চাদের বাজনা

চাদের বাজনা

৷৷ ১ ৷৷

চাদের এঞ্জামেনা হ্যাবিউট মিউজিয়ামে ঘুরে বেড়াচ্ছিল প্রফেসর জুয়ান আর দীপাঞ্জন। আফ্রিকার প্রাচীন লোকসংস্কৃতির নানা উপকরণ দিয়ে সাজানো এই সংগ্রহশালা। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর পোশাক, অলংকার, দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত জিনিসপত্র, অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি রাখা আছে এখানে। গ্যালারিগুলো দেখতে দেখতে এক সময় তারা প্রবেশ করল একটা ঘরে। নানা ধরনের ঢাক রাখা আছে সেখানে। অদ্ভুত ধরনের সব ঢাক । কোনো ঢাক দেখতে বিরাট ডুগডুগির মতো। কোনোটা দেখতে চোঙাকৃতি, কোনোটা রণভেরীর মতো, কোনোটা আবার ঠিক যেন মাটিতে শোয়ানো বিরাট একটা গাছের গুঁড়ি।

সাকুল্যে জনা কুড়ি টুরিস্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে মিউজিয়ামে, বিভিন্ন দেশের মানুষ সব। তাদের গলায় ঝোলানো ফোটো আইডেন্টিটি কার্ড দেখে দীপাঞ্জনরা বুঝতে পারছে ওরাও তাদেরই মতো ইউনেস্কোর প্রোগ্রামেই এখানে এসেছে। নচেৎ মধ্য আফ্রিকার এই ছোট্ট, গরিব দেশটাতে পর্যটকরা খুব বেশি আসে না। তবে এক সময় ইউরোপীয়রা খুব আসত এ দেশে। না, ভ্রমণের জন্য নয়, মানুষ ধরার জন্য। চাদের মানুষদের তারা ধরে নিয়ে যেত দাস বাজারে। ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করার জন্য। দাস বাজারে একটা বড়ো সংখ্যক মানুষের জোগান দিত এই চাদই। তবে এসব দেড়-দুশো বছর আগের কথা। ১৯২০ সাল থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত শেষ এ-দেশ শাসন করেছিল ফরাসিরা। তারপর চাদ স্বাধীন হয় । এখন এ-এক স্বাধীন দেশ—‘রিপাবলিক অব চাদ’। তবে দেশটা স্বাধীন হলেও ঊষর ভূমি, খরাপ্রবণ প্রাকৃতিক পরিবেশ, গৃহযুদ্ধ, সামরিক অভ্যুত্থান ইত্যাদি নানা প্রতিকূলতার কারণে এ-দেশ তেমনভাবে এখনও গড়ে উঠতে পারেনি। এমনকি পৃথিবীর হাতে গোনা যে-কটি দেশে রেলপথ নেই এ-দেশ তাদের মধ্যে একটি, দেশের ৯ শতাংশ রাস্তা মাত্র পাকা। একটিমাত্র বন্দর, তাও সেটা আবার পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ক্যামেরুনের অধীনে। তারা সেটা ব্যবহার করতে দেয় চাদকে। রাজধানী এঞ্জামেনা থেকেও তার দূরত্ব প্রায় দু-হাজার কিলোমিটার। কাজেই পর্যটকরা এ-দেশে কেন আসেন তা সহজেই অনুমেয়। তবে হ্যাঁ, এঞ্জামেনাতে এয়ারপোর্ট অবশ্য একটা আছে, যেখানে দু-দিন আগে এসে নেমেছে দীপাঞ্জনরা ।

সেই বাদ্যযন্ত্রের ঘরটাতে সবাই এসে দাঁড়াবার পর কৃষ্ণাঙ্গ গাইড ছেলেটা জনতাকে বলল, ‘আপনারা দেখতে পাচ্ছেন এখানে বিভিন্ন ধরনের ঢাক রাখা আছে। এই বিরাট আফ্রিকা মহাদেশের মিশরের মমি আপনারা বহু দেশের মিউজিয়ামে দেখতে পাবেন, হয়তো দেখতে পাবেন আফ্রিকার সিংহ-র মাউন্ট করা দেহ, বা দুর্লভ ‘অ্যান্টিলোপ ওরিক্স’-এর শিং । কিন্তু হলফ করে বলতে পারি এখানে আফ্রিকার প্রাচীন লোকসংস্কৃতির স্মারক হিসাবে যে ঢাকগুলো রাখা আছে পৃথিবীর অন্য দু-তিনটে মিউজিয়াম ছাড়া এ-সব ঢাক দেখতে পাবেন না। কারণ এই সব ঢাক কথা বলে!’

একটা গুঞ্জন উঠল উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে। ‘কথা বলে!’

একজন দর্শক বলে উঠল ‘এগুলো কি তালে সেই টকিং ড্রাম অফ আফ্রিকা? আমি একটা বইতে পড়েছি এর কথা!” গাইড ছেলেটা বলল, ‘ঠিক তাই। এগুলো হল আফ্রিকার কথা বলা ঢাক। আফ্রিকার প্রাচীন সংস্কৃতির অঙ্গ। ভাষাকে শব্দে রূপান্তরিত করে এই সব ঢাকের মাধ্যমে দূর থেকে দূরে খবর ছড়িয়ে দেওয়া হত। একদম নিখুঁত খবর, পূর্ণাঙ্গ বিবরণসহ। ইউরোপীয় পর্যটক যখন আমাদের মহাদেশে আসতে শুরু করে তখন একটা ব্যাপারে তারা খুব আচর্য বোধ করত। লিভিংস্টোনসহ বহু পর্যটকের বিবরণে লিপিবদ্ধ আছে তারা যখন শ্বাপদসংকুল, বা পর্বত মরু অঞ্চলের প্রত্যন্ত কোনো গ্রামে উপস্থিত হতেন তখন তারা দেখতেন সেই গ্রামের মানুষরা আগেই তাদের আগমনবার্তা জেনে তাদের অভ্যর্থনা জানাবার জন্য বসে আছে। কখনও সে অভ্যর্থনা হত মধুর কখনও-বা রক্তক্ষয়ী। তারা বিস্মিত হতেন, কীভাবে আফ্রিকার আদিম জনজাতিরা পেয়ে যেত তাদের আগমন বার্তা? এটা কি অলৌকিক কোনো ব্যাপার? শুধু খবরই নয়, তাদের বিস্তৃত বিবরণ। অভিযাত্রীদের লোক সংখ্যা, অস্ত্র সংখ্যা, এমনকি মাথার চুল বা চোখের মণির রঙের মতো খুঁটিনাটি বিবরণও। আসলে এই ঢাকের বাদ্যিই তাদের যাত্রাপথের খবর পৌঁছে দিত তাদের অগ্রবর্তী গন্তব্যে। এমনকি সাহারা মরুভূমির একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তেও রিলে সিস্টেমে খবর আদান-প্রদান করা হত এই ঢাকের মাধ্যমে। ২৫ সেকেন্ডে ৮ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে এই ঢাকের সুরেলা তরঙ্গ। এই ঢাক আফ্রিকা মহাদেশের প্রাচীন জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ষোড়শ শতক থেকেই ইউরোপীয়রা হানা দিতে শুরু করে আমাদের এই মহাদেশে কখনও তারা আসে ধর্মপ্রচারের জন্য, কখনও সোনা বা হিরের খনির সন্ধানে, কখনও বা ক্রীতদাস সংগ্রহের জন্য। এই ঢাকের বাদ্যির মাধ্যমেই তাদের উপস্থিতি জানতে পারত আফ্রিকার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষরা। এবং সেই মতো নিজেদের নিরাপত্তারও ব্যবস্থা করত। একটা ছোট্ট গল্প বলি আপনাদের। সপ্তদশ শতকে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, স্পেন, পোর্তুগাল, ইটালির মতো দেশগুলো প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদ সংগ্রহের লোভে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে আক্রমণ ও দখল করতে শুরু করে, এই চাদ, ক্যামেরুন, গ্যাবন, দক্ষিণ আফ্রিকা, কিনিয়া নাইজার, তোগো, সুদান, ইথিওপিয়ার ওপর নেমে আসে শ্বেতাঙ্গদের বর্বর আক্রমণ। ১৮৯৬ সালে আবিসিনিয়া অর্থাৎ বর্তমান ইথিওপিয়া দখলের জন্য আক্রমণ করে ইতালীয় সেনা দল। কিন্তু এই যুদ্ধে তিরধনুক-কুঠার-বর্শা ইত্যাদি সাবেক অস্ত্র শোভিত আফ্রিকার কালো মানুষদের কাছে চূড়ান্তভাবে পরাজয় ঘটে তথাকথিত সভ্য বন্দুকধারী শ্বেতাঙ্গ ইটালিয়ানদের। কারণ আবিসিনিয়ার রাজা মেনালিক সে-দেশে ইতালীয়রা পৌঁছোবার অনেক আগেই এই কথাবলা ঢাকের মাধ্যমে ইতালীয় সেনা শক্তির পূর্ণাঙ্গ বিবরণ পেয়ে তাদের প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি নিয়ে ছিলেন। আফ্রিকাতে বহু ভাষাগোষ্ঠীর বাস। মাসাই, জুলু, বান্টু, হাউমা ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষা। তারা সবাই এ-ঢাকের ভাষা বুঝলেও ইউরোপীয়রা তা বুঝত না। এক সময় ফরাসি শাসনের নাগপাশে আবদ্ধ হয়েছিল আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ। যাতে এই বিভিন্ন দেশগুলো একত্রে ফরাসি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা না করতে পারে তাই তাদের মেলামেশা নিষিদ্ধ করেছিল ফরাসি সরকার। আর তার সাথে সাথে খবর আদান-প্রদান বন্ধ করতে নিষিদ্ধ করেছিল এই ঢাক। কেউ এই ঢাক বাজালে তার ফাঁসি হত। তবে আফ্রিকার বিভিন্ন গৃহযুদ্ধেও এই ঢাক ব্যবহৃত হয়েছে।

লোকটা কথা শেষ করার পর একজন দর্শনার্থী জিজ্ঞেস করল ‘এ ঢাকগুলো কীভাবে কাজ করে?’

প্রশ্ন শুনে গাইড একটা ঢাকের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সে ঢাকটা দেখতে অনেকটা ডুগডুগির মতো। তবে আকারে অনেকটা বড়ো। দীপাঞ্জনের সেটাকে দেখে অনেকটা কলকাতার ফুচকাঅলাদের বাখারির তৈরি স্ট্যান্ডের মতো লাগল। কাঠের কাঠামো পেটটা সরু, দু-পাশটা চওড়া, সেখানে চামড়ার আচ্ছাদন। সেই চামড়ার আচ্ছাদন থেকে চামড়ার ফিতা টান করে বাঁধা তার ঘর পেটের কাছে। আকারে ফুচকাঅলাদের স্ট্যান্ডের মতোই ফুট চারেক হবে। তার পাশেই ঢাকটা বাজাবার জন্য দুটো কাঠের লাঠি রাখা আছে। তার মাথাটা বাঁকানো। ঠিক যেন দেখতে গলফ খেলার স্টিক ।

গাইড বলল, ‘এই যে ঢাকটা দেকছেন, এ ঢাক যখন বাজানো হয় তখন বাদকের সহকারীরা এর পেটে ফিতাগুলোকে টান করে ধরে বিভিন্ন শব্দ তরঙ্গ সৃষ্টি করার জন্য । আফ্রিকার জনগোষ্ঠীর মূল ভাষাগুলো সাধারণত সুরেলা। এই ঢাকের শব্দও সাধারণত সুরেলা হয়। আফ্রিকা মহাদেশের মূল ভাষা ২৬টি। ৮টি ভাষায় ২টি ছন্দ আছে। উঁচু এবং নীচু। ৬টি ভাষায় ৪টি ছন্দ। উঁচু, খুব উঁচু, মাঝারি এবং নীচু। বাকি ১২টি ভাষায় তিন রকম ছন্দ। উঁচু, মাঝারি ও নীচু। এই ঢাকগুলো বাজাবার সময় ছন্দ খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ছন্দের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীও এই ঢাকের কথা বুঝতে পারে। চারপাশের এই যে বিভিন্ন ঢাক দেখতে পারছেন এগুলো বিভিন্ন উপজাতির। মাসাই, পিগমি, তুতমি, হুটু, হাউমা, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর। কিন্তু এদের ধ্বনি, কথা অন্য উপজাতি বুঝতে পারে।’ তার কথা শোনার পর একজন লোক জানতে চাইল, ‘এ ঢাকের ব্যবহার কি এখনও আছে? না উঠে গেছে?’

দীপাঞ্জন তাকাল তার দিকে। লোকটার চোখে সোনার পারকোল, পরনে ট্যুইট স্যুট, সাদা চামড়া, খাড়া নাক, লাল ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, এক মাঝবয়সি ভদ্রলোক ।

গাইড ছেলেটা জবাব দিল, “না না, এখনও ঢাকের ব্যবহার পরোপুরি উঠে যায়নি। যদিও এটা ই-মেল, ইন্টারনেট, কম্পিউটারের যুগ তবুও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এখনও এমন প্রত্যন্ত অঞ্চল আছে যেখানে খরচ পোষাবে না বলে কোম্পানিরা এ-সবের ব্যবস্থা করেনি। যেমন সাহারা মরুভূমি সহ আমাদের দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, যেখানে আধুনিক স্যাটেলাইট ব্যবস্থা তো দূর অস্ত, এমনকী ডাকঘর পর্যন্ত নেই সেখানে। সরকারি বিভিন্ন খবর, যেমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আগাম পূর্বাভাস, জনহিতকর সরকারি প্রকল্পসহ নানা খবর এই ঢাকের মাধ্যমেই দেশের নানা প্রান্তে পৌঁছে দেওয়া হয়। তাছাড়া আরও একদল লোক এই ঢাক ব্যবহার করে খবর আদান-প্রদানের জন্য।’

‘তারা কারা?’ জানতে চাইল অন্য এক দর্শনার্থী ।

গাইড ছেলেটা যেন শেষ কথাটা মুখ ফসকে বলেছিল। প্রশ্নটা শুনে একটু ইতস্ততভাবে বলল, ‘আসলে এদেশে বহুবছর ধরে নানা গোষ্ঠীসংঘর্ষ, ক্ষমতা দখলের লড়াই চলছে। বেশ কিছু টেররিস্ট গোষ্ঠী আছে যারা এই ঢাক ব্যবহার করে। এ-বিষয় নিয়ে আপনারা আমাকে আর প্রশ্ন করবেন না।’

প্রফেসর জুয়ান বললেন, ‘তার মানে, এখনও এ ঢাক বাজানোর লোক আছে! এখনও এ-ঢাক তৈরি হয়!’

গাইড ছেলেটা বলল, “হ্যাঁ, হয়। লেক চাদের ধারে কয়েকটা উপজাতি অধ্যুষিত গ্রাম আছে। সেখানে এ-ঢাক বানানো হয়। হ্যাঁ, বংশপরম্পরা কিছু মানুষ আজও এ ঢাক বাজাতে পারে। এই যেমন আমি। দাঁড়ান, আমি আপনাদের একটা ঢাক একটু বাজিয়ে দেখাই। এই বলে সে পা ঢাকা দুটো ড্রাম স্টিক বা ঢাকের কাঠি তুলে নিয়ে তার বাঁকানো দিকটা দিয়ে ঢাকটা বাজাতে শুরু করল। প্রথমে ধীর লয়ে আওয়াজ উঠল-ঢিপঢিপ, ঠ্যাপঠ্যাপ, তারপর সেটা বদলে গেল দ্রিমি দ্রিমি শব্দে। বিভিন্ন লয়ে বাজাতে লাগল সেই ছন্দবদ্ধ শব্দ । তারপর সেই শব্দ পরিণত হল এক সুরেলা, ছন্দবদ্ধ ধ্বনিতে। কখনও থেমে থেমে, কখনও বা ছন্দবদ্ধভাবে বেশ খানিকক্ষণ ধরে ছেলেটা বাজাল সেই ঢাক। তারপর বাজনা থামিয়ে ঝকঝকে সাদা দাঁত বার করে হেসে মন্তব্যের প্রত্যাশায় তাকাল উপস্থিত জনতার দিকে। সবাই হাততালি দিল তার বাজনা শুনে। দীপাঞ্জন ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কী কথা বললে এই ঢাক বাজিয়ে ?’ সে হেসে বলল, আমি বললাম, ‘একদল মানুষ এসেছে আমাদের দেশে। তাদের মধ্যে সাদা চামড়া, কালো চামড়া, পীত চামড়া নানা ধরনের মানুষ আছে। কলের পাখির পেটে চেপে এসেছে তারা। তাদের কাছে আগুন ছোড়া লাঠি অর্থাৎ বন্দুক নেই। তারা আমাদের ধরতে বা মারতে আসেনি। এরা সব ভালো মানুষ। বন্ধু মানুষ। সরকারি অতিথি তারা। তাদের কেউ যদি তোমাদের কাছে যায়, তাকে তোমরা সাহায্য কোরো।’

দীপাঞ্জন বলল, “বাবা, এত কথা! তোমার এই ঢাকের শব্দ কতদূর পৌঁছল?’

গাইড ছেলেটা প্রথমে হেসে বলল, ‘কথা বলা ঢাকের বৈশিষ্ট্যই হল বিস্তৃতভাবে কথা বলা । আর শব্দটা কতদূর পৌঁছল এই বলে সে ঘরের বিরাট বড়ো জানলার সামনে দাঁড়িয়ে কানখাড়া করে কী যেন শোনার চেষ্টা করল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তার মুখে আবছা একটা হাসি ফুটে উঠল। দীপাঞ্জনকে ইশারায় জানলার সামনে ডেকে সে বলল, “বাইরে থেকে কোনো নতুন শব্দ শুনতে পাচ্ছেন? ভালো করে শোনার চেষ্টা করুন।

শোনার চেষ্টা করল দীপাঞ্জন। শহরের নানা শব্দ ছাপিয়েও অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে অস্পষ্ট একটা শব্দ। ঢাকের শব্দ। দীপাঞ্জন সন্দেহ নিরসনের জন্য গাইড ছেলেটাকে বলল, ‘ওটাও কি ঢাকের শব্দ?”

সে বলল, ‘হ্যাঁ, শহরের বাইরে গ্রামটার দূরত্ব এখান থেকে পাঁচ মাইলেরও বেশি। ওরা এই ঢাকের বাজনা শুনে খবরটা ছড়িয়ে দিচ্ছে। শব্দহীন নির্জন মরুভূমি বা অরণ্য প্রদেশে আট-দশ মাইল দূরেও এই ঢাকের শব্দ পৌঁছয় ।

‘ওকে, জেন্টলমেন। আপনারা প্রয়োজনবোধে আর একবার মিউজিয়ামটা ঘুরে দেখতে পারেন।’ দর্শকদের দিকে তাকিয়ে একথা বলে তার কাজ শেষ করল ছেলেটা।

৷৷ ২ ৷৷

এটাই মিউজিয়ামের শেষ ঘর ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরটা ফাঁকা হয়ে গেল। রয়ে গেল শুধু চারজন। প্রফেসর জুয়ান, দীপাঞ্জন, সেই সোনার চশমা পরা লোক আর গাইড ছেলেটা ৷ জুয়ান বাদ্যযন্ত্রগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে দীপাঞ্জনকে বললেন, ইউরোপীয়রা তাদের সাদা চামড়ার গর্বে আফ্রিকানদের অসভ্য-বর্বর বলত। কিন্তু তুমি একবার ভাবো টেলিগ্রাফ আবিষ্কারের আগে তারা তাদের নিজস্ব কৌশলে কী অদ্ভুতভাবে বার্তা প্রেরণের ব্যবস্থা করেছিল। এও তো বিজ্ঞান! শব্দ বিজ্ঞানের ওপর যথেষ্ট জ্ঞান না থাকলে এ কাজ সম্ভব নয়।’

ঠিক এই সময় তাদের কানে এল পারকোল লাগানো সেই লোকটা গাইড ছেলেটার উদ্দেশে বলল, ‘যে গ্রামে এই ঢাক তৈরি হয় সব গ্রাম তুমি চেনো ?

গাইড ছেলেটা হেসে বলল, “চিনব না কেন? ওরকম একটা গ্রামেইতো আমার জন্ম।’ ভদ্রলোক বললেন, “আমাকে তুমি সেখানে নিয়ে যেতে পারবে?’

ছেলেটা এবার একটু বিস্মিতভাবে জানতে চাইল, ‘ওখানে গিয়ে আপনি কী করবেন ? লোকটা বলল, ‘আমার নাম শ্যাপেলিও। জাতে ফরাসি। গতকালই আমি এ দেশে এসেছি। ফ্রান্সে আমার একটা বাদ্যযন্ত্রের মিউজিয়াম আছে। বিভিন্ন দেশের দুষ্প্রাপ্য বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ করি আমি। যেমন আমাজনীয়দের রনডেডর বাঁশি, প্রাচীন তুর্কি বীণ, দ্বিতীয় ঝাঝর, ভারতীয়দের মাপের বাঁশি, ওলন্দাজদের নৌ-ভেরি, এমন নানা বাদ্যযন্ত্র আমার সংগ্রহেতে আছে। যা নেই তা হল এই কথা বলা ঢাক। এটা সংগ্রহ করতেই আমি এদেশে এসেছি।’ গাইড ছেলেটা একটু ভেবে নিয়ে বলল, “তা নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। আমার তো আর এখন এ মিউজিয়ামে কোনো কাজ নেই। ইউনিস্কোর টিমটা এসেছিল তাই আমার ডাক পড়েছিল। এখানে টুরিস্ট তেমন আসে না। সারা বছর এ জায়গা ফাঁকাই থাকে। তবে আপনার সাথে কি আরও লোকজন আছে? আসলে সেখানে পৌঁছবার জন্য মারি নদীর অববাহিকা ধরে তৃণভূমির মধ্যে দিয়ে প্রায় দুদিনের পথ আমাদের পাড়ি দিতে হবে। এবং সেই পথের অধিকাংশটাই পায়ে হেঁটে। রাস্তাটা সোজা, কিন্তু ঘাসবনে সিংহ আছে, চিতা আছে, হায়না আছে, আর আছে প্রচুর সংখ্যায় হাতি। কাজেই দলে ভারী থাকলে বিপদের সম্ভব কম, বন্যজন্তুরা চট করে কাছে ঘেষে না। তা, কী ঢাক কিনতে চান? ডোঙ্গো? লুনা? গ্যানগ্যান?”

শ্যাপেলিও শুনে বললেন, ‘না, আমার সঙ্গে কেউ নেই। আমি যা খুঁজছি তা শুধু এখানে আর মেনেগালে মেলে।’ ফুলানি ট্যামেট্যাম ‘ফুলানি ট্যামট্যাম!’ মৃদু চমকে উঠে কথাটা একবার উচ্চারণ করল ছেলেটা। তারপর বলল, ‘হ্যাঁ সে ঢাকের সন্ধান আমার জানা আছে ঠিক এই মুহূর্তে দীপাঞ্জনকে অবাক করে জুয়ান তাদের উদ্দেশে বলে উঠলেন, ‘আমরা আপনাদের সঙ্গী হলে আপত্তি আছে?’ তার কথা শুনে শ্যাপেলিয়ও আর গাইড ছেলেটা দুজনেই অবাক হয়ে তাকাল দীপাঞ্জনের দিকে। শ্যাপেলিয়ার বললেন, ‘আপনারা প্রফেসর স্মিত হেসে এগিয়ে গিয়ে ভদ্রলোকের দিকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে বললেন, “আমার নাম প্রফেসর জুয়ান। স্পেনের ক্যানারি ইউনিভার্সিটিতে মেমো-অ্যামিরিকান সভ্যতার ইতিহাস পড়াই। এখানে ইউনেস্কোর এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলাম। আর এ আমার ভ্রমণপিপাসু ভারতীয় বন্ধু—‘শেন।’

দীপাঞ্জনের খাঁটি বাঙালি পদবি ‘সেন’। জুয়ানের জিভে ‘শেন’ উচ্চারণ হয়।

দীপাঞ্জনও এগিয়ে এল। শ্যাপেলিও তাদের দুজনের সাথে করমর্দন করার পর জুয়ান এবার বললেন, ‘আপনাদের দু-জনের কথা কিছুটা অবাঞ্ছিতদের মতোই শুনছিলাম। তবে এগিয়ে না এসে আর থাকতে পারলাম না। আমার এখানকার কাজ শেষ। এ দেশে সম্ভবত আর আসা হবে না। মনে মনে ভাবছিলাম ‘লেক চাদটা যদি দেখা যেত। আফ্রিকার ‘লেক ট্যাঙ্গানিকা’ বহু পর্যটকই দেখেন, কিন্তু চাদ হ্রদ দেখা হয় না। তাছাড়া, আমি প্রাচীন জনজাতির সংস্কৃতির ব্যাপারে আগ্রহী। আপনারা যদি আমাদের সঙ্গী করেন তাহলে উভয়পক্ষের সুবিধা। খরচের ব্যাপারটাও আধাআধি করা যাবে।”

ভদ্রলোক প্রস্তাবটা শুনে মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে জবাব দিলেন, ‘আমার কোনো আপত্তি নেই।’ তারপর গাইড ছেলেটার উদ্দেশে বললেন, ‘তোমার কী নাম? কখন, কীভাবে যাত্রা শুরু করা যেতে পারে?’

