চান্স

চান্স

ওই তো ভোম্বলদা।

ওই যে, দোকানের বেঞ্চে বসে মন দিয়ে কচুরি খাচ্ছে। আরে বাবা, ওই তো ফ্যাকাশে হয়ে আসা নীল জামা, কালো ফুলপ্যান্ট পরা লোকটা। রোগা, ছোট ছোট চুল। পায়ে কেড্স। কাঁধে কিটব্যাগ। ব্যাগের ওদিকটায় একটা তাপ্পি আছে। বড় নয়, ছোট তাপ্পি।

খাওয়া শেষ করে প্রায় হাফ ছুটে, অলিগলি দিয়ে বড় রাস্তায় এসে পৌঁছোবে ডোম্বলদা। তারপর সামনে ট্রাম, বাস যা মিলবে উঠে পড়বে লাফ মেরে। এবার সোজা মাঠ। তবে কোন মাঠ ঠিক নেই। এক-একদিন এক-একটায়। কোনওদিন ময়দান, কোনওদিন দেশবন্ধু পার্ক, কোনওদিন রবীন্দ্র সরোবর। যে-মাঠে যে-দিন ম্যাচ থাকে।

বেশিরভাগ দিনই মাঠে পৌঁছে ভোম্বলদা দেখে, তখনও কেউ আসেনি। খুবই বিরক্ত হয়। এ আবার কেমন কথা? আরে বাবা, একটু আগে এলে ক্ষতি কী? ম্যাচ তো আর চাট্টিখানি জিনিস নয় যে এলাম, নামলাম আর খেললাম। আরে, যেখানে এতটা সময় থাকব, ছুটব, পড়ব, দাঁড়াব তার কোনও ব্যাপার নেই? মাঠের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে হয়, মেশাতে হয়। ঘাস-মাটির সঙ্গে রোজ নতুন নতুন করে চেনা-জানার দরকার আছে। দূর দূর, ছেলেপিলেরা আজকাল আর এত ভাবনাচিন্তা করে না। ম্যাচ শুরুর দশ-পনেরো মিনিট আগে আসে হেলতে দুলতে।

এইসব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে নিজের কিটব্যাগ খুলে পোশাক বের করে ফেলে ভোম্বলদা। জার্সি, প্যান্ট, বুটজুতো। দ্রুত তৈরি হয়ে নেয়। তারপর সকালবেলার হালকা রোদ গায়ে লাগিয়ে দৌড়োত শুরু করে মাঠ ঘিরে। কখনও দাঁড়িয়ে, কখনও বসে, কখনও আবার চিত হয়ে শুয়ে পড়ে হাত-পা ছুড়ে ব্যায়াম সারে। নিজের মনেই বলে, আঃ শরীরটা একেবারে ফুরফুরে হয়ে গেল। আজ একটা চান্স পেলে দেখিয়ে দিতে পারি।

তখনও সবুজ ঘাসের ফাঁকফোকরে চোরাগোপ্তা শিশির লুকিয়ে থাকে। সেই শিশির ভোম্বলদার পুরনো ছেঁড়া কেড্স, রংচটা জার্সিতে মাখামাখি হয়ে যায়।

বিকেলেও একই ব্যাপার। ম্যাচ শুরুর অনেক আগেই ভোম্বলদা মাঠে হাজির। মাথার ওপর দুপুরের কনকনে রোদ। মাটি তো গরমই, এমনকী ঘাস পর্যন্ত তেতে আছে। এদিক-সেদিক গাছের ছায়ায় তখনও কেউ কেউ দুপুরের ঘুম শেষ করেনি। ভোম্বলদার কিছু যায় আসে না। ওই রোদ্দুরেই লাফিয়ে, ঝাঁপিয়ে নিজেকে ম্যাচের জন্য তৈরি করে। দূর থেকে কেউ দেখলে ভাববে, ওরে বাবা, পাগল নাকি?

আমাদের ক্লাবের ছেলেরা মাঠে এক এক করে আসে। বিশু, কাজল, অবিনাশ, পটল, কানাই, পিন্টু। ভোম্বলদাকে দেখে মুখ টিপে হাসে। বলে, কী গো, কটা পাক হল ভোম্বলদা? ভোম্বলদা একগাল হাসে। দূর থেকে হাত নাড়ে। বুক ভরে দম নেয়। চিৎকার করে বলে, আজ বেশি হয়নি। দাঁড়িয়ে জগিং করছি। অবিনাশ হাসি চেপে অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলে, সে কী! বেশি না-ছুটলে হবে কী করে? ফুটবল কি আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লাফানোর খেলা? ছোটো ছোটো। জোরে জোরে ছুট দাও।

পটল মোজা পরতে পরতে ফিসফিস করে বলে, অ্যাই অবিনাশ, ওরকম করে বলছিস কেন? বেচারি। ভোম্বলদা পটলের কথা শুনতে পায় না। সে হাসতে হাসতেই বলে, ছুটব রে বাবা, ছুটব দাঁড়া, আগে গা-টা একটু গরম করে নিই। বিশু জার্সি হাতে নিয়ে বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ, ভাল করে গা গরম করে নাও। আজকের ম্যাচ কিন্তু হেভি গরম ম্যাচ। কাজল মুখ নামিয়ে বলল, ইস, খারাপ লাগে। রোজ রোজ এরকম করে…। অবিনাশ চাপা গলায় বলল, খারাপ লাগবার কী আছে? সবাই টিমে চান্স পায় নাকি? ভোম্বলদাও সে রকম একজন। চান্স পায় না। বিশু বলল, চান্স পায় না ঠিকই, কিন্তু তবু কেউ এভাবে আশায় আশায় থাকে? নইলে এভাবে প্রতিদিন মাঠে এসে ঝাঁপাঝাঁপি করত? একটা ম্যাচেও তো সুযোগ পায় না। অবিনাশ বলটাকে পায়ে নাচাতে নাচাতে বলল, আসে কেন? কে আসতে বলেছে? নিজেই তো দেখতে পাচ্ছে, চান্স হচ্ছে না। আমরা তো বলিনি। ক্লাবের কেউই বলে না। কানাই লাফ মেরে উঠে দাঁড়াল। বলল, অপেক্ষায় থাকে। যদি কোনওদিন চান্স হয়ে যায়। আর কবে হবে? বয়স তো বাড়তে লাগল। মনে হয় না, কোনওদিন হবে। একটা বোকা। পটল বলল, শুধু বোকা নয়। বিরাট বোকা। শুধু বোকা হলে কয়েক বছর পরেই হাল ছেড়ে দিত। বিরাট বোকা বলেই এতদিন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অবিনাশ মুচকি হেসে বলল, শুধু চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে না, লোকও হাসাচ্ছে। চল, এবার মাঠে নেমে পড়। অ্যাই মানিক, বলটা এদিকে দে। দেখবি, ভোম্বলদার দম শিগগিরই ফুরিয়ে যাবে। মনে হয়, সে-দিনের আর খুব বেশি দেরিও নেই। মানিক বলে একটা লাথি মেরে বলল, অবিনাশ, একবার ধীরেনদাকে বলে দেখ না। একটা ম্যাচে যদি ওকে নেওয়া যায়। বড় কোনও ম্যাচ বলছি না। ছোটখাটো টুর্নামেন্টও তো হচ্ছে। অন্তত একটা হাফ যদি লোকটা খেলতে পারে। ধীরেনদা ইচ্ছে করলে পারবে। কোচই তো সব। অবিনাশ মানিকের মারা বলটাকে বুক দিয়ে রিসিভ করল। নামিয়ে নিল পায়ে। তারপর সেটাকে নাচাতে নাচাতে বলল, খোপেছিস নাকি? আমাদের মতো ক্লাব সেই রিস্ক নিতে পারে? মনে রাখবি মানিক, খেলাটা কোনও এক্সপেরিমেন্টের জায়গা নয়। সবকিছু নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারিস, খেলা নিয়ে পারিস না। মাথা থেকে ওসব দূর কর। ভোম্বলদার পক্ষে এটাই বেস্ট। ম্যাচের আগে গা গরম করে সাইড লাইনে বসে থাকুক। আরে বাবা, সাইডলাইনেও কিছু খেলোয়াড় দরকার হয়। সাইডলাইন প্লেয়ার। হি হি। কানাই গম্ভীর মুখে বলল, তা ছাড়া ধীরেনদা যা কড়া। মানস ফিসফিস করে বলল, কড়া না কচু। কড়া হলে তমাল তিনটে ম্যাচে খেলে গেল কী করে? কানাই এদিক-ওদিক চেয়ে বলল, অ্যাই চুপ কর। খেয়াল রাখবি, তমাল আমাদের ক্লাব প্রেসিডেন্টের ভাইপো। বিল্টু জোড়া পায়ে লাফাচ্ছিল। লাফ থামিয়ে বলল, প্রেসিডেন্টের ভাইপো তো কী হয়েছে? তিনটে খেলাতেই আমরা ওর জন্য হেরেছি। পটল বল নিয়ে হেড দিতে দিতে বলল, হেরেছি তো কী হয়েছে? তিনটে খেলায় হেরেছি বলে প্রেসিডেন্টবাবু ক্লাবকে তিন হাজার টাকা চাঁদা দিয়েছিলেন। বিশু বলল, ইস, তা হলে ছ’টা খেলাতেই হারা উচিত ছিল। ছ’হাজার টাকা পেতাম। অবিনাশ এবার ধমক লাগাল, অ্যাই চুপ কর, ধীরেনদা এসে গেছে।

ম্যাচে চান্স না-পেলেও, প্র্যাকটিসে কিন্তু ভোম্বলদা একেবারে একশোয় একশো। কোনও ফাঁকি নেই। ম্যাচ শুরুর আগে যে পনেরো-কুড়ি মিনিট সময় পাওয়া যায়, সেই সময়টায় একেবারে মাঠ দাপিয়ে বেড়ায়। সকাল-বিকেল দু’বেলাতেই। লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপিতে কিছু কম যায় না। এই ছুটে যাচ্ছে, এই কিক মারছে, এই হেড দিচ্ছে। কখনও গোলকিপার সেজে বল ধরছে। কখনও স্টপার হয়ে গোলে বল মারছে। ফ্রিকিক, পেনাল্টি থ্রো সবেতেই আছে। ঘেমে নেয়ে একশা কাণ্ড। কতরকম যে কসরত দেখায়! কে জানে হয়তো ভাবে, শেষ মুহূর্তে হয়ে যাবে। এগারোজনে ঢুকে পড়বে।

হয় না।

ম্যাচ শুরু হলে দেখা যায়, ভোম্বলদা সেই মাঠের বাইরে। প্রথমদিকে খানিকটা সময় জার্সি, জুতো পরেই থাকে। দারুণ উৎসাহ দেখায়। সাইডলাইন ধরে ছোটাছুটি করে। চিকার করে গলা ফাটায়—

অ্যাই মানিক, বল দে। বিশু, উঠে যা। অবিনাশ, হচ্ছেটা কী? বিশু, ম্যান বিহাইন্ড। কাজল সেকেন্ড বার ফাঁকা, গোল খাবি যে! পটল, নেমে আয়, নেমে আয় বলছি। ইস কানাই, এটা কী করলি! বলটা ধরতে পারলি না!

একসময় হাঁপিয়ে যায়। ঘনঘন নিশ্বাস পড়ে। বসে পড়ে ঘাসের ওপর। খানিকটা দম নিয়ে নিঃশব্দে জার্সি, জুতো খুলে তাপ্পি মারা কিটব্যাগে গোছাতে থাকে যত্ন করে। পরের দিন আসতে হবে না?

এরকম পাগলামির জন্য ভোম্বলদা নিশ্চয় বাড়িতে বকাঝকা খায়। খাবেই তো। ভোম্বলদার স্ত্রী গীতাবউদি কি আর ছেড়ে দেন? দেবেনই বা কেন? রোজ রোজ এ কী কাণ্ড! বাড়ির কাজকর্ম ফেলে সকাল-বিকেল বেরিয়ে আসা। তার ওপর বাসভাড়া, টিফিন, জার্সিটার্সি কাচাকুচি আছে। গাদাখানেক খরচ। তা-ও খেলার সুযোগ পেলে একটা কথা ছিল। এ তো যাকে বলে একেবারে অপচয়।

কিন্তু সেদিন পিন্টু এসে যা শোনাল, তাতে আমরা একেবারে হাঁ!

ভোম্বলদা পিন্টুদের বাড়ির গায়েই ভাড়া থাকে। একদিন পিন্টু শুনল গীতাবউদি গজগজ করছে। রাস্তার পাশেই ওদের জানলা। পিন্টু থমকে দাঁড়াল। ইস, নিশ্চয় দু’জনের ঝগড়া চলছে। অন্যদের ঝগড়া শোনা উচিত নয়, তবু পিন্টু কৌতূহল সামলাতে পারল না। সে কান পাতল। যতই হোক ঝগড়া তো খেলা নিয়েই।

একটু শোনার পরই পিন্টু একেবারে থ!

হ্যাঁ, ঝগড়া খেলা নিয়েই। ভোম্বলদার স্ত্রী রাগারাগি করছেন এটাও ঠিক। তবে এ যে একেবারে অন্যরকম রাগারাগি!

গীতাবউদি গলা তুলে বলছে, কী হল, তুমি আজ মাঠে যাবে না? বিছানায় এখনও গড়াচ্ছ যে বড়!

ভোম্বলদা হাই তুলতে তুলতে উত্তর দিল, ভাবছি আজ আর যাব না। দাও, বাজারের থলিটা দাও।

গীতাবউদির গলায় বিরক্তি।

মানে! বাজারের থলি দেব কেন? বাজার রোজ আমি করি, আজও করব। তুমি তোমার কাজ করো তো। যাও উঠে মাঠে যাও।

বকুনি খেয়ে ভোম্বলদা মিনমিন করছে, দূর কী হবে? রোজই তো যাই। গিয়েও তো কোনও লাভ হবে না।

গীতাবউদি দাঁত কিড়মিড় করে বলল, লোকে যে তোমায় বোকা বলে ঠিকই বলে। লাভ-ক্ষতির বিচার করার তুমি কে? তোমার কাজ তুমি করবে। তুমি মাঠে যাবে।

ভোম্বলদা আরও কাঁচুমাচু গলায় বলল, একটা ম্যাচেও তে চান্স পাই না। মন খারাপ হয়ে যায়।

গীতাবউদি দাবড়ে উঠল, মন খারাপ হয়ে যায়, ন্যাকা। নিশ্চয় ভাল খেলতে পারো না বলেই চান্স পাও না। তা ছাড়া এতদিন পাওনি বলে পরে কোনওদিন পাবে না, এ-কথা তোমাকে কে বলল? যেদিন ভাল খেলবে সেদিন ওরা ঠিক তোমায় টিমে নেবে। যাও যাও।

ভোম্বলদা মিনমিন করে বলল, আমার জার্সি, মোজা সবই নোংরা। কেড্সটাও ধোয়া হয়নি।

গীতাবউদি চাপা গলায় হি্সহিস করে উঠল, সব আমি করে রেখেছি। ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখেছি। সংসারের তো কুটোটাও নাড়ো না। তোমার ওপর কে ভরসা করে?

ভোম্বলদা গলা নামিয়ে বলল, আজ ছেড়ে দাও গীতা। বাসভাড়া…।

গীতাবউদি আবার ধমকে উঠল, কোনওদিন বাস ট্রামের ভাড়া নিয়ে তোমাকে ভাবতে হয়? টিউশনির মাইনে পেয়েছি। তাকের ওপর দশটা টাকা রেখে গেলাম। উনি বিরাট ভাড়া জোগাড়ের লোক এসেছেন।

এরপর পিন্টু আর দাঁড়ায়নি। সোজা চলে এসেছে। এসে আমাদের সবটা জানিয়েছে। আমরা অনেকক্ষণ চুপ করে রইলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল।

অবিনাশ বলল, না, এবার ধীরেনদাকে বলতে হবে। পটল বলল, হ্যাঁ, আজই বল। পরশু নাকতলায় কাদম্বরী স্মৃতি টুর্নামেন্টের ফাইনাল। ওই দিন ভোম্বলদাকে একটা চান্স করে দিতেই হবে। কানাই বলল, সবাই মিলে বললে ধীরেনদা নিশ্চয় রাজি হবে।

না, ধীরেনদা রাজি হল না। উলটে আমাদের ধমক দিল। বলল, গত তিন বছর আমরা এই টুর্নামেন্টে হেরেছি। এবার জিততেই হবে। এখানে টিম নিয়ে কোনও ইয়ারকি মারা চলবে না। টিমের সঙ্গে সেন্টিমেন্টের কোনও সম্পর্ক নেই। এসব ছিঁচকাঁদুনেপনা বন্ধ কর।

না, এবারও চান্স হল না ভোম্বলদার।

তবে ব্যাপারটা আমরা ভুলে গেলাম। ভুলে তো যাবই। আমরা যে কাদম্বরী স্মৃতি টুর্নামেন্টে জিতে গেছি! এই আনন্দে মনখারাপের অনেক কিছু ভুলে যাওয়া যায়।

ঠিক হল বিজয় উৎসব হবে। ক্লাবঘরের সামনে টেবিলে সাদা চাদর পেতে ট্রফিটাকে রাখব। বক্স ভাড়া করে গান বাজানো হবে। আর রাতে খাওয়াদাওয়া। ভোম্বলদার উৎসাহ সব থেকে বেশি। বলল, ক্লাবঘর টুনি বাল্‌ব দিয়ে সাজানো হবে। লাল-নীল টুনি। একটা জ্বললে আর একটা নিভবে। তোমাদের কারও আপত্তি আছে? আমরা সবাই মিলে বললাম, কোনও আপত্তি নেই। পটল বলল, ট্রফির পাশে ফুটবলটাকে সাজিয়ে রাখতে হবে। ভোম্বলদা বলল, শুধু ফুটবল কেন, তোকেও রাখব। তুই দুটো গোল দিয়েছিস।

সবাই হেসে উঠলাম।

ধীরেনদাকে ধরা হল। ধীরেনদা বলল, খাওয়াদাওয়ার খরচ ক্লাব দিতে পারবে না। প্রেসিডেন্টকে ম্যানেজ করে রসগোল্লা-শিঙাড়ার একটা ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

অবিনাশ নাক কুঁচকে বলল, এ মা! শিঙাড়া দিয়ে বিজয় উৎসব?

কানাই কাঁদোকাঁদো মুখে বলল, অসম্ভব।

ধীরেনদা গম্ভীর মুখে বলল, রসগোল্লা আর একটা করে শিঙাড়া দিয়েই এবারের মতো সেরে ফেল। বলছি তো ক্লাবের ফান্ড নেই। ঠিক আছে শিঙাড়া দুটো করে। তবে প্রেসিডেন্ট সাহেবকে মিনিট দশেক ভাষণ দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে।

মানস বলল, হতেই পারে না। দুটো শিঙাড়ার জন্য দশ মিনিট লেকচার শুনব না। ধীরেনদা, ওনাকে বলুন ঘণ্টাখানেক বলতে। আমরা খুব হাততালিও দেব। তার বদলে বড় খাওয়াদাওয়া চাই। খাব আর লেকচার শুনব আর হাততালি দেব। বিশু বলল, খেতে খেতে হাততালি দিবি কী করে? কানাই বলল, কেন? এক হাতে দেব।

সবাই হেসে উঠলাম।

ধীরেনদা আরও গম্ভীর হয়ে বলল, রসিকতা করিস না। আমি এসবের মধ্যে নেই। খুব বেশি হলে আমি প্রেসিডেন্টকে ধরে ডাল-ভাত আর একটা ভাজার ব্যবস্থা করতে পারি। তাতে তোমাদের, ফিস্ট হবে? টকাই প্রায় কেঁদে ফেলল, অ্যাঁ, শুধু ডাল-ভাত আর আলুভাজা দিয়ে বিজয় উৎসব! মাংস থাকবে না? কবজি ডুবিয়ে মাংস না খেলে ফিস্ট কীসের?

এতক্ষণ চুপ করে ছিল ডোম্বলদা। এবার আমতা আমতা করে বলল, আমি একটা কথা বলব?

ধীরেনদা বিরক্ত হয়ে বলল, উফ! তুমি আবার কী বলবে? এর মধ্যে তুমি কোথা থেকে আসছ?

ভোম্বলদা কাঁচুমাচু মুখে বলল, আপনি ডাল-ভাতের ব্যবস্থাটা করুন। বাকিটা আমি দেখছি।

কানাই চোখ গোল গোল করে বলল, দেখছি মানে?

ভোম্বলদা শুকনো হেসে বলল, তোমরা আমায় একটা চান্স দিয়ে দেখো না।

চান্স! ভোম্বলদার কথায় চমকে উঠলাম। আবার চান্স! আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। কেউ কিছু বলার আগে আমি তাড়াতাড়ি বলে ফেললাম, ঠিক আছে, ঠিক আছে। ভোম্বলদা যখন বলছে, একটা চান্স দেওয়া যাক।

সকলে এতই অবাক হয়ে গেল যে আপত্তি করবার কথা মাথায় এলও না। ভোম্বলদাও গদগদ মুখে বাড়ির দিকে রওনা দিল। ধীরেনদা ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমরা যা খুশি করো। আমি এসবের মধ্যে নেই। ভোম্বলকে যখন চান্স দিয়েছ তখন তোমাদের ফিস্ট মাথায় উঠল।

মাথায় উঠল না। মুখে উঠল। সব থেকে বেশি মুখে তুলল ধীরেনদা নিজেই। গীতাবউদি যে এত ভাল মাংস রান্না করতে পারে কে জানত! শনিবার রাতে ক্লাবঘরের ভেতর বসে আমরা যখন গরম ভাত দিয়ে সেই মাংস খেলাম, তখন কারও মুখে কথা নেই! তার ওপরে আবার গীতাবউদি নিজে পরিবেশন করল। পরিবেশনের গুণে সবসময় খাবারের স্বাদ দ্বিগুণ হয়ে যায়। এখানে যেন হল দশ গুণ!

আর ভোম্বলদা? সে লজ্জা লজ্জা মুখে শুধু বলতে লাগল, ইস আর এক হাঁড়ি হলে ভাল হত। ইস…।

ধীরেনদা চোখ বুজে হাড় চুষতে চুষতে বলল, না, ভোম্বলকে চান্স দিয়ে দেখছি ভালই হয়েছে।

এবার ভোম্বলদার সত্যি সত্যি চান্স হল। খাওয়ানোর চান্স নয়। ম্যাচ খেলার চান্স।

এই ঘটনার কিছুদিন পরেই শক্তি সঙ্ঘের সঙ্গে ম্যাচের তারিখ চলে এল। দু’দিন আগে ধীরেনদা ভোম্বলদাকে ডেকে বলল, তোমাকে এবার খেলতে হবে।

ভোম্বলদা চোখ বড় বড় করে বলল, আমাকে!

ধীরেনদা বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমাকে। রেডি হও। কাল থেকে জোর প্র্যাকটিস।

আমরা বুঝতে পারলাম, সেদিনের মাংসের স্বাদ ধীরেনদা এখনও ভুলতে পারেনি। এটা নিশ্চয় তারই প্রতিদান। তবে আমরা খুশি হলাম। যে-কারণেই হোক, ভোম্বলদা একটা চান্স তো পাচ্ছে। সবাই মিলে হইহই করে বললাম, জমিয়ে খেলতে হবে কিন্তু ভোম্বলদা। প্রথম চান্সেই একেবারে মারকাটারি খেলা চাই। কাল থেকে একেবারে ভোরবেলা প্র্যাকটিসে চলে আসবে। ঠিক যেমন আসো। সবার আগে।

ভোম্বলদা এল না। একদিন, দু’দিন, তিনদিন হয়ে গেল।

বিশু বলল, কী রে, ঘাবড়ে গেল নাকি?

কানাই বলল, নিশ্চয় অসুখটসুখ হয়েছে।

অবিনাশ বলল, ভয়ে পালিয়েছে।

পিন্টু চিন্তিত মুখে বলল, দু’দিন তো ভোম্বলদার বাড়িতে তালা ঝুলছিল। আজ আসার সময় দেখলাম ঘর খোলা।

আমি পিন্টুকে বললাম, চল আজই একবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।

ধীরেনদা গম্ভীর মুখে বলল, কোনও দরকার নেই। এসব লোককে চান্স দেওয়াটাই আমার ভুল হয়েছে। এরা খেলোয়াড়ই নয়। নইলে এতদিন পরে চান্স পেয়েও হারায়? ছোঃ।

ধীরেনদার বারণ সত্ত্বেও আমি পিন্টুর সঙ্গে গেলাম। ভোম্বলদা লুঙ্গি পরে, বাসি খবরের কাগজ খুলে খেলার পাতা পড়ছিল। আমাদের দেখে হইহই করে উঠল। গীতাবউদি পাঁপড় ভেজে দিল। ভোম্বলদা বলল, চা চাইবি না। চা-পাতা ফুরিয়ে গেছে।

আমি বললাম, কিছু খাব না। আগে বলো তুমি প্র্যাকটিসে যাচ্ছ না কেন? কাল বাদে পরশু ম্যাচ।

ভোম্বলদা প্রথমে কথাটা এড়িয়ে যেতে চাইল। পিন্টু চেপে ধরল। বলল, আগে বলো। শরীরটরির খারাপ নাকি?

না ভালই আছি।

তবে!

ওসব কথা বাদ দে।

আমি বললাম, কেন বাদ দেব? এরকম চান্স কেউ ছাড়ে। তোমাকে বলতেই হবে।

ভোম্বলদা আমতা আমতা করে বলল, আসলে কী হয়েছে জানিস… ছেড়ে দে।

পিন্টু বলল, ছাড়ব না। তোমাকে বলতেই হবে।

ভোম্বলদা এদিক-ওদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, আসলে কী হয়েছে, এই ম্যাচে তো আমি চান্স পাইনি।

আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি চান্স পাওনি! ধীরেনদা যে বলল, তোমাকে রাইট আউটে খেলাবে। তা হলে কে চান্স পেল!

ভোম্বলদা শুকনো হেসে বলল, চান্স পেয়েছে তোদের বউদির মাংসের ঝোল। আমি ভেবে দেখলাম, এই চান্সটা নেওয়া ঠিক হবে না। গীতাও একই কথা বলল। বলল, খেলায় চান্স পেতে গেলে খেলেই পাওয়া উচিত। তোরা কী বলিস? নে এবার পাঁপড়টা খা দেখি। মিইয়ে যাচ্ছে।

ভোম্বলদা এখনও সকালে-বিকেলে মাঠে আসে। ছোটাছুটি, লাফালাফি করে। ম্যাচের আগে নানারকম কসরত দেখায়। যদি হয়। হয় না। চান্স পায় না ভোম্বলদা। হবেই বা কী করে? এমন বোকার মতো কাণ্ড করলে চান্স হয়!

তবু কী জানি কেন, দূর থেকে এই খেলোয়াড়কে দেখে আমাদের মন শ্রদ্ধায় ভরে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *