চাতকচাতকীর মতো
চাকচাতকী আমি কখনো দেখি নি। তবে স্বপ্নজাগানো একটি গল্প শুনেছি আমার অদেখা ওই পাখি সম্পর্কে। পিপাসায় বুক ফেটে যেতে চায় চাতকের। দরকার তার ঠাণ্ডা জল। চারদিকে কতো দিঘি হ্রদ সাগর। কতো নদী সরোবর, কিন্তু তাতে, কবি রামনিধি গুপ্ত প্রশ্ন করেছেন, কিবা ফল চাতকীর? চাকচাতকীর পিপাসা তো মিটবে না পদ্মদিঘির জলে। ঝর্নাধারায়, নদীর স্রোতে, সরোবরের টলটলে পানিতে। তার চাই মেঘগলা ঠাণ্ডা জল। চাতকচাতকী ডাকে, ‘ঠাণ্ডা মেঘ, কালো মেঘ, জল দাও। তোমার ধারাজল ছাড়া কিছুতেই যে পিপাসা মেটে না।’ এক সময় নীল আকাশের কালো মেঘ গ’লে বৃষ্টি নামে। আকাশ থেকে রুপোর রেখার . মতো নেমে আসা বৃষ্টির জল পান ক’রে তৃষ্ণা মেটে চাতকের। চাতকীর। আর কোনো জলে—ওই নদীর, দিঘির, ঝর্নার, সাগরের, সরোবরের জলে—পিপাসা মেটে না তাদের। আমরা সবাই ওই চাতকচাতকীরই মতো।
কতো ভাষা এই পৃথিবীতে। বাঙলা ইংরেজি ফরাশি জর্মন জাপানি রুশ তামিল তেলুগু মালায় আরবি ফারসি হিন্দি আসামি ওড়িয়া হিব্রু ও আরো কতো ভাষা। ইচ্ছে করলে আর সুযোগ পেলে আমরা শিখতে ও বলতে পারি যে-কোনো ভাষা। কিন্তু পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের রয়েছে একটি আপন ভাষা : মাতৃভাষা। যে-ভাষা তার মায়ের, যে-ভাষা তার বাবার। যে-ভাষা তার সমাজের অন্যান্যের; যে-ভাষা তার নিজের। নিজ ভাষা ব’লে আর শুনে যে-সুখ, তা পাওয়া যায় না অন্য কোনো ভাষায়। প্রতিটি মানুষের মূল পরিচয় তার ভাষায়। তার জাতীয় পরিচয়ও খচিত তার ভাষায়। প্রতিটি মানুষ তার আপন ভাষার চাতক। প্রত্যেকের নিজ ভাষা তার কাছে মেঘগলা বৃষ্টির জলের মতো। তার ঠাণ্ডা আদর ছাড়া মানুষের পিপাসা মেটে না। কতোদিন আমি দূরদেশে, তিন বছর ধ’রে, বাসে চেপে পায়ে হেঁটে তুষার ঠেলে বন্ধুর বাসায় টোকা দিয়েছি শুধু একটু বাঙলা বলবো ব’লে। শুধু একটু বাঙলা শুনবো ব’লে। এমন হয় সব মানুষেরই। পৃথিবীতে কতো ভাষা, তবু শুধু একটি ভাষাই তার কানের ভেতর দিয়ে মর্মে পশে। পৃথিবীতে কতো মা, তবু শুধু একজনের জন্যেই চোখ জলে ভ’রে ওঠে আনচান করে প্রাণ।
বাঙলা আমার মাতৃভাষা। আমাদের মাতৃভাষা। তার রূপ আর শোভায় আর সৌন্দর্যে আমি মুগ্ধ। পৃথিবীতে আরো বহু ভাষা আছে। তাদের কোনোটির সৌন্দর্যে অন্ধ হয়ে যায় চোখ। কোনোটির ঐশ্বর্যের কাছে নুয়ে আসে মাথা। কোনোটির দর্পের কাছে হার মানতে হয় মুখোমুখি হওয়ার সাথেসাথে। তবুও আমার কাছে বাঙলার মতো আর কোনো ভাষা নেই। বাঙলা আমার মাতৃভাষা। আমার ভাষা। আমার আনন্দ এ-ভাষায় নেচে ওঠে ময়ূরের মতো। আমার সুখ ভোরের রৌদ্র বিকেলের ছায়া আর সন্ধ্যার আভার মতো বিচ্ছুরিত হয় বাঙলা ভাষায়। আমার বেদনা আমার দুঃখ থরোথরো ক’রে ওঠে বাঙলা ভাষায়। আর কোনো ভাষা আমার দুঃখে কাতর হয় না। আর কোনো ভাষা পুলকিত শিহরিত মর্মরিত আকুল ব্যাকুল চঞ্চল অধীর হয় না আমার সুখে আমার আনন্দে।
আমি বাঙলা ভাষার রূপে আর শোভায় আর সৌন্দর্যে মুগ্ধ। আমার মায়ের মুখের মতো সে শান্ত। তার অশ্রুর মতো সে কোমলকাতর। আমার মায়ের দীর্ঘশ্বাসের মতোই নরম আমার মাতৃভাষা। কখনো সে অন্য রূপ নেয়, শোভা ছড়িয়ে দেয়। মুগ্ধ করে আমাকে অন্যভাবে। তাকে দেখে আমার চাঁদের কিরণের কথা মনে পড়ে; জ্যোৎস্নায় ছেয়ে যায় চারদিক। তার শরীর থেকে দ্যুতি ঠিকরে পড়ে। ঝলমল ক’রে ওঠে চিত্ত। যখন বাঙলা ভাষা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তখন আমার চণ্ডীদাসের নাম মনে পড়ে। তার উল্লাসে আমার মনে পড়ে মধুসূদনের মুখ। তার থরোথরো ভালোবাসার নাম আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ। তার বিজন অশ্রুবিন্দুর নাম জীবনানন্দ। তার বিদ্রোহের নাম নজরুল। বাঙলা আমার ভাষা। এ-ভাষা ছাড়া আমি নেই।
হাজার বছর আগে জন্ম হয়েছিলো বাঙলা ভাষার। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা মানুষের মুখেমুখে রূপান্তরিত হয়ে বঙ্গীয় অঞ্চলে জন্ম নিয়েছিলো এক মধুর-কোমল-বিদ্রোহী প্রাকৃত। তার নাম বাঙলা। তাকে কখনো বলা হয়েছে ‘প্রাকৃত’, কখনো বলা হয়েছে ‘গৌড়ীয় ভাষা’। কখনো বলা হয়েছে ‘বাঙ্গালা’, কখনো ‘বাঙ্গলা’। এখন বলি ‘বাঙলা’ বা ‘বাংলা’।
এ-ভাষায় লেখা হয় নি কোনো ঐশী শ্লোক। জন্মের সময় বাঙলা ভাষা স্নেহ পায় নি সমাজপ্রভুদের। কিন্তু তা হাজার বছর ধ’রে বইছে ও প্রকাশ করেছে কোটিকোটি সাধারণ মানুষের স্বপ্ন ও বাস্তব। বৌদ্ধ বাউলেরা এ- ভাষায় রচেছেন দুঃখের গীতিকা। বৈষ্ণব কবিরা ভালোবেসেছেন হাহাকার করেছেন এ-ভাষায়। মঙ্গলকাব্যের কবিরা এ-ভাষায় রচনা করেছেন লৌকিক মঙ্গলগান। এ-ভাষায় রচিত হয়েছে আধুনিক মানুষের কতো না উপাখ্যান। এ-ভাষার জন্য উৎসর্গিত হয়েছে আমার ভাইয়ের রক্ত। এ- ভাষার জল ছাড়া আমার পিপাসা মেটে না। আমার স্বপ্ন ভেঙে যায় এ-ভাষা ছাড়া। এ-ভাষা ছাড়া থেমে যায় আমার বাস্তব। আমার জীবন। আমি তার গান গাই।