পনেরো
দাদাসাহেব ফজরের নামাজ শেষ করে কারুকার্যময় রেহালে কোরান শরীফ রাখবেন এমন সময় একটি চাকর দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। এ-সময়ে তাঁর ধর্মীয় কাজে ব্যাঘাত ঘটলে তিনি বিরক্ত বোধ করেন বলে চশমার ওপর দিয়ে অসন্তুষ্টদৃষ্টিতে তার দিকে তাকান।
‘মাস্টার দেখা করতে চায়।’
দাদাসাহেবের মুখ থেকে অসন্তুষ্ট ভাবটি মিলিয়ে যায়। একটু ভেবে তিনি বলেন, ‘যাও, আসছি।’
চাকরটি অদৃশ্য হয়ে গেলে জরির কাজ-করা গাঢ় লালরঙের মখমলের সুদৃশ্য আবরণে কোরান শরীফ ভরে সেটি বুকের কাছে ধরে কতক্ষণ তিনি নিশ্চল হয়ে বসে থাকেন, মুখে একটু দুশ্চিন্তার ছায়া দেখা দেয়। তাঁর সন্দেহ থাকে না যে, যুবক শিক্ষক কাদের সম্বন্ধে কোনো কথা বলতে এসেছে। কিন্তু কী কথা?
কাদের এবং যুবক শিক্ষকের মধ্যে হঠাৎ দেখাশুনা হলে তিনি কৌতূহলী হয়ে সেদিন যুবক শিক্ষককে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, তাদের দেখাশোনার কারণ যুবক শিক্ষকের নিকট হতেই জানা সহজ হবে। কিন্তু সে কিছু বলতে রাজি হয় নাই। তার আচরণ এবং না-বলতে চাওয়ার অর্থ তিনি বুঝতে পারেন নাই। কী এমন কথা হতে পারে যা বলতে তার এত দ্বিধা? অকারণে কাদেরের সেদিনের বিচিত্র দৃষ্টিও তাঁর স্মরণ হয়। সে-দৃষ্টির অর্থও তিনি এখনো বুঝতে পারেন নাই।
কাদের দরবেশ সে-কথা তিনি নানা সময়ে বলে থাকেন বটে কিন্তু তাতে যে তিনি সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করেন, তা নয়। তিনি নিজেই জানেন, তা তাঁর একটি খেয়াল মাত্র। তবে এমন একটি খেয়াল যা কাদেরের মতো মানুষের পক্ষে সত্য হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তার আচরণ-ব্যবহার দশজনের মতো নয়। সাধারণ জীবনের নকশার সঙ্গে তার জীবনের মিজুক নাই। তার সম্বন্ধে তার বড় ভাইয়ের ভাবনাচিন্তা হওয়া স্বাভাবিক। তাই একদিন তিনি আশা করতে শুরু করেন, হয়তো কাদেরের মন দরবেশীতেই। আশাটি সত্য হলে তার আচরণের একটি যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা হবে, ভাবনাচিন্তারও কারণ থাকবে না। ক্রমশ আশাটি একদিন খেয়ালে পরিণত হয়। প্রথমে প্রথমে সে রসিকতা – অবিশ্বাসের অংশটা ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। যুবক শিক্ষক তাঁর সে আশা-খেয়াল ভাঙতে এসেছে কি?
অবশেষে সজোরে কেশে গলা সাফ করে তিনি উঠে দাঁড়ান। না, এমন আশঙ্কা অহেতুক।
রেহালটি প্রশস্ত বিছানায় স্থাপিত জায়নামাজের ওপর পড়ে থাকে। তবে কোরান শরীফটা তিনি খাটের মাথার কাছে তাকের ওপর সযত্নে তুলে রাখেন। তারপর গলার মাফলারটি ভালো করে পেঁচিয়ে আলোয়ানটাও আরেকবার জড়িয়ে নেন। এ-সময়ে মুহূর্তের জন্যে হঠাৎ কেমন একটি কথা তাঁর মনে আসে। তিনি ভাবেন, না, তাঁকে কাদের সম্বন্ধে কোনো কু-কথা বলার সাহস যুবক শিক্ষকের হবে না। অবশ্য তৎক্ষণাৎ সেটিকে মন থেকে দূর করে তিনি ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হন।
শূন্য বারান্দায় নিশ্চল হয়ে বসে যুবক শিক্ষক দাদাসাহেবের জন্যে অপেক্ষা করে। একটু দুর্বল দেখালেও মুখ শান্ত। নিদ্রাহীনতার জন্যে চোখে শুষ্কতা কিন্তু তাতেও অস্থিরতা- বিহ্বলতার স্পর্শ নাই। মেঝের সাদা-কালো ছকের দিকে তাকিয়ে ধীর-স্থির ভাবেই সে ভাবে, অবশেষে দাদাসাহেবকে দুঃসংবাদটি দিতে এসেছে। দুঃসংবাদটি এই যে, কাদের একটি যুবতী নারী খুন করেছে। কিন্তু কেবল দুঃসংবাদটি দিতেই কি সে এসেছে? বাঁশঝাড়ের ঘটনাটি আসলে বড় অস্পষ্ট মনে হয়। শুধু তা-ই নয়। যা সে বলতে এসেছে এবং যা দাদাসাহেবকে নিঃসন্দেহে ক্রুরভাবে আঘাত দেবে, তা যেন ঘটনাটির সঙ্গে অতি ক্ষীণভাবে জড়িত। যা সে বলতে এসেছে আর যা ঘটেছে, সে দুটি পৃথক বিষয় যেন। হত্যাকাণ্ড নয়, কাদের যেভাবে তার সামনে স্তরে স্তরে ধাপে ধাপে নিজেকে ধ্বংস করেছে সেটাই বড়। কাদের যখন নিম্নতম সোপানে এসে নাবে তখন তার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে নাই : কেবল থেকেছে সামান্য বিষাক্ত কালো ধুঁয়া, হয়তো একটা দূষিত ছায়া।
না, তার ধ্বংস হওয়াটাও আর বড় কথা নয়। বাঁশঝাড়ের ঘটনার মতো সেটিও যেন আবছা হয়ে উঠেছে। যুবক শিক্ষক এখন কেবল একটি কথাই বোঝে। কাদের অবশেষে যে বিষাক্ত ধুঁয়ায় এবং দূষিত ছায়ায় পরিণত হয়েছিল, সে-ধুঁয়া এবং ছায়া যুবক শিক্ষককেও যেন গ্রাস করার উপক্রম করেছিল।
মনের কথা বোঝা মুশকিল। বাঁশঝাড়ের ঘটনাটি কেন তার মনে এমন বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছিল তা সে এখনো সঠিকভাবে জানে না। হয়তো হত্যাকাণ্ডের কথাটি তার পক্ষে বিশ্বাস করা সম্ভব হয় নাই। এমন নির্মম কথা বিশ্বাস না হওয়াই স্বাভাবিক। অথবা বিশ্বাস না করাই সম্ভব হয় নাই। তাই কথাটা প্রকাশ করলে তার সমূহ ক্ষতি হতে পারে সে-কথা কাদেরের নিকট হতে শোনার আগেই নিজেকে বুঝতে পেরে স্বপ্নরাজ্যে সে আশ্রয় নিয়েছিল। দুটির ফল কিন্তু একই : ঘটনাটির বিষয়ে তার নীরবতা এবং দুটিই যে-কোনো একটির সাহায্যে তার পক্ষে সর্বপ্রকার আত্মরক্ষা করাও সম্ভব হত : মনটা নিষ্কলঙ্ক থাকত, কোনোপ্রকার ক্ষতিও হত না। কিন্তু কোনোটাই ধরে রাখা তার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। কথাটা বিশ্বাস না করে উপায় থাকে নাই, স্বপ্নরাজ্যে বাস করাও সম্ভব হয় নাই।
কেন? কারণ নিজের কাছে তার মনের ভয় লুকানো আর সম্ভব হয় নাই। আয়নায় একটি নগ্নভীতি দেখতে পায়; তার সন্দেহ থাকে না যে সেটি তারই প্রতিবিম্ব। তার কার্যের পরিণাম সম্বন্ধে এখনো সে ভীত, কিন্তু কাজটি না করে এখন তার উপায় নাই। ভয়টা যে তারই মনের ভয়, সে-কথা সে এখন জানে।
পরিণামভীতি না কাটা সত্ত্বেও সে যখন কথাটি প্রকাশ করতে উদ্যত হয়েছে তখন কোনো একটি যুক্তির সাহায্যে সে নিশ্চয়ই তার ভীত মনকে মানিয়েছে। হ্যাঁ, যুক্তি একটা আছে বটে, কিন্তু হয়তো সেটি একটু বিচিত্র। দাদাসাহেবকে তা সে বোঝাবার চেষ্টা করবে। তাহলে তিনি একথাও বুঝতে পারবেন যে, সে তাঁকে কাদের সম্বন্ধে একটা নিষ্ঠুর খবরই দিতে আসে নাই। তারপর তাঁর পক্ষে যুবক শিক্ষককে খানিকটা ক্ষমা করাও হয়তো সম্ভব হবে।
গতকাল স্বচ্ছদৃষ্টিতে পরিণামের সম্ভাবনাগুলি ভেবে সে ভয়ই পেয়েছিল। তারপর সে একটি কথা জানতে পারে। কথাটি এই যে, যুবতী নারীর আত্মীয়-স্বজন হত্যার অপরাধটি জিন-পরীর ঘাড়ে চাপানোই শ্রেয় মনে করেছে। হত্যাকারী কে তা না জানলেও হত্যার কথা সন্দেহ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় নাই, তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় নাই; মৃত্যুর কারণ সম্বন্ধে সরকারি ডাক্তারের রায়ের মধ্যে জিন-পরীর নামগন্ধ পর্যন্ত নাই। তবে কেন তারা জিন-পরীর নাম তুলেছে? কারণটি হয়তো এই যে, মৃত যুবতী নারীকে আর যখন তারা ফিরে পাবে না তখন তার মৃত্যুর অপ্রীতিকর ব্যাপারটি ঘাঁটিয়ে লাভ নাই। আত্মীয়-স্বজনের এমন বাসনা স্বাভাবিক।
এমন সময় যুবক শিক্ষক একটি বিচিত্র কথা লক্ষ করে। কথাটা সত্যিই বিচিত্র। (প্রথমে ঘটনাটি প্রকাশ না করার জন্যে সে যেমন অদ্ভুত যুক্তি-অজুহাতের সাহায্য নিয়েছিল, এবার তা প্রকাশ করবার জন্যেও কি তেমনি অদ্ভুত যুক্তি-অজুহাতের সাহায্য নিচ্ছে?) সে দেখতে পায় যে, সব যুক্তি কাদেরের, তার নিজের, এমন কি যুবতী নারীর মৃত্যুতে একমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ তার আত্মীয়-স্বজনের—সব যুক্তিই সত্য ঘটনাটি গোপন রাখার পক্ষে। সহসা তার মনে হয়, এই ঐকতানের মধ্যে একটি নিগূঢ় অর্থ আছে যেন।
না-বলার পক্ষে অতি আগ্রহের সঙ্গে কারা সে-সব যুক্তি জুগিয়ে দিয়েছে? জীবিত মানুষরা। জীবিত মানুষরা তাদেরই কথা বলছে, মৃত মানুষের কথা বলছে না। তারপর আরেকটি কথা সে বুঝতে পারে। জীবিত মানুষের পক্ষে জীবিত থাকার জন্যে আকুল আকাঙ্ক্ষা, বা জীবন থেকে যতটুকু পারা যায় লাভ-সুবিধা আদায় করার তীব্র বাসনা আপত্তিজনক নয়, কিন্তু যারা যুক্তিগুলি পেশ করেছে তারা যেন নামেই শুধু জীবিত। আসলে তারা মৃত, তাদের জীবনও ধার-করা জীবন। তা না-হলে তারা মৃত নারীর প্রতি কোনো সমবেদনা বোধ করবে না কেন, যে-মানুষ তার মৃত্যু ঘটিয়েছে তার প্রতি তীব্র ঘৃণা বোধ করবে না কেন? জীবনের ব্যাপারে তারা প্রতারক বলেই তাদের মনে এত ভীতি, সত্য ঘটনাটি লুকাবার জন্যে এত অধীরতা, এত শঠতা।
যুবক শিক্ষক শীঘ্র সে দল থেকে কাদেরকে এবং যুবতী নারীর আত্মীয়-স্বজনকে বাদ দেয় : ঘটনাটি গোপন রাখার ইচ্ছাটি তার পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু অন্যান্য যুক্তিগুলি সে কোথায় শুনেছে? কাদের ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে সে যখন আলাপ করে নাই, তখন সে-সব সে কি নিজের মনে শোনে নাই?
তার মানে এই নয় কি যে যুবক শিক্ষক নিজে জীবিত হয়েও মৃত, জীবনের ব্যাপারে সে-ই প্রতারক?
আয়নায় সে যেন নিজের আরেকটি চেহারা দেখতে পায়। তাহলে বাকি কথাও সত্য। কর্তব্য এড়াবার জন্যেই সে স্বপ্নরাজ্যে প্রবেশ করেছিল এবং নিজেরই সৃষ্ট অবিশ্বাস্য যুক্তি– অজুহাতে সে বিশ্বাস করেছিল। কাদের যে হত্যাকারী বা সে যে প্রেমিক নয় সে-কথা জানার পর তার মধ্যে যে-ভীষণ ক্রোধ দেখা দিয়েছিল তার কারণ অপরাধীর প্রতি ঘৃণা নয়, কাদের তাকে স্বপ্নরাজ্যে বাস করতে দেয় নাই বলেই সে এমন ক্রোধে আত্মহারা হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া, এ-কথাও সত্য যে যুবতী নারীর মৃত্যুর বীভৎসতা সে কিছুক্ষণের জন্যে বোধ করলেও তার প্রতি কোনো দুঃখ হয় নাই বা তার প্রতি গভীর অন্যায়টির সুবিচার হোক তার প্রয়োজন বোধ করে নাই। সে শুধু ভয়ই বোধ করেছে, নিজের জীবনের জন্য ভয়। সে-ভয়েই প্রথম রাতে মাঠে-মাঠে এমন উন্মাদের মতো ছুটাছুটি করেছিল এবং এ- ক’দিন এমন দিশেহারা হয়েছিল।
নিজের সত্যরূপ সে কী করে সঠিকভাবে জানবে?
কথাটি জানবার একটি পথই আছে। তার সত্যাসত্য বিচার ঘটনাটি প্রকাশ না করলে সম্ভব নয়। আবার, সে-বিষয়ে একটি পরিষ্কার উত্তর চাইলে মূল্যস্বরূপ দুটি পরিণামের জন্যে তাকে তৈরি হয়ে থাকতে হবে : হয় কাদের শাস্তি পাবে, না হয় সে-ই শাস্তি পাবে।
তারা যেন দু-জনেই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। তাদের মধ্যে আর প্রভেদ নাই।
না, দাদাসাহেবের কাছে সে কাদেরের কথাটিই কেবল বলতে আসে নাই।
হয়তো এখনো সে অন্যপ্রকারে স্বপ্নরাজ্যেই বাস করছে, নিজেকে ফাঁকি দেবার নূতন একটি পন্থা আবিষ্কার করেছে। তার একথা মনে হয় যে, সে যেন নিজেকেই কোনোপ্রকারে ভুলিয়ে ক্ষুধার্ত সিংহের গুহায় নিয়ে এসেছে। কিন্তু তবু তার মনে হয়, সে যেন ঘন জঙ্গল থেকে বেরিয়ে উন্মুক্ত স্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, কোথাও আশ্রয় নেবার স্থান নাই বলেই মনে বিচিত্র শান্তিও। বস্তুত, মন যেন শান্ত নদীর মতোই ঢেউশূন্য, মসৃণ। নদী তবু প্রবাহিত হয়। সে যেন নদীর মতোই একটি গন্তব্যস্থলের দিকে ভেসে যাচ্ছে। সে গন্তব্যস্থল সে দেখতে পায় না, সেখানে তার প্রশ্নের সঠিক উত্তর আছে কিনা তা-ও সে জানে না। তবে নদীর ধারা যেমন থামানো যায় না বা তার দিপরিবর্তন করা যায় না, তেমনি তার পক্ষে থামা বা দিক্- পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।
ভেতরের সিঁড়িতে দাদাসাহেবের খড়মের আওয়াজ শোনা যায়। সে আওয়াজ ক্রূরভাবে সারা বাড়িতে প্রতিধ্বনিত হয়। আচমকা সে আওয়াজ শুনে কয়েক মুহূর্তের জন্যে যুবক শিক্ষক বেসামাল হয়ে পড়ে, তার শান্তমনে আলোড়নের সৃষ্টি হয়। দাদাসাহেবকে কথাটি বলতে এসে সে ভুল করে নাই তো? আত্মপ্রবঞ্চনা থেকে নিস্তার পাওয়ার প্রয়াসে সে কি আত্মহত্যা করতে বসেছে?
মনকে সংযত করার চেষ্টা করে সে আপন মনে বলে, না। ভীতির কোনোই কারণ নাই। দাদাসাহেব তার অসহায়তা বুঝতে পারবেন। যে-স্রোতের বিরুদ্ধে সে দাঁড়াতে চেয়েছিল কিন্তু দাঁড়াতে পারে নাই এবং যে-স্রোতে সে এখন ভেসে যাচ্ছে দুটির কোনোটার অর্থই সে বোঝে না। এমন নিঃসহায় মানুষের জন্যে তাঁর নিশ্চয় দয়া হবে।
দাদাসাহেবের খড়মের উচ্চ আওয়াজে উদ্বেগের আভাস নাই। হয়তো তাতেই সে অবশেষে আশ্বস্ত হয়, তার মনের আলোড়ন শান্ত হয়। তারপর দাদাসাহেব বারান্দায় উপস্থিত হলে সে সসম্মানে উঠে দাঁড়ায়, তিনি সশব্দে আসন-গ্রহণ করলে সে-ও আবার বসে। তারপর সে খোলা দরজা দিয়ে উঠানের দিকে তাকায়। সেখানে অস্পষ্ট ঈষৎ কুয়াশাচ্ছন্ন রোদ দেখা দিয়েছে। একধারে একটি ব্যস্তসমস্ত সাদারঙের মুরগি চঞ্চলভাবে খাদ্য অন্বেষণ করে। দাদাসাহেব কাশেন।
কোথায় সে শুরু করবে? নদীর উৎস কোথায়, কোথায়ই-বা জীবন-মৃত্যুর উৎপত্তি? তাছাড়া, জীবন কি সত্যিই মৃত্যুর চেয়ে অধিকতর মূল্যবান?
দাদাসাহেব আবার কাশেন। তিনি অপেক্ষা করছেন সে-কথা যুবক শিক্ষককে জানান। যুবক শিক্ষক বোধ করে, তার ভেতর ঝরঝর করে কী যেন ঝরতে শুরু করেছে। তার অন্তর কি কাঁদতে শুরু করেছে একটি নিঃসহায় অজ্ঞানতার জন্যে?
তারপর সে অস্পষ্ট গলায় বলে, ‘কাদের মিঞা একটি মেয়েলোককে খুন করেছে।’
কথাটি বলার পরও তার ভেতরে সে-অজানা ধারাটি ঝরতে থাকে। ধারাটি ঝরতেই থাকে, ঝরঝর করে ঝরতেই থাকে। অবশেষে সব কিছু ক্রমশ শেষ হয়ে যায়। নিঃস্ব শূন্যতায় কোনো শব্দ হয় না।
বহুক্ষণ পর যেন নীরবতা ভঙ্গ করে দাদাসাহেব আস্তে বলেন, ‘বুঝলাম না।’
যুবক শিক্ষক তখন দৃষ্টিহীনভাবে ছককাটা মেঝের দিকে তাকিয়ে নিঃস্পন্দভাবে বসে। পূর্ববৎ কণ্ঠে সে কথাটি আবার বলে। তারপর কতক্ষণের জন্যে নীরবতা অবিচ্ছিন্ন থাকে।
‘পরিষ্কার করে বলেন।’
দাদাসাহেবের কথা ভালোভাবে বুঝবার ক্ষমতা না থাকলেও সে বোঝে, তিনি হয়তো ঘটনাটির বৃত্তান্ত জানতে চাইছেন। অনুচ্চ প্রাণহীন কণ্ঠে সে বাঁশঝাড়ের ঘটনাটির বৃত্তান্ত দিতে শুরু করে। কিন্তু শীঘ্র তার মনে হয়, তার শ্রোতা যেন নাই। তার কথা এলোমেলো হয়ে ওঠে। একবাক্যে যা বলেছে তার ব্যাখ্যা-সম্প্রসার হয়তো তার কাছে নিতান্ত নিষ্প্রয়োজনীয় বোধ হয়। বস্তুত, দাদাসাহেবকে আর কোনো কথা বলার প্রয়োজনই সে বোধ করে না। হঠাৎ লম্বা-চওড়া সম্ভ্রান্ত মানুষটি যেন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেন। তাছাড়া, কোনো কথা জানার কৌতূহলও যেন শেষ হয়ে গেছে।
একটু পরে বিসদৃশভাবে উঠে দাঁড়িয়ে কোনোদিকে না তাকিয়ে যুবক শিক্ষক বলে, ‘আপনার কাছে বিদায় নিতে এসেছি।’
গাঢ় নিঃশব্দতার মধ্যে তার কথাটা কেমন বেখাপ্পা শোনায়। হয়তো তা সে নিজেই অনুভব করে। তবু কয়েক মুহূর্ত সে অপেক্ষা করে। দাদাসাহেব নীরব হয়ে থাকলে সে এবার হাল্কা পায়ে বারান্দা অতিক্রম করে বেরিয়ে যায়। প্রস্থানটিও কেমন বেখাপ্পা মনে হয় যেন, কিন্তু সে-কথা বুঝলেও সে থামে না। উঠানে মুরগিটি সচকিত হয়ে ডানা তুলে পলায়নোদ্যত হয়, উচ্চ কর্কশ রব তোলে, কিন্তু নড়ে না।
ঘরে সব তৈরি। ফুলতোলা টিনের সুটকেসটি কেবল হাতে তুলে নিলেই হয়। তবে মাথাটা কেমন শূন্য শূন্য মনে হয় বলে কতক্ষণ ঘরের মধ্যখানে স্থির হয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে। যে-ঘরে সে দু-বছর বসবাস করেছে, সে ঘরের চারধারে একবার তাকিয়ে দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করে, কিছু দেখতে পায় না। মনে কোনো বেদনার ভাবও বোধ করে না।
তারপর সে সুটকেসটি তুলে নেয়। কর্তব্য কাজ এখনো সম্পূর্ণ হয় নাই। দু-ক্রোশ দূরে আদালতের সামনে ঘাসশূন্য বৃক্ষছায়াচ্ছন্ন প্রাঙ্গণের এককোণে যে থানা, সে-থানায় তাকে যেতে হবে। কথাটা কর্তৃপক্ষকে বলার দায়িত্ব তারই। কাদেরের বড় ভাইয়ের ওপর সে-দায়িত্বের ভার দেওয়ার মানে কর্তব্য শুধু অসম্পূর্ণ রাখাই নয়, তাঁকে অমানুষিক একটি কাজ করতে বলা।
উঠানে নেবে বড়বাড়ির দিকে না তাকিয়ে সে হাঁটতে শুরু করে। তারপর যে-বাড়ি মূর্ছিত হয়ে আছে মনে হয়েছিল সে-বাড়ি থেকে এবার গুরুগম্ভীর একটা ডাক আসে। সে-ডাকটির জন্যে তারই অজ্ঞাতে সে কতক্ষণ অপেক্ষা করেছিল। অবশেষে সেটি যখন তার কানে পৌঁছায়, তখন সে হয়তো আর তার জন্যে তৈরি নয়, বা তাতে তার মনে একটা নতুন ভয়ের সৃষ্টি হয়।
সে ছুটতে শুরু করে। হাঁটার ভঙ্গিতে চললেও আসলে সে দৌড়তেই থাকে। টিনের সুটকেসটি সশব্দে হাঁটুতে বাড়ি খায়।