চশমাটা পালটে ফেলুন

চশমাটা পালটে ফেলুন

শীতের সকাল! হরিগোপালবাবু বাড়ির পিছন দিকের বারান্দায় মৌজ করিয়া বসিয়া রৌদ্র এবং সংবাদপত্র সেবন করিতেছেন। এ দিকটা সকালের দিকে অপেক্ষাকৃত নির্জন থাকে, তাই কাগজ পড়িতে এই দিকটিই পছন্দ করেন হরিগোপাল। পাশের আর একটি চেয়ারে পঠিত কাগজখানি আলগা ভঁজে ছড়ানো।

ছুটির দিনে ইংরাজী বাংলা দুইখানি কাগজই রাখেন হরিগোপাল, অন্যদিন কেবলমাত্র বাংলা। রাখেন, সেটা নেহাই বাড়ির সৌষ্ঠব হিসাবে, নচেৎ সংসারের অন্যান্য সদস্যরা কাগজের ধার বড় ধারে না।

সর্বার্থসাধক টি ভি-র দাপটে এখন রেডিও খবরের কাগজ মূল্য হারাইয়াছে। কাগজটা আসে, দুই পুত্র জয়গোপাল খেলাধুলার পাতায় একবার চোখ বুলাইয়া ছড়াইয়া ফেলিয়া যায়, জয়গোপাল জননী কোনও একসময় (প্রধানত শিশি বোতলওয়ালার জন্য) তাহাদের কুড়াইয়া গোছ করিয়া ঘটনা ও দুর্ঘটনা এবং বাজারদরের কলমটা দেখিয়া লন। হরিগোপালের ভ্রাতৃবধূ চকিতে কখন কোন্ কোন্ চিত্ৰগৃহে কী কী-তে নজর বুলাইয়া যান, সেটা কাহারও নজরে পড়ে না।…ভাইঝি টুলি সপ্তাহে একদিন ছোটদেরপাতা খানা ধরিয়া টান মারে। পড়ে না। সেদিনের কাগজখানা হারাইয়া যায়।

একমাত্র হরিগোপালই নিষ্ঠাশীল সংবাদপত্র প্রেমী। তা তাহার তো অফিসেই কাজ মেটে। শুধু এই ছুটির দিনেই বাড়িতে

নিমগ্ন হইয়াছিলেন, সহসা গৃহের অপরাংশ হইতে যেন একটি সমবেত কণ্ঠের তুমুল হর্ষধ্বনি কানে আসিল।

ব্যাপারটা কী? হরিগোপাল কানটা একটু খাড়া করিলেন। নানা কণ্ঠ হইতে উখিত উল্লসিত প্রশ্ন বাচক শব্দে অনুমান হইতেছে, হঠাৎ কোনও ভি আই পি অতিথির আবির্ভাব ঘটিয়াছে। …কিন্তু কে? এমন কে হইতে পারে যাহার জন্য বাঘে গরুতে একঘাটে জল খায়? হরিগোপাল গৃহিণী ও হরিগোপালের কনিষ্ঠ দ্বিজগোপাল গৃহিণী, একই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াইয়া উল্লাস ধ্বনি করিতে পারে। উঠিয়া গিয়া দেখিবেন না কি?

ভাবিবার পরমুহূর্তেই টুলি তাহার তিনথাক ঝালর ঝোলানো ঘাগরা উড়াইয়া ছুটিয়া আসিয়া রুদ্ধশ্বাসে উচ্চারণ করিল, জ্যেঠু শীগগির চলো, দেখো কে এসেছে।

হরিগোপাল ভোলা কাগজ ভাঁজ করিতে করিতে কহিলেন, কে, রে?

তুমি দেখবেই চলো না।

টুলি হরিগোপালের হাতের মধ্যে হাত গলাইয়া বলপ্রয়োগের চেষ্টা করে, চলো না শীগগির। বঙ্কিমদা এসেছে।

বঙ্কিমদা!

সারা পৃথিবীর সর্ববিধ সংবাদের সারাংশে ভারাক্রান্ত মগজটায় সহসা এই অভাবিত আবির্ভাব বার্তাটির প্রবেশ ঘটিতে বিলম্ব ঘটিল, হরিগোপাল ভু কোচকাইলেন, বঙ্কিমদা! বঙ্কিমদা

ইস! আহা! জানো না বুঝি? ডাবুপিসির ছেলে না? সেই যে তোমার ঘড়িটা সারাতে গিয়ে আর এলো না। রাস্তায় হারিয়ে গেল।

অ্যাঁ! বঙ্কা! হরিগোপালের পায়ের রক্ত চড়াৎ করিয়া ব্রহ্মরন্ধে চড়িয়া গেল, অধিক রন্ধ্র ঘটাইয়া ভেদ করিল না এই রক্ষা।…বঙ্কার আবির্ভাবে বাড়িতে এমন সমবেত হর্ষধ্বনি!! হরিগোপাল আরও বিস্মিত হইলেন মেয়েটার স্মরণশক্তি দেখিয়া। বড়জোর বছর আট নয় বয়স, অথচ পাঁচবছর পূর্বে ঘটিত ঘটনাটা দিব্য মনে আছে।

রুষ্ট হরিগোপাল হাতটা ছাড়াইয়া লইয়া কহিলেন, আমার এখন সময় নেই। দেখছিস না কাগজ পড়ছি।

পড়ছো? না চিবোচ্ছো? হি হি হি, জ্যেঠিমা বঙ্কিমদাকে বলল, হি হি, তোর বড়মামা এখন খবরের কাগজ চিবোচ্ছে।…চলো না জ্যেঠু, দেখবে কী ফর্সা হয়ে গেছে বঙ্কিমদা। আর কী সুন্দর স্যুট পরেছে। টাইটা যে কী ফ্যান্টাসটিক!..জুতোটার তো কথাই নেই। আর যা একখানা গাড়ি চেপে এসেছে না। দেখলে তোমার তাক লেগে যাবে।…একদম শাদা ধপধপে।..নতুন চকচকে।

হরিগোপালের দেহের রক্তকণিকা সমূহ মুহুর্মুহু মাথা হইতে পায়ে, ও পা হইতে মাথায় তাঁতির মাকুর মত ছুটাছুটি করিতে থাকে। বঙ্কা নামক সেই হাড়জ্বালানে লক্ষ্মীছাড়া রকবাজ মস্তান ছেলেটার সহিত টুলি বর্ণিত জিনিসগুলাকে মিলাইতে যে বেগ পাইতে হইতেছে তাহারই ফলশ্রুতি এই ছুটাছুটি।

আচ্ছা, যাবে না তো? কলা কলা! মজার মজার গল্পপা টপো শুনতে পাবে না। উঃ যা না গপপো করছে বঙ্কিমদা, মা বাপী বড়দা জেঠিমা সব্বাই একেবারে হেসে গড়াগড়ি। হি হি মা তো গড়িয়ে খাট থেকে পড়েই যাচ্ছিল। তুমি না–বোকা! বোকা!

দ্রুত প্রস্থান করে টুলি।

কথা বলিতে সময় লাগে না, টুলির এই একটা গুণ। অতএব তার আসা এবং যাওয়ার মধ্যবর্তী অংশটুকু যৎসামান্য মাত্র।

হরিগোপাল ওদিকের ঘর হইতে হাস্যরোল শুনিতে পান। ..ও ঘর টুলিদের। অর্থাৎ মজলিশ বসিয়াছে দ্বিজুর ঘরে। …হরিগোপাল বিস্ময়ে বিমূঢ় হন। দ্বিজু বঙ্কাকে টলারেট করিতেছে?

দূর সম্পর্কের ভাগিনেয় বঙ্কিমবিহারী বা বঙ্কা একদা যখন নিজ মাতুলালয় বোধে এখানে আসিয়া মামারবাড়ির আবদারটি চালাইয়া চলিত, এবং নিতান্তই চক্ষুলজ্জার খাতিরে হরিগোপালকে তাহা সহিয়া যাইতে হইত (তস্য গৃহিণীকেও) তখন দ্বিজগোপাল তীব্র তিক্ত মন্তব্য করিত উঃ কী করে যে তোমরা ওকে টলারেট করো।

পাকে প্রকারে এও জানাইয়া দিতে ছাড়িত না, যে দ্বিজগোপাল যদি এ সংসারের সর্বময় কর্তা হইত, ওই বঙ্কিমবিহারীকে আর এ দরজা পার হইতে হইত না। নিরুপায় দ্বিজগোপাল অতএব বন্ধুর সহিত কথা বলিত না।

বঙ্কিমবিহারীর কি আর এ মনোভঙ্গী, বুঝিবার ক্ষমতা ছিল না? ছিল বইকি! পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্গত বিষয়সমূহ ব্যতীত জগতের অন্যান্য যাবতীয় বিষয়ই, মুহূর্তে বুঝিয়া ফেলিবার ক্ষমতা ছিল তাহার। তবে আরও একটি ক্ষমতাও আশ্চর্য রকমের ছিল, সেটি হইতেছে অবহেলা পরিপাক করিবার ক্ষমতা।… সে অবহেলা যত দুষ্পচ্যই হোক, বঙ্কা সেটি এমন অনায়াস নিপুণতায় হজম করিতে পারিত, দেখিলে তাক লাগিবার মত।

বঙ্কা উত্তরমাত্র না পাইয়াও, বুঝলে ছোটমামা সম্বোধনে দ্বিজগোপালকে উদ্দেশ করিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনর্গল কথা চালাইয়া যাইতে পারিত, (দ্বিজগোপাল স্থান পরিবর্তন করিলে সেও পিছু পিছু চলিত)। নিতান্ত অনিচ্ছুক বেজারবদনা ছোটমামীকে দিয়াই একাধিকবার চা আদায় করিয়া ছাড়িত এবং কস্মিনকালেও নিমন্ত্রণ না পাইলেও যখন তখন মামারবাড়ি আসিয়া দুই চারদিন কাটাইয়া যাইতে পারিত।…আর যে বড়মামী তাহাকে আসিতে দেখিলেই সশব্দ স্বগতোক্তি করিতেন, ওই যে আবার এসে উদয় হলেন। সেই বড়মামীকে দিয়াই নানাবিধ রসনা সুখকর আহার্য বস্তু রন্ধন করাইয়া, কব্জি ডুবাইয়া খাইয়া লইতে লজ্জা করিত না।

পদ্ধতি নিম্নলিখিত

প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্কার উদাত্ত কণ্ঠ ছাদ ভেদ করিত, মামী বাড়ি আছো? না বাপের বাড়ি গিয়ে বসে আছো?

অতঃপর তাহার বক্তব্যের ভঙ্গী এইরূপ।

তোমার ননদের হাতের ঝালের ঝোল আর বড়ি চচ্চড়ি খেতে খেতে লাইফ মিজারেবল হয়ে গেল মামী! চলে এলাম তোমার কাছে।… কী রান্না করছ? দারুণ সৌরভ পাচ্ছি। আহা মামী তোমার রান্না ঘরের সৌরভই আলাদা। আর তোমার ননদের? আহা!

মামী মনের কথা মনে রাখিয়া বেজার গলায় বলেন, তা তোর মা তোকেও জন্মের শোধ বড়ি চচ্চড়ির হেঁশেলে ভর্তি করে রেখেছে কেন? আলাদা করে একটু মাছ ফাচ বেঁধে দিতে পারে না?

হা হা হা। হাসালে মামী। বেকারের জন্যে আবার আলাদা। তাহলে ওই ফাচই হবে। মাছ নয়। যাকগে তুমি রাঁধো, ততক্ষণ একটু চা খাওয়া যাক।…ছোটমামী, ঘুমোচ্ছো না কি? একটু চা বানাও তো চটপট। সকাল থেকে দু কাপ বৈ জোটেনি।

আবার গলা শোনা যায় বন্ধুর, আচ্ছা ছোটমামী, তুমি এত কুঁড়ে কেন বল তো? বড় মামী যতক্ষণে মাংস বেঁধে ফেলে তুমি ততক্ষণে একটু চা বানাও। আশ্চর্য!

আবার হয় তো বা কোনও দিন রান্না ঘরে উঁকি মারিয়াই বলিয়া ওঠে, হোপলেস। আজ বাজার গিয়েছিল কে? ছোটমামা বুঝি?…টাকা ছাড়ো মামী মাংস নিয়ে আসি। …কী বলছো? এত বেলায় আর মাংস রাঁধা যাবে না? যাক গে বেশ জম্পেশ করে ডিমের ডালনাই চড়িয়ে দাও না হয়। মাংস কাল খাওয়া যাবে। মুর্গি ফুর্গি যে এখনও অছুৎ করে রেখেছ ছাই। ওই রাঁধতে বেশী সময় লাগে না।…কই গো ছোট মামী চা বানাতে যে বুড়ো হয়ে গেলে। চায়ের সঙ্গে টা টা একটু জোরদার কোরো বাপু। সকাল থেকে ঘুরছি। …বন্ধু বলল, তোর আর কি! চলে যা। মামার বাড়ি।

.

অবশ্য কেবলমাত্র খাওয়া দাওয়া ব্যাপারেই যে মামার বাড়ির আবদার সীমাবদ্ধ থাকিত, তাহা নহে, আবদারের পরিধি ছিল বিশাল বিস্মৃত। হতভাগা বেকার বলিয়া কি বন্ধুর প্রাণে কিছু সাধ বাসনা থাকিতে পারে না? কিন্তু সে বাসনা মিটাইতে যার তার কাছে ধারকর্জ করিয়া কি বন্ধু তাহার এমন মান্যগণ্য মামাদের সম্ভ্রম নষ্ট করিবে?…আর বন্ধু যদি তালিমারা জুতা, কাটা ওঠা চটি, আর ঘসা পয়সার মত শার্ট প্যান্ট পরিয়া বেড়ায়? তাহাতেও তো মামাদের মুখ হেঁট। …বন্ধু অভাগার ভাগ্যে যে মাটিও হাড় কেল্পন। এমন দিলদরিয়া ভাইদের অমন বোন। আশ্চর্য।

.

শহরে যে কোনও হলে নতুন ছবি আসিলেই বন্ধুর টনক নড়ে। ..রান্নাঘরের পোকা মামীদের টানিয়া বাহির করিবার জন্য সাধ্য সাধনার সাধনা চালায়। মামীরা লোভের বশে কখনও যে ফাঁদে পা দেন না, তাহা নয়, তবে কখনও কখনও সাবধানও হন। ছবি দেখার বিরুদ্ধে নানান অজুহাত দেখান। ..অতএব বন্ধু এই ঘোরতর সংসারীদিগকে ধিক্কার দিয়া চলিয়া যায়, এবং চলিয়া যাইবার আগে বলিয়া যায়, মামার পকেট থেকে গোটাকতক টাকা না বলে চেয়ে নিয়ে গেলাম মামী। খোঁজ পড়ে তো বোলো, নচেৎ লোকজনের ওপর সন্দেহ পড়তে পারে। খোঁজ না পড়লে চেপে যেও।

মামী যদি ছুটিয়া আসিয়া প্রশ্ন করেন, তা কত নিলি শুনি?

বঙ্কিমবিহারী সরলহাস্যে বলে, সেটা চেপে গেলাম। চেপে যাওয়াই হচ্ছে শান্তি বজায়ের প্রধান উপায়। বুঝলে মামী!

তা শুধুই কি আলনায় ঝোলানো জামা প্যান্টের পকেটের টাকা? …যে কোনও জিনিসই না বলিয়া চাহিয়া লওয়ার অভ্যাস বন্ধুর মজ্জাগত মুদ্রাদোষ। কিন্তু মুদ্রাদোষ কি দোষের পর্যায়ে পড়ে? বন্ধুর অন্তত তেমন কুসংস্কার নাই। দরকার পড়া জিনিসপত্র হাতের কাছে পড়িয়া থাকিতে দেখিলেও, বন্ধু সেই সব বস্তুগুলি আহরণ করিতে দোকানে ছুটিবে কেন, এটা বন্ধুর আবোধ্য। …কী বা জিনিস। তুচ্ছাতিতুচ্ছ। ব্লেড, শেভিং ব্রাশ। সাবান শ্যাম্পু, আফটার শেভিং লোশান, কি তেল চিরুণী ক্রীম পাউডার, অথবা একটা টর্চ, ডটপেন, এ সব কি আবার ধর্তব্য? দরকার পড়িলে উঠাইয়া লইয়া পকেটে পোরায় লজ্জার কিছুই দেখে না বন্ধু। বরং লজ্জিত হয় মামারবাড়ির কাহারো মুখে তাহার উল্লেখ শুনিলে। লজ্জা–মাতুকুলের অনুদারতায়।

তা মাঝে মাঝেই সে রকম লজ্জায় মর্মাহত হইতে হয় বৈকি বন্ধুকে। যে সব জিনিসগুলা খাইয়া ফেলিবার নয়। মাখিয়া উড়াইয়া দিবার, সেই সবেও যদি মামা মামীর অনিচ্ছুক ভাব দেখা যায় মর্মাহত হওয়াটা তো স্বাভাবিকই।…বন্ধু যদি বড় মামার দামী শাল খানা গায়ে দিয়া মাঝে মাঝে বন্ধুর দাদার বৌভাত, অথবা বন্ধুর বোনের বিয়েতে নিমন্ত্রণ খাইয়া আসে, ইয়া যাইবে সেটা? …অথবা বন্ধুদের সহিত দুই দশদিনের জন্য কোথাও বেড়াইতে যাওয়ার প্রাক্কালে ছোটমামার সৌখিন পুলওভার, সোয়েটারও শখের অ্যারিস্টোক্র্যাট সুটকেসটা সংগ্রহ করিয়া লইয়া যায়, মহাভারত অশুদ্ধ হইয়া যাইবে? ভাল জিনিস তো দেখাইবার জন্যই। তা সে বোধ কোথায়?

বন্ধু নিজ উদারতার বশে কিছু মাইণ্ড করে না তাই! অন্য ভাগিনেয় হইলে হয়তো এই সূত্রেই মামাদের সহিত চিরবিচ্ছেদ ঘটিয়া যাইত।…কথাতেই তো আছে জন জামাই ভাগনা তিন হয়না আপনা।

বন্ধু নিজগুণে আপন। তাই মামামামীর সংকীর্ণতা ক্ষমা করিয়া নিজেই সে সেইসব টানিয়া বাহির করিয়া ঝাড়িয়া ঝাড়িয়া লইয়া যায়।

এই বঙ্কিমবিহারী। ওরফে বঙ্কা।

তবে অন্য একটা দিকও কি নাই বন্ধুর? মানে হারাইয়া যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত অবধি ছিল না? মামাদের সংসারে যখন যে সমস্যা আসুক বন্ধু তাহার সমাধানে একপায়ে খাড়া থাকিত না?

কোন্ দুষ্প্রাপ্য জিনিসটি কোথায় প্রাপ্তব্য, কোন্ বাজারে কোন জিনিসটি সস্তা, কাহাকে ধরিতে পারিলে, একদিনে ট্রেনের রিজার্ভেশান হইয়া যায়, কোথায় টোপ ফেলিলে টেস্ট ম্যাচের সীজন টিকিটও হাতে আসিতে পারে, এসব বন্ধুর নখদর্পণে। যে ছিদ্রে ছুঁচ চলে না, বন্ধু সেখানে ফাল চালাইতে সক্ষম। ট্যাক্সি ভাড়ার টাকাটা অবশ্য লাগে। তা টাকা আর কিসে না লাগে?

মামীদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার পথ মসৃণ রাখিতেই কি বন্ধুর কম অবদান ছিল? …পাম্প, ইলেকট্রিক, টি ভি, টেলিফোন, হিটার, প্রেসার কুকার, জলের কল, সেলাইকল, বেসিন সিসটার্ন, ইত্যাদি করিয়া সংসারের প্রতিটি প্রাণহীন প্রাণীই তো প্রতিনিয়তই খারাপ হইয়া যাইবার জন্য উন্মুখ হইয়া থাকে। খারাপ হয়। অতএব সর্বদাই কাহাকেও না কাহাকে সুস্থজীবনে ফিরাইয়া আনার প্রয়োজন ঘটে। …তখন? তখন বন্ধু ছাড়া গতি কোথায়?

কিন্তু বন্ধু কি সর্ববিদ্যা বিশারদ?

তা অবশ্যই নয়। যাহারা বিশারদ, তাহারাই আসিয়া যা করিবার করিয়া দিয়া যায়। বন্ধু শুধু তাহাদের ডাকিয়া আনে।…তা কৃতিত্ব তো সেই খানেই। মিস্ত্রী নামক জীবনযাত্রা রক্ষক শিল্পী দিগের সংবিধানে এমন কথা লেখা নাই যে, ডাকিলেই আসিতে হইবে।

ডাকার মত ডাকা চাই। কিন্তু ওই ডাকার মত ডাকিবার ক্ষমতা কজনের থাকে?…কাজেই ডাক দিয়া দিয়া জুতা ছিঁড়িয়া ফেলিয়া ডাক ছাড়িয়া কাঁদিতে ইচ্ছা হয়, অগত্যাই তখন বন্ধু।

মামীরা এতদিন অসুবিধাভোগ করিতেছে জানিতে পারিলে, অভিমানহত বন্ধু মামাদের দুইকথা শুনাইয়া দিয়া তদ্দণ্ডে বাহির হইয়া যায়, এবং অভীষ্ট ব্যক্তিকে তখনই আনিয়া হাজির করে।

কোন্ মহামন্ত্রে?

গৃহিণীদের এই তীব্র প্রশ্নের উত্তরে হতমান্য মামারা বিরক্ত উত্তর দেন, মাইডিয়ারী মন্ত্রে! আবার কী? আমাদের দ্বারা তো আর তা হবে না। কিন্তু এত করিৎকর্মা বঙ্কিমবিহারীর একটা চাকরী কেন জোটে না?

তার জন্য বন্ধু মামাদেরই দায়ী করে। বলে চিরদিন শুনে আসছি মামা দাদার খুঁটির জোরে চাকরী মেলে। তা হতভাগা বঙ্কিমের দাদার বালাই নেই, মামারা থেকেও নেই। আমার এই বেকার হয়ে পড়ে থাকা যে তোমাদেরই অপযশ মামা, তা যদি বুঝতে!

কথা। কথা। অহরহ কথার চাষ। সেই চাষের ফসলেই বন্ধুর দিন গুজরাণ!…কিন্তু এ সমস্তই তো গত কথা। পাঁচ বছর আগের ওপারের কথা।

.

পাঁচ বছর পূর্বে এমনি এক শীতের সকালে রোদের দালানে বসিয়া ডিমভাজা সহযোগে চা খাইতে খাইতে বন্ধু যখন বলিতেছিল, তোমাদের এই বাড়িটা মামী এত আরামের।

শীত গ্রীষ্ম সব সীজনে আরাম, তখন সহসা তার কানে আসিল হরিগোপালের হাত ঘড়িটার কাটা আটকাইয়া গিয়াছে। শোনামাত্র বন্ধুর আরামের গলায় কাঁটা বিধিয়া গেল। লাফাইয়া উঠিয়া বলিল, তাই নাকি? দাও এক্ষুনি ঠিক করে আনছি–

বলিয়া মামার হাত হইতে ঘড়িটা প্রায় ছিনাইয়া লইয়া ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল। গেল তো গেলই। আর ফিরিল না।

সেই বন্ধুর মহানিষ্ক্রমণ।

 পাঁচ পাঁচটা বছর বন্ধুর কোনও পাত্তা নাই। …অতঃপর এই আলৌকিক নাটকীয় আবির্ভাব।

এ আবির্ভাব শুধু নাটকীয়ই নয়, রাজকীয়ও। কারণ টুলি জ্যাঠাকে কলা দেখাইয়া চলিয়া যাইবার পরক্ষণেই জয়গোপাল দ্রুত ব্যস্ততায় ছুটিয়া আসিয়া কহিল, বাবা, তুমি একবার গেলে না? বন্ধুদা এসেই তোমায় খুঁজেছে। কাগজ পড়াটাই এত ইমপর্ট্যান্ট হল। আশ্চর্য! ওদিকে কাকা

যেমন বেগে প্রবেশ, তেমনি বেগেই প্রস্থান।

হরিগোপাল ধীরে সুস্থে কাগজগুলা ভাঁজ করিয়া, উঠিয়া পা বাড়াইতেছেন, টুলির জ্যাঠাইমা আসিলেন আরক্ত মুখে, এই শীতেও হাঁপাইতে হাঁপাইতে।

আচ্ছা। তুমি কী গো? ছেলেটা কতক্ষণ হল এসেছে, বড়মামা বড়মামা করে হাঁপাচ্ছে, আর তুমি! ছিঃ! কতকাল পরে এল বেচারী!

হরিগোপাল কহিলেন, মামী তো একাই একশো! মামার জন্যে কী? তা ঘড়িটার কথা জিগ্যেস করেছ?

ঘড়ি। ঘড়ির কথা! কোন্ ঘড়ি!

 হরিগোপাল গৃহিণীকে কেউ যেন আচমকা জলে ফেলিয়া দিয়াছে।

হরিগোপালের স্বরে গাম্ভীর্য, কোন্ ঘড়ি মনে পড়ছে না? দয়াময় যেটা নিয়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছিলেন। আমার সেই রোলেক্সটা–

আ। ছি ছি। এতকাল পরে আমি সেই ঘড়িটার কথা জিগ্যেস করবো। কথাটা মুখ দিয়ে বার করলে কোন্ লজ্জায়। কী একখানা গাড়ি চড়ে এসেছে, দেখেছ?

তোমরা দেখগে। যাক আমিই বলছি গিয়ে ঘড়িটা কী করলি রে বঙ্কা।

ইস! বলছ কী? ওর সামনে মুখ দিয়ে বার করতে পারবে? একটা কপর্দকশূন্য ছেলে। নিঃসহায় অবস্থায় থেকে এই ক বছরে কোথায় উঠে গেছে ভাবা যাচ্ছে না, আর তুমি কিনা সেই ভাঙা ঘড়িটার কথা।

হরিগোপাল আরও গম্ভীর হল, ঘড়িটা ভাঙা ছিল না, কাঁটা আটকে রাখা হয়েছিল।

 ওমা! এ আবার কী কথা! কে আটকে রেখেছিল?

উত্তরটা শোনা হইল না।

ঘড়ির কথা কী হচ্ছিল বড়মামা? বলিতে বলিতে বঙ্কিমবিহারীর উদ্দাম প্রবেশ। দেখা গেল আর যতই যা বদল হোক, চিরদিনের প্রবেশভঙ্গীটার বদল হয় নাই বন্ধুর।

তা বড়মামার আগেই বড়মামী ভাগিনেয়র প্রশ্নের উত্তরটা দিয়া দেন। সরল, উচ্ছল, এই তোর হাতের ঘড়িটার কথা বলছিলাম তোর মামাকে। কী অপূর্ব দেখতে। কী কলকজা। ঘড়ির মধ্যেই ক্যালেন্ডার। ঘড়ির মধ্যেই।

ও হো হো। এই ব্যাপার। এ আর নতুন কী? ও দেশে এটা তো এখন বাতিলের দলে। তা মামা, তুমি এমন বুড়িয়ে গেলে কেন বল তো? রিটায়ার ফিটায়ার করে বসেছ না কি? …ওঃ!

মামী বলল, ছুটির দিনে কাগজ চিবোচ্ছে।

হাহা হা! নাঃ! সেই নেশা? তা এনার্জির এমন অভাব কেন মামা? সেই আদ্যিকালের পিঠ ভাঙা বেতের চেয়ারই চালিয়ে যাচ্ছ। ..কী আর বলব মামা, পৃথিবীটাকে একবার না দেখতে পারলে চোখ তৈরি হয় না। আমাদের এখানে জীবন মানে দিনগত পাপক্ষয়। আর ওদেশে? জীবন মানে হচ্ছে

বন্ধুর জীবনের মানে খোঁজার আলপিন প্রমাণ অবকাশে হরিগোপাল শীতল কণ্ঠে বলেন, আমেরিকা থেকে এলি বুঝি?

অ্যামেরিকা! মানে স্টেটস। নাঃ ওটা এখনও হয়ে ওঠেনি। তবে হওয়াতেই হবে শীগগির। বিজনেসের বেড়াজালে পড়তে যাচ্ছি যখন। তা অতদূরে নয়। এই মিডল ইষ্ট একবার ঘুরে এসো মামা। পাসপোর্টের জন্যে চিন্তা নেই, আমি আছি। দেখে এসো মামা, ভোগ কাকে বলে, রুচি কাকে বলে, বাঁচার মত বাঁচা কাকে বলে। হবে না কেন? সব কিছুরই মূলাধার তো টাকা? টাকা দিয়ে তুমি কী না কিনতে পারো? শুধু বাড়ি গাড়ি আরাম আয়েসই তো নয়, যশ মান খ্যাতি প্রতিষ্ঠা, রুচি কালচার, কী নয়? আর সেই টাকা ওই দেশটার রাস্তার ধূলোয় ছড়ানো। বাতাসে টাকা, আকাশে টাকা। নইলে আমার মত একটা অভাগা বেকারকে ষোলো হাজার টাকা মাস মাইনে দিয়ে পোষে? প্লাশ রাজার হালে রাখা। বাড়ি গাড়ি ফার্নিচার সব ফ্রী।

হরিগোপাল চমকিয়া বলেন, মাসে ষোলো হাজার? তখন হঠাৎ শুনে ভাবলাম বুঝি বছরে?

বছরে? হা হা হা। বছরে ষোলো হাজার ছাপানো তো ওদের ঝাড়দারের মাইনে। বঙ্কিম দমকে দমকে হাসে।

আর তুই সোনার দেশের চাকরী ছেড়ে দিয়ে চলে এলি? প্রশ্নমুখর কণ্ঠ আক্ষেপ বিহ্বল।

পরক্ষণেই সান্ত্বনাঘন উত্তর, তবু চাকরী ইজ চাকরী মামী, চাকরগিরি। দাসত্ব। বিজনেস হচ্ছে স্বাধীন ব্যাপার। তাছাড়া বরাবর তো বাইরে পড়ে থাকা যায় না? মা বুড়ি রয়েছে। আর মাসে ষোলো হাজার আর এমন কী? পার্ক স্ট্রীট পাড়ায় একটা ফ্ল্যাট নিয়ে নিলাম হাজার আড়াই দিয়ে, সেখানেই নিয়ে রাখবো মাকে। আহা এতদিন পরের বাড়িতে কাশীতে পড়ে আছে। পিসি অবিশ্যি যত্নটত্ন করে। তা আমার তো আকাশে উড়ে উড়েই দিন যাবে, মার জন্যেই ফ্ল্যাট!

হরিগোপাল বলিয়া ওঠেন, তুই উড়ে বেড়াবি, তা মা বুড়ি তোর ওই পার্ক স্ট্রীট পাড়ার আড়াই হাজারি ফ্ল্যাটে একা বাস করতে পারবে?

সেটাই প্রবলেম ছিল, তো ছোটমামা সেটা সম্ভ করে দিয়েছে। উইথ ফ্যামিলি মার কাছে গিয়ে থাকবে।

অ্যাঁ। হরিগোপাল গৃহিণী যেন আছাড় খাইলেন। ক্ষোভে দুঃখে বিস্ময়ে চোখে জল আসিয়া গেল। একটুখানির জন্য চলিয়া আসিয়াছেন তিনি, ইতিমধ্যে এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়া গেল। ..ছোটগিন্নী সাহেবপাড়ায় দুই হাজারি ফ্ল্যাটে সংসার সাজাইয়া বসিবে, আর তিনি এই পচা পুরনো নোনা ধরা বাড়িখানায় পুরনো জঞ্জালের বোঝা লইয়া পড়িয়া থাকিবেন। উঃ! হইবে না। কেন স্বামী যার বেকুব আহাম্মক, তার আর কী হইবে? মাথা খুঁড়িতে ইচ্ছা হইতেছে।

বন্ধুর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই হরিগোপাল যদি ছুটিয়া যাইতেন, এতবড় সিদ্ধান্তটা কী তার অজানিতে লওয়া হইয়া যাইত?

হরিগোপাল অবশ্য আকস্মিক ওই সংবাদে বিচলিত হইলেন না। অগ্রাহ্যের গলায় কহিলেন, দ্বিজু বাড়ি ছেড়ে ফ্ল্যাটে গিয়ে থাকতে যাবে ডাবুকে আগলাতে? ডাবুর সঙ্গে তো ওর বরাবর আদায় কাঁচকলায়।

ক্ষেত্র বিশেষে আদা কাঁচকলাও আমদুধ হয়ে যায় মামা, ওটা কোনও ব্যাপার নয়। …বন্ধু একটু দার্শনিক হাসি হাসে।

তারপর বলে, তা তুমিও এই পচাপড়া ছেড়ে, আসল কথা পুরনো চশমাটা পালটাতে হবে। দুনিয়াটাকে একবার চোখকান খুলে দেখতে শেখো মামা, দেখবে জলে স্থলে আকাশে বাতাসে সর্বত্র টাকার চাষ চলছে। বুদ্ধি খাঁটিয়ে তার ফসল থেকে খানিক খানিক নিজের গোলায় তোলা, ব্যস। নো চিন্তা!…যাই বল মামী, ছোট মামা অনেক প্রগ্রেসিভ। এক কথায় আমার বিজনেসে পার্টনার হতে রাজী হয়ে গেল। মহা উৎসাহে।

অ্যাঁ। আবার বিজনেসের পার্টনারও।

ওপাড়ায় চলো না মামা। ঠিক আমার ফ্ল্যাটেরই লাগোয়া আর একটা ফ্ল্যাট এখনও খালি রয়েছে, একটু মোটা সেলামী দিতে পারলেই পাওয়া অসম্ভব হবে না।…তা সেটা না হয় আমি ম্যানেজ করে ফেলব। দু মাসের অ্যাডভান্স দিয়ে বুক করে নিই তাহলে মামা? …বেশ সকলে একত্রে থাকা হবে। অথচ কারও সঙ্গে কারও ইয়ে থাকবে না। যে যার স্বাধীন। মামী একটু সুখের মুখ দেখে।

হরিগোপালবাবু তাহার স্ত্রীর বহুবিচিত্র আলোড়নে আলোড়িত মুখটি দেখিয়া লন, সে মুখে হতাশার সঙ্গে আশা। গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, ভাল প্রস্তাব। তা ভাড়া কত?

ওই তো বললাম, এক রকমই ফ্ল্যাট। দু হাজার। কিন্তু যে দেখছে আমায় তারিফ দিচ্ছে এত সস্তা পাওয়ার জন্যে। লোকে আড়াই তিনে পেলে লুফে নেবে। নেহাৎ আমার সঙ্গে খাতির আছে বলেই

খাতির আছে? তবে যে বললি মোটা সেলামী নেবে।

খাতির আছে বলে সেলামী ও নেবে না? মামা, তুমি এখনও তোমার জন্মকালের পৃথিবীতেই রয়ে গেছ। পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে।

অগ্রসর পৃথিবীর বাসিন্দা বন্ধু তার বড় মামার অপাপবিদ্ধতায় হাহা শব্দে হাসিয়া ওঠে। •

হরিগোপাল কহেন, তা তুমি না হয় সেটা ম্যানেজ করলে, দু মাসের অ্যাডভান্সটাও কিন্তু বরাবর? এ বাড়ির ভাড়া বেড়ে বেড়ে এতদিনে তিনশো। বাকিটা ম্যানেজ হবে কী করে? মাসে দুহাজার টাকা ভাড়া দেবার মত এলেমদার তো তোমার মামা নয়। তোমার মামীকে সুখের মুখ দেখানো এজন্মে আর

বন্ধু এক ফুঁয়ে মামার এই যুক্তিকে নস্যাৎ করিয়া দেয়, নাঃ। মামা। সত্যিই তুমি এখনও ওল্ড স্কুলের ছাত্র রয়ে গেছ। বাড়ি ভাড়া নিয়েছ বলেই বরাবর ভাড়া টেনে যেতে হবে, এ প্রেজুডিস এখনও গেল না তোমারও। অচল। দু চার বার দিয়েই ভাড়া দেওয়া বন্ধ করবে। তখন বাড়িওয়ালা কেস করবে। সে কেস শেষ হতে দশ বিশ বছর লেগে যাবে। অবশেষে বাড়িওয়ালাই তোমায় হাতে পায়ে ধরে মোটা টাকা সেলামী দিয়ে তবে বাড়ি ছাড়া করতে পারবে। তুমি তখন সেই সেলামীটাকায় আবার কোথাও একটা ফ্ল্যাট নেবে, আবার সে প্রেসকৃপশান রিপিট করবে। অসুবিধেটা কোথায়?…

হরিণোপাল গৃহিণীর মাথা ঝিমঝিম করিয়া আসে। ওঃ ছোট গিন্নী চিরদিন তাঁহাকে টেক্কা মারিয়া কাটাইয়া গেল। আর তিনি? এই এক বোকা হাবার হাতে পড়িয়া-মরীয়া হইয়া বলিয়া ওঠেন, তা আমাকেও তোর ব্যবসার পার্টনার করে নে না বাবা! আমি তো আর তোর বড় মামার মত সরকারের চাকর নই যে ব্যবসায় বাধা।

বাধা?

বন্ধুর মুখে একটু মোনালিসা মার্কা হাসি ফুটিয়া ওঠে, উঃ! এত ইনোসেন্ট তুমি মামী। সর্ষের মধ্যেই কত ভূত যদি জানতে। কিন্তু আমার ব্যবসার পার্টনার হওয়া তোমার কর্ম নয় মামী। ও ছোটমামাই–এই রে দারুণ দেরি হয়ে গেল। উঠলাম। ছোটমামী আবার চায়ের জন্যে মাথার দিব্যি দিয়ে টেবিল সাজানো টা নিয়ে বসে আছে।

হরিগোপাল ভ্রাতৃবধূর মাথাকে গুরুত্ব দেন না। পাথুরে গলায় বলিয়া ওঠেন, তা তোমার বিজনেসটা কিসের?

কিসের? এককথায় কি বোঝানো যাবে মামা? কিসের নয়? ক্যাপিট্যালের তো প্রশ্ন নেই, যখন যেদিকে সুবিধে শাখা বিস্তার করা যায়। তা ধরে নিতে পারো সাপ্লাইয়ের।

ক্যাপিটালের প্রশ্ন নেই?

বন্ধু ততক্ষণে উঠিয়া পড়িয়াছে, হাতের সেই অপূর্বসুন্দর ঘড়িটিতে একটা নজর ফেলিয়া দ্রুত উত্তর দেয়, মোটেই না, সবই হাওয়ায় হাওয়ায় লেনদেন, তাতেই ডিম পাড়ছে লাখ লাখ ছানা গাড়ছে কোটি কোটি। আজকের দুনিয়া তো ওই হাওয়ার ওপরেই চলছে মামা। বিশেষ করে আমাদের এইখানে। মার্কেট সমীক্ষা করেই চলে এলাম…উঃ নাঃ। অসম্ভব। সাড়ে দশটায় একটা মিটিং রয়েছে গ্র্যান্ড হোটেলে। চলি।…

ছোটমামী আজ আর তোমার হাতের চা খাওয়া হল না।…

তথাপি বড়মামী ছুটিয়া পিছু ধাওয়া করেন। অ বন্ধু বললি যে সাপ্লাইয়ের ব্যবসা। তো কী সাপ্লাইয়ে এমন লাখ লাখ কোটি কোটি

সিঁড়িতে নামিতে নামিতে মুখ ফিরায় বন্ধু হাসি আঁকা মুখে। গলা নামাইয়া বলে, তোমায় আর কী বোঝাবো মামী। এককথায় বলতে–আরও স্বর নামায়। ধরে নাও–নামিতে থাকে এক এক লাফে দুই দুইটা ধাপ।

মামী কিন্তু বসিয়া পড়িয়াছেন।

আমার সঙ্গে তুই ঠাট্টা করছিস বন্ধু?

 এমা ছি ছি, সে কি?

বন্ধুর মুখ ঊর্ধ্বমুখী, তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করবো আমি?

তবে ওকথা বললি কেন? ওটা আবার একটা জিনিস? যে তাই দুনিয়া সুষ্ঠু লোকেবলি কোন্ কর্মে লাগে ওটা?

বন্ধু আবার একলাফে দুই ধাপ উঠিয়া আসিয়া গলা বাড়ায় এবং চড়ায়, দুনিয়ায় অমন জিনিস আর আছে? ধরতে পারো ধরে যাও অতি উত্তম। আবার যত কিছু চাপা দিতে চাও দিয়ে যাও সেও উত্তম। এতদিন যাবৎ ধরে ধরেই দু পয়সা গুছিয়ে নেওয়া গেছে। এবার

আর একটু পষ্ট হ বন্ধু দেশসুদ্ধু লোক এত কি চাপা দেবে? বললি তো ব্যবসাটা হচ্ছে ধামার। তা কতবড় মাপেরই বা হয় সে জিনিস? কিছুই তো।…

হোপলেস! মামী তুমি চিরনাবালিকাই রয়ে গেলে। মামা, পারো তত বোঝাও, আমার আর টাইম নেই। মাপের প্রশ্ন নেই গো মামী। তোমাদের এতটুকুন দামোদর শিলাটি ব্রহ্মাণ্ড হজম করে না? নাঃ। মিটিঙের বারোটা বেজে গেল।

দ্রুত ধাবমান বন্ধুর বাণী বাতাসে আছড়াইয়া আছড়াইয়া দোতলায় উঠিয়া আসে, মাপ তো আমাপা। কায়দা জানলে ওতেই পাহাড় পর্বত, গঙ্গা পদ্মা, চন্দ্র সূয্যি আকাশ পাতাল। ইয়ে সত্যিমিথ্যে, ভুল ঠিক, সব…সব চা..আ…পা…।

শেষটা শোনা যায় না, সেই শব্দের উপর একটি কাতর আর্তনাদ আছড়াইয়া পড়ে, আজ আমায় ফাঁকি দিলে বন্ধু, কাল কিন্তু আসতেই হবে। না এলে দুঃখে মরে যাব।…প্লেন তো তোমার সন্ধ্যেবেলা

দ্রুতলয়ের এই আর্তনাদের উপর গাড়ির দরজা বন্ধ করার দমাস শব্দটা দমাস করিয়া পড়ে। অতঃপর স্টার্টের শব্দ।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *