চশমা

চশমা

আবার চশমা গেল মিনতির।

তক্তাপোষের এক কোনায় রাখা ছিল। হাতের ধাক্কায় পড়ল মেঝেতে। একটা লেন্সে চিড় খেল, আরেকটা হল তিন টুকরো। শুধু লেন্স গেলে একটা কথা ছিল, ফ্রেমেরও দফারফা হয়েছে। বাঁদিকের ডাণ্ডি ভেঙেছে। সস্তার জিনিস অল্প আঘাতেও ভেঙে যায়।

এই নিয়ে তিনমাসে দু’বার। একবার ভাঙল, একবার হারাল। যে পরিবারের টানাটানিতে দিন চলে, যে পরিবারে মাসের শেষ দিন’কটা শুধু ডাল-ভাতে সন্তুষ্ট থাকতে হয়, যে পরিবারে ডাক্তার বদ্যি দেখাতে হলে দু’বার ভাবতে হয়, সেখানে এভাবে চশমা যাওয়া বড় অপরাধ।

মিনতি ভয়ে কেঁপে ওঠে। সন্তোষ অফিস থেকে ফিরে খবরটা জানলে তুলকালাম করবে। করাই উচিত। বউ যদি এমন অলক্ষ্মী হয় তাহলে তুলকালাম করাটা অন্যায় নয়। বরং উচিত কাজ। মিনতি ছ’বছরের শিশু নয়, তার বয়স বত্রিশ। দুই মাস বেশি বত্রিশ। টানাটানির সংসারে মেয়েদের বত্রিশ মানে অনেক বয়স। ‘বুড়ি’ই বলা যেতে পারে। বড়লোক হলে শরীর চর্চা, ত্বক চর্চা, চুল চর্চা করে বয়স আটকে রাখা যায়। অভাবের সংসারে হয় না। বয়স আসে ভূতের মতো চুপিসাড়ে। কোথা থেকে যে কখন এসে ঘাড়ে চেপে বসল বোঝা যায় না।

সন্তোষ কাজ করে ছোট অফিসে, সেখানে মাইনেপত্তর ছোট। সংসারে বুঝেসুঝে চলতে হয়। বাড়তি তো দূরের কথা, এক বিন্দু অপচয় সম্ভব নয়। পারলে ছেঁড়া কাগজটুকুও তুলে রাখতে হয়।

মিনতি উবু হয়ে বসে। ছলছল চোখে ভাঙা চশমার টুকরো একটা একটা করে মেঝে থেকে তুলতে লাগল। চশমা চলে যাওয়ার জন্য তার যতটা না মন খারাপ, তার থেকে বেশি মন খারাপ স্বামীর বকাঝকার কথা ভেবে। গতবার চশমা হারানোর পর সন্তোষ একটানা তিনদিন বকেছিল। পারলে মারত। নেহাত ওই অভ্যেসটুকু নেই। তবে বকুনিতে কোনও রাখঢাক রাখেনি।

‘নিজেরে ভাব কী? কী ভাব? অ্যাঁ! রাজনন্দিনী?’

মিনতি মিনমিন করে বলেছিল, ‘আমি তো সব জায়গাতেই খুঁজেছি। মুদি দোকান, যশোদাদির বাড়ি, কাঞ্চনের সেলাইয়ের কারখানায় পর্যন্ত গেছি। ওই পথে আসবার সময় যদি ভুল করে ফেলে আসি। কে যে নিয়ে গেল!’

‘ব্যাঙের মাথা করেছ। চশমা কি ছাতা যে অন্য লোকে নিয়ে যাবে?’

মিনতি বিড়বিড় করে বলে, ‘তা কি বলেছি? আমি তো ইচ্ছে করে হারাইনি।’

সন্তোষ তেড়েফুঁড়ে উঠে বলে, অবশ্যই ইচ্ছে করে হারিয়েছ। যার নিজের দু’পয়সা আয় রোজগারের মূল্য নেই তার কিছু হারানো মানে ইচ্ছে করেই হারানো। তাও বুঝতাম যদি বাপের বাড়ি থেকে নতুন একটা নিয়ে আসতে। স্বামীর রোজগারে ফুটানি কর।’

মিনতির অপমান হয়। চোখ ফেটে জল আসে। নিজেকে কোনোরকমে সামলায়। মাথা নামিয়ে বলে, ‘থাক, আমার চশমা লাগবে না।’

সন্তোষ ডান হাত তুলে বলে, চুপ। একদম চুপ। চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিতে হয়। লাগবে না বললে কি যেটা হারিয়েছ সেটা ফিরে আসবে? টাকাগুলো তো জলে গেল।’

মিনতি আর পারে না। আঁচল তুলে চোখ মোছে।

সন্তোষ নিজের মনেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘দেখতে কালোকুলো। বিয়ের সময় দিতেও পারেনি কিছু। মেয়ে যে চোখে দেখে না, কানে শোনে কে জানত। ঘাড়ে গছানোর সময় একবার বলেও নি।’

কানে না শুনতে পাওয়ার কথাটা ঠিক নয়, তবে সেই ছোটোবেলা থেকে চোখে পাওয়ার মিনতির। তবে বাড়াবাড়ি কিছু নয়। কাছেরটা ঝাপসা লাগে। চাল-ডাল বাছাবাছিতে সমস্যা হয়। তাছাড়া আর একটা অভ্যেস রয়েছে মিনতির। অভ্যেস না শখ? গোপন শখ। সে বই পড়ে। লুকিয়ে পড়ে। বর যখন দুপুরবেলা অফিসে চলে যায় সেই সময় ঘরের কাজ সেরে বই নিয়ে গুছিয়ে বসে। পাড়ার লাইব্রেরিতে মেম্বার। সপ্তাহে তিনটে করে বই আনে। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনি। লক্ষ্মীর ভাঁড়ে জমানো পয়সা থেকে চাঁদা দেয়। বর জানলে সর্বনাশ হবে। বইয়ের পিছনে সময় আর পয়সা নষ্ট! তাও আবার মেয়েমানুষের শখ। হতেই পারে না। ছোটবেলা থেকেই মিনতির বই পড়বার অভ্যেস। বিয়ের পর ছেড়ে দেব ভেবেছিল। পারেনি। বই এনে লুকিয়ে রাখে। সন্তোষের চোখে যেন না পরে। কে জানে কী দক্ষ যজ্ঞ বাঁধিয়ে তুলবে। বই পড়তেও চশমা লাগে মিনতির। নইলে কিছু পরেই অক্ষরে অক্ষরে জড়িয়ে যায়। একটা লাইনের ওপর লাইন যেন উঠে আসে।

এখন কী হবে?

যা খুশি হোক, আগে তো বরের বকুনি থেকে বাঁচতে হবে। মিনতির কোনো চশমাই দামি নয়। হওয়ার কথাও নয়। একেবারে সস্তার প্রেম। গতবারেরটা তাও ছিল, এবার তো আরও সস্তার। লেন্সের পাওয়ারটুকু ঠিক থাকলেই হল। মিনতি ভাঙা চশমার টুকরোগুলো হাতে তুলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। জোড়াতাপ্পি দিয়ে কিছু করা যাবে? আঠা লাগিয়ে? সুতো দিয়ে বেঁধে? না, যাবে না। কাচ দুটোই গেছে। তারপরেও টুকরোগুলো কাগজে মুড়ে রাখল মিনতি। ঠিক করল, এই ঘটনা সন্তোষকে বলবে না। লাগবে না তার চশমা।

মিনতি বলেনি। তিনদিন খেয়াল করেনি সন্তোষ। অন্যমনস্ক ছিল। তার অফিসে কী যেন ঝামেলা চলছে। মেজাজটাও ছিল খিটখিটে। চতুর্থদিন খেতে বসে মুখে কাঁকর পড়ল। সস্তার চালে কাঁকর থাকাটাই স্বাভাবিক। তারপরেও মিনতি বাছাবাছি করে যতটা পারে সামলায়।

‘মিনতি ভাতে এত বড় কাঁকর কেন?’

মিনতি থতমত খেয়ে বলে, ‘চালটা ভালো নয়…।’

সন্তোষ হুংকার দিয়ে বলল, ‘শ্বশুরমাশাই তো আমাকে মাসে মাসে গোবিন্দভোগ পাঠিয়ে দেন না যে চাল ভালো হবে। বরের যেমন আয় তেমন চালই খেতে হবে।’

মিনতি বলে, ‘আমি তো চাল বেছেছি…কাঁকরও ফেলেছি অনেক…।’

সন্তোষ আরও জোরে হুংকার দেয়, ‘চোখের মাথা খেয়েছ নাকি?’

বলতে গিয়ে থমকে যায়। বউয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে থমথমে গলায় বলল, ‘চশমা কোথায়?’

মিনতি চমকে ওঠে। বলে, ‘পরিনি।’

‘কেন পরনি? চশমা ছাড়া চাল বাছলে তো কাঁকর থাকবেই। বরকে মারতে চাও?’

মিনতি বলে, ‘আচ্ছা কাল থেকে পরব।’

সন্তোষ খাওয়া বন্ধ করে বলে, ‘পরব নয়। এখন থেকেই পরবে। নিয়ে এসো চশমা।’

মিনতি ফ্যাকাশে মুখে বলে, ‘বলছি তো পরব।’

সন্তোষ চোখ সরু করে হিসহিসে গলায় বলে,’কী হয়েছে ঠিক করে বলো তো। চশমা কোথায়? আবার হারিয়েছ?’

মিনতি মাথা নামিয়ে বলে, ‘না, ভেঙে গেছে।’

সন্তোষ দিগ্‌বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ডালের বাটি থেকে হাতাটা তুলে ছুঁড়ে দেয়। মিনতির ডান চোখের খানিকটা নিচে এসে লাগে। গলগল করে রক্ত বেরোতে থাকে। মিনতি দুহাতে মুখ চাপা দেয়।

ওই যে দুজন তক্তাপোষের ওপর বসে আছেন পাশাপশি। দুই বুড়োবুড়ি। জানলা দিয়ে পৌষ মাসের রোদ এসে পড়েছে তাদের পায়ের ওপর। বুড়ির কোলে একটা বই। বুড়ি পড়া থামাল। বই সরিয়ে, চোখে ঝুলে থাকা গোল চশমাটা খুলল।

‘কী হল থামলে কেন? গল্প শোনার নেশা ধরিয়েছ যখন, এখন সামলাতে হবে। থামলে তো চলবে না।’

বুড়ি বলল, ‘এবার তুমি নিজে পড় দেখি। সংসারের কাজ রয়েছে না?’

বুড়ো একটা হাত বাড়িয়ে বুড়ির হাতের ওপর রাখে।

‘আমি কী বই পড়ব! আমি কি চোখে দেখতে পাই?’

বুড়ি বলল, আমার চশমাটা নাও, যেটুকু দেখতে পাও তাতেই হবে।’

বুড়ো নরম গলায় বলল, ‘দরকার কী? তোমার চোখই তো এখন আমার চোখ। তুমি দেখলেই এখন আমার দেখা। এই বয়েসে আবার আলাদা দেখা লাগে নাকি? আমাদের একটাই চশমা।

বুড়ো হেসে ওঠে। বুড়ির চোখ চিকচিক করে ওঠে। সে আবার কোলের ওপর বই টেনে নেয়।

এই বুড়োবুড়িকে আমরা চিনি। সন্তোষবাবুর বয়স এখন আশি বছর। মিনতিদেবী তো বাহাত্তর পেরিয়েছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *