চাঁদনি রাতের হাসি-কান্না

চাঁদনি রাতের হাসি-কান্না

নাঃ, একিজার এই ম্যানেজারটা তো জ্বালালে বড্ডো! চুরি করে করে ফাঁক করে দিলে গ্লাসগো-দক্ষিণ স্পেন অলিভ অয়েল কোম্পানিটাকে! সেভাইলে বসে ডিরেক্টার ম্যাকডোনাল্ড হাত কামড়াচ্ছেন নিষ্ফল আক্রোশে। এক-শো বার সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে লোকটাকে, কান দেয়নি কোনো কথায়। জানে কিনা, ওই অভিশপ্ত একিজায় গিয়ে জলপাই বাগানের তদারক করবার মতো যুগ্যি লোক দুই-চার বছর চেষ্টা করলেও মেলানো যাবে না এ তল্লাটে!

যায়নি মেলানো, যাচ্ছে না মেলানো, যাবেও না মেলানো। ম্যাকডোনাল্ড নিজে থাকেন সেভাইলে। কারবারের হেড অফিস ওটাই কিনা! একাধারে শহর এবং বন্দর। এখান থেকে দুনিয়ার যেকোনো দেশে মাল পাঠানো একটিমাত্র তুড়ির কাজ। জাহাজে জাহাজে সমুদ্রের জল ঢেকে আছে সবসময়। তা ছাড়া ব্যাঙ্ক আছে অগুন্তি। জায়গায় বসেই তাদের মারফত লেনদেন করা যায় চীন বা চিলি, কেপ কলোনি বা কামস্কাটকার সঙ্গে।

তা ছাড়া, ব্যক্তিগত আরাম-বিরামের ব্যবস্থা এই সেভাইলেই যাহোক কিছু করে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। গোটা দেশটাই তো বারো মাস আগুনে পুড়ছে। সমুদ্রের ধার ছেড়ে স্রেফ দশটা কিলোমিটার ভিতর দিকে পা বাড়াও, মনে হবে দুপুর রোদে সাহারা পাড়ি দিচ্ছ। বেশি দূরও তো নয় সাহারা। জিব্রালটার পেরুলেই মরক্কো, মরক্কো পেরুলেই সেই অপার আগুন পারাবার। তার উষ্ণ নিঃশ্বাস যখন তখন উত্তরমুখো ভেসে আসছে স্পেন পর্তুগালকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলবার জন্য। এ অবস্থায় এই সেভাইল— এ যেন শান্তির নীড় এক টুকরো! বেচারা ম্যাকডোনাল্ড স্কটল্যান্ডের মানুষ, পাহাড়ের ছায়ায় সমুদ্রের হাওয়ায় মানুষ চিরদিন। গরম সহ্য করবার মতো দেহমন নিয়ে দুনিয়ায় তিনি আসেননি। এখানে সমুদ্রের ধারে ছায়াতরু দিয়ে ঘেরা তাঁর বাড়িখানিতে ঠান্ডি ঘর আছে, বরফ তৈরির বন্দোবস্ত আছে, খসখসের পর্দায় ঘড়ি ঘড়ি জল ছিটোবার জন্য বিশেষ ভৃত্য আছে। সকাল ন-টার মধ্যে বাইরের কাজকর্ম সব সেরে তিনি এসে বাড়িতে ঢোকেন, সেখান থেকে সন্ধ্যার আগে আর বেরোন না প্রাণান্তেও। এহেন আদমি এই যে ম্যাকডোনাল্ড , একিজার ম্যানেজার চুরি করে মেরে দিচ্ছে দুর্মূল্য জলপাই তেল, এ-খবর পেয়ে পেয়ে তিতোবিরক্ত হয়ে গেলেও চুরি বন্ধ করার কোনো উপায় করে উঠতে পারেননি দুই বৎসরের মধ্যে।

কী করবেন তিনি? একিজার তেল কোম্পানির যা কাজকারবার, বিশেষজ্ঞ লোক ছাড়া অন্য কেউ তা সামাল দিতে পারবে না। বিশেষজ্ঞ কিন্তু গণ্ডায় গণ্ডায় গড়াগড়ি যায় না এদেশে। বিদেশ থেকে কাউকে আনতে হলে অনেক তোড়জোড়ের ব্যাপার সেটা। কতদিনে মনের মতো মানুষ পাওয়া যাবে, কেউ বলতে পারে না। কোম্পানির অন্য ডিরেক্টারেরা থাকেন গ্লাসগোতে। চুরির খবর তাঁরা পাননি, তা নয়। পেয়ে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছেন ম্যাকডোনাল্ডকে, ‘এর একটা বিহিত করুন কালবিলম্ব না-করে।’ আর সে-ভদ্রলোকেরা কীই-বা করতে পারেন? করতে তাঁরাও পারেন না কিছু। ম্যাকডোনাল্ডও না। না, ভুল বলা হল। ম্যাকডোনাল্ড ইচ্ছে করলে করতে পারেন বই কী একটা কাজ। নিজের পায়ে নিজে কুড়োল মারতে পারেন। কোম্পানির মুখ চেয়ে তাই তিনি করলেন শেষপর্যন্ত।

সেভাইলের সুখনীড় ছেড়ে নিজে চলে গেলেন একিজায়।

একিজার কাজ চালানোর জন্য চাই বিশেষজ্ঞ। কিন্তু সেভাইলের কাজ চালাবার জন্য বিশেষজ্ঞের কোনো দরকার নেই। যেকোনো চৌকোস ব্যবসায়ী লোকের পক্ষেই সে কাজ সম্ভব। আর তেমন লোকের অভাব সেভাইলের মতো অগ্রগণ্য ব্যাবসাকেন্দ্রে হবে কেন? একটা যোগ্য লোক বাছাই করে তাকে সেভাইল অফিসে বসিয়ে দিলেন ম্যাকডোনাল্ড, আর সর্বসুখে জলাঞ্জলি দিয়ে, মে মাসের আগুন-ঝরা হাওয়ায় পুড়তে পুড়তে তিনি রওনা হয়ে গেলেন একিজায়। যেকোনো শহর থেকে এক-শো কিলোমিটারের কম নয় সেই একিজার জলপাই আবাদ। দুই মাইল লম্বা দুই মাইল চওড়া সেই আবাদের মাঝখানে যেটুকু জায়গার নাম সানলরেঞ্জো, কোম্পানির কারখানা বলো, কর্মীদের আস্তানা বলো, সব সেইটুকুর ভিতরেই। একটা অনুচ্চ পাহাড়ের মাথায় ছোটো একখানা পাকা বাড়ি, ম্যানেজারের বাসা হিসেবেই সেটা তৈরি হয়েছিল একদা। কিন্তু ম্যাকডোনাল্ড শুনে অবাক হলেন, সে-বাসাতে ভূতপূর্ব ম্যানেজার কোনোদিন বাস করেননি, তিনি থাকতেন অন্য কর্মচারীদের সঙ্গে, পাহাড়তলির করোগেট ঘরগুলোরই একটাতে, সহকর্মীদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে।

হবে না কেন? চোরে চোরে মাসতুতো ভাইতো! ওতে শুধু প্রমাণ হয় যে কর্মচারীগুলি সবাই চোর। পালের গোদাও পালছাড়া হয়ে থাকতে সাহস পায়নি।

যাহোক সে-ম্যানেজার বিদায় হয়ে গিয়েছে, ম্যাকডোনাল্ড নিজের বাসস্থান হিসেবে নির্বাচিত করলেন পাহাড়ের মাথার সেই পাকা বাড়িটাকেই। সুন্দর বাড়ি, যেকোনো জানালায় গিয়ে দাঁড়ালে, যতদূর দৃষ্টি চলে, ম্যাকডোনাল্ডের চোখে পড়ে শুধু নিজেদেরই জলপাই আবাদ, মনটা প্রসন্ন হয়ে ওঠে আপনা থেকেই। আপশোস হয়, স্রেফ গরমের ভয়ে এতদিন এদিক মাড়াননি তিনি।

গরম রুখবার উপায় যতরকম আছে, সবই একে একে অবলম্বন করা হবে এখানেও। যতদিন তা না-হচ্ছে, ততদিনও খুব বেশি কষ্ট হয়তো পেতে হবে না ম্যাকডোনাল্ডকে। কারণ এ-বাড়িটার নীচের তলাটা আধাআধি মাটির নীচেই। জানালাগুলো ছাদের ঠিক নীচেই, তা দিয়ে হাওয়া ঢোকে বটে, গরম হাওয়াই ঢোকে, কিন্তু সে-খাওয়া গৃহবাসী মানুষটার গায়ে এসে সরল রেখায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে না। ঘুরে-ফিরে নীচে এসে পৌঁছোয় যখন, তার তাপ কমে যায় আর্ধেক পরিমাণ। সেই নীচের তলার একখানা ঘরই শয়নকক্ষ হিসেবে ব্যবহার করবেন ম্যাকডোনাল্ড। সারা রাত তো বটেই, দিনের বেলার অবসর সময়টাও কাটাবেন সেই ঘরে, গরমে তাহলে বোধ হয় তত বেশি কষ্ট না-ও হতে পারে।

হ্যাঁ, কাজ হয়েছে বটে ফন্দিটাতে। বাইরে থেকে ঘরে এসে ঢুকলেই মনে হয় স্পেন থেকে স্কটল্যান্ডে চলে এলাম বুঝি। অমনি ভবযন্ত্রণা আর্ধেক কমে যায় ম্যাকডোনাল্ডের, জীবনধারণ আর তত বেশি দুর্ঘট বলে মনে হয় না।

এ-বাড়িতে বাস করার পক্ষে অসুবিধা একটাই দেখতে পাচ্ছেন ম্যাকডোনাল্ড, কোনো ভৃত্য এখানে রাত্রিবাস করতে রাজি হয় না। ‘কেন? কেন? আপত্তি কী?’— এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর ম্যাকডোনাল্ড পাননি। এক একজন কৈফিয়ত দেয় এক একরকম। প্রায় সবই ব্যক্তিগত অসুবিধার কথা। কারও হয়তো স্ত্রীর অসুখ, কারও হয়তো সন্ধ্যার পরে সরাইখানায় গিয়ে দুই-তিন ঘণ্টা না-বসলে ডিনারের রুটি হজমই হয় না। যতসব ন্যাকা কথা আর কী!

যাহোক, ‘থাকতেই হবে এ-বাড়িতে’— এ-বলে কোনো ভৃত্যের উপরে জবরদস্তি করলেন না ম্যাকডোনাল্ড। না-থাকে, না-থাকুক। তার ডিনারটা যতক্ষণ শেষ না-হচ্ছে, ততক্ষণ থাকুক, তারপর যে-চুলোয় খুশি, চলে যাক সেই চুলোয়। এখানে থেকে ওরা করবেই বা কী ম্যাকডোনাল্ডের?

কেন যে ওরা থাকতে চায় না এ-বাড়িতে, সে সম্বন্ধে একটা ধারণা অবশ্য আছে তাঁর। ভূতের ভয় আর কী! একটামাত্র বাড়ি পাহাড়ের মাথায়, তায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে এক যুগ ধরে। সে-বাড়িকে যে অশিক্ষিত গেঁয়ো স্পেনিয়ার্ডরা ভূতের আড্ডা বলে ঠাওরাবে, এতে আর আশ্চর্য কী! জ্যান্ত মানুষের মুখোমুখি লড়বার সময় ওরা দুঃসাহসী, কিন্তু মরা মানুষ? মা-মেরি রক্ষা করুন! ওদের ত্রিসীমায় যেতে এদেশের লোক অরাজি।

যাহোক, একা এক বাড়িতে আরামেই আছেন ম্যাকডোনাল্ড। কাজ ঢের, তাই নিয়েই মেতে আছেন সারাদিন। চোরের দলের চাঁই যেটি, তাকে তো তাড়িয়েছেন। কিন্তু ক্ষুদে চোর তো অনেক আছে আরও। তাদের খুঁজে বার করা আর অর্ধচন্দ্র দেওয়া, একদিনে একাজ হওয়া সম্ভব নয়। তা হোক, ব্যস্ত হবার কারণ নেই। নিজের উপরে আস্থা আছে ম্যাকডোনাল্ডের। যে কাজে যখন হাত দিয়েছেন, ব্যর্থ হননি তাতে।

সারাদিন অফিসে, কারখানায় বা আবাদে থাকতে হয়, বাড়ি ফেরেন রাত সাতটায়। এসেই ডিনারে বসেন। একাই খেতে হয়, দোসর আর পাবেন কোথায়? তবে বাড়ি ফেরার মুখে কারখানার সমুখ দিয়ে যেদিন আসতে হয়, সেদিন ওখান থেকে রাসায়নিক ফ্রেডরিকোকে ডেকে নিয়ে আসেন তাঁর সঙ্গে খাওয়ার জন্য। তবে সেটা হয় ক্বচিৎ কদাচিৎ।

প্রায় রোজই যেমন হয়, সেদিনও একাই বাড়ি ফিরেছেন ম্যাকডোনাল্ড। একাই খেয়েছেন, তারপর ঘণ্টা দুই বসে অফিসের কাগজপত্র দেখেছেন গভীর মনোযোগ দিয়ে। অবশেষে যখন শয্যাগ্রহণের জন্য উঠলেন একটা জ্বলন্ত মোম হাতে নিয়ে, দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ঘড়িতে দেখলেন রাত এগারোটা। তা বেশ। এইরকম সময়ই ঘুমোতে যান ম্যাকডোনাল্ড। এক ঘুমেই রাত কাবার করে দেন।

সেদিনও কম্বলের ভিতর ঢোকামাত্র ঘুমিয়ে পড়লেন উনি। কিন্তু আজ আর একটানা রাতভোর ঘুম তার বরাতে ছিল না।

ঠিক কতক্ষণ তিনি ঘুমিয়েছিলেন, তা কেমন করে বুঝবেন তিনি? হঠাৎ সে-ঘুম যেন কী একটা আওয়াজের আঘাতে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, ঠিক যেমন করে চীনেমাটির বাসন ভেঙে যায় পাথুরে মেজের উপরে পড়লে।

আওয়াজটা থেমে যায়নি। ম্যাকডোনাল্ড জেগে উঠেও শুয়ে আছেন কান খাড়া করে। আওয়াজটা মনে হচ্ছে যেন একটা হাসির আওয়াজ। অট্টহাসি! হাসির গররা যাকে বলে। একবার উঠছে, একবার নামছে তার পর্দা। একটানা হাসি! অবিশ্রান্ত হাসি! একেবারে কানের কাছেই ম্যাকডোনাল্ডের। ওই যে জানালাটা পায়ের দিকে, ওরই বাইরে দাঁড়িয়ে কেউ যেন হেসেই চলেছে, হেসেই চলেছে গলা ফাটিয়ে।

জনপ্রাণী নেই এ-বাড়িতে, নিজে ম্যাকডোনাল্ড ছাড়া। তবে এত রাত্রে এখানে হাসে কে? আর, হাসেই বা কেন? স্থান-কাল-পাত্র কোনোটাকেই তো অনুকূল বলা যায় না ও-রকম দানবীয় হাসির! এর মানে কী? মানে?

হঠাৎ আর এক চমক খেলেন ম্যাকডোনাল্ড। হাসিটা হঠাৎই পরিবর্তিত হল কান্নায়। সেও কি অল্প-স্বল্প কান্না? যেমন হাসছিল আকাশ-ফাটানো হাসি, তেমনই তুলেছে পিলে-চমকানো আর্তনাদ। ডুকরে কাঁদছে নিশীথ রাতের অদৃশ্য অভাগা, সুপ্ত পৃথিবীর কাছে কী এক দুর্বোধ্য নালিশ জানিয়ে জানিয়ে।

পাগল! অনিবার্যভাবেই ম্যাকডোনাল্ডের মনে হল, মানুষটা নির্ঘাত পাগল। হাসবার কারণ মানুষের ঘটতে পারে। আবার থাকতে পারে কাঁদবারও কারণ। কিন্তু দুটো একসাথে কারও ঘটে কখনো, এতো ধারণা করাই যায় না! কোথা থেকে এই নির্জন পাহাড়ে একটা বদ্ধউন্মাদ এসে জুটল এত রাতে?

ঠিক ওই জানালাটার নীচে থেকেই আসছে আওয়াজগুলো। পাগলটা আর জায়গা পেল না! গলাবাজি করতে এল ম্যাকডোনাল্ডেরই কানের কাছে! ভীষণ রাগ হতে লাগল তাঁর। লোকটাকে তাড়ানো দরকার। নইলে তো সারা রাত আর চোখের পাতা এক করা যাবে না। অথচ রাত ভোর হলেই আবা শুরু হবে হাড়ভাঙা খাটুনি।

লোকটাকে তাড়াতে হবে। ধমকে যদি তাড়ানো না-যায়, ফাঁকা আওয়াজও করতে হবে বন্দুকের। তড়াক করে ম্যাকডোনাল্ড বিছানা থেকে লাফিয়ে নামলেন, দড়াম করে খুলে ফেললেন জানালাটা।

কই, না। জানালার ধারেকাছেও কেউ নেই। তবে হ্যাঁ, কান্না একটা শোনা যাচ্ছে এখনও। পাহাড়তলির কোনো জায়গা থেকেই আসছে আওয়াজটা। হ্যাঁ, সোজা ওই জানালা-বরাবর পাহাড়তলি থেকেই। তা ওখানে এত রাত্রে কী করে যাবেন ম্যাকডোনাল্ড? নতুন এসেছেন এখানে, ওঠা-নামার পথ কোন দিকে দিয়ে, কিছুই জানা নেই। নামার চেষ্টা করলে পড়ে গিয়ে ঘাড় গর্দান ভেঙে যাওয়ার ভয় আছে বিলক্ষণ।

ম্যাকডোনাল্ড জানালায় দাঁড়িয়ে আছেন। কান্নার পর্দা হঠাৎ নেমে গেল। তা ছাড়া সে-একটানা কান্না এখন দাঁড়িয়েছে ভাঙা-ভাঙা গোঙানিতে। কেউ যেন গলা চেপে ধরেছে লোকটার। সেই চাপ যখন আলগা হয়ে আসছে একটু, তখনই কাতরানিটা ফুটে বেরুচ্ছে এক একবার, তা নইলে সে-আওয়াজ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতরই ক্রমশ। ম্যাকডোনাল্ডের মনে হল, এক্ষুনি ওটা একেবারেই থেমে যাবে নিশ্চয়, সেইসঙ্গে থেমে যাবে বুকের ভিতরকার ধুকধুকুনিটাও।

কিন্তু কী করা যাবে? ফুটফুটে জোছনা চারধারে কিন্তু পাহাড়তলিতে কোথায় কী হচ্ছে, তা দেখা যায় না এখান থেকে। যেত যদি দেখা, কর্তব্য স্থির করার একটা প্রশ্ন দেখা দিত ম্যাকডোনাল্ডের সামনে। তা যখন যাচ্ছে না, তখন প্রথম দিকের সেই অট্টহাসি আর শেষ দিকের এই বুকফাটা কাতরানি, এগুলো যে বাস্তব জগতের ঘটনা, না ম্যাকডোনাল্ডেরই দুঃস্বপ্ন একটা, তাই তো ঠিক করা যাচ্ছে না।

যাঃ, কান্নাটা একদম থেমে গেল। নিথর নিস্তব্ধ নিশীথিনী জোছনার চাদর মুড়ি দিয়ে কী যেন সযত্নে লুকিয়ে রেখেছে একটা শোকাবহ রহস্য। জানালা বন্ধ করে দিয়ে ম্যাকডোনাল্ড ধীরে ধীরে শয্যায় গিয়ে ঢুকলেন আবার।

পরদিন যাকে সমুখে পান, তাকেই তিনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘কাল রাতে কে অমন করে কাঁদছিল হে? প্রথমে হাসি, পরে কান্না, কোথাও খুন-জখম কিছু হয়নি তো?’

সবাই একবাক্যে জানাল, ‘ও সেই পাগলাটা স্যার। বিশ বছর হল মারা গিয়েছে, এখনও প্রতি পূর্ণিমা রাতে তার ওইভাবে একটা জানান দেওয়া চাই। প্রথমে হাসি, তারপরে কান্না। বিশ বছর ধরে শুনছি আমরা।’

ম্যাকডোনাল্ড আবার ভূতে বিশ্বাস করেন না। চট করে ধারণা করে নিলেন, ভূত-টূত সব বাজে কথা। এ কোনো বদমাইশ লোকের খেল। ভৌতিক হাসি-কান্নার ধোঁয়া সৃষ্টি করে তারই আড়ালে আড়ালে নিজেদের কোনো কুকর্ম নির্ঝঞ্ঝাটে সমাধা করে। গোঁয়ার স্কচ, তিনি সেই মুহূর্তেই সংকল্প করে বসলেন, এ-রহস্যের তিনি উদঘাটন করবেনই।

প্রতি পূর্ণিমা রাত্রে জানান দেয় সেই পাগলার প্রেতাত্মা? বেশ, আগামী পূর্ণিমাতেই এ-ব্যাপারের একটা এসপার বা ওসপার করবেন ম্যাকডোনাল্ড। ইতিমধ্যে তিনি দেখে রাখলেন সেই ভাঙা বাড়িটা, যেখানে বাসস্থান ছিল ওই পাগলের। ম্যাকডোনাল্ডের জানালার নীচেই বটে, তবে অন্তত পাঁচ-শো ফুট নীচে। পাহাড়ের গায়ে একটা খাঁজ আছে ওখানে, লম্বায়-চওড়ায় দুই দিকেই বিশ-পঁচিশ গজের মতো হবে। সেই খাঁজেতেই ছিল ছোট্ট একটা বাড়ি, এখন একেবারেই ভগ্নদশা তার। জঙ্গলে যেভাবে ঢেকে আছে এখন যে, পাহাড়ের উপর থেকেও বাড়িটা দেখা যায় না, নীচে থেকেও না। ম্যাকডোনাল্ড গিয়ে দেখে এলেন বাড়িটা। কয়েক বারই দেখে এলেন। দিনেও, রাতেও। রাতেও কিন্তু অনৈসর্গিক কোনো কিছুর আভাস তিনি পেলেন না সেখানে। পাওয়ার আশাও তিনি করেননি অবশ্য, কারণ পূর্ণিমা রাতে ছাড়া প্রেতাত্মার হাসি-কান্না যে শোনা যায় না, তা তো তিনি আগেই শুনেছেন। তিনি ধৈর্য ধরে আছেন। আসুক পূর্ণিমা আবার।

এল আবার পূর্ণিমা। রাতদুপুরে ম্যাকডোনাল্ড হাজির সেই ভাঙা বাড়িতে, এক হাতে জোরালো টর্চ, অন্য হাতে রাইফেল। তিনিও ঢুকেছেন বাড়িতে, অমনি শুরু হল সেই হাসির তাণ্ডব। হাসি যদি থামল, শুরু হল কান্না। ম্যাকডোনাল্ডের মনে হচ্ছে ঠিক তাঁর সমুখে, আট-দশ ফুটের মধ্যেই কেউ একজন গলা টিপে হত্যা করছে অন্য কোনো একজনকে, এ-কান্না সেই মুমূর্ষুর।

টর্চ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গোটা বাড়িটাই দেখলেন ম্যাকডোনাল্ড, কেউ কোথাও নেই। নেই কেউ। জনমানবের অস্তিত্ব নেই ধারে-কাছে।

অবশেষে কান্না থেমে গেল। ম্যাকডোনাল্ডও বাড়ি ফিরে গেলেন। কান্না শুনেছেন, কিন্তু মানুষ খুঁজে পাননি, তাতে কী? হয়তো এমন কোনো জায়গা আছে তাদের এসব কোনো বদমাইশ দলের কুকাণ্ড। খুঁজে পাওয়া যায়নি, তা সত্ত্বেও ভূতে অবিশ্বাস এখনও তাঁর অক্ষুণ্ণ। নিশ্চয় লুকোবার কোনো জায়গা আছে যে-জায়গার পাত্তাই পাননি তিনি।

তবু প্রশ্ন জাগে অনেক। বেছে বেছে পূর্ণিমা রাতেই গোলমালটা হয় কেন? বদমাইশের দল হলে তাদের তো বরং অন্ধকার রাতেই সক্রিয় হবার কথা। আর বদমাইশ দলই যদি হবে, স্রেফ হেসে আর কেঁদে তাদের লাভ কী? অন্য কোনো উৎপাত তারা কোনো লোকের উপরে করেছে বলে তো শোনা যায়নি কোনোদিন!

প্রশ্ন অনেক। ম্যাকডোনাল্ডের চিন্তাও অনেক। কিছুতেই ভাঙা বাড়ির ওই হাসি-কান্নার কথা তিনি ভুলতে পারেন না। বিশেষত, পূর্ণিমার অব্যবহিত আগে তিনি যেন পাগল হয়েই যান। ‘এবার ধরবই ওদের। প্রাণ যায় তাও স্বীকার, কিন্তু ধরবই।’ বৃথা পণ। প্রাণ তাঁর যায় না। কিন্তু ধরতেও পারেন না কাউকে।

প্রাণ যায় না, কিন্তু মাথা বুঝি খারাপ হয়ে যায়। নিজেকে বোঝান, অত্যধিক গরম এ দেশে। দীর্ঘদিন স্পেনে বাস করলে ঠান্ডা দেশ স্কটল্যান্ডের লোকের মাথার গোলমাল হওয়া স্বাভাবিক। ম্যাকডোনাল্ড ছুটি নিয়ে গ্লাসগোতে যাবার জন্য তৈরি হলেন। জিব্রালটার থেকে জাহাজে উঠবেন। বন্দরের কাছাকাছি এক হোটেলে তিনি রাত্রিযাপন করছেন। রাতদুপুরে হঠাৎ তাঁর ঘুম ভেঙে গেল একটা অট্টহাসির আওয়াজে। তিনি ধড়মড় করে উঠে বসলেন বিছানাতে। সেই হাসি! সেই কান্না! এক-শো মাইল তাঁর পিছু পিছু তাড়া করে এসেছে সেই হাসি! সেই কান্না! ঠিক তো? আজকের রাতটা তো পূর্ণিমার রাতই বটে!

বদমাইশ? না ভূত? ম্যাকডোনাল্ড ভৃত্যদের ডাকাডাকি করে এনে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘একটা হাসি শুনেছ? কিংবা একটা কান্না?’

‘না তো!’ অত্যন্ত অবাক হয়েছে তারা প্রশ্ন শুনে।

গ্লাসগোতে যখন পৌঁছোলেন ম্যাকডোনাল্ড, তখন তিনি বদ্ধউন্মাদ। কখনো আকাশ ফাটিয়ে হেসে উঠছেন, কখনো-বা কেঁদে উঠছেন ডুকরে ডুকরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *