চাবি – আশা দেবী
মাঝরাতে একটা ঝোড়ো হাওয়া প্রভাত বিশ্বাসের কাচের জানালার ওপর আছড়ে পড়ল। যেন মনে হল দূরের পাহাড় পেরিয়ে ঝাউগাছগুলোর মাথার ওপর দিয়ে সে যেন ওই জানালাটা লক্ষ করেই ছুটে আসছে, তারপর সেই ঝোড়ো হাওয়া ঠিক কান্নার মতো সবেগ উচ্ছ্বাসে জানালার খড়খড়িগুলোকে বুক চাপড়ানোর মতো আওয়াজ করে খুলে ফেলল! আর যেন ঝোড়ো হাওয়ায় দূরের ভেসে আসা ফুলের গন্ধের মতো একরাশ গন্ধের সঙ্গে পালকের মতো লঘু পায়ে কে যেন ঘরের ভেতর নেমে এল। তারপর সেই কোরা শাড়ির গন্ধ, চেনা চেনা মিষ্টি মিষ্টি গায়ের গন্ধ, চুলের গন্ধ আর গরম গরম নিশ্বাসে কে যেন ঘরটা ভরে দিল। প্রভাত অনুমান করল অনু এসেছে।
ক—দিন বৃষ্টি নেই। প্রচণ্ড গুমোট চলছে। পাহাড়ে এমন গুমোট সচরাচর দেখা যায় না। মনে হচ্ছে একটা প্রবল ঝড়বৃষ্টির পূর্বসংকেত। প্রভাতের ঘরটার বাইরে যেন শব্দহীন পাহাড়ি রাজ্যের স্পন্দনহীন অন্ধকার রাতটা যেন তার অনুভূতিগুলোকে স্তিমিত করে আনছে। যেন মনে হচ্ছে, বাইরের এই পাহাড়ি—পাথুরে অন্ধকারটা তার বুকটাকে দু—হাত দিয়ে চেপে ধরতে চাইছে।
বাইরের নিঃশব্দ পৃথিবী—ভেতরে নীরন্ধ্র অন্ধকার। এই নিথর রাতের আঁধারে যেন তার ইন্দ্রিয়গুলো এই মুহূর্তে সজাগ হয়ে উঠেছে, মনে হচ্ছে তার কে যেন জানালার কাছে এসেছে। শাঁখের মতো সাদা আর সরু সরু আঙুলগুলো দিয়ে খড়খড়ির কাঠগুলো তুলছে, তারপর, ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে, তার খাটের কাছে। আরও কাছে—এগিয়ে আসছে সে।
—বাহাদুর—বাহাদুর! নিল—নিল আমার সিন্দুকের চাবি নিল। বিকৃত কণ্ঠে প্রভাত চিৎকার করে উঠল। তারপর তিরের মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। এই শীতের রাতেও সে ঘেমে নেয়ে গেছে। উত্তেজনায় ছুটে সে ঘরের কোণার সুইচ বোর্ডটার কাছে গিয়ে আলো জ্বালাল। মাথার মধ্যে যেন হাতুড়ির ঘা দিচ্ছে কে। ঘরের আলোটা জ্বলে উঠতেই যেন ছায়াবাজির মতো দেওয়ালের গায়ে অনু আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল।
প্রভাত বিছানার ওপর বসে পড়ল ধপ করে। নিজেকে একটু সংযত করে নিয়ে সে আবার চারিদিকটা বেশ করে চেয়ে দেখল। আলোটা ভারি ঘোলাটে লাগছে। কতদিনের পুরোনো আর ময়লা বালব। ধুলো—ময়লা পড়ে পড়ে ওর জোর কমে গেছে। চারিদিকে মাকড়সায় জাল বুনেছে। সেই মাকড়সার জালের তার বেয়ে নেমে আসা আলোর ক্ষীণতম রশ্মিগুলোতে চুন—বালি ওঠা দেওয়ালগুলোকে যেন ক্রুর শ্বাপদের দাঁতের মতো লাগছিল। কারা যেন অজস্র অঙ্গুলির সংকেতে তাকে শাসিয়ে চলেছে একটানা।
প্রভাত ঘর—বার, খাটের তলা, আলমারির পাশ সব দেখল খুঁজে। অনু কোথাও নেই। দরজার হুড়কো তেমনি বন্ধ। তবে কে বালিশের নীচের চাবি নিতে এসেছিল? প্রভাত বালিশ তুলে দেখল, সেটা সেখানেই পড়ে আছে। আলমারির পাশে লোহার সিন্দুকে তেমনি ছেঁড়া অয়েলক্লথ দিয়ে ঢাকা। ধুলোয় ধুলোয় সিন্দুকের গায়ের লাল স্বস্তিক চিহ্নটা একটা ক্ষতের মতো তেমনি কালো হয়ে তাকিয়ে আছে। কেউ যে এতে হাত দিয়েছে এমন তো মনে হচ্ছে না। তবে—?
প্রভাত বিছানা ছেড়ে উঠে বসল। ভাঙা দাঁতের ওপরের কাটা ঠোঁটটার ভেতর থেকে সরীসৃপের মতো বার কতক লাল জিভটা নাড়ল। এবার যেন তার অনুভূতিগুলো একটু একটু করে আসছিল। হঠাৎ মনে হল বড্ড তেষ্টা পেয়েছে, ঘরের ভেতরে রাখা কাচের কুঁজোটা থেকে ঢক ঢক করে খানিকটা জল সে খেয়ে ফেলল। তারপর ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। অনু এসেছিল! প্রভাত জানত সে আসবেই, আসবেই তার গয়নার আকর্ষণে।
পাগলের মতো ছুটে এসে সে জানালাটা খুলে দিল, তারপর দূরে সন্ধানী চোখ মেলে কাকে যেন খুঁজতে লাগল সেই নিকষ—কালো অন্ধকারের ভেতর। ওই যে পেনসিলে আঁকা পাহাড়ের সারি আকাশের বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে, তাদেরই মাথার ওপর দিয়ে হয়তো ওই দমকা ঠান্ডা হাওয়াটা ছুটে এসেছিল পাগলের মতো। কালো কালো পাইনের মাথাগুলো কেঁপে কেঁপে শিউরে শিউরে উঠেছিল যেন সেই হিমেল স্পর্শে। পাহাড়ের বুকের গ্রামগুলোর ঘুমন্ত গৃহস্থের ঘরের নিবু নিবু আলোগুলোকে যেন সে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল সহসা। হঠাৎ যেন বাজপড়া নেড়া গাছটার ওপর শকুনের ছানাটা চিৎকার করে কঁকিয়ে কেঁদে হঠাৎ চুপ করে গেল কাকে দেখে। আর কে যেন ছুটে আসছে সাদা কঙ্কালের আঙুলের ধোঁয়ায় কালো বুকপোড়া চোরা লণ্ঠন হাতে ধরে। আর দেখতে দেখতে সেই ঘরের চাল সেই গাছের মাথার পুঞ্জপুঞ্জ হিমানী জমে রূপ নিলে অনু আর সেই গাছের মায়াময়ীর কায়া যেন অনায়াসেই কায়া গ্রহণ করে জানালার ভেতর দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল।
তারপর তার ব্রোঞ্জের চুড়ির কর্কশ ঠুনঠান, শাড়ির আওয়াজ আর মাথার তেলের গন্ধ ঘরে ভরে দিয়েছিল। প্রভাত তাকে দেখেছে নইলে সে বুঝল কী করে অনুকে।
বাইরে থেকে বাহাদুর ডাকছে—বাবু—বাবু কী হল? দরজা খোল। কিন্তু প্রভাত দরজা খুলল না, শুধু পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগল যেন কাকে খুঁজছে—যেন দরজা খুললেই সে পালিয়ে যাবে।
এমনি সে প্রায়ই করে। বাহাদুর পুরোনো চাকর, সে সবই জানে। অনুকে দোতলার জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে খুন করবার পর থেকেই সে অমনি করে স্ত্রীর গহনা পাহারা দিয়ে চলেছে যক্ষের মতো অনুর হাত থেকে। তবু মনে হয় পারবে না, সে কিছুতেই পারবে না। অলংকার লোলুপতা অনুর মৃত্যুর পর আরও বেড়েছে, সে ওগুলো নেবেই— এই কথাটা ভাবতে ভাবতে যেন তার মাথার শিরা—উপশিরাগুলো টুকরো হয়ে ছিঁড়ে যেতে চাইছে যন্ত্রণায়। যদি তার একটা রাতও নিশ্চিন্তে ঘুম হত তাহলে হয়তো সে বাঁচতে পারত।
বাড়ির নাম ‘প্রভাত—কিরণ’। এই ইতি—কথা বড়ো বিচিত্র। এই শহরের পথে পথে সিগারেট ফিরি করে বেড়াত প্রভাত! ক—টা পয়সাই বা হয় এতে। কখনো একবেলা ভাত জোটে, কখনো অনাহার। হঠাৎ যুদ্ধ বাধল। চারটে ভাঙা দাঁত আর কাটা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে হাসির ঝিলিক খেলে গেল তার মুখে। সরস্বতীকে ক্লাস সেভেনে বিদায় দিলেও লক্ষ্মীকে কীভাবে লোহার সিন্দুকে বাঁধতে হয় তা সে জানত। যুদ্ধের সুযোগে ভুটিয়াদের মারফত তিব্বতে সে সিগারেটের চোরাকারবার করত। আরও যেন কী কী চালান দিত কে জানে, চক্ষের নিমেষে কাঁচা টাকা আর সোনার বারে তার সিন্দুক ভরে উঠল।
গরিলার মতো লোমশ হাতে কানের ওপর থোপা থোপা চুলগুলো টেনে টেনে ফাঁকা দাঁতের পাশে লিকলিকে জিভটা নেড়ে নেড়ে হাসত প্রভাত। কি সুখী কি সুখী সে। নিজের নামে বাড়ি করেছে সে।
সবাই ধরে বসল—বিয়ে কর। কেউ নেই, কে দেখবে। প্রভাত এবার জন্তুর মতো অর্থহীন দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল। তাকে বিয়ে করবে কে? যার চোখ আছে সে কিছুতেই সাহস করবে না।
কিছুদিন বেশ কেটে গেল। এবার বিয়ের প্রসঙ্গে তার মুখে রহস্যের হাসি। এরও তিনমাস পর একদিন সকলকে বিস্মিত করে চৌমাথার মোড়ে বউ নিয়ে নামল প্রভাত। সবাই বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল। অফিসের লেট হয়ে গেল তবু কোনো মন্তব্য পর্যন্ত করতে পারল না। অপূর্ব সুন্দরী অনু—তার সারা শরীর গয়না আর বেনারসিতে ঝলমল করছে। সবাই বললে, এ গরিলার গলায় হিরের হার পরাল কে?
গয়না প্রভাতই দিয়েছিল। মনে মনে ছিল স্ত্রীকে দেওয়া মানেই গর্বে থাকা। তা ছাড়া সুন্দরী বুদ্ধিমতী অনু প্রথমে একেবারে বেঁকে বসেছিল। কিন্তু গরিবের মেয়ে, সাজতে—গুজতে গয়নাগাঁটিতে তার বড়ো লোভ। সেই রন্ধ্রেই শনি প্রবেশ করল এবং সে প্রভাতের ফাঁদে পা দিল।
পাহাড়ের কোলে বিরাট বাড়ি, বাগান। এমন স্বামীর ঘর অনু আশাও করেনি। কিন্তু আশ্চর্য, এ ক—দিনেই যেন সে অনুভব করল প্রভাতের চোখ তাকে সমানে পাহারা দিয়ে ফিরছে। কিছুদিন আড়ে আড়ে কথা বলে তারপর একদিন বলেই ফেলল প্রভাত—গয়নাগুলো খুলে রাখ। সর্বদা ব্যবহার করলে ক্ষয়ে যাবে।
—সেকি? তবে দেবার দরকার ছিল কি?
—আমি তোমার সর্বদা ব্যবহারের জন্যে ব্রোঞ্জের চুড়ি তৈরি করে রেখেছি।
—না, আমি গয়না খুলব না। অনু গলার হারটা দু—হাতে চেপে ধরল। রোলড গোলডের হার পরব না আমি। ছিঃ—
—ছিঃ, আবার কী? সবাই তাই করে। তুমিও করবে।
না, আমি করব না। দৃঢ়স্বরে অনু জানিয়েছিল। কিন্তু কথা তার টেঁকেনি। প্রভাত ঠিক তখনই নেয়নি, কিন্তু তার ক—দিন পরই নিয়েছে জোর করে। যেন সে এত সোনার এভাবে অপচয় সহ্য করতে পারছে না! ব্যবহার করলে সোনা ক্ষয়ে যায় যে।
অনু ক—দিন চেয়েছে, অভিমান করেছে। তারপর হাতে ক—গাছা ব্রোঞ্জের চুড়ি ছাড়া কোনো গহনাই পরেনি। আর মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে প্রভাত— কী লোভী মেয়েটা! কী ভীষণ লোভ ওর গয়নার ওপর, নইলে গরিলার মতো স্বামীর চেহারা দেখেও বিয়ে করবে কেন? বিয়ে তো করেছে সে গয়না—শাড়িকে, প্রভাতকে নয়। কাছে ডাকলে আসে না। সর্বদা দূরে দূরে থাকে। মনে হয় যেন কেমন ভয় করে তাকে। বেশ তো ছিল, কী দরকার ছিল তাকে বিয়ে করবার। তার সুন্দরী স্ত্রী—ইচ্ছে করে অনুকে দূর করে দেয় বাড়ি থেকে—সামনের কাটা ঠোঁটের দন্তহীন গহ্বরের ফাঁক দিয়ে যেন সরীসৃপের মতো জিহ্বাটা তার লিকলিক করে ওঠে। এই সময় যেন তাকে ভারি বীভৎস লাগে দেখতে।
হঠাৎ তার সামনে চোখ পড়তেই দেখে অনু জানালার কাছ থেকে দু—চোখে ভয় নিয়ে ছুটে পালাচ্ছে যেন পায়ের কাছে সাপ দেখেছে সে।
বাজারের সামনে ক—টা হোটেল খুলেছে। দিনরাত সে তাই নিয়েই ব্যস্ত, বাড়ি প্রায় ফেরা হয়ই না। আজ সে বাড়ি ফিরবেই যত রাত হোক। বাহাদুর অবশ্য বাড়ি ফেরবার জন্য রোজই বলে, এও বলে, না ফিরলে হয়তো খুবই ক্ষতি হবে। কিন্তু প্রভাত নিরুপায়। চীনা সীমান্তে যুদ্ধ লেগেছে। এখানে কত সৈন্যের আমদানি হচ্ছে, একটা ভালো হোটেল খুললে এ সময়ে লাল হয়ে যাবে সে। বাড়ি তো আছেই চিরকালের, এই মওকায় কিছু টাকা সংগ্রহ করে নিতে দোষ কি?—সুযোগ জীবনে ক—বার আসে?—কিন্তু যাক সে সব কথা। সে আজ বাড়ি ফিরবেই।
একটা পুরু ইটালিয়ান কম্বল গায়ে জড়িয়ে সে নির্জন বনের পথ ধরে অন্ধকারে একা বাড়ির পথ ধরল।
কুয়াশা, শীত, হাওয়া আর এই আঁকাবাঁকা পথ। একটু দেরিই হল বাড়ি ফিরতে। কিন্তু বাড়ির সামনে এসে চমকে থেমে গেল প্রভাত। অনু হাসছে আর কথা বলছে যেন কার সঙ্গে। কী সুন্দর সে হাসি! এমন করে আবার যে অনু হাসতে জানে, না দেখলে প্রভাত বিশ্বাস করত না।
পোলাটা ভূপতির না? তারই কর্মচারী ছোকরা। অনুরই দেশের ছেলে। ভারি সুপুরুষ দেখতে। অনুরই অনুরোধে প্রভাত ওকে চাকরি দিয়েছে। তখন বোঝেনি, খাল কেটে সে কুমির এনেছে।
—আমি আর থাকব না ভূপতি, তুমি আমাকে বাঁচাও। ওরা আমাকে সারাদিন পাহারা দেয়। বাড়ি থেকে বাগানে পর্যন্ত নামতে দেয় না, সব গয়নাপত্র কেড়ে নিয়েছে। তুমি আমায় নিয়ে চল।
—আমি তো তখনই বলেছি। মানুষ জন্তুর সঙ্গে থাকতে পারে না।
—তুমি আমাকে বাঁচাও!
—চাবিটা নিয়ে গয়নাগুলো হাত কর। তারপর চল যাই চলে।
—চাবি নেব কী করে? ওর ট্যাঁকে থাকে যে।
—দেখ না, বুদ্ধি করে কীভাবে নেওয়া যায়।
আর সহ্য হল না প্রভাতের। সে ছুটে এসে দরজায় ধাক্কা দিল। —দরজা খোল অনু।
ওদিকে জানালা বন্ধের আওয়াজ এল। তারপর অনু দরজা খুলতেই সে বাঘের মতো অনুর ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
লুকিয়ে লুকিয়ে হাসি আর প্রেম। বের করছি সব। আমি জন্তু? বেশ, দেখাচ্ছি তোর মজা।
কুকুর বাঁধা শেকল দিয়ে খাটের পায়ার সঙ্গে বেঁধে প্রভাত অনুকে পিশাচের মতো চাবুক দিয়ে পিটল। অনু দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে রইল। ঘৃণায় লজ্জায় তার চিৎকার পর্যন্ত করতে ইচ্ছে করল না। শুধু ভয় হতে লাগল ওই শ্বাপদটার ভাঙা দাঁত আর কাটা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে লিকলিকে জিবটা বেরিয়ে কখন তাকে একেবারে শেষ করে ফেলবে। খানিকটা পরই অনু জ্ঞান হারিয়েছিল।
সামনের জানালার কাছে দপ দপ করে জ্বলছে ভূপতির দুটো চোখ। অন্ধরাগে যেন ফেটে পড়তে চাইছে সেই অগ্নিপিণ্ড দুটো।
এর পর কিছুদিন বেশ চুপচাপ কাটল। প্রভাত নিয়মিত কাজকর্ম করতে লাগল আর অনু আপনার মতো এতবড়ো বাড়ির কোন কোণে গৃহকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। তার খবর কেউই রাখবার প্রয়োজন বোধ করল না।
মাঝে মাঝে প্রভাতের কেমন আত্মজিজ্ঞাসা জাগত। তখন মনে হত তারও আজকাল এমন করে ভালোবাসা, স্নেহ, মায়ার জন্যে মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
শনিবারের হাট থেকে ফিরে প্রভাত মুখর কণ্ঠে ডাকল,—অনু, অনু, অনুপমা!
অনুর কানে সে ডাক যেতেই সে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
আবার ডাক এল—কী এনেছি, দেখ এসে।
বেরিয়ে যাবার সময় ট্যাঁকের চাবিটা ফেলে গিয়েছিল প্রভাত। এখন সেটা অনুর চোখে পড়েছে। দেবে কী দেবে না ভাবতে ভাবতেই আবার ডাক এল—অনু আমার সর্বনাশ হয়েছে, চাবি?—ছুটে পাগলের মতো সে ঘরে ঢুকল।
দ্রুত কতকগুলো চিন্তা বিদ্যুতের মতো খেলে গেল তার মাথায় আর মুহূর্তে পাকা অভিনেত্রীর মতো একগাল হেসে সে বললে—এই তো এখানে পড়ে। পাগলের মতো কোথায় খুঁজছ তুমি?
—দাও—দাও, বলে হাত বাড়িয়ে ছুটে এল প্রভাত—আলমারি—টালমারি আবার খোলনি তো?
—কী যে বল! এখুনি তো পেলাম এই তোমার ডাক শুনে আসতে গিয়ে।
—ঠিক তো? আগে পাওনি তো? বলেই সে চাবি নিয়ে ছুটে গেল, আলমারি খুলে দেখল। না, সব ঠিক আছে।
আর বাঁকা চোখের সকৌতুক দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল অনু। যেন একটা মজার খেলার দর্শক সে।
এবার ছুটে এসে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বললে—দেখ, তোমার জন্যে কী এনেছি। শাড়ি—সাবান—স্নো—পাথরের মালা। গলাটা খালি থাকে কিনা, ভালো দেখায় না। নাও—অনু। অমন করে চেয়ে আছ কেন?
নিথর হয়ে জমে যাওয়া হৃৎপিণ্ডটাকে অনু যেন নাড়া দিয়ে জাগাতে চাইল আর একবার! আর অভিনয় করা সম্ভব নয়। বরং নিষ্ঠুরতা ভালো। এ সোহাগ সহ্য হয় না আর। ফাঁকা দাঁতের ফাঁকের কাটা ঠোঁটের এই বিকট হাসি তার আরও অসহ্য। সে ধীরে ধীরে মৃতের মতো পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
পাশের বাড়ির ভূপতির জানালার দিকে খানিক তাকিয়ে কী যেন ভাবল প্রভাত, তারপর থেকে ক্যাশমেমোটা বের করে একবার দেখে নিয়ে সাবধানে জিনিসগুলো তুলে রাখল। আর এতগুলো টাকা বেঁচে গেল ভেবেই কী ‘একটা বাঁকা হাসির রেখা ঠোঁটের কোণে খেলে গেল না অন্য কিছু সে অনুভব করল?
রাতে অনুর ঘুম হল না। কেবল এপাশ—ওপাশ করতে লাগল। প্রভাত সশব্দে নাক ডাকছে। সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
ঘরটা যেন তিমির তীর্থ। শীতের দেশ—সব কেমন স্যাঁৎস্যাঁৎ করছে বলে মনে হয়। চারিদিকে ধুলোর গন্ধ—জিনিসপত্রের দম বন্ধ করা গুমোট ভাব যেন অসহ্য লাগছে তার। দিনের বেলায় এসব তো কিছুই মনে হয় না। কিন্তু রাতের অখণ্ড অবসরে এরা যেন একটা অখণ্ড রূপ নিয়ে সে সামনে দাঁড়ায়।
ভূপতি বলেছে পালাতে হবে। জানালার কাছে সে সংকেত করেছে। পথে দাঁড়িয়ে থাকবে। আর দেরি করা চলবে না। এখুনি পালাতে হবে। কিন্তু চাবিটা প্রভাতের ঘুনসিতে বাঁধা—হাতটা তার ওপর আছে। কিন্তু গহনা না নিয়ে সে কিছুতেই যেতে পারবে না—প্রাণ গেলেও নয়। এই গহনার জন্যে তার আজ এত কষ্ট!
কী করে চাবিটা নেওয়া যায়? অনু ধীরে ধীরে প্রভাতের পাশে এসে বসল। ধীরে ধীরে মাথায় কপালে হাত বুলোতে লাগল। আর ঘুমের ঘোরে দুর্বলতার মুহূর্তে প্রভাত অনুকে দু—হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। ধীরে ধীরে অনু চাবিটা কোমর থেকে খুলে নিল।
আলমারিটা খুলতেই হয়তো শব্দ হয়েছে। হঠাৎ প্রভাত চিৎকার করে উঠল—বাহাদুর—বাহাদুর, চোর—চোর। বলেই ছুটে গিয়ে ইলেকট্রিকের বোতামটা টিপে দিতেই আলো জ্বলে উঠল। আর প্রভাত বাঘের মতো লাফিয়ে গিয়ে অনুর ঘাড়ে পড়ল।
—চোর—শয়তান—
অনু সোজা হয়ে দাঁড়াল—নিজের জিনিস নেওয়া চুরি নয়। তা ছাড়া আমি কি এ বাড়ির কেউ নই? আলমারিতে হাত দেবারও আমার অধিকার নেই?
—না, নেই। তোমার কিছুতেই কোনো অধিকার নেই এ বাড়ির।
—নিশ্চয়ই আছে। আমার গয়না দিয়ে দাও। আমি চলে যাব।
—ভূপতির সঙ্গে? মুখ বিকৃত করে প্রভাত বলল।
—হ্যাঁ, ওর সঙ্গেই যাব। আমার ওকে ভালো লাগে।
—তবে রে! যাও, ওর কাছেই তোমাকে পাঠাচ্ছি। বলেই জানালা খুলেই সেই নিথর জঙ্গলের অতলান্তে অনুকে এক ধাক্কায় ফেলে দিয়ে জানালা বন্ধ করে দিল। পেছনের ঝরনার কলতানের সঙ্গে অনুর চিৎকার যেন মিশে রাতের আকাশকে বিদীর্ণ করে দিল। আর তখুনি কালো আকাশ চিরে বিদ্যুৎ চমকালো আর সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ি ঝড় আর আকাশ—ভাঙা বৃষ্টি নামল বিশ্রামহীন সংযমহীন ভাবে একটানা সাতদিন। নীচের মুখর ঝরনা আরও মুখর হল। বড়ো বড়ো পাথর টেনে আনতে লাগল—গাছপালা ভেঙে জলের স্রোত চলল তিস্তার দিকে ছুটে। পাথরের নীচে কোনো গুহার অন্ধকারে অনু চিরনিদ্রায় নিথর হয়ে রইল, কে তার খবর রাখে?
অনু চলে গেল চিরদিনের মতো, কিন্তু প্রভাতের দ্বিতীয় চেতনা যেন মনের কাছে একটানা প্রলাপ বকে চলল! প্রতি রাতে তারপর থেকে আর্ত চিৎকার শোনা যেত। রাত যেন বিভীষিকা। তার সব শান্তি—ঘুম যেন কেড়ে নিল অনু। রাতের পর রাত জেগে সে সেই বন্ধ জানালার কাছে বসে চিৎকার করে। ডাক্তারের পায়ে ধরে বলে—আমার সব নাও ডাক্তারবাবু, আমায় একরাত ঘুমোতে দাও।
কিন্তু অনু তার ঘুম কেড়ে নিয়ে গেছে। সারারাত মনে হয় কে যেন আসে। কে যেন তার ঘরে ঢুকছে। তার শাড়ির গন্ধ, চুড়ির শব্দ, পায়ের আলতো আওয়াজ আর রাতের অন্ধকারে উত্তপ্ত নিশ্বাসের স্পর্শ আর চাবির শব্দ প্রভাতকে পাগল করে তোলে।
অনু এসেছিল। নিশ্চয়ই এসেছিল। বন—প্রান্তর পাইনের সারির ওপর দিয়ে দূর—দূরান্তর সপ্তসিন্ধু পার হয়ে মৃত্যুর অন্ধকার থেকে। জীবন্তকে খুন করা যায় কিন্তু মৃতকে খুন করবে কেমন করে? প্রভাত চিৎকার বলে উঠল—চাবি, দাও অনু। নইলে খুন করব।