চশমা চোর – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

চশমা চোর – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

হাবুলমামা বৃদ্ধ

পল্টন ওঁর ভাগনে। বয়স ১৫-১৬

কিরীটি রায় গোয়েন্দা

ফেলুদা ,,

ঘনাদা ,,

টেনিদা ,,

হাবুল টেনিদার দুই সঙ্গী

প্যালা ,,

সন্ন্যাসী ,,

বিচারক ,,

প্রথম দৃশ্য

[ হাবুলমামার বাইরের ঘর, ঘরের একদিকে একটা টেবিল, টেবিলের দু-পাশে কয়েকটা চেয়ার। দেওয়ালে টাঙানো একটি ঘড়ি। মঞ্চের একদিক থেকে অন্ধদের মতো হাতড়াতে হাতড়াতে এক প্রায় বৃদ্ধের প্রবেশ। পরনে ফতুয়া ও খাটো ধুতি ]

হাবুলমামা। ওরে ও পল্টন, পল্টন রে, আর কত ঘুমুবি, অ্যাঁ! এদিকে তো সকালের রোদ থইথই করছে। ঘড়িতে পাঁচটা বেজে উনচল্লিশ। তুই ওদিকে নাক ডাকিয়ে দেদার ঘুমোচ্ছিস? এদিকে আমার সাড়ে সব্বোনাশ।

[ হাবুলমামা হাতড়াতে হাতড়াতে ঘুরে বেড়াতে থাকেন মঞ্চের ওপর। টেবিলের কাছে গিয়ে একটা চেয়ারে পা বেধে পড়ে যাচ্ছিলেন আর কি ]

হাবুলমামা। ও পল্টন, পল্টন রে, ওরে আবার যে সন্ধে রাত্তির হয়ে এল। ঘড়িতে পাঁচটা একচল্লিশ। এত ঘুমুলে কি চলে?

[ চোখ মুছতে মুছতে পল্টনের প্রবেশ। পরনে টি-শার্ট আর হাফপ্যান্ট ]

(নিচু হয়ে পল্টনকে পরখ করতে করতে-) কে? সদাশিববাবু নাকি? এত সকালে আপনি? কী সৌভাগ্য, কী সৌভাগ্য। কতদিন আপনার পদধূলি আমার বাড়িতে পড়েনি। আসুন, আসুন, বসুন এখানে-

পল্টন। কী যে সব আজেবাজে বকছ মামা। আমাকে দেখে কি তোমার সদাশিববাবু মনে হল? সদাশিববাবুর গড়ের মাঠের মতো পেল্লাই টাক। সেই টাকের ওপর মাছি বসলেও মাছির পা স্লিপ করে। তেত্রিশ মাইল দূর থেকেও সদাশিববাবুর চকচকে টাক চেনা যায়। আর আমাকে দেখে কিনা তোমার মনে হল-

হাবুলমামা। (নিচু হয়ে পল্টনের চুলভরতি মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে) তাই বল, তুই হতচ্ছাড়া পল্টন। ভোঁস ভোঁস করে নাক ডাকিয়ে বেলা এগারোটা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছিস! আর এদিকে আমি সর্বস্বান্ত হওয়ার পথে।

পল্টন। বেলা এগারোটা! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একবার দেখেছ! মোটে পাঁচটা উনপঞ্চাশ। রাত ভালো করে ফরসাও হয়নি। তোমার রাতে ঘুম হয় না বলে শেষ রাতে উঠে পড়ো। তারপর সারা বাড়ির লোককে জাগিয়ে তুলবে। (কিছুক্ষণ থেমে হাবুলমামার মুখে কী যেন নিরীক্ষণ করে) কিন্তু কী ব্যাপার বলো তো মামা! ঘরে জলজ্যান্ত একটা ঘড়ি থাকতে তুমি ভোর পাঁচটা উনপঞ্চাশের জায়গায় বেলা এগারোটা দেখছ! আবার আমাকে চোখের সামনে দেখেও মনে হচ্ছে আমি তোমার বন্ধু সদাশিববাবু! ব্যাপারটা কী বলো তো? বাহাত্তর বছর হতে তোমার তো এখনও একবছর সাত মাস সতেরো দিন বাকি। এই তো পরশুই হিসেব করে বললে। তার আগেই কি তোমাকে ভীমরতিতে ধরল! না কি কানা হয়ে গেলে চোখে!

হাবুলমামা। শেষেরটাই কিন্তু ঠিক বলেছিস, পল্টন। সকালে ঘুম ভেঙে উঠেই চশমাজোড়া কোথায় গেল তা আর খুঁজে পাচ্ছি না। তারপর থেকে একের পর এক অঘটন। তোর মামিকে দেখে বললাম তুমি একটা ডটপেনের মতো সরু ছিলে, তোমার হঠাৎ এরকম কুমড়োপটাশের মতো চেহারা হল কী করে! তা শুনে তোর মামি আমাকে একটা ডিকশনারি নিয়ে তাড়া করে এল মারতে। পালিয়ে আর পথ পাইনে। তারপর শুনলাম ওটা ডিকশনারি ছিল না, তোর মামির মাথার বালিশটা।

পল্টন। ও তাহলে এই ব্যাপার? তা চশমাজোড়া বললে কেন? তুমি কি একসঙ্গে দুটো চশমা পরতে নাকি?

হাবুলমামা। না রে, হতভাগা। দুটো চশমা পরব কেন? দু-চোখে চশমা পরতে হয় বলেই তো চশমাজোড়া বলে। যেমন জুতোজোড়া।

পল্টন। তাই বলো। কিন্তু চশমাটা গেল কোথায়? তুমি চোখে চশমা না পরলে আমি তো সারাদিন তোমার চোখে সদাশিববাবু হয়ে বিচরণ করতে থাকব! সে বড়ো বিশ্রী ব্যাপার। আমার মাথায় ঠকঠক করবে টাক। নাকের নীচে বুরুশের মতো গোঁফ। হাতে একটা বাহারি ছড়ি, ধুতির কোঁচা লুটোবে মাটিতে, হি হি হি হি হি হি-

হাবুলমামা। দূর হতভাগা, হাসছিস যে বড়ো! এদিকে আমার সব্বোনাশ, আর ওদিকে তোর কিনা পৌষমাস! চশমাটা কী করে পাওয়া যায় তার খোঁজ করার নাম নেই-

পল্টন। তাহলে পুলিশ-ফুলিশে খবর দেব! তোমার চশমা তো হারাবার কথা নয়। যা হাড়কেপ্পন মানুষ তুমি। অমনি অমনি তো তোমার কাছ থেকে চশমা খোয়া যাবে না। নির্ঘাত কেউ চুরি করে সটকেছে।

হাবুলমামা। (কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে) তুই বলছিস চুরি হয়ে গেছে চশমাটা!

পল্টন। নির্ঘাত। এ-বিষয়ে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই।

হাবুলমামা। এ হে হে। তাহলে কী হবে? এ তো শুধু সব্বোনাশ নয়, ডবল সব্বোনাশ! আমি যে একেবারে পথে বসে যাব!

পল্টন। আমি থাকতে তুমি পথে বসবে কেন মামা! এক্ষুনি তার ব্যবস্থা করছি, পুলিশ-ফুলিশে খবর দিলেই দেখবে, অমনি সুড়সুড় করে তোমার চশমাজোড়া লাফিয়ে এসে জড়িয়ে ধরবে তোমার চোখজোড়া।

হাবুলমামা। না, না, না। ওসব পুলিশ-ফুলিশে আমার বিশ্বাস নেই। পুলিশরা সব ফুলিশ হয়। রাম যদি চোর হয় ধরে আনবে শ্যামকে। তারপর হয়তো মাল পাওয়া যাবে যদুর ঘরে। আর জেল খাটবে মধু।

পল্টন। তাহলে গোয়েন্দা?

হাবুলমামা। গোয়েন্দা!

পল্টন। হ্যাঁ। তোমার চোখ থেকে চশমা চুরি যাওয়া মানে যে-সে ব্যাপার নয়। তুমি ঠিকই বলেছ মামা, এটা ফুলিশদের কর্ম নয়। ডাকতে হলে গোয়েন্দা ডাকতে হবে।

হাবুলমামা। (থম হয়ে ভাবলেন) কাকে ডাকবি বল দেখি? দেশে ভালো গোয়েন্দা আছে?

পল্টন। কেন? কিরীটি রায়! একেবারে ঝানু গোয়েন্দা। কেসের বর্ণনা শুনতে না শুনতে তিনি মানসচক্ষে দেখতে পান কালপ্রিটের মুখ।

হাবুলমামা। সেই ভালো। তাহলে এক্ষুনি ডাক। তোর মামি ঠাকুরঘরে পুজো করতে গেছে। একটু পরেই নামবে। তার টিকটিকির মতো রোগা শরীরকে হয়তো হাতির মতো দেখবখন। তখন আবার আরেক কেলেঙ্কারি।

পল্টন। ঠিক আছে। এখনই ধরে আনছি কিরীটি রায়কে।

[ পল্টনের প্রস্থান

[ হাবুলমামা হাতড়াতে হাতড়াতে মঞ্চে পায়চারি করতে থাকেন। একটু পরেই চোখে কালো চশমা, মাথায় চৌকো টুপি পরে লম্বা-চওড়া কিরীটি রায়ের প্রবেশ ]

পল্টন। এই যে মি. রায়। ইনিই হলেন আমার মামা শ্রী শ্রী হাবুলচন্দ্র হর্ষবর্ধন থুড়ি রায়বর্ধন।

কিরীটি রায়। (ব্যস্তভাবে ঘরের এ-পাশ ও-পাশ ঘুরে দেখতে দেখতে) হুঁ, তা কোথায় ঘটল ঘটনাটা? এই ঘরে, না ভেতরের কোনো ঘরে! কোনো সূত্র-টুত্র রেখে গেছে তো?

হাবুলমামা। মনে তো হচ্ছে না কোনো সূত্র রেখে গেছে। আপনি গোয়েন্দা আপনাকেই খুঁজে বার করতে হবে সূত্র।

কিরীটি রায়। তা লোকটা দেখতে কেমন? বেঁটে, না লম্বা? ক-ফুট ক-ইঞ্চি?

হাবুলমামা। অ্যাঁ? মানে?

কিরীটি। ফরসা, না কালো? রোগা, না মোটা? টেকো, না চুলঅলা?

পল্টন। এই তো খুব মুশকিলে ফেললেন, মি. রায়। মামা এখন রোগাকে মোটা দেখছেন। মোটাকে রোগা। চুলওলাকে টেকো দেখছেন, টেকোকে চুলওলা। বেঁটেকে লম্বা, লম্বাকে বেঁটে।

কিরীটি। সে কী! তাহলে তো খুব দুর্ভাবনার বিষয়। যে মার্ডারার সে বহাল তবিয়তে চোখের সামনে ঘুরে বেড়াবে, আর যে নির্দোষ তার হাতে পড়বে পুলিশের হাতকড়া। যাই হোক, কোন ঘরে ঘটনাটা ঘটল? ডেডবডি কোথায়? হত্যাকারী কখন ঢুকে ছিল ঘরে? দিনে, না রাতে?

হাবুলমামা। ডেডবডি! হত্যাকারী? এসব কী বলছেন আপনি?

কিরীটি। ঠিকই বলছি। জানতে চাইছি কোন ঘরে মার্ডারটা হল? নিশ্চয়ই বেডরুমে? রাত্রির তৃতীয় প্রহরে যখন সমস্ত শহর নিস্তব্ধ?

হাবুলমামা। আজ্ঞে না। মার্ডার-টার্ডার কোনো কিছুই ঘটেনি এখানে। হারিয়েছে আমার চশমাজোড়া।

কিরীটি। চশমাজোড়া!

হাবুলমামা। হ্যাঁ। আমার চশমাজোড়া সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। নিশ্চয়ই চুরি করেছে কেউ। হারানো চশমা উদ্ধারের জন্যই আপনাকে ডাকা হয়েছে।

কিরীটি। বলেন কী, মশাই? সামান্য একটা চশমা চুরি গেছে বলে আমার মতো একজন বিখ্যাত গোয়েন্দাকে কল দিয়েছেন আপনারা? হোপলেস! আপনারা কি জানেন না রোমহর্ষক কোনো মার্ডার কেস ছাড়া আমি তদন্ত করতে নামি না! তাও যদি কলকাতায় বেড়াতে এসে গোয়ালিয়রের রাজকুমারীর হিরের নেকলেস অথবা কুচবিহারের রাজবধূর জড়োয়া গয়না চুরি যেত, সেসব কেসও হাতে নেওয়া যায়। তাই বলে চশমা-চুরির কেস। ছোঃ, ছোঃ, শুধু শুধু আমার সময় নষ্ট করলেন। কই, দিন আমার ফিসটা, চলে যাই। প্রথম কল সাড়ে সাত হাজার।

হাবুলমামা। ফিস? কেন, গোয়েন্দারা কি ডাক্তার নাকি যে রোগী দেখতে এসে তার গলা কেটে নিয়ে চলে যাবে! হুঁ, হত যদি শার্লক হোমস, তাহলে ঘরে ঢুকেই শুধু চুরুটের গন্ধ শুঁকে কিংবা ঘরের কোণে মাকড়সার জাল সদ্য ছেঁড়া দেখেই মুহূর্তে ধরে দিতেন বমালসুদ্ধ চোর।

কিরীটি। (রেগেমেগে) হুঁ! ননসেন্স।

[ প্রস্থান

পল্টন। ও মামা। কিরীটি রায়কে দিয়ে হবে না। ডাকতে হবে ফেলুদাকেই। এখন ফেলুদাই বেশি বিখ্যাত। যা চ্যাম্পিয়ন ব্রেন না! দেখবে, ঘরে ঢুকেই অমনি-

হাবুলমামা। সে তুই যাকে ভালো মনে করিস তাকেই ডাক, আমার এখন শিরে সংক্রান্তি। একটু পরেই বাজারে যেতে হবে। হয়তো শিঙিমাছকে ইলিশমাছ ভেবে কিনে নিয়ে আসব। তখন তোর মামি যা রাগে লাফাবে!

পল্টন। (শশব্যস্ত হয়ে) তাহলে তো ফেলুদাকে এক্ষুনি ডেকে আনতে হয়-

[ প্রস্থান

[ কিছুক্ষণ পরেই ফেলুদাসহ পল্টনের প্রবেশ ]

পল্টন। এই যে মামা, ইনিই সেই বিখ্যাত গোয়েন্দা, দি গ্রেট ফেলুদা। তোমার চশমা রহস্য ইনি নিশ্চয়ই ভেদ করতে সমর্থ হবেন।

ফেলুদা। হ্যাঁ, অনেকদিন হাতে কোনো জটিল কেস নেই। হ্যাঁ, বলুন তো ঘটনাটা কী? পল্টনবাবুর সঙ্গে কথা বলে মনে হল কোনো একটা বড়ো স্মাগলারদের দল এই রহস্যের পেছনে আছে।

হাবুলমামা। তা ব্যাপারটা একেবারে অসম্ভব কিছু নয়। আপনি মনে হচ্ছে ব্যাপারটা ধরতে পেরেছেন।

. . . চিরিমিরি?

ফেলুদা। হ্যাঁ, এসব কেস আমার কাছে নস্যি। নাকের ওপরই চশমাটা থাকে কিনা। এক টিপ নস্যি নেওয়ার মতোই জলবৎ তরল; বাতলে দেব স্মাগলারদের ঠিকানা। তাহলে আমরা কোন ট্রেনে রওনা দিচ্ছি?

হাবুলমামা। ট্রেনে রওনা দিচ্ছেন মানে?

ফেলুদা। আমি তোপসেকে বলে এসেছি, লালমোহনবাবুকে বাকসোপ্যাঁটরা রেডি করতে, শুধু মাফলার সোয়েটার কোট নেবেন কি না সেটুকু বলিনি, কারণ ঘটনাটা কোথায় ঘটেছে তা এখনও জানতে পারিনি। চিরিমিরিতে হলে ভালো হয়, না হলে চেরাপুঞ্জি।

হাবুলমামা। ব্যাপারটা আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। শুধু চিররররর শব্দ হচ্ছে।

ফেলুদা। সে তো আপনাদের মতো নিরেট মাথার লোক এসব জটিল রহস্যের কিছুই বুঝবে না। তাহলে আর ফেলুদার জন্ম হয়েছে কেন? এখন চটপট করে বলুন, কোথায় রওনা হতে হবে আমাদের? চেরাপুঞ্জি না হয়ে চিরিমিরি হলে ভালো হয়। চেরাপুঞ্জিতে আবার বৃষ্টি বেশি। তদন্ত করতে ভয়ানক অসুবিধে। তার চেয়ে চিরিমিরিতে চশমা চুরি এরকম একটা নাম পেলে লালমোহনবাবু বেশ জম্পেশ করে নামিয়ে দেবেন কাহিনিটা। কিন্তু চিরিমিরিটা কোন দিকে ঠিক বলুন তো?

হাবুলমামা। চিরিমিরি?

ফেলুদা। হ্যাঁ চীন আর মিশরের মাঝামাঝি কোথাও হবে হয়তো। তাহলে তো ট্রেনে যাওয়া যাবে না। প্লেনেই যেতে হবে। দিন, তিনজনের প্লেনভাড়া প্লাস সাত দিনের রাহা খরচ।

পল্টন। আজ্ঞে, ফেলুদা। ঘটনাটা তো এই শহরেই ঘটেছে। এই বাড়িতেই।

ফেলুদা। সে কী, মশাই? ওরে তোপসে, কোথায় গেলি? তোপসে না থাকলে আমার সব যেন কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়। না মশাই, কলকাতার কোনো কেস আমি হাতে নিই না। দূরের কোনো শহরে তদন্ত করতে যাই বলেই তো লালমোহনবাবু -কৈলাসে কেলেংকারি-, -গ্যাংটকে গণ্ডগোল’, কিংবা -যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে- লিখতে পারেন।

পল্টন। তাহলে কী হবে?

ফেলুদা। আপনারা বরং ঘনাদাকে দিয়ে ট্রাই করুন। ঘনাদা তো কলকাতার রকে বসেই ভূ-ভারত পর্যটন করতে পারেন। তারপর অদ্ভুত অদ্ভুত সব গল্প শুনিয়ে মাত করে দেন সবাইকে। চলি। আমি বরং গিয়ে ফোন করে দিচ্ছি ঘনাদাকে, ঘনাদা, মানে ঘনশ্যামবাবু এলেই দেখবেন-

[ প্রস্থান

হাবুলমামা। ও পল্টন। এ তো বড়ো মুশকিলে পড়া গেল! ফেলুদার মতো বড়ো গোয়েন্দাও কিনা ফেল মেরে গেল আমার চশমা উদ্ধার করতে এসে?

পল্টন। তবেই বোঝো, মামা। এ হচ্ছে দরজি পাড়ার বিখ্যাত শ্রী হাবুলচন্দ্র হর্ষবর্ধন থুড়ি রায়বর্ধনের চশমা। এত চট করে কি সেই চশমাজোড়া খুঁজে পাওয়া যায়!

[ ঘনাদার প্রবেশ। রোগা হাড়গিলে চেহারা। মাথার চুল উসকোখুসকো ]

ঘনাদা। কেন! চশমা খুঁজে পাওয়া কি একটা সমস্যা হল! নিশ্চয়ই আপনার ক্যালকেশিয়ান ব্যারাম আছে।

হাবুলমামা। কী বললেন শব্দটা। অ্যালসেশিয়ান? না, না। আমার বাড়িতে কোনো অ্যালসেশিয়ান নেই।

ঘনাদা। (চটেমটে) তাহলে তো আপনার চোখের ব্যারামের সঙ্গে কানের ব্যারামও আছে দেখছি। নিশ্চয়ই রোগটা ক্যালকেশিয়ান।

পল্টন। সেটা আবার কী, ঘনাদা?

ঘনাদা। এটা একটা ল্যাটিন নাম। এই রোগে ধরলে প্রথমে তার চশমা হারায়। তারপর চোখে অদ্ভুত অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে শুরু করে। কানেও সব অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসে। তাতে ক্যালকেশিয়ান শুনতে অ্যালসেশিয়ান শোনে। তাই না!

পল্টন। একজ্যাকটলি, ঘনাদা। আপনি যা ডায়াগনসিস করেছেন সব ঠিকঠিক মিলে যাচ্ছে হাবুলমামার সঙ্গে। এই যেমন এখন আপনাকে নিশ্চয়ই কুম্ভকর্ণের মতো ইয়া মোটা দেখবেন মামা।

ঘনাদা। বলেন কী মশাই! শুনেই যে আমার খিদে-খিদে পেয়ে যাচ্ছে। যাক গে, এখন খাওয়ারও টাইম নেই। যে-কথা হচ্ছিল, তা হল রোগটা তাহলে হিপোপটেমাস হিপ হিপ বাপ বাপ ক্যালকেশিয়ান।

হাবুলমামা। ও বাবা, এ তো শুনেই আমার বুকের ভেতরটা ধড়ফড় ধড়ফড় করছে! কী যেন নাম বললেন-

ঘনাদা। তাহলে তো আপনার বুকের ব্যামোও আছে মনে হচ্ছে!

হাবুলমামা। আজ্ঞে না, ছিল না। এইমাত্র হল। ওই যে অ্যালসেশিয়ান না কী যেন বললেন-

ঘনাদা। নাহ, আপনার দেখছি শুধু চোখ থেকেই সর্বশরীরে ব্যামো ছড়িয়েছে। এ সেই আলাস্কা উপসাগরের ঘটনাটা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে। সে যে কী সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা!

হাবুলমামা। (চমকে উঠে) কী অভিজ্ঞতা!

ঘনাদা। সে তো ওয়ান্ডারফুল, ভয়াবহফুল এক্সপিরিয়েন্স। সেবার হঠাৎ ইচ্ছে হয়েছিল আলাস্কা উপসাগরের জলে স্কি খেলব।

পল্টন। জলে স্কি খেলবেন? খেলা যায় নাকি ঘনাদা?

ঘনাদা। ওই, মশাই, কথা বলার সময় এত বাধা সৃষ্টি করলে কিছু বিস্তৃত করে বলা যায় না। খেই হারিয়ে যায়। আলাস্কা উপসাগর সারা বছর জমাট বরফে ঢাকা থাকে। সাদা ধবধব করে তার ওপরটা। দেখলেই মনে হয় স্কি খেলতে নামি। তা সেবার আমার সঙ্গে ছিলেন দুই বিশ্ববিখ্যাত স্কিয়ার- একজন পর্তুগালের ম্যানুয়েল দ্য অলিভিয়েরা, অন্যজন ফ্যান্সের জাঁ চার্লস রুয়াউলট। তো আলাস্কা মাউন্টেন থেকে দীর্ঘ সতেরো কিলোমিটার পথ স্কি করতে করতে অতিক্রম করে আলাস্কা উপসাগরে নেমে আসা-সে যেন এক আশ্চর্য বিস্ময়!

পল্টন। এতটা পথ স্কি খেলতে খেলতে এলেন? খুব স্ট্যামিনা কিন্তু আপনার!

ঘনাদা। তবে আর বলছি কী? তিনজনে একসঙ্গে রওনা দিলাম। কিন্তু শেষমেশ আলাস্কা উপসাগরে পৌঁছোল এই একমাত্র শর্মা- ঘনশ্যাম।

পল্টন। সে কী! বাকি দুজন তাহলে কোথায় গেল?

ঘনাদা। সেইটেই তো পরম আশ্চর্য। তখনই আবার রিভার্স পথ ধরে যাত্রা শুরু করলাম। কিন্তু জানেনই তো, জীবনে নামার পথ যত মসৃণ, ওঠার পথ ততই বন্ধুর।

পল্টন। তারপর?

ঘনাদ। তারপর উলটো পথে যাত্রা শুরু করে চড়াই পথ ভাঙতে থাকি। আট কিলোমিটার চড়াইয়ের পর দেখি বরফের ওপর একটা টুপি ভেসে আছে। দেখেই বুঝতে পারি পর্তুগালের ম্যানুয়েল দ্য অলিভিয়েরার বরফসমাধি হয়েছে।

হাবুলমামা। কী সর্বনাশ! তারপর?

ঘনাদা। আরও চার কিলোমিটার খাড়াই বেয়ে উঠে দেখি একটা চশমা পড়ে আছে। বুঝলাম ফ্রান্সের জাঁ চার্লস রুয়াউলটেরও একই পরিণতি।

পল্টন। সে কী! দুটো মানুষ জলজ্যান্ত বরফে ডুবে গেল, আর তাদের টুপি আর চশমা জেগে আছে বরফের ওপর?

ঘনাদা। (হা হা করে হেসে) তবে আর গল্পটা শোনাচ্ছি কেন? এক হাতে টুপি আর এক হাতে চশমা নিয়ে তখন দুই বিশ্ববিখ্যাত খেলোয়াড়ের উদ্দেশে দু-মিনিট নীরবতা পালন করছি। তারপর কী খেয়াল হতে টুপিটা মাথায় ও চশমাটা চোখে পরতেই এক ভোজবাজি কাণ্ড!

পল্টন। কী হল, ঘনাদা?

ঘনাদা। টুপিটা মাথায় দিতে মনে হল, হঠাৎ আমার মাথায় বুদ্ধি গিজগিজ করছে। টুপিটা বেশিক্ষণ মাথায় দিয়ে রাখা যাচ্ছে না। আর চশমাটা পরে তো আরও অবাক। আলাস্কা পর্বতের মাথায় দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছি কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরের ওয়াশিংটন শহরের দৃশ্য।

পল্টন। (উত্তেজিত হয়ে) তারপর! কোথায় গেল সেই টুপি আর চশমা?

ঘনাদা। সেই গল্পই তো শোনাচ্ছি আপনাদের। টুপি আর চশমা পরে নতুন করে স্কি খেলতে খেলতে নামছি নীচে। এত জোরে নামছিলাম যে টুপিটা হঠাৎ মাথা থেকে উড়ে কোথায় যে ভ্যানিস হল!

পল্টন। ইস, ইস। আর চশমাটা?

ঘনাদা। চশমাটা তখন পকেটে পুরে নিই। পাছে হারিয়ে যায়। কিন্তু ব্যাড লাক। ফেরার পথে অটোয়া থেকে প্লেন ধরেছি ভায়া লন্ডন ফিরব বলে। প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর দিয়ে যখন উড়ছি, কী মনে হল হঠাৎ চশমাটা চোখে পরি। আর কী অবাক কাণ্ড! দেখি সমুদ্রের জল একেবারে প্লেনের জানলার মাত্র একহাত নীচে। কী বিশাল বিশাল ঢেউ! যেন জল লাফিয়ে ঢুকবে প্লেনের মধ্যে। হঠাৎ জানলা খুলে ঝুঁকে পড়ে সমুদ্রের জলে হাত ছোঁয়াতে গেছি, দেখি কী, চশমাটা নাক থেকে স্লিপ করে এক্কেবারে অনেক অনেক নীচে সমুদ্রের ভেতর।

পল্টন। যাহ! যাকে বলে একসঙ্গে দুটো লস।

ঘনাদা। হ্যাঁ। তবে বলতে পারো প্রথমে গেইন, তারপর লস। কাটাকুটি হয়ে গেল।

হাবুলমামা। কিন্তু তাতে আমার কী হল! আমার চশমা কী করে পাওয়া যাবে!

ঘনাদা। চশমা! ও হ্যাঁ। আপনার চশমার কথাটা ভুলেই গিয়েছিলাম প্রায়। কিন্তু সেই চশমা পেতে হলে তো আমাকে ফ্রান্স যেতে হয়।

হাবুলমামা। ফ্রান্সে!

ঘনাদা। হ্যাঁ। জাঁ চার্লস রুয়াউলটের ওই চশমাটায় খোদাই করা ছিল মেকারের নাম। এখনও স্পষ্ট মনে আছে নামটা- -ল ম্যাগাম্যাঁ-। প্যারিসের বিখ্যাত দোকান। যাতায়াত খরচ তার সঙ্গে কয়েকদিন হোটেলবাস। কত আর লাগবে, দেড় লাখ। টাকাটা দিন। ঘুরে আসি।

হাবুলমামা। (বুকে হাত দিয়ে) ও বাবা পল্টন, বুকের ভেতরটা যে কেমন কেমন করছে।

পল্টন। (ছুটে এসে মামার বুকে মালিশ করতে করতে) ঘনাদা, মামার হারানো চশমাটাই বরং খুঁজে বার করা যাক। শুধু দেড় লাখ টাকার গল্প শুনেই মামার বুকে রেলগাড়ি চলছে। টাকাটা যদি সত্যিই দিতে হয়, তাহলে মামার আর চশমা লাগবে না। টাকার শোকে মামা সোজা ঊর্ধ্বলোকে যাত্রা শুরু করবেন। দেখুন না, যদি কলকাতায়-

ঘনাদা। নাহ, আমার পক্ষে কলকাতায় চশমা খোঁজা সম্ভবই নয়। আমি হচ্ছি ঘনশ্যাম। একজন ইন্টারন্যাশনাল ক্যারেকটার-বরং আপনারা টেনিকে ট্রাই করতে পারেন।

হাবুলমামা। টেনি? সে আবার কে?

পল্টন। টেনি, মানে টেনিদা। ও তুমি চিনবে না, মামা। আমি বরং টেনিদাকেই কল দিই।

ঘনাদা। হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই ভালো। আমি বরং এখনই আমার মেসে ফিরে যাই। একটু পরেই বড়োবাজারের শ্রী গনেশপ্রসাদ চৌরাসিয়ার সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। তাঁর কুমির শিকারের ব্যারাম আছে। তিনি আবার যে-সে জঙ্গলে যাবেন না। সাউথ আমেরিকার আমাজন নদীর পশ্চিম তীরে নামতে চান হেলিকপ্টারে চড়ে। সূর্যের আলো প্রবেশ করে না এমন ঘন জঙ্গলে গিয়ে কুমির শিকার করবেন। আমাকে তিনি গাইড হিসেবে চাইছেন। আচ্ছা চলি। নমস্কার।

[ ঘনাদার প্রস্থান

পল্টন। বুঝলে মামা, টেনিদাই হচ্ছে আসল লোক। তুমি ততক্ষণে কিছু আলুর চপ আর পিঁয়াজির ব্যবস্থা করো। টেনিদা ঝাল ঝাল তেলে ভাজা খেতে ভীষণ পছন্দ করে। আমি চট করে পটলডাঙায় গিয়ে ধরে নিয়ে আসছি টেনিদাকে।

[ পল্টনের প্রস্থান

হাবুলমামা। (মঞ্চের এককোণে গিয়ে গলা উঁচিয়ে) বলি, ওগো শুনছ, ওই হতচ্ছাড়াটা কী যেন বলে গেল। পিঁয়াজি আর কী যেন-। কী বললে? পেঁয়াজ ঘরে বাড়ন্ত! পিঁয়াজি ভাজা যাবে না? এ হে হে। কিন্তু আমার চশমা-

[ টেনিদার সদলবলে প্রবেশ ]

টেনিদা। বুঝলি হাবুল, সব ব্যাটা যখন ফেল মারে, তখন খোঁজ পড়ে এই পটলডাঙার টেনি শর্মার। কারণ এই টেনি শর্মার টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো বাঁকানো নাকই হল চশমা পরার যোগ্যতম স্থান।

হাবুল। যা কইছেন, টেনিদা। আপনাগো বংশেই তো ল্যাখা আছে চশমার কথা, তাই না?

টেনিদা। এখন তোর ওই বংশের কথা ছাড়। কই মি. হর্ষবর্ধন, আপনার চশমা নিয়ে কী একটা সমস্যা হয়েছে শুনলাম।

হাবুলমামা। আজ্ঞে, আমার পদবি হর্ষবধর্ন নয়, রায়বর্ধন-

টেনিদা। আপনার ভাগ্নে মানে ওই ছোঁড়া যে বলল, মি. হর্ষবর্ধনের বাড়িতে প্রবল গোলযোগ উপস্থিত হয়েছে। একজোড়া চশমা নিয়ে –

ক্যাবলা। তাহলে এটা নির্ঘাত ভুল বাড়ি, টেনিদা। ওই ছেলেটা ভুল ডিরেকশন দিয়ে সব গুবলেট করে দিয়েছে।

টেনিদা। এটা কি ক্যাফেঁট নাকি মিঃ হর্ষবধর্ন? বলল, গরম গরম পিঁয়াজি আর আলুর চপ ঝুড়ি ভরতি রেডি আছে। কই, ঝুড়িটা কোথায়?

হাবুলমামা। আজ্ঞে, পেঁয়াজ এত আক্রা যে-

টেনিদা। সে আবার কী কথা! পেঁয়াজের সঙ্গে পিঁয়াজির কী সম্পর্ক! পেঁয়াজ বিক্রি হয় বাজারে। আর পিঁয়াজি ভাজা হয় গরম সরষের তেলে।

হাবুল। ওই পোলাডা মনে হয় ভুল বুঝাইছে, টেনিদা। চলেন, চলেন, নির্ঘাত পাশের বাড়ি হইব। শুধু শুধু আপনাগো ট্রাবল দিত্যাছে-

টেনিদা। প্যালা-

প্যালা। বলো টেনিদা।

টেনিদা। তোকে না তখনই বললাম, রাস্তায় রয়্যাল সাইজের এগরোল বিক্রি হচ্ছে, ডবল ডিম দিয়ে ভাজা। এক ডজন কিনে ফ্যাল। তুই দিব্যি সটকে পড়লি তখন। এখন কী দুর্যোগ-

[ টেনিদা প্যালার পিঠে সশব্দে একটা চড় কষাতেই লাফিয়ে উঠল প্যালা ]

প্যালা। উফ টেনিদা। পিঠের জয়েন্টগুলো নির্ঘাত ফ্র্যাকচার হয়ে গেছে। আমার এই পালাজ্বরে ভোগা দুবলা শরীর।

টেনিদা। এটা ডবল ডিমের এগরোল না কেনার ফাইন।

প্যালা। উফ। টেনিদা, পিঠটা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে। ওই ছোঁড়াটা বলল, ঝুড়ি ভরতি আলুর চপ আর পিঁয়াজি রেডি আছে। ভাবলাম খেতে খেতে আহ্লাদে আটখানা হব। তা নয় পিঠের হাড় এখন আটখানা, এইট পিসেস-

হাবুলমামা। কই রে, হতচ্ছাড়া কোথায় গেলি?

[ পল্টনের প্রবেশ ]

পল্টন। এই যে মামা, মামির কাছে খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম, আলুর চপ আর পিঁয়াজি ভাজা কদ্দুর। তা মামি বলল একটাও পেঁয়াজ নেই তো পিঁয়াজি হবে কী করে! তা দু-কেজি পেঁয়াজ কিনে দিয়ে এলাম কিনা।

হাবুল। দু-কেজি পেঁয়াজ! ওরে, সে তো এক বস্তা রে। অত পেঁয়াজ কী হবে? আমার তো এক বছর চলে যাবে ওতে।

পল্টন। কিন্তু মামা, টেনিদা অ্যান্ড হিজ কোং দু-কেজি পেঁয়াজের পিঁয়াজি দু-মিনিটে সাফ করে দেবে। তুমি টেনিদাকে তো চেনো না।

হাবুলমামা। পোলাডা হক কথা কইছে, মামা। অর ব্রেইনে বুদ্ধি গিজগিজ করত্যাছে। কালে কালে পোলাডা কেউকেটা হইব।

টেনিদা। যাক, সকালবেলাটা তাহলে আজ ভালো কাটবে কী বল, প্যালা-

[ টেনিদা আবার একটা চাঁটি কষাতে যাচ্ছিল প্যালার মাথায়। প্যালা চট করে সরে গেল ]

হাবুলমামা। কিন্তু তাতে আমার কী ভালো হল। আমার চশমা কী করে পাওয়া যাবে?

টেনিদা। হ্যাঁ, এইবার সেই প্রসঙ্গেই যাচ্ছি। পিঁয়াজির গল্প শুনতে শুনতে ঠিক করছিলাম কোথায় এবং কীভাবে আপনার ব্যারাম সারানো যাবে। এইবার স্মরণে এল, জায়গাটা আফ্রিকা।

হাবুলমামা। আফ্রিকা।

টেনিদা। হ্যাঁ। পূর্ব আফ্রিকার মোগাম্বো জঙ্গলে গিয়েই সন্ধান পেয়েছিলাম ওষুধটার। খুব দুর্গম জায়গা। চারপাশে বাঘ, সিংহ আর পাইথনে ভরতি। তার ওপর তিনশো বারো ডিগ্রি ফারেনহাইট টেম্পারেচার। সেবার গিয়ে কী বিপত্তি, একটা তিনশো বছর বয়সি মেহগনি গাছের মগডালে মাচা বেঁধে বসে আছি সিংহ ধরব বলে।

হাবুলমামা। সিংহ! ওরে বাবা!

টেনিদা। হ্যাঁ, ওরে বাবা বলার মতোই অভিজ্ঞতা। তবে সেটা সিংহের জন্য নয়। হঠাৎ মেহগনি গাছের ডাল থেকে একটা পোকা উড়ে এসে মারল আমার চোখে একটা ছোবল।

হাবুলমামা। বলেন কী? পোকায় মারল ছোবল?

ঘনাদা। হ্যাঁ। যন্ত্রণাটা এমন প্রবল ছিল যে ছোবল বলাটাই সংগত।। তার ওপর একটা উৎকট ব্যাপার। কালোকে সাদা দেখছি তো সাদাকে কালো।

হাবুলমামা। বলেন কী?

টেনিদা। হ্যাঁ, মোটাকে রোগা দেখছি তো রোগাকে মোটা। আর ধানকে শুনছি কান।

পল্টন। ঠিক, ঠিক, টেনিদা। আমাদের হাবুলমামার ঠিক এরকমই অসুখ হয়েছে।

টেনিদা। যন্ত্রণায় প্রবল ছটফট করছি দেখে আমার সঙ্গী এক আদিবাসী পিগমি সন্ধান দিল একটা আশ্চর্য ওষুধের।

হাবুলমামা। কী ওষুধ?

টেনিদা। একটা গাছের বাকল। সাত ভাঁজ বাকলের তৃতীয় ভাঁজ থেকে সংগ্রহ করতে হয়েছিল একধরনের গুঁড়ো। গাছটার নাম মরফোফাইলেটিয়া। এটা একটা বটানিকাল টার্ম।

হাবুলমামা। উফ কী সাংঘাতিক নাম!

টেনিদা। কিন্তু তার থেকে যে ওষুধটা আবিষ্কার করলাম তা কিন্তু অব্যর্থ। গুঁড়োটা চোখে লাগাতেই চোখের যন্ত্রণা তো গেলই, চোখও আগের মতো রোগমুক্ত। আবার সাদাকে সাদা কালোকে কালো। রোগাকে রোগা, মোটাকে মোটা।

হাবুলমামা। কিন্তু আমার চোখে তো আর পোকায় ছোবল মারেনি কোনো। কোনো জ্বালাযন্ত্রণাও নেই।

টেনিদা। (হা হা করে হেসে) আরে মশাই, পরশুরাম পড়েননি! হয়, হয়, সবই হয়, কিছুই জানতি পারেন না।

হাবুলমামা। (হতবাক হয়ে) আপনি বলছেন, হয়!

টেনিদা। না হলেও হতে কতক্ষণ? হয়তো কদিন পরে হবে। চোখ ফুলে ঢোল হবে। রোগটার নাম ইয়ারটাইটিস আপটিমরফিয়া। একই সঙ্গে চোখ আর কানের ব্যামো।

হাবুলমামা। উফ, কী সাংঘাতিক নাম? আমার বুক আবার ধড়ফড় করছে।

টেনিদা। আরে মশাই, সেই জন্যেই তো বলছি, পূর্ব আফ্রিকার মোগাম্বা জঙ্গলে এখনই যাওয়া দরকার। খুব বেশি তো খরচ নয়, যাওয়া-আসার প্লেন ভাড়া আর কদিনের থাকা-খাওয়া। লাখ দুয়েক টাকা হলেই আপনার এই কঠিন ব্যামোর চিকিৎসা হবে। বলতে কী, এর পর আর চশমা পরার দরকারই হবে না।

হাবুলমামা। লাখ দুয়েক! আমার চশমাটার দাম যে মাত্র ন-টাকা বারো আনা।

টেনিদা। ন-টাকা বারো আনা?

হাবুলমামা। হ্যাঁ, চশমাটা তো কিনেছিলেন আমার ঠাকুরদা। গাঁয়ে থাকতেন কিনা! কলকাতায় দু-তিনবার যাতায়াত করতে গাড়িভাড়া দু-টাকা বারো আনা। ডাক্তারের ভিজিট দু-বারে দু-টাকা। আর চশমা আর ফ্রেম মিলিয়ে পাঁচটাকা। মোট ন-টাকা বারো আনা। ঠাকুরদা মারা যাওয়ার পর আমার বাবা ওটা পরতেন। বাবা মারা যাওয়ার পর আমিও পরছি আজ সতেরো বছর।

টেনিদা। তারপর আপনি মারা গেলে আপনার ছেলেও ওটা পরবে?

হাবুলমামা। (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) নাহ, আমার তো ছেলেপুলে নেই। ভেবেছিলাম আমার ওই ভাগনের নামে চশমাটা উইল করে দিয়ে যাব। কিন্তু এমন গেরো যে চশমাটাই-

টেনিদা। তাহলে এক কাজ করুন। একজন গনতকার কিংবা তান্ত্রিক সন্ন্যাসী ডাকুন। তিনি হয়তো এক টাকা বারো আনা, স্যরি এক টাকা পঁচাত্তর পয়সা ফিজ নিয়ে আপনার চশমাটা উদ্ধার করে দিতে পারবেন। তাহলে বাকি আট টাকা আপনার লাভ। চলরে প্যালা, চল রে হাবুল, ততক্ষণে আমরা পিঁয়াজি খাই। যা সুন্দর গন্ধ বেরিয়েছে। কই-ও হাবুলমামি, দেখি ঝুড়িটা-

[ টেনিদার সদলবলে প্রস্থান

হাবুলমামা। আর আট টাকা লাভ। দু-কেজি পেঁয়াজের পিঁয়াজি ভাজতে ক-কেজি সরষের তেল লাগবে কে জানে? ও পল্টন, হতচ্ছাড়া, আজ সকালে উঠে আমার যা লস করিয়ে দিলি-

পল্টন। আমি বরং ততক্ষণে একটা গনতকার ধরে নিয়ে আসি, মামা। টেনিদা বুদ্ধির আড়ত। বুদ্ধিটা ঠিকই বাতলে দিয়ে গেছে। তোমার চশমা একমাত্র গনতকারই-

[ পল্টনের প্রস্থান

হাবুলমামা। এ হে হে, কী পিঁয়াজির গন্ধ ছাড়ছে। ব্যাটারা সকালে এসে আমার হাড়ে দুব্বোঘাস গজিয়ে দিয়ে গেল!

[ একজন সন্ন্যাসী চেহারার লোককে সঙ্গে নিয়ে পল্টনের প্রবেশ। সন্ন্যাসীর হাতে কমণ্ডলু। বগলে কাগজের তাড়া ]

সন্ন্যাসী। ওঁ তন্তর মন্তর মন্তর তন্তর তন্তর মন্তর ছুঁ

চশমাং দিগং রাত্তিং কালোং এলাটিং বেলাটিং ফুঃ।

হাবুলমামা। (গড় হয়ে সন্ন্যাসীকে প্রণাম করে) বাবা, তুমিই আমাকে বিপদ থেকে রক্ষা করো-

সন্ন্যাসী। হুম, তোর যে একটা চশমা হারিয়েছে তা কাল রাত্তিরেই আমি জানতে পেরে গেছি। তখনই অনুমান করছিলাম সকাল হলেই কেউ না কেউ চশমার সন্ধানে ছুটে আসবে আমার কাছে।

হাবুলমামা। (গদগদ হয়ে) তাই নাকি, বাবা! আপনি কাল রাতেই জানতে পেরে গেলেন?

সন্ন্যাসী। হ্যাঁ, দেখলাম তো একটা চশমা উড়তে উড়তে, উড়তে উড়তে চলে যাচ্ছে আমার নাকের ডগা দিয়ে।

হাবুলমামা। সে কী, বাবা, একেবারে উড়তে উড়তে! কিন্তু বাবা আমার চশমার তো পাখা ছিল না?

সন্ন্যাসী। ধুর বোকা! ওড়া মানে কি আর সেই ওড়া! নিশ্চয়ই ছিল কারো বুক-পকেটে, কিংবা ব্যাগের মধ্যে। আমি তো ধ্যানের মধ্যে সেই মানুষটা, বা তার পকেট বা ব্যাগ কিছুই দেখতে পাচ্ছি নে। শুধু চশমাটাই যেতে দেখছি।

হাবুলমামা। তা চশমাটা উড়তে উড়তে কোথায় যাচ্ছিল, বাবা?

সন্ন্যাসী। ধ্যানের মধ্যে মনে হল নির্ঘাত বোম্বের দিকে। নিশ্চয়ই একজন বোম্বেটের কাজ এটা। ওদেরই তো চশমা চুরির একটা চক্র আছে।

পল্টন। তাহলে তো মামা, সেটা উদ্ধার করার কাজ আমাদের ফেলুদাই পারতেন। তারপর বোম্বে থেকে ঘুরে এসে লালমোহনবাবু -বোম্বের বোম্বেটে- নামের একটা মারকাটারি রহস্য উপন্যাস লিখে ফেলতেন।

হাবুলমামা। এই বিপদের মধ্যেও হতচ্ছাড়ার ফচকেমি করা যাচ্ছে না। আমার চশমা না পেলে এদিকে দুনিয়া যে রসাতলে যাচ্ছে-

সন্ন্যাসী। আরে দুনিয়া রসাতলে যাবে কেন? দুনিয়া এখনই বশে এসে যাবে তোর। শুধু কিছুক্ষণ সময়ের অপেক্ষা। (একটা আসন পেতে বসে, সামনে কমণ্ডলুটা রাখলেন সন্ন্যাসী। তারপর বগল থেকে একতাড়া কাগজ বার করে সামনে বিছোলেন। অতঃপর মাটিতে লম্বা লম্বা রেখা টানতে টানতে) এবার তাহলে বল, তোর কোন রাশি? মেষ, না বৃষ, না সিংহ-

হাবুলমামা। কেন? আমাকে দেখে কি আপনার মনে হচ্ছে আমি কোনো চতুষ্পদ জন্তু! আমার পেছনে কোনো লেজ-টেজও নেই যে ওরকম কিছু মনে হতে পারে। আমি নিতান্তই একজন সাধারণ মানুষ।

সন্ন্যাসী। তা তোর বৃহস্পতি সপ্তমে, না পঞ্চমে?

হাবুলমামা। সে আমি কী করে জানব? আপনি জানলেও জানতে পারেন। তবে আমার বৃহস্পতি যে একাদশে নেই তা হলফ করে বলতে পারি?

সন্ন্যাসী। কিন্তু তোর বৃহস্পতি যে তুঙ্গে অবস্থান করছে তা আমি মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছি।

হাবুলমামা। কিন্তু আমার চোখে চশমা না ওঠা পর্যন্ত আমি তো কিছুই দেখতে পারছিনে।

সন্ন্যাসী। সে তো কদিনের মধ্যেই দেখতে পাবি। তার আগে একটা কাজ করতে হবে তোকে।

হাবুলমামা। বলুন বাবা, কী করতে হবে?

সন্ন্যাসী। সামনের শনিবার ঘোর অমাবস্যা। শুভদিনে শুভকাজ সম্পন্ন করাই শ্রেয়। আমি ওইদিন মধ্যরাতে নিশ্চিন্দিপুর শ্মশানে ধ্যানে বসব, তুই পুজোর জোগাড় কর।

হাবুলমামা। কী পুজো, বাবা। আমি তো এসব কিছুই জানিনে। ও বাবা পল্টন, তুই দেখ তো সন্ন্যাসীবাবা কী জোগাড় করতে বলছেন?

সন্ন্যাসী। তেমন কিছুই নয়। তুই বরং আমার হাতে টাকা ধরে দে। মাত্র তিন হাজার ন-শো নিরানব্বই টাকা। আমি পুজোর উপকরণ জোগাড় করে রাখি। তারপর সামনের শনিবারে মধ্যরাতে তুই নিশ্চিন্দিপুর শ্মশানে চলে আসবি।

হাবুলমামা। তিন হাজার ন-শো নিরানব্বই টাকা! টাকাটা যে বড্ড বেশি হয়ে গেল বাবা।

সন্ন্যাসী। বেশি! বেশি কোথায়? ওই টাকা খরচ করে পুজো করলে তোর চোখের চশমা নাচতে নাচতে তোর চোখেই ফিরে আসবে।

পল্টন। কিংবা বলা ভালো উড়তে উড়তে তাই না, দাদামশাই!

সন্ন্যাসী। দাদামশাই! কে দাদামশাই!

পল্টন। আপনি তো আমার মামার বাবা। মামার বাবা মানেই তো দাদামশাই।

সন্ন্যাসী। ও তাই বল।

হাবুলমামা। কিন্তু বাবা, ন-টাকা বারো আনার চশমার জন্যে তিন হাজার ন-শো নিরানব্বই টাকাটা বড়ো বেশি হয়ে গেল না? ওটা শুধু ন-টাকা করা যায় না? তাহলে অন্তত বারো আনা পয়সা আমার লাভ থাকে।

সন্ন্যাসী। মোটে ন-টাকা! নাহ, তাতে পুজো হয় না। ন-টাকা তো নস্যি নিতে ফুরিয়ে যাবে।

হাবুলমামা। বাবা, আমি সাড়ে ন-টাকা পর্যন্ত উঠতে পারি। তাতে অন্তত আমার চার আনা লাভ থাকে।

সন্ন্যাসী। (চটেমটে) ধুত্তোরি, নিকুচি করেছে তোর চশমার। ও আর তোর কপালে নেই।

পল্টন। কপালে নয়, দাদামশাই বলুন তোর চোখে নেই। চশমা তো আর কেউ কপালে পরে না।

সন্ন্যাসী। (হন্তদন্ত হয়ে) তবে আমি চললাম। তোর চশমা বোম্বে গিয়ে বোম্বেটেদের হাতেই ঘোরাফেরা করুক।

[ সন্ন্যাসীর প্রস্থান

হাবুলমামা। ও পল্টন, সন্ন্যাসীবাবা যে সত্যিই চলে গেল! তাহলে আমার চশমা আর পাওয়া যাবে না?

পল্টন। কী করে পাওয়া যাবে যদি চশমাটা বোম্বেটেদের খপ্পরে পড়ে থাকে। আচ্ছা মামা, সেই বোম্বেটেকে বাগে পেলে তুমি তাকে কী সাজা দিতে!

হাবুলমামা। (রাগে কাঁপতে কাঁপতে) তাকে নাগালে পেলে নির্ঘাত ফাঁসিতে লটকাব। না হলে নিশ্চিত দ্বীপান্তর।

পল্টন। ঠিক তো, মামা? তিন সত্যি?

হাবুলমামা। ঠিক ঠিক ঠিক।

পল্টন। তাহলে তুমি দু-মিনিটের জন্য চোখ বুজে দাঁড়াও। আমি একটা নতুন কায়দা শিখেছি চোর ধরতে।

হাবুলমামা। সেটা আবার কী কায়দা?

পল্টন। নল-চালা। হ্যাঁ। দাঁড়াও চোখ বুজে। রেডি, ওয়ান, টু, থ্রি…

[ পল্টন ছুটে লম্বা লাঠির একদিকের প্রান্ত দু-বগলে ধরে অপর প্রান্ত এগিয়ে নিয়ে চেপে ধরল হাবুলমামার গলা ]

হাবুলমামা। এ কী? এ কী? এসব কী অসভ্যতা হচ্ছে?

পল্টন। মামা, নল-চালা বলছে আসল কালপ্রিট হচ্ছে তুমিই।

হাবুলমামা। তার মানে?

পল্টন। চশমাটা নিশ্চয়ই তুমিই চুরি করেছ। কই দেখি তোমাকে সার্চ করে। (পল্টন হাবুলমামার ফতুয়ার পকেট ঘেঁটেঘুঁটে বার করল চশমাটা) এই তো, মাল একেবারে রেড-হ্যান্ডেড কট। কই জজসাহেব কোথায়? এক্ষুনি এসে কালপ্রিটের বিচার করুন।

[ পরনে কালো কোট। মাথায় টুপি পরে বিচারকের প্রবেশ ]

বিচারক। বাদি ও বিবাদি উভয়পক্ষের জবানবন্দি শুনিয়া ও অন্যান্য সাক্ষ্য প্রমাণাদি বিচার করিয়া এবং মাননীয় উকিল মহোদয়দের যুক্তিপূর্ণ সওয়াল অনুধাবন করিয়া সাব্যস্ত হইল যে, অত্র মামলার আসামি হাবুলচন্দ্র হর্ষবর্ধন থুড়ি রায়বর্ধন যথার্থই তাহার স্বীয় চশমা চুরির অপরাধে অপরাধী। অতএব ভারতীয় দণ্ডবিধির চারশো কুড়ি ধারা অনুযায়ী হাবুলচন্দ্র রায়বর্ধনকে আট বছরের ফাঁসি ও দু-হাজার টাকার দীপান্তর দেওয়া হইল।

[ যবনিকা পতন ]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *