চাবি – আশাপূর্ণা দেবী
হাসপাতালের ঘরে একটা চাপা গুঞ্জন উঠল, বিস্ময়ের আর ধিক্কারের! ধিক্কারের সেই অস্ফুট তরঙ্গ যেন ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ছড়িয়ে পড়ল কৃষ্ণার সঙ্গের আত্মীয়বর্গদের থেকে ডাক্তার আর নার্স, পুলিশ আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের মধ্যে।
সব্বাই শক্ খেয়েছে। কেউ আশা করেনি এটা!
এই ভয়ঙ্কর মুহূর্তে কৃষ্ণার রসনা থেকে যে এই নির্লজ্জক নিরাবরণ প্রশ্নটা উচ্চারিত হবে, এটা আশা করার নয়।
ডাক্তার মুখার্জি সুদীর্ঘকালের অভিজ্ঞতায় পৃথিবীকে অনেক দেখেছেন, তবু কৃষ্ণার এই শ্রীহীন প্রশ্নটায় নতুন করে একটু বৈরাগ্যের হাসি হেসে ভাবলেন, ‘এই পৃথিবী’!
নার্স দু’জন মনে মনে মুচকে হেসে ভাবল হুঁ, এরাই সাধ্বী। এঁরাই স্বামীর মৃত্যুর পর বৈরাগ্যের খোলস এঁটে নির্লিপ্ত মুখে ঘুরে বেড়াবেন জগতে। যেন জগতের সব দেনা পাওনা চুকিয়ে ফেলেছেন।
কৃষ্ণার দাদা ভাবলেন, ‘ছি ছি ছি! কৃষ্ণা এই! অথচ দেখলে মনে হত—’
নীলাব্জর ছোট ভাই ভাবল, জানতাম—বৌদি এই রকমই! শুধু দেখলে মনে হত—’
কিন্তু কৃষ্ণা?
কথাটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে সে কি নিজেই বুঝতে পারল না, একটা অনুচ্চারিত ধিক্কারের তরঙ্গ বয়ে গেল ঘরখানা ভরে, বয়ে গেল ঘর থেকে বাইরে। ইথার-তরঙ্গে মিশে গিয়ে সেই ধিক্কার ছড়িয়ে পড়ল দিকে-দিগন্তরে। …ব্যাপ্ত করে ফেলল পৃথিবী, আচ্ছন্ন করে দিল আকাশ।
অথচ এক মুহূর্ত আগেও কি ভেবেছিল কৃষ্ণা, এই চরম দুঃসময়ে, এই ভয়ঙ্কর পরিবেশের মাঝখানে এই তুচ্ছ কথাটা ছাড়া জিজ্ঞেস করবার মতো আর কোনও কথা খুঁজে পাবে না সে।
কিন্তু আগে থেকে কী-ই বা বলা যায়?
দুপুরবেলা নিত্য নিয়মে লেটার বক্সটা খুলতে গিয়ে কৃষ্ণা যখন চাবির রিংটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, তখন কি ভেবেছিল এই তুচ্ছ বিস্ময়টাই তার জীবনে চরম বিস্ময় হয়ে থাকবে? ভেবেছিল কি এই সামান্য ব্যাপারটাই তার সমস্ত আকাশ আচ্ছন্ন করে দেবে?
রিঙের প্রত্যেকটি চাবি পাঁচ-সাতবার করে দেখেছিল কৃষ্ণা। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না বলে, একটি একটি করে গুনে দেখেছিল চাবিগুলো, তারপর নিঃসন্দেহ হয়েছিল।
নাঃ, লেটার বক্সের চাবিটা রিঙে নেই।
রিং থেকে ‘খোয়া’ গেছে সেটা! অথচ কী করে গেল!
কেউ খুলে না নিলে, নিজে নিজে খুলে পড়তে পারে না নিশ্চয়ই।
কিন্তু কে নেবে?
লেটার বক্স সম্বন্ধে কৌতূহলী হবে, এমন কে আছে এ-বাড়িতে?
চিরকালের চাকর নন্দলাল, আর চিরদিনের বামুন ঠাকুর হরিনন্দন, এদের কথা উঠতেই পারে না। নতুনের মধ্যে বাসন-মাজা ঝিটা। কিন্তু সদ্য দেহাত থেকে আবির্ভূতা, অষ্টাঙ্গে উল্কি আঁকা বুড়ি সুভদ্রাকে এ প্রসঙ্গে সন্দেহ করতে গিয়ে হেসে ওঠা ছাড়া আর কী করা চলে?
আর তো বাড়িতে থাকার মধ্যে আছে তিন বছরের ছেলে ‘খোকন বুড়ো’। এবং শেষ পর্যন্ত নীলাব্জ! তা তার প্রতি সন্দেহটাও হাসির ঘরে জমা দেওয়া ছাড়া তো আর কিছুই করা যায় না!
কী মনে করা যায়? বিশেষ কোনও প্রয়োজনে তাড়াতাড়ি নিয়ে গেছে? কৃষ্ণাকে বলার অবসর হয়নি, এমন কথা ভাবা যায় না! নীলাব্জর জীবনে এমন কি ‘প্রয়োজন’ আছে, যা কৃষ্ণার অজ্ঞাত?
তবু কৌতূহলের একটা সীমা থাকা উচিত। থাকা উচিত অসহিষ্ণুতার মাত্রা।
‘লেটার বক্সের চাবিটা কী হল’ এই কথাটুকু জিজ্ঞেস করতে কেউ ভরদুপুরে স্বামীর কর্মস্থলে ফোন করতে বসার ঝঞ্ঝাট পোহায়? গহনার বাক্সের কি লোহার সিন্দুকের চাবি হলেও বা কথা ছিল। এ চাবিটার জন্যে কৃষ্ণার কোনও কাজ আটকাচ্ছে এমনও নয়। জরুরি কোনও চিঠির প্রতীক্ষা করছে কৃষ্ণা— তা-ও নয়।
হয়তো বাক্সের ডালাটা খুললে দেখা যাবে, চিঠিই আসেনি একটাও।
তবু কৃষ্ণা সে-ঝঞ্ঝাট পোহাল।
অফিস ঠিক নয় নীলাব্জর, দোকান। বিরাট এক স্টেশনারি শপ। নীলাব্জর বাপের আমলের ব্যবসা। কাজে-অকাজে, কারণে-অকারণে দোকানে ফোন যে করে না কৃষ্ণা তা নয়, তবু আজকের মতো কারণে এত ব্যস্ত হয় না। কণ্ঠস্বর শুনে দোকানের চাকর সাধন বরং একটু আশ্চর্যই হল। দ্রুত কম্পিত কণ্ঠে বলে,—“হ্যালো হ্যালো, কে—সাধন?… ও হ্যাঁ আমি কথা বলছি। বাবুকে একবার ধরতে বলো তো। …বাবু দোকানে নেই? যাননি আজকে? …কী বললে? একবারটি গিয়েই তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন? …কখন ফিরবেন কিছু বলে গেছেন?…বলে যাননি? …আচ্ছা সাধন, বিশেষ কোনও কাজে পড়ে কোথাও গেছেন কি না জানো কিছু? …জানো না? …আচ্ছা, ফিরলে একবার বাড়িতে ডাকতে বলো।’
তবু সে-ডাকের অপেক্ষা করে ধৈর্য ধরে বসে থাকেনি কৃষ্ণা। কে জানে কোন দুরন্ত খেয়ালের বশে ডাকাডাকি করে জাগিয়ে তুলল ঘুমন্ত দুটো লোককে দিবানিদ্রার সুখশয্যা থেকে।
“চিঠির বাক্সর চাবি কোথায় জানিস নন্দ?”
নিদ্রাতুর নন্দ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে, “চিঠির বাক্স? কোন চিঠির বাক্স? কার চাবি?”
“ভূতের মতো কথা বলছিস কেন? লেটার বক্সে চাবি দেওয়া থাকে, জানিস না তুই?”
“জানি তো।”
“সে-চাবিটা কই?”
“সে-চাবি—সে-চাবি, আপনার কাপড়ের কোণে!” বলেই ফের ধপাস করে শুয়ে পড়ে নন্দ।
“ঘুমই হচ্ছে মুখপোড়ার যম! এত ঘুমোতেও পারে—”বলে নন্দলালের প্রতি বিরক্তচিত্ত কৃষ্ণা হরিনন্দনকে ডাকে চেঁচিয়ে, “ঠাকুর ঠাকুর! …বলি দিনের বেলা তোমাদের এত ঘুম কীসের বাপু? একটা কাজে পাবার জো নেই!”
হরিনন্দন উঠে পড়ে নম্রভাবে দাঁড়ায়। অতএব কৃষ্ণাকেও একটু নম্র হতে হয়। নরমভাবে বলে, “আচ্ছা ঠাকুর, চিঠির বাক্সর চাবিটা কোথায় জানো?”
“না বউমা।”
“কোন চাবির কথা বলছি বুঝতে পারছ তো? আমারই এই রিঙে থাকে, হঠাৎ দেখতে পাচ্ছি না বাপু।”
লোহার সিন্দুকের চাবি নয় যে, পুরনো লোক মনিবানির এ প্রশ্নে অপমানিত বা আহত হবে, তাই ভেবে-চিন্তে বলে, “খোকাবাবু ফেলে দিয়েছে সম্ভব।”
“দূর! খোকাবাবু খুলবে কী করে!”
বলে চলে যায় কৃষ্ণা। পুরোপুরি রিংটাই যদি নিরুদ্দেশ হত, তাহলে খোকাকেই আসামি করা হত সন্দেহ নেই, কিন্তু এতে হয় না।
দোতলায় উঠে গিয়ে আর একবার রিসিভারটা হাতে তুলে নিল কৃষ্ণা, তুলে নিয়েই কী ভেবে কে জানে রেখে দিল। …থাক গে! আর হইচই করে কাজ নেই, আসুক নীলাব্জ।
কিন্তু কিছুতেই কেন স্বস্তি আসে না!
ছোট্ট পাতলা একটা পিতলের চাবির চিন্তা কৃষ্ণার দিবানিদ্রার সুখ হরণ করে নিল কেন! শুয়ে পড়েছিল, আবার ধড়মড় করে উঠে পড়ল। …তাই তো, এটা তো এতক্ষণ মনে পড়েনি। যাক, মনে যখন পড়েছে তখন চেষ্টায় ক্ষতি কী!
অতএব বাড়িতে যেখানে যত চাবি ছিল সবগুলো নিয়ে নীচে নেমে যায় কৃষ্ণা। দেখে প্রত্যেকটি ঢুকিয়ে। কিন্তু নাঃ, ছোট্ট পাতলা একটি পিতলের চাবির অভাব কেউ পূরণ করতে পারে না।
গোটা কয়েক স্ক্রু খুলে ফেললেই খুলে ফেলা যায় বাক্সের ডালাটা, নন্দকে বললে নন্দই পারে খুলে দিতে। কিন্তু বলবে কোন মুখে?
অকারণে একদিন একটু চঞ্চল হয়ে উঠেছে বলেই তো সত্যি পাগল হয়ে যায়নি কৃষ্ণা! নন্দকে যা-তা বলে বোঝানো যেতে পারে। কিন্তু নীলাব্জকে?
ও যখন বাড়ি এসে কৃষ্ণার এই অসহিষ্ণুতার পরিচয় পেয়ে অবাক হয়ে যাবে, বিস্মিত প্রশ্নে বলবে, সে কী, ঘণ্টা চার-পাঁচ সবুর সইল না তোমার? তখন কী উত্তর। দেবে কৃষ্ণা?
আর কিছু করার নেই।
মনকে বোঝাতে চেষ্টা করে কৃষ্ণা। হয়তো দোকানের কোনও ড্রয়ার কি বাক্সর চাবিটাবি হারিয়ে গেছে, হয়তো ছোট্ট পাতলা পিতলের এই চাবিটা তাতে লাগতে পারে এই আশায় ওটা খুলে নিয়ে গেছে নীলাব্জ। হয়তো তাড়াতাড়িতে আর বলে যাবার সময় পায়নি। হয়তো এই ভেবেছে, এক বেলা ‘লেটারবক্সটা’ খুলতে না পারলেই বা কী এমন রাজ্য রসাতলে যাবে?
তবু কিছুতেই কেন কে জানে স্বস্তি আসে না। কেবলই যেন মনটা হারিয়ে যায়।
দিনটাও কি তেমনি!
মেঘলা-মেঘলা, ছায়া-ছায়া….। হাওয়া বইছে। প্রায় শীত করে-করে, এমনি শিরশিরে উদাস-উদাস!
এমন দিনে যেন মনটা আকারণে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে; ইচ্ছে করে বাড়ি ছেড়ে কোথাও বেরিয়ে পড়তে, ইচ্ছে করে জানালার মধ্যে থেকে আকাশের টুকরোটুকুর দিকে তাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অলসভাবে শুয়ে শুয়ে মনগড়া দুঃখের কথা ভাবতে।
যে-দুঃখ জীবনে নেই, যে-দুঃখ জীবনে আসবার কোনও সম্ভাবনা নেই, তেমনি এক দুঃখের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে কৃষ্ণা, আজকের মেঘ-ভারাক্রান্ত আকাশের মতোই।
এমনও তো হতে পারে কৃষ্ণাকে হঠাৎ সন্দেহ করতে শুরু করেছে নীলাব্জ। তাই হয়তো লেটার বক্সের চাবি নিজের হাতের মুঠোয় রাখতে চায় সে। দেখতে চায় কখন কোথা থেকে কী চিঠি আসে। …না একল্পনায় বিরক্তি আছে, বিলাস নেই। সত্যকার দুঃখ না থাকলেই বোধ করি, দৈবাৎ এমনি এক মেঘমেদুর দিনে দুঃখের বিলাসে সাধ যায়। …সেই সাধেই ভাবতে বসে কৃষ্ণা, চিরদিন নীলাব্জ ফাঁকি দিয়ে এসেছে তাকে। ভালবাসার ভান করে অপমান করে এসেছে চিরদিন। নীলাব্জর মর্মে যার আসন পাতা, সে কৃষ্ণা নয়, আর কেউ।…
ভাবতে থাকে, হয়তো দীর্ঘকালের ব্যবধানে এতদিনে আবার হঠাৎ কোথাও নীলাব্জর দেখা হয়ে গিয়েছে তার সঙ্গে, হয়তো সে দিয়েছে চিঠি দেবার প্রতিশ্রুতি। তাই নীলাব্জর এই সতর্কতা।
হয়তো দু’জনে হাসাহাসি করেছে কৃষ্ণাকে নিয়ে। বলাবলি করেছে, কৃষ্ণা কী নির্বোধ। …কাঁচে আর কাঞ্চনে প্রভেদ বুঝতে পারে না সে। সমাদর আর সদ্ব্যবহার, এই পেয়েই সে ধন্য। কে জানে, হয়তো দোকান পালিয়ে তার সঙ্গেই দেখা-সাক্ষাৎ করতে গেছে নীলাব্জ। হয়তো এমন প্রায়ই যায়, নিঃশঙ্ক কৃষ্ণা জানতেই পারে না। কোথায় সে জায়গা? কোনখানে? শহরের মধ্যে? শহরতলিতে? শহর ছাড়িয়ে অনেক দূরে? কৃষ্ণা তত দূরে পৌঁছতে পারে না?
কিন্তু পৌঁছেই বা কী করবে কৃষ্ণা? নিজের চক্ষে নিজের পরাজয়ের দৃশ্য দেখতে যাবে, নির্বোধ বলে কি এমনই নির্বোধ সে!
নীলাব্জ এমন!
নীলাব্জ এত মিথ্যাবাদী! এই নীলাব্জকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে কৃষ্ণা! উঃ এই দণ্ডে যদি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তে পারত কৃষ্ণা, নিজে গাড়ি চালিয়ে হানা দিয়ে বেড়াত এখানে-সেখানে, শহরে আর শহরতলির আশেপাশে, হাতে হাতে ধরতে পারত নীলাব্জকে!
তীব্র তিরস্কারে বলতে পারত তাকে, ‘তুমি না একটি বিশ্বস্তহৃদয় স্ত্রীর স্বামী, তুমি সন্তানের পিতা!
কিছুই হয় না, কিছুই হবে না, শুধু হঠাৎ এক সময় সংবিৎ ফিরে পেয়ে দেখতে পায় কৃষ্ণা, চোখের জল ঝরে ঝরে বালিশ ভিজে গেছে তার।
কী কাণ্ড, এ কী!
যে-দুঃখ নেই সে-দুঃখকে মনে গড়ে অহেতুক এতটা চোখের জল খরচ করেছে কৃষ্ণা!
চোখ মুছে হাসবার চেষ্টা করে উঠে বসে, কিন্তু চোখকে মুছে মুছে কিছুতেই শুকিয়ে তুলতে পারে না। ব্যাধিগ্রস্ত চোখের মতো শুধু জল পড়তেই থাকে অবিরত।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল, আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যায় পর্যবসিত হয়। কৃষ্ণা ওঠেনি, চুল বাঁধেনি, কাপড় ছাড়েনি।
ইচ্ছে করেই করেনি এসব।
আজ সে অভিমানিনীর রূপ নিয়ে বিপর্যস্ত করে দেবে নীলাব্জকে। স্বীকারোক্তি করিয়ে নেবে নীলাব্জকে দিয়ে, তার বিগত জীবনের দুর্বলতার।
অনেক ভেঙেছে, অনেক গড়েছে, অনেক প্রশ্ন ভেজেছে।
কিন্তু আজকেই কি নীলাব্জর যত দেরি?
হবে বইকী। বাল্যবান্ধবী ছাড়েননি বোধ হয় এখনও!
“বউমা!” বামুন ঠাকুর এসে ডাক দেয়, “কী রান্না হবে বলে দিলেন না, তরকারি কোটা হল না, উনুন জ্বলে যাচ্ছে।”
“আমি জানি না। যা পারো করোগে না ঠাকুর। একদিন নিজে বুদ্ধি করে চালিয়ে নিতে পার না?”
হরিনন্দন নিঃশব্দে সরে যায়। চালিয়ে নিতে পারে না সে? কৃষ্ণার আসার আগে পর্যন্ত চালিয়েছে কে? মা-মরা ছেলেকে চালিয়ে নিয়ে বিয়ের যুগ্যি করে তুলেছিল কে?
হরিনন্দনের কোনও দান নেই?
ও নিঃশব্দে চলে যেতেই কৃষ্ণা একটু অপ্রতিভ হয়ে পড়ে। ‘না বললেই হত এমন করে। যাই দেখে আসি।’ উঠি উঠি করতে করতে আর কতক্ষণ গেছে কে জানে, হঠাৎ চমক ভাঙল নন্দলালের ডাকে। “বৌমা, বৈঠকখানা-ঘরে মামাবাবু আর কাকাবাবু এসে বসে আছেন। চা দিলাম, ফেরত দিলেন!”
মামাবাবু আর কাকাবাবু! একসঙ্গে! এ আবার কী মণিকাঞ্চনযোগ!
ধড়মড় করে উঠে বসে কৃষ্ণা। “এসেছেন তো ডাকিসনি কেন আমাকে?”
“বলেছিলাম, বারণ করলেন!”
“বারণ করলেন। সে আবার কী? কতক্ষণ এসেছেন?”
“এই একটুক্ষণ!”
“দেখি যাই! করছেন কী দু’জনে?”
“কী জানি বউমা, কী যে গুজগাজ করছে দু’জনে! আমাদের বাবুই বা এখনও এল না কেন?”
দ্রুত ভাষণে কৃষ্ণা প্রশ্ন করেছিল, “কী গো ঠাকুরপো, কতক্ষণ? …দাদা, আমায় ডাকোনি যে?”
কিন্তু কৃষ্ণার দাদা উত্তর দিয়েছে শান্ত আর মৃদু।
“হ্যাঁ, এইবার ভাবছিলাম ডাকা যাক। যেতে হবে এক জায়গায়।”
“যেতে হবে? কাকে দাদা, আমাকে?”
“হ্যাঁ— একবার মেডিকেল কলেজে যাওয়ার দরকার! নীলাব্জ গাড়ি নিয়ে সোনারপুর না ওই দিকে কোথায় গিয়েছিল, হঠাৎ একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়ে—ইয়ে মেডিকেল কলেজে এনে তুলেছে। …চলো আমার সঙ্গে।”
নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন দাদা।
কৃষ্ণা শুধু অনেক কষ্টে উচ্চারণ করল, “সোনারপুর!”
“হ্যাঁ, তাই তো বললে! পকেটে কাগজপত্র ছিল, তাতেই ঠিকানা পেয়ে স্থানীয় লোকেরা দোকানে খবর দেয়, দোকানের লোক ট্যাক্সি নিয়ে গিয়ে—”
তারপর থেকে আর একটিও কথা কয়নি কৃষ্ণা। নিঃশব্দে ওদের সঙ্গে গাড়িতে গিয়ে উঠেছে। গাড়ি থেকে নেমে অনেকখানি দালান আর অনেকগুলো সিঁড়ি পার হয়ে চলে এসেছে ওদের পিছন পিছন তেমনি নিঃশব্দে।
ঘরের দরজায় ঢুকবার মুখে নীলাব্জর ভাই একবার থমকে দাঁড়াল, ইস্পাতের মতো মাজা, ঠাণ্ডা স্বরে বলল, “একটু শক্ত হবেন বৌদি। অধৈর্য হয়ে লাভ নেই।”
লাভ! ও কি তাহলে বুঝতে পেরেছে সারা রাস্তা কৃষ্ণা শুধু লাভ-লোকসানেরই হিসাব কষতে কষতে এসেছে?
শূন্য দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে একবার চেয়ে দেখলে কৃষ্ণা। কৃষ্ণার দাদা ওর পিঠের উপর আস্তে একটু হাত রাখলেন। থাক এইটুকু স্নেহস্পৰ্শ, বেদনাবিধুর সহানুভূতিতে কোমল। আবার এ একপ্রকার প্রস্তুতিও বটে। হাহাকার করে যদি আছড়ে পড়তে চায় কৃষ্ণা স্বামীর মৃতদেহের উপর, তখন আগলে রাখতে হবে এই হাত দিয়ে, স্বামীর আশ্রয়হারা নারীকে বাল্যের আশ্রয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার আশ্বাস থাকে যে-হাতের স্পর্শে।
কিন্তু কৃষ্ণা কি সে-প্রস্তুতিকে কাজে লাগতে দিয়েছিল? আছড়ে পড়েছিল স্বামীর বুকের উপর? বুকফাটা বিলাপে বিদীর্ণ করতে চেয়েছিল মৃত্যুর স্তব্ধতাকে?
কই, কিছুই তো করেনি সে।
শুধু ঘরে ঢুকেই চাদরটাকা মূর্তিটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ডাক্তারবাবুর দিকে তাকিয়ে একটা প্রশ্ন করেছিল। অপ্রত্যাশিত আর নিরাবরণ প্রশ্ন।
যে-প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়ের আর ধিক্কারের একটা চাপা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ঘরে, ঘর থেকে বাইরে।
প্রশ্নের সুরের মধ্যে ব্যগ্রতাটুকুও ঢাকতে পারেনি কৃষ্ণা। বিনা ভূমিকায় বলে বসেছিল, “ওকে যখন প্রথম পেয়েছিলেন, ওর পকেটে একটা চাবি দেখেছিলেন? ছোট্ট পাতলা পিতলের চাবি একটা?”
০১.০৫.১৯৫৫
লেখক পরিচিতি
আশাপূর্ণা দেবী : ৮ জানুয়ারি ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জন্ম। স্কুল-কলেজে পড়েননি। তেরো বছর বয়সে শিশুসাথী পত্রিকায় সাহিত্যজীবন শুরু। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রথম বড়দের জন্য লেখা গল্প। ১৯৬৬ সালে ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ উপন্যাসের জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার। ১৯৭৮-এ জ্ঞানপীঠ, ১৯৮৯-এ দেশিকোত্তম। মৃত্যু: ১৩ জুলাই ১৯৯৫।