চারিত্রিক সনদ

চারিত্রিক সনদ

পিএইচডি শেষে আমেরিকায় যখন পোস্টডকের জন্য আবেদন করলাম, কোনো ইউনিভার্সিটি আমার পিএইচডির সার্টিফিকেট কিংবা অনার্স-মাস্টার্সের সার্টিফিকেট চায়নি। পাঁচটা আবেদন করেছিলাম। সবই ছিল আইভিলিগ স্কুলে। কোনো ইউনিভার্সিটি, স্থানীয় চেয়ারম্যান বা সিটি করপোরেশন থেকে চারিত্রিক সনদ চায়নি। পাঁচটা আবেদনের মধ্যে তিনটা ইয়েস কার্ড পেয়েছিলাম, কোনো ধরনের সনদ ছাড়াই। পোস্টডক শেষে জবে ঢুকলাম। জবের জন্যই যে আবেদন করলাম, ইন্টারভিউ দিলাম–কোথাও কেউ কোনো সনদ-ফনদ চাইল না। আমি ব্যাচেলরে কত পেয়েছি, মাস্টার্সে কত জিপিএ ছিল, এগুলো কেউই জিজ্ঞেস করেনি। আমেরিকার মতো একটা দেশ, কোনো সনদ-নদ। ছাড়া তাহলে কী করে চাকরি দিয়ে দেয়? কী করে আইভিলিগ স্কুলে গবেষণার জন্য নিয়োগ দেয়?

এই দেশে সনদের চেয়ে বড় হলো রিকমেন্ডেশন লেটার। আমার পিএইচডির সুপারভাইজার ইউনিভার্সিটিগুলোতে লেটার পাঠাতেন, সেটাই সনদ। এর চেয়ে বড় কোনো সনদ নেই। সেই লেটারের ওপর ভিত্তি করে এবং আমার পূর্ববর্তী গবেষণার রেকর্ড। থেকে ওরা পোস্টডকের জন্য আবেদন গ্রহণ করেছে। আবার আমি যখন জবের জন্যে আবেদন করতাম, তখন আমার পিএইচডি এবং পোস্টডক সুপারভাইজারগণ রিকমেন্ডশন লেটার। পাঠাতেন। তাঁদের লেটার, আমার পূর্ববর্তী গবেষণার রেকর্ড ও পারফরম্যান্স–এই বিষয়গুলোর কম্বিনেশন থেকেই এ দেশে চাকরি। তাহলে, সনদ ওদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ নয় কেন?

দুনিয়াতে সনদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সনদ প্রদানকারী মানুষ। ইউরোপ-আমেরিকায় এই মানুষগুলোকে তৈরি করা হয়েছে। এমন মানুষগুলোকেই প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। একজন মানুষ যখন আপনার বিষয়ে দুকলম লিখে দেন, সেটাকেই সনদ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। কারণ, এই মানুষগুলো কাউকে মিথ্যে মিথ্যে সার্টিফাই করবে না। একজন প্রফেসরের সুপারিশপত্র, সনদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সনদ শুধু পরীক্ষার ফলাফল সম্পর্কে ধারণা দেয়। কিন্তু একজন মানুষের মেধা, আগ্রহ, কাজের নেশা, চারিত্রিক দিক, ধৈর্য ইত্যাদি বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করে না। একটা রিকমেন্ডেশন লেটার এসব বিষয়ও তুলে ধরে। তাই, সত্যিকারের রিকমেন্ডেশন। লেটার হয় কনফিডেনশাল বা গোপনীয়। আমার মেন্টররা আমার বিষয়ে কী লিখতেন, আমি কখনো দেখিনি। আমি একবার দেশে থাকার সময়, সায়েন্টিফিক অফিসার পদে আবেদনের জন্য এ প্রস্তুতি নিলাম। একপর্যায়ে দেখলাম সব ডকুমেন্ট রেডি আছে, কিন্তু চারিত্রিক সনদ নেই। আবেদনের জন্য চারিত্রিক সনদ লাগবে। সেই সনদ আবার আনতে হবে ইউনিয়ন। পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে। এত সনদ, এত কাগজপত্র–তারপরও যথেষ্ট নয়। বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদের আবেদনের জন্য সনদ লাগবে ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের। হঠাৎ এই। কথাটা যখন মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল, তখনই আবেদন করা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছিলাম। কোনো দিন আর আবেদন করা হয়নি। একজন ভোটচোর, অসভ্য, অযোগ্য চেয়ারম্যানের কাছ থেকে একজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার চাকরির জন্য আনতে হবেচারিত্রিক সনদ! সেলুকাস! আমরা সনদ প্রদানের মানুষ তৈরি না করে, কাগজের সনদেই পূর্ণ আস্থা রেখেছি!