চাঁদ যখন ডাকে (গল্প)
গরমের ছুটিতে হোমটাস্ক দেওয়াটা সব স্কুলেরই রেওয়াজ৷ বুয়ানের স্কুলও এই রেওয়াজের বাইরে নয়৷ কিন্তু বুয়ানকে দেখলে মনে হবে ওর মাথায় হোমটাস্কের কোনও চাপ নেই৷ গরমের ছুটিটা ওকে দেওয়া হয়েছে শুধুই খেলাধুলোর জন্য, গল্পের বই পড়ার জন্য, ডাইনোসর আর মহাকাশের বই পড়ার জন্য, টিভিতে ডোরেমন, রোল নাম্বার টুয়েন্টি ওয়ান কিংবা মোটু-পাতলু দেখার জন্য এবং পলিমারের খুদে-খুদে রঙিন টুকরো জুড়ে নানান জিনিস তৈরি করার জন্য৷
পলিমারের টুকরো জুড়ে হরেক জিনিস তৈরির যে-ব্যাপারটা সেটা পুরোনো আমলের ‘মেকানো’-রই একটা আধুনিক সংস্করণ৷ এগুলোর চলতি নাম ‘ব্লক’৷ সহজ থেকে কঠিন—নানান লেভেলের ব্লক কিনতে পাওয়া যায় দোকানে৷ গত ছ’-আটমাস ধরে এই ব্লকের নেশাই বুয়ানকে মশগুল করে রেখেছে৷ বাবা-মায়ের সঙ্গে কোনও শপিং কমপ্লেক্সে গেলেই ওর আবদার: ‘বাপি, একটা ব্লক কিনে দাও!’
দিনদশেক আগে মা-বাবার সঙ্গে শপিংমলে গিয়ে একই আবদার করেছে বুয়ান৷
তখন রণবীর বলেছেন, ‘কেন, বুয়ান? তোমার তো অনেকগুলো ব্লক রয়েছে!’
‘ওগুলো বারবার তৈরি করে একদম মুখস্থ হয়ে গেছে৷ আর ওগুলো নিয়ে খেলতে ভালো লাগে না৷ টু ইজি, টু বোরিং…৷’
মা শ্রেয়সী তখন ছেলের পক্ষ নিয়ে বলেন, ‘দাও না নতুন একটা কিনে! পুরোনোগুলো আর কতবার খুলবে আর কতবার তৈরি করবে?’
কথাটা ঠিকই৷ ব্লকের বাক্সের ভেতরে রঙিন টুকরোগুলোর সঙ্গে যে-জিনিসটা তৈরি করতে হবে তারও রঙিন ছবি দেওয়া থাকে৷ একটা নয়, অনেকগুলো ছবি৷ সেই ছবিগুলো বুঝিয়ে দেয় কীভাবে জিনিসটাকে ধাপে-ধাপে তৈরি করতে হবে৷
বুয়ান শুরু করেছিল খুব সহজ ব্লক দিয়ে৷ যেমন, কুকুর, বেড়াল, মাছ, বাড়ি এইসব৷ তারপর ও তৈরি করেছে ট্রেন, প্লেন, ট্র্যাক্টর, তাজমহল, জাহাজ, ক্রেন—আরও কত কী! এখন ও বলতে গেলে ব্লক-এক্সপার্ট৷ তৈরি করার জিনিসটা যত কঠিন হবে, ব্লকের বাক্সে পলিমারের টুকরোর সংখ্যা হবে তত বেশি, তার বাক্সটাও হবে বেশ বড়, আর জিনিসটার দামও হবে বেশি৷ ফলে রণবীর আর শ্রেয়সী এখন বুয়ানের জন্য নতুন কোনও ব্লক কিনতে বেশ কিন্তু-কিন্তু করেন৷
রণবীর ছেলের মাথায় হাত-টাত বুলিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ‘শোন, তোর এখন ক্লাস ফাইভ৷ পড়ার চাপ কত বেড়ে গেছে! তুই কত বড় হয়ে গেছিস! এখন এইসব ব্লক-টক নিয়ে খেলা তোর মানায়!’
বুয়ান ছলছলে চোখে মায়ের দিকে তাকাল৷ আঙুল তুলে দেখাল দোকানের একটা র্যাকের দিকে৷ সেখানে পরপর ব্লকের বাক্স সাজানো—ছোট-বড় নানান বাক্স৷ তারই মধ্যে একটা বড় বাক্স লক্ষ্য করে আঙুল তুলেছে বুয়ান৷ সেই বাক্সটার ওপর খুব সুন্দর একটা রোবটের ছবি৷ ছবির ওপরে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে ‘রোবট-ফ্রেন্ড জুনো’৷ আরও লেখা আছে যে, এটা টকিং রোবট—অর্থাৎ, জুনো কথা বলতে পারে৷ ওর শরীরে ব্যাটারি লাগানোর ব্যবস্থা আছে৷ এ ছাড়া রয়েছে স্পেশাল রিমোট কন্ট্রোল ইউনিট৷
বাক্সের ওপরে জুনোর রঙিন ছবিটা এত জীবন্ত যেন বুয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে এবং হাসছে৷
সুতরাং অন্যান্যবারের মতো এবারেও বুয়ানের আবদারের কাছে রণবীর-শ্রেয়সী হেরে গেলেন৷ রোবট-ফ্রেন্ড জুনো চলে এল ওদের বাড়িতে৷ আর তারপর? তারপর নাওয়া-খাওয়া মাথায় উঠল বুয়ানের৷ সেইসঙ্গে পড়াও৷ রোবট-ফ্রেন্ডের ব্লক নিয়ে ও মেতে উঠল৷ বাক্সের ভেতরে দেওয়া ছবি দেখে-দেখে পলিমারের টুকরোগুলো একের পর এক জুড়তে লাগল৷ ধাপে-ধাপে তৈরি হতে লাগল জুনো৷
যে-সন্ধেয় ব্লকের বাক্সটা ও কিনে এনেছিল তারপর চব্বিশ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই বুয়ানের কাজ শেষ৷ ওর পড়ার টেবিলে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক রংচঙে রোবট৷ উচ্চতায় আট ইঞ্চি মতন৷ কী সুন্দর দেখতে! বড়-বড় গোল-গোল চোখ৷ মাথায় কালো টুপির মতো চুল৷ নীল রঙের জামা৷ লাল রঙের প্যান্ট৷ বুকে লাগানো রয়েছে ছোট-ছোট রঙিন এল. ই. ডি.৷ হাত আর পা মেটালিক৷ তাতে অনেকগুলো জয়েন্ট৷ জয়েন্ট রয়েছে কাঁধ আর গলাতেও৷
সবমিলিয়ে জুনোকে দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে৷
রোবট তৈরির কাজ শেষ হওয়ার পর মা-বাবাকে ডেকে নিয়ে এল বুয়ান৷
‘দ্যাখো, দ্যাখো, জুনোকে কী সুন্দর দেখতে!’
রণবীর আর শ্রেয়সী হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন রোবটটার দিকে৷ সত্যিই ভীষণ আদুরে আর সুন্দর দেখতে জুনোকে৷
রণবীর বললেন, ‘যাকগে৷ রোবট চেয়েছিলে, পেয়ে গেছ৷ এবার তো একটু পড়াশোনায় বোসো! কাল বিকেলের পর আমার কাছে ম্যাথস নিয়ে বসবে৷’
শ্রেয়সী ছেলেকে বললেন, ‘কাল সকাল দশটায় ম্যাডাম পড়াতে আসবেন তোর মনে আছে তো? ম্যামের কাছে হোমটাস্কের কাজ যতটা পারবি এগিয়ে নিবি—!’
বুয়ান একেবারে অন্য জগৎ থেকে মায়ের দিকে শূন্য চোখে তাকাল৷ হোমটাস্ক! সেটা আবার কী জিনিস?
‘কী রে, অমন হাঁ করে চেয়ে আছিস কেন? হোমটাস্ক! হোমটাস্ক! জুনোকে পেয়ে সব ভুলে গেলি?’
সত্যিই মনে-মনে রোবটদের জগতে চলে গিয়েছিল বুয়ান৷ মায়ের কথায় ঝটকা খেয়ে ফিরে এল পড়াশোনার রুক্ষ বাস্তবে৷ চটপট ঘাড় নেড়ে বলল যে, কাল ও ম্যামের কাছে অনেকখানি হোমটাস্ক সেরে নেবে৷
তারপর কাঁচুমাচু মুখে রণবীরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাপি, মোড়ের মাথায় সুরেনকাকুর দোকান থেকে এইরকম চারটে ব্যাটারি এনে দেবে? প্লিজ!’
বাক্সের গায়ে ব্যাটারির ছবি দিয়ে মাপ লেখা ছিল৷ সেটা রণবীরকে দেখাল বুয়ান৷
রণবীর ছোট্ট করে ‘হুঁ’ বললেন, তারপর: ‘ব্যাটারি এনে দিচ্ছি, কিন্তু লেখাপড়ার কথাগুলো ভুলে যেয়ো না৷’
একগাল হাসল বুয়ান৷ বলল, ‘জানো, বাপি, ব্যাটারি লাগিয়ে দিলেই জুনো হেঁটে-চলে বেড়াবে, কথাও বলবে!’
আশ্চর্য! রোবট পেয়ে ছেলেটা সব ভুলে গেল না কি?
রণবীর বললেন, ‘ব্যাটারি তো হবে, কিন্তু পড়ার কথাগুলো তুই শুনতে পেয়েছিস তো?’
‘শুনেছি, শুনেছি!’ ব্যস্তভাবে বলল বুয়ান৷ তারপর বাপিকে ছোট্ট ঠেলা মেরে বলল, ‘যাও না, বাপি, ব্যাটারিগুলো এনে দাও না তাড়াতাড়ি!’
রণবীর আর দেরি না করে ব্যাটারি কিনতে বেরোলেন৷
পড়ার টেবিলের সব বইপত্র সরিয়ে প্রথমেই জুনোর চলা-ফেরার জায়গা তৈরি করল বুয়ান৷ তারপর টেবিলের ওপরে জুনোকে দাঁড় করিয়ে ওর রিমোটের বোতামগুলো দেখতে লাগল৷ সেখানে ‘মুভ’, ‘স্টপ’, ‘স্লিপ’, ‘টক’ ইত্যাদি বেশ কয়েকটা বড় মাপের বোতাম রয়েছে৷ এক-একটা বোতামের এক-একরকম রং৷ প্রত্যেকটা বড় বোতামের সঙ্গে রয়েছে তিনটে কি চারটে করে ছোট-ছোট বোতাম৷ যেমন, ‘মুভ’ বোতামের ঠিক ওপরেই রয়েছে চারটে ছোট বোতাম৷ বোতামে লেখা রয়েছে ‘মোড ওয়ান’, ‘মোড টু’ ইত্যাদি৷ বোঝাই যাচ্ছে, এই বোতামগুলো রোবটের মুভমেন্টের স্টাইল সিলেক্ট করার জন্য৷
বুয়ান ‘মুভ’ লেখা সুইচটা অন করে দিল৷ সঙ্গে-সঙ্গে জুনো চলতে শুরু করল৷
ওঃ, কী অদ্ভুত ওর চলার ধরন! সদ্য হাঁটতে শেখা বাচ্চা ছেলের মতো একটু সময় নিয়ে একটা-একটা করে পা ফেলছে৷ একইসঙ্গে মাথাটা এপাশ-ওপাশ ঘুরিয়ে গোল-গোল চোখজোড়া মেলে কী দেখছে ও-ই জানে!
রোবটটার চোখের মণির জায়গায় সাদা রঙের এল. ই. ডি. লাগানো ছিল৷ সুইচ অন করে দিতেই সেই আলোগুলো এখন উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে৷ তার সঙ্গে বুকের এল. ই. ডি.-গুলো দপদপ করে জ্বলছে-নিভছে৷
বুয়ান মুগ্ধ চোখে জুনোর চলা-ফেরা দেখছিল৷ ওর চলার সময় মোটরের আওয়াজ প্রায় শোনাই যাচ্ছে না৷ বাপি বলেছেন, রোবটের চলার জন্য মোটর ব্যবহার করা হয়৷ জুনোর মোটরটা নিশ্চয়ই খুব হাই-ফাই, তাই আওয়াজ কম৷
কিন্তু আরও একটা ব্যাপার বুয়ানকে খুব অবাক করল৷ হাঁটতে-হাঁটতে জুনো যখন টেবিলের কিনারার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে তখনই ও থমকে দাঁড়াচ্ছে নিজে থেকেই৷ তারপর ডানদিকে ঘুরে আবার চলতে শুরু করছে৷ কী করে রোবটটা বুঝতে পারছে যে, ও টেবিলের কিনারায় এসে গেছে—আর এগোলেই ও টেবিল থেকে নীচে পড়ে যাবে?
এই জিজ্ঞাসার উত্তর জানতে বুয়ান চেঁচিয়ে ডেকে উঠল, ‘বাপি! বাপি! মা! মা! শিগগির আমার পড়ার ঘরে এসো…৷’
ওর ডাকে তাড়াহুড়ো করে চলে এলেন দুজনেই৷ কিছুক্ষণ ওঁরা অবাক বিস্ময়ে জুনোর চলে বেড়ানো দেখলেন৷ তারপর বুয়ানের প্রশ্নের উত্তরে রণবীর বললেন, ‘শোন, জুনোর চোখে অপটিক্যাল সেন্সর লাগানো রয়েছে৷ সেই সেন্সর বুঝতে পারছে যে, টেবিলের সারফেসটা শেষ হয়ে গেছে—সুতরাং আর এগোনো ঠিক হবে না৷ সেই সিগন্যালটা চলে যাচ্ছে জুনোর ভেতরের কম্পিউটার-ব্রেইনে৷ ব্রেইন জুনোর মোটরকে থামিয়ে দিচ্ছে—তারপর ওর চলার দিক ডানদিকে, নব্বই ডিগ্রি ঘুরিয়ে দিচ্ছে৷ সবমিলিয়ে খুব কমপ্লিকেটেড ব্যাপার…৷’
কমপ্লিকেটেড ব্যাপার যে তাতে সন্দেহ নেই৷
রোবট-ফ্রেন্ড জুনোর নতুন বাক্সটা বাড়িতে এনে খোলার পর একটা মোটাসোটা ‘অপারেটিং ম্যানুয়াল’ দেখতে পেয়েছিল বুয়ান৷ মা আর বাপিকে ও ম্যানুয়ালটা পড়ে ফেলার দায়িত্ব দিয়েছিল৷ শ্রেয়সী আবার সেটা কায়দা করে রণবীরের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিলেন৷ অগত্যা রণবীর স্কুল-কলেজের পড়াশোনার মতো সেটা স্টাডি করেছেন এবং সাধ্যমতো বুয়ানের খটোমটো প্রশ্নের থতোমতো জবাব দিয়েছেন৷
শ্রেয়সী বুয়ানকে জিগ্যেস করলেন, ‘কী রে, তোর হোমটাস্ক কতটা এগোল?’
‘হবে, মা৷ জুনোর ব্যাপারটা এই তো সবে কমপ্লিট হল৷ কাল থেকে আমার হোমটাস্ক স্টার্ট—৷’
রণবীর হেসে বুয়ানের মাথায় একটা আদরের চাঁটি মেরে বললেন, ‘দেখা যাক, কাল থেকে তোমার হোমটাস্ক স্টার্ট হয় কি না৷ নইলে জুনোকে আবার দোকানে রিটার্ন করে দেব—৷’
‘সত্যি বলছি, বাপি, কাল থেকে হোমটাস্ক স্টার্ট করবই৷ গড প্রমিস৷’
শ্রেয়সী স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই রোবটের ব্লকটা ওকে কিনে দেওয়াটাই ভুল হয়েছে৷ এখন লেখাপড়া বাদ দিয়ে ক’দিন ধরে চলবে শুধু রোবট আর রোবট—৷’
রণবীর শ্রেয়সীকে পালটা বললেন, ‘যতদূর মনে পড়ছে, আমি তো এটা কিনে দেওয়ার এগেইনস্টেই ছিলাম৷ কিন্তু কে একজন যেন বুয়ানের হয়ে ওকালতি করেছিল…৷’
শ্রেয়সী ছেলের বইপত্রের দিকে ইশারা করে বললেন, ‘তখন তো আর জানি না, রোবটের নেশায় লেখাপড়া লাটে উঠবে! যাকগে, রাত দশটা বেজে গেছে, এখন খেতে চলো দেখি! বুয়ান, জুনো যেমন আছে থাক, এখন চলো তো, খেতে চলো…৷’
বুয়ান জুনোর রিমোটের ‘স্টপ’ বোতাম টিপে দিল৷ তারপর ওর কাছ থেকে উঠে পড়ল৷ তবে ঘর ছেড়ে বেরোনোর সময় দুবার ওর দিকে পিছন ফিরে তাকাল৷ যেন বলতে চাইল, ‘তুমি টেবিলে দাঁড়িয়ে একটু রেস্ট নাও, আমি পাঁচমিনিট পরেই আসছি…৷’
জুনোকে নিয়ে বুয়ান এমন মেতে উঠল যে, জুনো হয়ে গেল ওর ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’৷ তবে একইসঙ্গে ও পড়াশোনা শুরু করল মন দিয়ে৷ আর সত্যি-সত্যিই স্কুলের সামার ভ্যাকেশনের হোমটাস্ক রোজ নিয়ম করে করতে লাগল৷
