চাঁদের অমাবস্যা – ৯

নয় 

রবিবার সকাল। বেলা ন’টার দিকে যুবক শিক্ষককে আসতে বলে দাদাসাহেব নিচের তলার বারান্দায় খোলা জানালার পাশে রোদে পিঠ দিয়ে বসেন। হাতে তসবি, মুখভাব গম্ভীর। একটু পরে পায়ের মৃদু শব্দ শুনতে পেলে সেদিকে না তাকিয়ে বলেন, ‘বসেন।’ 

অদূরে হাতল ছাড়া কাঠের চেয়ারে সঙ্কুচিত হয়ে যুবক শিক্ষক বসে, মনে অস্বচ্ছন্দতা। কেন তিনি ডেকে পাঠিয়েছেন? গত ক’দিনে শিক্ষকতার ব্যাপারে তার কোনো গাফিলতি হয়েছে কি? বা তার বিসদৃশ আচরণ-ব্যবহারের খবর তাঁর কাছে পৌঁছেছে কি? এসব ব্যাপারে তিনি যদি প্রশ্ন করেন তবে সে কী বলবে? সকালবেলা কাদেরের মুখে সত্য কথাটি জানবার পর একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে তার দেরি হয় নাই। কিন্তু পরে আরেকটি কথা সে বুঝতে পারে। সে-কথাটি ভেবে দেখা দরকার। না, গত ক’দিনের কথা দাদাসাহেবকে বলবার জন্যে এখনো সে তৈরি নয়। 

অবশেষে দাদাসাহেব গলা সাফ করেন। তারপর অস্পষ্টকণ্ঠে যুবক শিক্ষককে তার বাড়ির খবর জিজ্ঞাসা করেন। শ্রদ্ধাভরে সেও একটি উপযুক্ত উত্তর দেয়। 

সামান্য নীরবতার পর দাদাসাহেব পুনর্বার গলা সাফ করেন। তারপর তসবিতে তাঁর আঙ্গুল সঞ্চালন থেমে যায়। 

‘আমার ছোটভাই কাদের মিঞার সঙ্গে আপনার নাকি দেখাসাক্ষাৎ হয়। শুনে বড়ই খুশি হলাম।’ 

তিনি বলেন না যে আজ সকালে ওপরের জানালা দিয়ে কাদেরকে যুবক শিক্ষকের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে স্বচক্ষে দেখেছেন। কাদেরকে কেমন রাগান্বিত মনে হয়েছিল। দু-জনের মধ্যে অকস্মাৎ এই মেলামেশার কারণ কী, যুবক শিক্ষকের ঘর থেকে এমন রাগান্বিতভাবে সে বেরিয়ে আসবেই-বা কেন? ক’দিন আগে কাদেরের বিচিত্র দৃষ্টির কথা এখনো তিনি ভোলেন নাই। 

গভীর বিশ্বাস-ভরা কণ্ঠে—যে কণ্ঠ সম্পূর্ণ খাঁটি মনে হয় না, তিনি আবার বলেন, ‘তার ভাবসাব সাধারণ মানুষের মতো নয়।’ সামান্য ইতস্তত করে কথাটা বলেই ফেলেন। ‘একটু দরবেশী ভাব আছে তার মধ্যে।’ 

যুবক শিক্ষক নত মাথায় তাঁর কথা শোনে, কিন্তু কিছু বলে না। কাদেরের বিষয়েই তিনি যে তাকে ডেকে পাঠাবেন, সে-কথা সে ভাবে নাই। হয়তো এখন সে তার সম্বন্ধে কিছু বলতে প্রস্তুত নয় বলেই সে-কথাটি ভাবতে পারে নাই। না, এই মুহূর্তে কিছু বলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। বাঁশঝাড়ের সত্যটি সে জানতে পেরেছে বটে কিন্তু সে সত্যটি যেন অতিশয় নগ্ন। বস্তুত, তা এত নগ্ন যে তাতে না আছে সম্পূর্ণ সত্য, না আছে তার প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর। সব কথা জানার আগে তার পক্ষে কিছুই বলা সম্ভব নয়। 

দাদাসাহেবকে একটু অপ্রস্তুত মনে হয়। তাঁর পক্ষেও কাদেরের কথা তোলা সহজ হয় নাই। তিনি বড়বাড়ির মুরুব্বি। বয়স বা আত্মীয়তার ধরন যাই হোক, সে-বাড়ির প্রত্যেক বাসিন্দার প্রতি তিনি যে শুধু একটি গভীর দায়িত্ব বোধ করেন তা নয়, তাদের সঙ্গে একটা আন্তরিক যোগাযোগও বোধ করেন। কোথায় কার দোষত্রুটি, কোথায় কার গুণ বা গুণের সম্ভাবনা, সে-সব তাঁর অজ্ঞাত নয়। এমনকি প্রত্যেকের হৃদয়ের কথাও তিনি জানেন বলে তাঁর বিশ্বাস। এ-বিষয়ে কেবল কাদেরের ক্ষেত্রেই একটা ব্যতিক্রম বোধ করেন। সে জন্যে এবং তার সম্বন্ধে তাঁর চিন্তার শেষ নাই বলে অনাত্মীয়ের সামনে তার কথা তোলা তাঁর পক্ষে সহজ নয়। 

যুবক শিক্ষক নীরব হয়ে থাকলে তিনি এবার অনিশ্চিতকণ্ঠে প্রশ্ন করেন, ‘আপনাদের মধ্যে কী আলাপ হয়?’ 

যুবক শিক্ষক ক্ষিপ্রদৃষ্টিতে দাদাসাহেবের দিকে একবার তাকায়। বর্তমান মানসিক অবস্থার জন্যে প্রশ্নটি সরলভাবে গ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। কাদের যে দরবেশ সে-বিশ্বাসটি তাঁর মনে কি এতই দৃঢ় হয়ে উঠেছে যে তিনি তার প্রমাণের জন্যে এমন উদগ্রীব হয়ে পড়েছেন, না তার সম্বন্ধে তাঁর মনে কোনো প্রকার সন্দেহ উপস্থিত হয়েছে? 

কারণ যা-ই হোক, তাঁর প্রশ্নের উত্তর দেয়া তার পক্ষে এখন সত্যিই সম্ভব নয়। তার মনে সন্দেহ নাই, শীঘ্র তাঁকে বাঁশঝাড়ের ঘটনাটি বলতে হবে, কিন্তু যে-নগ্ন সত্যটি আজ সকালে সে জানতে পেরেছে, তাতে সে তৃপ্ত নয়। যে-ঘটনাটি তার মনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল, নিঃসন্দেহে সে ঘটনাটির রহস্য ঘুচেছে : নানাপ্রকার কল্পনা-অনুমানের জটিল জাল থেকে মুক্তি পেয়ে তা একটি স্পষ্টরূপ ধারণ করেছে। তবু কাদেরের মুখে যা জানতে পেরেছে, তা একটু ভেবে দেখতেই তার মনে এ ধারণা জন্মে যে, এখনো সব কথা জানা হয় নাই। বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে জানার পূর্বে দাদাসাহেবকে এমন একটি নিদারুণ কথা কী করে বলে? 

আজ সকালে কাদের স্বীকার করেছে, সে-ই যুবতী নারীর হত্যাকারী। তবে সেটি ঠিক হত্যা নয়, একটি দুর্ঘটনা। বাঁশঝাড়ের বাইরে যুবক শিক্ষকের পদধ্বনি এবং পরে তার গলার শব্দ শুনতে পেলে হঠাৎ ভয়ে দিশেহারা হয়ে সে যুবতী নারীর গলা টিপে ধরেছিল। হত্যার উদ্দেশ্যে নয়, তার মুখের আওয়াজ বন্ধ করার জন্যে। মুখ না ঢেকে গলা টিপে ধরেছিল কেন সে তা বলতে পারে না : তখন তার জ্ঞান-বুদ্ধি ছিল না। আসল অপরাধী সে সংজ্ঞাবুদ্ধিগ্রাসী মারাত্মক ভয়। সে-নিদারুণ ভয়ের কারণ কী? তার পরিবারের সুনাম। এককালে যে-পরিবারের এত নামডাক ছিল, সে পরিবারের আজ আগের মতো ধন-দৌলত না থাকলেও ধার্মিকতা দান-দয়া-নিষ্ঠার জন্যে এখনো অনেক সুনাম। কাদের সে পরিবারেরই মানুষ। যে-পরিবার নিষ্কলঙ্কভাবে দীর্ঘদিন সুনামের সৌরভ ছড়িয়েছে, তার সে-সুনামে কলঙ্কের ছাপ বসাতে কার বুকে সাহস হয়? কথাটা অবিশ্বাস্য ঠেকে না। 

কাদের যখন বুঝতে পারে একটি ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, তখন সে বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু অল্পদূর যাবার পর তার মনে একটা সন্দেহ জাগে : সত্যই কি কোনো মানুষের শব্দ সে শুনেছিল? শীতের এমন গভীর রাতে কে আসবে বাঁশঝাড়ে? যুবতী নারীর স্বামীর কথাই কেবল তার মনে আসে কিন্তু সে যে গ্রামে নাই সে-বিষয়ে সে নিশ্চিত। সে কি ভুলবশত এমন মর্মান্তিক কাণ্ড করে বসেছে? 

কথাটা পরখ করে দেখবার জন্যে নির্বোধের মতো সে বাঁশঝাড়ের সামনে এবার ফিরে আসে। পরিস্ফুট চন্দ্রালোকে এধার-ওধার চেয়ে দেখে, কেউ কোথাও নাই। এমন সময় সে যুবক শিক্ষককে বাঁশঝাড় থেকে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে আসতে দেখে। সে যেন তারই দিকে তাকিয়ে। শুধু তাই নয়। সে তারই দিকে আসছে। পালাবার কোনো সময় নাই, মুক্তস্থানে গা-ঢাকা দেবারও কোনো উপায় নাই। কাঠের পুতুলের মতো হতভম্ব হয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে। সেখানে তার উপস্থিতির একটা কৈফিয়ৎ বের করার চেষ্টাও করে কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য কোনো কৈফিয়ৎ খুঁজে পায় না। তারপর যুবক শিক্ষক তার সামনে এসে দাঁড়ায় কিন্তু সে কোনো প্রশ্নই করে না। কয়েক মুহূর্ত তার দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ সে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে পালিয়ে যায়। সে যেন ভূত দেখেছে। 

এবার কাদের দুটি কথা বুঝতে পারে। প্রথমত, যুবতী নারী যে এখনো বেঁচে থাকতে পারে সে-কথা আশা করা বৃথা। দ্বিতীয়ত, সে-ই যে হত্যাকারী সে কথা যুবক শিক্ষক জানে। বস্তুত, তাকে উদ্ভ্রান্তের মতো মাঠে-ঘাটে ছুটাছুটি করতে দেখলে সে বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না। তবু কথাটা সামনাসামনি একবার যাচাই করে দেখবার জন্যে পরে সে তারই ঘরে এসে উপস্থিত হয়। সেখানে সে একটি অতি ভীত-বিহ্বল, বাকশূন্য মানুষ দেখতে পায়। সন্দেহের কোনোই অবকাশ থাকে না। 

এ-বিবৃতিতে অবিশ্বাস্য কিছুই নাই : নিঃসন্দেহে তার প্রতিটি শব্দ সত্য। প্রথম রাতের বিবরণটি এতই নিখুঁত যে তাতে কোনো ছিদ্র নাই, প্রশ্ন-জেরার স্থান নাই। অস্পষ্টতা দেখা দেয় দ্বিতীয় রাতের বিবরণে। 

যুবতী নারীর দেহটি নদীতে ফেলার ব্যাপারে কাদের যুবক শিক্ষকের সাহায্যপ্রার্থী হয়েছিল কেন? কথাটির কোনো ব্যাখ্যা কাদের দেয় নাই। তখন প্রশ্ন করার কোনো প্ৰয়োজন বোধ করে নাই বলে যুবক শিক্ষকও তাকে সে-বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করে নাই। এখন বিষয়টির ব্যাখ্যা শিক্ষকের কাছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মনে হয়। চারটি সম্ভাব্য উত্তর তার দৃষ্টিগোচর হয়। এক—বাঁশঝাড়ের ঘটনার পর কাদেরের মনে নিশ্চয়ই গভীর বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। হয়তো একটি ঘোরতর পাপ বোধে সে জর্জরিত হয়ে পড়ে। তখন একটি বিচিত্র যুক্তির সাহায্যে সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, যুবক শিক্ষক মৃতদেহটির বহনকার্যে অংশগ্রহণ করলে সে-পাপের খানিকটা তার মধ্যে স্থানান্তরিত হবে। দুই—তার এই বিশ্বাস হয় যে, যুবতী নারীর মৃত্যুর সঙ্গে যুবক শিক্ষক জড়িত, কারণ বাঁশঝাড়ে সে উপস্থিত না হলে দুর্ঘটনাটি ঘটত না। অতএব দেহ বহনকার্যে সাহায্য করা তার কর্তব্য। তিন— যুবতী নারীর মৃত্যুর কথা যুবক শিক্ষক ছাড়া অন্য কেউ জানে না। পরদিন সে কথাটা প্রকাশ করে নাই সত্য কিন্তু ভবিষ্যতে করবে না সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। দেহটির বহনকার্যে তার কাছ থেকে একবার সাহায্য আদায় করতে পারলে তার মুখ বন্ধ করা সহজ হবে। দুর্বলচিত্ত লোকটি সাহায্য করতে রাজি না হতে পারে, সে-সম্ভাবনা নিশ্চয়ই কাদেরের মনে জেগেছে। হয়তো সে-ব্যাপারে তাকে বাধ্য করার ফিকির-ফন্দিও সে ভেবে নিয়েছিল। হয়তো তাকে ভয় দেখাত বা কোনো প্রকারে তার হৃদয় গলাবার ব্যবস্থা করত। কিন্তু কাদেরকে কিছুই করতে হয় নাই। দু-একবার ডাকতেই সে বিনাবাক্যে তার অনুসরণ করে। চার—ভয়াবহ কাজটি একা করতে সাহস পায় নাই। কাজটি একাকী সম্পন্ন করার লাভ নিশ্চয়ই তার চোখে পড়েছে। যুবক শিক্ষকের অগোচরে দেহটি একবার অদৃশ্য হয়ে গেলে সে কোনো অভিযোগ আনলেও সাক্ষীর অভাবে তা প্রমাণ করতে পারবে না। কিন্তু নির্জন রাতে বাঁশঝাড়ে একটি যুবতী নারীর সঙ্গে মিলিত হওয়া এক কথা, গভীর রাতে তার মৃতদেহটি বহন করা অন্য কথা। সে স্বভাবজাত খুনী-ডাকাত নয়। 

ভীতি, স্বার্থপরতা, দুরভিসন্ধি ইত্যাদি বিভিন্ন উদ্দেশ্য-অনুপ্রাণিত এর কোনটি সত্য? 

আরেকটি কথাও কুজ্‌ঝটিকাবৃত মনে হয়। কী কারণে কাদের দেহটি নদীতে ফেলবে ঠিক করে? আজ সকালে সে-বিষয়টি সে স্পর্শই করে নাই। 

হত্যাকাণ্ডের জের টানা বিপজ্জনক। দেহটি নিশ্চিহ্ন করার প্রয়োজনটা কি তার কাছে এতই জরুরি মনে হয়েছে যে সে দ্বিতীয় রাতে বিপজ্জনক কাজটি করতে দ্বিধা করে নাই? হয়তো পাপের ফল সম্পূর্ণভাবে অদৃশ্য না হয়ে-যাওয়া পর্যন্ত পাপী মনে শান্তি পায় না। এ- কথা যদি সত্যি হয় তবে কাদেরের চোখে যে-ব্যাপার একটি দুর্ঘটনা হিসেবে শুরু হয়েছিল, সেটি আর দুর্ঘটনা থাকে নাই, শীঘ্রই তা পাপে পরিণত হয়। 

আজ সকালে ঘটনাটির নির্মম সত্য জানার পর যুবক শিক্ষকের মনে হয়েছিল : আর কোনো কথা জানার প্রয়োজন নাই। কিন্তু দেখতে-না-দেখতে নূতন অনেক প্রশ্ন তার মনে এসে উপস্থিত হয়েছে। কাদেরের গুরুতর অপরাধের কথা প্রকাশ করা তার কর্তব্য। কিন্তু কর্তব্যটির সঙ্গে একটি গভীর দায়িত্ব জড়িত মনে হয়। অপরাধটি প্রকাশ করা অতি সহজ কিন্তু সব কথা না জেনে কী করে সে তা প্রকাশ করে? তার মনে হয়, অপরাধের গুরুত্ব অপরাধের ফলের উপরই নির্ভর করে না। একটি যুবতী নারীর খুন অতি গুরুতর ব্যাপার। তারই ওজনে অপরাধ মেপে দেখা স্বাভাবিক। কিন্তু দুটির ওজন সমান না-ও হতে পারে। সব কিছু না বুঝে কথাটা প্রকাশ করলে কর্তব্যপালন হবে কিন্তু তাতে দায়িত্বহীনতাও প্রকাশ পেতে পারে। 

তাছাড়া, সর্বপ্রথম তাকে ঘটনাটি পুরাপুরিভাবে বুঝতে হবে। সামাজিক কর্তব্যপালনের চেয়ে সেটাই তার কাছে বড় মনে হয়। অপরাধী কে সে কথা সে জানতে পেরেছে, কিন্তু অপরাধের অর্থ এখনো সে বোঝে নাই। 

যুবক শিক্ষককে চুপ করে থাকতে দেখে দাদাসাহেব কিছু বিস্মিত হন। তাঁর মনে হয়, দরবেশীর কথাটা তুলে তিনি ভুল করছেন। যুবক শিক্ষক হয়তো সে-কথা বিশ্বাস করে না বলে কী উত্তর দেবে তা ভেবে উঠতে পারছে না। সে-বিষয়ে তাকে নিশ্চিত করার জন্যে এবার তিনি বলেন, ‘কাদের একা একা থাকে। আপনার সঙ্গে মেলামেশা করতে শুরু করেছে দেখে মনটা খুশি হয়েছে।’ তাদের মধ্যে কী আলাপ-আলোচনা হয় সে বিষয়ে তাঁর ঔৎসুক্যের কথা তিনি এবার উল্লেখ করেন না। একবার বলেছেন, দু-বার বলতে পারেন না। তারপর তাঁর মুখে একটি কৌতূহলশূন্যতার ভাব জাগে। সেটা কৃত্রিম মনে হয়। 

হঠাৎ যুবক শিক্ষক মাথা তুলে বেদনার্ত দৃষ্টিতে দাদাসাহেবের দিকে তাকায়। তার সঙ্গে চোখাচোখি হলে সে ইতস্তত করে দৃষ্টি নাবিয়ে অস্ফুট গলায় বলে, ‘বেআদবি মাফ করবেন কিন্তু আজ কিছু বলতে পারব না।’ 

দাদাসাহেব এবার তাঁর বিস্ময় ঢাকবার চেষ্টা করেন না। তার উক্তিটা বুঝবার চেষ্টা করে গম্ভীরকণ্ঠে প্রশ্ন করেন, ‘কী কথা বলতে পারেন না?’ 

যুবক শিক্ষক চোখ না তুলে কয়েকবার কেবল ঘন-ঘনভাবে মাথা নাড়ে। দাদাসাহেবের দিকে তাকাতে বা তাঁকে আর কিছু বলতে তার সাহস হয় না। নিজের দৃষ্টিতে এবং কণ্ঠে সে- বিশ্বাস যেন হারিয়েছে। তার মনে হয়, আজ কিছু বলতে পারবে না এ-কথা বলেই সে ইতিমধ্যে অনেক কথা বলে ফেলেছে। 

দাদাসাহেব আর কিছু বলেন না। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বারান্দা অতিক্রম করতে শুরু করেন। তাঁর খড়মের আওয়াজ আজ কেমন বেসুরো মনে হয়। 

শঙ্কিত হয়ে যুবক শিক্ষক বোঝে, তার হাতে সময় আর বেশি নাই। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *