্যায় শাস্তির না। মনে নেই তোমার, সেইবারকার জন্মদিনেই অতীন্দ্রবাবু আমার মুখে নাম নিলেন অন্তু? সেটা তো খুব ছোটো কথা নয়। তোমার অন্তু নামের ইতিহাসটা বলো শুনি।”

“সখী, তবে শ্রবণ করো। তখন বয়স আমার চার পাঁচ বছর, মাথায় ছিলুম ছোটো, কথা ছিল না মুখে, শুনেছি বোকার মতো ছিল চোখের চাহনি। জ্যেঠামশায় পশ্চিম থেকে এসে আমাকে প্রথম দেখলেন। কোলে তুলে নিলেন, বললেন, এই বালখিল্যটার নাম অতীন্দ্র রেখেছে কে? অতিশয়োক্তি অলংকার, এর নাম দাও অনতীন্দ্র। সেই অনতি শব্দটা স্নেহের কণ্ঠে অন্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। তোমার কাছেও একদিন অতি হয়েছে অনতি, ইচ্ছে করে খুইয়েছে মান।”

হঠাৎ অতীন চমকে উঠে থেমে গেল। বললে, “পায়ের শব্দ শুনছি যেন।”

এলা বললে, “অখিল।”

আওয়াজ এল, “দিদিমণি।”

ছাদে আসবার দরজা খুলে দিয়ে এলা জিজ্ঞাসা করলে, “কী।”

অখিল বললে, “খাবার।”

বাড়িতে রান্নার ব্যবস্থা নেই। অদূরবর্তী দিশি রেস্‌টোরাঁ থেকে বরাদ্দমত খাবার দিয়ে যায়।

এলা বললে, “অন্তু, চলো খেতে।”

“খাওয়ার কথা বলো না। না খেয়ে মরতে মানুষের অনেকদিন লাগে। নইলে ভারতবর্ষ টিঁকত না। ভাই অখিল, আর রাগ রেখো না মনে। আমার ভাগটা তুমিই খেয়ে নাও। তার পরে পলায়নেন সমাপয়েৎ–দৌড় দিয়ো যত পার।”

অখিল চলে গেল।

দুজনে ছাদের মেঝের উপর বসল। অতীন আবার শুরু করলে। “সেদিনকার জন্মদিন চলতে লাগল একটানা, কেউ নড়বার নাম করে না। আমি ঘন ঘন ঘড়ি দেখছি, ওটা একটা ইঙ্গিত রাতকানাদের কাছে। শেষকালে তোমাকে বললুম, সকাল সকাল তোমার শুতে যাওয়া উচিত, এই সেদিন ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে উঠেছ। –প্রশ্ন উঠল, “কটা বেজেছে?’ উত্তর “সাড়ে দশটা।’ সভা ভাঙবার দুটো-একটা হাইতোলা গড়িমসি-করা লক্ষণ দেখা গেল। বটু বললে, বসে রইলেন যে অতীনবাবু? চলুন একসঙ্গে যাওয়া যাক্‌। –কোথায়? না, মেথরদের বস্‌তিতে; হঠাৎ গিয়ে পড়ে ওদের মদ খাওয়া বন্ধ করতে হবে। –সর্বশরীর জ্বলে উঠল। বললুম, মদ তো বন্ধ করবে, তার বদলে দেবে কী।–বিষয়টা নিয়ে এতটা উত্তেজিত হবার দরকার ছিল না। ফল হল, যারা চলে যাচ্ছিল তারা দাঁড়িয়ে গেল। শুরু হল–আপনি কি তবে বলতে চান–তীব্রস্বরে বলে উঠলুম–কিছু বলতে চাই নে।–এতটা বেশি ঝাঁজও বেমানান হল। গলা ভারি করে তোমার দিকে আধখানা চোখে চেয়ে বললুম, তবে আজ আসি। দোতলায় তোমার ঘরের সামনে পর্যন্ত এসে পা চলতে চায় না। কী বুদ্ধি হল বুকের পকেট চাপড়িয়ে বললুম, ফাউন্টেন পেনটা বুঝি ফেলে এসেছি। বটু বললে, আমিই খুঁজে আনছি– বলেই দ্রুত চলে গেল ছাদে। পিছু পিছু ছুটলুম আমি। খানিকটা খোঁজবার ভান করে বটু ঈষৎ হেসে বললে, দেখুন তো বোধ করি পকেটেই আছে। নিশ্চিত জানতুম আমার ফাউন্টেন পেনটা আবিষ্কার করতে হলে ভূগোল সন্ধানের প্রয়োজন আমার নিজের বাসাতেই। স্পষ্ট বলতে হল, এলাদির সঙ্গে বিশেষ কথা আছে। বটু বললে, বেশ তো অপেক্ষা করছি। আমি বললুম, অপেক্ষা করতে হবে না, যাও। বটু ঈষৎ হেসে বললে, রাগ করেন কেন অতীনবাবু, আমি চললুম।”

আবার পায়ের শব্দ শুনে অতীন চমকে উঠে থামল। অখিল এল ছাদে। বললে, “কে একজন এই চিরকুট দিয়েছে অতীনবাবুকে। তাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখেছি।

এলার বুক ধড়াস করে উঠল, বললে, “কে এল?”

অতীন বললে, বাবুকে ঢুকতে দাও ঘরে।” অখিল জোরের সঙ্গে বললে, “না, দেব না।”

অতীন বললে, “ভয় নেই, বাবুকে তুমি চেন; অনেকবার দেখেছ।”

“না চিনি নে।”

“খুব চেন। আমি বলছি, ভয় নেই, আমি আছি।”

এলা বললে, “অখিল, যা তুই মিথ্যে ভয় করিস নে।”

অখিল চলে গেল।

এলা জিজ্ঞাসা করলে, “বটু এসেছে না কি?”

“না বটু নয়।”

“বলো না, কে এসেছে। আমার ভালো লাগছে না।”

“থাক্‌ সে-কথা, যা বলছিলুম বলতে দাও।”

“অন্তু, কিছুতেই মন দিতে পারছি নে।”

“এলা, শেষ করতে দাও আমার কাহিনী। বেশি দেরি নেই।–তুমি উঠে এলে ছাদে। মৃদুগন্ধ পেলুম রজনীগন্ধার। ফুলের গুচ্ছটি সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলে একলা আমার হাতে দেবে বলে। আমাদের সম্বন্ধের ক্ষেত্রে অন্তুর জীবনলীলা শুরু হল এই লাজুক ফুলের গোপন অভ্যর্থনায়, তার পর থেকে অতীন্দ্রনাথের বিদ্যাবুদ্ধি গাম্ভীর্য ক্রমে ক্রমে তলিয়ে গেল অতলস্পর্শ আত্মবিস্মৃতিতে। সেইদিন প্রথম তুমি আমার গলা জড়িয়ে ধরলে, বললে, এই নাও জন্মদিনের উপহার–সেই পেয়েছি প্রথম চুম্বন। আজ দাবি করতে এসেছি শেষ চুম্বনের।”

অখিল এসে বললে, “বাবুটি দরজায় ধাক্কা মারতে শুরু করেছে। ভাঙল বুঝি। বলছে, জরুরি কথা।”

“ভয় নেই অখিল, দরজা ভাঙবার আগেই তাকে ঠাণ্ডা করব। বাবুকে ওইখানেই অনাথ করে রেখে তুমি এখনই পালাও অন্য ঠিকানায়। আমি আছি এলাদির খবর নিতে।”

এলা অখিলকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে তার মাথায় চুমো খেয়ে বললে, “সোনা আমার, লক্ষ্ণী আমার, ভাই আমার, তুই চলে যা। তোর জন্যে কখানা নোট আমার আঁচলে বেঁধে রেখেছি, তোর এলাদির আশীর্বাদ। আমার পা ছুঁয়ে বল্‌, এখনই তুই যাবি, দেরি করবি নে।”

অতীন বললে, “অখিল আমার একটি পরামর্শ তোমাকে শুনতেই হবে। যদি তোমাকে কখনো কোনো প্রশ্ন কেউ জিজ্ঞাসা করে তুমি ঠিক কথাই বলবে। বলো এই রাত এগারোটার সময় আমিই তোমাকে জোর করে এ-বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি। চলো কথাটাকে সত্য করে আসি।”

এলা আর-একবার অখিলকে কাছে টেনে নিয়ে বললে, “আমার জন্যে ভাবিস নে ভাই। তোর অন্তুদা রইল, কোনো ভয় নেই।”

অখিলকে যখন ঠেলে নিয়ে অতীন চলেছে এলা বললে,”আমিও যাই তোমার সঙ্গে অন্তু।”

আদেশের স্বরে অতীন বললে, “না, কিছুতেই না।”

ছাদের ছোটো পাঁচিলটার উপর বুক চেপে ধরে এলা দাঁড়িয়ে রইল–কণ্ঠের কাছে গুমরে গুমরে উঠতে লাগল কান্না, বুঝলে আজ রাত্রে ওর কাছ থেকে চিরকালের মতো অখিল গেল চলে।

ফিরে এল অতীন। এলা জিজ্ঞাসা করলে, “কী হল, অন্তু?”

অতীন বললে “অখিল গেছে। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছি।”

“আর সেই লোকটি?”

“তাকেও দিয়েছি ছেড়ে। সে বসে বসে ভাবছিল কাজে ফাঁকি দিয়ে আমি বুঝি কেবল গল্পই করছি। যেন নতুন একটা আরব্য উপন্যাস শুরু হয়েছে। আরব্য উপন্যাসই বটে। সমস্তটাই গল্প, একেবারেই আজগবি গল্প। ভয় করছে এলা? আমাকে ভয় নেই তোমার?”

“তোমাকে ভয়, কী যে বল।”

“কী না করতে পারি আমি! পড়েছি পতনের শেষ সীমায়। সেদিন আমাদের দল অনাথা বিধবার সর্বস্ব লুঠ করে এনেছে। মন্মথ ছিল বুড়ীর গ্রামসম্পর্কে চেনা লোক–খবর দিয়ে পথ দেখিয়ে সে-ই এনেছে দলকে। ছদ্মবেশের মধ্যেও বিধবা তাকে চিনতে পেরে বলে উঠল, মনু, বাবা তুই এমন কাজ করতে পারলি? তার পরে বুড়ীকে আর বাঁচতে দিলে না। যাকে বলি দেশের প্রয়োজন সেই আত্মধর্মনাশের প্রয়োজনে টাকাটা এই হাত দিয়েই পৌছেছে যথাস্থানে। আমার উপবাস ভেঙেছি সেই টাকাতেই। এতদিন পরে যথার্থ দাগি হয়েছি চোরের কলঙ্কে, চোরাই মাল ছুঁয়েছি, ভোগ করেছি। চোর অতীন্দ্রের নাম বটু ফাঁস করে দিয়েছে। পাছে প্রমাণাভাবে শাস্তি না পাই বা অল্প শাস্তি পাই সেইজন্য পুলিস-সুপারিন্টেণ্ডেন্টের মারফত সে-মকদ্দমা ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে দায়ের না হয়ে যাতে বাঙালি জয়ন্ত হাজরার এজলাসে ওঠে কমিশনরের কাছ থেকে সেই হুকুম আনাবে বলে মন্ত্রণা করে রেখেছে। সে নিশ্চিত জানে, কাল ধরা পড়বই। ইতিমধ্যে ভয় করো আমাকে, আমি নিজে ভয় করি আমার মৃত আত্মার কালো ভূতটাকে। আজ তোমার ঘরে কেউ নেই।”

“কেন, তুমি আছ।”

“আমার হাত থেকে বাঁচাবে কে?”

“নেই বা বাঁচালে।”

“তোমারই আপন মণ্ডলীতে একদিন যারা ছিল এলাদির সব দেশভাই–ভাইফোঁটা দিয়েছ যাদের কপালে প্রতিবৎসর–তাদেরই মধ্যে কথা উঠেছে যে তোমার বেঁচে থাকা উচিত নয়।”

“তাদের চেয়ে বেশি অপরাধ আমি কী করেছি?”

“অনেক কথা জান তুমি, অনেকের নামধাম। পীড়ন করলে বেরিয়ে পড়বে।”

“কখনোই না।”

“কী করে বলব যে-মানুষটা এসেছিল আজ, এই হুকুম নিয়েই সে আসে নি? হুকুমের জোর কত সে তো জান তুমি।”

এলা চমকে উঠে বললে, “সত্যি বলছ অন্তু, সত্যি?”

“একটা খবর পেয়েছি আমরা।”

“কী খবর?”

“আজ ভোররাত্রে পুলিস আসবে তোমাকে ধরতে।”

“নিশ্চিত জানতুম একদিন পুলিস আমাকে ধরতে আসছে।”

“কেমন করে জানলে?”

“কাল বটুর চিঠি পেয়েছি, সে খবর দিয়েছে পুলিস আমাকে ধরবে, লিখেছে–সে এখনও আমাকে বাঁচাতে পারে।”

“কী উপায়ে?”

“বলছে, যদি তাকে বিয়ে করি তাহলে সে আমার জামিন হয়ে আমার দায় গ্রহণ করবে।”

অন্ধকার হয়ে উঠল অতীনের মুখ, জিজ্ঞাসা করলে, “কী জবাব দিলে তুমি?”

এলা বললে, “আমি সেই চিঠির উপর কেবল লিখে দিলুম পিশাচ। আর-কিছু নয়।”

“খবর পেয়েছি, সেই বটুই আসবে কাল পুলিসকে সঙ্গে নিয়ে। তোমার সম্মতি পেলেই বাঘের সঙ্গে রফা করে তোমাকে কুমিরের গর্তে আশ্রয় দেবার হিতব্রতে সে উঠে পড়ে লাগবে। তার হৃদয় কোমল।”

এলা অতীনের পা জড়িয়ে ধরে বললে, “মারো আমাকে অন্তু, নিজের হাতে। তার চেয়ে সৌভাগ্য আমার কিছু হতে পারে না।” মেঝের থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অতীনকে বার বার চুমো খেয়ে বললে, “মারো এইবার মারো।” ছিঁড়ে ফেললে বুকের জামা।

অতীন পাথরের মূর্তির মতো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

এলা বললে, “একটুও ভেবো না অন্তু। আমি যে তোমার, সম্পূর্ণই তোমার– মরণেও তোমার। নাও আমাকে। নোংরা হাত লাগতে দিয়ো না আমার গায়ে, আমার এ দেহ তোমার।”

অতীন কঠিন সুরে বললে, “যাও এখনই শুতে যাও, হুকুম করছি শুতে যাও।”

অতীনকে বুকে চেপে ধরে এলা বলতে লাগল।–“অন্তু, অন্তু আমার, আমার রাজা, আমার দেবতা, তোমাকে কত ভালোবেসেছি আজ পর্যন্ত সম্পূর্ণ করে তা জানাতে পারলুম না। সেই ভালোবাসার দোহাই, মারো, আমাকে মারো।”

অতীন এলার হাত জোর করে ধরে তাকে শোবার ঘরে টেনে নিয়ে গেল, বললে, “শোও, এখনই শোও। ঘুমোও।”

“ঘুম হবে না।”

“ঘুমোবার ওষুধ আছে আমার হাতে।”

“কিচ্ছু দরকার নেই অন্তু। আমার চৈতন্যের শেষ মুহূর্ত তুমিই নাও। ক্লোরোফর্‌ম এনেছ? দাও ওটাকে ফেলে। ভীরু নই আমি; জেগে থেকে যাতে মরি তোমার কোলে তাই করো। শেষ চুম্বন আজ অফুরান হল অন্তু। অন্তু।”

দূরের থেকে হুইস্‌লের শব্দ এল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *