চারুহাসিনীর দেওয়াল-সিন্দুক – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
চারুহাসিনীর মৃত্যুর পর মহাফাঁপরে পড়ে গেছে তাঁর তিন ছেলে। আজ পনেরোদিন হল মারা গেছেন চারুহাসিনী, তাঁর শ্রাদ্ধশান্তি পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম চোকা পর্যন্ত কোনও ঝাট ছিল না, তার পরেই দেখা দিয়েছে সমস্যাটা। চারুহাসিনীর দেওয়াল-সিন্দুকটি কিছুতেই খোলা যাচ্ছে না।
চারুহাসিনীর সিন্দুকের অন্দরমহলটি অতি মূল্যবান। তার ছেলে, বউ, নাতি-নাতনিরা তো বটেই, লতায়-পাতায় আত্মীয় থেকে শুরু করে এই মায়াপুর গ্রামের বাচ্চা-বুড়োরা পর্যন্ত জানে ওই সিন্দুকেই সর্বস্ব লুকিয়ে রাখতেন চারুহাসিনী। এই ‘সর্বস্ব’র পরিমাণ নেহাত কম নয়। জমি-বাড়ির দলিল তো আছেই, সঙ্গে সোনাদানা টাকাপয়সা কি আর নেই কিছু! চারুহাসিনীর ছেলেদের বিশ্বাস, সিন্দুক খুললে মাথাপিছু লাখ-দু’লাখ তো জুটবেই, বেশিও হতে পারে। নিজের নিজের ভাগ গুছিয়ে নিয়ে সবাইকে এবার ফিরতে হবে না নিজের জায়গায়।
হ্যাঁ, নিজের জায়গা। মায়াপুরে বাড়ি বটে, তবে চারুহাসিনীর কোনও ছেলেই আর এখানে থাকে না। সত্যি বলতে কী, তারা বছরান্তে এ-গ্রামের ছায়াও আর মাড়ায় কি না সন্দেহ। তারা সব শহুরে মানুষ, কাজের লোক, অজগাঁয়ে পড়ে থাকা বুড়ি মাকে দেখতে আসার তাদের সময় কোথায়। বড়জোর বিজয়ার পর ছুটতে ছুটতে এল, প্রণামটি সেরে রাত পোহাতে না পোহাতে আবার যে যার মত্যে ফিরে গেল, ব্যস, মার সঙ্গে সম্পর্ক শেষ। নাতি-নাতনিরাও সব শহুরে ছেলেমেয়ে, গ্রামে এসে তাদেরও একটি দিনের তরে মন টেকে না।
এবার অবশ্য সকলকেই আসতে হয়েছে, থাকতেও হয়েছে। দায়ে পড়ে। মা’র মৃত্যু বলে কথা, এসেই চলে গেলে, পাঁচজনকে দেখিয়ে মা’র জন্য চোখের জল না ফেললে, ঘটা করে শ্রাদ্ধশান্তি না করলে লোক নিন্দে করবে না? এখন মানে মানে আখের গুছিয়ে ফিরতে পারলে সকলেরই সবদিক থেকে মঙ্গল৷
শুধু এই সিন্দুক খোলার সমস্যাটাই এমন ফ্যাসাদে ফেলে দিল!
দেওয়ালে গাঁথা সিন্দুকটা আছে দোতলার বড় ঘরে। মায়াপুরেরই এক নামী কর্মকার বলরামকে দিয়ে এটা বানিয়েছিলেন চারুহাসিনীর শ্বশুরমশাইয়ের বাবা। অনেককাল আগে, যখন এই বাড়ি তৈরি হয়েছিল, সেই সময়ে। সিন্দুকটা আকারে তেমন প্রকাণ্ড নয়। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে কোনও দিকেই ফুট দুয়েকের বেশি হবে না, তবে জিনিস হিসেবে ভারী মজবুত। মোটা লোহার বডি, চওড়া পেতলের হাতল, তার পাশে এক ইয়া পেতলের চাকা।
সিন্দুক খোলা-বন্ধ করার পদ্ধতিটাও ভারী বিটকেল। দশ-দশখানা চাবি আছে সিন্দুকের, প্রত্যেকটি চাবিতে আলাদা আলাদা নম্বব। শূন্য থেকে নয়। ইচ্ছে করলে দশটা চাবি দিয়েও সিন্দুক খোলা-বন্ধ করা যায়, আবার চাইলে একটা চাবি দিয়েও। অনেকটা আজকালকার কম্বিনেশন লক সিস্টেমের মতো।
কায়দাটা আর-একটু খোলসা করা যাক। কেউ যদি শুধু এক নম্বর চাবি ব্যবহার করতে চায় তবে তাকে এক নম্বর চাবি ঢুকিয়ে চাকাটাকে একপাক ঘোরাতে হবে। পাঁচ নম্বর ব্যবহার করতে চাইলে পাচ লেখা চাবি ঢুকিয়ে চাকা ঘোরাতে হবে পাঁচবার। শূন্য নম্বর চাবির জন্য চাকা ঘুরবে দশবার…। কেউ যদি একসঙ্গে দুটো চাবি ব্যবহার করতে চায়, ধরা যাক এক আর দুই। তখন এক নম্বর চাবি আগে ঢুকিয়ে চাকা একবার ঘোরাতে হবে, তারপর দু’নম্বর চাবি ঢুকিয়ে চাকা দু’বার। যদি কেউ একসঙ্গে ন’টা চাবি ব্যবহার করতে চায়, ধরা যাক নয় আট এক দুই সাত ছয় তিন চার পাঁচ। তা হলে তাকে প্রথমে ন’নম্বর চাবি ঢুকিয়ে চাকা ন’বার ঘোরাতে হবে, তারপর আট নম্বর চাবি ঢুকিয়ে চাকা আটবার, তারপর এক নম্বর চাবি ঢুকিয়ে চাকাটাকে একবার… সেই পাঁচ পর্যন্ত। খোলার কৌশল ঠিক এর উলটো। অর্থাৎ শুরু করতে হবে পাঁচ নম্বর থেকে, চলবে সেই নয় পর্যন্ত। কেবল চাকা ঘুরবে উলটো দিকে। অর্থাৎ কীভাবে সিন্দুকটা বন্ধ করা হয়েছে সেটা জানা না থাকলে কোনওভাবেই সিন্দুক খোলা সম্ভব নয়।
এবং এই নিয়েই যত গন্ডগোল। চারুহাসিনী ঠিক কোন কোন নম্বরের চাবি দিয়ে সিন্দুক বন্ধ করেছেন, তা কাকপক্ষীও জানে না। সারাদিন ধরে চারুহাসিনীর তিন ছেলে, ছেলের বউ, আর পাঁচ নাতি-নাতনি একটার পর একটা চাবি ঢোকাচ্ছে আর চাকা ঘোরাচ্ছে, কিন্তু সিন্দুকের দরজা অনড়। মাঝখান থেকে চাবি চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে সকলের পিঠ কাঁধ ব্যথা হয়ে গেল। কেউ বা হট ওয়াটার ব্যাগ চাপছে কাঁধে, কেউ বা নুনের পুলটিশ দিয়ে গরম সেঁক দিচ্ছে, কেউ ঘ্যাসর ঘ্যাসর মলম ঘষে চলেছে।
হতাশ হয়ে রাতে ছাদে মিটিং-এ বসল সবাই। নিয়মভঙ্গের দিন আজ খাওয়াদাওয়াটা বেশ জম্পেশ হয়েছিল। পুকুরে জাল কেলিয়ে ইয়া বড় বড় কাতলা মাছ ধরিয়েছিল এ-বাড়ির পুরনো কাজের লোক নীলমাধব, সেই মাছের কালিয়া, সঙ্গে মুড়িঘণ্ট, দাদখানি চালের ভাত, নিজেদের খেতের শাকসবজি, দই, মিষ্টি―এলাহি আয়োজন। এত আহারের পরেও কারও মনে সুখ নেই। বসন্তকাল, মিঠে মিঠে দখিনা বাতাস বইছে, আকাশে সুন্দর চাঁদও উঠেছে একটা, তবু কারও কিছুই ভাল লাগছে না। সকলেই শুধু এ ওর মুখের দিকে তাকায়, আর ফোঁস ফোঁস দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
এক সময়ে আর চুপ থাকতে পারল না চারুহাসিনীর বড় ছেলে শ্যামাকান্ত। বর্ধমান স্টেশনের ধাবেই বড়সড় এক স্টেশনারি দোকান আছে তার। রমরমা ব্যাবসা। সে ভারিক্কি দোকানদারি গলায় বলে উঠল, “কী রে, আর কতক্ষণ এভাবে গুমসুম মেরে কাউন্টারে বসে থাকব, অ্যাঁ? মালপত্র কীভাবে গস্ত করা যায় তার একটা পরামর্শ দে।”
ছোট ছেলে রমাকান্তর রেলে চাকরি। চিত্তরঞ্জনে পোস্টেড। বিরক্তিভরা স্বরে সে বলল, “আমি তো অনেকক্ষণ শানটিং করার উপায় বাতলে দিয়েছি। সিগন্যাল ডাউন হয়ে গেছে, এবার সিন্দুকটা ভেঙে ফেলো।”
শ্যামাকান্তর বউ শ্যামলী হাঁ হাঁ করে উঠল, “যাহ, তা কী করে হয়! মাত্র ক’দিন আগে মা মারা গেছেন, এখনই সিন্দুক ভাঙলে লোকে ছি ছি করবে না?”
মেজো ছেলে সুধাকান্ত রানিগঞ্জে এক কয়লাখনির ওভারসিয়ার। সে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে খেঁকিয়ে উঠেছে, “লোকের ছি ছি করার কী আছে? খাদান আমাদের, কোদাল বেলচা আমাদের, কীভাবে কয়লা তুলব সে আমরা ঠিক করব।”
“আহা, উত্তেজিত হচ্ছ কেন?” সুধাকান্তর স্ত্রী সুমতি স্বামীকে শান্ত করার চেষ্টা করল, “আচ্ছা, সেই বলরামের নাতিকে ডেকে আনলে হয় না? সেও তো শুনেছি তালা-চাবি বানায়। সে যদি একটা সবখোল চাবি দিয়ে লকটা খুলে দিতে পারে…!”
রমাকান্তর বউ রমলা বলে উঠল, “তোমার দেওর সকালেই বলরামের নাতির কাছে গিয়েছিল। সে সাফ বলে দিয়েছে এই সিন্দুক খোলা তার কম্মো নয়।”
শ্যামাকান্ত বলল, “কিন্তু সিন্দুকটা কোনও দিনই খোলা যাবে না, এ নিশ্চয়ই মা চাননি। অবশ্যই মা কাউকে না কাউকে কিছু বলে গেছেন।”
সুমতি বলল, “আমরা তো মারা যাওয়ার আগেই এসেছি। মা’র তখনও পুরো জ্ঞান ছিল। মা’র মুখে গঙ্গাজল দিলাম, হরিনাম শোনালাম, কই মা আমাকেও তো কিছু বলে যাননি!”
রমাকান্ত সন্দিগ্ধ চোখে মেজো বউদির দিকে তাকাল। বোধহয় কথাটা বিশ্বাস করল না। তাদের তিন ভাইয়ের পরিবারে পরিবারে এতটুকু সম্ভাব নেই, নেহাত আজ অবস্থার ফেরে পড়ে সকলে একত্র হয়েছে। সে বেশ চিমটি কাটা সুরে বলল, “হয়তো মা তোমাকে বলতে চাননি। হয়তো কাজের লোকদের বলে গেছেন।”
শ্যামাকান্তর বড় ছেলে রাজা এবার ক্লাস টুয়েলভে উঠেছে। নাকের নীচে তার ঘন গোঁফের রেখা, গলাটাও দিব্যি হেঁড়ে হেঁড়ে। সে পাশ থেকে ফুট কাটল, “ওদের কাছে বলে যাওয়াই তো স্বাভাবিক। ওরাই তো ঠাম্মার সেবাযত্ন করত।”
সুধাকান্তর মেয়ে টুনটুনি এখন ক্লাস নাইনে। বিনুনি দুলিয়ে বেশ টুকুর টুকুর কথা বলে। সে টুকুস মন্তব্য জড়ল, “রাজাদা ঠিকই বলেছে। নীলমাধব জ্যাঠারাই তো ঠাম্মার আপনজন ছিল।”
বড়রা সকলেই যেন বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। এ-ও মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। শ্যামাকান্ত ভার গলায় বলল, “বেশ, তা হলে মান খুইয়ে কাজের লোকেদেরই ডাকা যাক। নীলমাধব কমলমণি মানদা, ওরাই এসে বলে দিক…”
এক হাঁকেই তিনজন ছাদে হাজির। কমলমণির বয়স বছর ষাটেক, সে এ-বাড়িতে রান্নার কাজ করছে বহুকাল। প্রশ্ন শুনে উত্তর দেবে কী, হাউমাউ করছে, “আমি কিছু বলতে পারবুনি, আমি কিছুটি বলতে পারবুনি…”।
মানদার বয়স বছর পঞ্চাশ। সে ছিল চারুহাসিনীর সর্বক্ষণের সঙ্গী। গিন্নিমার মৃত্যুতে ভারী ভেঙে পড়েছে সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “মা কী একটা চিঠির কথা বলেছিলেন বটে, আমার ঠিক মনে নেই।”
বৃদ্ধ নীলমাধবের উত্তরটাই চমকপ্রদ হল। সে বলল, “মা আমায় বলেছিলেন তোমাদের নাকি সব জানিয়ে দিয়েছেন।”
“জানিয়ে দিয়েছেন। আমাদের?” একসঙ্গে তিন ভাইয়ের গলা ঠিকরে উঠল, “বুড়ো হয়ে কি তোর ভীমরতি হয়েছে নাকি? কবে জানিয়েছেন মা?”
চারুহাসিনীর এই তিন ছেলেকেই কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে নীলমাধব। কিন্তু তারা এখন আর একটুও মানিগণ্যি করে না। বরং পান থেকে চুন খসলেই বিশ্রীভাবে তেড়ে ওঠে। তবু নীলমাধবের তাদের ওপর রাগ নেই। সে বিনীত গলাতেই বলল, “পুজোর পর উনি নাকি তোমাদের সকলকে চিঠি দিয়েছেন। তাতেই নাকি…”
শ্যামাকান্ত সুধাকান্তর দিকে দুরে তাকাল, সুধাকান্ত রমাকান্তর দিকে। রমাকান্ত বলে উঠল, “ফের বাজে কথা। সেই চিঠিতে তো সিন্দুকের কথা কিছু ছিল না। অন্তত আমারটাতে তো নয়ই।”
শ্যামাকান্ত বলল, “আমার চিঠিটা তো আমি বর্ধমানে রেখে এসেছি। তোদের কারও চিঠি কি সঙ্গে আছে? একবার দেখা যায়।”
রমাকান্তর মেয়ে বুলবুলি সুধাকান্তর ছোট ছেলে ঝান্টুর সঙ্গে খুনসুটি করছিল। সে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, “ঠাম্মার চিঠি তো মা ফেলে দিয়েছিল। ওটা এখন আমার কাছে আছে। আমি ঠাম্মার সব চিঠি রেখে দিই।”
রমা অপ্রতিভ স্বরে বলল, “যাহ, ফেলব কেন? হয়তো কাজের লোকটা ঝাঁট দিতে গিয়ে…। তোর কাছে এখন আছে চিঠিটা।”
“আছে তো।”
“যা, নিয়ে আয়।”
শুধু মুখের কথা খসার অপেক্ষা, বুলবুলি নিমেষে উড়ে গেল নীচে। উড়তে উড়তেই মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ফিরল। হাতে এক মলিন পোস্টকার্ড।
চাঁদের আলোয় চিঠিটা পড়ার চেষ্টা করল সবাই। পারল না। দোতলা থেকে হারিকেন আনানো হয়েছে, সেই আলোতে শেষে জোরে জোরে পড়া হল চিঠি।
স্নেহের রমা,
আশাকরি তুমি, বউমা এবং বুলবুলি কুশলেই আছ। বিজয়ার পর আসিয়াছিলে, এক বেলাও থাকিলে না, মনে বড় দুঃখ পাইয়াছি। যাকগে, কী আর করা, তোমরা তোমাদের সংসার লইয়াই সুখে থাকো। আমার দিন ফুরাইয়া আসিতেছে, শেষ ক’টা দিন শ্রীহরির অষ্টোত্তর শতনাম জপ করিয়াই কাটাইয়া দিব। নামজপের অপার মহিমা, ইহাতেই চিত্ত শীতল হয়। আমার মৃত্যুর পর কথাটি স্মরণে রাখিয়ো। আশীর্বাদ নিয়ো।
ইতি— হতভাগিনী মা।
একটুক্ষণ সকলেই চুপ। তারপর সুধাকান্ত বলে উঠল, “আশ্চর্য, মা তো এই এক চিঠি আমাকেও লিখেছিলেন।”
শ্যামলী অফুটে বলল, “হ্যাঁ, আমাদের চিঠির ভাষাও তো ওই এক ছিল।”
আবহাওয়া গম্ভীর হয়ে গেছে। তারই মধ্যে সুমতি বলে উঠল, “কী কাণ্ড! মা কি একটাই চিঠি লিখে ফোটোকপি করেছিলেন নাকি?”
শ্যামাকান্ত বেজার মুখে বলল, “মা তো প্রায় সবসময়েই এই ভাষাতে চিঠি লিখতেন। এতে সিন্দুক খোলার কথা কোথায়?”
সুধাকান্ত কটমট করে নীলমাধবের দিকে তাকাল, “কী রে, তুই আমাদের সঙ্গে ফাজলামি করছিলি নাকি?”
নীলমাধব মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। বলল, “আমাকে মা ওই কথাই বলেছিলেন, বিশ্বাস করো। বলেছিলেন, ওরা যদি সিন্দুক খোলার কথা তোলে, তা হলে আমার শেষ চিঠির কথা মনে করিয়ে দিস।
কথা চালাচালির মধ্যে হঠাৎ রাজা এগিয়ে এল। ফস করে চিঠিটা নিয়ে নিয়েছে বাবার হাত থেকে। উলটেপালটে দেখল। শুঁকছে। শ্যামলীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “দ্যাখো তো, পেঁয়াজের গন্ধ পাও কি না!”
শ্যামলী অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকাল তারপর চিঠিটা শুঁকতে শুঁকতে বলল, “কই, না তো!”
“তা হলে বোধহয় গন্ধ উঠে গেছে।” বলেই মা’র হাত থেকে পোস্টকার্ডটা নিয়ে হারিকেনের মাথায় ধরল রাজা।
রমাকান্ত হাঁ হাঁ করে উঠল, “করছিস কী? চিঠিটা পুড়ে যাবে যে!”
রাজা বিজ্ঞের মতো হাসল, “তোমরা ক্রাইম স্টোরি পড়োনি ছোটকাকা। পেঁয়াজের রস দারুণ ইনভিজিবল ইঙ্কের কাজ করে। নির্ঘাত ওই অদৃশ্য কালি দিয়ে কিছু লিখে গেছে ঠাম্মা, গরমে ধরলেই ফুটে উঠবে।”
নীলমাধব আমতা আমতা করে বলল, “মা? মাকে তো আমি কোনওদিন পেঁয়াজ ছুঁতেও দেখিনি।”
“হেঁ হেঁ, এখন ম্যাজিক দ্যাখো।”
সকলেরই চোখ জ্বলজ্বল। হা হতোস্মি, তাপে পোস্টকার্ড গাঢ় বাদামি হয়ে এল, কিন্তু লেখার দেখা নেই।
রাজার মুখ ক্রমে শুকিয়ে এতটুকু। তাই দেখে ভারী মজা পেয়েছে বুলবুলি। হিহি হাসছে, আর বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে। ছেলের অপমানে মুখ গোমড়া হয়ে গেল শ্যামলীর। ফস করে কী যেন বলল রমলাকে, সঙ্গে সঙ্গে বেঁঝে উঠেছে রমলা। মাঝখান থেকে সুমতি একটা টিপ্পনী ছুড়ে দিল, আমনই রমাকান্ত রেগে কাঁই। শ্যামাকান্ত যত তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, সে তত তেড়ে তেড়ে ওঠে। সুধাকান্তর সঙ্গেও রমাকান্তর লেগে গেল জোর, সেও খুব চেল্লাচ্ছে। তিন ভাইয়ে প্রায় লাঠালাঠি বাধার উপক্রম।
রাতের সভা ছত্রখান হয়ে গেল।
তিন ভাইয়ের নিজের নিজের ঘরে শুতে চলে গেছে। কিন্তু কারও চোখেই ঘুম নেই! উত্তেজনা থিতিয়ে গেছে বটে, তবে চিঠিটা এখনও বনবন করে ঘুরছে মাথায়। মা তাদের সঙ্গে কী খেলাটা খেলে গেছেন কিছুতেই কেউ ধরতে পারছে না।
এক সময়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সকলে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে আপনা আপনি খুলে গেছে সিন্দুক। ভেতরে থরে থরে সাজানো আছে টাকা গয়না…।
কাকভোরে হঠাৎ বুলবুলির ঘুম ভেঙে গেল। কোত্থেকে একটা গুনগুন ধ্বনি ভেসে আসছে না? মা বাবা অঘোরে ঘুমোচ্ছে, পা টিপে টিপে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল বুলবুলি। সবে হালকা হালকা আলো ফুটেছে, যেন রাত্তিরকে একটু একটু করে মুছে দিচ্ছে আর একটা নতুন সকাল। পিক পিক পাখি ডেকে উঠছে। কী নরম, কী অপরূপ যে লাগছে চারদিক!
বারান্দায় এসে শব্দটার উৎস খুঁজে পেল বুলবুলি। আধো আলো আধো অন্ধকার মাখা বারান্দার এক কোণে বসে কে অমন দুলে দুলে গান গাইছে? নীলমাধব জ্যাঠা না?
বুলবুলি পা টিপে টিপে নীলমাধবের কাছে গেল। কীসব মুকুন্দ মুরারি কেশব গোবিন্দ গোপাল বাসুদেব বলে বলে গান গাইছে নীলমাধব! চোখ বন্ধ, হাত জোড় করা।
বেশিক্ষণ ধৈর্য ধরে দাড়িয়ে থাকতে পারল না বুলবুলি। আলতো ঠেলা দিয়েছে নীলমাধবকে।
নীলমাধব চোখ মেলে তাকাল। রমাকান্তর দশ বছরের এই ফুটফুটে মেয়েটাকে ভারী ভাল লাগে নীলমাধবের। মুখখানা যেন চারুহাসিনী বসানো। কথাবার্তা আচার-আচরণও চারুহাসিনীর কথা মনে পড়িয়ে দেয়।
হাসি হাসি মুখে নীলমাধব বলল, “কী গো দিদি, এত ভাবে ভোরে উঠে পড়েছ যে?”
“তোমার গান শুনেই তো ঘুম ভেঙে গেল।” বুলবুলি থেবড়ে বসল নীলমাধবের পাশে, “ওটা কী। গান গাইছিলে গো জেঠু?”
নীলমাধবের হাসি ছড়িয়ে গেল, “দূর পাগল, গান কোথায়? ও তো আমি শ্রীহরির নাম জপ করছিলাম।”
“শ্রীহরির নাম জপ? কই, হরি হরি তো করছিলে না?”
“ওরে দিদি, আমি শ্রীহরির অষ্টোত্তর শতনাম জপ করছিলাম।”
“সেটা আবার কী?”
“ওমা, তাও জানো না? শ্রীকৃষ্ণের একশো আটটা নাম আছে। মা বলতেন রোজ ভোরে উঠে ওই একশো আটটা নাম জপ করে নিলে সারাটা দিন বড় ভাল যায়। শুনবে নামগুলো? শ্রীকৃষ্ণ, শ্যাম, কানু, মধুসূদন, মুরলীধর, দর্পহারী, যশোদাদুলাল, পুণ্ডরীকাক্ষ, কালিয়া, শৌরি, গোপীজনবল্লভ, কংসহা, অচ্যুত…”
পুরোটা আর শোনা হয়ে উঠল না বুলবুলির। হঠাৎ মাথার ভেতর বিব বিব বাজতে শুরু করেছে― একশো আট। একশো আট। ঠাম্মার চিঠিতে অষ্টোত্তর শতনামের কথা বলা আছে না?
নীলমাধবকে স্তম্ভিত করে দিয়ে সহসা বুলবুলি বড় ঘরের দিকে ছুটেছে। সোজা চারুহাসিনীর দেওয়াল সিন্দুকের সামনে। সার সার দশখানা চাবি হাতলে ঝুলছে। প্রথমে আট নম্বর চাবিটা নিল বুলবুলি। চাবি গলিয়ে উলটো দিকে চাকা ঘোরাল আটবার।
শূন্য নম্বর চাবি গলিয়েছে এবার, দশবার উলটো দিকে চাকা ঘোরাল। তারপর এক নম্বর চাবি গলিয়ে একবার। কুট করে একটা শব্দ হল না? দুরু দুরু বুকে বুলবুলি হাতলটা ধরল। টান দিতেই সিন্দুক হাঁ।
প্রবল আনন্দে বুলবুলি চিৎকার করে উঠল, “চিচিং ফাঁক। চিচিং ফাঁক। সিন্দুক খুলে গেছে।”
মুহূর্তে গোটা বাড়ি জেগে গেল। সবাই আঁকুপাকু করে দৌড়ে এসেছে। জোড়া জোড়া বিস্ফারিত চোখ দেখছে সিন্দুকের অভ্যন্তর। ফাঁকা, বেবাক ফাঁকা। টাকা নেই, গয়না নেই, জমি বাড়ির দলিল কিছু নেই।
না, পুরো ফাঁকা নয়। দু’ তাকের সিন্দুকের ওপর তাকে একটা কাগজ পড়ে আছে না?
শ্যামাকান্ত কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজটা বার করল। চারুহাসিনীর উইলের কপি।
ভাঙা ভাঙা স্বরে উইলটা পড়তে শুরু করল শ্যামাকান্ত:
আমি, চারুহাসিনী দেবী, সুস্থ শরীরে এবং সজ্ঞানে আমার সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তি বর্ধমানের শান্তিনীড় বৃদ্ধাশ্রমে দান করিলাম। যেসব বৃদ্ধ বৃদ্ধার কেহ নাই, সন্তানসন্ততিরা থাকিয়াও নাই, আমার সঞ্চিত অর্থ ও গহনায় যদি তাঁহাদের সামান্যতম উপকারও হয়, আমি নিজেকে ধন্য মনে করিব। আমার যাবতীয় স্থাবর সম্পত্তি (জমি বাড়ি ইত্যাদি) আমার মৃত্যুর পর সরকারকে গ্রহণ করিতে অনুরোধ করিতেছি। আমার শেষ বাসনা, এই বসতবাটীতে যেন একটি অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আমার জমির ফসল, পুকুরের মাছ অনাথ শিশুরা নিঃশর্তে ভোগ করিতে পারে। শুধু একটিই শর্তা আমার অসহায় অবস্থায় যাহারা আমার দেখাশুনা করিয়াছে, সেই নীলমাধব কমলমণি এবং মানদাকে আজীবন অনাথ আশ্রমের কর্মচারী হিসাবে বহাল রাখিতে হইবে। আমার কোনও পুত্র কোনওভাবে এই আশ্রমের সহিত সম্পর্ক রাখিতে পারিবে না, ইহাই আমার অভিরুচি।
তিন ভাই মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে আছে। বসন্তের মধুর সকালে তাদের চোখে নেমে এসেছে ঘন আঁধার।।
২৮ জুলাই ১৯৯৯
অলংকরণ: কৃষ্ণেন্দু চাকী