বুয়ানের পড়ার টেবিলের ডানদিকে আর-একটা টেবিল বসানো হয়েছে৷ সেই টেবিলটা জুনোর জন্য৷ জুনো সবসময় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে, নয় চলাফেরা করে৷ ওকে পাশে রেখে বুয়ান পড়াশোনা করে৷ কখনও-কখনও ওর সঙ্গে কথা বলে, কিংবা ‘টক’ বোতাম টিপে জুনোর কথা চালু করে দেয়৷ ওর কথা শোনে, কখনও বা পালটা কথাও বলে, কিন্তু জুনো বুয়ানের কথা বুঝতে পারে না বলে ওর ভেতরের সেট করা প্রোগ্রাম অনুযায়ী নিজের কথা বলেই যায়৷
জুনোর ব্যাপার নিয়ে ছেলের এই পাগলামিতে শ্রেয়সী বা রণবীর নাক গলাননি, বাধাও দেননি৷ বরং ওঁরা লক্ষ করেছিলেন, জুনো বাড়িতে আসার পর থেকে বুয়ানের লেখাপড়ার দিকে মনোযোগ অনেক বেড়ে গেছে৷ অনেক সময় ওঁদের মনে হয়েছে, বুয়ান যেন জুনোকে দেখিয়ে-দেখিয়ে ওর পড়াশোনার বহরটা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে৷
একদিন সন্ধেবেলা পড়াশোনার মাঝে ব্রেক নিয়ে জুনোর সঙ্গে খেলতে শুরু করল বুয়ান৷ ‘টক’ বোতাম টিপে ওর কথা চালু করে দিল৷ জুনো ওর প্রোগ্রাম অনুযায়ী বাঁধাধরা কথা বলতে লাগল৷
‘হাই, মাই নেম ইজ জুনো৷’ একটু জড়ানো ধাতব কণ্ঠস্বর৷ তবে কী বলছে সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়৷
বুয়ান জুনোর কথার জবাব দিল: ‘আমার নাম বুয়ান৷ ভালো নাম অঙ্কুশ৷’
‘আই অ্যাম ইয়োর ফ্রেন্ড৷’
‘আমিও তোমার বন্ধু৷’
‘আই লাভ ইউ৷’
‘আমিও তোমাকে ভালোবাসি৷’
‘কাম, লেট আস প্লে৷’
‘হ্যাঁ, চলো—আমরা খেলি৷’
তারপরই জুনো চুপ৷ কারণ, এই চারটি কথা শোনানোর ব্যবস্থাই করা আছে জুনোর সিস্টেমে৷ আর এক-একটা সংলাপ বলার পর জুনো চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ৷ সেই চুপ করে থাকার সময়টুকুতে বুয়ান ওর ইচ্ছেমতো উত্তর দেয়৷
জুনো রোজ একইরকম কথা বারবার বলে, কিন্তু বুয়ানের সেটা মোটেই একঘেয়ে লাগে না৷ তা ছাড়া ওর বিশ্বাস, জুনো ওর সঙ্গে মিশে একদিন না একদিন নতুন-নতুন কথা বলতে শিখবে৷
এই বিশ্বাসের কথা মা আর বাপিকেও জানিয়েছে বুয়ান৷ শুনে যা হওয়ার তাই হয়েছে: ওঁরা দুজনেই হেসে ফেলেছেন৷
‘তাই আবার কখনও হয় না কি? জুনো তো একটা মেশিন—মানুষ তো আর নয়!’ বাপি৷
‘জুনো তোর সঙ্গে নতুন-নতুন কথা বলতে না পারুক, তুই তো পারিস! তুই ওর সঙ্গে মন খুলে গল্প কর—৷’ মা৷
তো সেটাই করে বুয়ান৷ জুনোর সঙ্গে অনেক গল্প করে৷ ওকে স্কুলের নানান বন্ধুর কথা শোনায়, টিভিতে দেখা প্রোগ্রামের গল্প বলে, বলে টিনটিনের চাঁদে অভিযানের গল্প, ডাইনোসরের গল্প, মহাকাশের গল্প, আরও কত কী!
বুয়ানের এক-একসময় হঠাৎ করে মনে হয়, গল্প শুনতে-শুনতে জুনো মাথা নাড়ছে৷
মাঝে-মাঝে ডাইনোসর আর মহাকাশের বই নিয়ে জুনোর সামনে বসে পড়ে বুয়ান৷ বইগুলো বড় মাপের, তাতে সুন্দর-সুন্দর রঙিন ছবি৷ সেইসব বই থেকে জুনোকে পড়ে-পড়ে শোনায়৷ জুনো সেসব বুঝতে না পারলেও কথা বলে যায়—ওর সেই পুরোনো কথা৷
‘হাই, মাই নেম ইজ জুনো৷’ ‘আই অ্যাম ইয়োর ফ্রেন্ড৷’ ইত্যাদি৷
যতই পুরোনো হোক কথাগুলো শুনতে ভালো লাগে বুয়ানের৷ তবে মাঝে-মাঝে মনে হয়, ইস, জুনো যদি নতুন-নতুন কথা বলতে পারত!
একদিন সন্ধেবেলা একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল৷
তখন ঘড়িতে ক’টা বাজে? সাতটা কি সওয়া সাতটা৷ আধঘণ্টা ধরে বাইরে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়েছে৷ মাঝে-মাঝেই আকাশ আলোয় ভাসিয়ে ঝলসে উঠছে বিদ্যুৎ, আর তার পরেই কড়-কড়-কড় কড়াৎ৷ কানফাটানো আওয়াজে কেঁপে উঠছে বাড়ি৷
বাজ পড়ার ব্যাপারটাকে শ্রেয়সী ভীষণ ভয় পান৷ তাই বাজের প্রতিটি আওয়াজের পরপরই তিনি ভয়ে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠছেন এবং সেই চিৎকার থামানোর জন্য রণবীর বারবার বলছেন, ‘কী হচ্ছে, শ্রেয়সী! কেন এমনি করে বাচ্চাদের মতো চিৎকার করছ!’
বুয়ান তখন জানলা-টানলা বন্ধ করে পড়াশোনা করছিল৷ পাশের টেবিলে জুনো হেঁটে বেড়াচ্ছিল, কথা বলছিল৷ বুয়ান বাজ পড়ার শব্দকে মোটেই ভয় পায় না৷ কিন্তু বাজ-টাজ পড়লে মায়ের এই ছেলেমানুষি কাণ্ড দেখতে ওর খুব মজা লাগে৷ তাই ও পড়া ফেলে ছুটল মায়ের কাণ্ড দেখতে৷ এবং সেই কাণ্ড দেখে ও তো হেসেই কুটিপাটি৷ ও আর বাপি মা-কে বাজ পড়ার ভয় দেখিয়ে মজা করতে লাগল৷
একটু পরেই বুয়ান চলে এল ওর পড়ার ঘরে৷ ঝড়-বৃষ্টির দাপট তখন আরও বেড়েছে৷ জুনো টেবিলের ওপরে ওর নিজের মতো হেঁটে বেড়াচ্ছিল৷
হঠাৎই ঝোড়ো হাওয়ার দাপটে ঘরের একটা জানলা খুলে গেল৷ সোঁ-সোঁ হাওয়া ঢুকে পড়ল ঘরে৷ সেইসঙ্গে বৃষ্টির ছাট৷ বিকট শব্দে বাজ পড়ল কাছেই৷ এবং জুনো উলটে পড়ে গেল টেবিলের ওপরে৷
বুয়ান প্রায় দৌড়ে গেল টেবিলের কাছে—জুনোকে সোজা করে দাঁড় করাতে গেল৷ কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে জুনো নিজেই সোজা হয়ে দাঁড়াল, চলতে শুরু করল আগের মতো৷
ব্যাপারটা কী হল?
বুয়ান হাঁ করে তাকিয়ে রইল আট ইঞ্চি মাপের রোবটটার দিকে৷ ওটা যে পড়ে গেলে আবার নিজে-নিজেই উঠে দাঁড়াতে পারে এমন কথা দোকানের সেলসম্যান ছেলেটিও বলেনি, আর ম্যানুয়াল পড়ে বাপিও কিছু বলেননি৷ তা হলে?
বুয়ান ওর পড়ার টেবিলে বসে পড়ল৷ রিমোটটা রাখা ছিল কম্পোজিট ম্যাথ বইটার পাশেই—সেটা তুলে নিয়ে বোতাম টিপে জুনোকে থামাল৷ তারপর ‘রোটেট’ বোতাম টিপে জুনোকে ঘুরিয়ে নিজের দিকে মুখ করিয়ে দাঁড় করাল৷ ওর শরীরের এল. ই. ডি. বাতিগুলো দপদপ করে জ্বলছে নিভছে৷
‘ব্যাপার কী, জুনো? তুমি পড়ে গেলে নিজে-নিজে উঠে দাঁড়াতে পারো?’
‘পারি—’ পরিষ্কার বাংলায় জবাব দিল বুয়ানের রোবট, ‘এটা সিক্রেট৷ আর কেউ যেন জানতে না পারে৷ তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড৷’
বুয়ান কিছুক্ষণ কোনও কথা বলতে পারল না৷ জুনো এরকম পালটে গেল কী করে! ওর ‘টেল মি হোয়াই’ সিরিজের বই পড়ে ও জেনেছে, বাজ পড়া মানে হাই ভোল্টেজ ইলেকট্রিসিটির ডিসচার্জ৷ সেই সময় কাছাকাছি কোনও ধাতুর জিনিস থাকলে তার মধ্যে ভোল্টেজ তৈরি হয়—ইনডিউসড ভোল্টেজ৷ সেরকম কিছু হয়েই কি জুনো পালটে গেল? ওর ভেতরের প্রোগ্রামের বাইরে কাজ করতে লাগল? হিসেবের বাইরে কথা বলতে লাগল?
বুয়ানকে চমকে দিয়ে জুনোর এই পালটে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি খুশি হল বুয়ান৷ কিন্তু ব্যাপারটা সিক্রেট রাখতে হবে৷ ওর বেস্ট ফ্রেন্ড ওকে সে-কথাই বলেছে৷
এরপর থেকে বুয়ানের দিন আর রাত কেমন পালটে গেল৷ জুনোর সঙ্গে ওর ‘সিক্রেট বন্ধুত্ব’ ক্রমশই বাড়তে লাগল৷ রণবীর আর শ্রেয়সী সেই আড়ালের বন্ধুত্বের কথা মোটেও জানতে পারলেন না৷
বুয়ান যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ততক্ষণ জুনো ওর সঙ্গে-সঙ্গে থাকে৷ এমনকী খাওয়ার টেবিলে যখন বুয়ান খেতে বসে তখনও জুনোকে ওর চেয়ারের পাশে মেঝেতে দাঁড় করিয়ে রাখে৷ এ ছাড়া টিভি দেখা, কমিকস কিংবা গল্পের বই পড়ার সময়, অথবা পড়াশোনার সময় জুনো তো পাশে আছেই!
প্রথম-প্রথম ছেলের এই ‘জুনো ম্যানিয়া’ নিয়ে শ্রেয়সী এবং রণবীর বুয়ানের সঙ্গে অনেক চেঁচামেচি করেছেন৷ কিন্তু বুয়ান বারবারই বলেছে, ‘জুনো আমার পড়াশোনায় কত হেলপ করে জানো?’
‘একটা মেকানিক্যাল রোবট—সেটা আবার হেলপ করবে কী করে!’ শ্রেয়সী একইসঙ্গে অবাক এবং বিরক্ত৷
বুয়ান হেসে বলেছে, ‘ও তোমরা বুঝবে না, মা—ওটা আমাদের দুজনের সিক্রেট…৷’
রণবীর ধৈর্য হারিয়ে বলেন, ‘কী যে সব এলোমেলো কথা বলিস…!’
এইরকম ক’দিন ঝামেলা চলার পর বুয়ানের ক্লাস টেস্টের রেজাল্ট বেরোতে শুরু করল৷ এবং তখনই শ্রেয়সী আর রণবীর চুপ করে যেতে বাধ্য হলেন৷ কারণ, বুয়ান দারুণ সব নম্বর পেয়েছে৷ সব ক’টা এগজ্যামেই গ্রেড ‘ও’—আউটস্ট্যান্ডিং৷ এর আগে ও কখনও এত ভালো স্কোর করতে পারেনি৷ সুতরাং, বুয়ানকে তখন আর পায় কে!
সত্যিই জুনো ওকে অনেক হেলপ করে৷ জুনো অনেক বিষয়ে অনেক কিছু জানে৷ ওর সামনে বুয়ান এ পর্যন্ত যত পড়াশোনা করেছে তার সবটুকুই জুনোর মগজ ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিয়েছে৷ যখন-তখন ও বুয়ানের পড়ার ভুল শুধরে দেয়৷ এ ছাড়া নতুন অনেক কিছু শিখিয়ে দেয় ওকে৷ রণবীর আর শ্রেয়সী যখন কাছে থাকেন না তখনই ওদের দুজনের মধ্যে এইসব কথাবার্তা হয়৷ আর যদি ওঁদের দুজনের কেউ একজন কাছে থাকেন তা হলে জুনোর ছক বাঁধা ‘হাই, মাই নেম ইজ জুনো৷’ শুরু হয়ে যায়৷
একদিন সন্ধেবেলা বুয়ান একটা বই পড়ছিল৷ বেশ বড় মাপের বাঁধানো বই৷ তাতে অনেক রঙিন ছবি৷ বইটার নাম ‘মাই বিগ এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ডাইনোসরস’৷
বুয়ান পড়ছিল আর অবাক হয়ে ডাইনোসর যুগের হরেকরকম প্রাণীর ছবি দেখছিল৷
জুনো বইটার আশপাশ দিয়ে ঘোরাফেরা করছিল৷ বুয়ানের পড়া শুনে ও ধাতব গলায় বলে উঠল, ‘এটা মেসোজোয়িক যুগের ব্যাপার৷ এই যুগের টাইম লেংথ হচ্ছে একশো বিরাশি মিলিয়ন বছর৷ এই সময়ের মধ্যে রয়েছে তিন-তিনটে পিরিয়ড: ট্রায়াসিক পিরিয়ড, জুরাসিক পিরিয়ড আর ক্রিটেইশাস পিরিয়ড৷ ট্রায়াসিক পিরিয়ডে ছোট-ছোট ডাইনোসরের জন্ম হয়৷ জুরাসিক পিরিয়ডে ওরা সংখ্যায় আর মাপে বেড়ে ওঠে৷ সবচেয়ে বড় তৃণভোজী ডাইনোসর ছিল অ্যাপাটোসরাস, আর সবচেয়ে বড় মাংসাশী ডাইনোসর ছিল টিরানোসরাস রেক্স৷ তারপর ক্রিটেইশাস পিরিয়ডে ওদের মাপ আর দাপট আরও বাড়তে থাকে৷ বাড়তে-বাড়তে হঠাৎই সব শেষ৷ সায়েন্টিস্টদের আইডিয়া হল, একটা প্রকাণ্ড ধূমকেতু এসে আছড়ে পড়েছিল পৃথিবীর বুকে৷ আর সেই মহা সংঘর্ষেই ডাইনোসররা একদম খতম৷ এই অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছিল প্রায় পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বছর আগে…৷’
জুনোর কথা শুনতে-শুনতে অবাক হয়ে যাচ্ছিল বুয়ান৷ কারণ, রোবটটা এমন অনেক কথা বলছে যেগুলো বইটাতেও লেখা নেই!
বুয়ানের কী মনে হল, ও বই বন্ধ করে উঠে পড়ল৷ বলল, ‘জুনো, জাস্ট এক মিনিট ওয়েট করো৷ আমার টিরানোসরাস রেক্সের একটা ব্লক আছে৷ ওটা কিছুদিন আগে আমি তৈরি করেছিলাম৷ এক্ষুনি নিয়ে আসছি৷ ওই ডাইনোসরটা দেখলে তুমি অবাক হয়ে যাবে…৷’
বুয়ান ছুটে চলে গেল শোওয়ার ঘরে৷ সেই ঘরের এক কোণে ওর খেলনার পাহাড়৷ ক্লাস ফাইভে পড়ে অথচ এখনও ও ছোট বাচ্চার মতো খেলনা নিয়ে খেলতে ভালোবাসে৷
আধ মিনিটের মধ্যেই টিরানোসরাস রেক্সকে হাতে নিয়ে ফিরে এল ও৷ ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে চলে এল জুনোর কাছে৷
‘এই দ্যাখো, জুনো, কী সুন্দর দেখতে৷ টিরানোসরাস রেক্স…৷’
প্রাণীটা দেখতে বড় ভয়ংকর, হিংস্র৷ অসংখ্য তীক্ষ্ণ ধারালো দাঁত৷ সবুজ, কালো আর বাদামি রং৷ গা-টা চকচক করছে, আলো পিছলে যাচ্ছে এমনভাবে যে, মনে হচ্ছে সারা গায়ে লালা মাখানো৷ একটা প্রকাণ্ড টিকটিকি যেন দু-পায়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ সামনের দুটো পা ছোট, মাথাটা বড়৷ মুখটা হাঁ করা৷
এই প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীটাকেই ছোট-ছোট পলিমারের ব্লক জুড়ে-জুড়ে বুয়ান তৈরি করেছে৷ মাপে ছোট একটা মডেল হলেও প্রাণীটা একেবারে যেন জীবন্ত৷
‘অ্যানিম্যালটা দারুণ ইন্টারেস্টিং দেখতে…৷’ জুনো বলল৷
বুয়ানের মাথায় এক অদ্ভুত খেয়াল চাপল৷ আচ্ছা, ডাইনোসরের দেশে অ্যাডভেঞ্চার করতে গেলে কেমন হয়? ওঃ, একটা সুপার-ডুপার অ্যাডভেঞ্চার হবে তা হলে!
সেই কথাটাই জুনোকে জিগ্যেস করল বুয়ান৷
জুনো ওর ধাতব গলায় উত্তর দিল, ‘সেটা পসিবল নয়, ফ্রেন্ড৷ কারণ, ডাইনোসরদের ল্যান্ডে যেতে হলে আমাদের টাইম ট্র্যাভেল করতে হবে৷ আর টাইম ট্র্যাভেল করতে হলে টাইম মেশিন চাই৷ ব্যাড লাক, আমাদের কোনও টাইম মেশিন নেই৷’
শুনে মুখ ব্যাজার করল বুয়ান৷ ওঃ, একটা মেশিনের জন্য একটা অ্যাডভেঞ্চার ফসকে গেল!
এমন সময় দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন শ্রেয়সী৷
‘বুয়ান, তোর রুটিন ধরে স্কুলের ব্যাগ গোছানো হয়ে গেছে? নাকি কাল স্কুল আছে সেটা ভুলে গেছিস!’
বুয়ান সঙ্গে-সঙ্গে ডাইনোসরের বই বন্ধ করে উঠে পড়ল, বলল, ‘এই দ্যাখো না, এক মিনিটে গুছিয়ে নিচ্ছি…৷’
জুনো ওর প্রোগ্রাম বাঁধা সংলাপ শুরু করে দিল৷
‘হাই, মাই নেম ইজ জুনো৷’
আবার নতুন দুটো ব্লক কিনল বুয়ান৷ একটা অ্যাপাটোসরাস, আর-একটা চাঁদ৷ ওর পড়াশোনা ভালো হচ্ছে, পরীক্ষাতেও ভালো-ভালো নম্বর পাচ্ছে, তাই শ্রেয়সী বা রণবীর ছেলের নতুন বায়না মেটাতে আর আপত্তি করেননি৷
সুতরাং নতুন ব্লক দুটো নিয়ে এবার মেতে উঠল বুয়ান৷ পরের দিনই তৈরি হয়ে গেল দুটো জিনিস: তৃণভোজী ডাইনোসর আর চাঁদ৷ মা আর বাপি আশেপাশে না থাকলেই নতুন ব্লক নিয়ে জুনোর সঙ্গে ওর গল্প চলতে লাগল৷
অ্যাপাটোসরাসটা মাপে ইঞ্চিসাতেক একটা মডেল হলেও দেখতে একেবারে জীবন্ত৷ ঠিক ওর টিরানোসরাস রেক্সের মতন৷
চাঁদটাও ঠিক যেন তাই৷ মাপে দশ ইঞ্চি ব্যাসের একটা ফুটবলের মতো হলেও দেখতে হুবহু আসল চাঁদের মতো৷ ক্ষতচিহ্নের মতো দেখতে উল্কাপাতের বড়-বড় গর্ত, সাদা বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ওপরে কালো-কালো শিরা-উপশিরা—পরিভাষায় যাকে বলে ‘লুনার মারিয়া’৷ এ ছাড়া ‘ইমপ্যাক্ট বেসিন’, ‘ক্রেটার’—বইয়ে যা-যা পড়েছে বুয়ান তার সবকিছুরই ইশারা রয়েছে চাঁদের এই খুদে মডেলে৷
আরও একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করল বুয়ান৷ অন্ধকারে চাঁদের মডেলটা থেকে হালকা আলোর আভা বেরোয়৷ হয়তো চাঁদ তৈরির ছোট-ছোট ব্লকগুলো ফ্লুওরেসেন্ট পলিমার দিয়ে তৈরি৷
একদিন সন্ধের পর পড়াশোনার পাট চুকিয়ে জুনোর সঙ্গে খেলতে শুরু করল৷ খেলার সরঞ্জাম হিসেবে হাতের কাছে রয়েছে একজোড়া ডাইনোসর আর চাঁদ৷
বুয়ান আর জুনো নিজেদের মধ্যে নানান কথা বলছিল৷ তারই মধ্যে বুয়ান হঠাৎ বলে উঠল, ‘জুনো, চলো, আমরা চাঁদে যাই—৷’
‘যাব বললেই যাওয়া যায়! একটা স্পেসশিপ লাগবে, আর তোমার জন্যে লাগবে স্পেস-স্যুট—নইলে তুমি চাঁদে নামবে কী করে!’
‘আর তুমি? তোমার স্পেস-স্যুট লাগবে না?’
‘না৷ বিকজ আমি তো রোবট—স্পেশাল প্লাস্টিক আর মেটাল দিয়ে তৈরি…৷’
বুয়ান বুঝতে পারল, ওর বেস্ট ফ্রেন্ড ওর সঙ্গে মজা করছে৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও স্পেসশিপ আর স্পেস-স্যুটের ব্যাপারটা ওর মাথায় গেঁথে গেল৷ ব্লকের দোকানে ও এই ব্লকগুলো বিক্রি হতে দেখেছে৷ সুতরাং সেগুলোর না হয় ব্যবস্থা হল৷ কিন্তু…৷
‘কিন্তু জুনো, চাঁদ তো মহাকাশে ভেসে থাকে! আমার এই চাঁদটা, তুমি তো জানো, মেঝেতে থাকে—গড়ায়…৷’
‘সব জানি৷ চিন্তা কোরো না—ধীরে-ধীরে সব হবে৷ চাঁদের অ্যাটমসফিয়ার তৈরি করতে হবে, চাঁদের গ্র্যাভিটি তৈরি করতে হবে, ওটাকে শূন্যে ভাসাতে হবে—তবেই না ব্লকের মডেলটা আসলের মতো হবে!’
জুনোর কথায় বুয়ানের হাসি পেয়ে গেল৷ কী যে আজেবাজে বকছে রোবটটা! বুয়ান জানে, চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের ছ’ভাগের একভাগ৷ সেইজন্যই চাঁদে বায়ুমণ্ডল খুব পাতলা—প্রায় নেই বললেই চলে৷
কিন্তু কী করে এসব তৈরি করবে জুনো?
সে যাই হোক, সপ্তাহখানেকের মধ্যে স্পেসশিপ আর স্পেস-স্যুটের ব্লক চলে এল বাড়িতে এবং দু-দিনের মধ্যে মডেল দুটো তৈরিও হয়ে গেল৷
তারপর চাঁদে যাওয়া নিয়ে দু-বন্ধুর চর্চা চলতে লাগল দিনের পর দিন৷
চাঁদ সম্পর্কে বুয়ান অনেক কথা জানে৷ কিন্তু জুনোর কথায় ও বুঝতে পারল, চাঁদ সম্পর্কে জুনোর জ্ঞান বুয়ানের অন্তত একশো গুণ৷ ও জানে, চাঁদের ব্যাস ১৭৩৮ কিলোমিটার, চাঁদ পৃথিবীকে ঘিরে পাক খাওয়ার সময় চাঁদের একটা পিঠ সবসময় পৃথিবীর দিকে ‘মুখ’ করে থাকে, চাঁদের কালচে এলাকাগুলোর নাম ‘মারিয়া’, আর আলোকিত অঞ্চলগুলো ‘লুনার হাইল্যান্ডস’৷ এও জানে, পৃথিবী থেকে চাঁদের গড় দূরত্ব ৩৮৪৪০০ কিলোমিটার৷
বুয়ান বলল, ‘জানো, ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই নিল আর্মস্ট্রং প্রথম চাঁদের মাটিতে পা রেখেছিলেন? ওঁর সঙ্গী ছিলেন এডুইন অলড্রিন?’
‘জানি৷’ বলল জুনো, ‘ওঁদের আর-এক সঙ্গী মাইকেল কলিন্স লুনার মডিউলের ভেতরে বসেছিলেন…চাঁদে নামেননি…৷’
চাঁদে যাওয়ার জন্য বুয়ানের আর তর সইছিল না৷ ও তাগাদা করে-করে জুনোকে একেবারে পাগল করে দিচ্ছিল৷ তাতে বেস্ট ফ্রেন্ড সবসময় বলে, ‘একটু সবুর করো৷ ঠিক সময় এলেই আমরা স্টার্ট দেব…৷’ একটু থেমে জুনো আবার বলেছে, ‘জানো তো, চাঁদের টেম্পারেচার ওর নানান জায়গায় নানান রকম৷ -১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে +১১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠা-নামা করে৷ আমরা ওর এমন জায়গায় গিয়ে ল্যান্ড করব যেখানে টেম্পারেচার আটাশ কি তিরিশ ডিগ্রি—মানে, আমাদের পক্ষে খুব কমফোর্টেবল, বুঝলে?’
বুয়ান শোনে, কিন্তু ওর মনে হয় পুরো ব্যাপারটাই মিথ্যে, মনভোলানো কথা৷ কিন্তু তার পরের মুহূর্তেই মনে হয়, জুনো ওর বেস্ট ফ্রেন্ড৷ বেস্ট ফ্রেন্ড কখনও মিথ্যে কথা বলবে না!
চারদিন পরেই এসে গেল সেই দিন৷
রাত আটটার সময় পড়ার ঘরের দরজা ভেজিয়ে জুনোর কাছে এসে বসল বুয়ান৷ হাতের কাছেই রাখা আছে স্পেস-স্যুট, স্পেসশিপ আর চাঁদ৷ এইবার জুনো শুরু করবে ওদের চাঁদে পাড়ি দেওয়ার তোড়জোড়৷
এবং শুরু হয়েও গেল৷
জুনো বলল, ‘বুয়ান, এখন আমি যা-যা করব সেটাকে তুমি মোটেই ম্যাজিক বলে ভেবো না৷ কারণ, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি যখন অনেকটা এগিয়ে যায় তখন সেটাকে সবাই ম্যাজিক ভেবে ভুল করে৷ এসো, লেট আস স্টার্ট…ওয়ান, টু, থ্রি…৷’
ঘরের ভেজানো দরজা ঠেলে খুলতেই যে-দৃশ্য শ্রেয়সীর চোখে পড়ল সেরকম দৃশ্য বুঝি শুধু স্বপ্নেই দেখা যায়৷
বুয়ানকে ডাকতে এসেছিলেন শ্রেয়সী৷ কিন্তু দরজা খুলতেই পাথর হয়ে গেলেন৷
কোথায় বুয়ান!
তার বদলে চোখের সামনে এক ম্যাজিক-দৃশ্য৷
ঘরটা অন্ধকার৷ তবে একটা হালকা আলোর নীল আভা ছড়িয়ে রয়েছে ঘরে৷ ঘরটা এত ঠান্ডা যেন মনে হচ্ছে ঘোর শীতকাল৷ ঘরের ঠিক মাঝখানে শূন্যে ভেসে রয়েছে একটা সাদা গোলক—ব্লক দিয়ে তৈরি বুয়ানের চাঁদ৷ সেই চাঁদের গায়ে আসল চাঁদের মতো কলঙ্কের দাগ চোখে পড়ছে৷
গোলকটা যে শুধু ভেসে রয়েছে তা নয়৷ খুব ধীরে-ধীরে একটা বৃত্তাকার কক্ষপথে পাক খাচ্ছে৷ আর সেই গোলকের ওপর লাফালাফি করে খেলা করছে দুটো ছোট-ছোট পুতুল: একটা প্লাস্টিক আর মেটালের তৈরি রংচঙে রোবট—তার সারা শরীরে এখানে-সেখানে রঙিন ফুটকির মতো ছোট-ছোট বাতি জ্বলছে; আর দ্বিতীয় পুতুলটার শরীরে মহাকাশচারীদের স্পেস-স্যুট৷
পুতুল দুটোর লাফের ধরন ভারী অদ্ভুত৷ ওরা ধীরে-ধীরে ভেসে উঠছে শূন্যে, আবার ধীরে-ধীরে নেমে আসছে গোলকের পিঠে৷ ঠিক যেন স্লো-মোশনে বাস্কেট বল খেলায় গোল করছে৷ আর এত লাফালাফি সত্ত্বেও, আশ্চর্য, পুতুল দুটো গোলকের ওপর থেকে পড়ে যাচ্ছে না!
পুতুল দুটোর কাছ থেকে বেশ খানিকটা তফাতে ‘মিনি’ চাঁদের পিঠে ওপরদিকে মুখ উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা খুদে স্পেসশিপ—দেখে অন্তত তাই মনে হল শ্রেয়সীর৷ কেমন একটা ঘোরের মধ্যে অস্ফুটে ‘বুয়ান!’ বলে একবার ডেকে উঠলেন৷ একইসঙ্গে মাথাটা টলে উঠল৷
তারপর আর কিছু মনে নেই৷