চশমরঙ্গ – ১

চশমরঙ্গ : একটি জাদুবাস্তব উপন্যাস – মলয় রায়চৌধুরী

বাইলাইন : অ্যাকাডেমি অফ দি পারফরমিং ফ্লেশ

         নগেন দত্ত নিজের মগজের ভেতরের গোলাপি অন্ধকারকে বলছিলেন, আমি তো একজন সাধারণ ল্যাওড়াকান্তি মানুষ মাত্র, তবে কেন সবাই আমাকে প্রতিভাধর বলে, চেনা কিশোররা প্রতিভাধারী নগেন বলে পঞ্চাশ একশো দেড়শো বছর আগে ক্ষ্যাপাতো, এখনও ক্ষ্যাপায়, এখন, যখন তাঁর বয়স চব্বিশ পেরিয়ে সবে পঁচিশ ; প্রায় তিরিশ বছর আটকে ছিলেন চব্বিশতম বয়সে, তাঁর দাদামশায়ের ফারসি ভাষায় লেখা উইলে সেরকমই নির্দেশ ছিল, কত বছর বয়সে কোন বয়সে কতোকালের জন্যে আটকে থাকতে হবে, নগেন দত্ত তা মেনে চলেছেন !

         ওনার, দাদামশায়ের, যিনি ছিলেন ছয় ফিট লম্বা, চওড়া কপাল, কাঁধ পর্যন্ত চুল, জোড়াভুরু, সিক্সপ্যাক অ্যাব, যদিও সময়ের প্রথা অস্বীকার করে একটিই বিয়ে করেছিলেন, উইলে ‘কী করিতে পারিবে’ আর কী করিতে পারিবে না’, তার দুটি তালিকা আছে, ‘কী করিতে পারিবে না’ তালিকার কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন নগেন দত্ত যে তিনি তা সত্যিই পারেননি, যেমন একবার এক কুকুরীকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছিলেন যখন তাঁর সজীব বয়স উত্তাল নয় বছরে আটকে ছিল ।

         যারা ওনাকে, মানে নগেন দত্তকে, প্রতিভাধারী বলে ক্ষ্যাপায়, তাদের উনি ইচ্ছে করলেই উন্মাদ করে দিতে পারেন, স্রেফ লম্পটের শিস দিয়ে, করেন না, কেননা জিনিয়াসগিরি হল দানবিক আর দৈব প্রাপ্তির মিশেল, সকলের জীবনে জোটে না ।

         নগেন দত্ত, ছটফটে তারুণ্যের অনিশ্চয়তায়  যখন প্রেসিডেন্সি কালেজে পড়তেন, হেনরি মেইনে ছিলেন ভাইস চ্যান্সেলার, সহপাঠী নবীনচন্দ্র সেন, যিনি তাঁর সঙ্গেই ১৮৬৫ সালে এফ এ পাশ করেছিলেন, তাঁকে বলতেন, ‘তোমার মাথায় কীট প্রবেশ করিয়াছে, সত্বর বৈদ্যের নিকট যাও।’

         নগেন দত্ত উত্তরে বলেছিলেন, ‘মাথায় কীট আছে বলেই আমি নগেন দত্ত, নয়তো বাংলার নাগরিক আমায় নুনুযুবক বলে চিনতো ।’

         তখনও নুড়িপূজক আর কাটানেড়েরা মারামারি কাটাকাটি করে আলাদা হয়নি, একই জালে ধরা দুই সের ওজনের ইলিশ খেতো, একই খেতের ধানের পান্তা-ভাত খেতো, একই বানভাসিতে ডুবে পচে ভেসে উঠতো হাত ধরাধরি করে সুন্দরবনের মোহনায়, তারপর হারিয়ে যেতো, একই দুর্ভিক্ষে কেঁদেকেটে ‘একটু ফ্যান দাও গো মা’ বলে গেরস্তের দোরে কঙ্কালসার পরিবার নিয়ে হাজিরা দিতো, একই মড়কে রাস্তায় মরে পড়ে থাকতো, যার ওপর একই নীল মাছি ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’ গাইতে গাইতে মরে যেতো ।

         নিজের জীবনীতে নগেন দত্ত সম্পর্কে লিখেছিলেন নবীনচন্দ্র সেন, যদিও পাণ্ডুলিপির সেই পৃষ্ঠা হারিয়ে গিয়েছিল হাতে সাজানো সীসার অক্ষরের ছাপাখানা থেকে, নবীনচন্দ্র সেনের সন্দেহ ছিল যে এই কুকীর্তি স্বয়ং নগেন দত্তের, উনি অমরত্ব নিজে চান না, অন্যদের বিলিয়ে থাকেন।

        নবীনচন্দ্র সেন লিখেছিলেন যে, “নগেন দত্ত নামের তরুণটি লুডউইগ বিঠোফেনের সি শার্প মাইনরে বাজানো চোদ্দো নম্বর পিয়ানো সোনাটা শুনিলে উন্মাদের ন্যায় আচরণ করিতেন, তখন তাঁহাকে সামলাইবার জন্য তিরিশ হাজারিনীর দেশে লইয়া যাইতে হইত।” 

         তিরিশ হাজারিনীর দেশে কেবল বুদ্ধিমান আর সাহসী পুরুষরাই যাতায়াত করে ।

         তিনি, নগেন দত্ত, কখনও কদমছাঁট, কখনও ব্যাকব্রাশ তেলচুকচুক, কখনও বাবরিছাঁট, কখনও পিগটেল নুটি, আকাশে বসন্তকালের কালবৈশাখির হাড়ভাঙা পরিশ্রমের কালো মেঘ আর আওয়াজহীন মেয়াদি বিদ্দ্যুচমক সত্ত্বেও, কোনো বাড়িতে চেনবাঁধা নেড়ি-কুকুরের অনুনয়ী ডাক শুনতে-শুনতে, বৃষ্টির আগের রাশ-টানা শীৎশিতে হাওয়া মুখে মেখে, মনে করার চেষ্টা করছিলেন, দেড়-দুশো বছর আগের আকুলি-বিকুলি ঘটনা, বা তারও আগের হতে পারে, ঝোড়ো ঝড় এড়িয়ে আলোকপ্রাপ্তির জন্যে নৌকো থেকে নেমে তিরিশ হাজারিনীর দেশে যখন এসেছিলেন উনি, মাত্র কয়েকটা পাকা দোতলা বাড়ি ছিল, জমিদারি আয়েসের হাঁসজারু স্হাপত্যের বাড়ি, এলাকাটা তখন এরকম বহুযোনিক ছিল না, পাড়া নামের বিদকুটে ব্যারিকেড অঞ্চল হয়নি বলে, আজ কালো টয়োটা এটিওস সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে পার্ক করে, হঠাৎ লোডশেডিঙের নানাবিধ অন্ধকার হাতড়িয়ে, মুঠোয়ধরা মোবাইলে দেড়-দুশো বছর আগে রেকর্ড করা, জিপিএস পথনির্দেশ দেখতে-দেখতে, আর ইয়ার ফোনে তা শুনতে-শুনতে, এগোচ্ছিলেন, রেকর্ড করা কন্ঠস্বর ওনার নিজের, অথচ যাকে কালেজের শিক্ষকরা মনে করেন তা এক ডেপুটি ম্যাজিসট্রেটের ।

          তখনকার, যখন লোকে তাঁকে, তিনি সাধারণ মানুষ নন বলে, প্রতিভাধর কিংবা অতিমানুষ আখ্যা দিতো, সেইসব অচেনা-আধাচেনা মানুষের কথাগুলো শুনে, নগেন দত্ত নিজের মগজের ভেতরের গোলাপি অন্ধকারে,   প্রতিক্রিয়ায় বলে ওঠতেন, “যতো সব অ্যাঁড়গ্যাঁজানে পেঁচো মালের গুষ্টি।”

         তিরিশ হাজারিনীর দেশের পথে, তিল ধারণের জায়গা নেই এমন জমাট অন্ধকারে, ওনার কথাগুলো প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এলো ওনার কাছে, তা শুনে টের পেলেন, কেউ উনোনে চাপানো কড়াইতে সর্ষের গরম তেলে হিঙের ফোড়ন দিলো, হয়তো ধোকার ডালনা বানাবে, যেমন ওনার স্ত্রী সূর্যমুখী,  আশি বছর আগে কচিসবুজ তুঁতে-বিষ খেয়ে আত্মহত্যার আগে রাঁধতো ।

       হেডফোনে যা উনি শুনছিলেন :

        “আকাশে মেঘাড়ম্বরকারণ রাত্রি প্রদোষকালেই ঘনান্ধতমোময়ী হইল । গ্রাম, গৃহ, প্রান্তর, পথ, নদী, কিছুই লক্ষ্য হয় না । কেবল বনবিটপী সকল, সহস্র সহস্র খদ্যোতমালাপরিমণ্ডিত হইয়া হীরকখচিত কৃত্রিম বৃক্ষের ন্যায় শোভা পাইতেছিল । কেবলমাত্র গর্জনবিরত শ্বেতকৃষ্ণাভ মেঘমালার মধ্যে হ্রস্বদীপ্তি সৌদামিনি মধ্যে মধ্যে চমকিতেছিল — স্ত্রীলোকের ক্রোধ একেবারে হ্রাসপ্রাপ্তি হয় না । কেবলমাত্র নববারিসমাগমপ্রফুল্ল ভেকেরা উৎসব করিতেছিল । ঝিল্লিরব মনোযোগপূর্বক লক্ষ্য করিলে শুনা যায়, রাবণের চিতার ন্যায় অশ্রান্ত রব করিতেছে, কিন্তু বিশেষ মনোযোগ না করিলে লক্ষ্য হয় না । শব্দের মধ্যে বৃক্ষাগ্র হইতে বৃক্ষপত্রের উপর বর্ষাবিশিষ্ট বারিবিন্দুর পতনশব্দ, বৃক্ষতলস্হ, বর্ষাজলে পত্রচূত জলবিন্দু পতনশব্দ, পথিস্হ অনিঃসৃত জলে শৃগালের পদসঞ্চরণশব্দ, কদাচিৎ বৃক্ষারূঢ় পক্ষীর আর্দ্র পক্ষের জল মোচনার্থ পক্ষবিধূনন শব্দ । মধ্যে মধ্যে শমিতপ্রায় বায়ুর ক্ষণিক গর্জন, তৎসঙ্গে বৃক্ষপত্রচূত বারিবিন্দু সকলের এককালীন পতনশব্দ । ক্রমে নগেন্দ্র দূরে একটা আলো দেখিতে পাইলেন । জলপ্লাবিত ভূমি অতিক্রম করিয়া, বৃক্ষচ্যূত বারি কতৃক সিক্ত হইয়া, বৃক্ষতলস্হ শৃগালের ভীতি বিধান করিয়া, নগেন্দ্র সেই আলোকাভিমুখে চলিলেন । বহু কষ্টে আলোক সন্নিধি উপস্হিত হইলেন । দেখিলেন এক ইষ্টকনির্মিত প্রাচীন বাসগৃহ হইতে আলো নির্গত হইতেছে । গৃহের দ্বার মুক্ত ।”

        ঠিক জায়গাতেই এসে পড়েছি, তিরিশ হাজারিনীর দেশে, নিজের মগজের ভেতরে নিজেকে ফিসফিস করে বললেন নগেন দত্ত, যেন পারিবারিক মানদণ্ডের অলিখিত অথচ সর্বমান্য সীমালঙ্ঘন করতে চলেছেন এমন সাবধানি সন্তর্পণে, খরগোশের গর্তের মুখে শেয়ালের অপেক্ষারত ঔৎসুক্যের মতন, যদিও দাদামশায়ের বাঁধা সীমা উনি পেরোন না, পেরোবার উপায় নেই, তা এক মহাজাগতিক সীমা । কোনো মামণিকে যে পিং করবেন তাও প্রেমের শেমে বাঁধা ।

         বেশ দূরে, ঝিমন্ত-হলুদ  আলো জ্বলছিল দেখে, নিশ্চিন্ত হলেন নগেন দত্ত, লন্ঠনের আলো, হ্যাজাকের নয়, ওই তো একটা বাড়ির সদরের কপাট হাঁ করে খোলা, নাগরদের গিলে ফেলার অপেক্ষায়, যারা এই পাড়ায় আরেকটু রাত হলেই আসা আরম্ভ করবে । কিন্তু জঙ্গলের বদলে রয়েছে ইঁটের দাঁত-বেরোনো ফুটপাথ-ঘেঁষা দিনকয়েকের পচা জঞ্জাল, শেয়ালের বদলে খ্যাংরাটে হাড়গিলে  ভেড়ুয়াদের ঘ্যানঘ্যানানি, রয়েছে বুড়িয়ে হেলে পড়া বৃষ্টি-বাদলার মার খাওয়া নোংরা কুঁজো বাড়ি, কার্নিশের ফাঁকে বেবি অশথ্থগাছ, অন্ধকারে যেটুকু দেখা যায়, বাড়িগুলোর সামনে কচি-পাকা নানা রকমের চংকুমণি ঢলঢলে-যৌবন যুবতী আর উঠতি-যুবতীরা দাঁড়িয়ে আছে, পোশাকও অদ্ভুত, যেন হাফশেমিজের তলা কেটে কোমরে বেঁধেছে, যেন শেমিজের ওপরটা কেটে ওপরে পরেছে যাতে তাদের বুকের খাঁজের মনমাতানো আলো আর কোমরের হাতমাতানো বেড় দেখতে পাওয়া যায় ,ওপরের সঙ্গে তলাকার পোশাকের মিল নেই কোনো, অন্তত তাই মনে হল অন্ধকারে ।

        যাতায়াত-মুখর ল্যাদখোর রাস্তায় আরেকটু খুঁটিয়ে দেখে বুঝতে পারলেন নগেন দত্ত, যাকে উনি কাটা-শেমিজ বলে ভাবছিলেন, তা ওদের ত্বকে আঁকা, কয়েকটা পেইনটিঙ উনি ইতালি, ফ্রান্স, নেদারল্যাণ্ড, আমেরিকায় দেখেছেন, যখন পতৃদেবের হাত ধরে গিয়েছিলেন ওই দেশগুলোয়, ভ্যানগঘের ‘স্টারি নাইটস’, সান্দ্রা বত্তিচেলির ‘বার্থ অফ ভেনাস’, গুস্তাভ ক্লিমটের ‘দি কিস’, গেওর্গে সেরার ‘এ সানডে আফটারনুন’, দিয়েগো ভেলাকোয়েজের ‘লা মেনিনাস’, জ্যাকসন পোলকের ‘নম্বর ফাইভ’, দিয়েগো রেভেরার ‘দি ফ্লাওয়ার ক্যারিয়ার’, আরও অনেকের । ছবিগুলোর নিউড দেখে নগেন দত্ত বাবাকে বলেছিলেন, ইশ কি ভীষণ বাজে সুন্দর মেয়েরা। উত্তরে বাবা বলেছিলেন, ছবি দেখে ক্রাশ খাসনি, এখন অনেক বছর বাঁচবি, অপেক্ষায় শিমুল পলাশ রঙ ধরে।

         অন্ধকারে ভেসে বেড়াচ্ছে মেয়েগুলোর কাঁচা মাংসের ডাক, কতোরকমের পাখির ডাকের গন্ধ, গত দুশো বছর যাবত শুনে এসেছেন নগেন দত্ত, বাদাতিতির, লালগলা-বাতাই, রাজসরালি, ধলাকপাল রাজহাঁস, চকাচকি, মেটেহাঁস, মেটেধনেশ, নাটাবটের, কুটিকুড়ালি, নীলকন্ঠ, সুইচোরা, পাপিয়া, কোকিল, মালকোয়া, কুবোপাখি, চন্দনা, ঘরবাতাসি, রাতচরা. তিলাঘুঘু, হরিয়াল, ডাহর, সারস, ডাহুক, নেউপিপি, সোনাজিরিয়া, গাঙচিল, মধুবাজ, চড়ুই, ঈগল, শাহিন, পানকৌড়ি, কানিবক, কাস্তেচরা, মদনটাক, শুমচা, বেনেবউ, ফিঙে, ফটিকজল, দোয়েল — তাদের ডানা-ঝাপটানো ডাকের মিহিমিহি সুবাস রয়ে গেছে নগেন দত্তের শরীরে ।

         উনি, নগেন দত্ত, কয়েকশো বছর যাবত খুঁজে ফিরছেন কুন্দনন্দিনী নামে কুমারীফাটল এক তরুণীকে । জীবনের উদ্দেশ্য থাকা প্রয়োজন মনে করে নয়, খুঁজে চলেছেন মেয়েটিকে ভালোবাসবেন বলে, তাকে আজও ভালোবাসতে পারেননি নগেন দত্ত ; আসলে ভালোবাসাই ওনার জীবনের উদ্দেশ্য, বেঁচে থাকার মানে । বেঁচে থাকার জন্যে ওনাকে কিছুই করতে হয় না, কিন্তু জানেন যে ভালোবাসার জন্যে অনেককিছু করতে হবে । জীবন ওনার তারিখহীন হয়ে গেছে ।

         মগজের ভেতরে যে গানটা তাঁকে বিনবিনে উনকির মতন ছেঁকে ধরেছিল, অন্ধকারকে চটচটে একাকীত্ব থেকে বের করে আনার জন্য, তা মুখ দিয়ে জগন্ময় মিত্রের কন্ঠস্বরে বেরিয়ে আসছে শুনে অবাক হলেন না নগেন দত্ত, বেরোতে দিলেন গানখানা, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকসুদ্দু, কেননা ওনার মুখের ভেতরে হেন বাঙালি-অবাঙালি পুরুষ নেই যার কন্ঠস্বর সময়ে-অসময়ে বেরিয়ে আসেনি গত পঞ্চাশ একশো দেড়শো বছর যাবত, উনি যদি আজ ধুতি-পাঞ্জাবির বদলে জিনস-টিশার্ট পরে থাকতেন, তাহলে হয়তো গলার ভেতরে নাচতে আরম্ভ করতেন এলভিস প্রিসলে তাঁর ‘জেল হাউস রক’ গানখানা গাইতে-গাইতে, কিংবা হয়তো মাইকেল জ্যাকসনের ‘আই জাস্ট কান্ট স্টপ লাভিং ইউ’ গাইতে গাইতে, এখন ধুতি-পাঞ্জাবি-কোলহাপুরি পরে আছেন বলে জগন্ময় মিত্রের গানখানা আচমকাই বেরিয়ে এলো, নয়তো বড়ে গুলাম আলির ‘কা করুঁ সজনা আয়ে না বালম’ ও বেরোতে পারত, কার গান যে কখন বেরোবে তার ওপর ওনার, নগেন দত্তর বড়ো একটা নিয়ন্ত্রণ নেই, তা উনি মুখ বন্ধকরে রেখেও দেখেছেন, গান এসে গেলে তা বেরোবেই বেরোবে, আর ভালোবাসার গান হলে তা থামানো অসম্ভব :

                  ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে
                  তোমারে করেছি রানি ।
                  তোমারই দুয়ারে কুড়াতে এসেছি
                  ফেলে দেওয়া মালাখানি
                  নয়নের জলে যেকথা জানাই
                  সে ব্যথা আমার কেহ বোঝে নাই
                  মেঘের মরমে যে মিনতি কাঁদে
                  চাঁদ বুঝিবে না জানি ;
                 ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে
                 তোমারে করেছে রানি
                 মাধবীলতা গো আজ তুমি
                 আছ ফুলের স্বপনসুখে
                 একদিন যবে ফুল ঝরে যাবে
                 লুটাবে ধূলির বুকে ।
                 খেয়ালি প্রেমের খেলা বোঝা দায়
                 কখনো হাসায় কখনো কাঁদায়
                 মুক হয়ে যায় কারও মুখরতা
                 কারও মুখে জাগে বাণী
                 ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে
                 তোমারে করেছে রানি….

        ভালোবাসা, নগেন দত্ত চেয়েছেন, বিপথে যাবার মতন হোক, পথে যা পাবে ভেঙে গুঁড়িয়ে চুরমার করে, নারকেল গাছের মাথা থেকে পাতা মুড়িয়ে, ডাবের কাঁদি ছিঁড়ে ফেলে, চিলের বাসার ডিম ফাটিয়ে, বটগাছকে ঝুরি-শেকড়সুদ্দু উপড়ে ফেলে, মেছোবকের ঘুমন্ত ঝাঁক উড়িয়ে, নদীর জলে বান এনে, মাছের ঝাঁকেদের মধ্যে ঘুর্ণির মতন ঢুকে যাক, চালাবাড়িসুদ্দু গ্রামের পর গ্রাম এক জায়গা থেকে নিয়ে গিয়ে আরেক জায়গায় বসিয়ে দিক, শহরের বাড়িগুলো হেলে পড়ুক ভালোবাসার ভূমিকম্পে, ঝড়ে উড়তে থাকুক মিছিল ফেরত মানুষের দল, সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাক তাঁর প্রাপ্য ভালোবাসার পাত্রীর জন্যে ।

         আশা ছাড়ে না অনুভূতির দালাল  পেশাদার কোটনারা, খ্যাংরাটে পিম্পদের ঢ্যামনাকাত্তিক চেল্লাচিল্লির ঘ্যানঘ্যানানি ছেঁকে ধরেছিল ওনাকে, ঠিক যেমন ওদের হাড়ের সঙ্গে কোনোরকমে চিপকে আছে চামড়াটে মাংস, মুখের ভেতরে সেকারণেই থেমে গিয়েছিল গানখানা, ব্যাটারা দেখেছে নগেন দত্ত নেমেছেন টয়োটা গাড়ি থেকে, ওরা জানে খদ্দেরটা মালদার হাবলা, রসের নাগর, খাজা পাবলিক নয়, টাকার টাইমকল, সহজে ইল্লি খায় না, দশ কুড়ি চল্লিশ একশো দেড়শো বছরে অবিরাম কয়েকদিনের জন্যে আসে আর তারপর কোথায় হারিয়ে যায়, কোনো মেয়ে এনাকে ভালো কাস্টমার সার্ভিস দিলে তার একশো-দুশো বছরের জন্যে জীবনের বীমা করিয়ে দ্যান।

         কাচরাদের ক্যাচাল ভ্যানতারা এড়িয়ে,  অন্ধকারে বাঁহাতে মোবাইল দেখে এগোচ্ছেন , ডানহাতে অ্যাটাচিকেস, যাতে হয়তো অনেক টাকা আছে, তবু লুটপাটের চেষ্টা করে না দালালরা, তুকতাক করে এমন ক্ষতি করে দিতে পারেন যে হঠাৎ চিৎপটাঙ হয়ে মরে পড়বে গলিতে, মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত, এর আগে দুজন নাঙের সঙ্গে ঘটেছে অমন ঘটনা, একজনকে তো আকাশের চিল বানিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেই থেকে দালালটাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, থানায় নালিশ করতে গেলে ওসি বলেছিল, “এই, এই মালগুলোকে লকআপে বন্ধ করে দুচার ঘা দিয়ে হুঁশ ফিরিয়ে আন তো।”  যখন তাদের হুঁশ ফিরেছিল তখন ওরা দেখল যে কেষ্টপুরের খালের পাঁকে পোঁদ উল্টে উলঙ্গ পড়ে আছে, চারিদিকে অশ্লীল আধুনিক বাংলা ভাষার শহুরে ডিগডিগে কিচাইন ।

         আকাশের মেঘ আর কালবৈশাখিও যে নগেন দত্তই নিজের সঙ্গে নিয়ে এসেছেন সে ব্যাপারে কয়েকজন পুরোনো ভেড়ুয়া নিশ্চিন্ত, নয়তো এখন তো কালবৈশাখির মরসুম নয় ।

         লেগেই আছে পিটপিটে-চোখ ফ্যাঁচফ্যাঁচে সর্দি দাঁতক্যালানে দালালরা, যেমনটা ওরা প্রতিবার নগেন দত্তকে দেখলেই বিস্কুটখেকো নেড়ি-কুকুরের মতন পেছনে দৌড়োয়, মেজাজ চটকে যাবার যোগাড়, স্যার যেমন চান তেমন পাইয়ে দেবো, এই বাড়িতে আসুন, ফর্সা ধবধবে পাঞ্জাবি পাবেন, গুলশন কৌর, ফুরসত মাজিঠিয়া, সিমরন সিং,  গালফোলা ঢাউসবুক নেপালি চান পাবেন, ছিনমুন থাপা, চম্পক গুরুং, কুচর কইরালা, ঘড়ঘড়ে সর্দিবন্ধ গলার স্বরে, না স্যার, আমাদের বাড়িতে আসুন, মারোয়াড়ি বউয়ের সঙ্গে শুয়েছেন কখনও, জগৎশেঠের বাঁদির মেয়ের মেয়ের মেয়ের মেয়ে, ছয়েলছবিলি ঝুনঝুনওয়ালি, রাজস্হান থেকে টাটকা আমদানি, ব্রিটিশ সায়েবদের আমলের মারোয়াড়ি বউ, শিফনশাড়ি, কানে ঝমঝমে দুল, এয়ার কান্ডিশান ঘর, ঠোঁটে ল্যাকমে, গায়ে ডিওডোরেন্ট, ঘরে রুম ফ্রেশেনার, নাকি সুরে, লোকটার গালে ছুরি খাওয়ার দাগ, স্যার ওদের ছাড়ুন, আমি টিভিস্টার পাইয়ে দেবো, বাংলা চান বাংলা, হিন্দি চান হিন্দি, এক্সট্রা লার্জ বুকের সাইজ হুজুর, এক্সট্রা লার্জ পাছা, একবার এসে দেখুন না হয় তারপর যা ভালো বোঝেন করবেন, সারা রাত চান, ঘণ্টাখানেক চান, এমনকি দশ-পনেরো মিনিটের জন্যেও পাবেন হুজুর, বড়ো ছ্যাঁদা চান পাবেন, ছোটো ছ্যাঁদা চান পাবেন, যেন কিছুক্ষণ আগেই ঘুম ভেঙেছে, হাই তোলা বন্ধ রেখে ।

        নাহ, এ পাগল কাউকে পাত্তা দেবে না, বলল একজন কমবয়সী দালাল, ফিসফিস, হাঁ-মুখে চোলাই সাঁটা হাওয়া, চোঙা প্যান্ট । এই দালাল পঁচাত্তর বছর আগে, যখন ওর বয়স কুড়ি ছিল, নাইট-ভিউ গ্যালারির দরোজায় গেট-মিটিং করে পিম্পদের হরতাল ডেকেছিল, তবে তাতে অন্য পিম্পরা যোগ না দেয়ায় পাড়ার নেতা হতে পারেনি, বাইরের এক পালোয়ান এসে পাড়ার নেতা হয়ে গিয়েছিল, মনে পড়ল নগেন দত্তর। পালোয়ানের নাতি এখন মোহোল্লা কমিটির মুখ্য-কোটনা ।

        নগেন দত্ত কাউকে পাত্তা দিচ্ছেন না দেখে একজন খ্যাংরাকাঠি লুঙ্গিপরা গুটকামুখ দালাল টিটকিরি মারল, ওর বড়ো ছ্যাঁদার পাল্লায় পড়বেন না হুজুর, ঝাণ্ডা নিয়ে বড়ো ছ্যাঁদায় ঢুকবেন আর পুরো পার্টি দলবল নিয়ে মিছিলের স্লোগান দিতে-দিতে বেরিয়ে আসবে আবনার পিছন-পিছন ।

         নগেন দত্ত জানেন যে লোকটা সঠিক কথা বলেছে, ওনার ক্ষমতা আছে তা করার, একবার রাস্তা পেরোতে আধ ঘণ্টা লেগে গিয়েছিল বলে, ময়দানমুখো র‌্যালিকে সেই মিছিলের একজন মহিলার গর্ভে লোপাট করে দিয়েছিলেন, গর্ভের ভেতরে স্লোগানের দপদপানি শুনে সিজার করতে হয়েছিল মেডিকাল বোর্ডকে । এক ইঞ্চি মাপের মানুষেরা গর্ভ থেকে  ‘ইয়ে আজাদি ঝুঠা হ্যায়’ স্লোগান দিতে-দিতে বেরিয়েছিল।

         আমি শুতে আসিনি, জীবনে হাজার-হাজার বার শুয়েছি, দিনে দুতিনবার দুতিন জনের সঙ্গে শুয়েছি, বাৎসায়নের সবগুলো শোয়া শুয়ে নিয়েছি, এখন ভালোবাসতে আর ভালোবাসা পেতে এসেছি, এবার শুধু ভালোবাসার পাত্রীর ভালোবাসা চাইছি, বললেন নগেন দত্ত ।

         খেটে-খাওয়া মা আর খুঁটে খাওয়া বাপের ঝুপ্পুসলীলায় পয়দা-হওয়া দালালগুলো নাছোড়, মাংসের ঝোল দিয়ে ভাত মুখে পুরে কথা বলার ঢঙে, পাবেন স্যার, ভালোবাসা পাবেন, যেমন করে ভালোবাসতে চান পাবেন, দাঁড়িয়ে, বসে, পা ছড়িয়ে, উপুড় হয়ে, কুকুরের পোজে, সিংহের পোজে, গণ্ডারের পোজে, হাতির পোজে, বাসুন না যেমন ভাবে চান, একবার এসে তো দেখুন, দেখবেন ভালোবাসবার জন্য মুখিয়ে আছে, আপনার মন ভরে যাবে, রোজ আসতে ইচ্ছে করবে, বেশি রেট নয় স্যার, চলুন না, একবার নিজের চোখে দেখে তো নিন, যাদের দেখছেন এরা ভালো কোয়ালিটির আইটেম নয় স্যার, সস্তা, রোগ বাধিয়ে দেবে, ওপরে চলুন, নামি-দামি পাইয়ে দেব আপনাকে  ।

         মোবাইলকে লাউডস্পিকার মোডে লাগিয়ে নরেন দত্ত পিম্পগুলোকে বললেন, শোন শোন, তোরা শোন, আমি এই মেয়েকে খুজছি, তাকেই ভালোবাসতে চেয়েছি,  ভালোবাসতে এসেছি, তা দুশো বছর আগের কথা তো হবেই, বেশি তো কম নয় ।

         দালালগুলো নগেন দত্তকে ঘিরে মোবাইলে রেকর্ড করা কথা শুনতে লাগল, এতো কাছ থেকে যে নগেন দত্ত নিজের মগজের গোলাপি অন্ধকারে নিজেকে বললেন, ব্যাটারা ষাট-সত্তর বছর স্নানটান করে নি, গায়ে কি দুর্গন্ধ, এখন থেকেই ধেনো টেনে রেখেছে, বা হয়তো দশ বছর আগে যে ধেনো টেনেছে তার খোঁয়ারির বদবুতে মুখ ম-ম করছে ।

         একজন দালাল বলল, স্যার এর আগে কি এই মেয়েটাকেই খুঁজেছিলেন ?

         নগেন দত্ত বললেন দুশো বছর যাবত খুঁজে চলেছি, তোরা মন দিয়ে শোন :

         “সকলেই বিস্মিত হইয়া দেখিল যে যুবতীর শরীরে আর রূপ ধরে না । সেই বহুসুন্দরীশোভিত রমণীমণ্ডলেও, কুন্দনন্দিনী ব্যতীত তাহা হইতে সমধিক রূপবতী কেহই নহে । তাহার স্ফুরিত বিম্বাধর, সুগঠিত নাসা, বিস্ফারিত ফুল্লিন্দীবরতুল্য চক্ষু, চিত্ররেখাবৎ ভ্রুযুগ, নিটোল ললাট, বাহুযুগের মৃণালবৎ গঠন, এবং চম্পকদামবৎ বর্ণ, রমণীকুলদুর্লভ ।”

         মোবাইল অফ করে নগেন দত্ত বললেন, বুঝেছ, এই মেয়েকেই খুঁজছি ।

         একজন দালাল, গলায় মাফলার জড়ানো, এই গরমেও, বলল, স্যার এটা কি সরকারি হিন্দি, দূরদর্শনে খবর পড়ে, সেরকম মনে হল, শুনি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারি না । এর আগে তো আপনি কুঁদি নামে একটা মেয়েকে খুঁজতে আসতেন ।

         আরে, না রে ল্যাওড়ার ক্যাওড়া, মালায়ুলি মালায়ুলি, নীলকমল গ্যালারিতে আছে, দেখিছিস তো, এমনি করেই কতাটতা বলে, রেমড়িঁআম্মা, চলুন স্যার, নিয়ে যাচ্ছি মালায়ুলির কাছে, তবে ওর গায়ের যা রঙ, আবনার পাঞ্জাবি-ধুতি শাদা থাগলে হয়, ঘড়ঘড়ে গলার দালাল ।

         মালায়ুলি নয়, মালায়ুলি নয়, হায়দ্রাবাদি, কাইকু কাইকু করে কতা বলে, মোচোরমান চলবে তো হুজুর, ওর চেয়ে ভালো মোচোরমান মেয়ে পাইয়ে দেবো, আরবদেশের চেয়ে ফর্সা, চলুন আমার সঙ্গে, বুকে মুখ গুঁজে পিথ্থিবির সব দুখ্খু ভুলে যাবেন , অবশ্যি মেয়েদের হিন্দু-মোচোরমান বলে কিছু নেই স্যার, ওসব আস্ত-খোসা আর ছাড়ানো-খোসা পুরুষদের ব্যাপার স্যার, চলুন না, একবারটি দেখে নিন, নাকিসুর দালাল ।

        কারেন্ট চলে আসতে, ভেড়ুয়াগুলোকে দেখলেন নগেন দত্ত, নাঃ, কর্নওয়ালিসের দেয়া জমিদারি উঠে যাবার আগে এদের কেউই তাঁর মোসাহেব ছিল না, এরা তো সংসদীয় গণতন্ত্রের বাইপ্রডাক্ট, একেবারে ভিকিরি, দুবেলা নালির চোলাই আর পচাই-তাড়ি খেয়ে পড়ে থাকে । এরা কুন্দনন্দিনী উচ্চারণ করতে পারবে না ভেবে কুন্দনন্দিনীর ডাকনামটার কথা বলেছিলেন ।

         আরেকজন ভেড়ুয়া, গমগমে গলায় বলল, হুজুর, শুনে তো কিছুই বুঝতে পারিনি, তবে কুন্দনন্দিনী শুনতে পেলুম । আমার মাসিপিসির গ্যালারিতে যতোগুলো মেয়ে আছে সকলের নামই কুন্দনন্দিনী । ওই যে গন্ধরানির বাড়ি দেখছেন, সেখানে। আপনি আগের বার গিসলেন বোধয় স্যার ।

        মাসিপিসির গ্যালারি ? মুখময় পানিবসন্তের আলপনাদেয়া কোটনাটার দিকে মুখ ঘুরিয়ে, জানতে চাইলেন নগেন দত্ত, মাসি আর পিসি একই সঙ্গে ! যতোদূর জানি, আগে তো মাসি বলেই ডাকা হতো বাড়িউলিকে । তার বাড়িতে একজন নয়, দুজন নয়, সবাই কুন্দনন্দিনী ! কেমন করে জানা যাবে আসল কুন্দনন্দিনী কে ! ভালোবাসার পাত্রীকে কেমন করে খুঁজে পাবো ?

         না স্যার, উনি আগে কালেজে পড়াতেন, প্রফেসার চক্কোত্তি, কালেজের ছেলে-মেয়েরা ওনাকে পিসি বলে ডাকতো, কালেজে পড়িয়ে আর বেনামে বই লিখে তেমন রোজগারপাতি হতো না বলে এই লাইনে এয়েচেন, ওনার মালিক অনেক ট্যাকা ঢেলেচেন, আগের মাসি ছোটোবেলায় ওনার বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতো, তাপ্পরে কেউ ফুসলিয়ে ঝিকে বেচে দিলে দিল্লির মেড়ো পার্টিকে, সে আর ছাড়ে কেন, হেভি দাম দিয়ে কুমারী মেয়ের পরদা ছিঁড়তে পেলো । প্রফেসার চক্কোত্তি অ্যাগবার এসেছিলেন গন্ধরানির কাছে, বছর তিরিশ-চল্লিশ আগে, নকশাল করবার সময়ে গন্ধরানির খাটের তলায় পনেরোদিন লুক্কে ছিলেন, দুজনের এমন সখি-সখি ভাবভালোবাসা হল যে প্রফেসর চক্কোত্তি  গন্ধরানির ব্যবসা অনেক ট্যাকা দিয়ে কিনে নিলেন, লোকে বলে ট্যাকাটা ওনার গুরু-মহারাজের। অ্যাগবারে নতুন ঢঙে সাজিয়েচেন স্যার । গন্ধরানিকে রেখে এয়েচেন বুড়োবুড়ি আবাসে ।

         —ওঃ, ছোটো থেকে প্রোমোশান পেয়ে-পেয়ে এই বাড়িটা দখল করে নিলেন ?

         —জি হুজুর, আগের মাসির নামই গন্ধরানি । পাড়ার মেয়েরা বাড়িটাকে মাসিপিসির গ্যালারি বলে জানে । ঘড়ঘড়ে কন্ঠস্বরের দালাল ।

         —চলো, নিয়ে চলো, আসল কুন্দনন্দিনীকে যদি পাই, দেড়শো বছরের কান্না চোখের তলার থলিতে জমে আছে ।

         —পাবেন, পাবেন, সুদু এপার বাংলা-ওপার বাংলার মেয়ে পাবেন মাসিপিসির গ্যালারিতে, সকলের নামই কুন্দনন্দিনী ।

        —চলো, নিয়ে চলো, কতকাল হয়ে গেল বাংলা ভাষার সঙ্গে শুইনি, বাংলা ভাষার অরগ্যাজমের আনন্দ উপভোগ করিনি, ঠোঁটে বাংলা ভাষার থুতু পাইনি, বুকে বাংলা মাংসের জাপট পাইনি, বোধহয় পঞ্চাশ আশি একশো বছর হয়ে গেল । সেই কবে তিথি আহমেদ আর ছন্দরানি মজুমদারের সঙ্গে লিভ-টুগেদার করার দিনকালে যেটুকু আয়েশ করেছিলুম ।

         নিজের মগজের গোলাপি অন্ধকারে নিজেকে ফিসফিস করে বললেন, যে মেয়েগুলোকে দোরগোড়ায় দেখছি, এরা বাঙালিনী নয় বলেই তো মনে হচ্ছে, ত্বকে শ্যামল কোমলতা নেই, চোখ ডাগর নয়, পাছা অব্দি কোঁকড়ানো চুল নয়, কেবল ফর্সা দিয়ে নগেন দত্তের মন ভরে না, অবাঙালিনী হলে আবোলতাবোল কথা বলার আনন্দের তো উপায় নেই, কেবল দুদণ্ড জড়িয়ে শোয়া আর ইল্লি করে উঠে পড়ার জন্যে তো আসেননি, ভালোবাসতে আর ভালোবাসা পেতে এসেছেন, যে ভালোবাসা কুন্দনন্দিনী দেবে বলে কথা দিয়েছিল বহুকাল আগে । অ্যাটাচিকেসটা সেই জন্যেই তো এনেছেন সঙ্গে ।

         রাস্তার মুখে নীলের ওপর সাদা অক্ষরে লেখা কোবরেজ হরিদাস পাল সরণী ।

         মনে পড়ল নগেন দত্তর, জঙ্গলের মধ্যে শিশু গাছের তলায় বসে-থাকা নাকে-নস্যি হরিদাস পাল কোবরেজের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছিল ।

         —তুমি কি ?

         —আমি জীব ।

         —তুমি কোন জীব ?

         —আমি তটস্হ জীব ।

         —থাকেন কোথায় ?

         —ভাণ্ডে ।

         —ভাণ্ড কিরূপে হৈল ?

         —তত্ববস্তু হইতে ।

         —তত্ববস্তু কি ?

         —পঞ্চ আত্মা, একাদশেন্দ্র, ছয় রিপু, ইচ্ছা, এই সকল য়েক যোগে ভাণ্ড হইল । আমি সেহেতু চিরযুবক।

         নগেন দত্তর উত্তর শুনে হরিদাস পাল কোবরেজ বলেছিলেন, সঠিক উত্তর দিয়েছ, আলোকপ্রাপ্তির জন্যে জঙ্গলে প্রবেশ করতে পারো ।

        আলোকপ্রাপ্তি শব্দের সঙ্গে কুন্দনন্দিনীর কোথাও মিল আছে, মনে হল নগেন দত্তর।

         আজকে রাস্তাটায় ঢুকে সবই গুলিয়ে যাচ্ছিল নগেন দত্তর । ময়নামতির বাড়ির নাম হয়েছে নীলকমল গ্যালারি, সুখরানির বাড়ির নাম হয়েছে প্রেমকমল গ্যালারি, হরিমতির বাড়ির নাম হয়েছে প্রেমবন্ধন গ্যালারি, হেমনন্দিনীর বাড়ির নাম হয়েছে গঙ্গাজমুনা গ্যালারি, নলিনীবালার বাড়ির নাম হয়েছে নাইট লাভার্স গ্যালারি, যশোমতির বাড়ির নাম  পালটে কি হয়েছে দেখতে হবে , পিসির বাড়ির ঝিয়ের কথা বলছে, তাহলে কি যশোমতির কথা বলছে ! তবে বাড়ির দরজায় একটা নম্বর দেয়া, লোডশেডিঙের সময়ে অন্ধকার ফুটো-করা আলো দেখা যাচ্ছিল এই বাড়ির দরোজায় ।

          আরেকটু ভেতরে ঢুকতে পারতেন নগেন দত্ত, চিনতে পারলেন,   দুর্গাবরণ মিত্র সরণী, হ্যাঁ, এই জমিদারবাবুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বলে মনে পড়ছে, ওনার কাছারিবাড়িতে রামপ্রসাদ সেন নামে একটি ছেলে ভালো শ্যামাসঙ্গীত গাইত।  মগজের ভেতরে রামপ্রসাদ সেনের কন্ঠস্বর গেয়ে উঠতে চেয়েছিল, শ্লেষ্মা দিয়ে চাপা দিলেন এখনকার মতন, পরে ওনাকে গলায় গাইতে দেওয়া যাবে, আপাতত কালীবন্দনার প্রয়োজন ঘটেনি ।

        তারপর হামাম বক্স সরণী, নাঃ, এনার সঙ্গে পরিচয় হয়নি । এই এলাকায় যারা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তারা তেমন আকর্ষক নয় । তাদের গায়ে কালিঘাটের পট আঁকা ।

        এদের কাউকে বেছে নিয়ে কুন্দনন্দিনীর রূপ দিতে পারি, নিজের মগজের গোলাপি অন্ধকারে নিজেকে বললেন নগেন দত্ত, কিন্তু তার ভেতরটা, যাকে আগেকার লোকেরা বলত অন্তরজগত, তা তো পালটে কুন্দনন্দিনীর করে দিতে পারব না ।  আমার চাই আসল কুন্দনন্দিনী, যাকে দুশো বছর যাবত খুঁজছি ।

         মনে পড়ল ওনার,  কাজী জহির রায়হান নামে এক মুসলমান যুবকের সঙ্গে বছর পঁয়তাল্লিশ আগে পরিচয় হয়েছিল বটে,  বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়ে যারা মুক্তি যুদ্ধ এড়িয়ে তিরিশ হাজারিনীর দেশে আলোকপ্রাপ্তির জন্যে আসত, লুকিয়ে-লুকিয়ে তাদের মুভি ফিল্ম তুলেছিল, সেই থেকে কাজী জহির রায়হানকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি । দেশটা তখন পাকিস্তান ছিল, এখন বাংলাদেশ হয়েছে ; বাংলাদেশ হলেও অনেকের অন্তরজগতে পাকিস্তান রয়ে গেছে ।

         নগেন দত্তের একবার মনে হয়েছিল কাজী জহির রায়হানকে জীবন্ত করে ঢাকায় পাঠিয়ে দেবেন, তা আর করেননি, শেষে ওপার বাংলার লোকেরাও তাঁকে প্রতিভাবান মনে করবে, এই আতঙ্কে ।

         পিসিমাসির গ্যালারির বাড়ির দরোজা খোলা দেখে, দালালটাকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে,  ওপরে দোতলায় ওঠার সময়ে নগেন দত্ত বাইরে হাত নাড়িয়ে শিলাবৃষ্টি আরম্ভ করে দিলেন, তিরিশ হাজারিনীর শহরে শিলাবৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হবার সমস্যা নেই, পিম্পগুলো অন্তত আড়ালে আশ্রয় নেবে ।

        সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়ে, হাজার-হাজার পুরুষেরা উঠে-উঠে সিঁড়ির গোলাপি দেয়ালকে ছুঁয়ে মসৃণ করে দিয়েছে, স্লেট-রঙের সিঁড়িগুলো ক্ষইয়ে দিয়েছে,  দেখলেন দেয়ালজুড়ে বাংলায় লেখা রয়েছে ‘বিইং অ্যাণ্ড নাথিংনেস’, বিইং-এর ওপর পুরুষের বিশাল লিঙ্গ আঁকা আর নাথিংনেসের ওপরে ফাটল-স্ফীত ভগ ।

         সিঁড়িতে কোথাও লুকোনো স্পিকার থেকে জি-মাইনরে য়োহানেস ব্রাহমসের পাঁচ নম্বর হাংগেরিয়ান নাচ বাজছিল মৃদুস্বরে, আগত নাগরদের মেজাজকে আহ্লাদে চুবিয়ে দেবার খাতিরে ।

         নিজের মগজের গোলাপি অন্ধকারে নিজেকে নগেন দত্ত বললেন, ঠিক বাড়িতেই এসে পড়েছি, বছর আশি আগে যখন এসেছিলেন তখন সিঁড়ির দেয়ালে এই লেখা আর লিঙ্গ-যোনির হাতে আঁকা রঙিন ছবি ছিল, বাজনাও এইটেই ছিল।

         বিইং মানে যা ‘আছে’, নাথিংনেস মানে যা ‘নেই’। আঁকা লিঙ্গ দাঁড়িয়ে থেকে প্রমাণ করছে যে সে ‘আছে’, শিশ্নকে গোলাপি রঙ করে গেছেন কোনো আন্তর্জাতিক বহুজাতিক প্রেমিক ছবি-আঁকিয়ে, হয়তো এদেশেরই, হয়তো ফরাসি দেশের, হয়তো ইতালির রেনেসঁসের সময়কার, যাঁদের তুলির মাপ একহাত সাতইঞ্চি ছিল, বিখ্যাত ছবি-আঁকিয়েরা, যশোমতির বাড়িতে প্রেম করতে এলে ছবিগুলোকে চাঁঙ্গা করে দিয়ে যান । টুকরো দু-পাট লাবিয়ার মাঝে গোলাপি ভগাঙ্কুর প্রমাণ করছে যে সেখানে বিইং জিনিসটা ‘নেই’ ।

         দালালটা ঠিকই বলেছিল, ‘নেই’ এর হিন্দু-মুসলমান হয় না ।    

         সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়ে নগেন দত্ত অনুভব করতে পারছিলেন যে তিনি উলুপি-সুবাসের হ্রদের হাফঠাণ্ডা তলদেশ থেকে ওপরের দিকে উঠছেন, আলোকপ্রাপ্তির আধুনিকতায় ধুয়ে যাচ্ছে তাঁর পোশাক, যেমন দুশো বছর আগে হয়েছিল, তখন বাবার সঙ্গে এসেছিলেন, বাবা নিয়ে এসেছিলেন ছেলেকে যৌনকর্মে সুদক্ষ করে তোলার জন্য ।

         নগেন দত্তের বাবা ভাব-ভালোবাসায় বিশ্বাস করতেন না, বিশ্বাস করতেন যৌনখেলার দক্ষতায়, যেমন তাঁর পূর্বপুরুষরা তিন-চারশো বছর আগে দশবারোজন বউ রাখতেন আর আনন্দ করতেন ।

         বাবা একটি যুবতীকে চিৎ করিয়ে শুইয়ে, ছেলেকে বলেছিলেন, তুমি যতোই প্রেমের রসবিজ্ঞান পড়ো, লিঙ্গের স্মৃতির কাছে সবই তুচ্ছ, যে লিঙ্গের নিজস্ব স্মৃতি নেই, বুঝতে হবে তাতে মনুষ্যত্বের অভাব রয়েছে, এইভাবে দশ বছরের ছেলেকে শিক্ষা দিয়েছিলেন :

         বাবা : এই দুটো হল ঠোঁট, তোর যেমন আছে তেমন মেয়েদেরও থাকে, দেখেইছিস, তা এই দুটো ঠোঁটে তুই নিজের দুটো ঠোঁট রেখে ডাবের জল খাবি ।

         ছেলে : ডাব তো আমাদের শেতলপুরের জমিদারিতে কাঁদি কাঁদি হয় বাবা, একজন মেয়ের ঠোঁটে কেন খাবো, ডাবের জল তো পাবো না, কী পাবো তাহলে ?

         বাবা : যখন খাবি তখন বুঝতে পারবি, লালার সঙ্গে লালা মিশলে জ্বালা বাড়ার জ্বালা কমে ।

         ছেলে : আচ্ছা, তুমি বলছ যখন তখন খেতেই হবে ।

         বাবা : এই দ্যাখ, এদুটো হল মাই, কিন্তু শক্তপোক্ত হলে তাকে বলে স্তন, ছোটো বেলায় যেমন করে চাকরানিদের দুধ খেয়েছিস, এখনও তেমন করেই খাবি ।

         ছেলে : এখন আর কেন দুধ খাবো বাবা, বাড়িতে গোরুর খাঁটি দুধ তো খাইই ।

         বাবা : দুধ খাবার মতন করে খাবি, কিন্তু দুধ বেরোবে না, আনন্দ খাবি, দুধ থাকলে একরকমের আনন্দ হয়, আবার দুধ না থাকলে আরেকরকমের আনন্দ ।

         ছেলে : দুধের বদলে কী বেরোবে তাহলে ?

         বাবা : কিছুই বেরোবে না, তুই যখন খাবি তখন বুঝতে পারবি ।

         ছেলে : বাবা, এনাকে এরকম উলঙ্গ দেখে আমার কুঁচকির  জায়গায় টিং-টিং করে শিরশিরানি আরম্ভ হয়ে গেছে ।

         বাবা : গেছে তো ? এই যে কুঁচকির মাঝে যা দেখছিস, সেখানে শিরশিরানির সঙ্গে শিরশিরানি মেশালে  তোর আনন্দধারা প্রবাহিত হবে, তোর মন ভালো হয়ে যাবে, অন্ধকার থেকে আলোয় পৌঁছোবি, আলোকপ্রাপ্তি ঘটবে ।

         যে মেয়েটি শুয়েছিল সে আচমকা উঠে বসে বলেছিল, ওভাবে বোঝালে হবে না কত্তা, শেষে বন্দরের বদলে খেয়াঘাটে জাহাজ ভেড়াবে তোমার ছেলে, তোমাকে চিন্তা করতে হবে না, ও আমি হাতে-নাতে শিখিয়ে দেবো, যেমন করে তোমায় শিখিয়েছিলুম, তোমার শশুরের উইল অনুযায়ী । এখন তুমি বাইরে গিয়ে অপিক্ষে করো, আমরা মহড়া দিয়ে নিই । ওকে জানতে হবে তো দুটো শরীরকে কেমন করে স্হিতাবস্হা থেকে স্ফীতির অবস্হায় নিয়ে যায় প্রেম, ওতো এখনও জানে না যে প্রেম হল স্হিতাবস্হার বিরুদ্ধে প্রথম উল্লাস ।

         ছেলে বলেছিল, জানি গো জানি, প্রেমিকার সবকিছু জেনে ফেললেই প্রেম গুবলেট ।

         শিক্ষিকা মেয়েটি বলেছিল, নগেন দত্তর চুলে বিলি কেটে, অ্যাই তো কতার মতোন কতা ।

         ছেলে সেইমতো জীবন কাটাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎই কুন্দনন্দিনীকে দেখে তার প্রতি ভালোবাসায় আক্রান্ত হলেন নগেন দত্ত।

         ছেলেকে ভালোবাসায় আক্রান্ত হতে দেখে হঠাৎ মারা গিয়েছিলেন নগেন দত্তের বাবা ।

         শেষ শয্যায় শুয়ে উনি, নগেন দত্তের বাবা, বলেছিলেন, আমার আর কোনো আপশোষ নেই, পরশুই দেখে এলুম মোহনবাগান ফুটবলাররা খালি পায়ে আই এফ এ শিল্ড ফাইনালে ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে কেমন গুহারান হারালো ।

         ১৯১১ সালের সে-কথা মনে আছে নগেন দত্তর । তবে পরাজয়ের সঙ্গে গুয়ের সম্পর্কের রহস্য উদঘাটন করতে পারেননি আজও ।

        আজকে, সিঁড়ি দিয়ে ওঠবার সময়ে টের পেলেন, ‘আছের’ সঙ্গে ‘নেইয়ের’ মিলনে আলোকপ্রাপ্তি ঘটে এই গ্যালারিতে,  নগেন দত্ত নিজের মোবাইলে বিইং অ্যাণ্ড নাথিংনেসর ফোটো তুলে নিলেন, দেড়-দুশো বছর পরে আবার যখন আসবেন তখন মিলিয়ে দেখার জন্য, বিইং কতোটা উন্নতশির হলো আর নাথিংনেস কতোটা ডাকসাইটে গোলাপি  ।

         দেশ-বিদেশের কতো কতো ‘আছে’ এখানে আসে ‘নেইদের’ সঙ্গে মিলন করতে, নিজেকে আলোয় আলো করে তুলতে । ‘নেইরা’ কতো কতো ‘আছেকে’ আলোয় ভরে দ্যায় ।

        সিঁড়ি দিয়ে উঠে, দোতলার বারান্দায় ঢোকার মুখে চারিধারে লাল টুনিআলো ঝোলানো একটা সাইনবোর্ড টাঙানো, তাতে সাদার ওপরে গেরুয়া রঙে লেখা “দি অ্যাকাডেমি অফ পারফরমিং ফ্লেশ” । সাইনবোর্ডেরও ছবি তুলে নিলেন মোবাইলে, তুলে, মনে পড়ে গেল সেই গানটা, কে যেন গেয়েছিল, মগজের ভেতরে তার গুনগুন শুনতে পাচ্ছিলেন নগেন দত্ত :                             

                                  পা গা মা রে সা নি
                                 পা নি সা রে মা গা রে
                                 রে মা পা নি ধা মা পা না সা রে নি সা
                                 পা ধা মা পা নি ধা মা গা গা সা নি সা

        ঘষা-কাচের আড়াল-তোলা মাসিপিসি গ্যালারির কিউবিকলের পাশ দিয়ে দোতলার বারান্দায় পৌঁছোলেন নগেন দত্ত, মাসিপিসির সঙ্গে কথা পরে বলবেন ।

        যে কোনে একশো বছর আগে এই বাড়ির মাসি জলচৌকিতে বসে দোক্তাদেয়া পানের খিলি সাজাতো, আর মেয়ে বাছাই নিয়ে দরাদরি করত, সেখানটা ফাঁকা, সেই জলচৌকির ওপরে মাসির দোক্তামুখ হাসির ফোটো, তাতে যে রজনীগন্ধার মালা পরানো, তা দশ বছর আগে শুকিয়ে গেছে, মাসি তবুও দোক্তামুখে হাসি বজায় রেখেছে ।

         নগেন দত্ত দেখলেন, বারান্দায় দুটো খাটে দুঃখকাতর দুটো কাটা-মুণ্ডু রাখা , তাদের  মলম ধরণের কিছু মাখানো হয়েছে, দুই খাটের পাশে মুণ্ডুদের শিয়রে দুজন যুবক মেঝেয় বসে, যেন কাটা মাথায় হাত বুলিয়ে তাদের ধড়হীনতার দুঃখ কমাবার চেষ্টা করছে ।

         মুণ্ডুদের মুখে গোঁজা সিগারেটের ফিকে নীল ধোঁয়া জিজ্ঞাসার চিহ্ণ হয়ে উঠে যাচ্ছে প্রেমালাপে ব্যস্ত কড়িকাঠের টিকটিকিদের মাঝে, মুণ্ডুদের খাটের পাশে চায়ের কাপে ফোঁকা সিগারেট গোঁজা, কিন্তু সিগারেটের ধোঁয়া বেরোচ্ছে যুবকদের মুখ থেকে, মুণ্ডুদের মুখ থেকে নয়, ধোঁয়ার গন্ধে নগেন দত্ত টের পেলেন ওরা চরস ফুঁকছে ।

         বোঝা গেল না জিজ্ঞাসায় আক্রান্ত কারা, মুণ্ডুদুটো নাকি পাশে বসে থাকা যুবকেরা ।

         টিকটিকি আর টিকটিকিনী বিরক্ত হল তাদের প্রেমে ব্যাঘাত ঘটায়, ক্লাইম্যাক্সে প্রায় পৌঁছে গিয়েছিল, বাধ সাধলো চরসের ধোঁয়া ; বিরক্তি জানাতে বাধ্য হল

         টিকটিকি : এই বাঞ্চোত মানুষগুলো আমাদের শান্তিতে থাকতে দেবে না, আমাদের সবকিছু দখল করে নিয়েছে, কোথাও যাবার যো নেই, ওদের বাড়ির বউগুলো তো আমাদের দেখলেই অজ্ঞান হবার যোগাড়, যাও বা একটু দূরত্ব রেখে প্রেম করছি, তাও করতে দেবে না । এদিকে নিজেরা বাজার খুলে বসে আছে ।

         টিকটিকিনী : ওদের কথা আর বোলো না, ঘরের ভেতরে দেখেছি তো, মরদগুলো চুর হয়ে থাকে, পায়ের ফাঁকে গেল না বালিশের ফাঁকে গেল, সেসব টের পায় না, ব্যাস, নিজের শকড়ি বয়ে গেলেই হলো । মাগিগুলোও চুষে পকেট ফাঁকা করে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে । সেদিন তো একজনকে সিঁড়ি দিয়ে লাথিয়ে বের করে দিলে, যন্তর দিয়ে “আই লাভ ইউ” বলতে পারেনি বলে ।

        টিকটিকি : ওদের সংস্কৃতি হল গোলাপায়রার সংস্কৃতি, চোপরদিন বকরবকম বকরবকম ছাড়া অন্য কাজ নেই ।

        টিকটিকিনী : ওদের সমাজে যারা দুর্বল তাদের ওরা বলে ভালোমানুষ, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ ।

        টিকটিকি : ওয়ান টু থ্রি বলব, আর দুজনে মিলে ওদের মাথায় হাগবো, কি বলিস ? নে, ওয়ান টু থ্রি।

        টিকটিকি আর টিকটিকিনীর ন্যাড় ঝরে পড়ে যুবতী কন্ঠস্বরের যুবকদের কোঁকড়া চুলে, আর পাকতে লাগলো ওদের মাথার চুল ।

         নগেন দত্তের সন্দেহ হল যে এই দুই ধড়হীন মুণ্ডুর দেহ ডিকনসট্রাক্ট করে ফেলা হয়েছে, অবিনির্মাণ, পি সি সরকার, মানে প্রতুলচন্দ্র সরকার যেমন অবিনির্মাণ করতেন মঞ্চে রাখা তরুণীর দেহ, পি সি সরকারের বাবা ভগবানচন্দ্র সরকার ওনাদের টাঙ্গাইলের বাড়িতে ১৯০৯ সালে নগেন দত্তকে দেখিয়েছিলেন অবিনির্মাণের ক্যারদানিখানা, নগেন দত্ত তখন কৈশোরে আটকে আছেন , সবে গোঁফে রদবদল ঘটছে, কতোকাল আটকে ছিলেন কৈশোরে তা আর মনে নেই ওনার ।

         নিজের মগজের গোলাপি অন্ধকারে নিজেকে নগেন দত্ত বললেন, দেখি, সময় পেলে এদের দেহ দুটো রিকনসট্রাক্ট করে জেনে নেবো প্রকৃত আদল-আদরা , এদের মুণ্ডুদের বোধহয় ডেফারাল চলছে।

         যুবকেরা মুণ্ডুদের ঠোঁট থেকে সিগারেট বের করে নিলে, দুটো মুণ্ডুই একসঙ্গে বলে উঠল, “নগেন এসেছ?”

        নগেন দত্তর মনে হল, মুণ্ডু দুটো নয়, যে যুবকেরা খাটের শিয়রে বসে আছে, কথাটা তারাই একসঙ্গে বলে উঠল ; নিজের মগজের গোলাপি অন্ধকারে প্রশ্ন জেগে উঠল নগেন দত্তের, যুবকদের কন্ঠস্বর এরকম মেয়েলি আর সুরেলা কেন ? এরা সত্যিই যুবক নাকি তিনি কোনো মায়ায় আক্রান্ত হয়েছেন, পায়ুকামের মায়ায় । মুণ্ডু দুটো তাঁকে চিনল কেমন করে ! কখনও শুয়েছেন হয়তো এদের সঙ্গে, পঞ্চাশ, আশি, একশো বছর আগে, মুখ তো আর মনে থাকে না, বড়ো জোর বুকের উঁকি-দেয়া আঁচিল মনে থাকে, উরুর ট্যারা-চাউনি তিল মনে থাকে, ভগাঙ্কুরের জটার-পেন উথাল-পাথাল মনে থাকে, অকুস্হলের পাকানো চুলের গান মনে থাকে, মনমাতানো গন্ধ আর হাতমাতানো কোমর মনে থাকে ।

         মুণ্ডু দুজনের উদ্দেশে নগেন দত্ত বললেন, আপনাদের তো চিনতে পারছি না, আগেও কতোবার এসেছি, সকালে, দুপুরে, মাঝরাতে, কিন্তু কখনও দেখিনি তো, বললেন নগেন দত্ত, তারপর যোগ করলেন, দেহের বাকি অংশ নেই কেন ?

        চিনতে পারছ না কেন নগেন ? আমি তোমার তিথি আহমেদ, বেগমপুরের জর্দাভরা কতো পান খাইয়েছো, তুমি প্রথমবার যখন ঢাকায় রাতের-বউ বাছতে এলে তখন আমাকে বেছে নিয়েছিলে, আর জলপাইগুড়ি থেকে ছন্দরানি মজুমদারকে, তোমাদের গোবিন্দপুরের জমিদারিতে, ছাতিমগাঁয়ের বাগানবাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলেছিলে, ভুলে গেলে এতো তাড়াতাড়ি ? বিলিতি মদ খাবার পর, তুমি আমায় আদর করে কখনও মেরি, কখনও এমিলি বলে ডাকতে । মাথায় কাঁচাপাকা চুল, চোখে চশমা, কাটা-মুণ্ডু, জোর করে হেসে বললে।

        নগেন দত্ত বললেন, মনে পড়েছে গো, বাবর আহমেদ পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, তিথি নামটা বড়ো ভালো লাগেছিল, অনেকের নামের ভেতরেই মাংসল ইশারা গোঁজা থাকে ।

        অন্য মুণ্ডু বলে উঠল, আর আমাকে মনে নেই তোমার ?

        ছন্দরানি মজুমদার ? তিনি কোথায়, দেখলে মনে করতে পারব হয়তো, উত্তরবঙ্গে যেতুম তো মাঝেমাঝে, দেশভাগের যেমন দুঃখের দিক ছিল, তেমনই আনন্দের দিকও ছিল, বললেন নগেন দত্ত ।

       তাঁর সন্দেহ হল যে মুণ্ডুটা নিজে কথাগুলো বলেনি, ছন্দরানির খাটের পাশে যে যুবক মুণ্ডুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, কথাগুলো সেই বলল, অথচ কথা বলার মতন করে ছন্দরানির ঠোঁট তো নড়ছিল ।

         অ, মা, সেকি অলুক্ষুণে কতা গো, বলে উঠলে অন্য মুণ্ডু, আমিই তো ছন্দরানি মজুমদার, উত্তরবঙ্গে বেড়াতে গিয়ে পছন্দ হয়ে গিয়েছিল তোমার, তুমি আমাকে আদর করে কখনও বলতে পুলি, কখনও বলতে মিশলি, এরই মধ্যে ভুলে গেলে, আমাদের দুজনকেই তো তুমি ছাতিমগাঁয়ের বাগানবাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়েছিলে ঢাকা আর জলপাইগুড়ি  থেকে, গোড়েগ্রাম থেকে যুঁইবেলির মালা এনে দিতো মোচোরমান মালি, তোমার জুড়িগাড়ি করে, বাদামি রঙের একজোড়া ঘোড়া, সহিস দিদিয়ের সন্ধেবেলা গঙ্গার ধারে বেড়াতে নিয়ে যেতো ।

        যে নিজেকে ছন্দরানি বললে, নগেন দত্ত দেখলেন, তার মাথায় চুল নেই, টাক পড়ে গেছে, চোখে চশমা, ঠোঁট নড়ছিল বটে, কিন্তু কথাগুলো যে যুবকদের কন্ঠ থেকে বেরোচ্ছিল তা নিশ্চিত । বুড়িদের কন্ঠস্বর হলে  তো কাঁপা-কাঁপা হতো । টাক পড়া মাথায় হাত বুলিয়ে চলেছে যুবতী-কন্ঠস্বরের যুবক ।

         তা তোমাদের দুঃখটা কিসের, জানতে চাইলেন নগেন দত্ত, যুবক দুজন হাত বুলিয়ে চলেছে, যন্ত্রণার কি উপশম হচ্ছে ?

        আমাদের দুঃখ চাউনির গো, চাউনির, বলে ওঠে দুই কাটা-মুণ্ড, কিংবা বোধহয় যুবতী কন্ঠস্বরের দুই যুবক ।

        মুখ আর পোশাক দেখে এদের যুবক ভাবছি, সত্যিই কি এরা যুবক, কন্ঠস্বর তো যুবতীর । এটা কি আমার চাউনির যন্ত্রণা, পোশাক আর মুখ দেখে মনে হচ্ছে ‘আছে’, কন্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছে ‘নেই’, এই যুবক-যুবতী পার্থক্য করতে না পারা ? নিজেকে প্রশ্ন করলেন নগেন দত্ত ।

        মগজের গোলাপি অন্ধকারের মধ্যে নিজেকে বললেন, আমার পায়ুকামেও আগ্রহ ছিল, এখনও আছে যৎসামান্য, হয়তো তাই এই আধাযুবক-আধাযুবতীদের দিকে টান অনুভব করছি । কিন্তু সে কামেচ্ছা  পুরো করতো তিথি আহমেদ-ছন্দরানি মজুমদাররা আর নানা বয়সের নানা রানিরা । পুরুষদের সঙ্গে তো পায়ুকামের খেলা খেলিনি । নারীর দেহে ধরে থাকার মতন যে দুটি নোঙর থাকে তা পুরুষের দেহে নেই, নারীদেহের নোঙরগুলো আঁকড়ে অনেক ঝড়ঝাপটা পার হওয়া যায় ।

         তোমাদের আবার কিসের চাউনির যন্ত্রণা, যদি বলতে দেহ না থাকার যন্ত্রণা, বা গলাটা কাটা থাকার যন্ত্রণা, তাহলে না হয় বুঝতুম, চাউনি মেলে তো দিব্বি দেখছ, দেখেও এসেছ এতোকাল কতো কতো নানা মাপের নানা রঙের নানা দামের ‘আছে’, যার রসাস্বাদন করেছ তোমাদের ‘নেই’ দিয়ে  ।

         আ খেলে যা, আমাদের দুজনের যন্ত্রণা কি একই হতে হবে, বললে তিথি আহমেদের  মাথা, যতো চাউনি সারা জীবন আমাকে দেখেছে, আমার ‘নেইয়ের’ দিকে তাকিয়ে থেকেছে, আমার বুকের দিকে তাকিয়ে থেকেছে, আমার বোঁটার দিকে তাকিয়ে থেকেছে, সব চাউনি জমা করা আছে আমার মনখারাপের ওজনপাল্লায় । যারা যারা দেখে গেছে তারা আমার ফাঁকফোকোর, বুক, বোঁটা, পাছা নিজেদের চাউনির সঙ্গে তুলে নিয়ে গেছে, যেন ওগুলো ওনাদের দখলের মালপত্তর।

        আমার চাউনি কিন্তু দেখেছে, বললে ছন্দরানি মজুমদারের মাথা, নজর রেখেছে,’আছেঅলাদের’ ওপর, ভেতর পর্যন্ত দেখেছে, সেপাইলস্করদের দেখেছে ।

        নিজের মগজের গোলাপি অন্ধকারে নেমে নগেন দত্ত নিজেকে বললেন, একথাও তো ঠিক, একজনের স্বাধীনতা মানে তো আরেকজনের স্বাধীনতা নয়, স্বাধীনতার নানা রকমফের আছে, কে কার থেকে, কী থেকে স্বাধীন হতে চায়, সেটা তো তার নিজের ব্যাপার ।

        যে ঘরগুলো দেখা যাচ্ছিল সেদিকে তাকিয়ে নগেন দত্ত বললেন, তোমাদের মেয়েদের ঘরে মেঝেয় শেতলপাটি পাতা নেই কেন ? ধুতি খুলব কোথায়, পরবই বা কোথায় দাঁড়িয়ে ? নরুণপেড়ে ধুতির কাছা-কোঁচা যে নোংরা হয়ে যাবে । পঞ্চাশ বছর আগেও পাতা থাকতো, তার আগেও পাতা থাকতো ।

         তিথি আহমেদের মুণ্ডু বললে, শেতলপাটির যুগ চলে গেছে গো, লোকে খেতে ধানগম পুঁতবে না শেতলপাটির গাছ পুঁতবে, শান্তিপুরী ধুতির যুগও চলে গেছে, এখন মাসিপিসির গ্যালারিতে হবু শশুররা হবু জামাইকে ট্রেনিং দেওয়াতে নিয়ে এলে লাল টকটকে ধুতি পরিয়ে আনে, বরযাত্রীদলের নাপিত এখানেই ধুতি খুলে দেখে নেয় যন্তর ঠিকঠাক আছে কিনা, তবু তুমি আমাদের রসের নাগর, বিছানার ওপর দাঁড়িয়ে ধুতি খুলতে পারো, পরতেও পারো, তা ধুতি খোলার দরকারটাই বা কি, পরে থেকেও প্রণয় করা  যায়, যেমন আমাদের করতে, একবার আমাকে একবার ওকে, একবার আমাকে একবার ওকে, একবার আমাকে একবার ওকে, এই করে তো সকাল হয়ে যেতো গো, তুমি কি আর আমাদের ঘুমুতে দিতে ।

         ছন্দরানির মাথা বললে, ধুতি খোলার দরকারটাই বা কেন, তুমি তো কখনও জাঙিয়া পরো না, ধুতি পরেই সব কাজ করতে । আজকাল, মঙ্গলা হাটের দিন ছাড়া, বুড়ো ক্লায়েন্টরাও ধুতি পরে আসে না, সবাই ফুলপ্যান্ট-শার্ট পরে আসে, তারা মেঝেয় ঝপ করে প্যান্ট ফেলে, কাজ সেরে চলে যায়, কারই বা কোমরে অতো সময় আছে, তোমার কালের মতন, তুমি ভুলে যাচ্ছ বোধহয় এটা হল যুগসন্ধিক্ষণ, ছোকরা বয়সীরা, যারা সকালে আসে, প্যান্ট খোলারও সময় পায় না, জিপ নাবিয়ে কাজ সেরে আপিসমুখো হয়, তাতে নাকি আপিসের চাপ কমে । আমি তাদের বলি ভালো গো ভালো, এখানে এসে চাপ বাড়াও, সেখানে গিয়ে চাপ কমাও ।

         অবাক হলেন না নগেন দত্ত, তবে কয়েকটা দরোজায় উনি দেখলেন মেয়েরা পেতলের ঝিকমিকে জিপ-বসানো হাফপ্যান্ট পরে, বুকে  সাঁতার কাটার ফুলতোলা বুকবাঁধুনি, কাকে ছেড়ে কাকে বাছি মনে হচ্ছিল নগেন দত্তর । আজকালকার ফ্যাশান বেশ আকর্ষণীয়, মাসে প্রতিদিনই আসতে হবে, একদিনে একজনের সঙ্গে খেলা করা যাবে । তবে খুঁটিয়ে দেখে বুঝতে পারলেন, ওগুলো পোশাক নয়, আন্তর্জাতিক পেইনটারদের আঁকা ত্বক, যিনি যখন যার কাছে এসেছেন, চামড়ায় এঁকে দিয়ে গেছেন ।

         তার আগে কুন্দনন্দিনীকে ভালোবাসতে চাই, পেতেই হবে কুন্দনন্দিনীকে, ওহ কুন্দনন্দিনী । প্রেম করা, প্রণয় করা মানে ভালোবাসা নয় ।

         তিথি আহমেদ বললে, বুঝলে নগেন, তুমি ভালো বলে মহৎ, মহৎ বলে ক্ষমতাশালী, ক্ষমতাশালী বলে সুন্দর, সুন্দর বলে সুখি, সুখি বলে ঈশ্বরভক্ত ।

         ধন্যবাদ জানিয়ে নগেন দত্ত বললেন, আমি ঈশ্বরভক্ত ছিলুম, এখন আর নই রে, কেননা আমার বাবার সময়েই ঈশ্বর মারা গিয়েছিল, বাবা ঈশ্বরের শ্রাদ্ধশান্তি করিয়েছিলেন, হাজার লোক খেয়েছিল, এখন আমি আপনভক্ত । তবে আমার পোষা অ্যালসেশিয়ানটা আমাকে ওর একমাত্র ভগবান বলে মনে করে । বুঝলে কিনা, আমি কুকুরের ঈশ্বর ।

         ছন্দরানি মজুমদার বললে, উচিত কথা বলেছ নগেন, লাঞ্ছিত-নিপীড়িতরাই কেবল ভালো বলে গরিবরা ভালো, গরিবরা ভালো বলে নিম্নবর্গেরা ভালো, নিম্নবর্গেরা ভালো বলে সর্বহারারা ভালো, সর্বহারারা ভালো বলে তারা কষ্টজর্জর, কষ্টজর্জররা ভালো বলে তারা বঞ্চিত, বঞ্চিতরা ভালো বলে তারা অসুস্হ, অসুস্হরা ভালো বলে তারা কুশ্রী, কুশ্রীরা ভালো বলে তারা ধার্মিক ।

         ধন্যবাদ জানিয়ে নগেন দত্ত বললেন, ওই গরিব হওয়া ভালো, সর্বহারা হওয়া ভালো, উদ্বাস্তু হওয়া ভালো, ইংরেজি না শেখা ভালো, কমপিউটার না শেখা ভালো, হড়তাল ডাকা ভালো,  বনধ ডাকা ভালো, এগুলোয় আমি আর নিজেকে সোপর্দ করি না, একশো-দেড়শো বছর ধরে যথেষ্ট করেছি, মুখ টকে গেছে সেসব করে-করে ।

         কিছুক্ষণ থেমে, কোমরে দুহাত রেখে নগেন দত্ত বললেন, ১৯২২ সালে আমি স্ট্যালিনকে বলেছিলুম, হুঁশিয়ার, এই পেছলতত্ত্ব পিছলেই যাবে ল্যাঠামাছের মতন, স্ট্যালিন বিশ্বাস করলে না, ট্রটস্কির পেছনে লেগে গেল, এখন দ্যাখো, কোথাকার ভোমরা কোথায় গিয়ে মধু খাচ্ছে, মাটি ফুঁড়ে বেরোচ্ছে নানা মাপের মাফিয়া আর তাদের গোলাপিউরু লালকুঁচকি বিছানাবউ ।

         তিথি আহমেদ আর ছন্দরানি মজুমদার দুজনে একই সঙ্গে চিৎকার করে উঠলো, তাহলে তুমি কি চাও ?

         নগেন দত্ত বললেন, কুন্দনন্দিনীকে চাই, আসল কুন্দনন্দিনীকে চাই, তাকে ভালোবাসতে চাই।

        তিথি আহমেদ বললে, তাহলে তোমাকে সেই গানখানা শোনাই যেটা তোমার বাগানবাড়িতে নেচে-নেচে গাইতুম, প্রেমের গান, তাহলে তোমার বিশ্বাস হবে যে আমিই তোমার তিথি ।

        কোন গান ? ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলেন নগেন দত্ত ।

        সেই যে পোস্টমডার্ন প্রেমের গানখানা, বলে, গাইতে আরম্ভ করল তিথি আহমেদের মাথা, গাইতে-গাইতে খাটের ওপরে ড্রোনের মতন ভাসতে লাগল মুণ্ডুখানা, তালে তালে হাততালি দিতে লাগল যুবতী কন্ঠস্বরের যুবকেরা, রাস্তার মোড়ে ভিকখে চাইবার সময়ে হিজড়েরা যেভাবে হাততালি দ্যায় :

                 চাঁদনিরাতের পেতনিপিসি সজনেতলায় খোঁজ না রে
                 থ্যাঁৎলামাথা হ্যাংলা সেথা হাড়কচকচ ভোজ মারে ।
                 চালতাগাছে আলতাপরা নাক ঝোলানো শাঁকচুনি
                 মাকড়ি নেড়ে বলে আমায় তো কেউ ডাকছনি ।
                 মুণ্ডু ঝোলা উলটোবুড়ি ঝুলছে দেখ চুল খুলে,
                 বলছে দুলে, মিনসেগুলোর মাংস খাব তুলতুলে ।         

         নগেন দত্ত বললেন, হ্যাঁ, যতোদিন না মিনসেগুলোর মাংস খুবলে খাওয়া হচ্ছে, ততোদিন এমনি করেই চলবে, তারপর যোগ করলেন, আমার সারেঙ্গিঅলা ওস্তাদ তো তোমাদের পোস্ট-মার্কসিস্ট প্রেমের গান শিখিয়েছিল একখানা, মনে পড়ছে, মগজে বাজছে গানটা, ভুলে গেলে নাকি গো ?

         ছন্দরানি মজুমদারের মাথা বলে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব মনে আছে, তোমার মোসাহেবরা পাশ বালিশ জড়িয়ে মাঙনার আফিমের নেশা করে কতো মাথা দোলাতো, তুমি লণ্ডনে তোমার বাবার হরমোন চিকিৎসা করাতে নিয়ে যেতে বছরে একবার , তখনও মোসায়েবরা পাশবালিশ জড়িয়ে আফিম টেনে এই গানখানা শুনতে চাইতো । গাইছি শোনো, গাইতে গাইতে ছন্দরানির মাথা ড্রোনের মতন  ভাসতে লাগল খাটের ওপর :

                 মিশিমাখা শিখিপাখা আকাশের কানে কানে
                 শিশিবোতল ছিপিঢাকা সরু সরু গানে গানে
                 আলোভোলা বাঁকা আলো আধোআধো কতো দূরে
                 সরু মোটা শাদা কালো ছলছল ছায়া সুরে

        গানের সুরে সুরে হাততালি দিচ্ছিল বটে যুবতী কন্ঠস্বরের যুবকেরা, কিন্তু সে হাততালি বুড়োদের মতন শ্লথ, কেননা তাদের পুরো চুলে পাক ধরে গেছে মাথায় টিকটিকি হাগার দরুন ।

         আরেকবার শুরু করতে যাচ্ছিল ছন্দরানি, নগেন দত্ত বললেন, থাক থাক, পরে আবার শুনবোখন, এখন তোমাদের মনে করার চেষ্টা করি, গান মনে এলেই তো আর গায়িকাকে মনে পড়ে না, তোমাদের দেহগুলো থাকলে নাহয় খুঁত দেখে-দেখে আর তিল গুনে-গুনে মনে করতে পারতুম ।

        এক পলক চোখ বুজে তিথি আহমেদ আর নন্দরানি মজুমদারের দেহ রিকনসট্রাক্ট করে ফেললেন নগেন দত্ত, পুণর্নিমাণ ।

         নিজের মগজের গোলাপি অন্ধকারে নিজেকে বললেন, ১৯৬৭ সালে যখন প্যারিসে থাকতুম লাতিন কোয়ার্টারের একটা লজে, সবাই তাকে বলত বিট লজ, সেখানে উইলিয়াম বারোজ, গ্রেগরি কোর্সো, অ্যালেন গিন্সবার্গ, ব্রায়ন জিসিন নামে মার্কিন ছোকরারা ল্যাংটোপোঁদে হ্যাশিস ফুঁকে নাচতো, সেই লজ থেকে বাদামি কোটের পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তায় বেরিয়েছি, তখন বসন্তকালের সকাল, রাস্তার দুপাশে চেরিব্লসম আর পলোনিয়া গাছের সারি, পার্কে-পার্কে আর ঝুলবারান্দার টবে ফুটে আছে হলুদ ড্যাফোডিল, পিওনিস, আইরিস, লিলি, গুর্দোঁ ফুল, বাচ্চারা নাসতুরতিয়াম ফুল ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খাচ্ছে, তখন জাক দেরিদা নামে একজন ফরাসির সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তার কাছ থেকেই শিখেছিলুম, অবিনির্মাণ আর পুনর্ণিমানের ওয়র্ডপ্লে ।

        তারপর যখন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গেলুম, আমেরিকায়, তখন, ১৯৮১ সালের হেমন্তে, তামারঙের পাতায় ঢাকা কপার বিচ গাছ, হর্সচেস্টনাট গাছ থেকে সব পাতা ঝরে গেছে, নীল রঙের বিশাল মাপের লিঙ্গর মতন ফল ঝোলানো ডেড ম্যানস ফিংগার্স গাছ, লাল পাতায় ঢাকা জাপানি মেপল, জাপানি সেডারের ঝোপ চারিধারে, উপিং চেরি, রেড ওক, পড়াবার বদলে বাগানে ঘাসের ওপর শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগতো, সেই সময়ে পল ডি মান, জিওফ্রে হার্টম্যান, জে হিলস মিলার ওরা তো টেবিলের ওপর এক তরুণীর দেহের কাটা টুকরোগুলো রেখে, দিখিয়েছিল, কেমন করে জোড়া লাগাতে হয় আর আবার কেটে টুকরো করতে হয় ।

        নগেন দত্তের আপশোষ হল, কেন যে পি সি সরকার ওনার ইন্দ্রজাল প্রয়োগ করে মানুষকাটার সময়ে কাটাকুটির তত্ব বানাননি ! তাহলে এখন তত্বের রয়ালটি পেতো ওনার বংশধররা, যেমন জাক দেরিদার রয়ালটি পাচ্ছে তার বংশধররা ।

        পুনর্নিমান প্রক্রিয়ার নিয়মগুলো প্রয়োগ করে দেখলেন নগেন দত্ত, তিথি আহমেদ ফর্সা, চোখ দুটো সামান্য কটা, নাক একটু টেপা, ঠোঁট চিনা মেয়েদের মতন গোল, কোমর পাতলা, বুক দুটো মাঝারি, পাছার ঢেউ আদরযোগ্য, অরগ্যাজমের অভিনয় করত না, জড়িয়ে ধরে নখ আর দাঁত বসাতো কাঁধে, পা দিয়ে কোমর জড়িয়ে নিতো ।

       মনে পড়তে লাগল, মদ খেয়ে যখন তিথি আহমেদ চুর হয়ে যেতো, ওর উলঙ্গ শরীর হয়ে উঠতো মায়াবী, পাঁজাকোলা করে পাক খেলে শরীর ভরে যেতো আগুনের হলকায়, সহজে নিভতো না সে আগুন, তরল আগুন, মদে মাতাল দেহের সঙ্গে প্রেম করাটা ধর্ষণ হয়ে যাবে ভেবে অপেক্ষা করতেন নগেন দত্ত, কখন তিথি আহমেদ খোঁয়ারির ভেতর থেকে তাঁকে ডাক দেবে ।

        তিথি আহমেদের মায়ের মায়ের মায়ের মায়ের মায়ের মায়ের মায়ের মায়ের মায়ের দিদিমির দিদিমা ছিলেন সুলতান ইলিয়াস শাহের পেয়ারের বাঁদির মেয়ে, তাই তিথির থুতুতে চাটগাঁইয়া স্বাদ বেশ ভালো লাগতো নগেন দত্তর, বুলিবুকনির যৌন আহ্লাদ উপভোগ করতেন, কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতের ঢেউয়ের মতন দোল খেতো ওর উরু জোড়া । আহা সে কি ঘেমো মাংসল ঘুমের রাত গেছে ।

        একই প্রক্রিয়ায় দেখলেন, ছন্দরানি মজুমদার কালচে, চোখ দুটো বেশ বড়ো, কপাল ছোট্ট, কোঁকড়ানো চুল পাছা পর্যন্ত, বুক দুটো ঢাউস, পাছাও ঢাউস, কোমর পাতলা, অরগ্যাজম অনেক বার হতো, একের পর এক, শরীর কাঁপিয়ে-কাঁপিয়ে, একের পর আরেক, নিজেই ওপরে থাকতে চাইতো । ছন্দরানি মাতাল হয়ে কেবল হাসতো, হাসতেই থাকতো, যেন ওর ভাঁড়ারের শব্দরা ফুরিয়ে গিয়ে কেবল হাসিগুলোর দেহঢেউ  টিকে আছে, হাসতে হাসতেই উঠে পড়তো নগেন দত্তের ওপর, কালচে কোমরে খেলতো ভুঁড়িনাচন, কখনও মায়াবি খোঁয়ারিতে হারিয়ে যেতো না ।

         চিকনচাম রোগাটে গুটকাখোর দালাল, নগেন দত্তর পাশে দাঁড়িয়ে হাবামুখে অপেক্ষা করছিল, বললে, স্যার চলুন না, এই গ্যালারির ম্যানেজার প্রফেসার চক্কোত্তির সঙ্গে কথা বলে রেট-সময় ঠিক করে নেবেন, এই সব বাজে কথা বলে ফালতু সময় নষ্ট করছেন, দেখছেন তো কেমন ভাসা-ভাসা প্রকৃতির, এতক্ষণে মনের মতন মেয়ে বেছে নিতে পারতেন, মাসকাবারি বাবু হতে চাইলে উনি ডিসকাউন্ট দ্যান, আপনি জোয়ান হয়েও দেড়-দুশো বছর আগে আসতেন বলছিলেন, তা উনি সিনিয়র সিটিজেনদের জন্যে ভরতুকির ব্যবস্হা রেখেছেন, সুগন্ধী কনডোম, ডিওডেরেন্ট, তোয়ালে, ফুলের মালা, বিছানায় ফুলশয্যার ফুল, অ্যাটাচড টয়লেট যাতে আপনার সামনেই আপনার প্রেমিকা ধোয়াধুয়ি না করে, ধোয়াধুয়ির জন্যে টয়লেটে জেট-ওয়াটার স্প্রে-পাইপ আছে, প্রথম দিন এক্সট্রা বেনেফিটস ফ্রি।

         দালালটাকে বুকপকেট থেকে একহাজার টাকার একটা নোট দিয়ে নগেন দত্ত বললেন, যা, এখান থেকে যা, এদের কাছ থেকে তোর দালালি চাইতে আসিসনি, জানিস তো আমাকে, কি থেকে কি হয়ে যাবি, নিজেই জানতে পারবি না।

         হ্যাঁ হুজুর হ্যাঁ হুজুর বলতে-বলতে সিঁড়ি বেয়ে প্রায় গড়িয়ে চলে গেল চিকনচাম পিম্প । উঠে এলো হাঁপাতে-হাঁপাতে,  প্রমিথিউসের অদৃশ্য পাথর ঠেলে, বলল, স্যার, আকাশ থেকে কয়লার টুকরোর মতন বড়ো-বড়ো শিল পড়েছে, কুচকুচে কালো, হাঁটু জলে ভরে গেছে রাস্তা, এই দেখুন আমার পা দুখানা।

         নগেন দত্ত পায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, যা, আহিরিটোলা ঘাটে গিয়ে পা ধুয়ে নে, কালো জল নামতে সময় লাগবে, ওগুলো সব দিল্লি আর চেন্নাইয়ের উকিল ছিল, জমাট বেঁধে  অন্য লোকেদের জান কয়লা করতে গিয়ে নিজেরাই কয়লা হয়ে গেছে।

         নগেন দত্ত ঢুকলেন পিসির ঘরে, ভেতরে আসতে পারি, ঢুকে দেখলেন, মহিলা নয়, একজন পুরুষমানুষ, ডানদিক ঘেঁষে সিঁথিকাটা, চুলে পাক ধরেছে, চোখে চশমা, মুখে পানের খিলি, চেনা মনে হল, আগের বার এসে দেখে থাকবেন, বা অন্য কোথাও, বিপ্লবে ব্যসনে দুর্ভিক্ষে, ঢুকে পড়লেন ঘরে, হ্যালো, প্রফেসার, হাউ আর ইউ ।

         মনে পড়ল, যে কালেজে নগেন দত্ত একসময়ে বিজ্ঞান পড়াতেন সেই কালেজেই দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন পি চক্রবর্তী ।

         ঘরে আরেকজন লোক বসেছিল, তার পাশে বসলেন নগেন দত্ত, ভালো পারফিউম মেখেছে লোকটা, চাককাটা ফুলশার্ট, চওড়া টাই, কালো ট্রাউজারে বেশ স্মার্ট ।

         তোমাদের কথা পুরো করে নাও, আমার তো তাড়াহুড়ো নেই, জানোই তো, বললেন নগেন দত্ত  ।

         প্রফেসর পি চক্রবর্তী পরিচয় করিয়ে দিলে, ইনি নগেন দত্ত, ইনডাসট্রিয়ালিস্ট, জমিজমাও প্রচুর, বয়সের গাছপাথর নেই কথাটা এনাকে দেখেই বলে গেছেন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ওনার বঙ্গীয় শব্দকোষ বইখানায়, অবশ্য কলিম খান ওনার শব্দকোষে নগেন দত্তের উল্লেখ করেননি ।

        আগন্তুকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলে প্রফেসর পি চক্রবর্তী, আর ইনি তারকনাথ ব্যানার্জি, লোকে ঠাট্টা করে বলে টিবি, রপ্তানির ব্যবসা করেন ।

        প্রফেসর পি চক্রবর্তী টেবিলের তলা থেকে একটা পাত্র তুলে তাতে পানের পিক ফেললেন, ওয়াক থুঃ ।

        পানের পিকদানিটা নতুন ধরণের দেখে নগেন দত্ত বললেন, অমন পিকদানি তো দেখিনি ।

        উত্তরে প্রফেসর পি চক্রবর্তী বললে, একে বলে ‘ওয়াখটিন’, নতুন বেরিয়েছে বছর ষাটেক হল, রাশিয়ায় একজন লোক ছিল মিখায়েল বাখতিন নামে, তার স্মৃতিতে বেরিয়েছে, এই ‘ওয়াখটিনে’ পানের পিক ফ্যালো, শিকনি ফ্যালো, থুতু ফ্যালো, ধাতুরস ফ্যালো, সব নিমেষে উবে যায় । আমার বা অন্যদের গ্যালারিতে যেমন নানা ভাষার খদ্দের এসে মিশে যায়, তেমনিই এই ‘ওয়াখটিন’, বাংলার ভেতরেই তুমি পাবে হিন্দি মারোয়াড়ি গুজরাতি পাঞ্জাবি অহমিয়া ওড়িয়া তামিল তেলুগু মালায়ালম কন্নড় মারাঠি আর যতো বিদেশি খদ্দের হয় সব ।

        আগন্তুক নগেন দত্তের দিকে মুখ করে বলল, এই প্রডাক্টটা আমরাই ম্যানুফ্যাকচার করি ।

        নগেন দত্ত চুপচাপ বসে পিসি আর টিবির কথা শুনতে লাগলেন ।

        পিসি : তিন পিসের দাম ক্যাশে দিতে হলে জিএমকে জিগ্যেস করতে হবে ।

        টিবি : জিগ্যেস করে তাড়াতাড়ি জানিও ।

        পিসি : অরিজিনাল না সেকেন্ডহ্যাণ্ড ?

         টিবি : অরিজিনাল ছিল, এক লাখে বিক্রি হয়েছিল এক-একটা আইটেম ।

         পিসি : রিপেয়ার করাতে হবে তার মানে ।

         টিবি : রিপেয়ার করিয়ে নিও, তোমার প্রবলেম কোথায়, তোমার কাছে তো ভালো রিপেয়ারিং ইউনিট আছে । দরকার হলে আরও ইমপ্রুভ করিয়ে নিতে পারো ।

         পিসি : জিএমের পারমিশান নিতে হবে ।

         টিবি : ইমপ্রুভ করিয়ে নিলে ওগুলো প্রত্যেকটা দুলাখে বিকোবে, ক্রেতা আমি যোগাড় করে দেবো । ওদের কাস্টমার সার্ভিস অনেক ভালো, কোনো বেগড়বাঁই নেই, নো কমপ্লেইন্টস ।

         পিসি : ওকে, জিএমের সঙ্গে ডিসকাস করে তোমায় কল ব্যাক করব ।

         টিবি : ওকে, বাই ।

         টিবি চলে গেল উঠে ।

         ঘরে এসি চলছে, পুরোনো উইনডো এসি, হালকা ঘরঘর আওয়াজ, টেবিলে ফুলদানিতে বিদেশি ফুলের তোড়া, মালদার কোনো পার্টি দিয়ে গিয়ে থাকবে দুপুরে আয়েস করতে এসে । কাচের গেলাসে সোনার দাঁতের পাটি ভিজছে, কার কে জানে, হয়তো কোনো খাজা খদ্দের ইল্লি করার সময়ে খুলে রেখেছিল । চারিদিকের দেয়ালে সুন্দরী-করে-তোলা মামুলি মেয়েদের পোস্টার । পেছনের দেয়ালে কোনো গুরু-মহারাজের গেরুয়া ছবি, হাত ওপরে তুলে বাতাসকে আশীর্বাদ করছে, খালি গায়ে, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, ভুঁড়ি ঝুলে পড়েছে গেরুয়া লুঙ্গির তলায়, ফ্রেমে  সাদাচন্দনে র‌্যাঁদামারা কাঠের মালা, যা বোধহয় গত চল্লিশ বছরে বদলানো হয়নি ; ঘরে চন্দনের গন্ধ বেরোচ্ছে, ধুপকাঠি থেকে। গুরু-মহারাজের ফোটোতে তাঁর বাণী সোনালী অক্ষরে লেখা রয়েছে, “সত্যের জয় কখনও হয় না, কখনও হয়নি, কখনও হবে না।”

        স্মার্টফোন আর অ্যাটাচি টেবিলের ওপর রাখলেন নগেন দত্ত ।

        প্রফেসার চক্রবর্তী অবাক উঠে দাঁড়িয়ে সবাক, বললেন, আরে, নগেন দত্ত না ? কতোকাল পরে দেখছি, পঞ্চাশ একশো না দুশো, অ্যাঁ, কত বছর হল । বোসো, বোসো, কি খাবে বলো, কনিয়াক না শেরি ? চুল্লু চাও তো তাও আছে, ওটাই বেশি চলে তিরিশ হাজারিনীর দেশে, জানোই তো মাফিয়া জন্মায় না এই ভূঁয়ে, সবই তাপ্পিমারা মাস্তান ।

        —নো, থ্যাংকস, এখন পানভোজন করতে চাই না, অন্য কাজে এসেছি, হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ পঞ্চাশ বছর সাত মাস কুড়ি দিন আগে ;  তুমি যখন কালেজে পড়াতে ।

        —চন্দনকাঠের মালা দেখছিলে তো ? উনি আমার গুরু মহারাজ ।  খাঁটি একেবারে, বীরপ্পন ছিল গুরু-মহারাজের শিষ্য, নিজের হাতে গাছে র‌্যাঁদা মেরে মালা তৈরি করে পরিয়ে দিয়েছিল ওনাকে ।

         ‘ওয়াখটিন’-এ আরেকবার পিক ফেলে প্রফেসর চক্কোত্তি বলল, এই তিরিশ হাজারিনীর দেশে মনুস্মৃতি চলে না, বুঝলে, আর যেখানেই চলুক, ক্লায়েন্টরা সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়ে তাদের জাত-ধর্ম-পরিবার সবকিছু পেছনে ফেলে আসে । শিষ্যদের পনজিস্কিমের টাকায় গুরু-মহারাজ নিজের টিভি, সংবাদপত্র, ল্যাংবোট অনেককিছু করে ফেলেছেন । অধ্যাপক চক্কোত্তি যোগ করলে, তোমার চেহারার বেশ খোলতাই হয়েছে কিন্তু, সেই পঁচিশ বছরই চলছে বোধহয় ?

        —হ্যাঁ, দাদামশায়ের উইলের আইনি বাঁধন তো উপেক্ষা করতে পারি না ।

        —আমি তো, জানোই, সাতাশি বছর কার্ড হোল্ডার ছিলুম, কিন্তু হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট করলে না, বড়ো-ছোটো এমনকি চুনোপুঁটিদেরও কতো তেল দিলুম, কোনও ফল হল না, তাই রেগেমেগে এই লাইনে চলে এলুম, গুরু-মহারাজের কাছে দীক্ষা নিয়ে শান্তিতে ব্যবসা চালাচ্ছি । আগেরবার এসে কুন্দনন্দিনী নামে একটি মেয়ের খোঁজ করেছিলে, মনে আছে, রেকর্ড করা আছে আমার মোবাইলে, মালদার ক্লায়েন্ট পেলে তাদের শোনাই তোমার বর্ণনা, টিভিতে আমাদের সেক্সুয়াল পাওয়ার বাড়াবার প্রডাক্ট বিক্রির জন্যে কাজে লাগাই ।

       —মানে ? ওই জাপানি কোরিয়ান ক্যামবোডিয়ান তেল ? বুলেট-বড়ি ? স্টে অন ? হোল নাইট ?

       —কারেক্ট, কারেক্ট । তোমার উদাত্ত গলা বেশ কাজে দ্যায় ।

        —তাই বুঝি ? কই শোনাও তো । কারখানা-টারখানা খুলে ব্যবসাও করছ তাহলে । এটা সাইড বিজনেস? আগ্রহ না থাকলেও কথার পিঠে কথা চাপিয়ে বললেন নগেন দত্ত ।

        অধ্যাপক চক্রবর্তী তাঁর টেবিলের ডেস্কটপে একটা সিডি ঢুকিয়ে বললেন, শোনো, তোমারই কন্ঠস্বর। ব্যাকগ্রাউন্ডে গিটারের মৃদু আবহ গড়ে নগেন দত্তের কথাগুলো শুনতে লাগলেন নগেন দত্ত ।

        “বৃহৎ নীল দুইটি চক্ষু — চক্ষু দুইটি শরতের মত সর্বদাই স্বচ্ছ জলে ভাসিতেছে — সেই দুইটি চক্ষু আমার মুখের উপর স্হাপিত করিয়া চাহিয়া থাকে ; কিছু বলে না — আমি সে চক্ষু দেখিতে দেখিতে অন্যমনস্ক হই, আর বুঝাইতে পারি না । তুমি আমার মতিস্হৈর্যের এই পরিচয় শুনিয়া হাসিবে, বিশেষ তুমি বাতিকের গুণে গাছ কয় চুল পাকাইয়া ব্যঙ্গ করিবার পরওয়ানা হাসিল করিয়াছ ; কিন্তু যদি তোমাকে সেই দুইটি চক্ষুর সন্মুখে দাঁড় করাইতে পারি, তবে তোমারও মতিস্হৈর্যের পরিচয় পাই । চক্ষু দুইটি যে কিরূপ তাহা আমি এ-পর্যন্ত স্হির করিতে পারিলাম না । তাহা দুইবার একরকম দেখিলাম না ; আমার বোধহয়, যেন এ পৃথিবীর সে চোখ নয় ; অন্তরীক্ষে যেন কি দেখিয়া তাহাতে নিযুক্ত আছে । কুন্দ যে  নির্দোষ সুন্দরী, তাহা নহে । অনেকের সঙ্গে তুলনায় তাহার মুখাবয়ব অপেক্ষাকৃত অপ্রশংসনীয় বোধ হয়, অথচ আমার বোধহয়, এমন সুন্দরী কখনও দেখিনাই । বোধহয় যেন কুন্দনন্দিনীতে পৃথিবী ছাড়া কিছু আছে, রক্তমাংসের যেন গঠন নয়, যেন চন্দ্রকর কি পুষ্পসৌরভকে শরীরী করিয়া তাহাকে গড়িয়াছে । তাহার সঙ্গে তুলনা করিবার সামগ্রী হঠাৎ মনে হয় না । অতুল্য পদার্থটি, তাহার সর্বাঙ্গীন শান্তভাবব্যক্তি — যদি স্বচ্ছ সরোবরে শরচ্চন্দ্রের কিরণসম্পাতে যে ভাবব্যক্তি, তাহা বিশেষ করিয়ে দেখ তবে ইহার সাদৃশ্য কতন অন্তর্ভূত করিতে পারিবে । তুলনায় অন্য সামগ্রী পাইলাম না।”

       সিডিটা ড্রয়ারে রেখে প্রফেসার চক্রবর্তী বললেন, তোমার এই অসাধারণ বর্ণনার দরুণ একজন কুন্দনন্দিনীকে কেউ এংগেজ করে নিলে সেদিন আরেকজনকে কুন্দনন্দিনী নামে চালাই, সেও এংগেজ হয়ে গেলে অন্য কাউকে কুন্দনন্দিনী নামে চালিয়ে দিই । বাইরে নিয়ে যাবার অর্ডার এলে কচি কুন্দনন্দিনীকে পাঠাই না, ডুলিকেট, ট্রিপলিকেট যে ফ্রি থাকে তাকে কুন্দনন্দিনী নাম দিয়ে পাঠিয়ে দিই, সবাইকে ট্রেনিং দেয়া আছে । বুঝতেই পারছ, এটা সাইড বিজনেস নয়, প্রধান ব্যবসা, পলিটিশিয়ানদের সঙ্গে ওঠাবসার দরুন অনেক সময়ে পাশের গ্যালারি থেকে পারফরমিং ফ্লেশ ধার নিই । সত্যি কথা বলতে কি, আসল কুন্দনন্দিনী যে কে তা আমি নিজেই জানি না, তাই গোলমাল এড়াতে সবায়ের নামই কুন্দনন্দিনী করে দিয়েছি ।

         —পারফরমিং ফ্লেশ ? প্রশ্ন তুলে নগেন দত্ত নিজের মগজের গোলাপি অন্ধকারে নিজেকে বললেন, কন্ঠস্বরটা আমার নয়, একজন ডেপুটি ম্যাজিসট্রেটের, যাঁর বন্দে মাতরম গান এখন অনেকে খাকি ঢোলা-হাফপ্যান্ট পরে গায়, অনেকে তাকে নিজেদের স্লোগান বানিয়ে ফেলেছে, অনেকে আবার ডেপুটি ম্যাজিসট্রেটকে পছন্দ করে না, তারা বলে স্লোগানটা তাদের ধর্মবিরোধী ।

         অধ্যাপক চক্রবর্তী বললেন, তাছাড়া আর কী ? ক্লায়েন্ট তো এমন ফ্লেশ চায় যে মনের মতন পারফর্ম করবে । নয়কি ? আঠার সঙ্গে আঠা জুড়ে শরীরে ঢেউয়ের পর ঢেউ তুলবে, তুমিও তো তাই চাও । কুন্দনন্দিনী তোমাকে মনের মতন পারফরম্যান্স দিয়েছিল বলেই তো তাকে দু-আড়াইশো বছরেও ভুলতে পারোনি ।

         —-না না, ভুল ধারণা, আমি ভালোবাসতে চেয়েছি, ভালোবাসা পেতে চেয়েছি, কুন্দনন্দিনীর সঙ্গে শোয়া হয়নি কখনও, তাকে খুঁজে ফিরছি একশো-দেড়শো বছর হয়ে গেল , সারা দেশের লোকালয় ঘুরে-ঘুরে খুঁজে চলেছি ।

         —-আরে সেই কথাই তো বলছি, পারফরমিং ফ্লেশ হল একটা আর্ট,  আর যে ওই আর্টকে অ্যাপলাই করতে শিখে গেছে, সে ভালোবাসা এগজিবিট করতে শিখে গেছে বুঝতে হবে, আর্টের বাংলা হল শিল্প । ভালোবাসা হল সবচেয়ে উন্নত প্রদর্শনী, একে আরেকের কাছে, দেখছি তো কতো মাল আসে আর যায়, আজ একশো বছর হতে চলল, আমি কি আর ভালোবাসাবাসি করিনি ভাবছ, অনেকের সঙ্গে করেছি, সে ছিল ভালোবাসার দিনকাল, তখন আমাকে রোগে ধরেনি, এখন সকলে কুইকি পছন্দ করে, মরনিং আফটার ট্যাবলেট বেরিয়ে আমাদের মার্কেট ডাউন করে দিয়েছে ওষুধ কোম্পানিগুলো, তার ওপর ভার্জিনিটি রিপেয়ারিঙেরও ক্লিনিক বড়ো-বড়ো শহরে, আমার কাছে কোনো খদ্দের ভার্জিন মাল চাইতে এলে স্টকের কম বয়সী মেয়ের ভার্জিনিটি রিপেয়ার করিয়ে পাঠাই পার্টিকে ।

        চক্কোত্তি বলা বজায় রাখলে, সিগারেট ধরিয়ে এক ফুঁক মেরে, আমার স্টকে কোনো মেয়ে এলে তাকে শেখাতে হয় যে ক্লায়েন্টের ক্লাইম্যাক্স যখন হবে, তার সঙ্গে অরগ্যাজমের অভিনয় করতে হবে, যাতে সে নিজেকে সফল মনে করে, যদি সে অবাঙালি হয় তাহলে তাকে ‘জানেমন, বলম পরদেসি, আপকা প্যার মুঝে পাগল কর দিয়া, ফির জরুর আইয়েগা, ম্যায় ইন্তজার করুঙ্গি’ আর যদি বাঙালি হয় তাহলে একই ভাবে সিংক্রোনাইজ করে তাকে বলতে হবে, ‘আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি, এতো সুন্দর করে আপনি ভালোবাসা দেন প্রতিদান না দিয়ে পারি না, আপনার মতন এভাবে কেউ ভালোবাসেনি আমায়, আবার নিশ্চই আসবেন, আমি অপেক্ষা করব’, এটসেটরা, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে টেনশন কমাবার জন্যে যে খোকা কাস্টমার আসে, তাদের বলতে হয়, আবার এসো, লক্ষিটি, সব শিখিয়ে দেবো, কতোরকমের আনন্দ হয় জানতে পারবে, আমি অপেক্ষা করব, অ্যাঁ, তারপর থুতনিতে হাত বুলিয়ে খোকা-ক্লায়েন্টকে পার্টিং কিস দিতে হয়, অভিনয় শেখাবার জন্যে চিৎপুর যাত্রাদল থেকে অভিনেত্রী ভাড়া করে আনি ।

         নগেন দত্ত জিগ্যেস করলেন, আচ্ছা, বারান্দায় দুটি ধড়হীন মাথা দেখলুম, বললে তারা তিথি আহমেদ আর ছন্দরানি মজুমদার, আমার লিভ টুগেদার বউ ছিল, মনে করতে পারলুম না, তাদের দেহে তো সালভাদর দালি আর পাবলো পিকাসোর পেইনটিঙ শাড়ির মতন করে আঁকা ছিল । যুবতী-কন্ঠস্বরের যুবকরাই বা কেন পাশে বসে মাথায় হাত বোলাচ্ছে, তাও বুঝতে পারলুম না ।

        প্রফেসার চক্কোত্তি ওরফে পিসি চোখ থেকে চশমা খুলে টেবিলের ওপর রেখে, মদখোর চিকনগালে বাঁহাত দিয়ে আদর করতে-করতে, সুইংগিং চেয়ারে একচিলতে হেলে  বললে, তিথি আহমেদ আর ছন্দরানি মজুমদার হলেন গাইড, কালেজে হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট ছিলেন, অবসর নিয়েছেন, তোমার দাদামশায়ের উইল অনুযায়ী, যে বয়সে ওনাদের শেষবার দেখেছিলে সেই বয়সেই আটকে আছেন, ছাত্রদের গাইড করার জন্যে মাথাটাকে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন করে তোলেন ওনারা, সেই ক্ষমতাও তো তোমার দাদামশায়ের উইল অনুযায়ী তোমারই দেয়া, আর যুবতী-কন্ঠস্বরের যুবক দুজন ওনাদের আন্ডারে ডক্টরেট করছে, কেননা আজকাল ডক্টরেট না করলে লেকচারারের চাকরি পাকা হয় না, মাইনেও স্কেল অনুযায়ী হয় না, ডক্টরেট করার জ্ঞানের জন্যে আফগানি খাঁটি চরস আনিয়ে দিয়েছি।

        তা না হয় বুঝলুম, বললেন নগেন দত্ত, তা ওদের ধড় নেই কেন ।

        যে গাইডদের ধড় থাকে তারা বেশ বিপজ্জনক ; তাদের সঙ্গে না শুলে, তাদের সঙ্গে দার্জিলিং, দীঘা কিংবা পুরিতে বেড়াতে না গেলে গাইডরা পিএইচডির কাগজটা সহজে ছাড়ে না । আমাকে তো ওদের জন্যে একটা পুরো লাইব্রেরি খুলতে হয়েছে, ওই তো দ্যাখো, তবে কোনো বইই আমার গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে কেনা নয় । ওনাদের নাম তিথি আহমেদ আর ছন্দরানি মজুমদার হলেও, ধড় নেই বলে ছাত্রীরা নিশ্চিত হতে পেরেছে যে লেসবিয়ান কাজকম্মো করতে পারবেন না, আজকাল সকলেই যে-যার দেহকে যুগপোযোগী করে ফেলেছে, জানো তো ।

        ঘষাকাচের পার্টিশানের লাগোয়া গোদরেজ আলমারিতে রাখা বইগুলো কাছ থেকে দেখতে গেলেন নগেন দত্ত, যদি কাজে লাগে এমন কোনো বই , যদিও ওনার বাবা নিজেদের কারখানা আর ব্যবসা অন্ধ্রপ্রদেশে তুলে নিয়ে গেছেন, ইনকেলাব জিন্দাবাদ চলবে না চলবে না, এড়াবার জন্যে, বইগুলো দাতব্য করে দিয়েছিলেন গ্রামের চণ্ডীমন্দিরে ।

         নগেন দত্ত বললেন, দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাম শুনেছ তো ? তা দ্বারকাবাবুর  ব্যাংক ইনশিওরেন্স জাহাজ কোম্পানি চটকল কয়লা চা বাগানের ম্যানেজিং এজেন্সি আর চিনে আফিম পাঠাবার কারবারে আমার বাবার আর ঠাকুর্দার শেয়ারের কাগজ ছিল, হঠাৎ করে উনি মারা গেলেন আর সেই থেকে বাঙালির ব্যবসা লাটে উঠে গেল । ১৮৪৬ সালের আগস্টে আমি তো বাবার সঙ্গে লণ্ডনে ছিলুম যখন দ্বারকাবাবুর দেহ থেকে হৃৎপিণ্ড কেটে নিয়ে ওনাকে কেনসাল গ্রিন গোরস্তানে কবর দেয়া হয়েছিল ।

         ভুরু কুঁচকে নগেন দত্ত বললেন, ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠিয়ে দেবার দায় ওনার ছেলে দেবেন্দ্রনাথ আর নাতিদের । দেবেনবাবু বেমমো-বেমমো করে এমন ধর্ম নিয়ে পড়ল যে ব্যবসা ছারখার, তারপর যাও বা পুঁজি ছিল, দ্বারকাবাবুর নাতিরা পড়াশুনা আর লেখালিখিতে খরচ করে নামখ্যাতি করার পেছনে দৌড়ুলো । এখন সব ফক্কা-টরেটক্কা, কোন বেমমো যে কোথায় আছে তার খোঁজখবর রাখেনা কেউ, মাদুর গুটিয়ে শান্তিনিকেতনে, সেখানেও হরেদরে পেঁকোজল,  অধ্যাপকরা পড়াবার বদলে অন্য কাজে লেগে থাকে। পুরস্কারের সোনার বিসকুটটাও কেউ নিয়ে গিয়ে গয়না করে ফেলেছে।

        কয়েকটা বই দেখে, সেদিকে আঙুল দেখিয়ে, নগেন দত্ত বললেন, এই বইগুলো তোমার এখানে কারোর কাজে লাগে নাকি ?

       —আমার আলমারিতে যে বইপত্র দেখছ সবই ক্লায়েন্টদের ডোনেট করা কিংবা ভুলে ফেলে যাওয়া, তবুও কাজে লাগে ডক্টরেট করিয়ে ছাত্রীদের । একবার এক মার্কিন ছাত্রী গবেষণার উদ্দেশ্যে একমাসের জন্যে যৌনকর্মীর কাজ করে গেল, ক্লায়েন্টদের সাক্ষাৎকার নিতো কথা বলার ছলে, মেম পাবার জন্যে আগে থেকে ক্লায়েন্টরা বায়না দিয়ে যেতো, অনেক প্রফিট করেছি ওই এক মাস, সে প্রচুর বই ফেলে গেছে, ওই যে বিটকেল নামের বইগুলো, অন গ্র্যামেটোলজি অফ সেক্স, ফরম্যালিজম অ্যান্ড দি নিউড, এগজিসটেনশিয়াল পোজিশানস, ডিকন্সট্রাকশান অফ দি ফ্যালাস, দি রিটার্ন অফ দি রিয়াল স্লিট, হারমেনিউটিক্স অ্যাজ হরমোনাল চেঞ্জ, বডি অফ দি আদার, দি ট্রুথ অ্যাবাউট দি ট্রুথ অফ ইমমরট্যাল ট্রাইঅ্যাঙ্গল, কার কাজে যে লাগে ঈশ্বরই জানেন, প্রচ্ছদ দেখে পড়ুয়া কাস্টমাররা প্রশংসা করে অথচ পড়ে না ।

       —আর এগুলো, এগুলোও কেউ ডোনেট করেছে নাকি ?

       —না না, কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো আর দাস ক্যাপিটালের কথা বলছ তো ? ওগুলো এক ছোকরা কমরেডের, বইগুলোর গন্ধ শুঁকলেই বুঝতে পারবে সোভিয়েত দেশে ছাপানো, গোরুর খুর গলিয়ে তৈরি আঠায় পুট সাঁটা হয়েছে, বৃষ্টি পড়লেই বইগুলো সোভিয়েত দেশের দুঃখে দুর্গন্ধ ছাড়ে ।

        তা জানি, তা জানি, রাশিয়ার গোরু আর রাশিয়ার মেয়েমানুষ, ওদের থন তো বিশ্বখ্যাত, তা সে যতোই দুর্গন্ধ থাকুক, একবার মুখ গুঁজে পড়ে থাকলে রাশিয়ার পুরো শীতকাল  কাবার হয়ে যায় । বললেন নগেন দত্ত, বিশেষজ্ঞর গাম্ভীর্যে।।

         সেই ছোকরা কমরেড রাতটা কাটিয়ে সকালে উঠে টিভিতে জানতে পারলো যে পরিবর্তনের সরকার গদিতে বসতে চলেছে, কমরেডদের রাজত্ব শেষ, পরিবর্তনঅলারা কমরেডদের ধরে-ধরে আড়ং ধোলাই দিচ্ছে । রাতের কমরেড এমন ধরাধরি করতে লাগল যে নাপিত ডাকিয়ে তার দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে, চুল কদমছাঁট করিয়ে এখান থেকে বেরিয়েছিল, কাঁধের ঝোলাটা আমার টেবিলের ওপর ফেলে বলেছিল, এগুলোর যা গতি করার করবেন ।

        ড্রয়ার থেকে নোংরা বাদামি একটা কাঁধব্যাগ বের করে চক্কোত্তি বললে, এই ঝোলা থেকেই ওই বইগুলো পেয়েছিলুম, আর একটা ডায়েরি, সেটা আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি, ব্যাটা এখানে কার সঙ্গে কবে শুয়েছে, তার দিনক্ষণ-রেট সবই লিখে রেখেছিল, মেয়েরা কত রকমের, তাদের গুণদোষ কি-কি।  বই পড়াপড়ি আর লেখালিখিই কাল হয়েছে বাঙালির ।

         তাতে কুন্দনন্দিনীর নাম ছিল ? জানতে চাইলেন নগেন দত্ত ।

         অতো আর দেখিনি, থাকলেও থাকতে পারে, সকলের নামই তো কুন্দনন্দিনী করে দিয়েছি, বললেন প্রফেসর চক্কোত্তি । তারপর যোগ করলেন, যেন কোনো ব্যাপারই নয় এমন স্বাভাবিক কন্ঠস্বরে, ছোকরাকে সেদিন রাতেই পিটিয়ে মেরেছিল, ছবি বেরিয়েছিল কাগজে, কে বা কারা মেরেছিল তা আজও ধরতে পারেনি পুলিশ, তবে বিশ্বস্ত সূত্রের খবর ছাপা হয়েছিল যে তার সাগরেদরা যারা রাতারাতি কমরেড থেকে পরিবর্তনের দিকে চলে গিয়েছিল তারাই ওকে সাবড়ে দিলে । টিভিতে দেখোছো তো ব্যাঙরা ওজনপাল্লার একদিক থেকে আরেক দিকে লাফাচ্ছে, কানমুলে নাক খৎ দিচ্ছে ।

        তোমার আলমারিতে তো কুড়িটি প্রেমের চটচটে  উপন্যাস, পনেরোটি ভালোবাসার রগরগে উপন্যাস, তিনশো প্রেমের ভিজে কবিতা, শ্রেষ্ঠ প্রেমের চকাচক কবিতা, শ্রেষ্ঠ ভুতের ননস্টপ প্রেমের কবিতা, শ্রেষ্ঠখোকাদের প্রেমের কবিতা, কাফকার প্রেমের উপন্যাস, ডসটয়েভস্কির ভালোবাসা, মুরাকামির জাপানি যৌনতা আর প্রেম, আরও অনেকের শ্রেষ্ঠপ্রেমের কবিতার বই দেখছি । ওগুলোও কি ফেলে গেছে ক্লায়েন্টরা ?

         না, কেউ কেউ কুন্দনন্দিনীদের উপহার দিয়ে গেছে । শোবার আগে নিজেদের কবিতা শুনতে চেয়েছে কুন্দনন্দিনীদের গলায় । প্রধান অতিথি হয়ে দেখেছি তো, কবিতাপাঠের আসরে তো কেউ বড়ো একটা কবিতা শোনে না, পেছনের সারিতে বসে ঝিমোয়, চা-সিঙাড়া খেয়ে কেটে পড়ে নিজের কবিতা পড়ার পর, তাই একরাতের ভালোবাসার পাত্রীর গলায় নিজের কবিতা শুনে দাঁড়ানো যন্তরকে শোনায় ।

         টেবিলের ওপর রাখা গুরু-মহারাজের ফোটো ঝোলা দিয়ে মুছে অধ্যাপক চক্রবর্তী বললে,

আমার প্রজেক্ট অত্যন্ত সরল ; পুরুষরা ইডিয়ট, আমার কুন্দনন্দিনীদের কাজ হল তাদের বোকা বানিয়ে যতো পারা যায় নিংড়ে নেয়া। তাই তো চব্বিশ ঘণ্টা একটা টেলিফোন সেক্সের লাইন খোলা রাখি ।

        টেলিফোন সেক্স ? তাতে মন ভরে ? জানতে চাইলেন নগেন দত্ত ।

        পুরুষদের ইডিয়ট বলেছে কেন, ইডিয়ট জানোয়ার, মেয়েদের সিডাকটিভ গলার আওয়াজ স্বমেহন করতে সাহায্য করে ; যে মেয়েদের  অবসর নেবার বয়স হয়েছে, তাদের আমি টেলিফোন সেক্সের টেবিলে বসিয়ে দিই পালা করে, তাদের অভিজ্ঞতা কাজে দ্যায়, একটা মালটিলাইন বোর্ড আছে তার জন্য, আগেই অনলাইন পেমেন্ট করতে হয়, ইনটারনেটে স্কাইপে যৌনআলাপের ব্যবস্হাও করেছি, তাতে অবসরপ্রাপ্তদের বসিয়ে দিই ফিল্ম স্টারের মুখোশ পরিয়ে । ব্যাকগ্রাউণ্ডে বাংলা বা হিন্দি ফিলমের গান বাজে, হওলে-হওলে, ছিনছিনাছিনছিন, ইয়ামবা ইয়ামবা ।

        যাকগে যাক, কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো আর ডায়েরিটা বের করে দাও তো একটু, কেমন যেন চেনা-চেনা লাগছে, বললেন নগেন দত্ত, গলায় উদ্বেগ ।

         প্রফেসর চক্কোত্তি, নিজের মনে বললেন, কোন জিনিয়াসের পাল্লায় পড়েছি, মাঝে মাঝেই আসে আর কেলো করে যায়, ঘাঁটাতে চাই না বেশি, কাঁড়ি-কাঁড়ি টাকা কোথা থেকে পায় কে জানে, এমনও নয় যে টাকাগুলো চিনে ছাপিয়ে পাকিস্তানি কিংবা বাংলাদেশিরা এপারে এনেছে, সবই খাঁটি টাকা, যাচাই করিয়ে দেখেছি, তবুও প্রতিভাধর বলে কথা, এঁটুলির বাড়ন্ত, জিনিয়াসের সঙ্গদান করার সময়ে সকলকেই সাময়িকভাবে পাগল হয়ে উঠতে হয়, তাই কিই বা করি, পাগলামিই করি, অবশ্য পাগলামি করার মধ্যে আনন্দ আছে ।

         বইয়ের গোদরেজ আলমারি থেকে ডায়েরি, কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো আর দাস ক্যাপিটাল বের করে, প্রফেসর চক্কোত্তি টেবিলের ওপর রাখতেই, নগেন দত্ত প্রায় কেড়ে নিয়ে বললেন, আরে এগুলো তো আমারই, আমিই ফেলে গিয়েছিলুম কখনও ।

         এই দ্যাখো, বললেন নগেন দত্ত, ১৭৫২ সালে ভারত মুকুজ্জে নিজের হাতে ‘রসমঞ্জরী’ বই থেকে এই লাইনগুলো লিখে দিয়েছিলেন । ভারত মুকুজ্জেকে জানো তো, ওই যে, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, মহারাজা কেষ্টচন্দ্রর দরবারি কবি ছিলেন, তোমার এই গ্যালারিতে কতোবার এসেছেন-গেছেন, ওনার অভিজ্ঞতার থই পাওয়া যাবে না, আমি তো ওনার নির্দেশিকা মিলিয়ে কুন্দনন্দিনীকে মনে-মনে আবার থেকে গড়ে নিয়েছি । তুমিও এই নির্দেশিকা দেখে বাছবাছাই করতে পারো, এতো কুন্দনন্দিনী তোমার আণ্ডারে ।

         —না, আমি মানিক বাঁড়ুজ্জের শশীরোগে ভুগি, বললেন প্রফেসার চক্কোত্তি । বলার পর তাঁর সন্দেহ হল যে এই রোগের জন্যে নগেন দত্তই দায়ি, গেলবার নগেন দত্ত ফিরে যাবার পর থেকে এই রোগে ধরেছে তাঁকে, নগেন দত্তের আসল কুন্দনন্দিনীকে খুঁজে দিতে পারেননি সেবার । এবার লোকটা কী করবে কে জানে, হয়তো তাঁকে বলবে “তুমি মোটা চামড়ার মানুষ”, আর উনি নিমেষে গণ্ডার হয়ে যাবেন ।

         নগেন দত্ত শশীরোগের বিষয়ে জানেন না বলে অপ্রস্তুত গলায় বললেন, অমন রোগের কথা শুনিনি তো ।

         মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ বইটা পড়েছ তো, তাতে শশী নামে যে চরিত্র আছে, তার এরেকটাইল ডিসফাংশান রোগ ছিল, আমিও আজকাল ওই রোগেই ভুগি ।

         নিজের মগজের ভেতরে নিজেকে নগেন দত্ত বললেন, তার মানে ‘আছে’ থেকেও ‘নেই’ । বিইং নিজেই নাথিংনেস, চিন্তা করে হাসতে লাগলেন, কীক্কাণ্ড, বিইং আর নাথিংনেসে কোনো তফাতই থাকে না বহু ক্ষেত্রে । সিঁড়ির দেয়ালের পেইনটিঙের মানে ছবি দেখে যা মনে হয়েছিল তা নয় । দুটো অঙ্গের প্রতিটিই নাথিংনেস হতে পারে ।

         নগেন দত্ত বললেন, তোমার কথায় মনে পড়ে গেল, ১৯২১ সালে একবার শরৎ চাটুজ্জের সঙ্গে চিনেপাড়ায় দেখা হয়েছিল, উনি আফিম কিনতে গিয়েছিলেন আর আমি আফিম সাপলাই দিতে গিয়েছিলুম এক চীনে হোলসেলারকে, মালদায় আমাদের যে জমিদারি, সেখানে প্রচুর পোস্তখেত আছে, তা শরৎ চাটুজ্জেকে আমি জিগ্যেস করেছিলুম যে চন্দ্রমুখীর সঙ্গে দেবদাসের রিলেশানশিপটা কমপ্লিকেটেড করে দিলেন কেন ? উনি বলেছিলেন, দেবদাস এতো মদ খেতো যে ওকে এরেকটাইল ডিসফাংশান রোগে ধরেছিল, তা বুঝতে পারার পর দেবদাস মদ খাওয়া আরও বাড়িয়ে দিলে, ধেনো টানতে লাগল, তা আমি আর কি করি, দেবদাসের মুখে মাতালের সংলাপ দেয়া ছাড়া , সংলাপের জন্যে বইটা হিট হয়ে গেল, একটা বইয়ের সংলাপের টাকা থেকে সারা বছরের আফিমের খরচ উঠে যায় ।

        —এখনও পোস্তচাষ হয় ? এখন তো মার্কিন চাপে আফিম বেআইনি হয়ে গেছে শুনি, জানতে চাইলেন অধ্যাপক চক্রবর্তী ।

        —বেআইনি বলে কিছু আছে নাকি, এই তো কয়েকমাস আগে আমার কালিয়াচকের চাষিরা বিপদে পড়েছিল বলে নিজেরাই নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে ফয়সালা করে ফেললে ; আইনভাঙার কোনো প্রমাণ কারোর কাছে নেই।

        প্রফেসর চক্কোত্তি বললেন, সে যাহোক, নির্দেশিকাটা দেখান দিকি, ক্লায়েন্টদের হয়তো কাজে দিতে পারে, কেন কেউ একজন বিশেষ মেয়েকে পছন্দ করে, আর তার চেয়ে সুন্দর-মুখ সরেস-বডির মেয়েকে করে না, তার হদিশ পাইনি আজ পর্যন্ত, এ যেন বিয়ের জন্যে মেয়ে বাছাই করার মতন, কোন মেয়েকে যে কোন বরের পছন্দ হয়ে যায়, কেন হয়, তার ব্যাখ্যা নেই কোনো।

        নগেন দত্ত পড়া আরম্ভ করলেন, এই বলে যে, নারীরা চার রকমের হয়, পদ্মিনী, চিত্রিনী, শঙ্খিনী আর হস্তিনী, তোমার এই গ্যালারিতেই তো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে লিখে গেছেন ভারত মুকুজ্জে । তাঁর, নগেন দত্তর, গলা থেকে বেরোতে লাগল আঠারো শতকের বাঙালি বামুনের স্বর:

                                                  পদ্মিনী

                       নয়ন কমল কুঞ্চিত কুন্তল            ঘন কুচস্হল
                                                 মৃদু হাসিনী।
                       ক্ষুদ্ররন্ধ্র নাসা    মৃদুমন্দ ভাষা নৃত্যগীতে আশা
                                                 সত্যবাদিনী ।।
                       দেবদ্বিজে ভক্তি পতিঅনুরক্তি           অল্পরতিশক্তি
                                                 নিদ্রাভোগিনী
                       মদন আলয় লোম নাহি হয়          পদ্মগন্ধ কয়
                                                 সেই পদ্মিনী ।।

                                                    চিত্রিনী

                       প্রমাণ শরীর সর্ব কর্মে স্হির          নাভি সুগভীর
                                                 মৃদু হাসিনী ।
                       সুকঠিন স্তন চিকুর চিকন             শয়ন ভোজন
                                                 মধ্যচারিনী ।।

                       তিন রেখে যুত কন্ঠবিভূষিত            হাস্য অবিরত
                                                 মন্দ গামিনী ।
                       মদন আলয় অল্প লোম হয়            ক্ষারগন্ধ কয়
                                                  সেই চিত্রিনী।।

                                                    শঙ্খিনী

                      দীঘল শ্রবণ দীঘল নয়ন                  দীঘল চরণ
                                                 দীঘল পাণি।
                      মদন আলয় অল্পলোম হয়                 মীনগন্ধ কয়
                                                 শঙ্খিনী জানি ।।

                                                   হস্তিনী

                      স্হূল কলেবর স্হূল পয়োধর               স্হূল পদকর
                                                 ঘোর নাদিনী ।
                      আহার বিস্তর নিদ্রা ঘোরতর               রমণে প্রখর
                                                 পরগামিনী ।।
                       ধর্মে নাহি ডর দম্ভ নিরন্তর                   কর্মেতে তৎপর
                                                 মিথ্যাবাদিনী ।
                       মদন আলয় বহুলোম হয়                  মদগন্ধ কয়
                                                  সেই হস্তিনী ।।

         —ক্লায়েন্টরা কতো রকমের হয় লিখেছিলেন নাকি ? জানতে পারলে ক্লায়েন্ট অনুযায়ী কুন্দনন্দিনীদের কোন দরোজায় কে দাঁড়াবে, ডিসাইড করতে পারবো তাহলে ।

        নগেন দত্ত বললেন, পুরুষরা জানোয়ার, তা ভারত মুকুজ্জে ১৭৫৫ সালে আমাকে বলেছিলেন, আর লালন সাঁইও বলেছিলেন আমাকে ১৮৭০ সালে, সে আজ অনেককাল হয়ে গেল, পুরুষদের বিশেষ হেরফের হয়নি, জানোয়ারই রয়ে গেছে, আমি নিজেকে দিয়েই জানতে পারি, কখন কোন পশু হয়ে গেলুম, মেয়েদের বরং অনেক রদবদল ঘটে গেছে, আর চার রকমে আটকে নেই ।

        কোন জানোয়ার ? কুকুর নিশ্চয়ই, পুরুষগুলোকে দেখি হয় কুকুরের মতন ল্যাজ নাড়ায় কিংবা কামড়াতে দৌড়োয়, জ্ঞানীর গাম্ভীর্যে বললেন অধ্যাপক চক্রবর্তী ।

        নগেন দত্ত বললেন, এখানে গুণাগুণের কথা আলোচনা করছি আমরা, প্রভূভক্তির নয় । ভারত মুকুজ্জে আর লালন সাঁইয়ের মতে পুরুষ চার রকম জানোয়ারের মতন হয়, খরগোশ, হরিণ, ঘোড়া আর ষাঁড় । তবে ১৯৪০ সালে যখন আফ্রিকায় গিয়েছিলুম, সিংহের চামড়ার ব্যবসার ব্যাপারে, তখন মাসাই নদীতে যে কুমিরগুলোকে দেখেছিলুম, আমার মনে হয় সবকটা পুরুষ ওই কুমিরদের মতন, বুঝলে, কুমিররা কামড়ে খেতে পারে না তো, একটা জেব্রা কি মোষ যদি নদীর জলে ধরতে পারে, সব কয়টা কুমির মিলে তাকে ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খায়, ছেঁড়ার জন্যে কামড় দিয়ে জলের মধ্যে পাক খেয়ে মাংস-নাড়িভুঁড়ি টেনে বের করে আনে ।

       —যা বলেছো, বেশিরভাগ বাঞ্চোতই ষাঁড় কিংবা ঘোড়া, জান কালি করে দ্যায় মেয়েগুলোর । কালেজের ছেলেরা দল বেঁধে আসে হরিণ-খরগোশের মতন ল্যাংচার টুকটুকুনি দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বাড়ি চলে যায়, কিংবা কোনো কুন্দনন্দিনীর সঙ্গে আমোদ করে । রেসের দিন থাকলে ষাঁড়-ঘোড়াগুলো বাড়িটাকে একেবারে চোরছ্যাঁচড়ের আড়ত বানিয়ে তোলে, আর ব্যাটারা যদি দলবেঁধে কোনো মেয়ের ঘরে ঢোকে তাহলে কুমিরেরও বেহদ্দ হয়ে ওঠে।

         এতোটা টানা বলার পর টেবিলের ওপরে রাখা কাচের গেলাসের জল খেয়ে, জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে চক্কোত্তিমশায় বললে, তা কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর সঙ্গে ভারত মুকুজ্জের রসমঞ্জরীর কোটেশান ঠিক মেলাতে পারলুম না, ও-দুটো তুমি পিটুনি খেয়ে মারা যাবার আগে অষ্টপ্রহর সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে, কেন ?

         বলশেভিক বিপ্লবের পর যখন স্ট্যালিনের সঙ্গে মসকোয় দেখা করেছিলুম, দিনের বেলা দশটাতেই অন্ধকার, ভাগ্যিস ঘড়ি ছিল, ওভারকোটের ওপর মাথায় কুরাকুল ভেড়ার চামড়ায় তৈরি অ্যাসট্রাখান টুপি পরে, টুপির ওপরে হ্যাট তুষার থামাবার জন্যে, ওভারকোটের তলায় প্যাডেড কোট, হাতে কুমির চামড়ার দস্তানা, তার তলায় কাপড়ের দস্তানা, কাপড়ের মোজার ওপর থার্মাল মোজা, থার্মাল জাঙিয়া, জুতোর ওপরে পরার পেরেক বসানো গোরেটেক্স বুটজুতো, তখন তুষারে ঢাকা পড়ে গেছে রেড স্কোয়ার, চোখের পাতায় তুষার জমে যাচ্ছে আর ঝাড়ছি, মুলো দিয়ে ভোদকা খেয়ে বেরিয়েছিলুম, মুখের গন্ধ দূর করার জন্যে কালো চকোলেট চুষতে-চুষতে, ভোদকা কেনার কি লাইন ।

         ঠিক সময়ে ওনার কাছে না পৌঁছোলে দেখা করেন না শুনেছিলুম, তা উনি বলেছিলেন যে প্রত্যেকটা গরিব দেশে একজন করে স্ট্যালিন থাকা দরকার, যে শ্রমিকের শত্রুদের ধরে-ধরে নিকেশ করবে, একনায়কের গদিতে বসে রাজত্ব করবে, লাল সৈন্যদের প্রধান হবে, অধস্তন কাউকে ইচ্ছে হলে পেপারওয়েট ছুঁড়ে নাচাবে, বেয়াড়াদের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে পাঠিয়ে দেবে বরফের দেশে জেল খাটতে ।

        আমি ভেবেছিলুম যে আমিই হবো সেই একেশ্বর, তাই মাঝে-মাঝে কমিউনিস্ট ইশতাহার পড়তুম আর স্বপ্ন দেখতুম । দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘতর করে বললেন নগেন দত্ত । স্ট্যালিন বললে, জনগণের ভেতরটা বদলে দিতে না পারলে একনায়ক হওয়া যায় না, লাগাতার নাগরিকের ভেতরটা বদলাবার মেশিন তার শরীরে চালু রাখতে হবে, সকলের দ্বারা তা সম্ভব নয় ।

        একটা ব্যাপারে স্ট্যালিন আমার ওপর চটে গিয়েছিলেন, জুলিয়াস সিজারকে খুন করার ষড়যন্ত্রে আমিও ছিলুম, শুনে থাকবে, মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস আর কয়েকজন মিলে আমরা নির্ণয় নিয়েছিলুম যে পম্পেই থিয়েটারের কাছে ১৫ ই মার্চ জুলিয়াস সিজারকে ছোরা মেরে-মেরে খুন করব, কেননা ওর বড্ডো বাড় বেড়ে গিয়েছিল, আমাদের কথায় কান দেয়া দরকার মনে করতো না, তখনও যিশুখ্রিস্ট জন্মায়নি, সে চুয়াল্লিশ সালে, আমিও দিয়েছিলুম কয়েক ঘা, খচাখচ, সেদিন ছিল দোলপূর্ণিমা, দুধে ভাঙ মিলিয়ে টেনেছিলুম, কাৎ হয়ে পড়ে গেল সিজার ।

         স্ট্যালিন বললে, ইতিহাসকে ওইভাবে পাল্টানো উচিত হয়নি, আসলে স্ট্যালিনের নিজেরও তো ভয় ছিল, তাই কাউকে সন্দেহ হলেই কোতল করে দিতো । সাধারণ মানুষরা ভুল বুঝলে বেশ মজা পেতো স্ট্যালিন। উত্তরে আমি ডেনিস দিদেরোর কথা বলেছিলুম । দিদেরো বলেছিলেন যে যতোদিন না শেষ পুরোহিতের নাড়ি দিয়ে শেষ রাজার গলায় পেঁচিয়ে মারা হচ্ছে, ততোদিন মানুষ স্বাধীন হবে না । শুনে স্তালিনের সেই যে শরীর খারাপ হলো, পরের দিন ওকে ওর খাটের পাশে অজ্ঞান অবস্হায় পাওয়া গিয়েছিল ।

        ফেরার আগে আমি স্ট্যালিনকে জিগ্যেস করেছিলুম যে হিটলার কেমন করে একনায়ক হয়ে গেল, সে কি জার্মানদের ভেতরটা বদলে দিতে পেরেছিল ?

         স্ট্যালিন বললে, ও ব্যাটা টেম্পো বজায় রাখতে পারেনি, ব্যাটার একটা বিচি ছিল না, আর দাঁড়ানো অবস্হায় নুনু ছিল এক ইঞ্চির, যাকে কমিউনিস্ট ডিকশনারিতে বলে ন্যানোনুনু, তাই যুদ্ধু হেরে গেল, দেশটাকে টুকরো করে ফেললে, ধরা পড়ার ভয়ে বিষ খেয়ে নিলে, ছ্যা ছ্যা ছ্যা । আমেরিকানরা  ওর ন্যানোনুনু খুঁজে পেয়েছিল, সেটা ব্যবহার করে ওরা হাইড্রোজেন বোমা আবিষ্কার করলে ।

         তারপর ? কান দুটো গাধা-কান করে জানতে চাইলে অধ্যাপক চক্রবর্তী । অধ্যাপকের কাছে মাঝে মাঝে ক্লায়েন্টরা এই হিটলারি সমস্যা নিয়ে আসে, তার জন্য ট্রেনিং দিয়ে রাখতে হয়েছে দুটি মেয়েকে ।

         তারপর কুন্দনন্দিনীর দেখা পেলুম আর বিপ্লব সমাজে ঘটার বদলে আমার মগজে ঘটে গেল, সব ওলোটপালোট হয়ে গেল । তদ্দিনে স্ট্যালিন আর ওর বসানো লোকগুলো গণেশ উল্টে খাল্লাস । আমাদের এখানে স্ট্যালিনের রুবল খেয়ে অনেক বাঙালি কর্নওয়ালিসের জমিদারি আরম্ভ করে দিলে, কেজিবির দপতরে তাদের নাম-সাকিন দেখেছি, আমার কাছে তার তালিকা আছে।

        তা চলে এলে কেন ? অনেকে তো রাশিয়ান ভাষায় বাংলা লিখে প্রচুর পয়সা কড়ি করে ফিরেছে। সেসময়ে ডবকা-উরুর রুশ মেয়েদের অবশ্য সঙ্গে আনতে পারেনি, এখন তো রুশ মেয়েরা নিজেরাই পাকাপাকি বর বা সাময়িক বর খুঁজতে এদেশে আসছে, ডবকা উরু দেখাতে আর কোনো লজ্জা নেই তাদের ।

         আমি কুন্দনন্দিনীর জন্যে বেঁচে আছি । কতোকাল হয়ে গেল খুঁজে পাচ্ছি না কুন্দনন্দিনীকে । খরগোশ, হরিণ, ঘোড়া, কুমির, ষাঁড়ের মতন জানোয়ারি করেও খুঁজে পেলুম না, আরও জানোয়ার হয়ে চলেছি, জানোয়ারেরা আরও বেশি-বেশি জানোয়ার হয়ে চলেছে । আমি যেকোনো মেয়েকে কুন্দনন্দিনী বানিয়ে ফেলতে পারি, কিন্তু তার ভেতরটা বানাতে পারব না, যাকে ভালোবাসবো তার ভেতরটাই তো আসল ।

         অধ্যাপক চক্কোত্তি, হতাশা মেশানো গলায় বললে, তুমি স্ট্যালিন হলে আমার ব্যবসা লাটে উঠিয়ে আমাকেই কোতল করে দিতে ; ভাগ্যিস স্ট্যালিনের যুগ গিয়ে আবার তুঘলকের যুগ ফিরে এসেছে, সোনার টুকরো ছেলেদের রাতারাতি গাধার চামড়ার টুকরোয় গড়া ছেলে বানিয়ে ফেলা হচ্ছে, তারা নিজেরাই গাধা কিংবা খচ্চরের চামড়ায় গড়ে ফেলছে নিজেদের, এ একেবারে স্বর্ণযুগ, স্বর্ণযুগ, বুঝলে নগেন, বলছি কেন যে পারফরমিং ফ্লেশ হল উন্নততম শিল্প, আদি শিল্প বলে গেছেন রসশাস্ত্রীরা । এই শিল্প ছাড়া তো অন্য কোনো শিল্পের কথা শুনিনা ।

         তা বটে, বললেন নগেন দত্ত ।

         অধ্যাপক চক্রবর্তী, অধ্যাপকের ক্লাস নেবার ঢঙে বললে, দ্যাখো, একদিক থেকে সোভিয়েত দেশ ভেঙে গিয়ে ভালো হয়নি, আমার মার্কেটে নতুন নতুন কমপিটিটর এসে পড়েছে, ফর্সা চামড়া, ঢ্যাঙা ঠ্যাং, লাল-টুকটুকে ঠোঁট, উঁচু বুক, গোলাপি বোঁটার মেয়েরা, এসটোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, রোমানিয়া, আজারবাইজান, আরমেনিয়া, জর্জিয়া, ইউক্রেন, মলডোভা থেকে ।

         টেবিলের ওপর থেকে ঝোলাটা ড্রয়ারে ঢুকিয়ে অধ্যাপক চক্কোত্তি বললে, এখন আপকানট্রির ক্লায়েন্টদের হাতে ঠিকেদারির আর দিল্লিঘুষের দেদার কাঁচা টাকা, তারা এই মেম মেয়েদেরই পছন্দ করছে আজকাল, সেই জন্যেই তো আমি এপার বাংলা আর ওপার বাংলা ছাড়া আমার গ্যালারিতে অন্য আইটেম রাখি না, কেননা আপকান্ট্রির পুরুষরা বাঙালি মেয়েদের পেলে সব কিছু ভুলে যায় । ওসব ফর্সা মেমদের সঙ্গে সেলফি তোলাতে হলেও হাজার টাকা লাগে, বিয়েতে নাচাতে হলে আরো বেশি, শুতে লাগে এক থেকে দেড় লাখ ; আমার মেয়েদের সঙ্গে সেলফি তোলাতে হলে প্রথমে ক্লায়েন্ট হতে হয়, তারপর যতো ইচ্ছে সেলফি তোলো, ব্ল্যাকমেইলিঙের পাল্লায় পড়লে তার দায় ক্লায়েন্টের ।

         নগেন দত্ত বললেন, দ্যাখো, কুন্দনন্দিনীকে যদি পদ্মিনী হিসেবে পাই তাহলে বেশ হয়, কিন্তু ভারত মুকুজ্জে বলেছে যে তাদের অকুস্হলে লোম থাকে না, সেখানে লোম না থাকাটা যেন কেমন বিসদৃশ, নয়কি !

         চিন্তা নেই তোমার, বললে প্রফেসার চক্কোত্তি, যাত্রাদলের অভিনেত্রীরা ট্রেনিং দিচ্ছে কেন, এই অভাব পুরণের জন্যেই তো ! যাদের বগলে আর কুঁচকিতে যথেষ্ট লোম নেই, গ্রাহক চাহিদা অনুযায়ী আমরা স্পিরিটগাম দিয়ে সাময়িকভাবে নকল চুল বসিয়ে দেবার ব্যবস্হা করেছি, আদারওয়াইজ লোম কারোরই রাখা হয়নি, পদ্মিনী, শঙ্খিনী, চিত্রিনী আর হস্তিনী, যারই বলো, লেজার ট্রিটমেন্ট করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে ।

        —আচ্ছা, সেকারণেই  সিঁড়ির দেয়ালে ‘বিইং অ্যান্ড নাথিংনেস’ দুটোই দেখলুম লোমহীন ।

        অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল অধ্যাপক চক্রবর্তী, নগেন দত্তকে জিগ্যেস করলে, কতো টাকা নিয়ে ঘোরো তোমার অ্যাটাচি কেসে, এমন পাড়ায় যাতায়াত করো, কখন ছিনতাই হয়ে খুন হয়ে যাবে, সাবধানে চলাফেরা করা উচিত, তার ওপর একটু আগেই শিলাবৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে ।

        শিলাবৃষ্টি এই এক্ষুনি বন্ধ হয়ে গেছে, বলার পর, নগেন দত্ত অ্যাটাচির মুখ অধ্যাপক চক্রবর্তীর দিকে ঘুরিয়ে বোতাম টিপতেই খুলে গেল, আর দেখা গেল তাতে রাখা রয়েছে একটা ফেডেড জিনস, লাল রঙের টিশার্ট, জগিং করার জুতো-মোজা, খাপে গোঁজা কাগজপত্র ।

        টাকা মেটাবে কেমন করে ? জানতে চাইলে উদ্বিগ্ন অধ্যাপক, আমার গ্যালারিতে চার্জ সবচেয়ে বেশি জানো তো , তোমার ট্যাঁক তো ফাঁকা দেখছি ।

        নগেন দত্ত অ্যাটাচি কেস বন্ধ করে আরেকবার খুলে দেখালেন যে একহাজার টাকার চল্লিশটা প্যাকেট রাখা । দেখে, পঁচাত্তর বছর আগের ভীতি ফিরে এলো অধ্যাপক চক্রবর্তীর মগজে, বললে, দাঁড়াও অনেকক্ষণ হিসি চেপে আছি ।

       ঘরের লাগোয়া ওয়াশরুমে পেচ্ছাপ করতে দৌড়ুলো চক্কোত্তি প্রফেসর, আধ ঘন্টা লাগল ওনার ব্লাডার খালি হবার ধারার আওয়াজ বন্ধ হতে ।

        অথচ নিজের ঘরে ফিরলো  না অধ্যাপক মশায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *