চায়ের দোকানের সেই ছেলেটি
একসময়ে আমি একটা সরকারি চাকরি করতাম৷ পরিক্ষা দিয়ে সেই চাকরি পেয়েছিলাম৷ খুব সামান্য চাকরি, মৌলালির মোড়ে একটা সরকারি ওষুধের গুদামে চিঠিপত্র লেখালেখি করা৷ সেই অফিসের রাস্তার উলটো দিকেই ছিল একটা চায়ের দোকান৷ টিফিনের সময় ওই চায়ের দোকানে কয়েকজন বন্ধু আড্ডা দিতে আসত৷
আমার কয়েকজন বন্ধু তখনও বেকার, আর আমার মতো কয়েকজন যে-কোনো চাকরিতে ঢুকে পড়েছি৷ তখন চাকরি-টাকরি পাওয়া খুব শক্ত ছিল৷ আমার বাড়ির অবস্থার জন্য আমাকে খুব তাড়াতাড়ি চাকরি জোগাড় করতেই হবে বলে আমি আর এম. এ পড়তে পারিনি৷
যাই হোক, আমার বন্ধুদের মধ্যে একটা নিয়ম করা হয়েছিল, যারা চাকরি পেয়েছে, অন্য বন্ধুদের তারা নিয়মিত খাওয়াতে বাধ্য৷ ওই চায়ের দোকানে আমার যেসব বন্ধুরা আসত, তাদের খাওয়াবার খরচ আমাকে দিতে হত৷ আমি বেশি মাইনে পাই না, তাই বলে দিয়েছিলাম, চপ-কাটলেট খাওয়াতে পারব না ভাই৷ শুধু চা আর টোস্ট৷
তখন আমাদের কম বয়েস তো, তাই দেখা হলেই শুধু লেখালিখির কথা৷ কে কী কবিতা লিখছে, কার গল্প কোথায় ছাপা হল, এইসব৷ অনেক সময় তর্কাতর্কিও হত৷ তখনকার বিখ্যাত লেখকদের মধ্যে কার নাম আমাদের পছন্দ আর কার লেখা একেবারেই ভালো লাগে না, তাও বলতাম খোলাখুলিভাবে৷
একটা টেবিল আমাদের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ আমরা পাঁচ-সাতজন সেই টেবিল ঘিরে বসে সাহিত্য আলোচনায় চ্যাঁচামেচি করতাম৷ এক এক সময় অন্য টেবিলের খদ্দেররা বিরক্ত, আমরা গ্রাহ্য করতাম না৷
যে ছেলেটি আমাদের চা দিত, তার বয়েস বড়োজোর চোদ্দো-পনেরো৷ গায়ের রং কালো৷ মুখখানি সুশ্রী৷ চোখ দুটিতে সারল্য মাখা৷ ওই বয়েসের ছেলের ইস্কুলে পড়ার কথা, কিন্তু কাজ করছে চায়ের দোকানে৷ আমাদের দেশে শিশু-শ্রমিক বন্ধ করার জন্য আইন আছে, কিন্তু অনেকেই সে আইন মানে না৷ আবার অভাবের তাড়নায় অনেক বাবা-মাও কম বয়েসের ছেলেমেয়েদের কাজ করতে পাঠায়৷
এই ছেলেটি আমাদের চা-টা দিয়েও মাঝে-মাঝে দাঁড়িয়ে থাকত একটু দূরে৷ আমাদের কথা শুনত৷
একদিন দোকানের মালিক বাইরে গেছেন, সেই ছেলেটি আমাদের কাছে এসে খুব লাজুকভাবে বলল, স্যার, আপনারা সবাই লেখক৷ আমিও কবিতা লিখি, একটু দেখবেন?
আমি প্রথমে একটু অবাক হলেও পরে বললাম, ঠিক আছে, নিয়ে এসো একদিন৷ দেখে দেব!
সে চলে যাবার পর আমার এক বন্ধু ঠোঁট উলটে বলল, দেশের কী অবস্থা! চায়ের দোকানের বেয়ারাও কবিতা লিখছে আজকাল!
এই মন্তব্য আমার পছন্দ হল না৷
চায়ের দোকানে কাজ করে তো কী হয়েছে? কোনো কাজই যে ছোটো নয়, তা আমরা এখনও শিখিনি৷ বিদেশে অনেক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের খরচ চালাবার জন্য অনেক হোটেল- রেস্টুরেন্ট-পেট্রল পাম্পে পার্টটাইম কাজ করে, রেস্টুরেন্টে তারা টেবিলে টেবিলে খাবার দেয়, বাসন মাজে, ঘর পরিষ্কার করে, তাতে কোনো লজ্জা নেই৷
আমাদের দেশে ছাত্র-ছাত্রীরা বাবা-মায়ের পয়সাতেই স্কুল-কলেজে পড়াশুনো করে৷ বড়োজোর টিউশনি করে কেউ কেউ৷ অনেক বাবা-মা দারিদ্র্যের জন্য ছেলে-মেয়েদের পড়ার খরচ জোগাতে পারেন না, মাঝপথে ছাড়িয়ে দেন৷ গ্রামগঞ্জের অনেক ছাত্র-ছাত্রী শেষ পরিক্ষা পর্যন্ত পৌঁছোয় না৷ যাদের বলে ড্রপ আউট, তাদের মধ্যে কিন্তু অনেক মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীও থাকে৷ অভাবের তাড়নায় তারা বাধ্য হয়ে যে-কোনো কাজ নেয়৷
এই চায়ের দোকানের ছেলেটির সঙ্গে আমি কথা বলে জানলাম, তার নাম সুখময় মিদ্যা, বাঁকুড়া জেলায় এক গ্রামে বাড়ি৷ ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছে, হঠাৎ সাপের কামড়ে তার বাবা মারা যায়৷ তারপর এমনই অবস্থা, পড়াশুনো চালিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, দু’বেলা খাবারই জোটে না৷ কোনো একজন চেনা লোকের সঙ্গে এসে কলকাতায় এই চায়ের দোকানের চাকরি জুটিয়েছে৷ যা মাইনে পায়, তার অনেকটাই বাঁচিয়ে বাড়িতে মাকে পাঠায়৷
তার বয়েস আমি যত কম ভেবেছিলাম, ততটা কম নয়৷ সতেরো বছর চলছে৷
একদিন আমার বন্ধুরা আসবার আগেই সে চুপি চুপি আমাকে তার লেখা তিনটি কবিতা দেখাল৷
আমি প্রথমেই যা দেখে চমকে উঠলাম, তা তার হাতের লেখা৷ ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়া ছেলেদের তুলনায় তার হাতের লেখা বেশ ভালো৷ এবং বানান ভুলও একটি-দুটি মাত্র৷ কবিতাগুলিও একেবারে আজেবাজে নয়৷ ছন্দে-টন্দে ভুল আছে বটে কিন্তু তার দেখবার বিশেষ চোখ আছে৷ কারুর কারুর এই ক্ষমতা থাকে, তারাই কিছু না কিছু সৃষ্টি করতে পারে৷ তার বিষয়বস্তুতেই নতুনত্ব আছে৷ একটা কবিতার নাম ‘নদী যেখানে বাঁক নেয়’, আর একটির নাম ‘পাখির বাসা, পাখিটা আর আসে না’৷
আমি তার ভুল-ত্রুটি বুঝিয়ে দিয়ে বললাম, আবার লিখে এনে দেখিও৷
দু-তিনবার ঠিক করে আনার পর, তার দুটি কবিতা বেশ উতরে গেল, আমি সেই দুটি কবিতা নিয়ে ছাপিয়ে দিলাম দুটি পত্রিকায়৷ তাতে তার কী আনন্দ, ‘দেশ’ পত্রিকায় যে কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছে, তার জন্য সে টাকা পাবে শুনে জল এসে গেল তার চোখে৷
এরপর প্রায়ই এসে সে কবিতা দেখায়, আমি একটু-আধটু ঠিক করে দিই৷ চায়ের দোকান মালিক যখন মাঝে মাঝে তাকে বকাবকি করে, তখন আমার কষ্ট হয়৷ কিন্তু আমি আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যাই না, ওই ছেলেটি কবিতা লেখে শুনলে হয়তো ঝট করে চাকরি থেকেই ছাড়িয়ে দেবে৷ এইসব চাকরির তো কোনো নিরাপত্তা নেই৷
ছেলেটির লেখার দিন দিন উন্নতি দেখে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছিল, একদিন সে নামকরা কবি হবে নিশ্চয়ই৷ সুন্দরবনের এক কবিকে আমি চিনি, সে নিতান্তই চাষি, সেই অবস্থাতেও লেখালেখি করে সে বেশ নাম করেছে৷
সে বছরে পুজোর ছুটির সময় আরও কয়েকটা দিন ছুটি জুড়ে নিয়ে আমি বেড়াতে গিয়েছিলাম আন্দামান৷ সেখান থেকে ফিরে অফিসে যোগ দেবার দিনই দুপুরবেলা বেরিয়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ! সেই চায়ের দোকানটা নেই৷ উঠে গেছে! সেই জায়গায় এর মধ্যেই খুলে গেছে একটা ওষুধের দোকান৷
তখনই আমার মনে হল, সুখময় কোথায় গেল? তার তো আমি ঠিকানা-ফিকানা কিছু জানি না৷ কোথায় তার খোঁজ করব? অবশ্য, সে তো জানে, আমি এই অফিসে চাকরি করি৷ এখানে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে৷
কিন্তু সে এল না৷ হয়তো, হঠাৎ চাকরি চলে যাওয়ায় সে খুব বিপদে পড়েছে৷ আশেপাশে কোনো চায়ের দোকানেও তার সন্ধান পাওয়া গেল না, কোথায় গেল কে জানে!
কিছুদিন পর অবশ্য আমিও ওই চাকরি ছেড়ে চলে গেলাম অন্য জায়গায়৷
আমি আশা করেছিলাম, কবিতা লেখা সে যতটা শিখেছে, তখন যে-কোনো জায়গা থেকেই ডাকে পাঠালেই অনেক পত্র-পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হতে পারে৷ আমি বেশ কিছু বছর সব পত্র-পত্রিকাতেই সূচিপত্রে সুখময় মিদ্যার নামটা খুঁজেছি৷ কিন্তু আর দেখতে পাইনি৷ অনেক বছর হয়ে গেল, আর বোধ হয় সম্ভাবনা নেই৷
এখনও তার সেই সারল্যমাখা মুখটি মনে পড়ে৷ কোথায় হারিয়ে গেল সে৷ এবং হারিয়ে গেল একজন সম্ভাবনাময় কবি!
—