1 of 2

চাঁপাফুলের গন্ধ – সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়

চাঁপাফুলের গন্ধ – সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়

বব গ্রেগরির বলটাকে স্কোয়ার কাট করে বাউন্ডারিতে পাঠাবার পরেই আমি বুঝতে পারলাম, গাওস্করের পঁয়ত্রিশ টেস্ট সেঞ্চুরির রেকর্ডটা আমি আজ ধরব। সঙ্গে সঙ্গে বাবার মুখটাও আমার মনে পড়ল। আমি টেস্ট টিমে ঢোকবার আগেই আমার বাবা মারা যান। আমার বয়স তখন সতেরো। এখন আমার ৩৩ বছর ৮ মাস ১৭ দিন। এগুলো খুব দরকারি তথ্য। আজ যদি সেঞ্চুরি করি, কাল কত ভাষ্যকার কত কী লিখবে। আগের সেঞ্চুরিটার পর থেকেই তো আরম্ভ হয়েছে, গাভাসকর আমার চেয়ে বড়ো কি ছোটো। অদ্ভুত লোকগুলো। আমার গুরু গাভাসকর। আজ যদি পঁয়ত্রিশতম সেঞ্চুরিটা হয়, তা হলে কাউকে যা বলিনি, সেটা করব। আমি অবসর নেব। রেকর্ড—বুকে আমার আর গাভাসকরের নাম পাশাপাশি থাকবে। গুরু আর শিষ্য। একলব্য শিষ্য। গাভাসকরের এখন পঁচাত্তরের ওপর বয়স। তবুও একদম সটান মানুষ।

ইডেনের বিরাট স্কোরবোর্ডে জ্বলজ্বল করছে আমার নামের পাশে আমার রান, ৬০ নট আউট। অন্যদিকে ব্যাট করছে আন্দামানের ছেলে রাকেশ পিটার। একটু আগে ইনিংসের গোড়াপত্ত হয়েছিল খুব ভালো। জম্মু কাশ্মীরের গোলাম রসুল আর উত্তরপ্রদেশের বিনয় দুবে দারুণ খেলে ১০১ রান তোলে। তারপরই এই সাত ফুট লম্বা বব ইংল্যান্ডের হয়ে তৃতীয়বার বল করতে এসে দু ওভারে চারটে উইকেট নেয়। বিনয় প্রথম আউট হয়। আমি নামলাম। প্রথম বলেই একটা বাই রান পেলাম। গোলাম আউট হল। পরের ওভারে আমি চারটে রান পেলাম। দুবার দুই—দুই করে। আবার বব বল করতে এল। পর পর দু বলে আউট হল গোয়ার ফেলিক্স কারনিরেও আর কেরলের সি.এন. জন। দুজনেই দারুণ ফর্মে ছিল। কিন্তু আজ বব দারুণ বল করছে। ছিলাম বিনা উইকেটে ১০১, হলাম চার উইকেটে ১০৬। রাকেশ পিটারের এটাই প্রথম টেস্ট ম্যাচ। বেচারি। আমি এগিয়ে গেলাম। বললাম, ‘তোমার খেলা আমি রনজি আর দলিপ ট্রফিতে দেখেছি, তুমি বড় খেলোয়াড় হবে। আজ তুমি মাথা ঠান্ডা রেখে সোজা ব্যাটে খেলবে। সাহস করে ববের সামনে দাঁড়াও কিচ্ছু ভয় নেই। আমি আর তুমি ভারতের ইনিংস দাঁড় করিয়ে দেব।’ রাকেশ নিশ্চয় সাহস পেয়েছিল। ববের বাকি দুটি বল একদম ব্যাটের মধ্যিখানে নিয়ে খেলল। কিন্তু ইংল্যান্ডের আসল লক্ষ্য আমি। আমাকে সরাতে পারলেই ওদের মতলব হাসিল হবে।

জোর লড়াই হল! গ্রেগরি, গারুফি, স্মিথসন তিনজন ফাস্ট বোলার, আর ছোবলমারা বল—দেনেওয়ালা কিচিন তাদের প্রাণপণ চেষ্টা করল। আর সেইসঙ্গে ইংল্যান্ডের ফিল্ডাররা কী ফিল্ডিংই না করল! আমার নিশ্চিত চারগুলোতে হয় রান হল না, নয় দুটো করে রান হল। ওদিকে রাকেশও অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের মতো খেলছে, ওর রানও হয়েছে ৫০। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত ও আর আমি সমান যাচ্ছিলাম। আমাদের রান এখন ২৩১। গারুফি অনেকগুলো নো—বল করেছে। গ্রেগরির এই ওভারে দশ রান নেবার পর আমি বুঝলাম, আজ আমার দিন।

আর সঙ্গে—সঙ্গে বাবার মুখ মনে পড়ল। আমাদের বংশ অধ্যাপকের বংশ। কত পুরুষ, তা জানি না। তবে সবাই বাঘা—বাঘা অধ্যাপক। তাদের নামে লোকে এখন মাথা নোয়ায়। সেই বাড়ির ছেলে হয়ে আমি পড়াশোনা ভালোবাসতাম না। রাজ্য সরকারের বাধ্যতামূলক শিক্ষাসূচি শেষ হতেই আমি পড়াশোনা ছাড়লাম। এখন আমি শুধু ক্রিকেট খেলব। বাবা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। রোগা লম্বা মানুষটা দেখতে ভারি সুন্দর ছিলেন। চেহারার মধ্যে এমন মাধুর্য ছিল যে, সকলের ভালো লাগত। অত শান্ত মানুষটিরও কিন্তু থুতনিতে একটা বিরাট কাটা দাগ ছিল। মজা এমনি যে, ওই কাটা দাগেও ওঁকে ভালো দেখাত। সেদিনটার কথা মনে আছে। বাবা তাঁর অঞ্জলি ভরে চাঁপাফুল এনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি চাঁপাফুল ভালোবাসি বলে বাবা প্রায় সারা বছর ধরেই আমার জন্যে চাঁপাফুল আনতেন। কোথায় একটা বারোমেসে গাছের সন্ধান পেয়েছিলেন। তখনই আমি হাতে ব্যাট নিয়ে বেরোচ্ছি। বাবা অবাক হয়ে বললেন, ‘তুই কলেজ যাবি না?’ বাবাকে আমি বললাম, ‘না। আমি পড়া ছেড়ে দিলাম। নিউ স্টার আমায় ভালো একটা শর্তে খেলতে দিচ্ছে। হাতখরচা পাব। তা ছাড়া ক্রিকেটে এখন অনেক পয়সা। ভালো খেলতে পারলে প্রফেসারির চেয়ে অনেক বেশি টাকা পাব।’

বাবার মুখটা ম্লান হয়ে গেল। বললেন, ‘খেলার মাঠেও একজন শিক্ষিত আর একজন অশিক্ষিত লোককে খুব সহজেই আলাদা করা যায়। কোনো অশিক্ষিত লোককে দেশের নেতৃত্ব করার দায়িত্ব কেউ দেয় না।’

সেই আমার সঙ্গে বাবার শেষ কথা। শেষ দেখাও বটে। ডাক্তার ডাকার সময়ও বাবা দেননি। আমার ওপর অভিমান করে চলে গেলেন।

চায়ের সময় হয়ে এল আমি একটিবার ভাবলাম, আমি কি একটু আস্তে খেলব। বড়ো স্কোরবোর্ডে জ্বলজ্বল করছে—আমার রান ৭৮। আর ২২—রান, আর সঙ্গে সঙ্গে আমার আর গাভাসকরের নাম পাশাপাশি হবে।

রাকেশও দারুণ খেলছে। একবার ওভারের মধ্যে ও বললে, ‘ক্যাপ্টেন, তুমি একটু জোরে খেলছ। একটু ধীরে খেললে তুমি সেঞ্চুরি পাবেই।’

আমি ওর পিঠের মধ্যে একটা থাবা মেরে বললাম, ‘আমি তো পাবই, তুমিও পাবে।’

রাকেশ ভীষণ খুশি হয়ে গেল। তার ফলে কি না জানি না, চায়ের ঠিক আগের ওভারটা কিচিনকে পেটাল দেখবার মতো। আগের ওভারে আমিই বরং চুপচাপ ছিলাম। ৮৪ থেকে ৮৮—তে উঠেছি। বাকি ১২ রান পরে হবে। রাকেশ তখন ৫৬। বেশ ঠান্ডা মাথায় খেলছে। গত বছর রনজি ট্রফিতে আমরা বোম্বাইয়ের অনেক দিনের রেকর্ড ভেঙেছি। ফাইনালে হারাই আন্দামানকে। এই রাকেশ দারুণ ব্যাট করেছিল। আমার বলকেই এগিয়ে এসে ছয় মেরেছিল। সারা পৃথিবীতে খুব বেশি ব্যাটসম্যান এ—কাজ করার সাহস দেখাবে না। সেই খেলা দেখাল। কিচিন বহু যুদ্ধের নায়ক। অনেক উইকেট পেয়েছে, অনেক মার খেয়েছে। কিন্তু প্রথম টেস্ট খেলছে এমন ছেলে ওর এক ওভারে ৬,৬,৪,৪,৬,৪ মোট ৩০ রান নেবে, তাও চায়ের আগের ওভারে, কিচিন ভাবেনি। চার উইকেটে ২৯৪। পঞ্চম উইকেটে আমরা জুড়েছি ১৮৮ রান, পিটার ৮৬ আমি ৮৮ রানে চা খেতে গেলাম। ইডেনের বিশ্বনাথ ব্লক আমাদের প্রতিটি হাঁটার সঙ্গে সঙ্গে বিউগল বাজাল। আমি রাকেশকে বললাম, ‘তুমি এগোও। শেষ ওভারটা অনবদ্য।’

চা খেতে মন চাইছিল না। শুনলাম গাভাসকর, আজাহারউদ্দিন, বেদী, তিন বৃদ্ধই টেলিফোন করেছিলেন। আমি তখনও বাবার কথা ভাবছি। কী অন্যায়! যে মরে যায়, তার সঙ্গে কেন আর কথা বলা যায় না? নইলে বলতাম বাবাকে, আমি পড়াশোনা করেছি। খুব মন দিয়ে করেছি। আজ যদি আমায় দেখতে, তুমি খুশি হতে বাবা। তুমি সত্য বলেছিলে, প্রথম দিকে আমাকে লোকে ঠাট্টা করত। বলত, আমি ভালো খেলি, কিন্তু আসলে চাষা। তারপর সব বদলে গেল। আমি বদলে গেলাম। রাতের পর রাত জেগে পড়েছি। নিজেকে তৈরি করেছি। বাবা, তুমি কিছু দেখতে পাওনি। আজ আমি সারা ভারতে শুধু নয়, সারা বিশ্বে পরিচিত। শুধু ভালো ব্যাটসম্যান বলে নয়, ভালো বোলার বলে নয়, মার্জিত ভদ্রলোক বলেও। ভারতের টিম আদর্শ টিম। খেলার মাঠে, খেলার বাইরে। আমি টিমের ক্যাপ্টেন হবার পর ভারতের কোনো খেলোয়াড় কোনো বাজে আবেদন করেননি। কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কখনো আম্পায়ারের সঙ্গে ঝগড়া করেনি। এখন বলো, আমি কি একজন ভালো অধ্যাপকের সমান হইনি?

আবার মাঠে খেলা। বিশ্বনাথ ব্লক বোধহয় চায়ের বিরতির সময় একদম ওঠেনি। রক্ত—খাওয়া বাঘের মতো হয়ে আছে। আমার তখন মন খুব শান্ত। পিটারকে দেখতে হবে। প্রথম ওভারে একটা লেটকাট করলাম স্মিথসনকে। উইকেটকিপার হাঁ করে বলের চলে যাওয়া দেখল। ৯২। পরের ওভারে ইংল্যান্ডের কাপ্টেন ডিক বার্ট নিজে বল করতে এল। ও এমনিতে বল করে না, কিন্তু চেঞ্জ বোলার হিসেবে ভালো। রাকেশকে আমি দেখেশুনে খেলতে বলেছিলাম। তাই তিনটে মাত্র চার নিল। সব কটা বোলারের পাশ দিয়ে। মাঠে কী হচ্ছে বোঝানো যাবে না। পিটার ৯৮। এ পরের ওভারেও আমি দুবার দুই—দুই রান নিলাম। আমি ৯৬। মাঠ ফেটে পড়ছে। রাকেশ কিন্তু আমাকে অবাক করে দিল। প্রথম বলে ডিপ থার্ড ম্যানে বল পাঠিয়ে দৌড় শুরু করল। ওর সেঞ্চুরি নিশ্চিত, কিন্তু একটা রান নিয়েই চেঁচাল, নো। তারপর আম্পায়ারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে বলল, ‘ক্যাপ্টেন, সেঞ্চুরিটা আগে তুমি করো।’ সারা পৃথিবী অপেক্ষা করে আছে।

আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, কিন্তু রাকেশ, ক্রিকেটে আর কখনো পাওয়া রান ছাড়বে না। দলের ক্ষতি।’

রাকেশ বলল, ‘জানি, কিন্তু আজ রাগ কোরো না।’

সবাই বুঝেছে, রাকেশ কী করেছে। আমার চোখের সামনে একজন নতুন জনপ্রিয় তারকাকে জন্ম নিতে দেখলাম। পরের বলটা কী করে এল, কী করে খেললাম কিচ্ছু মনে নেই, শুধু চিৎকারই শুনলাম। আমি ৩৫ নম্বর সেঞ্চুরি করেছি। রাকেশ দৌড়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল, ‘আই ওয়াজ দেয়ার হোয়েন ইউ স্কোরড ইয়োর থার্টিফিফথ সেঞ্চুরি!’ ডিক আর তার দল একে একে এসে করমর্দন করল। আমার মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছিল। তারপরই আবার বিস্ফোরণ। রাকেশ সেঞ্চুরি করেছে। প্রথম ইনিংসে ১০০ রানের এগিয়ে থাকার সুবাদে আমরা মোটমাট ৪২৪ রানে এগিয়ে গেলাম। এখন ইংল্যান্ডকে আউট করার পালা। রাকেশকে নিয়ে আমি ক্লাব হাউসের দিকে পা বাড়ালাম। আজ দুটো উইকেট চাই।

দিনের খেলার শেষে কী যে হল, আর কী যে হল, বলতে পারব না। সারা কলকাতা ময়দানে এসে হাজির হয়েছে। চারদিকে মালা আর মালা। আর বাজি পুড়ছে। যেন কালীপুজোর রাত। বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হল। দরজা খুলে দিল আমার ছেলে। ও ক্রিকেট একদম মজা পায় না। কিন্তু তাও খুব খুশি। বাড়ির সামনেও তখন ছেলেরা নাচছে।

হঠাৎ মনে হল, চাঁপাফুলের গন্ধে ম’ম’ করছে আমার ঘর। বাবার পরে আর কেউ আমার জন্যে চাঁপা আনেনি। প্রশ্ন করলাম, ‘চাঁপাফুল কোথা থেকে এল রে?’

ছেলে বলল, ‘একজন বুড়োমতো লোক এসে তোমাকে দিয়ে গেছেন। ভদ্রলোকের না থুতনিতে একটা বিরাট কাটা দাগ।’

ফুলগুলো আমি বুকে জড়িয়ে ধরলাম। এবারও বাবাকে দেখতে পেলাম না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *