চাঁদের অমাবস্যা – ৪

চার 

দু’বছর ধরে বড়বাড়ির বাইরের ঘরে বসবাস, তবু কাদেরের সঙ্গে মুখামুখি হবার সুযোগ কমই হয়েছে। মুখামুখি হলেও কথালাপ হয় নাই। তবু তার সম্বন্ধে যুবক শিক্ষক কখনো কখনো গভীর কৌতূহল বোধ করেছে। হয়তো তার সম্বন্ধে দাদাসাহেবের খেয়ালটির কোনো ভিত্তি নাই, তবু দরবেশী ব্যাপারে কে নিশ্চিত হতে পারে? 

আজ রাতে যুবক শিক্ষক শান্তচিত্তে তাকে ভালো করে চেয়ে দেখে। খাটো মানুষ, কিন্তু বংশজাত চওড়া হাড়। কালো রং, চেহারার গঠন ধারালো। তবে তার চেহারায় দুটি জিনিস শীঘ্র চোখে পড়ে। প্রথমত, তার অর্ধ-নিমীলিত চোখ। সে যেন নিদ্রা-জাগরণের মধ্যে কোথাও সর্বদা বিরাজ করে। নিদ্রাবিষ্ট চোখের প্রভাব তার সারা মুখেও বিস্তারিত। দ্বিতীয়ত, তার মাথায় চুলের বাহার। তেল-চকচকে মাথায় সযত্নে সিঁথি কাটা, একটি চুলও অস্থানে নাই। তার অর্ধঘুমন্ত মুখে সে চুলের বাহার কেমন বেমানান মনে হয়। 

কাদের মশারি সরিয়ে যুবক শিক্ষকের বিছানার একপ্রান্তে বসে। তার অর্ধ-নিমীলিত ছোট টেবিলে স্থাপিত লণ্ঠনের ওপর নিবদ্ধ। কেমন মনে হয়, যুবক শিক্ষকের এ-সূক্ষ্ম পরীক্ষা সম্বন্ধে সে সচেতন এবং এ-পরীক্ষায় তার আপত্তি নাই। বরঞ্চ স্ব-ইচ্ছায়ই যেন সে তার পরীক্ষাধীন হয়েছে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে যুবক শিক্ষকের ভয় হয়, কানে আবার ঝাঁঝ ধরবে বুঝি। ভাগ্যবশত, কাদের এমন সময় একটু নড়ে ওঠে। হয়তো সে বুঝতে পারে, পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আলগোছে সে এধার-ওধার তাকায়। টেবিলের ওপর দু-একটা বইয়ের ওপর তার নজর পড়ে। কিন্তু ক্ষণকালের জন্য। অবশেষে লণ্ঠনের ওপরই তার দৃষ্টি ফিরে আসে। 

শীঘ্র যুবক শিক্ষক অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করে। একই বাড়িতে দু-বছর বসবাস করে যার সঙ্গে কখনো কথালাপ হয় নাই এবং যার সঙ্গে গত রাতে অতি বিচিত্র অবস্থার মধ্যে সাক্ষাৎ হয়েছিল, গভীর রাতে তার এ আগমন এবং আগমনের পরেও তার গভীর নির্বাকতা বেশিক্ষণ স্বচ্ছন্দচিত্তে গ্রহণ করা মুশকিল। কী জন্যে সে এসেছে? তার সম্বন্ধে যুবক শিক্ষকের মনে যে একটি অদ্ভুত সন্দেহ জেগেছিল, সে সন্দেহটি দূর করতে এসেছে কি? তার সন্দেহটি কাদেরকে হয়তো সারাদিন পীড়া দিয়েছে। 

একটা অস্পষ্ট সহানুভূতিতে যুবক শিক্ষকের মন আর্দ্র হয়ে ওঠে। কিন্তু নীরব লোকটিকে কী বলবে বুঝে পায় না। মনে সন্দেহটা কেটেছে বলে কথাটা ভাবতেই মনে লজ্জা আসে। তার পক্ষে সে কথা তোলা সহজ নয়। 

অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করে কাদের কিছু বলে ওঠে। যুবক শিক্ষক তার কথাটা ঠিক ধরতে পারে না। কেবল কাদের কথা বলেছে বলে একটা স্বস্তির ভাব বোধ করে। নম্রকণ্ঠে সে প্রশ্ন করে, ‘কী বললেন?’ 

কাদেরের দৃষ্টি পূর্ববৎ লণ্ঠনের ওপর নিবদ্ধ। একটু চুপ থেকে সে কেমন খনখনে গলায় বলে, ‘তোতারী কিংখাবের কথা বলছিলাম।’ 

আরেকটি বিসদৃশ জিনিস : খনখনে গলা। মুখের সঙ্গে মানায় না! 

‘তোতারী কিংখাব?’ 

‘শোনেন নাই?’ 

গলা আরো নম্র করে যুবক শিক্ষক উত্তর দেয়, ‘না।’ 

‘পুরোনো আমলের জিনিস। সিন্দুকে তালাবন্ধ থাকে।’

যুবক শিক্ষক বোঝে, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কোনো মূল্যবান বস্তুর কথা কাদের বলছে, কিন্তু সে কথার আকস্মিক উত্থাপনের অর্থ সে বোঝে না। হঠাৎ তার সন্দেহ হয়, গত রাতের ঘটনা বা তার প্রতি যুবক শিক্ষকের যে সন্দেহ জেগেছিল, সে ঘটনা বা সে-সন্দেহ তার আগমনের কারণ নয়। তাদের বংশের তোতারী কিংখাবের কথাও যে তাকে বলতে এসেছে, তা নয়। কাদের নিঃসঙ্গ মানুষ। গত রাতে বিচিত্র অবস্থার মধ্যে তাদের সাক্ষাৎ হলে হঠাৎ সে কি তার প্রতি একটা বন্ধুত্ব-ভাব বোধ করতে শুরু করেছে? 

‘দামি জিনিস হবে।’ অবশেষে যুবক শিক্ষক উত্তর দেয়। সে যে তোস্তারী কিংখাবের মূল্য বুঝতে পেরেছে সে-কথা কাদের উপলব্ধি করেছে কিনা তাই দেখবার জন্যে তার দিকে একবার তাকায়। কাদের তার দৃষ্টি লক্ষ করে না। কয়েক মুহূর্ত নির্বাক থাকার পর যুবক শিক্ষক ভাবে তাকে প্রশ্ন করবে তোস্তারী কিংখাব আসলে কী জিনিস, এমন সময় কাদের হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। একটু ইতস্তত করে অবশেষে খনখনে গলায় বলে, ‘চলেন যাই।’ 

যুবক শিক্ষক সহসা কোনো উত্তর দিতে সক্ষম হয় না। শেষে শুষ্ককণ্ঠে প্রশ্ন করে, ‘কোথায়?’ 

‘এখনো বাঁশঝাড়ে পড়ে আছে। কেউ খবর পায় নাই।’ 

কথাটি এমন সাধারণ শোনায় যেন তা যুবক শিক্ষকের মনে তৎক্ষণাৎ কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে না। তারপর হঠাৎ কাদেরের কথার মর্মোদ্ধার করার আগেই যেন একটা দুর্বোধ্য স্রোত প্রবলবেগে এসে তাকে স্থানচ্যুত করে। দুপুরবেলা থেকে তার মনে দুনিয়াটা স্বাভাবিক রূপ ধারণ করেছিল। মধ্যরাতে তার ঘরে কাদেরের উপস্থিতিও সে যে শুধু স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছিল তা নয়, তাদের কেমন বন্ধুত্বের আভাস পেয়ে তার মন উষ্ণ হয়ে উঠেছিল। কাদেরের প্রস্তাবে এবার সব ধূলিসাৎ হয়ে যায়। না, সে কিছুই বুঝতে পারছে না। 

যুবক শিক্ষকের উত্তর দিতে দেরি হচ্ছে দেখে কাদের আবার বলে, ‘বাঁশঝাড়ে জন্তু-জানোয়ার আসে।’

যুবক শিক্ষক তখন লণ্ঠনের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে। এবারও সে কোনো উত্তর দিতে সক্ষম হয় না। সে কী উত্তর দেবে? মনটা তার কেমন ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। কী একটা কথা ধরবার চেষ্টা করে বলে সারা মনে প্রচণ্ড আলোড়ন হয় কিন্তু কথাটি শুধু কাদায় নয়, লতাপাতা-আগাছায়ও জড়িয়ে আছে। 

‘চলেন।’ আরেকটু অপেক্ষা করে কাদের আবার বলে। চলার ভঙ্গি করে বলে তার জুতায় একটু শব্দ হয়। 

যুবক শিক্ষক বুঝতে পারে, তার পক্ষে চুপচাপ বসে থাকা সম্ভব নয়। কাদেরের প্রস্তাবটি বুঝতে না পারলেও সেটিকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা তার নাই। সত্যাসত্য, সাধারণ-অসাধারণ, উচিত-অনুচিত বিচার করাও যেন আর সম্ভব নয়। মনের কথাটি উদ্ধার করবার চেষ্টায় শুধু শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, শরীরে কোথাও কাঁপনও ধরেছে। 

তবু সাহসের জন্যেই যেন বিহ্বল দৃষ্টিতে কাদেরের দিকে তাকায়। তার মুখের পাশটা কেবল দেখতে পায়। কপালটা খাড়া, কিন্তু অর্ধ-নিমীলিত চোখে বেদনার আভাস। তার মুখে ভীতিজনক কোনো ছায়া তো নাই-ই বরঞ্চ তাতে অতি নিরীহ, এমনকি একটু অসহায় ভাবও। বিস্মিত হয়ে সে কতক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকে। 

অকস্মাৎ যুবক শিক্ষক যন্ত্রচালিতের মতো উঠে দাঁড়ায়। ঘরের কোণে খড়ম ছেড়ে পাম্প-সু পরে, টেবিলের ওপর লণ্ঠনটা নিভিয়ে দেয়। কাদের তখন খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। বাইরে উজ্জ্বল চন্দ্রালোকের জন্যে চৌকাঠের মধ্যে তার শরীরের ছায়া জেগে উঠেছে। মুহূর্তের মধ্যে সে যেন অন্য মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে। যুবক শিক্ষক কিন্তু তার দিকে আর স্পষ্টভাবে তাকায় না। 

সন্ধ্যার পর ঝড়-বৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু এখন চাঁদ আর ছিটেফোঁটা কয়েকটা তারা ছাড়া সম্পূর্ণ আকাশ শূন্য। স্থানে স্থানে মাটি ভেজা, গাছের সিক্ত পাতায় আলোর ঝলকানি। যুবক শিক্ষক কোনো দিকে তাকাবার প্রয়োজনও বোধ করে না। চতুর্দিকে অন্ধকার দেয়াল, যে-দেয়ালের জন্যে বাস্তব জগতের সঙ্গে হঠাৎ তার সমস্ত সংযোগ ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অন্যান্য দিনের মতো সে আজও সুপরিচিত পথে চলেছে কিন্তু যে-অবাস্তব জগতে সে প্রবেশ করেছে সে-জগতের সঙ্গে সত্যিকার পারিপার্শ্বিকতার কোনো সম্বন্ধ নাই। তার পরিচিত জগৎ সে যে আর দেখতে পায় না তাতে তার দুঃখ হয় না, বরঞ্চ তাতে সে স্বস্তিই পায়। তবে এমন স্বচ্ছন্দতার সঙ্গে সে-জগৎ পরিত্যাগ করতে পেরেছে বলে মনে একটু বিস্ময় হয়। যে-দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীরবেষ্টিত জগতের মধ্যে মানুষ আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, তার আলিঙ্গন থেকে এত সহজেই যে মুক্তিলাভ করা সম্ভব সে-কথা সে জানত না। চোখের পলকেই সে তার সীমানা অতিক্রম করেছে। এ-নূতন জ্ঞান শীঘ্র তার মনে একটা বিচিত্র নেশার সৃষ্টি করে। ক্ষণকালের জন্যে তার হৃদয়ে কম্পন উপস্থিত হয়। ভয়ে নয়, কেমন একটা উত্তেজনায়। বাঁশঝাড়ে মৃতদেহের কাছে নয়, সে যেন অভিসারে চলেছে। 

খানিকটা পথ গিয়ে তারা লাঙ্গল-দেয়া ক্ষেতের পাশে আইল পথ ধরে। পাশে ছোট সেচনী-নালা। একটু দূরে রাতে পরিত্যক্ত সেঁউতি নজরে পড়ে। মনে হয়, একটি মানুষ হাত বাড়িয়ে উবু হয়ে বসে আছে। সেদিকে একবার দৃষ্টি দিয়ে কাদের আস্তে বলে, ‘সেকালে তোতারী কিংখাব বড় মশহুর ছিল।’ 

পাশে ক্ষুদ্র নালায় স্বচ্ছ আকাশের প্রতিবিম্ব। নিঃশব্দ রাতে তাদের দু-জনের পায়ের শব্দ। তারা দ্রুতপায়ে চলে। একটু পরে কাদেরের উক্তিটা যুবক শিক্ষকের কানে পৌঁছায়। উক্তিটি অর্থহীন মনে হয়, তবু তাতে সে বিস্ময় বোধ না করে বরঞ্চ স্বস্তিই বোধ করে। অবাস্তব জগতে প্রবেশ করেও বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্বন্ধ যে একেবারে ছিন্ন হয় নাই, কোথাও যে দুটির মধ্যে একটি অদৃশ্য বন্ধন আছে, উক্তিটি সে-কথাটাই যেন ঘোষণা করে। তাই মনে স্বস্তি আসে। অবাস্তব জগৎও নেহাত স্বাভাবিক। তাতে কিছু অসাধারণত্ব নাই। দুটি যেন একই মুদ্রার এপাশ-ওপাশ। 

সে-বিষয়ে আশ্বস্ত হলে একটু আগে যে-নেশা এসেছিল সে নেশা কাটে। পরক্ষণেই তার মনে একটি প্রশ্ন আসে, কোথায় যাচ্ছে সে? উত্তরের জন্যে সে কাদেরের দিকে চোরা- দৃষ্টিতে একবার তাকায়। অভ্যাসবশত বাঁ-হাত স্থির রেখে ডান-হাত সজোরে দুলিয়ে তার সঙ্গী পূর্ববৎ দ্রুতপায়ে হাঁটে, দৃষ্টি সামনের পথে নিবদ্ধ। সে জানে কোথায় সে যাচ্ছে। 

শীঘ্র যুবক শিক্ষক নিঃসঙ্গ বোধ করতে শুরু করে। একটা নিদারুণ বেদনায় বার-বার ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। অকারণেই যেন কতগুলি অর্থহীন ঘরোয়া চিত্র তার মনের পর্দার ওপর দিয়ে ভেসে যায়। তার গ্রামের মুদির দোকানের ফেনি বাতাসা, ঘরের পেছনে শেওলা পড়া ছায়াচ্ছন্ন পুকুর, পড়শীর নূতন বেড়া। তার বর্তমান যাত্রার পরিণাম তার কাছে প্রত্যক্ষগোচর হয় না বলে হয়তো তার ভীত মন পশ্চাতের পরিচিত স্থানে খুঁটি গাড়তে চায়। অথবা যা সে পেছনে ফেলে যাচ্ছে তার মূল্য নিরূপণ করবার চেষ্টা করে। হয়তো এখনো ফিরবার সময় আছে। যা সে ফেলে যাচ্ছে তার সে মূল্য জানে না কিন্তু সেখানেই তার প্রত্যাবর্তন করা উচিত। জীবনের মূল্য কি কেউ কখনো সঠিকভাবে বুঝতে পারে? মানুষ সর্বদা, জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে, জীবনের মূল্য নিরূপণ করার চেষ্টা করে কিন্তু সক্ষম হয় কি? কী দিয়ে ওজন করে তুলনা করে? স্বর্ণকারের নিক্তিতেও তার মূল্য যাচাই করা যায় না। তার মূল্য নিরূপণের কোনো মানদণ্ড নাই। 

যুবক শিক্ষক কাদেরের দ্রুতগতিতে তাল দিয়ে চলে কিন্তু তার সঙ্গীর সাবলীলতা নাই তার পদক্ষেপে। কাদের জানে যাত্রার কারণ, সে জানে না। অর্ধ-নিমীলিত চোখেও কাদের সবকিছু দেখে, যা সে সম্পূর্ণ খোলা দৃষ্টিতেও দেখতে পায় না। কিন্তু দেখার কী আছে? না দেখাতেই নিরাপত্তা। শীঘ্র কল্পনায় সে শত-শত চোখ দেখে : হাটে-বাজারে, পথে-ঘাটে, ক্ষেত-খামারে। তার বিশ্বাস হয়, সবারই চোখ আছে কিন্তু কেউ কিছু দেখে না। সবাই তাই অতল গহ্বরের প্রান্তে দাঁড়িয়েও নিরাপদ বোধ করে। 

একটু পরে যুবক শিক্ষকের মনটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। চারধারে চাঁদের আলো ঝকঝক করে। না, সে দেখতে না পেলেও সামনে অতল গহ্বর নাই। পাশে কাদেরের নিঃশঙ্কচিত্ত ও সে যেন স্পর্শ করতে পারে। 

তবু শীতের রাতেও তার কপালে ঘামের আভাস দেখা দেয়। 

.

বাঁশঝাড়ে প্রবেশ করার আগে কাদের একবার থমকে দাঁড়ায়। শান্তভাবে এদিক-ওদিক তাকায়, পাশে যুবক শিক্ষক সম্বন্ধে সজ্ঞান বলে মনে হয় না। তারপর সে দৃঢ়পদে বাঁশঝাড়ের মধ্যে প্রবেশ করে। অপ্রশস্ত পথ, পাশাপাশি দুজন মানুষের পক্ষে চলা সম্ভব নয়। একটি মানুষের গায়েও আঁচড়-খোঁচা লাগে। যুবক শিক্ষকও কাদেরের মতো এধার-ওধার তাকায়, কিন্তু কেন তাকায় তা সে নিজেই জানে না। তারপর পায়ে কেমন জড়তা বোধ করলে সে দাঁড়িয়েই থাকে। অনতিদূরে নদী দেখা যায়। নদীর বুকে কুয়াশা। বাঁশঝাড়ে কাদেরের আওয়াজ শোনা যায় কিন্তু সেদিকে কান দেয় না। সে যে নদীর বুকে কুয়াশা দেখতে পায় তাতেই সে সন্তুষ্ট। উদ্দেশ্যহীনভাবে সে উরুর কাছে চুলকাতে শুরু করে এবং মনে হয় একবার হাই তুলবে। 

বাঁশঝাড় থেকে কাদেরের অনুচ্চকণ্ঠ শোনা যায়। 

‘কোথায় আপনি?’ 

যুবক শিক্ষক উত্তর দেয় না। উত্তর দেবার চেষ্টা করে বটে কিন্তু ভেতর থেকে উঠে এসেও উত্তরটা মাঝপথে কোথাও হারিয়ে যায়। তারপর কাদের আবার তাকে ডাকে। যুবক শিক্ষক কতক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকে? এবারও সে উত্তর দেয় না বটে কিন্তু ঝট্ করে বাঁশঝাড়ে ঢুকে পড়ে। সঙ্গে-সঙ্গে শরীরটা অবশ হয়ে ওঠে, চোখের সামনে নিবিড় অন্ধকারটিও আবার নাবে। আজও বাঁশঝাড়ে হাল্কা অন্ধকার, দেখতে চাইলে সব দেখা যায়, কিন্তু সে আর কিছুই দেখতে পায় না। একটি দুর্বোধ্য কিন্তু দুর্লঙ্ঘ্য আদেশে অন্ধের মতো সে এগিয়ে যায়। 

তারপর বাঁশঝাড়ে সে কাদেরকে সাহায্য করে, কিন্তু কিছু না দেখে কিছু না অনুভব করে। সময় দীর্ঘ ঢেউয়ের মতো ধীরে-ধীরে বয়ে যায়, চোখের অন্ধকার আরো নিবিড় কালো হয়, তার সমস্ত জ্ঞানেন্দ্রিয় শিল-পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে থাকে। সাবধানতা সত্ত্বেও বাঁশঝাড়ে নানাবিধ শব্দ হয়, প্রভূত বাধাবিপত্তির সৃষ্টি হয়। যুবক শিক্ষক সে-সব শব্দের বা বাধাবিপত্তির কারণ বোঝে না, বোঝার তাগিদও বোধ করে না। 

একবার কাদেরের কণ্ঠস্বর তার কর্ণগোচর হয়। অনুচ্চ কণ্ঠ, তবু সন্দেহ থাকে না যে যুবক শিক্ষককে সে তিরস্কার করে। 

‘শক্ত করে ধরেন না কেন?’ সে বলে। 

কী সে শক্ত করে ধরবে? তার হাতে দুই খণ্ড হিমশীতল কাঠ। কিন্তু নিজের হাত দুটিও কাঠের মতো প্রাণহীন মনে হয় তার কাছে। তবু যতটা পারে ততটা শক্ত করে ধরে। 

আবার কাদেরের গলা কোত্থেকে ভেসে ওঠে। তখন কালোস্রোতে যুবক শিক্ষক ভাসছে। কাদেরের কণ্ঠ অনেক দূরে অজানা কোনো পানির জন্তুর মতো লাফিয়ে ওঠে। যুবক শিক্ষক হিমশীতল কাঠ দুটি প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে। 

‘কোথায় যাচ্ছেন?’ আবার কাদেরের গলা। কাছাকাছি কোথাও সে-গলা ঝনঝন করে ওঠে। 

উত্তরে যুবক শিক্ষক ব্যথার অস্ফুট আওয়াজ করে, কারণ তার পশ্চাদ্ভাগে সূক্ষ্মাগ্র কিছু বিদ্ধ হয় যেন। ত্রস্তগতিতে অন্যদিকে মোড় নিলে বাঁশঝাড় তাকে সহস্র হস্ত দিয়ে আলিঙ্গন করে। ফলে বিদ্যুদ্বেগে একটি নিদারুণ ভয় তাকে এবার আঁকড়ে ধরে। তারপর সে-ভীতির জন্যেই হয়তো সে ক্ষণকালের জন্যে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়। বাঁশে আলোয়ান আটকে গেছে। একহাতে মৃত নারীর পা-দুটি ধরে সে বিষম বেগে আলোয়ানটা ছাড়িয়ে নেয়। হিংস্র জন্তুর মুখগ্রাস থেকে সে যেন হাত ছিনিয়ে নেয়। সারা বাঁশঝাড় কেঁপে ওঠে। 

কয়েক মুহূর্ত পরে অত্যাশ্চর্য একটি ঘটনা ঘটে। হঠাৎ উজ্জ্বল জ্যোৎস্নালোকে যুবক শিক্ষকের মুখ ভেসে যায়। সে অবশেষে দীর্ঘ গুহা অতিক্রম করে আলোতে পৌঁছেছে। কিছুটা বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লে কাদের তৎক্ষণাৎ ভর্ৎসনা করে ওঠে। কাতরকণ্ঠে যুবক শিক্ষক উত্তর দেয়, ‘কোন্ দিকে যাব?’ 

তারা নদীর দিকে চলতে শুরু করে। কাদের নির্বাক। দূরে গ্রামে একটা কুকুর ঘেউ-ঘেউ করে, কোথাও একটা রাত জাগা পাখি নিঃসঙ্গ কণ্ঠে ডেকে ওঠে। যুবক শিক্ষকের মুখ দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরে। অতি নিকটে পরিচিত আওয়াজ শুনতে পেলে প্রথমে কিছুটা বিস্মিত হয়, তারপর বোঝে সে-আওয়াজ তাদের উচ্চ শ্বাস-প্রশ্বাসের। তার মনে হয়, তারা যেন বিক্রয়সামগ্রী নিয়ে হাট-বাজার অভিমুখে ধাবমান দুটি মানুষ, দিগন্তে সকালের তির্যক সূর্যালোক। তারা হাঁপাচ্ছে। পথে অশেষ ধুলা। 

নদীর খাড়া পাড় দিয়ে নাবতে শুরু করে যুবক শিক্ষক ভয়ে নিথর হয়ে পড়ে। তার মনে হয়, সে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। নিচে আবার অতল গহ্বর। 

‘কী হল?’ কাদের অনুচ্চকণ্ঠে হুমকি দিয়ে ওঠে। 

যুবক শিক্ষক চোখ খুলবার আপ্রাণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে কান্নাকাতর স্বরে বলে, ‘কিছু দেখতে পাচ্ছি না।’ 

কিন্তু অতল গহ্বরের প্রান্তে চোখ আপনা থেকেই খোলে। অবশেষে অসীম শক্তি প্রয়োগ করে যুবক শিক্ষক তার দৃষ্টিকে কেন্দ্রীভূত করে। খাড়া পাড় অত খাড়া নয়। অদূরে একটু সমতল স্থানের পর পানি অস্ফুট শব্দে ছলছল করে। তারপর সে মুখটি দেখে। কাদের তার মুখ ঢেকে দিয়েছিল কিন্তু এক সময়ে আঁচলটি সরে গেছে! তার উন্মুক্ত মুখে চাঁদের পূর্ণ আলো। 

নিচে নেবে যুবক শিক্ষক এবার হুমড়ি খেয়ে পড়ে। চাপাস্বরে কাদের আবার ভর্ৎসনা করলে সে উঠবার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। দেহে একবিন্দু শক্তি আর নাই। হাড়-মাংস গলে নিঃশেষ হয়ে গেছে! যুবক শিক্ষক আর ওঠে না। কাদেরের ভর্ৎসনায় কানও দেয় না। 

কিছুক্ষণ পরে একাকী কাজ শেষ করে কাদের যখন নিঃশব্দে তার পাশে এসে দাঁড়ায়, তখন তার কিছু সম্বিত ফিরেছে। সে নিঃসাড় হয়ে পড়ে থেকে তার কণ্ঠস্বরের জন্যে অপেক্ষা করে। কাদের কিছু না বললে সে ধীরে-ধীরে উঠে বসে। তারপর একবার এক পলকের জন্যে মুখ তুলে তাকায় তার দিকে। কোমর পর্যন্ত তার কাপড় ভিজে জবজব করছে। সে তার দিকে তাকিয়ে আছে বলে তার মুখটা অন্ধকারে ঢাকা। তারপর অস্পষ্টভাবে তার চোখ সে দেখতে পায়। সে-চোখে যেন পরম ঘৃণার ভাব। কাদেরের পায়ের তলে সে যেন ঘৃণ্য বস্তু, শিরদাঁড়াহীন নপুংশক কীটপতঙ্গ কিছু। 

যুবক শিক্ষক মন্থরগতিতে প্রবাহিত শীতের শীর্ণ নদীর দিকে তাকায়। জ্যোৎস্না তার বুকে রূপালি আলোয় ঝলমল করে। এখন তাতে কুয়াশার কোনো চিহ্ন নাই। সত্যিই সে কি কুয়াশা দেখেছিল? নদীর বুকে কিছুই নাই। একবার দূরে একটা শিশুক মাছ ভেসে উঠে পরক্ষণেই আবার ডুবে যায়। ওপারে শুভ্র কাশবন স্বপ্নের মতো বিস্তারিত হয়ে ধবধব করে। পানির অস্ফুট কলতান ছাড়া চারধারে প্রগাঢ় নীরবতা।

একটু পরে কাদের নিঃশব্দে সরে গিয়ে পাড় বেয়ে উঠে অদৃশ্য হয়ে যায়। যুবক শিক্ষক মুখ ফিরিয়ে দেখে, কাদের নাই। কোনো কথা না বলে সে চলে গেছে। কোনো কথা, কোনো ব্যাখ্যার যেন প্রয়োজন ছিল না। শূন্য পাড়ের দিকে তাকিয়ে যুবক শিক্ষক কতক্ষণ হতবাক হয়ে বসে থাকে। তারপর কোথেকে একটা ক্রোধ এসে তার সারা মন ভরে দেয়। সে-ক্রোধের কারণ না বুঝলেও তার সন্দেহ থাকে না যে, ক্রোধটা ন্যায্য। তারপর এক সময় সে-ক্রোধ নিঃশেষ হয়ে গেলে সে অতিশয় নিঃসঙ্গ বোধ করে। 

পাড় বেয়ে ওঠার আগে যুবক শিক্ষক শেষবারের মতো নদীর বুকে দেহটাকে খুঁজে দেখে : কিন্তু কোথাও তার চিহ্ন নাই। তারপর একটি অপ্রীতিকর কথা স্মরণ হলে সে পানির ধারে গিয়ে কাদা মেখে প্রবলভাবে হাত সাফ করে। সে কাজ সম্পন্ন হলে সে আলোয়ানটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে তীরে উঠে বাড়ি অভিমুখে রওনা হয়। 

নদীর শূন্য বুকের মতো তার বুকও শূন্যতায় খাঁ খাঁ করে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *