1 of 2

চাপড়া ষষ্ঠীর কথা

চাপড়া ষষ্ঠীর কথা

এক দেশে এক বেনে সওদাগর ছিলেন। তাঁর তিন ছেলে ও তিন বউ। সকলেরই ছেলেপুলে হয়েছে। কর্তা ছোটো বউয়ের ছেলেদের বড়োই ভালোবাসেন। একদিন গিন্নি কর্তাকে বললেন, ‘দেখো, আমরা ছেলেপুলে নিয়ে লোকের পুকুরে ষষ্ঠী পুজো করতে যাই, সকলেই বিরক্ত হয়, কত কথা বলে। তা আমাদের একটি পুকুর কাটিয়ে দাও। আমরা সেখানে ছেলেপুলে নিয়ে ষষ্ঠী পুজো করব।’ কর্তা বললেন, ‘এই কথা বই তো নয়, তা আমি করে দেব।’ তখন কর্তা কোড়া ডাকিয়ে পুকুর কাটাতে আরম্ভ করলেন। পুকুর কাটানো হল, কিন্তু পুকুরে জল উঠল না। আষাঢ়, শ্রাবণ মাসে বর্ষা গেল, তবুও জল হল না। সবাই কানাকানি করে, নিন্দা করে, বলে—‘কী পাপিষ্ঠ গো, এত বড়ো দিঘির মতো পুকুরটা কাটালে, এক ফোঁটাও জল উঠল না।’ বেনে সওদাগর বড়োই দুঃখিত হলেন। গিন্নি সর্বদাই ভগবানকে ডাকেন, কেমন করে পুকুরে জল হবে।

একদিন গিন্নি কর্তাকে বললেন, ‘আজ বাদে কাল ষষ্ঠী পুজো, আবার ছেলেপুলে নিয়ে পরের পুকুরে যেতে হবে। কত কথা শুনতে হবে। এমনও বরাত, যে পুকুরে জল উঠল না!’ কথা শুনে কর্তার মনটা বড়োই খারাপ হল, তিনি চুপ করে কাঁদতে লাগলেন। সেই দিন রাত্রে মা ষষ্ঠী সওদাগরের মন ছলবার জন্যে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন, ‘তুমি ছোটো বউয়ের ছেলেদের বড়ো ভালোবাসো, তার একটি ছেলেকে কেটে যদি পুকুরে রক্ত ছড়িয়ে দিতে পারো, তবে পুকুরে জল হবে, নচেৎ পুকুরে আর জল হবে না।’ কর্তা এই স্বপ্ন দেখে ভয়ে অস্থির। সকালে বিছানা থেকে উঠে তিনি খালি ভাবতে লাগলেন কী হবে, কী রকম করে ছেলেকে কাটব, একথা ভাবলেও যে বুক ফেটে যায়। আবার ভাবলেন, মা ষষ্ঠী যখন স্বপ্নে দেখা দিয়েছেন, তখন স্বপ্ন কখনো মিথ্যা হবে না। যা অদৃষ্টে আছে তাই হবে। কী অশুভক্ষণেই পুকুর কাটিয়েছিলুম। আহা, ছোটো বউকে কী বলে বোঝাবো। এই সমস্ত ভাবছেন আর কাঁদছেন, এমন সময় সেইখানে গিন্নি এলেন। কর্তাকে কাঁদতে দেখে গিন্নি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হয়েছে? শুধু শুধু কাঁদছ কেন?’ সওদাগর কী আর মাথামুন্ডু বলবেন তা আর খুঁজে পান না, খালি কাঁদেন। তখন গিন্নির অনেক অনুরোধে স্বপ্নের সমস্ত কথা বললেন। গিন্নি শুনে কেঁদে-কেটে মাথা খুঁড়ে অস্থির হলেন। কর্তা বললেন, ‘আর গোল করো না, আমি চুপি চুপি কাজ সেরে আসি। যখন মা ষষ্ঠীর হুকুম হয়েছে তখন আর ভেবে কী করব? তাঁর দয়া হলে ঢের ছেলে হবে।’ এই বলে তিনি কাঁদতে কাঁদতে উঠে চলে গেলেন।

তারপর সওদাগর ছোটো বউয়ের ছোটো ছেলেকে ভুলিয়ে পুকুরধারে নিয়ে গেলেন। সেখানে তিনি ছেলেকে কেটে পুকুরে যেই ফেলে দিয়েছেন, আর অমনি কুল কুল করে কানায় কানায় এক পুকুর জল হল। জল দেখে কর্তার ভারি আহ্লাদ হল। তিনি মা ষষ্ঠীকে প্রণাম করে বাড়িতে গিয়ে বললেন, ‘মা ষষ্ঠীর দয়ায়, আজ এক পুকুর জল হয়েছে। অমনি সব বউয়েরা, ছেলেমেয়েরা সকলে জল দেখতে এল। জল দেখে সকলে ভারি খুশি। গিন্নি কিন্তু চোখের জল চোখে মেরে ঘাটে এসে পুকুর প্রতিষ্ঠা করলেন। তারপর সকলে মিলে ঘাটে বসে মা ষষ্ঠীর পুজো করতে লাগলেন। সকলেই পিটুলির চাপড়া ও পুতুল ভাসালে। ছোটো বউ কিছুই জানে না, যে তার এমন সর্বনাশ হয়েছে। পূজা সেরে যেমনি ছোটো বউ পুতুল ও চাপড়া ভাসাবে, অমনি সেই সময় তার সেই ছোটো ছেলেটি আঁচল ধরে জল থেকে উঠে এল। সকলেই দেখে অবাক হয়ে গেল। ছোটো বউ ছেলের গায়ের জল মুছিয়ে মুখে চুমু খেয়ে জিজ্ঞাসা করলে, ‘তুই কোথায় ছিলি বাবা, জলে কেমন করে এলি?’ ছেলে ভয়ে কোনো কথা বললে না। গিন্নি ছেলে দেখে আহ্লাদে কেঁদে উঠে দৌড়ে কর্তাকে খবর দিতে গেলেন। কর্তা ছেলের কথা শুনে আহ্লাদে হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে ঘাটে এলেন। তিনি ছেলেকে বুকে করে নিয়ে চুমু খেয়ে মা ষষ্ঠীকে ধন্যবাদ দিতে দিতে চোখের জল ফেলতে লাগলেন। এই সব দেখে বউয়েরা অবাক। তখন গিন্নি সমস্ত ঘটনা বউদের কাছে বলতে লাগলেন। ছোটো বউ শুনেই মূর্ছা গেল। তারপর তার চোখে-মুখে জল দিতে মা ষষ্ঠীর কৃপায় জ্ঞান হল। তখন তিন জায়ে ছেলেদের কোলে করে আঁচলে কলা বেঁধে, মা ষষ্ঠীর কথা শুনতে লাগলেন। গিন্নিই কথা বলতে লাগলেন। মা ষষ্ঠীর উপর সকলকার খুব ভক্তি বাড়ল। কর্তা মা ষষ্ঠীর এরকম দয়া দেখে দেশে দেশে তাঁর মাহাত্ম্য প্রচার করলেন। তিনি দুঃখী কাঙালদের খুব খাওয়ালেন, অনেক টাকাকড়ি দিলেন। চারিদিকে ধন্যি ধন্যি পড়ে গেল। মা ষষ্ঠীর মাহাত্ম্য দেখে প্রত্যেক বাড়িতে তাঁর পূজা হতে লাগল। সেই অবধি পৃথিবীতে চাপড়া ষষ্ঠীর পূজা প্রচার হল। একে মন্থন ষষ্ঠীও বলে।

চাপড়া বা মন্থন ষষ্ঠীর কথা সমাপ্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *