চাঁদ পরীক্ষা

চাঁদ পরীক্ষা

কার্টুন চ্যানেলে টম এন্ড জেরি দেখানো হচ্ছে। টম এন্ড জেরি খুব মজার কাটুন। এত মজার যে দ্যাখার সময় মুখ টিপে হাসা যায় না, শব্দ করে হাসতে হয়। এখন যেটা দেখানো হচ্ছে, সেটা যেন বেশি মজার। জেরি একটা কার্পেটের তলায় লুকিয়ে আছে, টম বালিশ ভেবে তার গায়ে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়েছে। তারপর জেরিও গড়াচ্ছে, টমও গড়াচ্ছে। যে দেখবে সেও হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়বে।

চার বছরের বিন্দু সোফায় বসে কার্টুন দেখছে। তবে সে হাসছে না, উলটে তার চোখ দিয়ে টসটস করে জল পড়ছে। বিল্টু কাঁদছে।

বিল্টু প্রতিদিন সকালে এই সময়টা কাঁদে। কারণ, এই সময় তাকে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে হয়। বিল্টুকে তৈরি করছে তার মা। ছেলে এবং মা দু’জনের কাছেই এটা একটা ঘটনা। এই ঘটনার বিভিন্ন পর্ব রয়েছে। সকাল ছ’টায় ঘুম থেকে টেনে হেঁচড়ে তোলা দিয়ে সেই পর্বের শুরু। তারপর মুখ ধোওয়া, দুধ খাওয়া, জামাপ্যান্ট পরা, জুতোর ফিতে বাঁধা এবং সবশেষে টাইয়ের নট ঠিক করা দিয়ে এর শেষ। গোটাটাই বিল্টুর কাছে ভয়ংকর অত্যাচার মতো। সম্প্রতি সেই অত্যাচারে নতুন একটা মাত্রা যোগ হয়েছে। সাজগোজের প্রতিটি পর্বে যূথিকা ছেলেকে ইংরেজিতে কথা বলা শেখাচ্ছে। সে নিয়ম করেছে, এই সাতসকালে ছেলেকে সব কথাই ইংরেজিতে বলতে হবে। যেমন, আজ কিছুতেই স্কুল যাব না, আমার ভীষণ ঘুম। পাচ্ছে, দুধ খেলে বমি করে ফেলব– কিছুই বাংলায় বলা চলবে না। এমনকী টম। এন্ড জেরি কার্টুন দেখার সময়ও হো হো করে হাসা বারণ, হাসির দমকে দমকে বলতে হবে ইয়া ইয়া, আউচ আউচ।

এরপর বিল্টুর কাঁদা ছাড়া আর কী উপায় আছে?

স্বাভাবিক কারণেই ছেলেকে ইংরেজি কথোপকথন শেখানোর সময় যূথিকাও বাংলা পরিত্যাগ করেছে। ইংরেজিতে বেশি জটিল বাক্য সে বলতে পারে না ঠিকই, তবে সেটা এমন কিছু ব্যাপার নয়। গুড মর্নিং, কাম, সিটডাউন, টেক ইয়োর মিল্ক ধরনের কথায় আর তার জড়তা লাগে না। বরং বেশ গর্বই হয়। নিজেকে মেমসাহেব মেমসাহেব লাগে। গতসপ্তাহে সে গোপনে নিউমার্কেট থেকে একটা হাউজকোট কিনে এনেছে। রংটা একটু চড়ার দিকে। গাঢ় হলুদ, কবজি আর গলার কাছটায় নীল। তা হোক। হাউজকোট পরে তো আর সে বিয়েবাড়ি যাচ্ছে না, বাড়িতেই থাকছে। শাড়ি ম্যাক্সি পরে আর যাই হোক ইংরেজি হয় না। ভোরবেলা উঠেই হাউজকোট পরে ফেলছে। প্রথমদিন ঘুম ভেঙে মাকে ওই কিম্ভূত পোশাকে দেখে বিল্টু আঁতকে উঠেছিল। এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। যূথিকার খুব ইচ্ছে কয়েক জোড়া কাঁটা-চামচ কেনে। ব্রেকফাস্টটা বিল্টুর কাঁটা-চামচেই করা উচিত। চিন্তা একটাই, পাউরুটি আর দুধ কি বিন্দু কাঁটা-চামচে ম্যানেজ করতে পারবে? কেন পারবে না? চিনারা যদি কাঠি দিয়ে ভাত খেতে পারে, চামচে পাউরুটি দুধ হবে না কেন?

সব মিলিয়ে যূথিকা আজকাল সকালটা ‘ইংরেজি ইংরেজি’র মধ্যে কাটাচ্ছিল। গলার স্বরটাই অনেক নেমে গিয়েছিল। কিন্তু আজ যে কেন অন্যরকম হচ্ছে! মাঝেমধ্যেই ছেলের ওপর খেঁকিয়ে উঠছে। ইংরেজি তো দূরের কথা, রাগের মধ্যে যে-ভাষা সে ব্যবহার করছে তাকে বিশুদ্ধ বাংলা বলাও কঠিন। যেমন, ‘কান্না না থামালে থাবড়ে গলি ফাটিয়ে দেব’ অথবা ‘লাই পেয়ে পেয়ে মাথায় উঠেছ’।

চন্দন একটু দূরে বসে আছে। বসে পা দোলাচ্ছে। তার পাশে খবরের কাগজ ভাঁজ করা। সেই ভাজ এখনও খোলা হয়নি। পাশে পড়ে থাকা সত্ত্বেও চন্দন খবরের কাগজ খুলে পড়ছে না মানে বড় কোনও গোলমাল হয়েছে। তার মুখ গম্ভীর। স্ত্রীর চিৎকার, ছেলের কান্না, কোনওদিকেই তার মন নেই। সে উঠে দাঁড়িয়ে পায়ে চটি গলাল। যূথিকাকে বলল, ‘তাড়াতাড়ি করো। স্কুলের বাস বেরিয়ে গেলে কিন্তু আমি ট্যাক্সি ধরতে পারব না।’

যূথিকা ঝাঁঝিয়ে বলল, ‘আমাকে ট্যাক্সির কথা শোনাচ্ছ কেন? আমি কি স্কুলে যাচ্ছি? তোমার ছেলে, ইচ্ছে হলে স্কুলে পাঠাবে, ইচ্ছে হলে পাঠাবে না।’

বিল্টু তার ছোট্ট জুতোটা পরতে পরতে চোখের জল মুছল। বলল, বাবা, আমি স্কুল বাসে যাব না, আমি ট্যাক্সি করে যাব। আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি ট্যাক্সিতে ঘুমোব।’

যুথিকা এবার সত্যি সত্যি ছেলের গালে একটা চড় মারল। চন্দন ছেলের হাত ধরে বলল, ‘চল, বাসে উঠে কাঁদবি।’

এ-বাড়িতে আজ কী হল? সকাল হতেনা-হতে কান্নাকাটি ঝগড়া মুখ ব্যাজার কেন? তিনজনের এই ছোট্ট পরিবারের তো এখন হাসিখুশি থাকা উচিত। মাত্র। কয়েকমাস হল তারা বাগুইআটির ভাড়া বাসা ছেড়ে দিয়ে সন্তোষপুরের এই নতুন ফ্ল্যাটে এসে উঠে। নিজেদের নতুন ফ্ল্যাটের তো মজাই আলাদা। কলকাতা যত হাত পা ছড়াচ্ছে জমি তত হাত পা গুটোচ্ছে। বাড়ির জন্য একা জমি পাওয়া অসম্ভব। পথ একটাই। সরকার নিয়ম করে দিয়েছে, আগে অনেকে মিলে কোঅপারেটিভ তৈরি। করো। সরকারকে বিস্তর ধরাধরি করো, তারপর এক টুকরো ঠাঁই মিললেও মিলতে পারে।

চন্দনদের অবশ্য বিস্তর ধরাধরি করতে হয়নি। অ্যাকাউন্টসের ভুবদুলাল হালদারকে বলা হল। ভবদুলালের ভায়রাভাইয়ের মামা ক্ষুদ্র ও মাঝারি স্বাস্থমন্ত্রী। মানুষটা ভাল। একটু যা জ্ঞানগর্ভ কথা বলেন। সে তো বলবেনই। মন্ত্রী জ্ঞানগর্ভ কথা বলবে না তো কে বলবে? জমি চাই শুনে তিনি বললেন, ‘বাঙালি একসঙ্গে থাকার কনসেপ্টটাই ভুলে গেছে। আমরা সেটাই সরকার থেকে ফিরিয়ে দিতে চাই। মনে। রাখবে ভবদুলাল, দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ। তোমরা অফিসের সহকর্মীরা মিলে কোঅপারেটিভ করে একসঙ্গে থাকার পরিকল্পনা করেছ, কর্মক্ষেত্রের বাইরেও হাত হাতে, পায়ে পা, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে চাইছ— এ তো খুশির খবর, এ তো আনন্দের কথা। যাও হে, চিন্তা কোরো না, তোমাদের ইচ্ছা পূরণ হবে। তোমরা জমি পাবে। কদম কদম বাড়ায়ে যা।’

বেশি কদম বাড়াতে হল না। অল্প আঁটাহাঁটি করে কাজ হল। কোঅপারেটিভের নাম হল, একসাথে। সস্তায় জমি পাওয়া গেল সন্তোষপুরে। অফিসের লোন নিয়ে ফ্ল্যাট হল। ফ্ল্যাটের নাম— একসাথে আবাসন।

ফ্ল্যাটে ঢোকার সময় এলাহি কাণ্ড। ছাদে প্যান্ডেল বেঁধে ফ্ল্যাটপ্রবেশের খাওয়াদাওয়া হল। কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর অনুষ্ঠানে আসবেন বললেও শেষ মুহূর্তে আসতে পারেননি। তবে বার্তা পাঠালেন— আমি গর্বিত। আমি মুগ্ধ। আমি অভিভূত। খুবই গা ছমছমে বার্তা।

সেই ফ্লাটে ঢোকার বেশিদিন হয়নি। তবু কেন আজ চন্দনের মুখ ব্যাজার? যূথিকা রেগে আছে বলে?

ছেলেকে বাসে তুলে দিয়ে চন্দন যখন ফিরল তখন তাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। সে সোজা শোবার ঘরে ঢুকল। এখনও ঘর পুরোপুরি সাজানো হয়নি। জিনিসপত্র। এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। যূথিকা চা নিয়ে এসে পাশে বসল। মুখই বোঝা যাচ্ছে, তার মেজাজ খুব খারাপ। ঘরের এক কোণে ডাঁই করে পড়ে থাকা জিনিসগুলো দেখে তার ভুরু আরও কুঁচকে গেল। খুব বিরক্তির সঙ্গে সে বলল, ‘এগুলো দেখলেই আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমি এসব গোছগাছ করতে পারব না।’

চন্দন হাই তুলে বলল, ‘তুমি পারবে না তো কে পারবে? তোমার ফ্ল্যাটের জিনিস। তুমি গোছাবে না তো কে গোছাবে?’

যূথিকা আড়মোড়া ভেঙে বলল, কেন তুমি? তুমি অফিস ছুটি নাও। জিনিস তো আমার একার নয়, তোমারও।’

চদন বলল, ‘আমি কিছুই করব না। আমি ঘুমোব। কাল রাতে গরমে একটু ঘুমোতে পারিনি।’

যূথিকা বলল, ‘পারবে কী করে? পশিচমমুখো ফ্ল্যাটে ছিটেফোঁটাও হাওয়া ঢোকে না। ফ্ল্যাট ফ্ল্যাট করে তো মরেছিল। এবার গরমে রাত জেগে ফ্ল্যাটের শোভা। দ্যাখো।’

চন্দন এবার উঠে বসল। গম্ভীরমুখে বলল, ‘গরমের শুরুতেই এই অবস্থা, আসল গরম পড়লে কী হবে তাই ভাবছি। শুধু রাত কে? দিনেরবেলাতে চাঁদি ফেটে যাবে। চারতলায় ছাদের তলায় ঘর। রোদটা পুরো পড়ছে। আজই প্রভাসকে কথাটা বলব ঠিক করেছি। প্রভাস কোঅপারেটিভের সেক্রেটারি। এমনি এমনি তো আর সেক্রেটারি হয়নি।’

যূথিকা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ‘কী বলবে? রোদটা একটু সরিয়ে নিন? প্লিজ, আপনি কোঅপারেটিভের সেক্রেটারি, আপনি বললেই রোদ সরে যাবে।’

এই বিদ্রূপে আরও রেগে গেল চন্দন। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “দেখতেই পাবে কী বলি। তুমি বাজারের থলি দাও।’

যূথিকা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, ‘বুঝতেই পারছ সবাই মিলে তোমাকে বেছে বেছে চারতলাটা দিয়েছে। অফিস অফিস করে জীবনটা হেদিয়ে মরলে, এখন বোঝো অফিস কী জিনিস।’

চন্দন গজগজ করতে করতে নেমে এল। ফ্ল্যাটের সামনে কেয়ারটেকারকে দিয়ে অমূল্য সেন তার মারুতি গাড়িটা যত্ন করে ধোয়াচ্ছে। অমূল্যর গাড়ি ধোওয়ানো দেখে চন্দনের মেজাজ গেল আরও বিগড়ে। অমূল্য তার সঙ্গেই অফিসে ঢুকেছিল। পদমর্যাদাতেও সে কাছাকাছি। ব্যাটা গাড়ি কিনল কী করে? সে কাছে গিয়ে বলল, ‘এটা কী অমূল্য? যে যার মতো পজিশন বুঝে নিলে। আমাকে দিলে চারতলার পশ্চিমমুখো ঘর? এটা কি ঠিক হল?’

অমূল্য চন্দনের দিকে না তাকিয়ে কেয়ারটেকারকে বলল, ‘রতন, সিটগুলো একটু ভাল করে ঝেড়ে দে বাবা। এ তো আর হারেমের পয়সার গাড়ি নয়, রক্ত জল করে কেনা। সাবধানে কাজ কর! হ্যাঁ, চন্দন কী বলছিলে।

চন্দন বলল, ‘কী আর বলব, বলছিলাম, আমায় চারতলায় দিলে কেন?’

‘আমরা তো দিইনি। লটারি দিয়েছে। তুমি বোধহয় ভুলে গেছ, লটারি করে ফ্ল্যাটের পজিশন ঠিক হয়েছে। আর এতদিন পরে বলছ কেন?’

‘এতদিন গরম পড়েনি তাই বুঝতে পারিনি। তা ছাড়া তুমি এমন একটা ভান করছ যেন লটারিতে দুর্নীতি হয় না?’

‘এসব কথা তুমি সেক্রেটারিকে বলো। অ্যাই রতন, কী হচ্ছেটা কী? জানলার কাচগুলো কে মুছবে? সব ব্যাপারে ফাঁকি।’

‘ঠিক আছে, তাই বলব। সেক্রেটারিকেই বলব।’

গটগট করে বাজারের দিকে হাঁটা দিল চন্দন।

বাজারে গিয়েও মনটা খারাপ হয়ে গেল চন্দনের। বিঘত সাইজের ট্যাংরা মাছ এসেছে। দাম ভয়ংকর। ফ্ল্যাটের লোন মেটাতেই জেরবার অবস্থা। এই সময় বিঘত সাইজের ট্যাংরা কেনা চলে না, কড়ে আঙুলের মতো পুঁটি হলে সবথেকে ভাল হয়। ট্যাংরা থেকে সরে গেল চন্দন। আড়চোখে দেখল, পল্লব ট্যাংরা মাছ বাছছে। পল্লব গাঙ্গুলি। তিনতলায় অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে বসে। ‘একসাথে’ বাড়িরই বাসিন্দা। পল্লব ট্যাংরার পেট টিপে ডিম দেখছে দেখে চন্দনের মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল। দু’তরফের খারাপ। এক, ট্যাংরা মাছ কিনছে বলে হিংসের খারাপ, আর দু’নম্বর খারাপ হল, এই পল্লবের কপালেই লটারিতে দোতলায় পুব খোলা ফ্ল্যাট জুটেছে।

বাজারের বাইরে চায়ের দোকানে পল্লব-চন্দন দু’জনে বসে চা খাচ্ছে। পায়ের কাছে বাজারের থলি। চন্দন ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে বলল, “অমূল্যর গাড়িটার দাম কিছু জানো নাকি পল্লব?’

পল্লব বলল, ‘সেকেন্ড হ্যান্ড শুনলাম।’

চন্দন বলল, ‘সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি বুঝি আজকাল বিনিপয়সায় পাওয়া যাচ্ছে? একসঙ্গে গাড়ি-ফ্ল্যাট তো, তাই চোখে লাগল। অবশ্য লোন ডিপার্টমেন্টে কাজ করলে কত কিছুই হয়।’

পল্লব জিভ কেটে বলল, ‘না না, অমূল্যদা সেরকম নন।’

চন্দন বলল, ‘না হলেই ভালো, তবে গরমে ট্যাংরা মাছ শরীরের পক্ষে মোটেই ভাল না পল্লব। মাছের যত অসুখবিসুখ তো গরমেই। সাবধান থাকাই ভাল।’ কথাটা কেটে কেটে বলল চন্দন যাতে পল্লবের বুঝতে অসুবিধে না হয়।