ছেলেটা বলল, ‘আমার নাম, এমি কুস্যি।’ তারপর সে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যাবার জন্য কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। একটা তাঁবু, একটা বন্দুক, আরও কিছু জিনিস হাত ভাড়া নিতে হবে। কিছু জিনিস কিনতেও হবে। তবে সবই কাছাকাছি পাওয়া যায়। হাজার দুই ফ্র্যাঙ্ক পেলে আমি সব ব্যবস্থা করে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বেড়িয়ে পড়তে পারব । আশাকরি তাহলে কাল সন্ধ্যার আগেই চাদ হ্রদে পৌঁছে যাব।’

তার কথা শুনে পকেট থেকে পার্টস বার করলেন শ্যাপলিয়র।

এমি ছেলেটা সত্যিই করিৎকর্মা। দীপাঞ্জনরা মিউজিয়াম থেকে নিজেদের হোটেলে ফিরে আসার একঘণ্টার মধ্যেই সে সব বন্দোবস্ত করে চালকসমেত একটা গাড়িতে শ্যাপলিয়কে তার ডেরা থেকে তুলে নিয়ে হাজির হল তাদের দরজায়। তারপর তারা বেড়িয়ে পড়ল চাদ হ্রদের খোঁজে।

ছোট্ট শহর এঞ্জামেনা অতিক্রম করতে তাদের বেশি সময় লাগল না। শহরের পর পথের পাশে মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো গ্রাম। পাতায় ছাওয়া কুটির। মুরগি, গোরু চড়ে বেড়াচ্ছে আশেপাশে। মানুষগুলো সব ছোটোখাটো চেহারার। মাসাইদের মতো লম্বা নয়। আফ্রিকান বলতেই তো সাধারণত চোখে ভেসে ওঠে বর্শা হাতে দীর্ঘদহেী মাসাইয়ের ছবি। এদের পুরুষদের পরনে আলখাল্লা, মেয়েদের পরনে রঙচঙে পোশাক, মাথায় রঙিন কাপড়ের ফেট্টি। এমি বলল, ‘এরা হলো সারা জনগোষ্ঠীর লোক। ধর্মে মুসলমান। এ দেশে তিন ধর্ম পালিত হয়। ইসলাম, খ্রিস্টান আর সনাতন লৌকিক ধর্ম। জনশ্রুতি অনুসারে চাদের প্রচতম অধিবাসীরা বসবাস করত চাদ হ্রদের অববাহিকার উত্তর-পূর্ব কোণে। সেখানে রাস্তা কানেম-বরনু এক শক্তিশালী রাজ্য স্থাপন করেন। তার রাজ্যের নামও হয় কামে-বরনু। খুব দুর্ধর্ষ ছিল তারা। কানেম-বরনুর লোকেরা এই নিরীহ সারা জনগোষ্ঠীর লোকেদের ধরে নিয়ে দাসবাজারে বিক্রি করত। এ লোকগুলো ছোটোখাট দেখতে হলেও প্রচণ্ড পরিশ্রমী। যে কারণে ইউরোপীয়নদের তুলোর খেতে এদের খুব কদর ছিল।’ এমির একথা শুনে দীপাঞ্জনের মনে পড়ে গেল বিখ্যাত উপন্যাস ‘আঙ্কেল টমস্ কেবিন’-এর কথা ।

বেশ কিছুপথ চলার পর একটা গ্রাম দেখিয়ে এমি বলল এটা হল সেই গ্রাম, যারা ঢাকের শব্দের প্রত্যুত্তর জানিয়ে ছিল। শ্যাপেলিও দীপাঞ্জনের বলল, ‘জানেন এই কথা বলা ঢাকগুলো যেমন অদ্ভুত দেখতে তেমনই অদ্ভুত তাদের নাম। সেনেগালে এ ঢাকের নাম “টামা’। নাইজার, বেনিন, চাদে যে ঢাক বাজে তার নাম ‘গ্যানগ্যান’ আর ‘লুনা’। সেন্ট্রাল ঘানায় আর-এক ধরনের ঢাক আছে তাকে বলে ‘ডোনডো’। আবার ফাঁপা কাঠের গুঁড়ি দিয়ে লম্বা যে ঢাক বানানো হয় তার নাম ট্যামট্যাম’। এই ঢাক মাসাইল্যান্ডে বেশি ব্যবহৃত হলেও আফ্রিকা মহাদেশের সর্বত্রই এর ব্যবহার আছে।’

এমি তার কথা শুনে প্রশংসাসূচকভাবে বলল, ‘বাঃ আপনি এ ব্যাপারে বেশ পড়াশোনা করে এসেছেন দেখছি।’

তারপর সে বলল, ‘আমরা এবার এঞ্জামেনা-চাদ ন্যাশানাল হাইওয়ে ধরব।’

দীপাঞ্জন সামনে তাকিয়ে দেখল, সামনে কিছুটা তফাতে পিচ রাস্তা শেষ হয়েছে। তারপর মাটির রাস্তা সামনের দিকে এগিয়েছে। সে এমিকে বলল, ‘সামনে কোথায় হাইওয়ে ? এ তো মাটির রাস্তা! তুমি মজা করছ?’

এমি উত্তর দিল, ‘না, মজা করছি না। আমাদের দেশের এক শতাংশ রাস্তাও পাকা নয় । এই মাটির রাস্তাটাই ন্যাশানাল হাইওয়ে। তাও এই রাস্তাটা একসময় হাতি চলাচলের ফলে হয়েছিল। আমাদের দেশের নিরানব্বই শতাংশ রাস্তাই মাটির।’

রাস্তার একপাশে ঘাসের বন, অন্যদিকে উন্মুক্ত প্রান্তর। মাঝে মাঝে দু-একটা গাছ দাঁড়িয়ে আছে। এমি জানাল ওই গাছগুলোর নাম ‘আকাকিয়া’। চাদে এ গাছ দেখা যায় ৷ কখনও বা ঝোপজঙ্গলের ফাঁক দিয়ে মাঝেমাঝে একটা রুপোলি রেখা চিকচিক করছে। ওটা সারি নদী। ওরই সমান্তরাল রাস্তা ধরে এগোচ্ছে দীপাঞ্জনদের গাড়ি।

আরও বেশ কিছুটা এগোবার পর এবারও একটা গ্রাম চোখে পড়ল। এমি বলল, —এটাই এ পথের শেষ গ্রাম।’

কিন্তু এ গ্রামে দাঁড়িয়ে পড়তে হল দীপাঞ্জনদের। রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছে একদল নারী-পুরুষ। এমি বলল, এদের ‘টোলট্যাক্স’দিতে হবে। নজরানা। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে এই ব্যবস্থা।’

তার কথা শুনে শ্যাপেলিও তার পকেটে হাত দিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু, এমি বলল, ‘না, না, ওসব কিছু নয়, অন্য ব্যবস্থা আছে। এমি বেশ কয়েকটা কার্ডবোর্ডের বাক্স গাড়িতে তুলেছিল। তার একটা খুলে সে বার করল কয়েকটা সস্তা দামের টিনের আয়না, পুঁতির মালা, রঙিন রুমাল, প্লাস্টিক আর কাঠের তৈরি ছোটো ছোটো কয়েকটা খেলনা। সেগুলো দেখে জনতার মধ্যে থেকে একজন লোক এগিয়ে এল তার দিকে। লোকটার পরনে একটা মাথা শুদ্ধ চিতাবাঘের চামড়া। চিতার মাথাটা দন্তবিকশিত করে জেগে আছে তার কাঁধের কাছে। লোকটার গলায় রংবেরঙের নানা পাথরের হার। এমি হাত থেকে সে জিনিসগুলো তুলে নিয়ে তার এক সঙ্গীর হাতে দিল। তারপর কোমর থেকে সুতলিবাঁধা এক গোছা চুলের মতো জিনিস বার করে দুর্বোধ্য ভাষায় কী সব বলে সেটা বেঁধে দিল এমির বাঁ-হাতের কবজিতে গাড়ি আবার চলতে শুরু করার পর এমি বলল, ‘দেশটা খুব গরিব। সামান্য জিনিস পেলেই খুশি হয় এরা। ওই সামান্য জিনিসের জন্য আপনার হয়ে মাইলের পর মাইল অতিক্রম করে কোনো খবর পৌঁছে দিতে পারে। একসময় ইউরোপীয়রা তামাকের বদলে হিরা সংগ্রহ করত আফ্রিকার গ্রামে। আমি দু-বাক্স টুকিটাকি এ ধরনের জিনিস এনেছি। প্রয়োজনে কাজে লাগতে পারে। চিতার চামড়া পরা লোকটা হল গ্রামের ওঝা। ও মন্ত্র পড়ল যাতে আমরা বিপদ থেকে রক্ষা পাই। আমার হাতেও সিংহের লোম বেঁধে দিল যাতে ভূতপ্রেত কোনো ক্ষতি না করে।’

তার কথা শুনে শ্যাপেলিয়র বললেন ‘হ্যাঁ, তামাকের বিনিময় হিরা সংগ্রহের ব্যাপারটা শুনেছি। আমার পূর্বপুরুষরাও করে ছিলেন। বিশেষত মধ্য আফ্রিকা থেকে এ ভাবে হিরা সংগ্রহ করা হত।’

প্রফেসর জুয়ান এবার হঠাৎ তার উদ্দেশে বললেন, ‘মশিয়ে শ্যাপলিও, একটা কথা জিজ্ঞেস করছি, কিছু মনে করবেন না, আপনার পেশাটা কী? ওই মিউজিয়াম চালানো?’ শ্যাপলিও হেসে বললেন, ‘ওই মিউজিয়ামটা আসলে শখের ব্যাপার। লোকজন জিনিসগুলো দেখে তাতে তৃপ্তি পাই আমি। সেখানে আয়ের চেয়ে খরচ অনেক বেশি। আমি আসলে বংশপরম্পরায় হিরা ব্যবসায়ী। জেম মার্চেন্ট।

তার কথা শুনে দীপাঞ্জনরা বুঝতে পারল, সারা পৃথিবী ঘুরে এত পয়সা খরচ করে শ্যাপলিও কীভাবে বাদ্যযন্ত্রগুলো সংগ্রহ করেন। আসলে ভদ্রলোক খুব ধনী।

আরও ঘণ্টা খানেক পথ চলার পর দিগন্তবিস্তৃত এক সবুজ প্রান্তরে এসে থেমে গেল গাড়িটা। সোজা পথ এখানে এসে থেমেছে। এমি গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে বলল, গাড়ি আর যাবে না। এবার হাঁটা পথ।

৷৷ ৩ ৷৷

যতদূর চোখ যায় শুধু তৃণভূমি। সারা নদীকে পশ্চিমে রেখে রেখে উঁচু-নীচু ঢাল বেয়ে দিগন্তবিস্তৃত ঘাসের প্রান্তর চাদ হ্রদে গিয়ে উত্তরে মিশেছে। আর পূর্বে এর প্রান্তসীমা সাহারা মরুভূমি। সারা নদীর পশ্চিমে আর একটা নদীও সারা-র সমান্তরাল চলছে। তার নাম ‘লোগোন’। সারা এবং লোগোন, এই দুই নদীই চাদ হ্রদে গিয়ে মিশেছে। গাড়ির থেকে জিনিসপত্র নামিয়ে সেগুলো ভাগাভাগি করে নেওয়া হল বহন করার জন্য। তারপর সারা নদীকে বাঁ পাশে রেখে তার পাড় বরাবর সিকি মাইল তফাতে হাঁটা শুরু করল সবাই। সবার আগে এমি বন্দুক হাতে। সে শুধু একবার সবাইকে সতর্ক করে বলল, ‘উঁচু ঘাসের জঙ্গল দেখলে একটু সতর্ক থাকবেন। ওখানে চিতা-লেপার্ড লুকিয়ে থাকে।’

সূর্যের তেজ এখনও থাকলেও নদীর দিক থেকে বাতাস এসে আন্দোলিত করছে ঘাসবন । তাই চলতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছিল না দীপাঞ্জনদের। যাত্রাপথের প্রথমে তারা দেখতে পেল এক দল অ্যান্টিলোপ। আর তারপরই অনেক দূর থেকে দেখতে পেল সবুজ জমিতে ধূসর পাথরের স্তূপ। এক দঙ্গল হাতি। সংখ্যায় প্রায় তিরিশ-চল্লিশটা হবে। মাইলখানেক দূর থেকে তাদের অনুচ্চ পাহাড়ের মতো দেখাচ্ছে। এমি বলল, ‘এ দেশে আর কিনিয়াতে হাতির সংখ্যা খুব বাড়ছে। সরকারি উদ্যোগে হাতি নিধনও করা হচ্ছে এ সব দেশে। আন্তর্জাতিক পশুপ্রেমীরা এ-নিয়ে বেশ শোরগোলও তুলছে। তবে সরকারের হাতি নিধনের পিছনে আরও একটা কারণ আছে। এখানে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীরাও হাতি মারে চোরা শিকারিদের মাধ্যমে। হাতির দাঁত জঙ্গিদের অর্থের জোগান দেয়। যা দিয়ে তারা অস্ত্রশস্ত্র কিনে সরকারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে। হাতির দাঁতগুলো যাতে তাদের দখলে না যায় সেটাও সরকারি উদ্যোগে হাতি নিধনের একটা কারণ।’

এগিয়ে চলল দীপাঞ্জনরা। সূর্যও মাথার ওপরে চলতে লাগল তাদের সাথে। তাদের চোখে পড়তে লাগল, নানা ধরনের হরিণ, অ্যান্টিলোপ। দলে দলে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে এই গেজিং-ফিল্ড বা চারণভূমিতে। এমি বলল, ‘হরিণ আর অ্যান্টিলোপের মধ্যে মূল পার্থক্য হল, অ্যান্টিলোপের শিং-এ কোনো শাখাপ্রশাখা থাকে না, এবং তাদের শিং দুটো পরস্পর সমান্তরালে থাকে।’

বিকাল হল এক সময়। তাদের যাত্রাপথে হঠাৎ দেখা গেল মাটির মধ্যে ভাতের থালার মতো গর্ত। হাতির পায়ের দাগ। বিরাট একটা দল কিছু আগে সামনের দিকে এগিয়েছে। কাজেই তাদের থেকে তফাতে চলার জন্য নদীর দিকে বেশ কিছুটা সরে হাঁটতে লাগল তারা । আর তাদের এই যাত্রাপথ পরিবর্তনই একটা বিরল দৃশ্য দেখার সুযোগ করে দিল কিছুক্ষণের মধ্যেই। জুয়ান হঠাৎ নদীর দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, “আরে ওই দেখো!” সবাই তাকাল সে দিকে। সূর্য অস্ত যেতে বসেছে। তার লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে নদীর জলে। আর শেষ বিকালের আলোতে সারি নদীর পাড়ে জলক্রীড়ায় মেতে উঠেছে একপাল জলহস্তী! জলে দাপাদাপি করছে, আকাশের দিকে জল ছেটাচ্ছে বিশালাকার প্রাণীগুলো ।

অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য! জুয়ান, দীপাঞ্জন, শ্যাপলিও সবাই ছবি তুলল সে দৃশ্যর।

এরপর আবার চলা। সূর্য ডুববার কিছু আগে তারা বেশ উঁচু একটা টিলা মতো জায়গাতে পৌঁছে গেল। হয়তো একসময় এখানে বিরাট কোনো প্রস্তরখণ্ড ছিল। এখন তা ঘাসের চাদরের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে। টিলার মাথায় তাঁবু ফেলার জন্য স্থান নির্বাচন করা হল। তাঁবু ফেলা হল সেখানে। অন্ধকার নামল কিছুক্ষণের মধ্যে। খাওয়া সেরে দীপাঞ্জনরা তাঁবুর ভিতর গল্প গুজব শুরু করল। রাতও বেড়ে চলল। একসময় এমির ডাকে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এল তারা। চাঁদের আলোতে সেই বিস্তীর্ণ প্রান্তরের বহুদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। সারি নদী চিকচিক করছে চাঁদের আলোয়। এমি আঙুল তুলে টিলার নীচের দিকটা দেখালো। দলে দলে হরিণ, অ্যান্টিলোপ, এমনকি কয়েকটা হাতিও চলেছে রাতের অন্ধকারে সারি নদীতে জলপানের জন্য। ছায়ামূর্তি সব। শুধু অন্ধকারে তাদের চোখগুলো জ্বলছে। দীপাঞ্জনরা নীচে তাকিয়ে দেখতে লাগল সেই অদ্ভুত দৃশ্য! নানা ধরনের অবয়ব। সে মিছিল যেন শেষ হচ্ছে না! হঠাৎ রাত্রির নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে কোনো একটা প্রাণীর আর্তনাদ ভেসে উঠল নদীর দিক থেকে! এমি বলল, ‘গ্যাজেলের ডাক। একধরনের তৃণভোজী। হরিণের নিকট আত্মীয় সম্ভবত কুমির টেনে নিল তাকে। এখানকার সব নদীতে, চাদ হ্রদেও প্রচুর কুমির আছে।’ আর এরপরই শোনা গেল নদীর পাড় থেকে ‘হ্যা হ্যা শব্দে কাদের যেন হাসি। এমি সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘কুমিরের বদলে হায়না হতে পারে। ওটা হায়নার ডাক।’ এরপর সে বলল, চলুন, এবার শুয়ে পড়তে হবে। কাল খুব ভোরে যাত্রা শুরু করব আমরা।”

দীপাঞ্জনরা তাঁবুতে ঢুকতে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময় মেঘের ডাকের মতো আর একটা গুরু গুরু শব্দ কানে এল তাদের। না, আকাশে তো কোনো মেঘ নেই। এমি কান খাড়া করল সঙ্গে সঙ্গে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে বলল, ‘ঢাকের শব্দ। কথা বলা ঢাকের শব্দ! আমাদের যাত্রাপথের খবর জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে দূরবর্তী গ্রামকে । আমরা না দেখলেও তারা আমাদের দেখেছে। সম্ভবত এই সাভানা প্রান্তর বা নদীতীরের কোনো যাযাবর গোষ্ঠী।

জুয়ান জানতে চাইলেন, ‘ঠিক কী বলছে ওরা?”

এমি ভালো করে শব্দটা শোনার পর বলল, “ঢাক বলছে, চারজন মানুষ সারি নদীর পাড় বরাবর চাদ হ্রদের দিকে যাচ্ছে। দুজন সাদা, একজন কালো, আর-একজন সাদা কালোর মাঝামাঝি রঙের ৷ তবে তারা শিকারি নয় । একজনের হাতে শুধু ‘আগুন ছোড়া লাঠি’ অর্থাৎ বন্দুক আছে। সম্ভবত তারা সরকারি লোক হতে পারে। তবে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। সতর্ক থাকা প্রয়োজন …।’

দীপাঞ্জনরা তাঁবুকে ঢুকে এরপর শুয়ে পড়ল। ঘুমের ঘোরেও যেন সে শুনতে থাকল মেঘ গর্জনের মতো সেই ঢাকের শব্দ! রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছিল। হাড়ে যেন কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছিল সবার। তাঁবুর ভিতর গুটিসুটি মেরে শুয়ে রইল সবাই। তবে রাতটা নির্বিঘ্নেই কেটে গেল। পরদিন সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই আবার সারি নদীর পাড় ধরে যাত্রা শুরু হল। বেলা এগোবার সাথে সাথেই প্রচণ্ড গরম শুরু হল। গরমে হাঁসফাস করতে লাগল দীপাঞ্জন। জুয়ান আর শ্যাপেলিওর অবস্থা আরও করুণ। সারা দেহ ঘামে ভিজে উঠল তাদের। আর এরই মাঝে এক শ্বাপদের দর্শন পেল তারা। তৃণভূমির মধ্যে মাঝে মাঝে যে দু-একটা গাছ আছে তারই একটাতে বসে ছিল একটা চিতা। সূর্যের আলোতে ঝলসাচ্ছে তার সোনালি দেহ। তবে সেই চিত্রক মহারাজ তাদের কিছু বলল না। অবজ্ঞার ভঙ্গিতে এই দো-পেয়ে জীবগুলোর প্রতি শুধু একবার তাকাল, তারপর সম্ভবত কোনো শিকারের আশায় তাকিয়ে রইল তৃণভূমির দিকে। দীপাঞ্জনরা কিছুটা তফাত দিয়ে পেরিয়ে গেল সে জায়গা ।

তবে এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আরও কয়েকজনকে তারা দেখতে পেল। চিতা নয় মানুষ। জনা পনেরো মানুষের একটা দল তাদের সাথে সাক্ষাতের জন্য এগিয়ে এল। সাভানার যাযাবর গোষ্ঠী তারা। কয়েক জনের পিঠে বিরাট হাতির দাঁত ঝুলছে। হাতির দাঁত বিক্রি করতে চায় তারা। এমি তাদের জানিয়ে দিল যে ব্যাপারটাতে তারা আগ্রহী নয় । তার সঙ্গীরা সরকারি লোক, সরকারের অতিথি, বিশেষ কাজে তারা চাদ হ্রদে যাচ্ছে। সরকারি লোক শুনে ভয় পেয়ে মুহূর্তের মধ্যে হাতির দাঁত সমেত হাওয়া হয়ে গেল।

তারা চলে যাবার পর এমি হেসে বলল, ‘এক একটা দাঁতের দাম মাত্র একশো ডলার চাইছিল ওরা। ইউরোপের বাজারে এর দাম তিরিশ হাজার ডলার হবে। বহু নিরীহ পৰ্যটক এ দাঁত কিনে ঠকেছে। শহরে এ দাঁত নিয়ে গেলেই পুলিশ ধরবে আপনাকে। দাঁত তো বাজেয়াপ্ত হবেই, সঙ্গে মোটা অঙ্কের জরিমানা। আর তা না দিতে পারলে নিশ্চিত জেল।’ দীপাঞ্জন বলল, ‘এ লোকগুলোর কাছেও কি ঢাকের বাদ্যির মাধ্যমে আমাদের আগমন বার্তা পৌঁছেছে? নইলে কোথা থেকে উদয় হল এরা?”

এমি জবাব দিল, ‘সম্ভবত তাই’। তারপর সে বলল, ‘কাল মাঝরাতেও ঢাক বেজেছে। আমরা যে দিকে যাচ্ছি সেই উত্তর দিক থেকে আসছিল শব্দ। কারা যেন ঢাক বাজিয়ে জানতে চাইছিল আমাদের অবস্থান, চাদের দিকে আমরা কতটা এগিয়েছি। প্রশ্নর জবাবে যেন একটা ঢাক জানান দিল যে তারা আমাদের তখনও দেখেননি। প্রথম ঢাকের শব্দের ধ্বনি শুনে মনে হল যে তারা খুব কৌতূহলী আমাদের ব্যাপারে।’

যতটা সম্ভব দ্রুত পা চালাতে লাগল সকলে৷ মাঝে হয়তো মিনিট দশেকের জন্য বিশ্ৰাম, তারপর আবার চলা। নদীর পাড়ের জঙ্গল এক সময় ঘন হয়ে উঠতে শুরু করল। এমি বলল, ‘আমরা যে চাদের কাছাকাছি পৌঁছচ্ছি এটা তার প্রমাণ।’

বেলা বারোটা নাগাদ উঁচু একটা টিলার ওপর উঠে এল তারা। এমি উত্তর দিকে তাকিয়ে বলল, “ওই দেখুন।’

দিগন্তে নীল আকাশ যেখানে মাটির সাথে মিশেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে একটা রুপোলি রেখা। চাদ হ্রদ। সেই রেখাকে আবৃত করে একটা কালো রেখাও আছে। চাদের তীরবর্তী জঙ্গল। এমি বলল, ‘আশা করি ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যেই ওখানে পৌঁছে যাব।’

টিলা থেকে নেমে দ্বিগুণ উৎসাহে চলতে লাগল সবাই। ক্রমশ সেই রুপোলি ফিতার মতো রেখা চওড়া হতে লাগল। কাছে এগিয়ে আসতে লাগল চাদ। তারপর সত্যিই এক সময় তারা পৌঁছে গেল তাদের মোহানায়। দীপাঞ্জনদের দু-দিনে পথ চলার সঙ্গী সারি নদী সবাইকে বিদায় জানিয়ে এখানে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল চাদ হ্রদে।

হ্রদ নয়, যেন সমুদ্র। তার এপার ওপার দেখা যাচ্ছে না। সভ্যতার উষা লগ্নে এই চাদ হ্রদকে কেন্দ্র করেই পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সভ্যতার পত্তন হয়েছিল। এমি বলল এ-হ্রদের ব্যাপ্তি প্রায় ষোলো হাজার বর্গকিলোমিটার। চাদ-ক্যামেরুন-নাইজেরিয়া এবং নাইজার, এই চারটে দেশের আন্তর্জাতিক সীমানা চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে হ্রদটাকে। দীপাঞ্জনরা বেশ কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল সেই সমুদ্র সমান হ্রদের দিকে। তারা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে ঘাসে ছাওয়া ঢালু জমি নেমে গেছে হ্রদের দিকে। দীপাঞ্জন বলল, ‘আপনারা একটু দাঁড়ান নীচে নেমে একটা ছবি তুলে আনি। এমি সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘না এখানে নয়, অন্য জায়গাতে তুলবেন, ওই দেখুন।’

ঢালু জমিটা হ্রদের পাড়ে যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে কাদা মাটিতে লম্বা লম্বা কালো কালো অনেক দাগ জেগে আছে। ভালো করে দেখার পর দীপাঞ্জন বুঝতে পারল ওগুলো আসলে কুমির। কাদা মাটিতে গা ঢুবিয়ে রয়েছে তারা। তাদের পিঠের কাঁটাগুলো শুধু জেগে আছে কালো রেখার মতো। মোহানাটা থিক থিক করছে কুমিরে। এমি বলল, ‘আপনাদের একটা মজার জিনিস দেখাই!’ এই বলে সে কাঁধ থেকে রাইফেল খুলে শূন্যে একটা ফাঁকা আওয়াজ করল। সেই শব্দে কেঁপে উঠল চারদিক। আর তার সাথে সাথেই নড়ে উঠল হ্রদের পাড়টা। তারা সঞ্চারণশীল হয়ে উঠল। বন্দুকের আওয়াজে ভীত হয়ে দ্রুত বুকে হেঁটে শয়ে শয়ে কুমির ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল নদীর জলে। এক ভয়ংকর সুন্দর দৃশ্য। এ কয়েকটা মানুষ তো কোন ছার, একপাল হাতি ওখানে গেলেও আর ফিরবে না। এমি জানাল হরিণ-অ্যান্টিলোপরা যত সংখ্যক লেপার্ড-চিতা-সিংহের পেটে যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি মারা পড়ে জল খেতে এসে কুমিরের শিকার হয়ে।

মোহানার দিক থেকে তেরছাভাবে একটু উত্তর-পশ্চিমে এরপর হাঁটা লাগালো তারা। ঘাসবন এখানে অনেক বড়ো। অন্য গাছপালাও আছে। আরও ঘণ্টাখানেক চলার পর হঠাৎ যেন জঙ্গল ফিকে হয়ে এল। জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ল একটা উন্মুক্ত জায়গা। কিছু অস্পষ্ট কুটির। এমি বলে উঠল, ‘উংগোয়ার।’ অর্থাৎ ‘গ্রাম’। ‘আমরা এসে গেছি!”

৷৷ ৪ ৷৷

বেশ বড়ো বড়ো কয়েকটা গাছের ছাওয়ায় গ্রামটা। ধানের গোলার মতো দেখতে পাতায় ছাওয়া কুটির। বুক সমান উঁচু কাঠের গুঁড়ি আর ক্যাকটাসের বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা গ্রাম। সেই বেষ্টনীর গায়ে লম্বা লম্বা খুঁটির মাথায় বসানো আছে নানা বন্যজন্তুর খুলি। দীপাঞ্জন জানতে চাইল, ‘তুমি কি এ গ্রামেরই বাসিন্দা ?”

এমি জবাব দিল, ‘আমার গ্রাম চাদের তীরে হলেও আরও অনেক দূরে। আমার আর কেউ নেই সেখানে। দশ বছর আগে পনেরো বছর আগে এক মিশনারির সাথে আমি শহরে চলে যাই। জাতিদাঙ্গায় আমার পরিবারের সবাই মারা গেছিল। আমি জাতিতে কানুরি। আর এরা ফুলানি। কানুরি, ফুলানি, মোব্বার, হাউমা, বুদুমা এমন ছাব্বিশটা বিভিন্ন উপজাতি বাস করে চাদ হ্রদের ধারে। নিজেদের মধ্যে খুব একটা সুসম্পর্ক রাখে না এরা। প্রায়শই দাঙ্গা হয়। তখন এই আপাত নিরীহ মানুষগুলোই খুব হিংস্র হয়ে ওঠে। তবে এই ফুলানিরা মোটামুটি বন্ধুবৎসল। কিছু ফুলানি গ্রাম খ্রিস্টান বা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও এরা এখনও লৌকিক ধর্ম পালন করে। সাদা চামড়ার লোকদের প্রতি এদের সম্ভ্রমও আছে, ঘৃণাও আছে।’ কথা বলতে বলতে গ্রামটার দিকে এগোল তারা। কিছুটা তফাত থেকে তারা দেখতে পেল গ্রামের প্রবেশ তোরণে গ্রামবাসীরা সমবেত হয়েছে তাদের অভ্যর্থনা জানাবার জন্য। এমি বলল, ‘এরাও সম্ভবত ঢাকের বাজনার মাধ্যমে আমাদের আগমন বার্তা পেয়েছে।’

প্রায় একশোজন মানুষের একটা দঙ্গল অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। দীপাঞ্জনরা তাদের সামনে উপস্থিত হল। সিংহচর্ম পরিহিত একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে সবার প্রথমে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বর্শাধারী কয়েকজন লোক। তাদের পিছনে আরও কিছু পুরুষ, সব শেষে মহিলা ও শিশুরা। তাদের কারও কোলে বাচ্চাও আছে। সুবার চোখে উৎসুক দৃষ্টি। একটা বর্শার ওপর ভর দিয়ে লোকটা দাঁড়িয়ে ছিল, তার মাথায় গোজা শিং-অলা একটা হরিণের ধবধবে সাদা খুলি। এমি সেই বৃদ্ধকে অভিবাদন জানিয়ে বলল, ‘এরা এ-দেশে সরকারি অতিথি হয়ে এসেছেন। গ্রাম দেখতে এসেছেন, কিছু কেনাকাটা করবেন।’

তার কথা শুনে বুড়োটা প্রথমে তার ছানিপড়া চোখে ভুরু কুঁচকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল দীপাঞ্জনদের। বিশেষত প্রফেসার জুয়ান আর শ্যাপলিওর দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখল লোকটা। তারপর মনে হয় আশ্বস্ত হল সে। ফোকলা দাঁতে এমির দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “বেশ ভালো কথা। তবে তোমাকে যেন আমার চেনা লাগছে।’ এমি জবাব দিল, ‘বেশ কয়েক বছর আগে একবার ট্যুরিস্ট নিয়ে এ পথে যাচ্ছিলাম,

তখন একবার দেখা হয়েছিল তোমার সাথে ।

বুড়োটা জবাব দিল, “তা হবে। অনেক কাল এই চাদের দেশে কাটালাম। এখন আর সব কিছু মনে থাকে না। বুড়োটার সাথে এমির এ-সব কথাই অবশ্য হল দেশীয় ভাষায়।

বিরাট বড়ো, শাখাপ্রশাখা অলা একটা হরিণের শিং শোভিত প্রবেশতোরণ অতিক্রম করে গ্রামে পা রাখল সবাই। এগোতে এগোতে এমি বলল, ‘আমি আপনাদের পরিচিত সরকারি অতিথি হিসাবে দিয়েছি’। ‘সরকার’ শব্দটা এরা ভয় পায়। বুড়ো লোকটার নাম “তিকাকা’, ও-এ গ্রামের মোড়ল। তবে আসল লোক কিন্তু ওর এই সাঙ্গোপাঙ্গারা। তারাই সব সিদ্ধান্ত নেয়, আর বিদেশি বা সরকারি লোকরা এলে তাদের সামনে বুড়ো মোড়লদের খাড়া করে দেয়।’

গ্রামের ঠিক মাঝখানে উপস্থিত হল তারা। সেখানে এক বিরাট গাছতলায় বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। সেখানেই মোড়ল তিকাকার ঘর, আর তার পাশেই গ্রামের অতিথি নিবাস-পাতায় ছাওয়া একটা আধো অন্ধকার ঘর। তিকাকার নির্দেশে সে ঘরে জিনিসপত্র রাখা হল। এমি তার জিনিসপত্রর মধ্যে থেকে বেশি কিছু মোটা সুতোর রঙিন চাদর বার করে জুয়ান-দীপাঞ্জন-শ্যাপেলিওর হাতে দিল। মোড়ল বুড়োকে নজরানা দিতে হবে। তার সেই ঘর থেকে বেরোনোর সাথে সাথেই গাছতলায় একজন ঢাক বাজাতে শুরু করল। ফাঁপা গাছের গুঁড়ির তৈরি কথাবলা ঢাক। এমি বলল, ‘গ্রামে অতিথি আসার খবর জানান দিচ্ছে এরা।’

বাইরে এসে গাছতলায় একটা উঁচু বেদির মতো জায়গায় তিকাকা-র আমন্ত্রণে তারা বসল। চাদরগুলো তার হাতে তুলে দিতেই হাসি ফুটে উঠল তিকাকার বলিরেখাময় মুখে। উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার সঙ্গীদের চোখ। তিকাকা আর তার সঙ্গীদের সাথে দুর্বোধ্য ভাষায় কথা শুরু হল এমির। দীপাঞ্জনরা নীরব দর্শক। সূর্য ঢলতে শুরু করল। পাতার কুটির থেকে বেরিয়ে গ্রামের সবাই গাছের সামনে ফাঁকা জায়গাতে সমবেত হল। এরপর হঠাৎই একটা শিঙা বেজে উঠল। তা শুনে যে-যার জায়গা ছেড়ে সার বেঁধে আকাশের দিকে তাকিয়ে একসাথে কী যেন বলতে শুরু করল সবাই। এমি বলল, ‘ওরা অপদেবতাদের উদ্দেশে প্ৰাৰ্থনা জানাচ্ছে। রাত আসছে, যাতে তারা গ্রামে হানা না দেয় সে জন্যই এই প্রার্থনা। আর এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝুপ করে অন্ধকার নামল। গ্রামের ঠিক মাঝখানে গাছের নীচে ফাঁকা জায়গাতে একটা বড়ো অগ্নিকুণ্ড জ্বালানো হল। এমির সাথে গ্রামের লোকদের কথা শেষ হলে জুয়ান তার কাছে জানতে চাইলেন, ‘কী কথা হল?’

শ্যাপলিও জিজ্ঞেস করলেন, ঢাকের ব্যাপারে ওরা কী বলল ? ”

এমি বলিল, উভয় তরফ থেকেই গ্রাম আর শহরের খবরের আদান-প্রদান হল। কাল সকালে ওরা ঢাক দেখাবে বলছে।’

শ্যাপলিও বললেন, ‘ফুলানি ট্যাম ট্যাম?’

এমি কী যেন ভেবে একটু চুপ করে থেকে বলল, “কী দেখায় দেখি? সে ঢাক তো এ গ্রামে থাকার কথা ।’

দীপাঞ্জনদের রাতে খাবার ব্যবস্থা হলো ঝলসানো হরিণের মাংস আর রুটি দিয়ে। খাওয়া সেরে সেদিনের মতো শুয়ে পড়ল সকলে ।

সারাদিন এতটা পথ আসতে অনেক পরিশ্রম হয়েছে। শেষবার কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্যাপেলিও নাক ডাকতে লাগলেন। প্রফেসরও ঘুমিয়ে পড়লেন। এমি মাঝে মাঝে নড়ছে। সে শুয়েছে দীপাঞ্জনের পাশে। দীপাঞ্জনের ঘুম আসছে না। তাদের আনা ছোট্ট একটা ব্যাটারির আলো জ্বলছে ঘরের কোণে। সারা গ্রাম ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু গ্রামের বাইরে থেকে অস্পষ্টভাবে ভেসে আসছে নানা জন্তু-জানোয়ারের ডাক। শুয়ে শুয়ে সে-সব শব্দ শুনতে লাগল দীপাঞ্জন । আর তার পরই সে-শব্দ ছাপিয়ে সে শুনতে পেল অনেক দূর থেকে আসা দ্রিমিদ্রিমি ঢাকের বাজনা। কান খাড়া করে সে বুঝতে পারল বিভিন্ন ছন্দে, বিভিন্ন লয়ে বাজছে সে-ঢাক। তার একবার মনে হল যে এমিকে জাগিয়ে ঢাক কী বলছে তা জানে ৷ কিন্তু পরিশ্রান্ত এমির ঘুম ভাঙানো সে সীমাচীন মনে করল না। বেশ কয়েকটা কাগজ কার্ডবোর্ডের বাক্স সহ অধিকাংশ মাল সে একাই বয়ে এনেছে। রাইফেলটার ওজনও কম নয় ৷ একাই ঢাকের বাজনা শুনতে লাগল দীপাঞ্জন। কিন্তু এরপর হঠাৎই সে-বাজনা ছাপিয়ে গ্রামের ভিতর থেকে বা বাইরে খুব কাছাকাছি জায়গা থেকে বেজে উঠতে লাগল আর-একটা ঢাক! নীচু খাদের হলেও বেশ তীক্ষ্ণ শব্দ। এত রাতে এ-গ্রামের লোক কী খবর পাঠাচ্ছে! কোথাও কী তবে কিছু ঘটেছে? ব্যাপারটা দীপাঞ্জনের বোধগম্য হচ্ছে না। শব্দটা বেশ সুরেলা হচ্ছে মাঝে মাঝে । অনেকটা নাকিসুরে কথা বলার মতন ! আর এর পরই ঘুম জড়ানো চোখে হঠাৎ উঠে বসল এমি। অস্পষ্ট স্বরে সে বলে উঠল,—‘ফুলানি ট্যাম ট্যাম! ফুল্যানি ট্যাম ট্যাম!’ তারপর যেন আতঙ্কে একটা দুর্বোধ্য চিৎকার করে উঠল। তার সেই চিৎকারে জুয়ান আর দীপাঞ্জন উঠে বসল। ঘরের আধো অন্ধকারেও তারা বুঝতে পারল এমির চোখে মুখে আতঙ্কর স্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠেছে। দীপাঞ্জন তাকে ধরে ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘এমি তোমার কী হয়েছে ?

এমি আবার অস্পষ্টভাবে বলল, ‘ফুল্যামি ট্যাম ট্যাম!’ ঠিক তখনই সেই ঢাকের বাজনা থেমে গেল। এমিও যেন তার চেতনা ফিরে পেল। পাশে রাখা বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে জল খেয়ে বলল, ‘ক্ষমা করবেন, মনে হয় কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম। শুয়ে পড়ুন সবাই।’

পরদিন মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙল সবার । প্রাতঃরাশ সেরে তৈরি হয়ে যখন তারা বাইরে বেরোল তখন গাছতলায় সেই চত্বরে বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে বিভিন্ন রকম ঢাক নিয়ে। আজ বেশ রঙচঙে পোশাকে তারা। গলায় পাথরের মালা, মাথায় পালকের সাজ। সম্ভবত খদ্দেরদের প্রলুব্ধ করার জন্যই অমন সাজ তাদের। তাদের মধ্যমণি দীপাঞ্জনদের দেওয়া লাল শাল গায়ে তিকাকা। ফোকলা দাঁতে হেসে সে অভিবাদন জানাল দীপাঞ্জনদের। তারপর অতিথিদের উদ্দেশে এক নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিল। তার মমার্থ এমির মাধ্যমে অনূদিত হল। এ-গ্রামের মতো ঢাক নাকি আফ্রিকার কোথাও আর পাওয়া যায় না। সরকারি লোকেরাই শুধু তাদের থেকে কেনে তা নয়, ক্যামেরন, লিবিয়া, নাইজেরিয়া থেকেও লোকে তাদের ঢাক কিনেছে। দামও খুব সস্তা। ‘বাতুরি’ অর্থাৎ ‘কত্তা’রা যদি ঢাক কেনেন তবে গ্রামের লোকেরা নিখরচায় এঞ্জামেনা পর্যন্ত সে-ঢাক পৌঁছে দিয়ে আসবে।

তিকাকা-র ইশারায় এরপর এক-এক করে ঢাকগুলো বাজতে শুরু করল বাতুরিদের ঢাকের গুণ দেখাবার জন্য। নানা ছন্দ, নানা খাদে, অজানা ভাষায় কথা বলতে লাগল তারা, বাজনা শুধু এমি বোঝে। সে মন্তব্য করল, ঢাকগুলো সত্যিই ভালো। এরা মিথ্যে বলেনি।’ শ্যাপেলিও তার কথা শুনে বললেন, ‘আমি যে ঢাকের খোঁজে এসেছি তার ছবি আমি দেখেছি। সে-ঢাক এখানে দেখছি না। এসব ঢাকই আমি মিউজিয়ামের জন্য নেব। কিন্তু সবার আগে সে-ঢাক চাই। ব্যাপারটা ওদের বলো।’

এমি, তিকাকা-র উদ্দেশ্যে বলল, ‘এ-সব ঢাকই আমরা কিনব একটা শর্তে। ‘সব ধরনের ঢাক নেবে!’—এতটা আশা করেনি তারা। তিকাকা জিজ্ঞেস করল, শর্ত?’

এমি জবাব দিল, ‘একটা ফুলানি ট্যাম ট্যাম দিতে হবে আমাদের। যা দাম লাগে দেব।’

ফুলানি ট্যাম ট্যাম!—একথাটা কানে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সব ঢাকের বাজনা এক সাথে থেমে গেল। তিকাকা সহ তার অনুচররা বিস্মিতভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল দীপাঞ্জনদের দিকে। তিকাকা এরপর গম্ভীরভাবে বলল, ‘ও-ঢাক নেই। ও-ঢাক আমরা আর বানাই না । সরকারি নিষেধ আছে।’

এমি বলল, “তা জানি। কিন্তু আমিও তো চাদের তীরের মানুষ। আমি জানি তোমাদের কাছে একটা ওই ট্যাম ট্যাম আছে।’

বৃদ্ধ এবার জবাব দিল, “হ্যাঁ তা একটা ছিল। আমার আগে যে মোড়ল ছিল সেই তুয়াতুয়া বানিয়ে ছিল সেটা। অনেক কাল আগের ঘটনা সেটা। সে সময় জাতি দাঙ্গা চলছিল। ঢাকটা বানাবার পরই তুয়াতুয়া যুদ্ধে মারা যায়। ঢাকটাও হারিয়ে যায়।

এমি তার কথা শুনে বলে উঠল, “কিন্তু কাল রাতেও ওর বাজনা শুনেছি আমি। ও-শব্দ আমি চিনি। খুব কাছেই বাজছিল, তার মানে ওটা এখানেই আছে। বলছি তো ওর জন্য আমরা ভালো পয়সা দেব।’

এমির কথা শুনে তিকাকা-র মুখ দেখে মনে হল সে যেন এবার ধরা পড়ে গেছে। বাধ্য হয়ে সে এবার বলল, ‘হ্যাঁ, ওটা আছে একজনের কাছে। তবে ঠিক আমাদের কাছে নয় ৷’ ‘কার আছে? তার খোঁজ দাও। আমরা কথা বলব তার সাথে। খোঁজ না দিলে আমরা অন্য গ্রামে চললাম। যেখানে ও-ঢাক পাওয়া যাবে, সেখান থেকেই ও-ঢাক আর অন্য ঢাক নেব।’ তিকাকাকে কথাটা বলে দীপাঞ্জনদের কথাগুলো তর্জমা করল এমি।

এমির স্পষ্ট উক্তি শুনে এবার যেন সমস্যায় পড়ে গেল তিকাকা আর তার লোকজন। শেষে কী এত বড়ো ক্রেতারা হাতছাড়া হয়ে যাবে। নিজেদের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ শলাপরামর্শ করল তারা। তারপর তিকাকা যেন একটু ভয় ভয়ে বলল, “ওটা আছে জুজু কুরির কাছে। আসলে ওকে আমরা বেশি ঘাটাই না। ও-রাতে কুরি হয়ে যায় । জিনিসটা ওকে আমরা ভয়ে দিয়ে দিয়েছি। ও-গ্রামের বাইরে হ্রদের দিকে একটা কুঁড়েতে একলা থাকে। তোমাদের সাথে দু-জন লোক দিচ্ছি। তারা তোমাদের ওর কাছে নিয়ে যাচ্ছে। দেখো ও-জিনিসটা বিক্রি করতে রাজি কিনা? সাদা চামড়ার লোকদের সবাই খাতির করে। তার ওপর আবার সরকারের অতিথি। তাই দিলে দিতেও পারে। তবে একটাই অনুরোধ সে যাই করুক, এ-গ্রাম থেকে ঢাকা কিনো তোমরা। এবার শুখা মরসুম খুব খারাপ গেছে। শস্য ফলাতে পারিনি। এক-একটা ঢাকের জন্য তিনশো ফ্রাঙ্ক দিলেই হবে।’

এমি বলল, ‘তোমাদের ব্যাপারটা আমরা অবশ্যই ভাবব।’

৷৷ ৫ ৷৷

দীপাঞ্জনরা আবার নিজেদের কুটিরে ফিরে এল দরকারি কিছু জিনিস নেবার জন্য। এমি বলল, ‘কিছু নয়, সবই সঙ্গে নেব। এ-দেশে একটা প্রবাদ আছে, যাত্রা শুরুর পর তুমি আর কোনো দিন আগের জায়গাতে ফিরে না আসতে পারো। এটাই এখানকার নিয়ম। তেমন হলে আমরা এখানে না ফিরে অন্য গ্রামের পথে ঢাকের খোঁজে রওনা দেব। তাছাড়া আমাদের অবর্তমানে ওরা কৌতূহলী হয়ে আমাদের জিনিস ঘাঁটুক সেটাও কাম্য নয়।” এ-পথে গাইডের নির্দেশ মানা খুব জরুরি। অগত্যা সব জিনিস নিয়ে আবার কুটিরের বাইরে এল সবাই। গাছের নীচে বর্শা হাতে দু-জন পথপ্রদর্শক তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। দীপাঞ্জনরা কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের সাথে গ্রাম ছেড়ে রওনা হল জুজু কুরির ডেরার উদ্দেশ্যে।

যেতে যেতে এমি বলল, ‘জুজু’ শব্দের অর্থ জাদুকর। গ্রামের মানুষরা সবাই তাকে ভয় করে।’

বাংলা ভাষায় ‘জুজু’ বলে ভীতিকর একটা শব্দ আছে। দীপাঞ্জনের মনে হল, ‘কে জানে কোনোভাবে আফ্রিকা থেকেই হয়তো এই ভয়সূচক শব্দ সুদূর ভারতবর্ষে পৌঁছেছিল। জুয়ান বললেন, ‘আর ‘কুরি’ শব্দের মানে ? ”

‘হায়না’-কে এখানে ‘কুরি’ বলে। এসব গ্রামীণ ওঝা জাদুকররা মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য নিজেদের সম্বন্ধে নানাকথা প্রচার করে। কেউ নাকি রাতে সিংহ হয়ে যায়। কেউ-বা চিতা অথবা হায়না। আফ্রিকার গ্রামীণ মানুষরা খুব সরল হয়। তারা ভূত-প্রেত-মন্ত্র-তন্ত্র, এ ধরনের নানা অলৌকিক ব্যাপার বিশ্বাসী।’—জবাব দিল এমি ।

প্রফেসার জুয়ান দীপাঞ্জনকে বললেন, ‘শেন, সত্যিই মহাদেশ বড়ো বিচিত্র, কত ধৰ্ম, কত লৌকিক আচার, কত ভাষা এ-মহাদেশে। মানবজাতির উন্মেষ যেখানে হয়েছিল তার মধ্যে এ-মহাদেশ অন্যতম। ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দেও এরা লোহা গলানোর ব্যবহার জানত। ২০০০ প্রাচীন জনগোষ্ঠী বাস করে এ-মহাদেশে তাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিয়ে। ৬ টি ইউরোপীয় ভাষা ছাড়া ৭৫০টি আদিবাসী ভাষা আছে। শুধু কঙ্গোতেই ৭৫টি ভাষায় কথা বলে মানুষ। আবার দক্ষিণ আফ্রিকার লোকেরা কথা বলে ষোড়শ শতাব্দীর কথ্য ওলন্দাজ ভাষায়। সারা পৃথিবীর অন্য কোথাও এমনকি ওলন্দাজদের দেখেও সে-ভাষায় কেউ কথা বলে না, অথচ আফ্রিকায় ভাষাটা টিকে আছে। চাদের অন্যতম সরকারি ভাষাই তো ফরাসি । কোথায় চাদ আর কোথায় ফ্রান্স। আসলে এরা প্রাচীন ভাষা সংস্কৃতির প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল। এই যে ওঝা, গুনিন, জাদুকরদের ব্যাপারটা এদেরকে এরা শুধু ভয়ে মান্য করে তা নয়, এ-লোকগুলোও আফ্রিকানদের প্রাচীন সংস্কৃতির অঙ্গ, তাই এ-কারণেও তাদের মান্য করে লোকেরা।’

গ্রাম ছেড়ে সবাই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলল চাদ হ্রদের দিকে। সবার আগে আগে চলছে সেই বর্শাধারী দুজন। জঙ্গলের দিকে সতর্ক দৃষ্টি। কোনো কথা বলছে না তারা। চোখে মুখে কেমন যেন অসন্তোষের ভাব। যেন নিতান্ত অনিচ্ছাকৃতভাবে তিকাকা-র নির্দেশে আসতে হয়েছে তাদের। চলতে চলতে হঠাৎ জঙ্গলের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গাতে অদ্ভুত একটা চিহ্ন দেখে এমি দাঁড়িয়ে পড়ল। সেখানে ঘাসহীন শক্ত খটখটে মাটি। তার ওপর স্পষ্ট জেগে আছে গাড়ির চাকার দাগ! সে সময় হয়তো ভেজা নরম মাটিতে চাকার দাগ গেঁথেছিল। মাটি শুকিয়ে দাগগুলো এখন ছাঁচের মতো আঁকা হয়ে গেছে।

জুয়ান বিস্মিতভাবে বললেন, ‘এখানে গাড়ি আসে ?’

এমি লোকগুলোকে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করায় একজন বলল, ‘বর্ষার পর মাস তিনেক আগে মিলিটারি এসেছিল এখানে। সে ছাপ রয়ে গেছে। আমরা আর কিছু জানি না এ-ব্যাপারে।’

এমি বলল, ‘জঙ্গি কার্যকলাপ দমনের জন্য আর্মি মাঝে মাঝে এই সব প্রত্যন্ত অঞ্চলে টহল দেয়। তাই হয়তো এসেছিল আর এর কিছুক্ষণ পরই এগোতে এগোতে নদীর পাড়ের কাছাকাছি তারা দেখতে পেল জাদুকর কুরির কুঁড়োটা।’

দীপাঞ্জনরা ঘরটার সামনে উপস্থিত হল।

কুঁড়ে না বলে ঘরটাকে তাঁবু বলাই ভালো। কুমিরের চামড়ার আচ্ছাদন দিয়ে বানানো ঘরটা। বিভিন্ন পশুপাখির খুলি, হাড়গোড়, চামড়া ইত্যাদি তার গায়ে ঝুলিয়ে কুটিরের বহিঃসজ্জা করা হয়েছে। দীপাঞ্জনরা দেখতে পেল সেই অদ্ভুত ঘরটার প্রবেশপথের ঠিক বাইরে শিকলে বাঁধা আছে ছোটোখাটো একটা হায়নার বাচ্চা। এমি তার রাইফেল শ্যাপেলিওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা আপনার হাতে রাখুন। বন্দুকধারী সাহেবকে এখনও এখানে লোকে ভয় পায়। ঘরটার দিকে আর একটু এগোতেই হায়নার বাচ্চাটা কুকুরের মতো গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হ্যা, হ্যা, করে ডেকে উঠল আর সেই ডাক শুনেই হয়তো গৃহকর্তা বাইরে বেরিয়ে এলেন। মাঝবয়সি লোক, চোখ দুটো ভাঁটার মতো লাল। পরনে হায়নার চামড়ার আচ্ছাদন। হায়নার চামড়াশুদ্ধ দাঁত বার করা মাথাটা হেলমেটের মতো লোকটার মাথায় বসানো আছে গলায় অগুনতি পাথরের মালা। কবজিতে বাঁধা আছে সিংহের লোম।

লোকটা সতর্ক চোখে ভালো করে দেখল আগন্তুকদের। একটা দুর্বোধ্য হাসি ফুটে উঠল ·তার মুখে। সে হলদেটে দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘আমি জানতাম তোমরা এখানে আসবে।’

‘কী ভাবে জানলে?’ প্রশ্ন করল এমি।

জাদুকর কুরি জবাব দিল, ‘আমি সব জানতে পারি। পরশু রাতে আমি তো তোমাদের পিছন পিছনই আসছিলাম। হায়নার বেশে। ডাক শোনোনি? পেট ভরা ছিল বলে কাউকে ধরিনি।’

এমি তার কথা তজমা করল। এ পথে আসার সময় হায়নার ডাক শোনা স্বাভাবিক । শ্যাপেলিও কথাটা শুনে এমির মাধ্যমে লোকটাকে বন্দুক নাচিয়ে বলল, ‘কাছে আসেনি ভালো করেছ। আমার বন্দুকের টিপ সাংঘাতিক। তোমার ভবলীলা সাঙ্গ হত।’ মুখের ওপর এ-কথা শুনে একটু থমকে গেল জাদুকর। সম্ভবত সে বুঝল এ লোকগুলোকে ভয় পাওয়ানো যাবে না।

এমি এবার তাকে বলল, ‘এরা হল সরকারি অতিথি। সরকারি লোকই বলতে পারো । এরা একটা জিনিস কিনতে এসেছে।’

জাদুকর এবার হেসে বলল, ‘হ্যাঁ আমি জিনিস বেচি বটে। সিংহের কেশর, লেজের লোম, হায়নার দাঁত, হিপোর তেল, কুমিরের চামড়া, নানা অদ্ভুত জিনিস। ওসব সঙ্গে থাকলে ভূতপ্রেত কাছে ঘেঁষে না। রোগব্যাধিও হয় না। অনেক সাদা চামড়াও এসব কিনে নিয়ে যায়। তোমাদের কী লাগবে বলো?”

এমি বলল, ‘ওসব নয়। আমরা ঢাক কিনতে এসেছি।’

ঢাক! সে তো গ্রাম পাওয়া যায়। আমার কাছে কেন ?”

এমি বলল, ‘না সে-ঢাক নয়। আমরা ‘ফুলানি ট্যাম ট্যাম’ কিনতে এসেছি । কাল রাতে যেটা তুমি বাজাচ্ছিলে?’

‘ফুলানি ট্যাম ট্যাম!” কথাটা শুনেই জাদুকরের মুখটা যেন বদলে গেল। তিকাকা-র মতোই সে বিস্মিতভাবে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে।

এমি তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী কথা বলছ না কেন?”

জাদুকর এবার গম্ভীরভাবে বলল, ‘ও ঢাক আমি বেচব না। ওটা আমার কাজে লাগে। ফুলানি ট্যাম ট্যাম চেনো তোমরা?

এমি উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ চিনি। ঢাকটা বেচলে ভালো দাম পাবে। তাছাড়া শহরের খবর কিছুদিনের মধ্যেই ও-ঢাক নিষিদ্ধ করতে চলেছে সরকার। তখন সরকারি লোক এসে জিনিসটা বাজেয়াপ্ত করবে। তার চেয়ে এ বেলা বেচে দাও। ভালো দাম পাবে। দু-পক্ষেরই লাভ এতে।’

এমির কথা শুনে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল লোকটা। তারপর বলল, ‘পাঁচ হাজার ফ্রাঙ্ক দিতে হবে পারবে?’

এমি ব্যাপারটা জানাল শ্যাপেলিওকে ৷ লোকটা অনেক টাকা চাইছে। গ্রামে একটা ঢাকের দাম তিনশ ফ্রাঙ্ক। আর এ-ঢাকের দাম পাঁচ হাজার ফ্রাঙ্ক! কিন্তু শ্যাপেলিও শুনে বললেন, ‘জিনিসটা খাঁটি হলে দরটা সমস্যা নয় ।’

এমি জাদুকরকে বলল, ‘জিনিসটা আগে দেখাও তুমি। পছন্দ হলে অবশ্যই নেব।’

জাদুকর কুরি এবার ঘরের ভিতর ঢুকল। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢোলকটা বাইরে আনল গলায় ঝুলিয়ে, তার হাতে দুটো কাঠি। দীপাঞ্জনরা ঘিরে দাঁড়াল জাদুকরকে। ছোট্ট একটা ঢাক । একটা কাঠের বাটির ওপর চামড়ার আচ্ছাদন। খুব বেশি হলে তার ব্যাস সাত ইঞ্চি হবে। জাদুকরকে গলায় ঢোলকটা ঝোলানো অবস্থাতেই তার চামড়ার ওপর একবার হাত বুলাল এমি। কেমন যেন একটা অদ্ভুত ভাব ফুটে উঠল তার চোখে। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে যেন বলল, “হ্যাঁ, এ ঢাকের দাম অনেক বেশি হওয়াই উচিত। খাঁটি জিনিস কোনো সন্দেহ নেই।’

জাদুকর এরপর জিনিসটার গুণাগুণ দেখাবার জন্যই মনে হয় বাজাতে শুরু করল ঢাকটা। মুহূর্তের মধ্যে শব্দ ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। ট্যামট্যাম, ট্যামট্যাম!’ এইটুকু ঢাক থেকে বিরাট ঢাকের মতো এত জোরালো শব্দ ছড়িয়ে পড়তে পারে তা ধারণা ছিল না দীপাঞ্জনদের। অবাক হয়ে গেল তারা। কিন্তু এরপরই অন্যদের চমকে দিয়ে এমি জাদুকরের হাত দুটো চেপে ধরে বলল, ‘বাজনাটা বন্ধ করো, বন্ধ করো।’

বাজনা থেমে গেল। এমির চোখমুখ কেমন যেন অদ্ভুত আতঙ্কগ্রস্ত লাগছে। শ্যাপেলিও জিজ্ঞেস করলেন, ‘এমি তোমার কী হল ? ‘

এমি বলল, “আসলে এ-বাজনার তরঙ্গটা আমি কেন জানি না সহ্য করতে পারি না। কানে লাগে’।

জুয়ান হেসে বললেন, “হ্যাঁ এমন অনেকের হয়। এই আমারই যেমন কাঠের ওপর করাত চালাবার ঘ্যাস ঘ্যাস শব্দে কেমন একটা অস্বস্তি হয়। শব্দ মানুষের মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে।’

ট্যামট্যাম নিয়ে দর কষাকষি একটা হল। শেষ পর্যন্ত চার হাজার ফ্রাঙ্ক দাম ধার্য হল। শ্যাপেলিও কড়কড়ে চার হাজার ফ্রাঙ্ক কুরির হাতে দিল। কুরি শ্যাপেলিওর গলায় ঝুলিয়ে দিল ঢোলকটা। গর্বের হাসি ফুটে উঠল শ্যাপেলিওর ঠোঁটে।

জাদুকর বলল, ‘আর মাত্র পাঁচশো ফ্রাঙ্ক দিলে আমি আপনাদের একটা অদ্ভুত জিনিস দিতে পারি। কাছেই জঙ্গলে সেটা রাখা আছে। জঙ্গলে তো এখন ঢুকতেই হবে আমাদের। ট্যামট্যামটা নিয়ে তো অনেক দূর পাড়ি দেবেন আপনারা। ট্যামট্যামের চামড়াটা খুব যত্নে রাখতে হয়। এক ধরনের বিশেষ গাছের পাতা দিয়ে জিনিসটা মুড়ে দেবো আমি। নইলে চামড়া নষ্ট হবে।

তার কথা শুনে শ্যাপেলিও জানতে চাইলেন, ‘আর একটা জিনিস কী? কোনো নিষিদ্ধ জিনিস নয় তো?’

জাদুকর হেসে বলল, “না নিষিদ্ধ নয় তবে ও জিনিসও আপনারা পাবেন না। ওকে বলে ‘উগো’, ক্যামেরুনের শিঙা। কাঠের তৈরি যে-শিঙা থেকে অবিকল সিংহর ডাক বেরোয় ৷ ক্যামেরুনের শিকারিরা উগো বাজিয়ে সিংহকে ফাঁদে ফেলে সিংহ শিকার করে ?

ব্যাপারটা শুনে দীপাঞ্জন একটু উৎসাহিত হয়ে বলল, ‘এ-জিনিসটা স্যুভেনির হিসাবে আমি নিতে পারি।’

শ্যাপেলিও হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি আপনার জন্য ওটায় হাত বাড়াব না।’

ট্যামট্যামটা নিয়ে এরপর জাদুকর কুটির থেকে তার সাথে জঙ্গলের দিকে পা বাড়াল দীপাঞ্জনরা। ঠিক যে পথে তারা এসেছিল ঠিক সে পথে নয়, একটু অন্যদিকে হ্রদের পাড়ের সমান্তরাল জঙ্গলের দিকে। গ্রাম থেকে যে লোক দু-জন এসেছিল তাদের মধ্যে এবার একজন হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘আমরা যে পথে এসেছিলাম সে পথেই যাব। পাতা দিয়ে ঢাক বেঁধে দিতে আমরাও জানি।

জাদুকর তাদের ধমকে বলে উঠল, ‘আমি যে পাতা দিয়ে বাঁধব তা তোমরা চেনো না। জিনিসটা বিক্রি করলাম ঠিকই, কিন্তু এটা নষ্ট হোক তা আমি চাই না ।

অগত্যা তাকেই আবার অনুসরণ করল সবাই। যেতে যেতে দীপাঞ্জনরা লক্ষ করল, এখানেও মাটির মধ্যে গাড়ির চাকার দাগ জেগে আছে। তার মধ্যে বেশ কিছু দাগ যেন টাটকা মনে হল তাদের ৷

গর্বিত ভাবে গলায় ঢাকটা ঝুলিয়ে চলছেন শ্যাপেলিও। তার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। বনের ভিতর কিছুটা এগোবার পর জুয়ান এক সময় এমির কাছে জানতে চাইলেন, ‘আচ্ছা, এই ফুলানি ট্যাম ট্যাম নিষিদ্ধ হবার ব্যাপারে তুমি কী বলছিলে?’

এমি বলল, ‘এ ঢাক বানানো অনেক দিন আগেই সরকার নিষিদ্ধ করেছে। কিছু দিনের মধ্যে নাকি কাছে রাখাও নিষিদ্ধ করবে বলে শুনছি।

‘কেন?” জানতে চাইলেন জুয়ান ।

চামড়াটার জন্য। আসলে কথা বলা ঢাক নানা দুর্লভ প্রাণীর চামড়া দিয়ে তৈরি। ওসব প্রাণী শিকার নিষিদ্ধ ৷

দীপাঞ্জন জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, ‘ফুলানি ট্যামট্যামের চামড়ার কীসের?’ কিন্তু তার আগেই জাদুকর কুরি বলল, ‘ওই গাছের ফোঁড়কেই শিঙাটা আছে।’

জঙ্গলের মধ্যে একটু ফাঁকা জায়গার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে একটা বড়ো গাছ । তার নীচে হাজির হল সবাই। জাদুকর কুরি সত্যিই তার ফোকর থেকে একটা শিঙা বার করল। কালো রঙের কাঠের শিঙা । সে এরপর সেটায় ফুঁ দিতেই অবিকল সিংহর গর্জনের মতো শব্দ নির্গত হল। বারকয়েক সে-সেটা বাজাবার পর দীপাঞ্জন সেটা হাতে নিল শিঙাটা নিজে বাজিয়ে পরখ করার জন্য। ঠিক সেই সময় তাদের সঙ্গে দাঁড়ানো একজন গ্রামবাসী ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠল—‘বিনভিগান রুয়া !”

‘বিনভিগান রুয়া!” অর্থাৎ ‘মেশিনগান!’ এমি লোকটার কথাটা শুনে একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সবাই চমকে উঠে তাকিয়ে দেখল চারপাশের জঙ্গলের আড়াল থেকে বেরিয়ে বৃত্তাকার ব্যুহ রচনা করে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে একদল ছোটোছেলে মানুষ। তাদের খালি পা, পরনে হাফপ্যান্টে, আধছেঁড়া পোশাক। আর সেই কালো ছোটো ছোটো মানুষগুলোর বুকে ঝুলছে কার্তুজের বেল্ট! হাতে ধরা সাব-মেশিনগান !

‘কারা ওরা? পিগমি নাকি?’, জুয়ান বলে উঠলেন। চাপা হাসি ফুটে উঠেছে জাদুকর কুরির ঠোঁটে। এমির মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সে চাপা স্বরে বলল, ‘না পিগমি নয়। তার চেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর আফ্রিকার কুখ্যাত চাইল্ড আর্মি’ টেররিস্ট গ্রুপ! ওরা সত্যিই বাচ্চা ছেলে।’

বৃত্তটা ক্রমশ ছোটো হয়ে আসছে। হ্যাঁ, সত্যিই ছোটো ছোটো ছেলে। একটা ছেলে তো এত ছোটো যে কার্তুজের বেল্ট তার পায়ে লুটোচ্ছে, আট-নয় বছর বয়স হবে হয়তো! তাকে দেখে বিস্মিত শ্যাপেলিও হেসে ফেলে বললেন, ‘এগুলো কি খেলনা বন্দুক?’

এমি ফিসফিস করে বলল, ‘হাসবেন না। খেলনা নয় আসল মেশিনগান। এরা খুব নিষ্ঠুর রোবোট হয়ে গেছে।

এমির কথা যে কতদূর সত্যি মুহূর্তের মধ্যে তা প্রমাণ হয়ে গেল। তাদের কাছে আসতে দেখে গ্রাম থেকে আসা লোক দুটো হঠাৎই পালাবার জন্য ছুটতে শুরু করল। আর সঙ্গে সঙ্গেই একটা বছর দশেকের বাচ্চা ছেলে তাদের দিকে ঘুরে র‍্যাটরাট শব্দে মেশিনগান চালিয়ে দিল । কিছুটা এগিয়েই গুলি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল লোক দুটো। যে গুলি চালাল তার কোনো ভাবান্তর হল না। গুলি চালাবার পর সে অন্যদের স্বার্থে আবার এগিয়ে আসতে লাগল। শ্যাপেলিয়রের হাসি উধাও হয়ে গেছে।

৷৷ ৬ ৷৷

ছেলেগুলো এসে দীপাঞ্জনদের বৃত্তাকারে ঘিরে দাঁড়াল। তাদের বয়স আট-নয় থেকে খুব বেশি হলে বারো-তেরো হবে। পরনে ধুলামলিন বেশ। কারও কারও দেহে অপুষ্টির স্পষ্ট ছাপ। মাথায় ছোটো ছোটো করে ছাঁটা চুল। তাদের শরীর শৈশব-কৈশোরের সব চিহ্ন থাকলেও তাদের মুখে আশ্চর্য্য কাঠিন্য জেগে আছে। ঠোঁটে আবছা হাসিরও রেশ নেই। চোখের দৃষ্টি অপলক, মৃত্যুশীতল কেমন যেন মরা মাছের মতো! যে ছেলেটা মেশিনগান চালিয়েছিল, তার অস্ত্র থেকে তখনও মৃদু ধোঁয়া উঠছে। কিছুটা তফাতে পড়ে আছে সেই হতভাগ্য লোক দুটোর মৃতদেহ। তাদের কালো অঙ্গ লাল হয়ে উঠেছে রক্তে।

প্রফেসর জুয়ান চাপা স্বরে দীপাঞ্জনকে বলল, ‘এদের কথা আমি বইতে পড়েছি।’ এমি বলল, ‘বাঁচতে হলে ওদের কোনো ব্যাপারে বাধা দেবেন না।’

গ্রামের লোক দুটোর যা পরিণতি হল, তাতে বাধা দেবার কোনো প্রশ্ন নেই । একটা ছেলে প্রথমে এগিয়ে এসে শ্যাপেলিওর হাত থেকে রাইফেলটা ছিনিয়ে নিল। অন্যরা কুরি বাদ দিয়ে সবার কোমরে হাত দিয়ে দেখে নিল সেখানে কোনো অস্ত্র লুকানো আছে কিনা ? এরপর জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল দু-জন প্রাপ্তবয়স্ক লোক। তাদের পরনে জংলাছাপ সামরিক পোশাক। তাদের হাতেও মেশিনগান, কোমরে রিভলবার, কার্তুজের বেল্ট। তারা এগিয়ে এসে দীপাঞ্জনদের দিকে দৃষ্টিপাত করে জাদুকর কুরির সাথে কী কথাবার্তা বলল দুর্বোধ্য ভাষায়। একমাত্র কুরির মুখেই হাসি, বোঝা যাচ্ছে এরা কুরির পূর্ব পরিচিত। তাদের সাথে কথা শেষ হলে কুরি এগিয়ে এসে শ্যাপলিওরের গলা থেকে ঢোলকটা খুলে নিল। দীপাঞ্জনের হাত থেকে নিয়ে নিল শিঙাটা।

বয়স্ক লোক দুটো এবার কী একটা নির্দেশ দিল ছোটো ছেলেগুলোকে। তারপর তারা এগোল জঙ্গলের একদিকে। তাদের নির্দেশ পেয়ে ছেলেগুলো দীপাঞ্জনদের ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে চলল অগ্রবর্তী লোক দুটো যেদিকে গেল সেদিকে। তাই দেখে হাসতে লাগল জাদুকর কুরি। সত্যিই সে কুরি বা হায়নার মতো ধূর্ত। সেই শিঙা ফুঁকে সংকেত করে এদের হাতে তুলে দিল তাদের। শ্যাপেলিও একবার শুধু থমকে দাঁড়িয়ে বলতে গেলেন, আমরা কোথায় যাচ্ছি?’

তার কথা শোনা মাত্র একটা বছর দশেকের ছেলে লাফিয়ে উঠে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে শ্যাপেলিওর কপালে এমন আঘাত করল যে ঝরঝর করে রক্ত বেরোতে শুরু হল। রুমালে কপাল চেপে হাঁটতে লাগলেন তিনি।

বাচ্চা ছেলেগুলো দীপাঞ্জনদের ব্যাগপত্র সহ তাড়িয়ে আনল জঙ্গলের গায়ে একটা ফাঁকা জায়গাতে। সে-জায়গা হ্রদের পাড়ের কাছে। দীপাঞ্জনরা এবারও বেশ অবাক হল । সেখানে দাঁড়িয়ে আছে ছোটোখাটো, একটা ট্রাক। তার মাথায় ক্যাম্বিসের আচ্ছাদন। ইতিমধ্যে সামরিক পোশাক পরা লোক দুটো চালকের আসনের কাছে উঠে বসেছে। মালপত্র সমেত দীপাঞ্জনদের ট্রাকে ওঠানো হল। জনা পনেরো ছেলের মধ্যে চার পাঁচজন ছেলেও অস্ত্র হাতে ঢুকল দীপাঞ্জনদের সাথে সেই ক্যাম্বিসের আচ্ছাদনের নীচে। আর বাদবাকিরা বিভিন্ন কৌশলে ঝুলে পড়ল গাড়ির বনেট, ফুটবোর্ড সহ গাড়ির বিভিন্ন অংশের গায়ে। গাড়ির ইঞ্চিন স্টার্ট হল। চাদ হ্রদের পাড় ঘেঁষে জঙ্গলের গা বেয়ে প্রচণ্ড ঝাঁকুনির সাথে ট্রাকটা চলতে শুরু করল অজানার উদ্দেশ্যে।

ঘণ্টাখানেক চলার পর গাড়ি অবশেষে থামল। বন্দুকের কুঁদোর ঘা দিয়ে দীপাঞ্জনদের গাড়ি থেকে নামিয়ে সার বেঁধে দাঁড় করানো হল। তারপর অনেকটা মার্চপাস্টের ঢঙে দীপাঞ্জনদের নিয়ে সেই আর্মি এগোলো হ্রদসংলগ্ন জঙ্গলের ভিতর। বেশিদূর অবশ্য তাদের যেতে হল না। কিছুটা এগিয়েই তারা দেখতে পেল বেশ কয়েকটা ছিরিছাঁদ-হীন পাথুরে ঘর। তাদের মাথায় ত্রিপল অথবা টিনের ছাদ। কালো পাথর বাঁধানো একটা ছোটো চত্বরও সেখানে আছে। সেখানে আরও জনা কুড়ি অস্ত্রধারী ছোটো ছেলে আর কিছু পূর্ণবয়স্ক লোকজনও আছে। তবে গাছপালার আড়ালে থাকায় বাইরে থেকে ও জায়গাটা চট করে বোঝা যায় না। দীপাঞ্জনদের হাজির করা হল সেই পাথুরে চত্বরে কাঠের চেয়ারে বসে থাকা একটা লোকের সামনে। মাঝবয়সি লোক। গায়ের রং আবলুশ কাঠের মতো কালো। পুরোদস্তুর সামরিক পোশাক। মাথার টুপিতে আঁকা আছে একটা সিংহের ছবি।

কোমরের দু-পাশে রিভলবার। কোলে শোয়ানো আছে মেশিনগান। পায়ের কাছে রাখা আছে একটা রকেট লঞ্চার। দীপাঞ্জন খেয়াল করল, লোকটার চারপাশে সামরিক পোশাক পরে অন্য যে সব লোক দাঁড়িয়ে আছে তাদের টুপিতেও সিংহর এমব্রস আঁকা। মধ্যাহ্নের সূর্য কিরণে ঝলমল করছে তাদের আগ্নেয়াস্ত্রগুলো। চেয়ারে বসা লোকটা ভালোভাবে নিরীক্ষণ করল দীপাঞ্জনদের। তারপর এমিকে লক্ষ করে দুর্বোধ্যভাষায় কী যেন বলতে শুরু করল। লোকটার বলার ঢং অনেকটা বক্তৃতা দেবার মতো। দীর্ঘক্ষণ ধরে সে বক্তৃতা করল দীপাঞ্জনদের উদ্দেশে। তারপর আবার খুদে সেনার দল তাদের ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলল একটা টিনের চালঅলা পাথুরে ঘরের দিকে। সে-ঘরে দীপাঞ্জনদের তাদের মালপত্র সমেত ঢুকিয়ে বাইরে থেকে শিকল তুলে দিল তারা। প্রচণ্ড গরম ঘরটাতে। তবে সুবিধা একটা আছে। দুটো বেশ বড়ো কপাটহীন লোহার গরাদঅলা জানলা এ-ঘরে। বাইরের অনেকটাই প্রায় দেখা যাচ্ছে জানলা দিয়ে। এ-ঘরটা সম্ভবত কয়েদ ঘর। একটা বছর দশেকের ছেলে গলায় মেশিনগান ঝুলিয়ে একটা জানলার বাইরে কিছুটা তফাতে পাথুরে ইটের পাঁজাতে পা ঝুলিয়ে বসল। সম্ভবত সে এই ঘরটার পাহারাদার।

ঘরের এক কোণে একটা জলের পাত্র আছে। সেখান থেকে জল খেয়ে একটু ধাতস্থ হল সবাই। দীপাঞ্জন বলল, ‘ভাগ্য ভালো ওরা আমাদের হাত-পা বাঁধেনি।’ এমি বলল, ‘বাঁধেনি কারণ, এখান থেকে আমাদের পালানো যে অসম্ভব সেটা ওরা জানে। মেশিনগানের গুলি আমাদের চেয়ে অনেক দ্রুতগামী। এবং মৃত্যুও।’ জুয়ান এরপর প্রশ্ন করলেন, ‘চেয়ারে বসা লোকটা আমাদের উদ্দেশে কী বলল বলো ? আমাদের এখানে ধরে আনা হল কেন ?’

এমি বলল, ‘হ্যাঁ আসল ব্যাপারটা এবার বলছি। লোকটা নিজের পরিচয় দিল ‘জেনারেল বর’ বলে। লোকটা দাবি করছে ও চাদের প্রাচীন রাজা কানেস বরনুর উত্তরাধিকারী বলে। বরনু চাদের প্রচলিত শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে নিজের শাসন ও-দেশে কায়েম করতে চায়। সে জন্য চাইল্ড আর্মিদের নিয়ে বিদ্রোহী বাহিনী বা সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী খুলেছে সে। তার ধারণা, কয়েক বছরের মধ্যেই সে তার কাজে সফল হবে, এ দেশের নাম হবে ‘করিম বানু’। কয়েকটা বিদেশি রাষ্ট্র নাকি তাকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করছে। ওরা আমাদের ধরে এনেছে বিশেষ কারণে। ওরা শুনেছে আপনারা সরকারি লোক বা সরকারি অতিথি। কিছু দিন আগে সরকার একটা আর্মি অপারেশন চালায় এখানে। তাতে ওদের দু-জন নেতাগোছের লোক ধরা পড়েছে। আমাদের মুক্তির বিনিময়ে সে দু-জন লোকের মুক্তি দাবি করবে বরনু। সে আমাদের বলল যে পালাবার চেষ্টা না করলে আমাদের কোনো ভয় নেই। সাত দিনের সময়সীমা তারা সরকারকে বেঁধে দেবে। অবশ্য এর মধ্যে সরকার কিছু না করলে সে আমাদের নিয়ে অন্য ভাবনা ভাববে।’

‘অন্য ভাবনা মানে?’ জানতে চাইলেন শ্যাপেলিও।

‘জেনারেল বরনুর কথার ঢং দেখে মনে হল, অন্য ভাবনা মানে, মেশিনগানের সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেবে।’ জবাব দিল এমি। তারপর সে বলল, ‘আমার ধারণা পরশু রাতে কথা বলা ঢাকের মাধ্যমে এরাই আমাদের খোঁজ নিচ্ছিল। কাল রাতেও নিয়েছে। ফুলানি ট্যামট্যাম বাজিয়ে আমাদের উপস্থিতির খবর কাল রাতে জাদুকর এদের জানিয়ে দিয়েছিল। এভাবে না হলেও অন্য কোনোভাবে হলেও বরনু আমাদের ধরতই।’

জানলার বাইরে বসা ছেলেটা ভাবলেশহীন মুখে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে ঘরের ভিতর দিকে। শ্যাপেলিও বললেন, “কিন্তু এই নিষ্ঠুর ছেলেগুলোকে এরা জোগাড় করল কোথা থেকে?”

এমি বলল, ‘এরা জন্মগতভাবে কেউ নিষ্ঠুর ছিল না। দেশটাতো খুব গরিব। গরিব পরিবারের সন্তান এরা। হয়তো এদের কেউ কেউ জাতিদাঙ্গা, গোষ্ঠীদাঙ্গায় বাবা মা পরিবারকে হারিয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এদের সংগ্রহ করে আনা হয়, তারপর মগজ ধোলাই করে, সামরিক ট্রেনিং দিয়ে এদের যন্ত্রমানবে পরিণত করা হয়। দলপতির নির্দেশে এরা মুহূর্তের মধ্যে কাউকে মারতে পারে আবার নিজেরাও মরতে পারে ।

জুয়ান বললেন, ‘আমি পড়েছি এই চাইল্ড আর্মির কথা। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ, যেমন লিবিয়া, সুদান, আলজেরিয়া, নাইজার, ক্যামেরুন, চাদ-সহ বিভিন্ন দেশের টেররিস্ট গ্রুপ এই চাইল্ড আর্মি ব্যবহার করে। এশিয়ার মধ্য প্রাচ্যের কয়েকটা দেশেও এই চাইল্ড আর্মি ব্যবহার করা হয়। ভাবতে অবাক লাগে, আমরা নাকি সভ্য পৃথিবীর মানুষ। নইলে যে-সব শিশুদের হাতে এখন কলম থাকার কথা তাদের হাতে কেউ কারবাইন রাইফেল তুলে দেয়? বইয়ের বদলে বিস্ফোরক দেয়? কোনো যুক্তিতেই ব্যাপারটাকে সমর্থন করা যায় না। মৃত্যুর আগেই একবার এদের খুন করা হয়। খুন করা হয় এদের শৈশব-কৈশোরকে।’

‘চাইল্ড আর্মি’ বানানোর ক্ষেত্রে সুবিধা কী?’ জানতে চাইলেন শ্যাপেলিও ৷ এমি বলল, ‘প্রথমত, বাচ্চাদের খাওয়া পরার চাহিদা খুব কম। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা বা ভুল বোঝানো সহজ। দ্বিতীয়ত, এদের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করা যায়। সবচেয়ে বড়ো কথা, বাচ্চা দেখলে লোকে কম সন্দেহ করে। সহজেই এদের দিয়ে আত্মঘাতী হামলা চালানো যায়। এরা হাসতে হাসতে বুকে বিস্ফোরক বেঁধে যে-কোনো জায়গাতে ঢুকে যেতে পারে। মানববোমা হতে পারে।’

শ্যাপেলিও আবার প্রশ্ন করলেন, ‘যুদ্ধের সময় কী হয় এদের?’

এমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘সে-সময় জঙ্গিরা এদেরই আগে ফ্রন্ট লাইনে এগিয়ে দেয়। বাচ্চাগুলো গুলি চালালে রাষ্ট্রও তখন বাধ্য হয় নিজেদের কর্তব্য পালন করতে। এরা কেউই সাধারণত বেশিদিন বাঁচে না ।

প্রফেসর জুয়ান বললেন, ‘ইউনেস্কো, ইউনিসেফ খুব চেষ্টা চালাচ্ছে এই চাইল্ড আর্মি ব্যাপারটা বন্ধ করার জন্য। কিন্তু যতদিন না মানুষের শুভবুদ্ধি উদয় হবে ততদিন ব্যাপারটা সম্ভব হচ্ছে না ।’

সময় এগিয়ে চলল। বিকাল হল এক সময়। যে-ছেলেটা জানলার সামনে পাহারায় ছিল সে অন্য দুটো ছেলেকে পাহারায় বসিয়ে এগোল পাথর বাঁধানো চত্বরটার দিকে। সেখানে জড়ো হয়েছে বেশ কিছু বাচ্চা ছেলে আর জেনারেল বর-সহ বেশ কিছু লোক। দীপাঞ্জনরা যে-গাড়িতে এসেছে সেটাও হাজির হয়েছে সেখানে। জানলার সামনে সারা দিন বসে থাকা ছেলেটা এবার অন্য ছেলেদের নিয়ে মার্চপাস্ট শুরু করল। যাদের মার্চপাস্ট করানো হচ্ছে সামরিক ভাষায় সম্ভবত তারা ‘রংরুট’। অর্থাৎ নতুন যোগ দিয়েছে বাহিনীতে, তাদের কাঁধে কোনো অস্ত্র নেই। মার্চপাস্ট যখন শেষ হল তখন কিছু দূরে চাদের বুকে সূর্য ডুবতে শুরু করেছে। দীপাঞ্জনরা দেখল সেই গাড়িটাতে উঠে পড়ল জেনারেল বরনু-সহ তার অন্য লোকেরা। দীপাঞ্জনদের চাইল্ড আর্মির হেফাজতে রেখে কিছুক্ষণের মধ্যেই গোপন কোনো ডেরার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল গাড়িটা।

মার্চপাস্ট শেষ করিয়ে আবার দীপাঞ্জনদের ঘরের জানলার কাছে ফিরে এল সেই ছেলেটা নিজের জায়গাতে অন্য দু-জন ছেলেকে সরিয়ে গিয়ে বসল। মেশিনগানটাকে গিটারের মতো গলায় ঝুলিয়ে সে তাকিয়ে রইল চাদ হ্রদের সূর্যাস্তের দিকে। সে-জায়গা থেকে গাছের ফাঁক দিয়ে হ্রদটা দেখা যাচ্ছে। দীপাঞ্জনরা ঘরের ভিতর থেকেও দেখতে পাচ্ছে চাদ হ্রদ। চাদের জলে সূর্য ডুবল এক সময়। দু-চারটে মশাল জ্বলে উঠল চত্বরে। একজন একটা মশাল এনে রাখল জানলার বাইরে সেই পাহারাদার ছেলেটার সামনে । কিছুক্ষণ পর দুজন ছেলে কাঁধে করে দুটো ঝুড়ি নিয়ে এল। ঘরের দরজার শিকল খোলা হল উদ্যত মেশিনগানের কঠোর নজরদারিতে। বন্দিদের খাবার দেবার পর আবার দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আধ পোড়ারুটি আর চর্বি যুক্ত ঝলসানো মাংস। সারাদিন দীপাঞ্জনদের খাওয়া হয়নি। শরীর শক্ত রাখতে হবে। তাই তারা সেই পোড়া রুটি আর আঁশটে গন্ধযুক্ত মাংসই কোনো রকমে গলাধঃকরণ করতে লাগল। জানলা দিয়ে তারা দেখল বাইরে বসা সেই বাচ্চা ছেলেটা পরম তৃপ্তিতে খাবারগুলো খাচ্ছে। এই প্রথম তার মুখের কাঠিন্য সরে গিতেয় যেন একটা খুশির ঝিলিক ফুটে উঠেছে। যেন সে পোড়া রুটি নয়, কোনো বাদশাহি খানা খাচ্ছে !

এমি বলল, ‘ছেলেটা কেমন খাচ্ছে দেখুন। আসলে এই খাবারের মূল্যই ওদের কাছে অনেক দামি। এ-দেশে বহু শিশু স্রেফ না খেতে পেয়ে মারা যায়। সামান্য এই খাবারটুকু এখানে পাওয়া যাবে বলে অনেক বাবা মা জঙ্গিদের হাতে বাচ্চাদের তুলে দেয়, না খেতে পেয়ে মরার চেয়ে মিলিটারির গুলি খেয়ে মরার আগে অন্তত খেয়ে মরুক ছেলেটা। এই তাদের ভাবনা থাকে। আর যে মাংসটা আমরা খাচ্ছি তা কীসের জানেন । জলহস্তীর।’

কথাটা শোনার পর শ্যাপেলিও আর একটু হলেই বমি করে ফেলছিলেন।

ঘরের ভিতর বাইরে খাওয়ার পাট সাঙ্গ হল একসময়। খাওয়া শেষ হবার পর বাইরে বসা ছেলেটা দুর্বোধ্য ভাষায় কী একটা হাঁক দিল। মিনিট খানেকের মধ্যেই চাইল্ড আর্মির ছেলেরা এসে তার সামনে দাঁড়াল। ছেলেটা তাদের কী সব নির্দেশ দিল, তারপর আবার বিভিন্ন জায়গাতে ছড়িয়ে পড়ল তারা। সম্ভবত ছেলেটা অন্যদের রাতের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিল।

চাঁদ উঠে গেছে। মশালের আলো নিভিয়ে দেওয়া হল। দীপাঞ্জন দেখতে পেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে চত্বরটার বিভিন্ন জায়গাতে টহল দিতে শুরু করেছে সেই শিশুসৈনিকরা ।

৷৷ ৭ ৷৷

‘লেফট রাইট লেফট্।’ দীপাঞ্জনের যখন পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙল তখন চত্বরে মার্চপাস্ট শুরু হয়ে গেছে। রং-রুট দের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে জানলার পাশে যে ছেলেটা বসে থাকে সেই ছেলেটা। জনাদশেক নতুন ছেলে। আর তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে অস্ত্রধারী চাইল্ড আর্মি। ছেলেগুলোর প্রতি কড়ানজর তাদের।

এমি বলল, ‘এ-সব দলে যারা যোগ দেয় তারা আর কোনো দিন পালাতে পারে না। হয়তো কোনো গ্রাম থেকে এদের তুলে আনা হয়েছে, অথবা সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে এদের বাবা-মা-রাই জঙ্গিদের হাতে তুলে দিয়েছে নিজের ছেলেকে। কিছু দিনের মধ্যেই এই শিশুরা পরিণত হবে নৃশংস খনিতে।’

জুয়ান বললেন ‘যে-ছেলেটা মার্চপাস্ট করাচ্ছে, আমাদের পাহারা দেয়, ওই এই চাইল্ড আর্মির নেতা বলে মনে হচ্ছে। কাল থেকে দেখছি ওর নেতৃত্বেই চলছে অন্য বাচ্চাগুলো।’ জানলার গরাদ ধরে দীপাঞ্জনরা দেখতে লাগল চাইল্ড আর্মির প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষক ছেলেটা এখন তার বদলে জানলা বাইরে বসিয়ে রেখে গেছে অন্য একজনকে। এ ছেলেটাই গুলি চালিয়েছিল সেই গ্রামবাসী দুটোকে।

মার্চপাস্ট চলল বেশ অনেকক্ষণ ধরে। তারপর শুরু হল গুলি চালানোর শিক্ষা। কাঠের তৈরি একটা মনুষ্যমূর্তি এনে রাখা হল চত্বরের এক অংশের দেয়ালের গায়ে। রং-রুটদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল অস্ত্র। দক্ষ চাইল্ড আর্মির বাচ্চারা নতুন ছেলেদের হাতে ধরে শেখাতে লাগল টার্গেট লক্ষ্য করে গুলি চালানোর কৌশল। মেশিনগানের ‘র‍্যাট্ র‍্যাট্’ শব্দ আর রাইফেলের ‘দুমদুম’ শব্দে কেঁপে উঠতে লাগল চারপাশ।

: তখনও আগ্নেয়াস্ত্রের প্রশিক্ষণ চলছে, এমন সময় গাড়ির শব্দ শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে চত্বরের সব শব্দ থেমে গেল। সার বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ল চাইল্ড আর্মি । সেই গাড়িটা ঢুকল চত্বরে। তার থেকে নামল জেনারেল বরনু সহ আরও কয়েকজন লোক। চাইল্ড আর্মি তাদের সামরিক কায়দাতে স্যালুট দেবার পর বরনু প্রশিক্ষক ছেলেটার সাথে কী সব কথাবার্তা বললেন। এর পর রংরুটদের মধ্যে থেকে একটা বাচ্চা ছেলেকে হাজির করানো হল বরনুর সামনে। বরনু বাচ্চাটার পিঠ চাপড়ে তার সাথেও কী সব কথা বলল। বাচ্চাটার হাতে একটা সাবমেশিনগান ধরিয়ে তার চোখ বেঁধে দেওয়া হল। আর এর পরই এক নৃশংস কুনাট পরিবেশিত হল। গাড়ির ভিতর থেকে চোখ, হাত-পা বাঁধা একটা লোককে নামিয়ে এনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল চোখ বাঁধা ছেলেটার রাইফেলের নলের কয়েক হাত তফাতে। ব্যাপারটা কী হচ্ছে বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে জানলা থেকে চোখ সরিয়ে নিল সবাই। চত্বর ছাপিয়ে জেনারেল বরনুর গলার শব্দ শোনা গেল—ফায়ার!’ পর মুহূর্তেই গুলির শব্দ হল। উল্লাসে চিৎকার করে উঠল জানলার পাশে যে এখন বসে আছে সেই ছেলেটা। চোখ বাঁধা যে ছেলেটা গুলি চালাল সে চোখ খুলে সামনে কী দেখতে পাবে তা কল্পনা করে কেঁপে উঠল দীপাঞ্জন। চোখ বাঁধা অবস্থায় নিজের অজান্তে বাচ্চা ছেলেটাকে খুনের তালিম দিল জেনারেল বরনু! লোকটা মানুষ না পশু! এর কিছুক্ষণের মধ্যেই দীপাঞ্জনদের ঘরের দরজা খোলার শব্দ হল। ঘরে ঢুকল জেনারেল বরনু, আর তার ক-জন লোক। তাদের, একজনের হাতে একটা ক্যামেরা। জেনারেল বরনু বলল, ‘আশাকরি আমার অতিথিশালাতে আপনারা ভালোই আছেন?’

এই ঘৃণ্য লোকটার কথার জবাব দেবার রুচি কারও হল না। চুপ করে রইল সবাই। বরনু এরপর বলল, আপনাদের ছবি তোলা হবে। আপনারা যে আমার অতিথি এ-ছবি তার প্রমাণস্বরূপ সরকারের কাছে পাঠানো হবে।’

বরনুর কথা এমি তর্জমা করার পর জুয়ান বললেন, ‘আমি ছবি তুলতে দেব না। আমার জীবনের বিনিময়ে কোনো খুনি মুক্তি পাক তা আমি চাই না ।’

কথাটা শুনে বরনু বলল, ‘সে ক্ষেত্রে আপনার মৃতদেহের ছবি তুলে পাঠানো হবে। একদিক থেকে সেটা ভালো হবে। অন্যদের আপনার মতো পরিণতি হতে পারে ভেবে দ্রুত আমাদের দাবি মানবে সরকার।’

ব্যাপারটা অন্যদিকে মোড় নিতে পারে। বরনুর সঙ্গীদের আগ্নেয়াস্ত্র তাগ করা জুয়ান সহ দীপাঞ্জনদের দিকে। বরনুর নির্দেশে যে-কোনো মুহূর্তে গুলি চালাতে পারে এই হিংস্র লোকগুলো। ব্যাপারটার গুরুত্ব অনুভব করে দীপাঞ্জন জুয়ানকে বলল, “প্লিজ মাথা ঠান্ডা করুন। এদের সাথে ঝগড়া করে লাভ নেই, বরং কৌশলে মুক্তির উপায় খুঁজতে হবে। এরা এখন যা করছে করতে দিন।’ দীপাঞ্জনের কথা শুনে জুয়ান আর কিছু বললেন না। দেয়ালের গায়ে দাঁড় করিয়ে একে একে ছবি তোলা হল তাদের চারজনের। ছবি তোলা শেষ হলে বরনু দাঁত বার করে বলল, “কালকের মধ্যেই আশা করা যায় যে এ-ছবিগুলো এঞ্জাসেনাতে পৌঁছে যাবে। তারপর দেখি কী হয়? সরকার একান্তই যদি শেষ পর্যন্ত আমার লোক দু-জনকে ছাড়তে রাজি না হয় সেক্ষেত্রে আর কী করব? তখন রং-রুটদের টার্গেট হিসাবে দাঁড় করিয়ে দেব আপনাদের।’

তার কথা শুনে শ্যাপেলিও বলে উঠলেন—“শয়তান।’

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল বরনু। আবার বাইরে থেকে শিকল উঠল সে-ঘরে। দীপাঞ্জনরা দেখতে পেল এর কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সঙ্গীদের নিয়ে গাড়িতে উঠে সে জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে গেল সেই বরনু।

জুয়ান বললেন, ‘লোকটা কী ধূর্ত দেখ। নিজে এখানে থাকে না। এখানে যদি পুলিশ বা আর্মি হানা দেয় তবে বাচ্চাগুলো মরবে অথচ আসল শয়তানটা দিব্যি বেঁচে যাবে।’ এমি বলল, ‘হয়তো এমন আরও ঘাঁটি আছে শয়তানটার। সেখানে আরও চাইল্ড আর্মি আছে। এ-জায়গাগুলোর মতো সেগুলোও খনি তৈরির কারখানা।

বরনু জায়গাটা ছেড়ে বেরিয়ে যাবার পর দীপাঞ্জন আর এমি এসে দাঁড়াল জানলার ধারে। চত্বর থেকে মৃতদেহটা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ট্রেনিং দেওয়া শেষ করার পর সেই ছেলেটা আবার জানলার বাইরে নিজের জায়গাতে এসে বসেছে। মেশিনগানটা কোলের ওপর শুইয়ে দাঁত দিয়ে নখ কাটছে সে। দীপাঞ্জনরা জানলার সামনে এসে দাঁড়াতেই সতর্ক চোখে সে তাকাল তাদের দিকে। বিশেষত দীপাঞ্জনকে সে ভালো করে দেখতে লাগল। হয়তো সেটা তার গায়ের রঙের জন্যই। এমির মতো কালো মানুষ বা জুয়ান, শ্যাপেলিওর মতো মানুষ এর আগে দেখেছে বাচ্চা ছেলেটা। কিন্তু দীপাঞ্জন মতো সাদা কালোর মাঝামাঝি কোনো লোককে সম্ভবত এর আগে দেখেনি। দীপাঞ্জনের এ-অনুমান সম্ভবত সত্যি, কারণ হঠাৎ সে এমিকে জিজ্ঞেস করল, “তোমাদের সঙ্গের এ-লোকটা কোন্ দেশের ?”

এমি জবাব দিল, ‘ইন্ডিয়া-র’।

ছেলেটা এরপর আবার জানতে চাইল, ‘সে দেশটা কোথায়? চাদ হ্রদের ও পাড়ে?’ এমি উত্তর দিল, ‘আরও অনেক দূরের দেশ।’ তারপর এমি সুযোগ বুঝে তাকে প্রশ্ন করল। তোমার নাম কী?’

ছেলেটা গম্ভীরভাবে জবাব দিল, ‘লেফটানেন্ট টোটা’।

এ-বয়সি অন্য কোনো ছেলে নিজেকে লেফটানেন্ট বললে হয়তো হেসে ফেলত দীপাঞ্জন। কিন্তু এদের কাজকর্ম নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছে সে, তাই হাসি এল না। সে এমিকে বলল, “ওকে জিজ্ঞেস করো কীভাবে সে এখানে এল?”

এমি তাকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল কথাটা। কিন্তু তারপরই ছেলেটা জানলার দিকে মেশিনগানের নল উঁচিয়ে ইশারায় বুঝিয়ে দিল সে আর কথা বলতে রাজি নয়। এরপর মুখ ফিরিয়ে গাছের ফাঁক দিয়ে হ্রদের দিকে তাকিয়ে রইল।

জানলার কাছ থেকে সরে এসে ঘরের মাঝখানে বসল দীপাঞ্জনরা, শ্যাপেলি ও বললেন, তার মানে আমাদের ভাগ্য এখন নির্ভর করছে সরকারি সিদ্ধান্তর ওপর। এ নরককুণ্ড থেকে মুক্তি পাব কিনা কে জানে ! ”

জুয়ান বললেন, ‘এদের কার্যকলাপ তো নিজের চোখেই দেখছেন। এমি আমরা প্রাণের বিনিময় ওই টেররিস্টদের মুক্তি চাই না। ওরা জেল থেকে বেরিয়ে আবার কত শিশুকে খুনি বানাবে কে জানে? ছোটো ছোটো শিশুদের যারা এমন খুনি বানাচ্ছে তাদের মতো ঘৃণ্য জীব আর কেউ হতে পারে না। স্বয়ং শয়তানও এদের মনে হয় ক্ষমা করবে না!’ বেশ উত্তেজিতভাবে কথাগুলো বললেন তিনি।

শ্যাপেলিও তার কথা শুনে বললেন, “আমি আপনার কথার বিরোধিতা করছি না, কিন্তু এখান থেকে মুক্তির অন্য উপায় খোঁজারও চেষ্টা করা উচিত। অন্তত একটা চেষ্টা . ‘l

এমি বলল, ‘জেনারেল বরনু আর তার বয়স্ক অনুচররা তো চাইল্ড আর্মির হাতে আমাদের ছেড়ে রেখে চলে যায়। বাইরে ওই যে বাচ্চাটা পাহারা দিচ্ছে ওর নাম লেফটোনেন্ট টোটা। ওর তত্ত্বাবধানেই আমরা থাকি। কোনোভাবে যদি এই চাইল্ড আর্মিকে বশ করা যেত!”

শ্যাপেলিও শুনে বললেন, ‘হ্যাঁ, এই ছেলেটাকে যদি কোনোভাবে হাত করা যায় তবে হয়তো পালানো সম্ভব।’

একথা বলে কী যেন একটা ভেবে তিনি বললেন, ‘আমি একবার চেষ্টা করে দেখব ? ” দীপাঞ্জন জিজ্ঞেস করল ‘কী ভাবে?’

শ্যাপেলিও তার ব্যাগটা খুলে কাগজ জড়ানো বেশ বড়ো একটা প্যাকেট বের করলেন। তিনি প্যাকেটটা খুলতেই চমকে গেল সবাই এত টাকা।

তিনি বললেন, ‘এখানে দু-লক্ষ ফ্রাঙ্ক আছে। পৃথিবীতে ছেলে বা বৃদ্ধ এমন লোক নেই যে টাকায় বশ হয় না। দেখা যাক !”

এই বলে তিনি টাকার বান্ডিলগুলো নিয়ে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাই দেখে দীপাঞ্জন আর এমিও তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, শ্যাপেলিও জানলার সামনে দাঁড়িয়ে সেই ঝকঝকে নতুন কারেন্সি নোটগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল। বাচ্চা ছেলেটা এক সময় ফিরে তাকাল। অত টাকা দেখে প্রাথমিকভাবে বিস্ময় ফুটে উঠল তার মুখে। শ্যাপেলিওর সাথে তার চোখাচোখি হতেই তিনি একটা বান্ডিল নেড়ে হাসলেন বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে। ছেলেটা স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল শ্যাপেলিওর হাতে ধরা টাকার বান্ডিলগুলোর দিকে। এরপর ধীরে ধীরে তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠতে লাগল। তাহলে কী শ্যাপেলিওর পরিকল্পনা সত্যি হতে চলেছে? বশ মানতে চলেছে বাচ্চা ছেলেটা?

ছেলেটার হাসি ক্রমশ চওড়া হতে শুরু করেছে টাকাগুলোর দিকে তাকিয়ে, শ্যাপেলিও এমিকে বলল, ওকে বলো ও-যদি আমাদের মুক্তি দেয় তবে এই সব টাকা ওর। ওকে তাহলে আর এসব খুন খারাপি করতে হবে না। ও-রাজার মতো দিন কাটাবে কিন্তু তার আগেই লেফটানেন্ট টোটা এমির উদ্দেশে হেসে উঠে বলল, ‘তোমার সঙ্গী এই সাদা চামড়াকে বলে দাও ও-সব টাকা দেখিয়ে কোনো কাজ হবে না। আমরা টাকা চাই না, স্বাধীনতা চাই। এই সাদা চামড়ার লোকগুলো দীর্ঘদিন আমাদের শাসন করেছে, শোষণ করেছে। এ-দেশে এখন কালো চামড়ার সরকার আছে ঠিকই, কিন্তু তার পিছনে আসলে আছে সাদা চামড়ার লোকরাই। জেনারেল বরনু এ দেশে প্রকৃত শাসন ব্যবস্থা কায়েম করবে। আমরা তার সৈনিক, টাকার বশ আমরা হব না।’—এই বলে সে-তার মেশিনগানের নলটা তাগ করল জানলার দিকে। যেন শ্যাপেলিও আর একটা কথা বললেই সে গুলি চালাবে। জানলার কাছ থেকে তারা তিনজনই সঙ্গে সঙ্গে সরে এল। মাটিতে বসে টাকাগুলো ব্যাগে ভরে শ্যাপেলিও বললেন, ‘এইটুকু ছোটো বাচ্চাদের কেমন মগজ ধোলাই করা হয়েছে দেখেছ! তবে আমি শেষ আর একটা চেষ্টা করব। স্বয়ং শয়তানেরও সে ফাঁদে পা দেওয়া উচিত।’

‘সেটা কী ফাঁদ?” এমি প্রশ্ন করল। কিন্তু শ্যাপেলিও কোনো জবাব দিলেন না । দুপুর গড়িয়ে বিকাল হল এক সময়। শ্যাপেলিও টোটাকে টাকা দেখাবার পরই যেন আরও সতর্ক হয়ে গেছে চাইল্ড আর্মির নেতা লেফটানেন্ট টোটা। সে অনুমান করেছে পালাবার ফিকির খুঁজছে বন্দিরা। তাই সে মেশিনগানের নলটা জানলার দিকেই ঘুরিয়ে রেখেছে। সে যে উঁচু জায়গাটাতে বসে আছে সেখান থেকে ঘরের ভিতরটা দেখা যায় ৷ দীপাঞ্জন খেয়াল করছে বাচ্চাটা মাঝে মাঝেই সতর্কভাবে দেখার চেষ্টা করছে ঘরের মেঝেতে বসে থাকা দীপাঞ্জনদের কার্যকলাপ। বিকাল হতেই সকালের রং-রুটরা হাজির হল মার্চপাস্টের জায়গাতে। তাদের সাথে চাইল্ড আর্মির প্রহরীরা। বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের জন্যই সম্ভবত লেফটানেন্ট নিজের জায়গা ছেড়ে এবেলা নড়ল না। একজন চাইল্ড সোলজারকে ডেকে সে তাকে নতুন ছেলেদের তালিমের নির্দেশ দিল। ছেলেটা ফিরে গিয়ে মার্চ পাস্ট শুরু করল।

এরপর সন্ধ্যা নামল। আগের দিনের মতোই ক-টা মশাল জ্বলল। দিনের শেষে দীপাঞ্জনদের খাবার দিয়ে গেল দুজন। সেই একই খাবার। পোড়া রুটি আর ঝলসানো হিপোর মাংস। দীপাঞ্জনরা তো খেল, বাইরে বসে লেফটানেন্টও তাই খেলেন। খাওয়া শেষ করে আগের দিনের মতোই চাইল্ড আর্মিকে ডেকে তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন লেফটানেন্ট। মশাল নিভিয়ে দেওয়া হল এরপর। আরও একটা দিন কেটে গেল ৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই দীপাঞ্জনরা শুয়ে পড়ল।

শুলেও কিছুতেই ঘুমাতে পারছিল না দীপাঞ্জন। বারবার তার খালি মনে পড়ছিল দেশের কথা। কোথায় কলকাতা আর কোথায় এই আফ্রিকায়। চাদ হ্রদের ধারে চাইল্ড আর্মির এই বন্দি শিবির। এক-এক সময় তার মনে হচ্ছে যে এই পুরো ব্যাপারটাই নিছকই হয়তো একটা দুঃস্বপ্ন। এর আগে মেক্সিকো আর রোমে বেড়াতে গিয়েও বিপদের মুখোমুখি হয়েছিল সে আর প্রফেসর জুয়ান। কিন্তু সে-বিপদ ছিল অন্যরকম। বেশ কয়েক ঘণ্টা শুয়ে শুয়ে ছটফট করার পর জল তেষ্টা পেল দীপাঞ্জনের। মাটি থেকে উঠে ঘরের কোণা থেকে জল খেয়ে সে জানলার সামনে এসে দাঁড়াল। চাঁদ উঠেছে। বেশ বড়ো গোল চাঁদ। গাছপালার ফাঁক দিয়ে হ্রদটা দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলোতে চিকচিক করছে হ্রদটা। জানলার ওপাশে ছেলেটা একলা বসে তাকিয়ে আছে মাথার ওপর চাঁদের দিকে। চাঁদের আলো এসে পড়েছে তার মুখে। কেমন যেন অবসন্ন দেখাচ্ছে তাকে। দীপাঞ্জনের এই প্রথম তাকে দেখে মনে হল ছেলেটার মুখের কাঠিন্যের আবরণ যেন সরে গেছে। বিষণ্ণ ভাব ফুটে উঠেছে তার মুখে। বাচ্চা ছেলেটা চাঁদের দিকে তাকিয়ে হয়তো ভাবছে তার হারিয়ে যাওয়া বাপ মার কথা, প্রিয়জনদের কথা। জেহাদের কথা, বিদ্রোহের কথা, তার কোলে শোয়ানো মেশিনগানের কথা এই মুহূর্তে হয়তো ভুলে গেছে সে। হয়তো তার চোখে ভেসে উঠছে চাদ হ্রদের ধারে কোনো শান্ত কুটিরের ছবি। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ছেলেটা ফিরে তাকাল জানলার দিকে। দীপাঞ্জনকে দেখে সে সম্ভবত আবছা হাসল ৷ দীপাঞ্জনও হাসল। ছেলেটা এরপর হাতের ইশারাতে তাকে বলল—‘যাও ঘুমিয়ে পড়ো।’

৷৷ ৮ ৷৷

ভোর হল। ঘুম থেকে উঠে দীপাঞ্জন দেখল জানালার বাইরে লেফটানেন্ট টোটা নেই। তার থেকেও একটা ছোটো ছেলেকে সে তার জায়গাতে পাহারায় বসিয়ে রেখে গেছে । ছেলেটা এতই ছোটো যে তার হাতের রাইফেলটা যদি মাটিতে খাড়া করে তার পাশে তাকে দাঁড় করানো যায় তবে রাইফেলের নল বোধ হয় তার মাথা ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু কী হিম শীতল বাচ্চাটার চোখের দৃষ্টি! মুখে শিশুসুলভ কোনো ছাপ নেই তার ৷ রক্তজমাট কাঠিন্য তার মুখে। রাইফেলের নলটা জানলার দিকে তাক করে ট্রিগারে আঙুল রেখে রোবটের মতো সে বসে আছে।

পাথুরে চত্বরটাতে ভিড় জমিয়েছে রং-রুট আর চাইল্ড আর্মিরা। লেফটানেন্ট টোটা সেখানে নেই। হয়তো কোথাও সে বিশ্রাম নিচ্ছে। সারা রাত ঘরটা সে পাহারা দিয়েছে। গতদিনের মতোই মার্চপাস্ট শুরু হল, তারপর টার্গেট প্র্যাকটিস। মেশিনগান আর রাইফেলের মুহুমুহু শব্দে শব্দে জায়গাটা কেঁপে উঠতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ গোলাগুলি চলার পর সেই গাড়িটা প্রবেশ করল চত্বরে। গাড়ি থেকে নামল জেনারেল বরনু আর তার সঙ্গীরা। এবং তাদের সাথে জাদুকর কুরি! তার হাতে শিকল বাঁধা হায়নার বাচ্চাটা। জাদুকর কুরি! তার গলায় ঝুলছে ফুলানি ট্যামট্যামটা। সবাই স্যালুট জানাল জেনারেলকে। টোটা এরপর কোথা থেকে যেন উপস্থিত হল সেখানে। জেনারেল বরনু তার পাশে দাঁড়ানো জাদুকর কুরিকে দেখিয়ে কী যেন বলতে লাগল টোটা আর চাইল্ড আর্মিকে। এত দূর থেকে অবশ্য তাদের কথা শোনা যাচ্ছে না। বেশ কিছুক্ষণ কথা চলার পর বরনু জাদুকরকে দীপাঞ্জনদের ঘরটা দেখিয়ে আঙুল তুলে দেখিয়ে কী সব বলল, তারপর কয়েদখানার দিকে না এসে তার অনুচরদের নিয়ে গাড়ির দিকে এগোল। তাকে দেখে মনে হল সে ভীষণ ব্যস্ত। তবে জাদুকর কিন্তু চাইল্ড আর্মিদের সাথেই দাঁড়িয়ে রইল। জেনারেলের গাড়ি চলে যাবার পর কুরি চাইল্ড আর্মির উদ্দেশে বেশ কিছুক্ষণ ধরে কী সব বলল। জমায়েতটা ভেঙে গেল। জাদুকরকে নিয়ে কোথায় যেন অদৃশ্য হল একটা ছেলে। লেফটানেন্ট টোটা চত্বর ছেড়ে এবার এসে বসল কয়েদখানার বাইরে তার নিজের জায়গাতে যে বাচ্চাটাকে সে বসিয়ে রেখেছিল তার পাশে। দীপাঞ্জনের সাথে তার চোখাচোখি হল। দীপাঞ্জন হাসলেও সে হাসল না। গম্ভীর তার মুখ সূর্য এখন সময় মধ্যগগনে পৌঁছল। বাইরে প্রচণ্ড রোদ। চত্বরটা মোটামুটি ফাঁকা হয়ে গেছে। দু-একজন চাইল্ড সোলজার শুধু ইতিউতি বন্দুক কাঁধে ঘুরছে। আর শুধু জানলার বাইরে বসে আছে টোটা আর সেই বাচ্চা ছেলেটা। জুয়ান বললেন, ‘আমাদের ওপর নজরদারি মনে হয় বাড়ল, একজনের বদলে দুজন হল। আবার শয়তান জাদুকরটাও এখানে হাজির হল কে জানে। হয়তো আমাদের ওপর নজর রাখার জন্য।’

দীপাঞ্জন আক্ষেপের সুরে বলল, ইস, কোনোভাবে যদি এই বাচ্চাগুলোকে বোঝানো যেত! কিন্তু এরা তো টাকাতেও বশ হয় না!”

.তার কথা শুনে শ্যাপলিও বললেন, টোকাতে হয়নি ঠিকই তবে আমি এবার শেষ চেষ্টা করব। দেখি কিছু হয় কি না? এতে কোনো সরকারি সেনাদলও নিজের দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারে।’

‘সেটা কী?’ জানতে চাইলেন জুয়ান।

মঁসিয়ে শ্যাপেলিও একবার জানলার বাইরে তাকালেন। না, জানলার বাইরে ওই দু-জন ছাড়া আর কেউ নেই। শ্যাপেলিও এরপর তার ডান পা থেকে তার হাই হিল বুটটা খুলে ফেললেন। জুতোটা উলটিয়ে ধরে তার হিলটা ধরে টান মারতেই সেটা একটু বাইরে বেরিয়ে এল। দেশলাই বাক্সর মতো একটা ফোকড়, তার মধ্যে ছোট্ট পলিথিনের প্যাকেটে কী যেন রয়েছে। শ্যাপেলিও সেই প্যাকেটটা নিয়ে তার ভিতরের জিনিসগুলো ঢাললেন তার তালুতে। বাইরে থেকে আসা সূর্যের আলোতে যেন ঝলসে উঠল শ্যাপেলিওর হাত। চোখ ধাঁধিয়ে গেল দীপাঞ্জনদের। দ্যুতি ছড়াচ্ছে শ্যাপলিওর হাত! হীরক দ্যুতি!

বিস্মিত কণ্ঠে জুয়ান বলে উঠলেন, ‘হিরা!’

শ্যাপেলিও মৃদু হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, দুর্মূল্য হিরা। জানেন তো আমি হীরক ব্যবসায়ী। এগুলো এত দামি যে আমি এদেরকে কোনোদিন কাছ ছাড়া করি না। এগুলোর বিনিময় আপনি পৃথিবীর যে-কোনো শহরের সবচেয়ে দামি বাড়ি কিনতে পারেন, অনায়াসে কিনতে পারেন গোটাকতক এরোপ্লেন বা একটা জাহাজ, বানাতে পারেন সর্বাধুনিক হাসপাতাল বা কয়েকটা স্কুল। পৃথিবীতে এক দেশের টাকা অন্য দেশে চলে না, কিন্তু হিরা পৃথিবীর সবচেয়ে দামি জিনিস। আমি এগুলোর বিনিময়ে আমাদের মুক্তি কিনব।’ এই বলে তিনি মুঠো ভরতি হিরে নিয়ে জানলার সামনে দাঁড়ালেন। তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল দীপাঞ্জন আর এমি।

ঘাড় ফিরিয়ে তাদের দিকে তাকাল লেফটানেন্ট টোটা আর তার সঙ্গী ছেলেটা। সূর্যের আলো এবার সরাসরি শ্যাপেলিওর হাতে এসে পড়েছে। আয়নার কাচে সূর্য প্রতিফলিত হলে যেমন হয়, তেমনই অগুনন্তি সূর্য যেন প্রতিফলিত হচ্ছে শ্যাপেলিওর হাত থেকে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল ছেলে দুটো।

কয়েক মুহূর্ত শ্যাপেলিওর হাতের দিকে তাকিয়ে থাকার পর লেফটানেন্ট টোটো লাফিয়ে নামল সেই উঁচু জায়গাটা থেকে তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে এসে জানলার সামনে দাঁড়াল ৷

এরপর সে বিস্মিতভাবে জানতে চাইল এগুলো কী! কাচ না অন্য কিছু? এমি বলল, ‘কাচ নয় হিরা। সত্যিকারের হিরা।

“হিরা! এ তো খুব দামি জিনিস জেনারেলের আঙুলে আছে আমি দেখেছি। যাদের কাছে হিরা থাকে তারা নাকি খুব বড়োলোক হয়।’ এই বলে অপলক দৃষ্টিতে সে চেয়ে রইল শ্যাপেলিওর হাতের দিকে।

ওষুধ একটু ধরতে শুরু করেছে বুঝতে পেরে এমি বলল, ‘এই হিরাগুলো আমরা তোমাদের দিতে পারি যদি তুমি আমাদের মুক্তির ব্যবস্থা করো। এই হিরাগুলো পেলে তোমরা এত বড়োলোক হয়ে যাবে যে আর তোমাদের পোড়া রুটি খেতে হবে না। বিরাট বিরাট বাড়ি-গাড়ি হবে তোমাদের। কোনো দুঃখ কষ্ট আর থাকবে না। শুধু আমাদের পালাবার ব্যবস্থা করো তুমি। তাহলেই সব দেব।’

‘তুমি সত্যি বলছ?’ জানতে চাইল ছেলেটা।

এমি বলল, ‘হ্যাঁ, সত্যি বলছি। শুধু তুমি আমাদের পালাবার ব্যবস্থা করো।’

এমির কথা শেষ হলে শ্যাপেলিও একটা হিরা আঙুলে তুলে সেটা বাড়িয়ে দিলেন টোটার দিকে। সূর্যকিরণে ঝলমল করে উঠল সেটা। টোটা হাত বাড়িয়ে জিনিসটা নিয়ে সূর্যের আলোতে সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল। আর তার সাথে বলতে লাগল, “তাহলে আর পোড়ারুটি খেতে হবে না? গাড়ি হবে, বাড়ি হবে ?

এমি বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, হবে। এমনকি মানুষ নিয়ে যে ‘কলের পাখি” আকাশে ওড়ে তেমন পাখিও কিনতে পারবে তুমি। তা চেপে ঘুরে বেড়াতে পারবে সব জায়গাতে।’

হিরাটা দেখতে দেখতে আর এমির কথা শুনতে শুনতে ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠতে লাগল টোটার চোখমুখ। আর তার সাথে সাথে মুক্তির আশায় দীপাঞ্জন আর শ্যাপেলিওর মুখও উজ্জ্বল হতে শুরু করল। এমি ছেলেটার উদ্দেশ্যে বলে যেতে লাগল, ‘যদি আমাদের মুক্ত করো, তবে সব তোমাদের, সব তোমাদের, আর কোনো কষ্ট থাকবে না, দুঃখ থাকবে না .।’ কিন্তু এরপর হঠাৎই যেন লেফটানেন্ট টোটার মুখের উজ্জ্বলতা উধাও হয়ে গেল। ফিরে এল চোয়ালের কাঠিন্য। হিরাটা জানলার ফাঁক গলিয়ে শ্যাপেলিওর হাতে দিয়ে সে বলল, ‘আমাদের লোভ দেখিও না। আমরা জেনারেল বরনুর সৈনিক। জেনারেল দেশটাকে আবার স্বাধীন করবে। এখন এ-দেশে আর কোনো গরিব থাকবে না। আমাদের কোনো দুঃখ থাকবে না, কষ্ট থাকবে না …।’

তার কথার প্রত্যুত্তরে এমি যেন তাকে কী বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই ছেলেটা কাঁধ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র খুলে নিয়ে জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে তার নলটা এমির বুকে চেপে ধরে বলল, ‘চুপ করো নইলে গুলি চালাব।’

অগত্যা জানলার পাশ থেকে সরে এল সবাই। জেনারেল টোটা আবার নিজের জায়গাতে ফিরে গেল তারপর নিস্পৃহ ভাবে তাকিয়ে রইল চত্বরের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর আবার উঠে দাঁড়াল সে। তারপর সঙ্গী ছেলেটার উদ্দেশ্যে কিছু বলে উধাও হয়ে গেল দীপাঞ্জনের চোখের আড়ালে। ছোট্ট ছেলেটা টোটা চলে যাবার পর চত্বরের দিকে পিঠ দিয়ে তার অস্ত্রটা সোজা জানলার দিকে তাক করে বসল।

মেঝেতে বসে থাকা শাঁপেলিও হতাশভাবে বললেন, ‘আমার এই শেষ চেষ্টাও ব্যর্থ হল। এখন ভাগ্যের হাতে নিজেদের সঁপে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’ জুয়ান বললেন, ‘আমি জানতাম এটাই ঘটবে। এই সব বাচ্চাদের এমনভাবে মগজধোলাই করা হয়েছে যে, টাকা হিরা জহরত কিছু দিয়েই এদের বশ করা যাবে না। জেহাদ, বিপ্লব, স্বাধীনতা—এই সব ভাবনা এদের রক্তের মধ্যে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই বয়সের শিশুদের মন কাদার তালের মতো নরম থাকে। তাদের যে ছাঁচে ফেলবেন সে ছাঁচই আঁকা হয়ে যাবে মনের মধ্যে।’

দীপাঞ্জন বলল, ‘আশাকরি আরও চারপাঁচ দিন বেঁচে থাকার জন্য সময় পাব। দেখা যাক কী হয়।’

হঠাৎ এমি জানলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখুন এদিকে কে আসছে!’

দীপাঞ্জনরা তাকিয়ে দেখল চত্বরের দিক থেকে একটালোক এগিয়ে আসছে এই বন্দিশালার দিকে। ভালো করে তাকে দেখে চিনতে পারা গেল। চেনা গেল তার গলায় ঝোলানো ফুলানি ট্যামট্যামটা দেখে। শয়তান জাদুকর কুরি। তার পরনে তখন পুরোদস্তুর সামরিক পোশাক। জংলা ছাপ জামাপ্যান্ট, পায়ে বুট কোমরে রিভলবার, কাঁধে রকেট লঞ্চার। শুধু ট্যামট্যামটা কাছ ছাড়া করতে তার হয়তো মন চায়নি, সেটা সে এখনও গলায় ঝুলিয়ে রেখেছে। শিঙাটা কোমরে গোঁজা জুয়ান বললেন, ‘দেখো মনে হচ্ছে শয়তানটা পাকাপাকিভাবে বরনুর দলে যোগ দিল আজ। আবার এমনও হতে পারে যে ওর ডেরায় পুলিশ আর্মি হানা দিতে পারে এই আশঙ্কা থেকেই এখানে পালিয়ে এসেছে। পুলিশ আমাদের খোঁজ করতে গ্রামে এলে গ্রামবাসীরা নিশ্চয় তাদের জানাবে যে আমরা কুরির ডেরার উদ্দেশ্যেই গ্রাম ছেড়ে নিখোঁজ হয়েছি। কিন্তু ও আবার এদিকে আসছে কেন?’

শ্যাপেলিও বললেন, ‘হয়তো টোটা হিরার খবরটা ওকে গিয়ে জানিয়েছে। হিরা নিতে আসছে সে।’

দেখতে দেখতে জাদুকর কুরি এসে উপস্থিত হল জানলার সামনে। গরাদ ধরে ভিতরে উঁকি দিয়ে হেসে বলল, ‘কেমন আছো তোমরা? আমাকে এ পোশাকে চিনতে পারছ তো?’

এমি ক্ষিপ্ত হয়ে জবাব দিল, ‘তোমাদের মতো হায়নাকে চিনতে অসুবিধা হয় না। তা তুমি এখানে এলে কেন?”

শয়তান জাদুকর কুরি ঠিক হায়নার মতোই ‘হ্যা হ্যা করে হেসে বলল, ‘যে লোক দুটোকে বাচ্চাগুলো গুলি চালিয়েছিল তার একটা আরও কিছুক্ষণ বেঁচে ছিল তারপর। গ্রামের লোকেরা তার খোঁজ পায়। মরার আগে সে ব্যাপারটা গ্রামের লোকদের বলে। ক্ষিপ্ত হয়ে তারা আমার কুঁড়েটা জ্বালিয়ে দিয়েছে। তবে তাতে আবার দুঃখ নেই। জেনারেল বরনু আর কিছুদিনের মধ্যেই সারা দেশ দখল করবে। তারপর সে এঞ্জামেলা চলে যাবে। তখন আমি এ তল্লাটের মালিক হব। হায়না দিয়ে খাওয়াব ওই গ্রামের লোকগুলোকে।’’

এরপর সে বলল, ‘ওই টোটা বলে বাচ্চা ছেলেটার বদলে আমিই আজ থেকে লেফটানেন্ট। জেনারেল বরনু আমাকে এ জায়গায় দায়িত্ব দিয়েছে। আমি এখন ‘লেফটানেট কুরি।’ আমার কথায় এখন থেকে এখানে সবকিছু চলবে। লেফটানেন্ট হিসাবে আমাকে তোমাদের পছন্দ হয়েছে তো?’ এই বলে আবার সে শয়তানের হাসি হাসল।

কেউ তার কোনো কথার জবাব দিল না। দীপাঞ্জন মনে মনে বলল, ‘হ্যাঁ, জেনারেল বরনুর সহচর তো তোমার মতো হায়নাই হবে!’ দীপাঞ্জনের অবস্থা এখন ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো। হায়নাটা তার কথার উত্তর পেল না ঠিকই, কিন্তু তাদের দুর্দশা উপভোগ করে শ্যাপেলিওর উদ্দেশ্যে ব্যঙ্গ করে বলল, ‘তুমিতো আবার ভালো হায়না মারতে পারো বলছিলে? কিন্তু এ জীবনে আর তোমার হায়না শিকার হল না, আর এই ফুলানি ট্যামট্যাম পাওয়াও হল না-তবে দুঃখে পেও না, আমি তোমাকে এর বাজনা শোনাচ্ছি।’—এই বলে সে জামার ভিতর থেকে কাঠি বার করে ঘা দিল সেই ঢাকে। তীব্র ট্যামট্যাম শব্দে বাজতে শুরু করল সেই ঢাক। কয়েকবার ঢাকে কাঠি পড়ার পরই এমির মুখটা কেমন যেন রক্তবর্ণ ধারণ করল! সে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘বাজনা বন্ধ করো, বন্ধ করো।’

কিন্তু জাদুকর কুরি হাসতে হাসতে বাজিয়ে চলল তার ঢাক। সেই শব্দে চত্বরে এ-পাশ ও-পাশ থেকে ছুটে আসতে লাগল চাইল্ড আর্মিরা। চাইল্ড আর্মির সোলজাররা মনে হয় তাদের বাহিনীর কোনো লোককে এমন ভুঁড়ি নাচিয়ে ঢাক বাজাতে দেখেনি। তাদের কঠিন চোয়ালের আড়াল থেকে আবছা হাসি উঁকি দিতে লাগল। আর এমি উঠে দাঁড়িয়ে দু-কানে আঙুল দিয়ে ছটফট করতে করতে বলতে লাগল, ‘দোহাই তোমার! বাজনা থামাও। দরকার হলে আমাকে গুলি করে মারো কিন্তু বাজনা থামাও।’

জাদুকর তখন ঘুরে ঘুরে নাচতে শুরু করেছে। হঠাৎ তার চোখ পড়ল আসে পাশে উপস্থিত হওয়া বাচ্চাগুলোর ওপর। এমির অনুনয়ের জন্য নয়। হয়তো শয়তানটার হঠাৎ মনে হল বাচ্চা ছেলেগুলোর সামনে তার নেচে নেচে ঢাক বাজানো ঠিক হচ্ছে না। একজন ওঝা বা জাদুকর হিসাবে তার এই ব্যাপারটা স্বাভাবিক। কিন্তু সামরিক বাহিনীর লেফটানেন্ট হিসাবে এটা শোভনীয় নয়। বাচ্চাগুলো হাসছে। সঙ্গে সঙ্গে সে বাজনা থামিয়ে দিল। তারপর কঠিন স্বরে দীপাঞ্জনদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘তোমাদের ভাগ্য এখন বলতে পারো আমার হাতে। পালাবার চেষ্টা করলে, বা কোনো বেচাল দেখলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে মারব।’ –এই বলে সে চত্বরের দিকে যাবার জন্য পা বাড়াল ।

কিন্তু কয়েক পা হেঁটেই সে থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরল। যে বাচ্চাটা জানলার বাইরে পাহারায় বসে ছিল তার উদ্দেশ্যে কুরি বলল, ‘তুমি আমাকে দেখেও বসে আছো কেন? স্যালুট দিচ্ছ না কেন? আমি আজ থেকে লেফটানেন্ট। সৈনিকরা লেফটানেন্টকে স্যালুট করে।’

ছেলেটা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমরা তো লেফটানেন্ট টোটাকে স্যালুট করি না। তুমি যে লেফটানেন্ট আমার জানা ছিল না। আমি সকাল থেকে এখানেই বসে আছি।’ ‘জানা ছিল না? নাকি আমাকে তুমি মানতে চাইছ না?’—চিৎকার করে উঠল জাদুকর কুরি। ঢোলকটা তার দেহের সাথে দুলে উঠল। আর তাই দেখেই সম্ভবত হেসে ফেলল বাচ্চাটা।

এ-ব্যাপারটা আর সহ্য করতে পারল না হায়নাটা। এতটুকু বাচ্চা তাকে মানছে না! কুরির কোমরে একটা চাবুক প্যাঁচানো ছিল। সেটা মুহূর্তের মধ্যে খুলে নিয়ে সে সেটা চালিয়ে দিল বাচ্চাটার ওপর। চাবুকের আঘাতটা গিয়ে পড়ল বাচ্চাটার মুখে। সঙ্গে সঙ্গে সে ছিটকে পড়ল বেশ কয়েক হাত তফাতে। তার ছোট্ট কালো মুখে ফুটে উঠল লম্বা লম্বি রক্তের রেখা। চাবুকের লিকলিকে, হিলহিলে সাপের লেজের মতো প্রান্তটা তার মুখের ওপর কেটে বসে গেছে। মাটিতে পড়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে গোঙাতে লাগল বাচ্চাটা। স্তম্ভিত হয়ে গেল এদিকে ওদিকে দাঁড়িয়ে থাকা চাইল্ড আর্মির বাচ্চাগুলো। হাসি মিলিয়ে গেল তাদের ঠোঁটের কোণ থেকে। হয়তো চাইল্ড আর্মির এই বাচ্চাটা ইতিমধ্যেই অনেক মানুষ খুন করেছে, হয়তো-বা ভবিষ্যতে এই ছেলেটাই গুলি চালিয়ে মারবে দীপাঞ্জনদের, তবু সে শিশু। এ-ব্যাপারটা দেখে শিউরে উঠল দীপাঞ্জনরাও। ঠিক এই সময় বাইরে উপস্থিত হল টোটা। কুরি আর বাচ্চাটার মাঝখানে সে এসে দাঁড়াল। তাকে দেখে শয়তান হায়নাটা বলে উঠল, ‘তোমার সঙ্গীদের সবাইকে বলে দাও আমি এখন লেফটানেন্ট। এখন থেকে আমার হুকুম মতোই এখানে সব কিছু চলবে। কোনো কিছু বেচাল দেখলে এর মতোই চাবুক চলবে অন্যদের ওপরও।’ এই বলে শয়তানটা সে-জায়গা ছেড়ে অন্য দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল। সে চলে যাবার পরে টোটা বাচ্চাটাকে মাটি থেকে উঠিয়ে আবার তার আগের জায়গাতে বসাল। রক্ত ঝরছে তার মুখ দিয়ে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে বাচ্চাটা। টোটা পকেট থেকে একফালি ন্যাকড়া বার করে বাচ্চাটার মুখের রক্ত মুছিয়ে দিতে লাগল।

প্রফেসর জুয়ান দীপাঞ্জনকে বলল, ‘শেন, আমাদের ‘মেডিক্যাল কিটে’ কাটা-ছেঁড়ার জন্য একটা ‘অয়েনমেন্ট’ আছে না? একবার দিয়ে দেখতে পারো, যদি নেয়? বাচ্চাটার রক্ত বন্ধ হতে পারে ওতে।’

জুয়ানের কথা শুনে দীপাঞ্জন মলমটা বের করে এমিকে নিয়ে জানলার পাশে এসে দাঁড়াল। এমি তারপর তাদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘এই শুনছ? এই ওষুধটা ওর মুখে লাগাও আরাম পাবে।’

টোটা তাকালো জানলার দিকে। মলমের টিউবটা দেখাল দীপাঞ্জন। প্রথমে একটু ইতস্তত করলেও শেষপর্যন্ত কাছে এসে টিউবটা নিল। তারপর বাচ্চাটার কাছে ফিরে গিয়ে টিউব থেকে সবটুকু মলম বের করে নিয়ে রং মাখানোর মতো পুরো মলমটাই লেপে দিল তার সঙ্গীর মুখে।

‘থ্যাঙ্ক ইউ।’ দীপাঞ্জনের উদ্দেশ্যে বলা টোটার মুখ থেকে এই প্রথম কোনো ইংরেজি শব্দ শুনল দীপাঞ্জনরা।

৷৷ ৯ ৷৷

নিস্তব্ধ দুপুর। বিকাল হব হব করছে। বাইরে কোনো শব্দ নেই। মাঝে মাঝে শুধু বাচ্চাটার গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে। চাবুকের প্রচণ্ড মার তার মুখে এসে পড়েছে। যন্ত্রণা তো হবেই। মেঝের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন শ্যাপেলিও। হতাশা আর ক্লান্তিতে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। জুয়ানও মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। চোখ বোজা তার। তবে দীপাঞ্জন আর এমি জেগে আছে। একসময় দীপাঞ্জন উঠে বসে বলল, “খুব খিদে পেয়েছে। জল খেয়ে পেট ভরিয়ে নিই।’

তার কথা শুনে এমি বলল, ‘আমার যে কার্ডবোর্ডের বাক্সটা আছে তার মধ্যে অনেক কিছু জিনিসপত্রের সাথে বিস্কুটের একটা প্যাকেট আছে। ওটা নিয়ে তুমি খেতে পারো। সত্যিই খিদেতে পেটের নাড়ি ছিঁড়ে যাবার জোগাড় তার। দীপাঞ্জন উঠে গেল ঘরের কোণায়। যেখানে রাখা আছে বেশ বড়ো একটা কার্ডবোর্ডের বাক্স। সারাটা পথ এমি বাক্সটা পিঠে নিয়ে এসেছে। এ বাক্সটা এমির ব্যক্তিগত সম্পত্তি।

বাক্সটা খুলল দীপাঞ্জন। একটা বিস্কুটের প্যাকেট তার ভিতরে রাখা থাকলেও আসলে বাক্সটা সস্তা দামের ছোটোছোটো খেলনায় ভরতি। মোটরগাড়ি, দমদেওয়া পুতুল, প্লাস্টিকের বল, টিনের পিস্তল, আরও নানা ধরনের খেলনা !

জিনিসগুলো দেখে দীপাঞ্জন বিস্মিতভাবে জানতে চাইল, ‘এত খেলনা কী করতে এনেছিলে তুমি?’

এমি জবাব দিল, ‘ইচ্ছা ছিল, যদি ভালোয় ভালোয় সব কাজ মিটে যায় তবে তোমাদের নিয়ে আমার গ্রাম ঘুরে আসব। গ্রামের বাচ্চারা এই সামান্য জিনিসে কত খুশি হয় তা ধারণা করতে পারবে না। গ্রামে যদি না-ও যাওয়া যেত তবে কাউকে দিয়ে এগুলো পাঠাতে পারতাম সেখানে। একটু দূরে হলেও চাদ হ্রদের তীরেই তো আমার গ্রাম।’

বিস্কুট খেতে খেতেই বাক্সটা থেকে একটা একটা খেলনা তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল দীপাঞ্জন। এত কষ্টের মধ্যেও খেলনাগুলো দেখে পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যেতে লাগল তার। এই যে দম দেওয়া গাড়ি, হাত-পা নাড়া পুতুল, এসব নিয়ে সে নিজেও কত খেলেছে ছোটোবেলায়। এ-জিনিসগুলো এক-একটা সে-বয়সে দীপাঞ্জনের নিজের প্রাণের থেকেও দামি ছিল! তখন তো আর ভিডিও গেম, কম্পিউটার গেম ঘরে ঘরে পৌঁছোয়নি। সামান্য একটা কাচের গুলিকেও সে বয়সে হিরার চেয়ে দামি মনে হত। কাঠের তৈরি সামান্য গুলি-ভাণ্ডার বিনিময়ে অর্ধেক পৃথিবী বিক্রি করে দেওয়া যেত কারও কাছে !

জিনিসগুলো দেখতে দেখতেই দীপাঞ্জনের হঠাৎ মনে হল, বাইরেটা যেন অদ্ভুত নিশ্চুপ হয়ে গেছে। থেমে গেছে বাচ্চাটার কান্না। কী হল ব্যাপারটা ?

দীপাঞ্জন জানলার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল টোটা আর বাচ্চাটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তারা অমন তাকিয়ে আছে কেন? দীপাঞ্জন এরপরই বুঝতে পারল ব্যাপারটা। আসলে তাদের দৃষ্টি তার হাতে ধরা ছোট্ট লাল টুকটুকে মোটর গাড়িটার ওপর নিবদ্ধ।

দীপাঞ্জন সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেল জানলার কাছে। হাতের মোটরগাড়িটা দেখিয়ে সে চাবুকখাওয়া ছেলেটাকে ইশারায় বলল, “তুমি এটা নেবে?’

বাচ্চাটা একবার তাকাল খেলনাটার দিকে, আর একবার তাকাল টোটার মুখের দিকে। তাদের দুজনের মধ্যে চাপা স্বরে কী কথাবার্তা হল তারপর বাচ্চা ছেলেটা উঁচু জায়গা থেকে নেমে এসে দীপাঞ্জনের হাত থেকে খেলনাটা নিয়ে আবার নিজের জায়গাতে ফিরে সেটা টোটার হাতে দিল। দুজনে বেশ কিছুক্ষণ সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার পর সেটা নিয়ে মাটিতে উঁবু হয়ে বসল বাচ্চাটা। গাড়িটাকে সে দম দিয়ে ছেড়ে দিতেই গাড়িটা পাথুরে মাটিতে গোল হয়ে ঘুরতে লাগল। বিস্মিতভাবে খেলনাটার দিকে তাকিয়ে রইল দুজন। তাদের দুজনের পিঠের আগ্নেয়াস্ত্রের নলগুলো আকাশের দিকে মুখ করা। সেগুলো অবশ্য খেলনা নয়, সত্যিকারের অস্ত্র!

আর এরপরই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করল। তাদের দুজনকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে চত্বরের এদিক ওদিক থেকে প্রথমে একজন, তারপর একজন, এভাবে চাইল্ড সোলজাররা এসে ভিড় জমাতে লাগল সেখানে। এক সময় পুরো বাহিনিটাই প্রায় হাজির হল সেখানে। সবার মুখেই বিস্ময়, সবাই নেড়েচেড়ে দেখতে চায় দম দেওয়া গাড়িটা। ইতিমধ্যে জুয়ান, শ্যাপেলিও আর এমিও এসে দাঁড়িয়েছে দীপাঞ্জনের পাশে। তারাও অবাক ব্যাপারটা দেখে।

হঠাৎ লেফটানেন্ট টোটা দীপাঞ্জনের উদ্দেশ্যে বলল, ‘এই একটাই আছে আর নেই।’ এমি সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘হ্যাঁ, আছে। আর একটা দিচ্ছি। এমির বাক্স থেকে বেরোল একটা ট্রেনগাড়ি । বৃত্তাকার প্লাস্টিকের লাইনের ওপর সেটা ঘোরে। এমি জানলার গরাদের ফাঁক গলিয়ে সেটা টোটার হাতে দিয়ে তার কার্যপদ্ধতি তাকে বুঝিয়ে দিল।

জানলার বাইরে মাটিতে সেই বৃত্তাকার রেললাইন পাতা হল। তার চারপাশে উবু হয়ে বসল চাইল্ড আর্মি। লাইনের ওপর দিয়ে খেলনা রেলগাড়িটা চলতে শুরু করতেই আনন্দে তালি দিয়ে উঠল চাইল্ড আর্মি। তাদের মুখের কাঠিন্য হঠাৎই যেন খসে পড়েছে! কে বলবে এরা মানুষ খুন করে! ওইতো যে ছেলেটা সবচেয়ে বেশি তালি দিল, সেইতো নিস্পৃহভাবে গুলি চালিয়ে ছিল গ্রামবাসী দুজনকে ! দীপাঞ্জনদের মনে হতে লাগল তাদের পিঠে ঝোলানো মেশিনগান, রাইফেল, রকেট লঞ্চার গুলোই বরং খেলনার! বেলা শেষের রোদ এসেছে তাদের মুখে। সেই আলোতে আনন্দে উদ্ভাসিত তাদের মুখগুলো। সহজ সরল গ্রাম্য বালকদের সাথে এ মুহূর্তে তাদের কোনো প্রভেদ নেই। বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকা রেলগাড়িটার দিকে তাকিয়ে কেউ কেউ নানারকম শব্দও করতে লাগল তারা। আর এসব করতে করতেই চাইল্ড আর্মি নিজেদের মধ্যে কী সব কথা বলতে শুরু করল।

কিছুক্ষণ পর লেফটানেন্ট টোটা, চাবুকের দগদগে ক্ষত মুখে নেওয়া বাচ্চাটা, তারও কয়েকজন জানলার সামনে এসে দাঁড়াল। এবং টোটা জানতে চাইল, ‘তোমাদের ওই বাক্সটা কী জাদু বাক্স? ও থেকে খেলনা বেরোয়?’

এমি জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, ওটাকে জাদুবাক্সই বলতে পারো। হাত দিলেই খেলনা বেরোয়। আর একটা ছেলে বলল, ‘কই বার করো তো দেখি?’

এমি এবার অদ্ভুত একটা কাণ্ড করল, জাদুকরদের মতো হাত-টাত নেড়ে অদ্ভুত ভাষায় কী-সব বলে বাক্সর ভিতর হাত ঢুকিয়ে একটা বল বার করে সেটা তুলে দিল সেই ছেলেটার হাতে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল বাচ্চাগুলো। হাত দিয়ে তারা বলটা টিপেটিপে দেখতে লাগল।

একজন মন্তব্য করল, ‘জাদুবল !’

এমি বাক্সটা তুলে আনল জানলার কাছে, ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে বলল, “দেখো, এর মধ্যে আরও অনেক কিছু আছে।’

জানলার গরাদ ধরে ঝুঁকে বাক্সর ভিতরটা দেখতে লাগল বাচ্চাগুলো। এত অদ্ভুত খেলনা বাক্সর ভিতর! তাদের আর বিস্ময়ের সীমা রইল না। লেফটানেন্ট টোটা এবার দীপাঞ্জনদের সবাইকে হঠাৎ অবাক করে দিয়ে বলল, ‘আমরা যদি তোমাদের ছেড়ে দেই তবে ওই বাক্সটা আমাদের দিয়ে দেবে?’

কথাটা শুনে চমকে উঠল দীপাঞ্জনরা। সামান্য কটা খেলনার বিনিময়ে এরা তাদের মুক্তি দেবে বলছে! বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে এমি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ দেব। বাক্সটা দিয়ে দেব।’

‘সত্যি দেবে?” বিস্ফারিত চোখে বলল একজন।

‘হ্যাঁ, সত্যি সত্যি দেব।’ জবাব দিল এমি।

কিন্তু এই সময় হঠাৎ একটা ছেলে বলল, ‘লেফটানেন্ট, কিন্তু এগুলো নিয়ে তো আমরা খেলতে পারব না। এগুলো জেনারেল কেড়ে নেবে। এখানে তো খোলা নিষিদ্ধ । মনে নেই, জেনারেল বলে যারা খেলে, তারা জেহাদি-বিপ্লবী হতে পারে না।’

মুহূর্তের মধ্যেই একটা নিস্তব্ধতা নেমে এল বাচ্চাগুলোর মধ্যে। কালো হয়ে গেল খুদে লেফটানেন্টের মুখ।

তাদের কথোপকথন তর্জমা করে দিতেই জুয়ান বললেন, ‘ওদের বলো, ওরা আমাদের সাথে পালাতে পারে। আমরা ওদের এঞ্জামেনা নিয়ে যাব। সেখানে ওরা আরও অনেক খেলনা পাবে। খাবার পাবে। সেখানে ওদের কেউ মারবে না। কারও ইচ্ছা হলে সেখান থেকে ওরা গ্রামেও ফিরতে পারবে।’

এমি কথাটা তাদের বলতেই আবার একটা গুঞ্জন শুরু হল বাচ্চাগুলোর মধ্যে। তাদের বলল, ‘সত্যিই সেখানে আরও খেলনা আছে?’ আর একজন বলল, ‘সত্যিই বাড়ি ফিরতে পারব?’

এমি বলল, ‘সব সত্যি, সব সত্যি।’

ঠিক এই সময় চাইল্ড আর্মির একজন এসে খবর দিল, থেকে উঠেছে। নতুন লেফটানেন্ট কুরি ঘুম টোটা দীপাঞ্জনদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘রাতে আমরা আসছি, এখন আর থাকা যাবে না। মার্চপাস্ট হবে । যে খেলনাগুলো তারা নিয়েছিল সেগুলো তারা ফেরত দিয়ে তাড়াতাড়ি ছুটল চত্বরের দিকে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে হাজির হল জাদুকর কুরি। তার হাতে চেনে বাঁধা হায়নার বাচ্চাটা। মার্চপাস্ট শুরু হল এরপর। দীপাঞ্জনরা জানলা দিয়ে সে দৃশ্য দেখতে লাগল। ছেলেগুলোর আজ ও কাজে যেন তেমন মন নেই। গলার জোরও তেমন শোনা যাচ্ছে না। লাইন ভাঙার জন্য কুরি একটা বাচ্চা ছেলের পিঠে চাবুক চালাল, আর একজনকে চড় কষাল ৷

অবশেষে মার্চপাস্ট শেষ হল একসময়। শয়তান জাদুকরটা ছেলেগুলোর প্রতি আরও কিছুটা হম্বিতম্বি করে নিজের ঘরে চলে গেল। চাঁদের বুকে সূর্য অস্ত গেল। অন্ধকার নামল। দীপাঞ্জনরা অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে লাগল লেফটানেন্ট টোটার জন্য । রোজকার মতো এদিনও মশাল জ্বলল। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি নিভেও গেল। আকাশে চাঁদ উঠল। শুনশান চত্বর। কেউ কোথাও নেই। এদিন তাদের খাবারও দিতে এল না কেউ। শ্যাপেলিও একসময় বললেন, ‘ওরা আমাদের সাথে মজা করেনি তো। যারা হিরে ফিরিয়ে দিল তারা সামান্য খেলনার বিনিময়ে আমাদের মুক্তি দিতে রাজি এ-ব্যাপারটা আমার এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। তার কথায় কেউ কোনো মন্তব্য করল না । আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলছে সবাই। এ-যেন এক অন্তহীন প্রতীক্ষা। রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে কোথা থেকে যেন হায়নার হাসি শোনা গেল! হয়তো এটা জাদুকরের পোষ্যটা। তবে হায়নার ওই ডাকটা রাত্রির রহস্যময়তা যেন আরও বাড়িয়ে দিল। অন্ধকারে ঘরে বসে মুক্তির প্রতীক্ষা করতে লাগল তারা চারজন ।
 

৷৷ ১০ ৷৷

এক সময় দরজার বাইরে শিকল খোলার শব্দ হল। টোটা আর কয়েকজন ঘরে ঢুকল, হ্যাঁ তারা এসেছে !

টোটা বলল, “নতুন লেফটানেন্ট জেগে ছিল তাই আসতে দেরি হল। রং-রুটরা আটকে ছিল একটা ঘরে। তাদেরও বের করে আনতে হল। খুব ভয় পাচ্ছে ওরা।’ এরপর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শেষবারের মতো সে জানতে চাইল, ‘তোমাদের সঙ্গে গেলে আমরা খেলনা পাবো তো? পেট ভরে খেতে পাব তো? মিলিটারি আমাদের মারবে না তো?’

জুয়ান তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “নিশ্চয় পাবে। আর কেউ তোমাদের মারবে না ।

জুয়ানের ভাষা পড়তে না পারলেও আর সস্নেহ স্পর্শে তিনি কী বলতে চাইছেন তা বুঝতে অসুবিধা হল না বাচ্চাটার। এমি এরপর জিজ্ঞেস করল, ‘কোন্ পথে পালাব আমরা?’

টোটো জবাব দিল, ‘হ্রদের ধার বরাবর জঙ্গল দিয়ে। তোমরা যেদিক থেকে এসেছ সেদিকেই। ওপথে একটা সিম্বা ঘুরে বেড়াচ্ছে কিছুদিন ধরে। ক-দিন আগে আমাদের একটা ছেলেকে সে তুলেও নিয়ে গেছে। কিন্তু সে পথ ধরা ছাড়া আমাদের পথ নেই। উলটো দিকে গেলে জেনারেল আমাদের ধরে ফেলবে। সে দিকেই তার ঘাঁটি।

এরপর সে বলল, ‘সামনের চত্বরটা খুব সাবধানে পেরোতে হবে। জাদুকর কুরি জেগে গেলে মুশকিল। হয়, তখন সে আমাদের পিছু নেবে, নয়তো ঢাক বাজিয়ে খবরটা জেনারেলের কাছে পৌঁছে দেবে। তারা আবার তখন আমাদের পিছু নেবে।’

সে কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই একটা বাচ্চা বলে উঠল, “ও লোকটাকে নিয়ে এত ভাবার দরকার কী। আমি এখনই ওর ঘরের দিকে যাচ্ছি। ও তো ঘুমাচ্ছে। এখনই ওর বুকে জানলা দিয়ে রাইফেলটা খালি করে দিয়ে আসছি, ব্যাস ঝামেলা শেষ।’ এমি তার কথা তর্জমা করে দিতেই জুয়ান বললেন, ‘না, এটা করা যাবে না। ওদের বলো এসব খুনের ভাবনা ছাড়তে হবে একান্ত প্রয়োজন না হলে কেউ যেন গুলি না চালায়।’

এমি ব্যাপারটা জানিয়ে দিল তাদের। তারা শুনে একটি বিমর্ষ হলেও ব্যাপারটা মেনে নিল।

দীপাঞ্জন হঠাৎ এই সময় খেয়াল করল যে বাচ্চাটা গুলি চালাবার কথা বলল, “তার ছেঁড়া জামার ফাঁক দিয়ে জাদুকর কুরির সেই ক্যামেরুনের শিঙাটা উঁকি দিচ্ছে। এটাকে যে আগ্নেয়াস্ত্র বলে ভাবছিল এতক্ষণ। এমির মাধ্যমে সে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, ‘জাদুকরের শিঙা তুমি কোথায় পেলে?’

ছেলেটা জবাব দিল, ‘মার্চপাস্টের সময় লোকটা ভুল করে এটা মাঠে ফেলে রেখে গেছিল, আমি কুড়িয়ে নিয়েছি। তোমার এটা পছন্দ। তবে নাও। এই বলে সে শিঙটা বের করে গুঁজে দিল দীপাঞ্জনের হাতে।

এত উত্তেজনার মধ্যেও শ্যাপেলিও হেসে বললেন, ‘ফুলানি ট্যামট্যামটা পাওয়া না গেলেও এই শিঙাটা অন্তত তুমি পেলে। টোটা এবার বলল, ‘আর দেরি করা যাবে না, এবার বেরোতে হবে।

দীপাঞ্জন নিজের কোমরে গুঁজে নিল শিঙাটা। তৈরি তারা হয়েই ছিল। খুব সামান্য জিনিস আর খেলনার বাক্সটা শুধু সঙ্গে নেওয়া হয়েছে।

ঘর থেকে বেরোল সবাই। টোটার বাকি সঙ্গীরা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। চাইল্ড আর্মির উনিশ জন, আর বারো জন রং-রুটটা। দেখেই বোঝা গেল নতুন ছেলেগুলো খুব ভীতসন্ত্রস্ত। আট-দশ বছরের ছেলে সব। টোটা জানাল মাত্র ক-দিন আগেই হ্রদের উত্তরদিকের এক গ্রাম থেকে তাদের ধরে আনা হয়েছে।

চাঁদের আলোতে শুনশান পাথুরে চত্বরটা দাঁড়িয়ে আছে। পাথুরে দেয়াল আর টিনের চালঅলা একটা ঘর দেখিয়ে টোটা বলল, ‘নতুন লেফটানেন্ট ওখানেই ঘুমাচ্ছে। ওই ঘরটার সামনে দিয়ে বুকে হেঁটে যেতে হবে কয়েকটা দলে ভাগ হয়ে। ঘরটার সামনে হায়নার বাচ্চাটা চেনে বাঁধা আছে। দূর থেকে তার জ্বলন্ত চোখ দুটো আগুনের ফুলকির মতো দেখাচ্ছে। নিঃশব্দে চত্বরের দিকে এগোল সবাই। এক সময় তারা পৌঁছে গেল ঘরটার কাছাকাছি। ঘরটা পেরিয়ে একটু এগোতেই হ্রদের পাড়ের জঙ্গলের মুখে পৌঁছে যাওয়া যাবে। হ্রদটা দেখা যাচ্ছে। চাদের জলে ধরা পড়ছে চাঁদের প্রতিবিম্ব। ঝিলমিল করছে হ্রদের জল। এই অবস্থার মধ্যেও তা দেখে দীপাঞ্জনের মনে হল প্রকৃতি কী আশ্চর্য সুন্দর !

দাঁড়িয়ে পড়ল টোটা। বয়সে বাচ্চা হলেও এবার তার সামরিক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া গেল। লেফটানেন্ট টোটা বলল, ‘একসাথে নয়, তিনটে দলে ভাগ হয়ে বুকে হেঁটে ঘরের সামনেটা পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকে এগোতে হবে। পিছনের দলের জন্য কেউ থামবে না। তাতে তেমন কিছু হলে এক সাথে সবাই ধরা পড়বে না। প্রতিটা দলে ভাগ হয়ে থাকবে দীপাঞ্জনদের, চাইল্ড আর্মির আর রং-রুট ছেলেগুলো।’ চাইল্ড আর্মি থেকে তিনজন অভিজ্ঞ ছেলেকেও তিনটে দলের নেতৃত্ব দেবার জন্য নির্বাচন করল সে। ঠিক হল প্রথম দলে যাবেন শ্যাপেলিও, দ্বিতীয় দলে জুয়ান, তৃতীয় দলে এমি আর দীপাঞ্জন ৷

দীপাঞ্জন টোটাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কোন্ দলে?”

সে জবাব দিল, ‘তিন দলের কোনোটাতেই নয়। আমি পিছন থেকে সামনের তিনটে দলকে ‘কভার’ করব। অর্থাৎ পিছন থেকে কোনো আক্রমণ হলে সেটা ঠেকাব। সবাই বেরোবার পর আমি এ-জায়গা ছাড়ব। সেনাদলের নিরাপত্তার দায়িত্ব তো লেফট্যানেন্টকেই নিতে হবে।’ লেফটানেন্টসূচক গম্ভীরভাবেই সে কথাগুলো বলল।

দীপাঞ্জন বলল, ‘তুমি একলা নয়, আমিও সব শেষে থাকব তোমার সাথে।’

প্রথম দলটা এগোতে শুরু করল সামনের দিকে। কয়েক-পা হেঁটে মাটিতে শুয়ে পড়ে বুকে হেঁটে এগোল সবাই। সেই ঘরটার মাত্র পনেরো ফুট তফাত দিয়ে বুকে হেঁটে ঘরটা পেরোচ্ছে তারা। জাদুকর শয়তানটা কোনোভাবে জেগে উঠলেই বিপত্তি। হায়নার বাচ্চাটা বিস্মিতভাবে তাকিয়ে তাদের দেখছে। দীপাঞ্জনরাও তাকিয়ে আছে দলটার দিকে। বুকের মধ্যে উত্তেজনায় হাতুড়ি পেটার শব্দ হচ্ছে। তবে শেষপর্যন্ত জায়গাটা তারা নির্বিঘ্নে পেরিয়ে গেল। তারা শ্যাপেলিওকে নিয়ে অদৃশ্য হলো জঙ্গলের ভিতরে।

দ্বিতীয় দলে রয়েছেন জুয়ান। তিনি এগোবার আগে একবার তাকালেন দীপাঞ্জনের দিকে। দীপাঞ্জন তাকে আশ্বস্ত করে বলল, আপনি এগোন আমার কোনো বিপদ হবে না ।

চাইল্ড-আর্মির সাথে বুকে হেঁটে এগোতে শুরু করলেন। দ্বিতীয় দলটাও নিশ্চিন্তে পেরিয়ে গেল জায়গাটা। জুয়ানও তারপর হারিয়ে গেলেন জঙ্গলের আড়ালে। প্রতি দলের বুকে হেঁটে জায়গাতে পেরোতে, জঙ্গলে ঢুকতে মিনিট দশেক সময় লাগছে চাইল্ড-আমি মিলিটারি ট্রেনিং এর কারণে বুকে হাঁটায় পারদর্শী হলেও রং-রুট বাচ্চারা এ ব্যাপারে খুব শ্লথ। অবশেষে যাত্রা শুরু করল তৃতীয় দল। দাঁড়িয়ে শুধু লেফট্যানেন্ট টোটা আর দীপাঞ্জন ।

তৃতীয় দলে এমি আছে। বুকে হেঁটে তারাও পেরোতে লাগল ঘরের সামনেটা। ঘরটা যখন প্রায় পেরিয়ে এসেছে ঠিক তখনই একটা ঘটনাটা ঘটল। কৌতূহলী হায়নার বাচ্চাটা এতক্ষণ চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল তার সামনে দিকে ঝুঁকে হেঁটে যাচ্ছে দোপেয়ে জীবগুলো। হয়তো তা দেখে শেষ পর্যন্ত হাসি চাপতে না পেরে হ্যাঁ, হ্যাঁ করে হেসে উঠল। আর তাতেই ভয় পেয়ে গেল বছর আটেকের এর রং-রুট। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠে দাঁড়াল সে। সেটা মুহূর্তের মধ্যে সংক্রামিত হল অন্য বাচ্চাদের মধ্যে। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে ছুটতে লাগল জঙ্গলের দিকে। আর তাতেই যা হবার তাই হলো। ঘরটার ভিতর থেকে শোনা গেল জাদুকর কুরির চিৎকার, ‘পালাচ্ছে! পালাচ্ছে!”

টোটা বলল, ‘আর সময় নষ্ট নয়। আমাদেরও পালাতে হবে।’ বুকে হেঁটে নয়। জাদুকরের ঘরের সামনে দিয়েই তির বেগে ছুটতে শুরু করল বাইরে যাবার জন্য। সেই ঘরের পাশ দিয়ে যখন তারা যাচ্ছে তখন সশব্দে খুলে গেল সেই ঘরের দরজা। মুহূর্তের জন্য একবার চোখাচোখি হলো তার সাথে দীপাঞ্জনের। হায়নার বাচ্চাটার থেকেও কদর্য হিংস্র জাদুকরের মুখ। আক্রোশে সে দুর্বোধ ভাষায় হিংস্র চিৎকার করে উঠল পলায়নমান দীপাঞ্জনদের দেখে জঙ্গলের দিকে তৃতীয় দলটা অদৃশ্য হলেও একজন তাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়েছে। দীপাঞ্জন ছুটতে ছুটতে তার অবয়ব দেখে বুঝতে পারল সে এমি। সে অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। চত্বর ছেড়ে তার তখন জঙ্গলে ঢোকার বাঁকের মুখে এমির কাছাকাছি প্রায় পৌঁছে গেছে। ঠিক তখনই পেছনে সাব মেশিনগানের ‘র‍্যাট র‍্যাট’ শব্দ শোনা গেল। এক ঝাঁক গুলি প্রথমে দীপাঞ্জনের মাথার ওপর দিয়ে ‘সাঁই সাঁই’ শব্দে হাওয়া কেটে বেরিয়ে গেল। আর তার পরমুহূর্তেই টোটা ছিটকে পড়ল মাটিতে। জাদুকর কুরির ছোড়া গুলি লেগেছে তার গায়ে। অস্পষ্টভাবে টোটা একবার শুধু বলে উঠল, ‘পালাও, তোমরা পালাও।’

এমি ছুটে এসে কাঁধে তুলে নিল টোটার ছোট্ট দেহটাকে। আরও এক ঝাঁক গুলি বেরিয়ে গেল তাদের পাশ দিয়ে টোটাকে কোনোরকমে নিয়ে তারা ঢুকে পড়ল জঙ্গলের মধ্যে।

অজানা, অচেনা জঙ্গল। মাঝে মাঝে বড়ো গাছ থাকলেও ঝোপঝাড়ই বেশি। দীপাঞ্জনদের সাথে পথ দেখাবার মতো চাইল্ড আর্মির কেউ নেই। টোটা অচৈতন্য। রক্ত ধরছে তার দেহ থেকে। অগ্রবর্তী তিনটে দল কোন্ পথ ধরল তারা বুঝতে পারল না। তবুও সেই ঝোপঝাড় ঠেলে এগোবার চেষ্টা করতে লাগল তারা। হঠাৎ গুলির আওয়াজ থেমে বেজে উঠল ‘ফুলানি ট্যামট্যাম।’ ঢাক বাজাচ্ছে কুরি। শব্দটা শুনে কেঁপে উঠল এমি। যন্ত্রণার চিহ্ন ফুটে উঠল তার মুখে। দীপাঞ্জন বলল, ‘ঢাক কী বলছে?’ যন্ত্রণাক্লিষ্ট কণ্ঠে এমি বলল, ‘ও বলছে ওরা পালাচ্ছে! ওরা পালাচ্ছে!’ তবে যত কষ্টই হোক আমি থামব না। প্রচণ্ড যন্ত্রণা উপেক্ষা করেও যেন চলতে লাগল সে। কিন্তু কিছুটা এগিয়ে তাদের থামতে হলো অন্য একটা শব্দে। যে দিকে তারা এগোচ্ছে সেদিক থেকেই এল শব্দটা। একটা গর্জন। এমি বলল, ‘সিম্ব! সিংহ।’

সিংহটা বার কয়েক ডাকার পর ঢাকের বাজনাটা হঠাৎ থেমে গেল। এমি কিছুটা আশ্বস্ত হল তাতে। সে এরপর বলল, ‘তবে সিংহটা বেশ কাছাকাছিই আছে। এদিকেই আসছে। আর সামনে এগোনো যাবে না ।

দীপাঞ্জন বলল, ‘তবে কোন্ দিকে যাবে। পিছনে গেলে তো জেনারেল বা জাদুকরের খপ্পরে পড়তে হবে।’

আবার সিংহটার গলা শোনা গেল। ঠিক গর্জন নয়, চাপা একটা ঘড়ঘড় শব্দ। সে শব্দটা গড়াতে গড়াতে সে-দিকে আসছে! কিছুটা তফাতেই একটা বিরাট কাঁটাঝোঁপ। এমি বলল, ‘কপালে যা আছে হবে, ওই কাঁটা ঝোপের মধ্যেই আত্মগোপন করতে হবে।’ তারা দুজন এরপর কোনোরকমে টোটার ছোট্ট শরীরটাকে নিয়ে ঝোঁপের মধ্যে ঢুকে পড়ল। কাঁটার আঘাতে তাদের দেহের উন্মুক্ত স্থানগুলো ছিঁড়ে রক্ত বেরোতে লাগল। তারা অবশ্য সে সব ভ্রুক্ষেপ করল না। আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে কীভাবে নিজেদের রক্ষা করা যায় সেটাই তাদের আসল লক্ষ এখন। ঝোঁপের ফাঁক দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল দুজনে। বড়ো গাছ এ জঙ্গলে খুব বেশি না থাকায় চাঁদের আলোয় ঝোপঝাড়ের ওপর এসে পড়ছে। কিছুটা আলো-আঁধারি হলেও মোটামুটি দেখা যাচ্ছে বাইরেটা। এমি একবার আফশোশের সুরে বলল, টোটা যখন গুলি খেয়ে পড়ল তখন ওর অস্ত্রটাও কয়েক হাত তফাতে ছিটকে পড়েছিল। ওটা তখন বুদ্ধি করে কুড়িয়ে আনলে ভালো হত। আত্মরক্ষা করা যেত ।

দীপাঞ্জন বলল, ‘সিংহটা যেদিক থেকে আসছে, সবাইতো সেদিকেই গেছে। ওরা সিংহর মুখোমুখি হল না কেন?’

এমি জবাব দিল, ‘সিংহ অতি ধূর্ত প্রাণী। বনের মধ্যে এতজন লোককে একসাথে দেখে নিশ্চয়ই গা ঢাকা দিয়েছিল। এবার শিকারের খোঁজে এদিকে আসছে।’

সেই ঝোপের মধ্যে বসে রইল দীপাঞ্জনরা। সিংহটা দূরে চলে গেছে বুঝতে না পারলে বেরোবার আর কোনো উপায় নেই। তার ডাক না শোনা গেলেও হয়তো খুব কাছেই সে এসে পড়েছে। এমি এবার টোটার নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখল তার শ্বাস চলছে কিনা হ্যাঁ, চলছে গুলিটা কোথায় লেগেছে দীপাঞ্জনরা তা ঠিক বুঝতে পারছে না। সময় এগোতে থাকল। প্রতিটি মিনিট যেন এক! একটা ঘণ্টা মনে হতে লাগল তাদের কাছে। এভাবে প্রায় আধঘণ্টা সময় কেটে গেল। এমি একসময় বলল, ‘তুমি বাচ্চাটাকে একটু “ধরো, আমি বাইরে বেরিয়ে দেখি। সামনের ওই গাছে চড়লে অনেকদূর দেখা যাবে। হয়তো সিংহটা অন্য দিকে চলে গেছে?’

দীপাঞ্জন বলল, “আচ্ছা !’

এরপর সে বাচ্চাটাকে কোলে নিতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই ঝোঁপের ফাঁক দিয়ে তাদের চোখে পড়ল একটা দৃশ্য। জঙ্গলে ঢুকছে একটা লোক! তার এক হাতে ধরা আছে স্বয়ংক্রিয় একটা রাইফেল। অন্য হাতে যা ধরা আছে তা দেখে লোকটাকে চিনতে পারল দীপাঞ্জন। জাদুকর কুরি তাদের পিছু ধাওয়া করে এ-পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। গলায় তার ট্যামট্যাম ঝুলছে। আর এক হাতে ধরা শিকল বাঁধা হায়নার বাচ্চাটা !

দীপাঞ্জন বলল, ‘ও সম্ভবত ঝোপের বাইরে থেকে আমাদের দেখতে পাবে না। আমাদের পাশ দিয়ে চলে যাবে।’

কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হল। দূর থেকে তাদের দিকেই যেন আসতে লাগল কুরি। হায়নার বাচ্চাটা চেনে বাঁধা। কুকুরের মতো মাটি শুঁকতে শুঁকতে তার প্রভুকে নিয়ে ঝোপের দিকেই আসতে লাগল !

এমি বলল, ‘মনে হচ্ছে আমরা ধরা পড়ে যাব। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি। রক্তের গন্ধ পেয়েছে হায়নার বাচ্চাটা। টোটার গায়ের রক্ত। এ-গন্ধ বহু দূর থেকে টের পায় এ সব প্রাণী।’

ঝোপটার ফুট তিরিশেক তফাতে এসে থেমে গেল জাদুকর। ঝোপটাকে লক্ষ করে হায়নার বাচ্চাটা শেকল টান দিচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কুরি তাকাল ঝোপটার দিকে। চাঁদের আলো এসে পড়েছে তার মুখে। কী বীভৎস সেই মুখ! যেন জিঘাংসার প্রতিমূর্তি! আফ্রিকার যে-কোনো হিংস্র শ্বাপদের চেয়েও তা ভয়ঙ্কর।

কুরি তাকিয়ে আছে ঝোপের দিকে। নিজেদের হৃদস্পন্দন যেন শুনতে পাচ্ছে দীপাঞ্জনরা। কুরি তার হাতের রাইফেল একটু উঁচিয়ে ধরল। ঝোপ লক্ষ করে সে গুলি চালাবে নাকি? প্রমাদ গুনল দীপাঞ্জনরা।

ঠিক সেই মুহূর্তেই অন্য একটা শব্দে কেঁপে উঠল বনভূমি। সিংহর গর্জন! প্রাণীটা তাহলে কাছেই ওঁৎ পেতে ছিল! তার ডাক শুনেই কুরি শব্দটার উৎস সন্ধান করার জন্য চারপাশ তাকাল। তার মুখে যেন এবার আতঙ্ক ফুটে উঠল। হায়নার বাচ্চাটার শিকল হাত থেকে ফেলে দিল সে। সিংহের গর্জনে আতঙ্কিত প্রাণীটা ছুটল অন্যদিকে। আর এর পর কুরিও সম্ভবত গা ঢাকা দেবার জন্য দীপাঞ্জনদের ঝোপটার দিকেই আসতে লাগল!

হঠাৎ দীপাঞ্জনের মস্তিষ্কে একটা অদ্ভুত ভাবনা কাজ করল। কুরি তখন ঝোপটার হাত দশেকের মধ্যে চলে এসেছে, দীপাঞ্জন তার নিজের কোমর থেকে কুরির-ই সেই শিঙাটা বার করে তাতে ফুঁ দিয়ে দিল। অবিকল সিংহর গর্জন বেরোচ্ছে তার থেকে। আবারও কেঁপে উঠল বন।

ঝোপের ভিতরেই সিংহটা আছে! আর কুরি কিনা এগোচ্ছে সেদিকেই! এ-ব্যাপারটা ভেবে নিয়ে গুলি চালানো ভুলে গিয়ে আতঙ্কে ছুটল পিছনের দিকে। আর এরপরই ঝোপের ভিতর থেকে দেখল সেই ভয়ংকর দৃশ্য যেদিকে কুরি দৌড়চ্ছে সেদিক থেকেই চাঁদের আলোতে একটা ধূসর বিদ্যুৎ যেন উড়ে এসে পড়ল জাদুকর কুরির ওপর। সিংহের গর্জনের সাথে মিশে গেল কুরির আর্তনাদ। কয়েক মুহূর্ত মাত্র! কুরিকে মুখে তুলে নিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল আফ্রিকার রাজা। হায়না যতই ধূর্ত আর খল হোক বনের রাজার কাছে পরাস্ত হল সে ।

দীপাঞ্জনরা কিন্তু এখনই বেরোল না। আরও কিছুটা সময় অতিক্রান্ত হবার পর দূর থেকে ভেসে এল সিংহের ডাক। এমি বলল, ‘এবার বেরোনো যাবে। সিংহ তার শিকার নিয়ে দূরে সরে যাচ্ছে।’

অচৈতন্য টোটাকে নিয়ে ঝোপের বাইরে বেরোল দুজন। অন্ধকারেও একটা জিনিস চোখে পড়ল এমির। কিছুটা তফাতে পড়ে আছে কুরির সেই ফুলানি ট্যামট্যামটা! সিংহ তাকে তুলে নেবার সময় তার গলা থেকে ছিঁড়ে পড়েছে বাজনাটা। টোটাকে দীপাঞ্জনের কাঁধে দিয়ে সে দৌড়ে গিয়ে কুড়িয়ে আনল বাজনাটা, আর তার সাথে কুরির রাইফেলটাও। কাছেই কোথাও ঝোপের আড়াল থেকে কেঁদে উঠল কুরির হায়নার বাচ্চাটা। তাকে দেখার সময় তখন দীপাঞ্জনদের ছিল না। চাদের পাড় ধরে জঙ্গল ঘেঁষে তারা টোটাকে নিয়ে ছুটতে শুরু করল।

ছুটতে ছুটতেই গুরুগুরু মেঘ ডাকার মতো শব্দ যেন কানে আসতে লাগল দীপাঞ্জনের। উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম চতুর্দিক দিয়েই যেন দূর থেকে ভেসে আসছে শব্দ। কখনও-বা খুব স্পষ্ট, কখনও-বা আবছা। কথা বলা ঢাকের শব্দ দীপাঞ্জন জিজ্ঞেস করল, ‘এত ঢাক বাজছে কেন? কী কথা হচ্ছে?”

এমি বলল, ওরা বলছে, ‘যুদ্ধ হবে যুদ্ধ। সেনা আসছে।’ এ-খবরই এক গ্রাম অন্য গ্রামকে জানিয়ে সতর্ক করে দিচ্ছে।’

‘কার সাথে কার যুদ্ধ ?”

এমি জবাব দিল, ‘সরকারি সেনার সাথে জেনারেল বরনুর দলের। আরও তাড়াতাড়ি পা চালাও। আমরা দু-দলের গোলাগুলির মাঝে পড়ে গেলে বাঁচব না।’

বাচ্চাটাকে নিয়ে আরও দ্রুত ছুটতে লাগল তারা। চাদের জলে তখন আলো ছড়াচ্ছে মাথার ওপরের চাঁদ। সেই আলোতে হ্রদের জলে খেলা করছে হিপোর দল। জলে ডুব দিচ্ছে, আবার ভুস করে ভেসে উঠছে। অ্যান্টিলোপের ঝাঁক সার বেঁধে হ্রদের দিকে এগোচ্ছে জলপানের জন্য, আর তাদের জন্য হ্রদের পাড়ে ওৎ পেতে আছে কুমিরের দল। এসব কোনো দৃশ্যই চোখে পড়ল না দীপাঞ্জনদের। তাদের শুধু কানে আসছে কথা বলা ঢাকের শব্দ। যুদ্ধ হবে, যুদ্ধ হবে . . .

হঠাৎ একটা বাঁক ঘুরতেই তাদের কানে একটা তীক্ষ্ণ শব্দ এল—“হল্ট’।

থমকে দাঁড়াল তারা। হ্রদের পাড়ের জঙ্গল থেকে অন্ধকার বিদীর্ণ করে জ্বলে উঠল এক ঝাঁক টর্চের জোরালো আলো! তাহলে কী তারা শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে গেল জেনারেল বরনুর হাতে? এখনই নিশ্চয় ছুটে আসবে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি! আত্মসমর্পণের জন্য মাথার ওপর হাত তুলতে যাচ্ছিল দীপাঞ্জন। ঠিক সেই সময় প্রফেসর জুয়ানের কণ্ঠস্বর কানে এল—ভয় নেই দীপাঞ্জন। এরা সরকারি আর্মি।’

ছুটে এলেন জুয়ান। তারপর তিনি কোলে তুলে নিলেন লেফটানেন্ট টোটার ছোট্ট দেহটা ৷

পরিশিষ্ট : তিনদিন পর সকালবেলা ইউনিসেফের অতিথিশালার একটা ঘরে বসেছিল সকলে। দীপাঞ্জন, প্রফেসর জুয়ামশিয়ে, শ্যাপোলিও আর এমি। ইউনিসেফ হল সেই আন্তর্জাতিক সংস্থা যারা ইউনেস্কোর সহযোগীরূপে সারা পৃথিবীর শিশুদের জন্য কাজ করে। তাদের হাতেই সমর্পণ করা হয়েছে ‘চাইল্ড আর্মি’র বাচ্চাগুলোকে। তারাই দেখভাল করবে তাদের। শিক্ষার ব্যবস্থা করবে, ভরণপোষণের দায়িত্ব নেবে যাতে বাচ্চাগুলো ভবিষ্যতে মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠতে পারে।

টেবিলের ওপর পড়েছিল এদিনের একটা ইংরেজি সংবাদপত্র। এখানকার অন্য সব সংবাদপত্রর মতোই এ কাগজটাতেও বেশ ফলাও করে ছাপা হয়েছ জেনারেল বরনুর অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবার খবর। তাকে যদিও শেষ পর্যন্ত ধরা যায়নি, কিন্তু তার বেশ কিছু ঘাঁটি ধ্বংস করেছে সরকারি সেনাদল। অনুমান করা হচ্ছে, জেনারেল বরনু সুদানের দিকে পালিয়েছেন। কাগজটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে তাতে একবার চোখ বুলিয়ে প্রফেসর জুয়ান বললেন, ‘সব চেয়ে খুশির খবর যে আমাদের লেফট্যানেন্ট টোটা বিপদমুক্ত। ডাক্তাররা তার পাঁজর থেকে গুলিটা বার করতে পেরেছেন। সপ্তাহখানেকের মধ্যে সে সুস্থ হয়ে উঠবে। খুব চিন্তায় ছিলাম ওর জন্য। এই যাবার বেলায় ছেলেটার সাথে দেখা হলে আরও ভালো লাগত। ওর জন্যই তো আমরা মুক্তি পেলাম। আর এমি, তোমার কথাও আমরা জীবন ভুলব না। হয়তো আবার কোনোদিন দেখা হবে তোমার সঙ্গে। গোছগাছ সব হয়ে গেছে। দীপাঞ্জনরা কিছুক্ষণের মধ্যেই রওনা হবে এয়ারপোর্টে ঘরে ফেরার জন্য। বিদায়বেলায় তাদের সাথে দেখা করতে এসেছে এমি। তার সঙ্গে একটা পিচবোর্ডের বাক্স।

জুয়ানের কথা শেষ হবার পর এনি প্রথমে তার উদ্দেশে বলল, ‘হ্যাঁ, আমিও সেই আশাতেই রইলাম। আপনারা আবার আসবেন আমাদের চাদের দেশে’। তারপর সে শ্যাপেলিওর দিকে তার বাক্সটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই নিন আপনার জিনিস। যার জন্য এত কষ্ট সহ্য করতে হল আপনাদের। এই বাক্সর মধ্যে রাখা আছে সেই ফুলানি ট্যামট্যাম। এটা আমার উপহার।’

বাক্সটা হাতে পেয়ে শ্যাপেলিওর মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি বললেন, ‘আমার সংগ্রহশালাতে এ জিনিসের দাতা হিসাবে তোমার নাম লিখে রাখব আমি। বহু লোক সেটা জানবে ।

দীপাঞ্জন এবার এমির উদ্দেশে বলল, ‘এই যাবার বেলা তোমার থেকে একটা জিনিস জানতে চাই। ফুলানি ট্যাম ট্যামের বাজনা শুনলেই তুমি বারবার অমন অদ্ভুত আচরণ করেছিলে কেন?’

প্রশ্ন শুনে মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে এমি বলল, ‘ফুলানি ট্যামট্যাম কেন এত দুষ্প্রাপ্য, কেন সরকার তা নিষিদ্ধ করেছে জানো’—এই বলে সে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে তার শার্টটা উঠিয়ে ফেলল। এমির পিঠটা উন্মুক্ত হয়ে গেল। দীপাঞ্জনরা বিস্মিতভাবে দেখলে এমির গায়ের রং ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হলেও তার শ্বেতী রোগীদের মতো সব ফ্যাকাশে! আর তাতে আঁকা হয়ে আছে অনেক কাটাকুটির দাগ !

জামাটা এরপর আবার নামিয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে এমি বলল, ‘ফুলানি ট্যামট্যাম তৈরি করা হয় মানুষের চামড়া দিয়ে। আর এই ট্যামট্যামটা বানানো হয়েছিল আমার চামড়া দিয়ে।’

তার কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল সবাই। দীপাঞ্জন বলে উঠল, ‘কী বলছ তুমি!’

এমি বিষণ্ণ হেসে বলল, ‘আমি ঠিকই বলছি। সেটা আমার ছেলেবেলার এক ভয়ংকর স্মৃতি! জাতিদাঙ্গায় পরাজিত হলো আমার গ্রাম। আমার বাপ-মা প্রাণ হারাল তাতে। আমাকে প্রাণে না মারলেও আমাকে নিয়ে যাওয়া হল ওই ফুলানি গ্রামে। সে গ্রামের মাথা এখন তুয়াতুনা নামের এক ভয়ংকর লোক। তিকাকা বলেছিল যার কথা। ওই ট্যামট্যাম বানানোর জন্য আমার পিঠের চামড়া ছাড়ানো হল। তারপর আমাকে ফেলে আসা হয়েছিল চাদ হ্রদের ধারে জঙ্গলে। ভাগ্যক্রমে এক মিশনারি আমাকে দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে। চিকিৎসা করে আমাকে সুস্থ করে তোলে। এই ট্যাম ট্যামির বাজনা শুনলেই আমার মনে পড়ে যায় সেই ছেলেবেলায় ভয়ংকর স্মৃতি। ছোট্ট একটা বাচ্চা ছেলের পিঠের চামড়া ছাড়ানো হচ্ছে! আমি সহ্য করতে পারি না।’—এই বলে আতঙ্কে চোখ বুজল এমি। মুহূর্তখানেক পর চোখ খুলে সে আবার হেসে শ্যাপেলিওকে বলল, “জিনিসটা রাখুন আপনার কাছে, সংকোচ করবেন না। এ চাদের বাজনা এর পর যদি কেউ বাজায় ও সাগর পেরিয়ে সে শব্দ আর আমার কানে এসে পৌঁছবে না। নিন, এবার চলুন, নইলে আপনাদের ফ্লাইট ধরতে দেরি হয়ে যাবে।

অতিথিশালা থেকে বাইরে বেরিয়ে এল সবাই। সামনে শানবাঁধানো বিরাট সুদৃশ্য চত্বর। ইউনিসেফের পতাকা উড়ছে সেখানে। সেদিকে তাকিয়ে দীপাঞ্জন বিস্মিতভাবে বলে উঠল, আরে, ওই যে লেফটানেন্ট টোটা!”

যেখানে ইউনিসেফের ফ্ল্যাগটা উড়ছে ঠিক তার নীচে দপ্তরের কয়েকজন কর্মীর সাথে দাঁড়িয়ে আছে চাইল্ড আর্মির বাচ্চাগুলো। না, এখন তাদের পরিচয় আর চাইল্ড আর্মি নয়। বাচ্চাগুলোর পরনে নতুন পোশাক। মুখে কোনো কাঠিন্য নেই, চোখে নেই কোনো হিংস্র। সকালের আলোতে ঝলমল করছে বাচ্চাগুলোর মুখ। ইউনিসেফের ব্যান্ড বাজছে। দীপাঞ্জন হাত রাখল টোটার ছোটো হাতের ওপর। সে টোটাকে বলল, ‘তোমার জন্য নতুন জীবন পেলাম আমরা।”

টোটা হেসে বলল, ‘আর তোমাদের জন্য আমরাও।’

এরপর সে বলল, ‘তোমাদের দেওয়া খেলনাগুলো খুব সুন্দর, তবে তার মধ্যে ক-টা জিনিস আমাদের আর লাগবে না।’

‘সেগুলো কী?’ দীপাঞ্জন হেসে জানতে চাইল।

পাশ থেকে একটা বাচ্চা এগিয়ে এসে দীপাঞ্জনের হাতে ধরিয়ে দিল সেগুলো। কয়েকটা খেলনা পিস্তল। যেগুলো রাখা ছিল খেলনার বাক্সর মধ্যে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *