চারে বেদ

চার বেদ

সাউথ ব্লকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রঞ্জিত গগৈয়ের অফিসে ঢুকে প্রথমা বলল, ‘জরুরি তলব কেন? আমরা সবাই সিরিয়াস কাজে ফেঁসে আছি। জঙ্গি ডেরার খোঁজে আমাকে লন্ডন যেতে হবে। আয়েষা আর অভিনন্দন যাবে সুবর্ণভূমি। দিল্লিতে পড়ে থাকবে শুধু ষষ্ঠী আর ধ্রুবিকা।’

ভারত সরকারের এলিট ইনটেলিজেন্স উইং কাইমেরার কাজের ফর্দ শুনে মৃদু হেসে রঞ্জিত বললেন, ‘দরকারটা সিরিয়াস, প্র্যাট।’

‘কীরকম?’ মুঠোর ওপরে চিবুক রেখে সামনে ঝুঁকে বসে প্রথমা।

‘আমাদের দেশ থেকে নানা ধনসম্পদ বিদেশে পাচার হয়। অতীতে শক, হুন, পাঠান, মোগল, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, ইংরেজ—যে যা পেরেছে নিয়ে গেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ভারতীয়রাও ডাকাতিতে যোগ দিয়েছে। আমাদের পুরোনো পুঁথি, থাংকা, হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির বিদেশে বিপুল চাহিদা। সেই চাহিদা মাফিক অর্ডার সাপ্লাই করে কলকাতার তিনজন ছেলেমেয়ে। এরা নিজেদের বলে, ‘অর্ডার সাপ্লায়ার’ বা ‘ও এস’। তিনজনই প্রভাবশালী পরিবারের ছেলেমেয়ে। এদের অ্যারেস্ট করা কোনও ব্যাপার না। কিন্তু সলিড প্রমাণ না থাকলে ঠিক জাল কেটে বেরিয়ে যাবে। মুখ পুড়বে আমার। ‘ও এস’-এর ফাইলটা দ্যাখ।’ পাতলা ফাইল এগিয়ে দিলেন রঞ্জিত।

ফাইলের প্রথম নামেই চমক। বাইশ বছরের হেমচন্দ্র মণ্ডল কলকাতার নামি কলেজে পড়ে। বাবা সুরেশ মণ্ডল ঝাড়খন্ড থেকে ভোটে জিতে কেন্দ্রের মন্ত্রী। দ্বিতীয় নাম রাজা ভকত। হেমচন্দ্রের সহপাঠী। রাজার মা ওই রাজ্যের নির্বাচিত সাংসদ। তৃতীয় নাম রেনু ভকত। নামের পাশে লেখা, ‘এক্সপায়ার্ড।’

‘এটা কী ব্যাপার?’ জানতে চাইল প্রথমা।

‘রেনু রাজার বোন। আর্ট কলেজের ছাত্রী। প্রিন্টিং টেকনোলজি নিয়েও পড়াশুনো করেছিল। দিন পনেরো আগে বাইক অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে।’

‘সত্যি অ্যাক্সিডেন্ট না খুন?’

‘সত্যি অ্যাক্সিডেন্ট। আরও একজন বাইকার মারা গেছে।

‘আমাকে কেন দরকার, সেটা বলুন।’

প্রথমার কথা শুনে রঞ্জিত খবরের কাগজে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের একটা কাটিং এগিয়ে দিলেন। বিজ্ঞাপনের বয়ান হল, ‘ইসাবেলা ব্যারেট লিখিত অথর্ব বেদের পাণ্ডুলিপির সন্ধানে আছেন মিমি ব্যানার্জি আর্চার। যোগাযোগ করুন এই মেল আইডিতে।’ বিজ্ঞাপনের নীচে একটি মেল আইডি লেখা।

প্রথমা বলল, ‘মিমি কে?’

‘কলকাতার মেয়ে। এখন লন্ডনে থাকেন। স্বামী নামকরা মিডিয়া ব্যারন মিকি আর্চার। অনেকগুলো টিভি চ্যানেল, ম্যাগাজিন আর খবরের কাগজের মালিক। মিডিয়া ব্যারন এবং তাঁর স্ত্রী—দুজনেই মিডিয়া থেকে দূরে থাকেন। ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে চূড়ান্ত গোপনীয়তা মেনটেন করেন। ইংল্যান্ডের রানির অনুরোধে একবার একটি আর্ট গ্যালারির উদ্বোধনে গিয়ে লন্ডন টাইমসের চিত্র সাংবাদিকের ক্যামেরার সামনে পড়ে গিয়েছিলেন। নেট ঘাঁটলে আর্চার দম্পতির ওই একটিই ছবি পাওয়া যায়। মিমিকে নিয়ে যা জেনেছি, তা হল এই…’ আর একটা ফাইল এগিয়ে দেন রঞ্জিত।

ফাইল খুলে প্রথমা বলল, ‘লন্ডন টাইমসের সেই ছবি। তথ্য বলতে, মিমির বয়স এখন চল্লিশ। ওজন পঞ্চাশ কিলো, চোখের মণির রং কালো, উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। মানে আমার মতো। বাগবাজার মাল্টিপারপাস থেকে স্কুলিং। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃতে এমএ। ইন্টারেস্টিং!’

ফাইল ফেরত নিয়ে রঞ্জিত বললেন, ‘মিমির কাছে ভারতীয় পুঁথির বিশাল সংগ্রহ আছে। মিমি জেনেছেন যে কলকাতায় বেদের লিখিত পাণ্ডুলিপি আছে।’

‘বেদের লিখিত রূপ কীভাবে এল?’

রঞ্জিত বললেন, ‘এই বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। মিমি কলকাতায় এলে ওঁকে পুলিশি নিরাপত্তা দিতে হয়। সেই ব্যাপারে কলকাতা পুলিশ মিমির সঙ্গে যোগাযোগ করে। মিমি বলেন, কলকাতার হেমচন্দ্র মণ্ডল মেল করে ওঁকে জানিয়েছে যে তার কাছে পুঁথিটা আছে। এবং পুঁথির দাম এক কোটি টাকার আশেপাশে।’

‘বুঝলাম,’ প্রথমার মুখে রহস্যময় হাসি, ‘অর্ডার সাপ্লায়ার গ্যাংকে হাতেনাতে ধরতে হবে। তাই তো?’

রঞ্জিত এই হাসির মানে জানেন। প্রথমা কোনও প্ল্যান কষছে। রঞ্জিত বললেন, ‘কী ভাবছিস?’

‘মিমির সঙ্গে দেখা করতে চাই।’

‘আজ চোদ্দোই এপ্রিল। মানে পয়লা বৈশাখ। মিমি আসছেন সাতই মে। তখন দেখা করিস।’

‘আমাকে তিন-চার দিনের মধ্যে লন্ডন যেতেই হবে। তখনই মিমির সঙ্গে দেখা করতে চাই,’ রঞ্জিতের চেম্বার থেকে বেরোচ্ছে প্রথমা, ‘আমি আপনাকে মেল করছি ফ্লাইটের টিকিট আর হোটেল বুকিং-এর জন্যে। ওটা আপনার সেক্রেটারিকে দেখতে বলবেন। আর আপনি মিমির সঙ্গে আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করে দিন।’

রঞ্জিত বললেন, ‘ফেরার টিকিটের কী হবে?’

‘আগে যাই। সিচুয়েশন বুঝি। তারপর আপনাকে মেল করে জানাব।’ দরজা বন্ধ করে দিয়েছে প্রথমা।

‘এত কী গবেষণা করছিস?’ হেমচন্দ্র মণ্ডলের কোমরে খোঁচা মেরে বলল রাজা ভকত।

‘বাজে না বকে ফ্রিজ থেকে তিনটে কোক নিয়ে আয়।’ ল্যাপটপে ঝুঁকে বলল হেমচন্দ্র।

‘তিনটে কেন? আমরা তো দুজন!’ আবার কোমরে খোঁচা দেয় রাজা।

‘শ্রুতি আসছে।’ প্রিন্টারে একগাদা পেজ গুঁজে প্রিন্টার অন করে হেমচন্দ্র।

ওরা দুজন বসে রয়েছে হেমচন্দ্রের বাড়ির শোওয়ার ঘরে। হেমের বাবা-মা দিল্লিতে থাকেন। কলকাতার ফ্ল্যাটে হেমচন্দ্র একা। রাজার মাকে সংগঠনের কাজের সূত্রে দিনরাত দৌড়োদৌড়ি করতে হয়। মায়ের অনুমতি নিয়ে সে হেমচন্দ্রের বাড়ি থাকে। আজ বৈশাখ মাসের কুড়ি তারিখ। গরমের চোটে লোকে রাস্তায় বেরোচ্ছে না। ঘরে এসির তাপমান ষোল ডিগ্রিতে বাঁধা।

রেনুর আঁকা একটি থাংকা হেমচন্দ্র এক জাপানি ট্যুরিস্টকে কুড়ি হাজার ডলারে বিক্রি করে। জাপানি ভদ্রলোককে হেমচন্দ্র বুঝিয়েছিল, থাংকাটি একশো বছরের পুরোনো। এই ঘটনার পর থেকে পুঁথি বা থাংকার জন্যে বিদেশ থেকে অর্ডার আসতে থাকে।

হেমচন্দ্রের কনট্যাক্ট এবং ব্রেন আছে। রাজা মাথামোটা কিন্তু শার্প শুটার। রেনু আঁকাআঁকি নিয়ে থাকে আর রিসার্চের কাজ করে। তিনজনেই দামি গাড়ি, ব্র্যান্ডেড পোশাক, জুতো এবং সানগ্লাস ভালোবাসে। ভালোবাসে বিদেশ ভ্রমণ করতে। এসবের জন্যে টাকা চাই। সেই থেকে ‘ও এস’-এর জন্ম।

মুশকিল হল, কিছুদিন আগে রেনু বাইক অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। ক্যালিগ্রাফি এবং পেইন্টিং-এ তুখোড় একজনের খোঁজে ছিল হেমচন্দ্র। দিন দশেক আগে শ্রুতির সন্ধান পাওয়া গেছে। মেয়েটার কাজ দেখে হেমচন্দ্র খুশি।

দুটো কোক এনে রাজা দেখল খুব রোগা একটা মেয়ে চপরচপর করে বাবল গাম চিবোচ্ছে আর কানে মোবাইলের হেডফোন গুঁজে গান শুনছে। হাত ভর্তি ট্যাটু, কান আর ভুরুতে একগাদা রিং পরা। পরনে নোংরা জিনস আর টিশার্ট। টেবিলে কোক রেখে রাজা হেমচন্দ্রকে বলল, ‘কীসের প্রিন্ট আউট নিচ্ছিস?’

পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে হেমচন্দ্র বলল, ‘ইসাবেলা ব্যারেট ভারতবর্ষের আসেন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বছরে। তখন তাঁর দশ বছর বয়স। ইসাবেলার বাবা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরি করতেন। ইসাবেলার পড়াশুনো কলকাতা শহরে। ব্রজলাল আচার্য নামের এক ব্রাহ্মণের কাছে তিনি উপনিষদ ও বেদের পাঠ নেন। ইসাবেলা আঁকতে ভালোবাসতেন। ক্যালিগ্রাফিতে আগ্রহ ছিল। ব্রজলালের পরামর্শে তিনি ঋক, সাম, যজু এবং অথর্ব বেদের হাতে লেখা সংস্করণ তৈরি করেন।’

‘বেদের তো আরও লিখিত রূপ আছে।’ বলে শ্রুতি।

‘তা আছে,’ বলে হেমচন্দ্র, ‘কিন্তু এই সংস্করণটি নানান কারণে ইউনিক। এক নম্বর, কুড়ি বছর বয়সি এক ব্রিটিশ মেয়ে দেবনাগরী হরফ শিখে এই কাজটি করেছিলেন। দু’নম্বর, এর কোনও কপি নেই। এটি এক এবং অদ্বিতীয়। তিন নম্বর, ইসাবেলা ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার আগে ব্রজলালকে চারটি বেদ দিয়ে যান। ব্রিটিশরা দেশ ছাড়ার সময়ে ব্রজলালের শ্যামপুকুরের বাড়ি থেকে তিনটে বেদ নিয়ে গিয়েছে।’

‘চার নম্বরটা নিল না কেন?’ কোঁকড়া চুলে ঘষঘষ করে আঙুল চালিয়ে প্রশ্ন করে শ্রুতি।

‘ব্রজলাল বাধা দিয়েছিলেন। ব্রিটিশরা তাঁকে হত্যা করে বাড়ির পাতকুয়োয় ফেলে দিয়ে যায়। আচার্য পরিবারের বর্তমান বংশধরের কাছে চতুর্থ বেদের পাণ্ডুলিপি থাকার কথা।’

রাজা বলল, ‘মিমি সরাসরি তার কাছ থেকে মালটা নিচ্ছে না কেন?’

‘অর্ডার সাপ্লাইয়ের মূল মন্ত্র ভুলে গেলি?’ হাসছে হেমচন্দ্র, ‘একজন একটা জিনিস ডিম্যান্ড করছে। অন্য একজন সেই জিনিসটা সাপ্লাই করে। এই দু’জনের মধ্যে যোগসূত্র হল অর্ডার সাপ্লায়ার? উনি আচার্য পরিবারের নাম জানেন না। যেটা আমি জানি।’

‘তোর প্ল্যান কী?’ রাজা কোকে চুমুক দিয়েছে।

‘খোঁজ নিয়ে দেখলাম, আচার্যদের বংশধরদের ক্যালাসনেসের জন্যে ইসাবেলার হাতে লেখা চতুর্থ বেদ নষ্ট হয়ে গেছে। তবে ওরা প্রতি পাতার ছবি তুলে রেখেছিল। সেগুলো নিয়ে এসেছি। আমি ঠিক করেছি, নতুন পাণ্ডুলিপি বানিয়ে মিমিকে বেচব।’

‘উনি কিনবেন কেন? পুঁথি যে জাল, সেটা বুঝতে পারবেন না?’

‘যাতে না পারেন সেই দায়িত্ব শ্রুতির। কি রে শ্রুতি, পারবি না?’

ফটাস করে বাবল গাম ফাটিয়ে শ্রুতি বলে, ‘মিমিকে জাল পুঁথি গছাবে? জালিয়াতির কেস খেলে তো জেল!’

‘আমার সঙ্গে মিমির মেল চালাচালি হয়ে গেছে। উনি এক কোটি টাকা অফার করেছেন।’ হেমচন্দ্র মুচকি হেসে বলে।

টাকার পরিমাণ শুনে রাজার চোখ চকচক করে ওঠে। শ্রুতি শ্রাগ করে বলে, ‘আমি এখনও কনভিনসড নই। আর একটু খবর নেওয়া উচিত।’

নতুন মেয়েটাকে থাপ্পড় মারার জন্যে রাজার হাত নিশপিশ করছে। বিরক্ত হয়ে সে বলল, ‘হেম, এই ফালতু মেয়েটাকে দলে নিলি কেন? বেয়াড়া তককো করে শুধু।’

শ্রুতি রাজার দিকে তাকিয়ে হিশহিশ করে বলল, ‘নন্দলাল বসুর একটা পেইন্টিং-এর কপি করে দিয়েছিলাম। সেটা আমেরিকান কালেক্টরকে বিক্রি করে হেমদা অনেক টাকা পেয়েছে। আমি এখানে এসেছি, কারণ হেমদা আমাকে ডেকেছে। তুমি ফালতু বলার কে হে?’

রাজা চুপ করে গেল। হেমচন্দ্র এক তাড়া প্রিন্ট আউট শ্রুতির হাতে ধরিয়ে বলল, ‘এই হল পুঁথির ফোটো থেকে প্রিন্ট আউট। ১৯১৫ সালের তুলোট কাগজ, খাগের কলম আর ভেজিটেবল ডাই জোগাড় করা; দেবনাগরী হরফে পুঁথি লেখা—সব তোর দায়িত্ব। আগে এক পাতা স্যাম্পল এঁকে আমাকে দেখা। আমি স্যাটিসফায়েড হলে মিমির কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবব।’

শ্রুতি প্রিন্ট আউটের পাতা উল্টোতে উল্টোতে বলল, ‘আজ বৈশাখ মাসের কুড়ি তারিখ। যা বলছ সেটা করতে মিনিমাম এক মাস লাগবে।’

হেমচন্দ্র বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ইমপসিবল। মিমি তেইশে বৈশাখ কলকাতায় আসছেন। তার আগে স্যাম্পল চাই।’

হেমচন্দ্রের কথা থামিয়ে রাজা বলল, ‘দিতে না পারলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে এখান থেকে বার করে দেব!’

শ্রুতি ফটাস করে বাবল গাম ফাটিয়ে বলল, ‘হেমদা, এই মাথামোটাকে মুখ সামলাতে বলো!’ তারপর কাগজের তাড়া নিয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেল।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ফ্লাইট টাচ ডাউন করল সন্ধে সাড়ে সাতটার সময়ে। বিজনেস ক্লাস থেকে সবার শেষে নামছেন যে মহিলা, তাঁর পরনে সালওয়ার কামিজ আর ওড়না। ওড়নায় মুখ ঢেকেছেন তিনি। রাতের বেলাও সানগ্লাস খোলেননি।

এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে মহিলা মোবাইল ফোন অন করছেন, এমন সময় পাশ থেকে এক যুবক বলল, ‘আপনিই মিমি ব্যানার্জি আর্চার?’

মিমি তাকিয়ে দেখলেন, বছর চব্বিশের একটি ছেলে দাঁড়িয়ে। ছেলেটি হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আমার নাম ষষ্ঠী লাহিড়ী।’

মিমি হাতজোড় করে বললেন, ‘আপনাকে চিনতে পারলাম না!’

‘কলকাতা পুলিশ।’ আই কার্ড বার করে দেখায় ষষ্ঠী, ‘আপনি যে ক’দিন কলকাতায় থাকবেন আমি আপনার সিকিয়োরিটির দায়িত্বে থাকব। আমার সঙ্গে আসুন। আপনাকে টিউলিপ বেঙ্গল হোটেলে নিয়ে যাব।’

মিমি দেখলেন পার্কিং লটে আর পাঁচটা গাড়ির থেকে সামান্য দূরে একটা লাল রঙের ল্যান্ডরোভার দাঁড়িয়ে রয়েছে। মিমি সেদিকে এগোলেন।

ষষ্ঠী ক্যাজুয়ালি জিজ্ঞাসা করল, ‘আজ সন্ধেবেলা আপনার কী প্ল্যান?’

‘আজ রেস্ট নেব।’

‘আমাকে না বলে কোথাও যাবেন না।’

মিমি মিষ্টি হেসে বললেন, ‘কলকাতা সেফ সিটি। এখানে আমার কিছু হবে না।’

তাঁর কথার মধ্যে দু’সারি গাড়ির মধ্য দিয়ে কেউ একজন ছুটে এল। মিমি প্রথমে ভেবেছিলেন শেয়াল। পরে দেখলেন, মাথা নিচু করে একটা লোক ডানদিকের গাড়ির সারির ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে বাঁদিকের গাড়ির সারির মধ্যে লুকিয়ে পড়ল। আর, লুকিয়ে পড়ার আগে কিছু একটা মিমির দিকে ছুড়ল।

ষষ্ঠীর রিফ্লেক্স সাংঘাতিক ভালো। সে এক হাতে জিনিসটা লুফে অনেক দূরে ছুড়ে দিয়েছে। পাশাপাশি হোলস্টার থেকে রিভলভার বার করে লোকটাকে ধাওয়া করেছে। মিমি কী করবেন বুঝতে না পেরে মাটিতে শুয়ে পড়ে কানে হাত চাপা দিলেন।

ষষ্ঠী কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ফিরে এল। তাকে দেখে মিমি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কোমরে খুব লাগল! বাবা গো!’

ষষ্ঠী মিমির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, ‘ফিজিকালি আনফিট হয়ে গেলে চলবে?’ তার কথা শুনে মিমি কড়া গলায় বললেন, ‘আমার ফিটনেস নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না!’

ষষ্ঠীর ঠোঁটের কোণ থেকে হাসি যায়নি। সে বলল, ‘ভালোই হচ্ছে! ক্যারি অন।’

সে কথায় পাত্তা না দিয়ে মুখে ওড়না জড়িয়ে ল্যান্ডরোভারের পিছনের আসনে বসে মিমি বললেন, ‘ওটা কে ছিল?’

‘বুঝতে পারলাম না!’ ড্রাইভারের আসনে বসে হতাশ গলায় বলে ষষ্ঠী, ‘চারিদিকে এত লোক যে ফায়ার করা গেল না। আপনাকে একা ফেলে দূরে যাওয়াও অসম্ভব।’

‘আমার দিকে যেটা উড়ে আসছিল সেটা কী?’ জানতে চাইলেন মিমি।

‘আপনি বসুন। আমি দেখে আসি।’ গাড়ির দরজা খুলে নামল ষষ্ঠী। তারপরে গাড়ির সারির মধ্যে অন্ধকারে টর্চ জ্বেলে দেখতে লাগল।

এই সময়ে ল্যান্ডরোভারের কাচে টকটক আওয়াজ। মিমি কাচ নামাতেই একটি ছেলে একটা ফাইল তার হাতে ধরিয়ে বলল, ‘আমি হেমচন্দ্র। স্যাম্পল দিলাম। দেখে রাখুন। কাল সকাল আটটায় অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলে ধরবেন। পুলিশ যেন না থাকে।’

হেমচন্দ্র অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ফাইল ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে মিমি জানলার কাচ তুলে দিলেন।

ষষ্ঠী ফিরে এসে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলল, ‘কিসসু পেলাম না।’

মিমি ফাইল খুলে তাকিয়ে রয়েছেন একটি কাগজের দিকে। তুলোট কাগজে সময়ের আঁচড় লেগেছে। হলদে কাগজে মসে পড়েছে। এখানে ওখানে উইপোকার কামড়ের চিহ্ন। এত কিছুর মধ্যেও ঝলমল করছে দেবনাগরী হরফে লেখা চতুর্থ বেদের প্রথম পৃষ্ঠা!

হোটেল টিউলিপ বেঙ্গলের ফয়্যারে গাড়ি ঢোকাল ষষ্ঠী। মুখে ওড়না জড়িয়ে, সানগ্লাস না খুলে ল্যান্ডরোভার থেকে নামলেন মিমি।

সাউথ ব্লকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দপ্তরে বসে রঞ্জিত তখন ভাবছেন, প্রথমা এখন কোথায় কে জানে! লন্ডনে যাওয়ার পর থেকে তাকে আর ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েটা কোনও মেল করেনি। ভারতে ফেরার টিকিটও চায়নি।

সকাল আটটার সময় মিমির রুমে বসে ষষ্ঠী কফি খাচ্ছে এমন সময়ে মিমির মোবাইলে টিংটিং শব্দ। মিমি ষষ্ঠীকে বললেন, ‘আপনি কাইন্ডলি একটু বাইরে যান!’

ষষ্ঠী শ্রাগ করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মিমি ফোন ধরলেন।

হেমচন্দ্র বলল, ‘এই ফোন কল ট্যাপ করা হচ্ছে। আপনি কম কথা বলুন। কারও নাম উচ্চারণ করবেন না।’

‘এত ধানাই-পানাই করছেন কেন? আমি কাস্টমার। টাকা দেব জিনিস নেব।’

‘ব্যাপারটা এত সরল হলে আপনার সঙ্গে পুলিশ কেন ম্যাডাম?’

‘পৃথিবীর যে দেশেই যাই না কেন, আমার জন্যে সিকিয়োরিটির বন্দোবস্ত থাকে। সেটার কারণ আমি নই। আমার স্বামী। বিভিন্ন পলিটিক্যাল গ্রুপ বা জঙ্গি গোষ্ঠীর আমাদের ওপরে রাগ আছে। আর আপনি যে এত ভয় পাচ্ছেন, আপনি কি জানেন যে মোবাইল নম্বর আর টাওয়ার লোকেশান দিয়ে পুলিশ আপনাকে ধরে ফেলতে পারে?’

‘মোবাইলটা হাতফেরতা। মালিকের ঠিক নেই। সিম কার্ড পানের দোকান থেকে কেনা। কোনও আইডি দেখিয়ে কিনিনি। আপনার সঙ্গে কথা বলেই এটা ফেলে দেব। এই দিয়ে আমাকে ধরা যাবে না।’

‘বুঝলাম। এবার কাজের কথায় আসুন।’

‘আগামীকাল মাল ডেলিভারি হবে। কোথায়, কখন—আপনাকে মেল করা হয়েছে। আবারও বলি, কোন মেশিন থেকে মেল করা হয়েছে, পুলিশ খুঁজে পাবে না। আইপি অ্যাড্রেস মাস্কিং করা আছে। আপনার কাজ খুব সহজ। যে লোকেশান বলা আছে, সেখানে নির্দিষ্ট সময়ে চলে আসুন। টাকা দিন। মাল নিন। সঙ্গে যেন পুলিশ না থাকে। থাকলে আমরা জানতে পারব। এবং ডিল ক্যানসেলড।’

মিমি বললেন, ‘আমার একা যেতে সমস্যা নেই। কিন্তু আমাকে নিজের সিকিয়োরিটি নিয়ে ভাবতে হয়।’

‘পুলিশ থাকলে ডিল ক্যানসেলড!’

মিমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমি একাই যাব।’

হেমচন্দ্রের ফোন কেটে গেল। মিমি রুমের দরজা খুলে বললেন, ‘ভেতরে আসুন।’

করিডোরে দাঁড়িয়ে ষষ্ঠী মোবাইলে কথা বলছিল। ফোন রেখে বলল, ‘মেল চেক করে বলুন, হেমচন্দ্র আপনাকে কোথায় যেতে বলেছে। এবং ক’টার সময়ে।’

মিমি হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমার ফোনে আড়ি পাতার কী দরকার ছিল? আমি এমনিই বলে দিতাম।’ মোবাইল থেকে মেল চেক করে বললেন, ‘জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। সকাল সাতটার সময়। পঁচিশে বৈশাখের জন্যে আদর্শ জায়গা।’

বাঁ-হাতের তালুতে ডানহাত দিয়ে ঘুষি মেরে ষষ্ঠী বলল, ‘ওই সময় জায়গাটা লোকে থইথই করবে। হেমচন্দ্রকে ধরা মুশকিল হয়ে যাবে।’

তাকে সান্ত্বনা দিয়ে মিমি বলেন, ‘পাশাপাশি এটাও সত্যি যে রবীন্দ্র অনুরাগীর ছদ্মবেশে আপনি আমার আশেপাশে থাকতে পারবেন।’

রবীন্দ্র সরণি ওয়ান ওয়ে। তার সঙ্গে আজ সকালে গাড়ির মেলা লেগেছে। পার্কিং পেতে প্রাণ বেরিয়ে গেল মিমির। তিনি আজ নিজেই ল্যান্ডরোভার চালাচ্ছেন। ষষ্ঠী এবং জোড়াসাঁকো থানার পুলিশ আশেপাশেই কোথাও আছে। ষষ্ঠী বলেছে, মিমি হোটেল থেকে বেরোনোর পর থেকেই হেমচন্দ্রের গ্যাং-এর লোক তাঁকে ফলো করবে। যদি বুঝতে পারে যে পুলিশ সঙ্গে আছে, তা হলে কেটে পড়বে।

সুতরাং মিমি একা। সঙ্গী বলতে কাপড়ের পাশঝোলা আর মোবাইল। এই ফোনের যাবতীয় কথা ট্যাপ করা হচ্ছে এবং প্রয়োজনীয় তথ্য ষষ্ঠীর কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।

ঠাকুরবাড়ি থেকে অনেকটা দূরে একটা গলির মধ্যে পার্কিং পেলেন মিমি। পার্কিং-এর ছেলেটা এসে বলল, ‘কতক্ষণ লাগবে?’

‘কী করে বলি বলো?’ হতাশভাবে কাঁধ ঝাঁকালেন মিমি। ছেলেটা পুরনো দিনের একটা বেসিক মোবাইল ফোন মিমির হাতে দিয়ে বলল, ‘এইটা ইউজ করুন। আপনার মোবাইল গাড়িতে রেখে দিন।’

মিমি দেখলেন ছেলেটার অন্য হাতে দেশি ওয়ান শটার। আগ্নেয়াস্ত্রর নল তাঁর কপালে তাক করা।

স্মার্টফোন গাড়িতে রেখে কাপড়ের পাশঝোলা নিয়ে ল্যান্ডরোভার থেকে নামলেন মিমি। ছেলেটার দেওয়া মোবাইল নিয়ে রবীন্দ্র সরণির দিকে এগোলেন। এই প্রথম তাঁর মনে হচ্ছে, হেমচন্দ্রের কথা শুনে ভুল করেছেন। কারও মোবাইল নম্বর মুখস্থ নেই। হাতে মোবাইল থাকা সত্ত্বেও তিনি কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন না।

এই দোলাচলের মধ্যেই মোবাইল বেজে উঠল। অচেনা ল্যান্ড লাইন থেকে ফোন এসেছে। নির্ঘাত আশেপাশের কোনও এসটিডি বুথ থেকে ফোন করা হয়েছে। যে ফোন করেছে সে নির্ঘাত মিমিকে দেখতে পাচ্ছে। দ্রুত সবুজ বোতাম টিপে ফোন কানে দিলেন মিমি, ‘হ্যালো?’

‘আপনার সামনে, রাস্তার উলটো ফুটে একটা হাতে টানা রিকশা দাঁড়িয়ে রয়েছে,’ হেমচন্দ্রের গলার আওয়াজ, ‘দেখতে পাচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ। ওয়ান ওয়ে রাস্তায় গাড়িগুলো যেদিকে যাচ্ছে, তার উলটো দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে।’

‘ওটায় উঠে বসুন।’

মিমি চুপচাপ রিকশায় উঠে বসলেন। বৃদ্ধ বিহারি রিকশাওয়ালা রবীন্দ্র সরণি দিয়ে কিছুটা গিয়ে গলিতে ঢুকে পড়ল। ডাঁয়ে-বাঁয়ে খানিক ঘুরে একটা গুদামের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।

মিমি পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছেন। ওয়ান ওয়ে রাস্তায় রিকশা চেপে উলটো মুখে যাওয়ার ফলে কোনও গাড়ি তাঁকে ফলো করতে পারেনি। সাদা পোশাকের পুলিশ পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে বা টু হুইলারে ফলো করলে, এই নির্জন জায়গায় তাকে অনেক দূর থেকে দেখা যাবে, সে রকম কেউ যে নেই এটা বোঝা যাচ্ছে। এখন মিমি একা! ষষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করার উপায় নেই। এখন তিনি হেমচন্দ্রের গ্যাং-এর হাতে। যেমনটা হেমচন্দ্র চেয়েছিল!

রিকশাওয়ালা টাকা না নিয়ে চলে গেছে। মিমি গ্যারাজে ঢুকলেন।

মাইকে নরম সুরে গান ভেসে আসছে ‘কোলাহল তো বারণ হল, এবার কথা কানে কানে…’ রবীন্দ্রানুরাগীরা মাথা ঝুঁকিয়ে ঘাড় নাড়ছেন। ভদ্রভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কবির আবাসে প্রবেশ করার জন্যে। এই শান্ত পরিবেশে, জোড়াসাঁকো থানার বড়বাবু মোবাইলে বাজখাঁই চিৎকার করলেন, ‘হোয়্যার দ্য হেল ইজ মিমি?’

ষষ্ঠী ল্যান্ডরোভারের পাশে দাঁড়িয়ে গাড়ির জানলায় নাক ঠেকিয়ে ভেতরে উঁকি মেরে মোবাইলে বলল, ‘আমি মিমির গাড়ির পাশে। ওঁর ফোন গাড়ির মধ্যে রাখা রয়েছে। পার্কিং-এর ছেলেটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।’

‘মিমি কোথায়?’ আবার চিৎকার করলেন বড়বাবু।

এক রবীন্দ্রানুরাগী মিনমিন করে বললেন, ‘কোলাহল করছেন কেন?’ বড়বাবু কটমট করে তাকাতেই ভদ্রলোক বাথরুমের দিকে দৌড়লেন।

‘নো ট্রেস!’ ফোন কেটে দিয়ে পার্কিং-এর ছেলেটিকে ধরে ঝাঁকাচ্ছে ষষ্ঠী। ছেলেটির জ্ঞান ফিরেছে। ষষ্ঠী তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছিল? সত্যি কথা বল!’

‘জানি না স্যার!’ হাঁউমাঁউ করে ওঠে ছেলেটি। ‘গাড়ি পার্কিং-এর কাজ করছিলাম। হঠাৎ পিছন থেকে ঘাড়ে রদ্দা। তারপরে আর কিছু জানি না…’

‘কে মেরেছে দেখিসনি?’

‘না স্যার!’

‘এই গাড়িটার পার্কিং কখন হয়েছে?’ ল্যান্ডরোভার দেখিয়ে বলল ষষ্ঠী। ছেলেটা ঘাড়ে হাত বুলিয়ে বলল, ‘আমি এই গাড়ির পার্কিং করাইনি।’

ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়ে চারিদিকে তাকায় ষষ্ঠী। সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। কোথাও মিমির চিহ্ন নেই।

ষষ্ঠী নিজের মনে বলল, ‘প্রথমা কোথায় যে গেল…’

‘আসুন ম্যাডাম!’ নিচু গলায় বলল হেমচন্দ্র। মিমি দেখলেন, পুরনো আমলের বাড়ির একতলার অব্যবহৃত গ্যারাজে একটি টেবিল আর চারটে চেয়ার পাতা রয়েছে। অন্ধকার গ্যারাজে আলো ছড়াচ্ছে ষাট ওয়াটের বালব। সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে—চেয়ারে বসে রয়েছে হেমচন্দ্র, একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। ছেলেটি পার্কিং লটে তাঁর হাতে মোবাইল তুলে দিয়েছিল।

চেয়ারে বসে মিমি বললেন, ‘এত গোপনীয়তার কী দরকার ছিল?’

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হেমচন্দ্র বলল, ‘টাকা এনেছেন?’

‘হ্যাঁ,’ পাশঝোলা টেবিলের ওপরে রাখলেন মিমি। হেমচন্দ্র বলল, ‘শ্রুতি, গুনে নে।’

মেয়েটি ঝোলার দিকে হাত বাড়াতেই মিমি বললেন, ‘আগে আমার জিনিস দেখি। তারপর টাকার কথা হবে।’

হেমচন্দ্র বলল, ‘শ্রুতি! দেখিয়ে দে!’ শ্রুতি টেবিলের ওপরে বড় একটা প্যাকেট রাখল।

মিমি প্যাকেট টেনে নিলেন। পাশঝোলা থেকে গ্লাভস বার করে, হাতে পরে প্যাকেট খুললেন। পুরোনো তুলোট কাগজে লেখা দেবনাগরী হরফের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

‘মাল পেয়ে গেছেন। এবার মাল্লু ছাড়ুন।’ ঠান্ডা গলায় বলল হেমচন্দ্র।

পাশঝোলা থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাস বার করে কাগজে মনোনিবেশ করেছেন মিমি। হেমচন্দ্রের কথা শুনতে পাননি।

হেমচন্দ্র বলল, ‘রাজা, টাকার ব্যাগটা এদিকে নিয়ে আয়।’

মিমি হেমচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘১৯১৫ সালের ম্যানাস্ক্রিপ্ট থেকে টাটকা অয়েল পেইন্টের গন্ধ আসছে! আপনারা অ্যান্টিকের নাম করে ভুয়ো মাল বিক্রি করতে চাইছেন? ছিঃ!’

‘আপনি পেইন্টিং-এর কিসসু বোঝেন না!’ আপত্তি করে শ্রুতি, ‘এতে ভেজিটেবল ডাই ইয়ুজ করা হয়েছে। অয়েল পেইন্টের নামগন্ধ নেই!’

‘কী করে জানলেন?’ মুচকি হাসেন মিমি, ‘আপনি এঁকেছেন নাকি?’

‘শাটাপ শ্রুতি!’ রাজা চিৎকার করে ওঠে। ‘নিজের লিমিটের মধ্যে থাক!’

মিমি বললেন, ‘আমি চললাম। এই সব ছেলেমানুষির মধ্যে আমি নেই!’

হেমচন্দ্র বলল, ‘আমার বরাবর ধারণা ছিল যে বেদের পাণ্ডুলিপিতে আপনার আগ্রহ কম। ‘ও এস’ নিয়ে আগ্রহ বেশি।’

‘আমি আর্ট কালেক্টর। যে আমাকে মাল সাপ্লাই করবে আমি তার সঙ্গে কাজ করব। সে চোর, ডাকাত না নিধিরাম সর্দার এই নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। আপনারা ভুয়ো মাল সাপ্লাই করেছেন। আমি আপনাদের সঙ্গে কাজ করব না। বাই!’

‘উঠল বাই তো কটক যাই?’ নিজের রসিকতায় নিজেই হাসছে হেমচন্দ্র। ‘আপনাকে তো আর ছাড়া যাবে না ম্যাডাম! আপনি আমাদের পিছনে পুলিশ লেলিয়ে দেবেন!’

‘মানে? কী বলতে চান আপনি?’ উঠে দাঁড়িয়েছেন মিমি। টেনে নিয়েছেন পাশঝোলা। রাগে তাঁর মুখ লাল। ‘মিমি ব্যানার্জি আর্চারের গায়ে হাত দিলে ইন্টারপোল আপনার পিছনে লাগবে। আপনার নামে রেড কর্নার নোটিস জারি হবে। পৃথিবীর কোথাও গিয়ে বাঁচতে পারবেন না!’

‘মিমির গায়ে হাত দিচ্ছি না। প্রথমা লাহিড়ীর গায়ে হাত দিচ্ছি। বলা ভালো, প্রথমার খুলিতে জাস্ট একটা গুলি গুঁজে দিচ্ছি!’ মিমির দিকে দেশি ওয়ান শটার তাক করে বলে রাজা।

‘হোয়াট দ্য হেল ইজ দিস? আমি প্রথমা নই!’

‘তা হলে সানগ্লাস পরে কেন? মুখে ওড়না কেন? আমরা জানি মিমিকে কী রকম দেখতে।’ টেবিলে লন্ডন টাইমসের পুরোনো এডিশানের প্রিন্ট আউট ফেলেছে রাজা। পেজ থ্রি পার্টির ছবিতে মিমি এবং মিকি একটি আর্ট গ্যালারির উদ্বোধন করছেন।

মিমি ওড়না সরিয়ে বললেন, ‘আপনারা কি উন্মাদ? হিট র‌্যাশ হয় বলে আমি ওড়না জড়িয়েছি। এই দেখুন আমার মুখ!’

শ্রুতি বাবল গাম চিবোতে চিবোতে এগিয়ে এসেছে। প্রিন্ট আউট হাতে নিয়ে বলল, ‘সানগ্লাস খুলুন। ছবির সঙ্গে আপনার চোখ মেলাব। চোখ না দেখলে আইডেন্টিফিকেশান কমপ্লিট হয় না।’

মিমি সানগ্লাস খুলে বললেন, ‘এখনও আমাকে প্রথমা বলে মনে হচ্ছে? আপনারা কি অন্ধ?’

রাজা অবাক হয়ে মিমির দিকে তাকাল। তাকাল প্রিন্ট আউটের দিকে। হেমচন্দ্রকে বলল, ‘তোর কোথাও ভুল হচ্ছে। ইনি মিমি।’

হেমচন্দ্রেরও ভুরু কুঁচকে গেছে। সে বলল, ‘তা হলে কি আমার কাছে ভুল খবর ছিল? এনিওয়ে, মিমিকে আর ছাড়া যাবে না। একটা দানা টপকে দে! মারার পরে লোচা হবে। কিন্তু না মারলে আরও বড় লোচা হবে!’

মিমি বললেন, ‘হেমচন্দ্র, ভুল ডিসিশান নিচ্ছেন!’

‘শাট আপ!’ গর্জে ওঠে হেমচন্দ্র। ‘আমি যা বলব, সেটাই ফাইনাল! রাজা! চালা গুলি!’

কেউ কিছু বোঝার আগেই গুলির আওয়াজে কেঁপে উঠল গুদাম। হেমচন্দ্র দেখল, মিমি মেঝেতে পড়ে আছেন। হাতে ওয়ান শটার নিয়ে রাজা দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার মুখে নানা অনুভূতি খেলা করছে।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে যাবতীয় অনুভূতিমালা মিলিয়ে গিয়ে রাজার মুখে একটিই অনুভূতি রয়ে গেল। সেটা যন্ত্রণার। স্লো মোশানে মেঝেতে বসে পড়ছে রাজা। তার বাঁ-হাঁটু দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরচ্ছে। হেমচন্দ্রের রগে পিস্তল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে শ্রুতি।

আর, গ্যারাজের দরজা এক লাথিতে খুলে ঢুকে পড়েছে ষষ্ঠী এবং জোড়াসাঁকো থানার বড়বাবু। পিছনে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা একদল পুলিশ। সবার হাতে পিস্তল। গান ভেসে আসছে, ‘তোমার হল শুরু, আমার হল সারা…’

‘মিমি কেমন দেখতে সেটা হেমচন্দ্রের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। এইটা বোঝার পরে মিমি সেজে কলকাতায় এসে হেমচন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা ছিল সোজা রাস্তা। কিন্তু মিমি সাজলে হেমচন্দ্রের গ্যাং-এর কাজ কারবার সম্পর্কে জানা যাবে না। তাই আমি সেই রাস্তায় হাঁটিনি।’ সাউথ ব্লকে রঞ্জিতের অফিসে বসে কথা বলছে প্রথমা। পাশে বসে ষষ্ঠী।

‘তা হলে কী করলি?’ জানতে চাইলেন রঞ্জিত।

‘লন্ডনে মিমির সঙ্গে দেখা করে কলকাতায় ফিরে এলাম।’

‘টিকিট নিজে কাটলি?’

‘হ্যাঁ! আপনাকে বললে আপনি হেমচন্দ্রের গ্যাং-এ ঢোকার রিস্ক নিতে দিতেন না!’

‘আমিও দিতাম না!’ অভিমানী গলায় বলে ষষ্ঠী।

‘কলকাতায় গিয়ে হাঁটাচলা, কথা বলার ধরন এবং চুলের কাট বদলে ফেললাম, টেম্পোরারি ট্যাটু করালাম, চোখে কনট্যাক্ট লেন্স পরলাম, বাবল গাম খাওয়া ধরলাম। রেনু মারা যাওয়ার পরে একজন ক্যালিগ্রাফি আর্টিস্টকে হেমচন্দ্রের দরকার লাগবে, এটা আপনিই বলেছিলেন।’ রঞ্জিতকে বলে প্রথমা।

‘তোর তো আবার ক্যালিগ্রাফিতে বিরাট ফান্ডা!’ হাসছেন রঞ্জিত, ‘তা, হেমচন্দ্রের সঙ্গে আলাপ করলি কী করে?’

‘হেমচন্দ্রের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করে হেমচন্দ্রের নজরে পড়ে গেলাম। আমাকে ও একটা অ্যাসাইনমেন্ট দিল। সেটা উতরে দিলাম। তারপর ‘ও এস’-এর মধ্যে ঢুকে গেলাম। মিমি না এলেও কাজটা উতরে দিতাম। মুশকিল হল, মিমি কলকাতায় এলেন। আর, আপনি তার সঙ্গে জুড়ে দিলেন ষষ্ঠীকে। মিমির কাছে থেকে শুনলাম, ষষ্ঠী নাকি ওঁকে প্রথমা ভেবে কী সব ভুলভাল কথা বলেছে!’

‘উনি কিছু মাইন্ড করেননি তো?’ চিন্তিত গলায় বলে ষষ্ঠী।

‘প্লেনে ওঠার আগে খুব হাসছিলেন।’ বলে প্রথমা, ‘তোকে আর আমাকে লন্ডনে নেমন্তন্ন করেছেন।’

রঞ্জিত বললেন, ‘প্র্যাট, তোর এই নতুন চেহারাটা খুব ইন্টারেস্টিং। এটা বদলাস না।’

‘শ্যাম্পু না করে মাথায় উকুন হয়ে গেছে! আমি আজই এই চেহারা থেকে বেরোব!’ চেয়ার থেকে উঠেছে প্রথমা।

‘তোর নতুন নামটাও খুব ইন্টারেস্টিং!’ হাসতে হাসতে বলেন রঞ্জিত।

তাঁর টেবিলে তুলোট কাগজে ভরতি একটা প্যাকেট রেখে প্রথমা বলে, ‘বেদের আর এক নাম শ্রুতি। তাই না?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *