চাকর রাখ
কি ‘কোয়ালিফিকেশন’ থাকলে, ঠাকুর, আমাকে গ্রহণ করবেন আপনার অন্তরঙ্গ গোষ্ঠীতে? পাণ্ডিত্য, প্রভূত শাস্ত্রজ্ঞান, উঠতে-বসতে গীতা উপনিষদ্ আওড়ানো! উদ্গারেও জ্ঞানবর্ষণ! শ্বেতপাথরের মেঝেওলা ঠাকুরঘরে আপনার মূর্তিস্থাপন! উদ্বোধন আর অদ্বৈত আশ্রম থেকে রাশি রাশি বই কিনে শেলফে সার সার সৈনিকের মতো দাঁড় করিয়ে রাখা!
–না হে, ওসব না! প্রথম হলো, তোমাকে সৎ হতে হবে। চোর-জোচ্চোর হলে হবে না।
আপনার বৈষয়িক ধনসম্পদ কি আছে যে, জোচ্চোর ঠকাবে, চোরে চুরি করবে?
–আরে আমার যা আছে, আমি তো চাই—যে পারে সে এসে লুটেপুটে নিয়ে যাক। তুমি চুরি করবে ভাবের ঘরে। তুমি যা আছ—সেইরকম থাক, সে বরং ভাল। চাকরি কর, সংসার কর, ভোগ কর নাচকোঁদ—কোন আপত্তি নেই। মাথার দিব্যি দিয়ে কেউ তোমাকে বলেনি—আত্মান্বেষী হও। দুটো পাখির একটা পাখি দর্শকমাত্র। “দ্বা সুপর্ণা, সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে।” (মুণ্ডক উপনিষদ্, ৩।১।১) একই গাছে দুটো পাখি। বন্ধুভাবাপন্ন। একটা ভোগ করে, আরেকটা নিশ্চেষ্ট—উদাসীন দর্শক। দেহবৃক্ষের পতন। সেই জোড়াই আবার অন্য বৃক্ষে। প্রবৃত্তি আর নিবৃত্তি তোমার দুই জায়া। জায়ার অর্থ—তোমাতেই যার জন্ম। একজন তোমাকে সারাটা জীবন ধেই ধেই করে নাচাবে, আরেকজন নির্বিকার হয়ে সেই নাচ দেখবে—তোমাকে বাধা দেবে না। এইবার তোমার যেন মনে হবে—যন্ত্রণা ছাড়া তো কিছুই পেলাম না, এত নাচানাচির ফল কি হলো— তখনই তুমি সেই পাখিটির দিকে সরতে চাইবে, আর তখনই শুরু হবে তোমার আধ্যাত্মিক পরিক্রমা। টাকা দিয়ে গাড়ি কেনা যায়। সেই গাড়িতে জগৎভ্রমণ করা যায়। তেল খাওয়ালেই চালানো যায়। আধ্যাত্মিক পথের ভ্রমণযান চলে সততার একাগ্রতায়। যাবে কোথায়? “যেদেশে রজনী নেই সেই দেশে?”
ইউরোপ, আমেরিকা, স্পেন, সুইজারল্যান্ড অনেকেই দেখেছে, দেখবে। রজনীহীন দেশ তো কল্পনা মাত্র। কল্পনার পিছনে ছুটে কেরিয়ার নষ্ট করার কোন অৰ্থ হয়!
–তোমার যদি তাই মনে হয় তাহলে জগতের পিছনেই ছোট। তবে জেনে রাখ, ওটি সোনার হরিণ। রামচন্দ্র ঐ ভুলটি করে সীতাকে হারিয়েছিলেন। সীতা-র অর্থ কি? হালচালনার ফলে জমিতে যে রেখা পড়ে। সেইখানে ছড়ানো হয় বীজ। তারপর ফসল। মানবজমিনে আবাদ করতে হলে হালধারীকে প্রয়োজন, কর্ষণে সীতা, তারপর? রামপ্রসাদ! “এমন মানবজমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা।” সোনা যেমন ধাতু, সেইরকম আবার পরম ধন। এখন কিসের পিছনে ছুটবে নিজে ঠিক কর। সোনার পিছনে না শোনার পিছনে? অর্থাৎ ধাতুর পিছনে না শ্রুতির পিছনে! ঋষিরা, অবতারগণ শুনিয়ে গেছেন। তাহলে শুনতে হবে। শুধু শুনলেই হবে না, বিশ্বাস করতে হবে। বিশ্বাসের জন্য চাই সরলতা। তারপরই চাই ব্যাকুলতা। সবকটাই আমি করে দেখিয়েছি। করে যা পাওয়া যায় তারই নাম কৃপা। শ্রম করলে লক্ষ্মীর কৃপা, গণেশের কৃপা। ব্যাকুল সাধনায় আধ্যাত্মিক কৃপা। একটা গল্প শোন। তার আগে একটা উদাহরণ শোন—কর্ম গেলে কেরানির যেমন ব্যাকুলতা হয়। সে যেমন রোজ অফিসে ঘোরে আর জিজ্ঞাসা করে, হাঁগা কোন কর্ম খালি হয়েছে? ব্যাকুলতা হলে ছটফট করে, কিসে ঈশ্বরকে পাব! এই গল্পটা শোন। একজনের বাড়িতে ভারী অসুখ—যায় যায়। কেউ বললে—স্বাতী নক্ষত্রে বৃষ্টি পড়বে, সেই বৃষ্টির জল মড়ার মাথার খুলিতে থাকবে, আরেকটা সাপ একটা ব্যাঙকে তেড়ে যাবে। ব্যাঙকে ছোবল মারার সময় ব্যাঙ যেই লাফ দিয়ে পালাবে, অমনি সেই সাপের বিষ মড়ার খুলিতে পড়ে যাবে। সেই বিষের ঔষধ তৈরি করে যদি রুগীকে খাওয়াতে পারে, তবে বাঁচে। তখন যার বাড়িতে অসুখ, সেই লোক দিন-ক্ষণ-নক্ষত্র দেখে বাড়ি থেকে বেরুল আর ব্যাকুল হয়ে ঐসব খুঁজতে লাগল। মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকছে, ঠাকুর! তুমি যদি জোটপাট করে দাও, তবেই হয়। এইরূপে যেতে যেতে সত্য সত্যই দেখতে পেল, একটা মড়ার মাথার খুলি পড়ে রয়েছে। দেখতে দেখতে এক পশলা বৃষ্টিও হলো। তখন সে-ব্যক্তি বলছে, হে গুরুদেব! মড়ার মাথার খুলিও পেলাম, আবার স্বাতী নক্ষত্রে বৃষ্টিও হলো। সেই বৃষ্টির জলও খুলিতে পড়েছে। এখন কৃপা করে আর কয়টি যোগাযোগ করে দাও ঠাকুর! ব্যাকুল হয়ে ভাবছে। এমন সময় দেখে একটা বিষধর সাপ আসছে। তখন সে লোকটির ভারী আহ্লাদ হলো। সে এত ব্যাকুল হলো যে, বুক দুরুদুরু করতে লাগল, আর সে বলতে লাগল—হে গুরুদেব! এবার সাপও এসেছে কৃপা করে, এখন আর যেগুলি বাকি আছে সেগুলি করিয়ে দাও। বলতে বলতে ব্যাঙও এল। সাপটা ব্যাঙকে তাড়া করে যেতে লাগল, মড়ার মাথার খুলির কাছে এসে যেই ছোবল দিতে যাবে, ব্যাঙটা লাফিয়ে ওদিকে গিয়ে পড়ল আর বিষ অমনি খুলির ভিতর পড়ে গেল। তখন লোকটির হাততালি দিয়ে আনন্দের নাচ।
—কি বুঝলে? ব্যাকুলতা। ব্যাকুলতা থাকলে সব হয়ে যায়। ব্যাকুলতা থাকলে তাঁর কৃপা হয়।
ব্যাকুলতা আসবে কি করে?
–কেন? গল্পটা বুঝলে না! তুমি যে মরতে বসেছ!
হ্যাঁ, ঠিকই তো, মরণাপন্ন আমি। আমি আমার অভ্যাসে বেঁচে আছি। দিন সব একই রকম—টুথপেস্টের সকাল, ভাত-ডালের মধ্যাহ্ন, অনিদ্রার রজনী। যখন হাসি, মনে হয় নিজেই নিজে মস্করা করছি। কাঁদতে গিয়ে দেখি মুখবিকৃতি আছে, জল নেই। প্রেম দেহফ্রেম ছেড়ে হিন্দি সিনেমার পর্দায়। এমনকি দুর্ভাবনারও সে-দাঁত নেই। পড়ে আছে বোবা একটা অস্তিত্ব। তাই তো ঠাকুর, আপনার চাকরি করতে চাই।
—চলে এস। প্রথমেই বল—যা করেন কালী সেই সে জানে। তোমার কিছু জানার দরকার নেই, মা সব জানেন। আমার চাকরির প্রথম শর্ত—মায়ের ওপর নির্ভরতা। তখন আমি রাসমণির কালীবাড়িতে। আমার উন্মাদ অবস্থা। রাতের পর রাত দক্ষিণেশ্বরের পথে পথে ঘুরতাম আর বলতাম, মা! আমার ভেদবিচার নষ্ট করে দে। কি ভাল, কে ভাল, কি মন্দ—আমার জানার দরকার নেই। আমার যা ভাল তা তুমিই জান, আমার জানার দরকার নেই।
–তাহলে বল, মা আছেন আর আমি আছি সংসারে। পালালে চলবে না। মনে রাখতে হবে, জনম-দুঃখিনী সীতার মতো জনম-দুঃখী রামকৃষ্ণ। রামকৃষ্ণ পালাননি। তুমিও পালাবে না। বল, “শ্মশান ভালবাসিস বলে শ্মশান করেছি হৃদি!”
—তাহলে আমার চাকরি করতে হলে তোমাকে কর্তব্যপরায়ণ হতে হবে। সংগ্রামী হতে হবে। সরল হতে হবে। সমস্ত রকমের অহঙ্কার বিসর্জন দিতে হবে। মনে করতে হবে, তুমি মায়ের সঙ্গে সদাসংলগ্ন। কি পাবে আগেই তার হিসেব নয়। এইখানেই তোমার বিশ্বাস, পাঁচ সিকে পাঁচ আনা বিশ্বাস।
ঠাকুর! ঠিক বলেছেন আপনি। বিজ্ঞাপনে বিশ্বাস—টাকে চুল গজাবে, বুড়োর ফুটিফাটা মুখে যৌবন ফিরবে, অথচ গুরুবাক্যে সংশয়! ঈশ্বর আছেন কি? তাঁকে লাভ করলে সত্যই কি অমৃতসাগরে অবগাহন হয়? তাঁর জন্য পৃথিবীর সবকিছু তুচ্ছ করা যায়? সংসার অবশ্যই একটা খাঁচা। বন্ধনের যন্ত্রণা, কর্মফলের দুশ্চিন্তা।
—শোন, শোন, আমি রামকৃষ্ণ বলছি, বইয়ের কথা নয়, নিজের জীবনের কথা—আত্মার সাক্ষাৎকার হলে সব সন্দেহ ভঞ্জন হয়। ভক্তির তমঃ আন। বল কী! রাম বলেছি, কালী বলেছি, আমার আবার বন্ধন! আমার আবার কর্মফল বিশ্বাস! বিশ্বাস! বিশ্বাস! গুরু বলে দিয়েছেন, রামই সব হয়েছেন—ওহি রাম ঘট ঘটমে লেটা। কুকুর রুটি খেয়ে যাচ্ছে। ভক্ত বলছে, রাম! দাঁড়াও, দাঁড়াও রুটিতে ঘি মাখিয়ে দিই। এমনি গুরুবাক্যে বিশ্বাস। এইবার আমি গালাগাল দিয়ে বলি—
হাভাতেগুলোর বিশ্বাস হয় না! সর্বদাই সংশয়! আত্মার সাক্ষাৎকার না হলে সব সংশয় যায় না। আমার চাকরি করতে চাও? তাহলে দুটো কোয়ালিফিকেশন চাই। দুটো প্রশ্ন—
তোমার ভক্তি আছে?
তোমার বিশ্বাস আছে?
উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে আজই বহাল হয়ে যাও। ভক্তিই সার, ঠিক ভক্তের কোন ভয়-ভাবনা নেই। মা সব জানে। বেড়াল ইঁদুরকে ধরে একরকম করে, কিন্তু নিজের ছানাকে ধরে আরেক রকম করে।