পল্লব হেসে বলল, ‘চিন্তা করবেন না, বড় মাছ আমাদের অভ্যেস আছে।’

বিদ্রূপ হজম করে তেতো মনে বাড়ি ফিরল চন্দন।

অফিস বেরোনোর আগে বড় রকম দুর্ঘটনার খবর পাওয়া গেল।

গত সপ্তাহে দক্ষিণ কলকাতার নামডাকওলা বড় স্কুলে ভরতির ইন্টারভিউ দিয়েছিল বিল্টু। বিল্টুর সঙ্গে ইন্টারভিউ দিয়েছে একতলার প্রতুলের মেয়ে। চন্দন প্রতুল বোসের থেকে তিন ধাপ উঁচু পদে কাজ করে। সেদিক দিয়ে তাকে প্রতুলের ‘বস’ বলাই উচিত। সকালে রেজাল্ট বেরিয়েছে। যূথিকা গিয়েছিল। ফিরে এল থমথমে মুখে। বিল্টর হয়নি এবং প্রতুলের মেয়ের নাম রয়েছে।

চন্দন খেতে বসে খবরটা শুনল। বলল, ‘সেকী, এত করেও হল না! নিউমার্কেট থেকে হাউজকোট কিনলে যে!’

‘নিজের বউকে নিয়ে রসিকতা করতে ভাল লাগলে করো। তবে মনে রেখো অফিসে গিয়ে তোমাকে নিয়েও ঠাট্টা শুনতে হবে। অজন্তাও গিয়েছিল। আমার শুকনো মুখ দেখে ন্যাকা ন্যাকা গলায় বলল, ‘চিন্তা কোরো না ভাই, পরেরবার নিশ্চয় হবে।’

অ্যাকাউন্টসের প্রতুল অফিসে গিয়ে কী বলবে কে জানে। আজ আর তিনতলায় যাওয়া নেই। ভাত নাড়াচাড়া করে উঠে পড়ল চন্দন। বিল্টু পায়নি ঠিক আছে। মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু প্রতুলের মেয়ের পাওয়াটা কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না। এরপর ভাত গলা দিয়ে নামার কথা নয়।

অফিসে গিয়ে চন্দন খবর পেল বিভূতির প্রোমোশন ফাইল রেডি। শুধু ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সই বাকি। বিভূতি বিশ্বাস একসাথে আবাসনের তিনতলার বাসিন্দা। কাজটাজ ফেলে এম. ডি-র প্রাইভেট সেক্রেটারির ঘরে ছুটল চন্দন। প্রোমোশন ঠেকাতে হবে। ফাইল যেন না যায়। বিভূতির প্রোমোশন মানে কেলেঙ্কারি। বাড়িতে মুখ দেখানো যাবে না।

এম. ডি-র প্রাইভেট সেক্রেটারি চন্দনের কথা শুনে অবাক! বলল, ‘সেকী!’ আপনারা একসঙ্গে বাড়িটাড়ি বানালেন যে! এর মধ্যে আবার কী হল? ফাইলটা তো আর আটকানো যাবে না। সব রেডি। তা ছাড়া বিভূতিবাবুর প্রোমোশন হলে আপনার ক্ষতি কী? আপনি পরের বছর পাবেন। ডিভিশনও তো আলাদা।’

চন্দন গম্ভীর মুখে বলে ‘ক্ষতি আছে। বুঝবেন না।’ মেজাজ অসম্ভব খারাপ নিয়েই নিজের টেবিলে ফিরে এল চন্দন। তার কাজ করতে ইচ্ছে করছে না। পরের পর গোলমাল। গরম ফ্ল্যাট, অমূল্যর গাড়ি, পল্লবের ট্যাংরা মাছ, প্রতুলের মেয়ের ভরতি, বিভূতির প্রোমোশন—।

এমন সময় এল সমর। সমর ছোট শালার বন্ধু! সে পারচেজে মাল সাপ্লাই করতে চায়। বড় কিছু নয়, ছোটখাটো অফিস গুডস। প্যাড খাম আলপিনের মতো এটা সেটা। ছেলেটাকে নিয়ে পরশু ফ্ল্যাটে এসেছিল শালা। যূথিকা বলেছে, ‘দ্যাখো না, যদি পারো। শ্বশুরবাড়ির জন্য তো কিছুই করতে হয় না।’

সেটাই এখন দেবে চন্দন।

পারচেজ ম্যানেজার গোকুলবাবু বয়স্ক মানুষ। সব শুনে বললেন, ‘সরি চন্দনবাবু। আপনার শালাকে সাহায্য করতে পারলাম না।’

‘শালা নয়, শালার বন্ধু? আর পারবেন না কেন?’

‘এখনও এক শালাই সাপ্লায়ার। আপনার ডিপার্টমেন্টের অশোক পালের শালা। তাকে বাদ দেব কী করে? আপনি বরং অশোক পালের সঙ্গে কথা বলে নেবেন। আপনারা এক বাড়িতেই তো থাকেন। শুনেছি আপনার উলটোদিকের ফ্ল্যাটটাই ওঁর। সকাল বিকেল দ্যাখা হচ্ছে। বলে দেখুন, উনি যদি কিছুটা ছাড়েন। আমার আর আপত্তি কীসের? এক শালার ভাগ নেবে আর এক শালা।’

চন্দনের মেজাজ এক চরমে উঠল। নিজের টেবিলে ফিরে অশোকের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে বসল সে। সমরাকে বলল, ‘আজ যাও পরে দেখব।’

পিয়োন নিয়ে এল রসগোল্লার হাঁড়ি। প্রতুলের মেয়ের স্কুলে ভরতির মিষ্টি। চন্দন প্রত্যাখ্যান করল। তার নাকি সম্প্রতি ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। প্রতুল সবার সামনেই খোঁচাটা দিল। বলল, ‘ডায়াবেটিস থাকলে খেয়ো না, পরের বছর কিন্তু ডায়াবেটিস থাকলেও আমরা খাব চন্দন। তোমার ছেলে ভরতি হবে কিনা।’ চন্দন পাশে বসে থাকা লোকনাথাকে গলা নামিয়ে বলল, ‘স্ত্রী সুন্দরী হলে অনেক সুবিধে মশাই। মেয়ে স্কুলেও ভরতি হয়ে যায়।’

লোকনাথ বোকাসোকা মানুষ। চোখ বড় করে বলল, ‘তাই নাকি!’

বাড়ি ফেরার সময় চন্দনকে দেখে অফিসের গেটে গাড়ি থামাল অমূল্য।

‘উঠে পড়ুন।’

চন্দন উঠল না। বলল, ‘শালার বাড়িতে ঘুরে যাব।’ অমূল্যর গাড়ি বেরিয়ে যেতেই সোজা বাস স্ট্যান্ড। মিনিবাস ধরে বাড়ি ফিরল। বাড়িতে যূথিকা নেই। বিল্টুকে নিয়ে বিভূতিলের ফ্ল্যাটে নাচ গানের রিহার্সাল দিতে গেছে। চন্দন মনে মনে চটল। ছেলে ভরতি হতে পারেনি, তবু যে কীসের এত ফুর্তি কে জানে।

আটটা নাগাদ যূথিকা ফিরল হাসিমুখে। চন্দনকে বলল, ‘রাগ করতে পারবে না কিন্তু। চা খেয়েছ ? ফ্লাস্ক ভরতি করে রেখে গিয়েছিলাম। অ্যাই জানো, তপতীর চালাটা না ভারী মিষ্টি। ও পাঁচটা সোলো করছে। প্রথম বছরই একসাথে আবাসনের রবীন্দ্রজয়ন্তী আমরা জমিয়ে দেব।’

‘আর তুমি ক’টা গান করছ?’

‘আমি দুটো। তার মধ্যে একটা সোলো, একটা সবার সঙ্গে। অ্যাই শুনবে?’

চন্দন চেঁচিয়ে বলে, ‘একদম এসব করবে না। লজ্জা করছে না, তপতী পাঁচটা আর তুমি একটা— বলতে লজ্জা করল না? তপতী কীসের গায়িকা হে?”

রাতে মনোজদের তিনতলার ফ্লাটে নেমন্তন্ন। মনোজ-কৃষ্ণার বিবাহবার্ষিকী। চন্দন যূথিকাকে নিয়ে একটু আগেই পৌঁছে গেল। দারুণ সাজানো ফ্ল্যাট। দেখে চন্দনের মুখ গম্ভীর হল। কৃষ্ণার হাত ধরে ঘুরে ঘুরে যুথিকা যত ঘরদোর দেখছে, চন্দনের মুখ তত গম্ভীর হচ্ছে। শেষপর্যন্ত না পেরে স্ত্রীকে ফিসফিস করে বলে বসল, ‘কী হ্যাংলামো করছ? চুপ করে বসো তো?’

‘হ্যাংলামো কেন? কী সুন্দর সাজিয়েছে, দেখব না চোখ বুজে থাকব? তোমার হিংসে হলে দেখো না।’

‘মনোজের মতো শ্বশুরের পয়সায় ফ্ল্যাট বানালে আমিও সাজাতে পারতাম।’

যূথিকা গলা নামিয়ে হিসহিসিয়ে বলল, ‘পয়সাওলা শশুর দেখে বিয়ে করলেই পারতে। ফ্ল্যাট সাজিয়ে দিত।’

ছেলেরা একঘরে, মেয়েরা আলাদা। ছোটরা ছোটাছুটি করে খেলছে। গৃহকর্তা আহারের আগে সামান্য ‘পান’-এর ব্যবস্থা রেখেছে। খাব না খাব না করেও চন্দন একটু বেশিই খেল। তিন পেগ। বেশিরভাগ সময়ই অফিস নিয়ে আলোচনা। এমন সময় আধো নেশায় চন্দন দেখল, যূথিকা হ্যান্ডসাম বিভূতির সঙ্গে একটু যেন বেশি কথা বলছে! কাছে ঘেঁষে ঘেঁষে যাচ্ছে না? সত্যি না চোখের ভুল? না, চোখের ভুল হওয়ার মতো বেশি তো সে খায়নি। মোটে চার। ঠিক আছে গেলে যাক। যার যেখানে ভাল লাগে যাবে। তার কী? সে বলার কে? না, বিভূতি হারামজাদাটাকে কোঅপারেটিভে নেওয়াটাই ঠিক হয়নি মনে হচ্ছে? হ্যান্ডসাম লোকগুলো চরিত্রহীন হয়।

নেশার ঘোরে চন্দন নিজেকে বিভূতির জায়গায় দেখতে পায়।

ইতিমধ্যে চন্দনের সঙ্গে ফ্ল্যাটের পজিশন নিয়ে প্রভাসের অল্প কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে। প্রভাস বলল, ‘এটা আপনি কী বলছেন চন্দনদা! কে কোনদিকে ফ্ল্যাট পাবে তা নিয়ে সেক্রেটারির কী করার আছে?’ চন্দন গলা চড়িয়ে বলল, ‘আলবাত আছে। কোঅপারেটিভ সেক্রেটারির অনেক পাওয়ার। ফ্ল্যাটের রোদ বৃষ্টি সবকিছুই সে কন্ট্রোল করতে পারে। তুমি আইনটা ভাল করে পড়েনি।’ প্রভাস বলল, ‘আপনি এখন প্রপার সেলে নেই চন্দনদা। আজ থাক, কাল বরং এ বিষয়ে কথা বলা যাবে। সেরকম হলে রবিবার মিটিং ডাকা যেতে পারে।’ পাশে বসে অজয় মৌলিক দু’জনের ঝগড়া শুনছিল। সে বলল, ‘চন্দনদা, আপনি চাইলে ফ্ল্যাটটা আপনার সঙ্গে বদল, করতে পারি। আসলে বাবার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। উনি বাস্তুতত্বে ভয়ানক বিশ্বাসী। বোঝেনই তো, সেকেলে মানুষ। উনি দক্ষিণের বদলে পশ্চিমদিকে ফেভার করছেন।’

চন্দন গম্ভীর হয়ে বলল, ‘কেন দক্ষিণ খারাপ কীসের?’ অজয় লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, ‘দুর, আমি এসব মানি না। বাবা বলছিলেন, বাসস্থান পশ্চিমমুখো হলে নাকি কর্মক্ষেত্রে উন্নতি অবধারিত। জানেনই তো অফিসে আমি একদম কোণঠাসা হয়ে আছি, সবাই টপাটপ টপকে যাচ্ছে। দেখা যাক বাবার বাস্তুতত্বে যদি কিছু হয়!’ একটু থেমে অজয় বলল, ‘চন্দনদা, আমি কি বাবার সঙ্গে কথা বলব?’

চন্দন গ্লাসে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, ভেবে বলব। একী অজয়! তোমার গ্লাস তো ফাঁকা, নাও আর একটা পেগ নাও।’

রাতে বিছানায় আধশোয়া হয়ে সিগারেট খাচ্ছে চন্দন। সে ক্লান্ত, খানিকটা যেন বিধ্বস্ত। যূথিকা ড্রেসিংটেবিলের সামনে টুলে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। বিল্টু বিছানার এককোণে ঘুমিয়ে কাদা। যূথিকা বলল, ‘অজয়বাবুদের সঙ্গে তা হলে ফ্ল্যাট বদলাবে?’

‘না।’

‘না! কেন? এই তো সকালে লাফাচ্ছিলে? এখন না বলছ কেন?’

‘পশ্চিম দিকটা নাকি ভাল। ভাল দিকটা অজয় শালাকে দেব কেন? আমি অন্য কথা ভাবছি।’

‘কী কথা?’

‘ফ্ল্যাটটা বেচে বাগুইহাটি ফিরে যাব।’

‘গরমের জন্য ফ্ল্যাটটা বেচে দেবে!’

‘না, শুধু গরমের জন্য নয়, অন্য কারণ আছে।’

‘অন্য কারণ! কী কারণ?’

‘এদের সঙ্গে থাকাটাই অসম্ভব। রোজ মুখ দেখা ইমপসিবল।’

যূথিকা ঘাড় ঘুরিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে হাসল। উঠে পড়ল। জানলার কাছে গিয়ে পাল্লা খুলে দিল। রাতের আকাশে বিরাট চাঁদ। এক ঝলক রুপোলি আলো ঘরে ঢুকল। পৃর্ণিমার বুঝি দেরি নেই।

যূথিকা নিজের মনেই বলল, ‘অপূর্ব।’

চন্দন উঠে বসল। যূথিকা তা হলে রাজি। সে বলল, ‘তুমি তা হলে রাজি তো? ফ্ল্যাটটা বেচে দেব?’

যূথিকা মাথা না ঘুরিয়ে বলল, ‘এসো, এসে একবার দ্যাখে কেমন চমৎকার চাঁদ উঠেছে।’

চন্দন বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এ আর এমন কী? চাঁদ তো রোজই ওঠে।’

যূথিকা কাছে ঘেঁষে চন্দনের হাত ধরল। গাঢ় স্বরে বলল, ‘অ্যাই, চলো না ছাদে যাই। যারে গো?’

‘ছাদে! তুমি কি পাগল হলে? এত রাতে ছাদে!’

‘প্লিজ চলো। একটু চাঁদের আলোয় থেকেই দেখে চলে আসব। এটাই দারুণ সময়, কেউ কোথায় নেই। চুপি চুপি চালো। প্লিজ।’

অনিচ্ছা নিয়েই চন্দন উঠে দাঁড়ায়। পাঞ্জাবি গলাতে গলাতে ভাবে, ফ্ল্যাট বিক্রি করতে হলে যূথিকার কিছু আবদার শুনতে হবে। ইচ্ছে না থাকলেও।

ছাদে গিয়ে দু’জনেই অবাক।

বাপ রে, কে নেই? অমুল্য, প্রতুল, প্রভাস, অজয়, দিব্যেন্দু সকলেই! ওদের বউরাও এসেছে। দিব্যেন্দু বিয়ে করেনি, ফলে ও বউ আনতে পারেনি, সে এনেছে একটা মাধুর। কেউ কেউ তাতে বসেও আছে যে! |

প্রভাস হেসে বলল, ‘আসুন আসুন বউদি, এসো চন্দনদা। আজ রাত জেগে চাঁদ দেখা হবে।’

যূথিকা অভিমানহত গলায় বলল, ‘বাঃ, আপনারা নিজেরা চলে এলেন, আমাদের একবার ডাকলেন না।’

অজয় গম্ভীরভাবে বলল, ‘আসলে আজ একটা পরীক্ষা হচ্ছে। পরীক্ষার নাম চাঁদ পরীক্ষা। চাঁদ দেখতে কে কে বিছানা ছেড়ে ছাদে উঠে আসে সেটাই আজ দেখা হচ্ছে। যাক বাবা, একসাথে আবাসনের সকলেই এই পরীক্ষায় পাশ করে গেছে। বোঝা যাচ্ছে, সত্যি সত্যি আমরা একসাথে থাকতে পারব। বড় দুশ্চিন্তায় ছিলাম।’

অজন্তা ছাদের এক কোণে দেয়ালে কনুই রেখে দাঁড়িয়ে ছিল। বলল, ‘প্লিজ, আপনারা সবাই একটু চুপ করবেন? এত কথা বললে জ্যোৎস্না এনজয় করা যায় না।’

সবাই চুপ করল, শুধু তপতী ছড়া।

তপতী খুব নিচু গলায় গান ধরেছে…শুক্ল রাতে চাঁদের তরণী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *